#প্রাচীন_সপ্তাশ্চর্যের_খোঁজ (১৩৫-শেষ কিস্তি)অন্তিম অধ্যায় - সপ্তম অভিযান*দ্যা গ্রেট পিরামিড* [১-১৪]প্রতিম দাস০০০০০০০০০০০০০
অন্তিম অধ্যায়
সপ্তম অভিযান
*দ্যা গ্রেট পিরামিড*
০০০
গিজা, ইজিপ্ট
২০শে মার্চ, ২০০৬
টারটারাসের দিন
০০০০০
**গিজার অতি বিশাল পিরামিড**
সম্ভবত এটাই এ পৃথিবীর একমাত্র
স্থাপত্য যার নাম মোটামুটি ভাবে সব মানুষ জানে।
গ্রেট পিরামিড।
একটা ভুল ধারনা আছে সাত
আশ্চর্যের এই অন্যতম আশ্চর্যটার সম্বন্ধে । প্রায় সকলেই ভাবেন তিনটে পিরামিডের
সমন্বয়ে এদের একত্রে গ্রেট পিরামিড বলা হয় ।
ব্যাপারটা মোটেই তা নয় ।
কাছেই থাকা খাফ্রে আর মেনকাঊরের
পিরামিড দুটোও অসাধারন দুই স্থাপত্য কিন্তু গ্রেট নামে পরিচিত একটাই পিরামিড । আর
সেটা খুফুর [বা চিওপ্সের । গ্রীকরা এই নামেই ডাকতো ।]। এই একটা পিরামিডকেই আশ্চর্য
বলে বিবেচনা করা হয় ।
এক কথায় বলতে হলে একে বলতে হবে
একে দেখা এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা ।
শুধু মাপের কথা চিন্তা করলেই
মাথা ঘুরে যায় । ১৩৭ মিটার উঁচু। ভিত্তির প্রত্যেকটা দিক ১৪০ মিটার করে লম্বা । এর
সাথে হারিয়ে যাওয়া ক্যাপস্টোনের – হারিয়ে
গিয়েছিল মহাকালের পাতায়- উচ্চতা যোগ করা হলে সঠিক মাপের ভারসাম্যটা ফিরে আসে ।
উচ্চতাও হয়ে দাঁড়ায় ১৪০ মিটার ।
ওজন ২মিলিয়ন টনেরও বেশী । এত
ওজন সত্বেও এই বিশাল স্থাপত্য আজ ও খাড়া হয়ে আছে নানান অসাধারন প্যাসেজ ওয়ে সহ ।
সমগ্র ব্যাপারটা এতোটাই নিখুঁত ভাবে বানানো হয়েছে যে সমস্ত বিশ্বাস যেন কোথায়
হারিয়ে যায়।
এটা দাঁড়িয়ে থেকেছে আপন মহিমায়
...একের পর রাজা...ফ্যারাও এসেছেন চলে গেছেন ... ঘটেছে একাধিক উপজাতি যুদ্ধ...
দুটো বিশ্বযুদ্ধ... আঘাত হেনেছে ভুমিকম্প... আছড়ে পড়েছে বালুঝড় ... তবুও আজ ও
স্বমহিমায় বর্তমান।
পিরামিডের উপাসক ভক্তরা বলেন , বিশ্বাস করেন, এর এক অসীম ক্ষমতা আছে । বলা হয়ে থাকে কোন রকম ব্যাক্টেরিয়া নাকি গ্রেট
পিরামিডের ভেতরে জন্মাতে পারে না । বলা হয় এর ভেতরে ফুলের গাছ বেড়ে ওঠে অতিরিক্ত
অবাক করে দেওয়া উচ্ছলতার সাথে। আরথারাইটিস এবং ক্যান্সার সারানোর ক্ষমতা নাকি আছে
এর অভ্যন্তরে ।
যে যাই বিশ্বাস করুক, কিছু একটা ক্ষমতা আছেই মানব নির্মিত এই পাহাড়ের যা মানুষকে
এর কাছে টেনে নিয়ে আসে। হাতছানি দেয় ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। গ্রেট পিরামিড হারিয়ে
দিয়েছে সময়কে । হারিয়ে দিয়েছে সমস্ত কল্পনাকে । আজ অবধি জানা সম্ভব হয়নি কিভাবে
বানান হয়েছিল এই সুবিশাল মহাকায় স্থাপত্য ।
ইতিহাসের একমাত্র মানব নির্মিত
স্থাপত্য যা একসাথে প্রকৃতি এবং সময়ের সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে । একমাত্র আশ্চর্য
সেই সাতটি প্রাচীন আশ্চর্যের যাকে আজ আমরা নিজেদের চোখে দেখতে পাই ।
সারা বিশ্বে একামাত্র জিনিষ যার
কোন তুলনা নেই ।
০০০০০
দ্যা গ্রেট পিরামিড
গিজা [কায়রোর বাইরের স্থান]
ইজিপ্ট
২০সে মার্চ, ২০০৬, সকাল ১১টা
টারটারাসের দিন
০০০০
খুফুর গ্রেট পিরামিড কায়রোর বহিরাঞ্চলে সম্রাটের মতো মাথা তুলে
দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র দৃশ্যপট জুড়ে।
৪৫০০ বছর বাদে মানুষের দ্বারা
বানানো স্কাই স্ক্যাপারগুলোকে ওর পাশে নেহাতি শিশু বলে মনে হচ্ছে । কায়রোর নদী উপত্যকা যেখানে
পশ্চিমের মরুভূমিকে স্পর্শ করেছে ঠিক সেই বিন্দুতে এর অবস্থান। এই উচ্চ এলাকাটির পরিচয় গিজার
অধিত্যকা বা গিজা প্ল্যাটু নামে।
ওর দুপাশে খাফ্রে আর মেন কাউরের পিরামিড – অবশ্যই দর্শনীয় কিন্তু খুফুর কাছে বাচ্চা সমান। এদের সামনে
থাবা পেতে অনন্তকালীন পাহারায় বসে আছে রহস্যময় স্ফিংস ।
এখন প্রায় মধ্য দুপুর । সূর্য
উঠে গেছে গোলাকৃতি চলনপথের সর্ব উচ্চ স্থানে। খুব গরম এই মুহূর্তে - খুব, খুব গরম – কায়রোর পক্ষে
ও ...৪৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস ...ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে ।
পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে সংবাদ
পাওয়া যাচ্ছে সব জায়গায় আবহাওয়া অত্যন্ত উষ্ণ । চীন, ভারত এমন কি রাশিয়াতেও – সব জায়গা থেকেই অতিরিক্ত মাত্রার গরমের খবর আসছে । তাপমাত্রার অত্যধিক
বৃদ্ধিতে অনেক জায়গায় মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ছে।
কিছু একটা গণ্ডগোলতো হচ্ছে
কোথাও।
টিভির কমেন্টেটর বললেন , এই কিছু একটা করতেই হবে সূর্যের তাপ কমানোর জন্য । আবহাওয়াবিদরা
জানালেন এক সৌর কলঙ্কর আবির্ভাব নাকি এর কারন।
ইউনাইটেড স্টেটসে, সকাল বেলার সব
খবরের আলোচনায় একটাই বিষয় বস্তু । সকলের নজর এখন হোয়াইট হাউসের দিকে। সকলেই
অপেক্ষা করছে প্রেসিডেন্টের বিশেষ ভাষন শোনার জন্য।
কিন্তু এরকম কোনো ভাষন প্রচারিত
হল না।
হোয়াইট হাউস রহস্যজনক ভাবে চুপ
করে আছে।
ওদিকে কায়রোতে ইজিপশিয়ান সরকার
আমেরিকান সেনাদলকে যতটা সম্ভব সাহায্য করছে।
গোটা গিজা অধিত্যকায় আজ সারা
দিনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে পর্যটক এবং
সাধারন মানুষের প্রবেশ – সব প্রবেশপথ
পাহারা দিচ্ছে ইজিপশিয়ান সেনা – শেষ রাতে
জুডার পাঠানো একদল আমেরিকান সেনা কাজ করছে প্রাচীন স্থাপত্যটির এলাকায়।
জুডা সকালে যখন লাক্সরে ছিল সেই সময়ে ওর পাঠানো দল তাদের কাজ করে
ফেলেছে । এখন জুডার আসার অপেক্ষা । ওদের
কাজ ছিল, এক অতিকায় ভারা নির্মাণ করা।
সেই ভারা এখন ঘিরে আছে গ্রেট পিরামিডটাকে।
তিনতলা উঁচু...কাঠের পাটাতন
দেওয়া বিশাল প্ল্যাটফর্ম ঘিরে রেখেছে পিরামিডের একেবারে ওপরের অংশটাকে । দেখে মনে
হচ্ছে একটা বিরাট মাপের হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং প্যাড। আকারে বর্গাকার । এক একদিক ৩০
মিটার চওড়া । ছাদের খোলা অংশটা পিরামিডের একেবারে ওপরের সমতলস্থানের সাথে আনুভূমিকভাবে
সমান্তরাল। অবশ্য পিরামিডের সেই অংশটা
কাঠ দিয়ে ঢাকা নেই...ওখানেই জুডা স্থাপন করবে ক্যাপস্টোনটাকে এবং পালন করবে
প্রয়োজনীয় প্রথা ।
সিঁড়ির ধাপের মতো জিনিষ প্ল্যাটফর্মটাকে উলম্ব ভাবে খাড়া
রেখেছে । ওর সাথেই সংযুক্ত আছে দুটো ক্রেন
। মুখ আকাশের দিকে । ওর ভেতরে বাস্কেট আসনে সিয়েফ সেনারা তৈরী স্টিঙ্গার মিসাইল আর
অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট গান নিয়ে।
অর্থাৎ প্রথা পালনের অনুষ্ঠান
ব্যাহত করার সুযোগ কেউ পাবে না ।
ঘড়ির কাঁটা ঠিক ১১ টার ঘরে
পৌছাতেই মার্শাল জুডা, গোল্ডেন ক্যাপস্টোনের
সাতটি টুকরো সহ সি এইচ-৫৩ই সুপার
স্ট্যালিয়ন হেলিকপ্টারে করে এসে গেল। ক্যাল কালিসের নেতৃত্বে ১২ জন সিয়েফ সেনা
ঘিরে আছে ওকে । সঠিক স্থানে, গ্রেট পিরামিডের ওপরে, টুকরোগুলোকে সাজিয়ে রাখার সময় এসে গেছে।
সুপার স্ট্যালিয়নটা হাওয়ার ঝড়
তুলে ভেসে থাকলো প্ল্যাটফর্মের ওপর । এক এক করে চাকা ওয়ালা ট্রলিতে করে
নামানোঠলো মূল্যবান টুকরোগুলোকে ।
তারপরে সিয়েফ সেনা পরিবৃত
পাহারায় নেমে এলো জুডা । সাথে আলেকজাণ্ডার আর লিলি ।
নেমে এলেন উইজার্ড । সাথে ডেল
পিয়েরো । হ্যান্ড কাফ বাঁধা এবং অবশ্যই সেনাদের নজরবন্দী হয়ে । জুডা এদের সাথে করে
নিয়ে এসেছে শুধু মাত্র ওদের বিরুদ্ধে নিজের বিজয় যাত্রার শেষ অংশ দেখানোর জন্য ।
জো, ফাজি এবং স্ট্রেচ [
শেষ জনকে এদের সাথে রেখেছে জুডা, লিলিকে সবার
সামনে এনে দেখানোর পরেই] কে আর একটা হেলিকপ্টারে – ব্ল্যাক হক- করে নিয়ে এসে নামানো হয়েছে গ্রেট পিরামিডের নিচে ভিত্তিস্থলে।
এদেরকে আনার কারন লিলিকে নিয়ন্ত্রনে রাখা । জুডা বলেই দিয়েছে লিলিকে বেগড়বাঁই করার
চেষ্টা করলেই এক এক করে মেরে ফেলা হবে ওদের তিনজনকে ।
০০০০০
হেলিকপ্টারে চেপে কায়রো থেকে
পিরামিডের কাছে আসার সময়ের ছোট্ট সফরটায় লিলির পাশে বসেছিল আলেকজান্ডার। দুজনের
মধ্যে সামান্য যে কথাবার্তা হয় তা এরকম –
‘হাই, আমি লিলি ।’
আলেকজাণ্ডার আড়চোখে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে থাকে লিলির দিকে। সম্ভবত চিন্তা করে উত্তর দেবে নাকি দেবে না। তারপর বলে, ‘আমার নাম আলেকজান্ডার ... তুমিতো আমার ছোটো বোন।’
‘ছোটো বোন? মোটেই না । মিনিট কুড়ির পার্থক্য আমাদের জন্মের সময়ে, ’ লিলি হাসি মুখে বললো।
আলেকজাণ্ডার বললো, ‘তাতে কিছু যায় আসে না । আমিতো আগেই জন্মেছি তাই নয়কি। যে
আগে জন্মায় সে কিছু বিশেষ সূ্যোগ পায়। যেমন ধরো রেসপেক্ট।’
‘আমি বাজি ধরতে পারি যে তুমি
মাঝে মধ্যে দৈনন্দিন কাজকর্মে করার সময় ফাঁকিটাকি দিতে ভালোই বাসো।’
ছেলেটি অবাক হয়ে বল লো, ‘দৈনন্দিন কাজকর্ম মানে?’
‘মানে আবার কি?’ লিলি আর বেশি অবাক হওয়ার সুরে বললো। ‘দৈনন্দিন কাজকর্ম মানে জানোনা। ওই ধরো বাসনটাসন ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদি।’
‘আমি কখনো একটা ডিসও ধুইনি আমার জীবনে।
ঘর পরিষ্কার! এসব কাজ আমার জন্য নয়।’
‘তুমি আজ অবধি এই ধরনের কাজ করোই
নই !’
লিলি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো । ‘উও! ইউ আর লাকি ! দৈনন্দিন কাজকর্ম করতেই হয়নি ...’
আলেকজান্ডার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে
বললো,
‘ তুমি ওই সব কাজ করতে কেন? তুমি উচ্চবংশ জাত । ওই সব কাজ সাধারন মানুষেরা করে । তুমি
কেনই বা নিজে ওই সব করেছো কেন সেটাই বুঝতে পারছি না।’
লিলি ঘাড় উঁচু করে না বোঝার
ভঙ্গি করলো । আসলে সে এরকমভাবে ভাবেইনি কোনো দিন। ‘ আমার মনে হয়... যাকগে ... আমার ওই সব কাজ করতে ভালো না লাগলেও আমি করেছি কারন, আমি চেয়েছি আমার পরিবারকে সাহায্য করতে। পরিবারের অংশ হতে।
কাজের চাপ কমাতে।’
‘কিন্তু তুমি তো ওদের থেকে অনেক
উঁচু মানের মানুষ । তোমার দরকারটা কি ওইসব সাধারন মানুষদের সাহায্য করার?’
‘আমি ওদের সাহায্য করতাম ...কারন, আমি ...আমি ওদের ভালোবাসি ।’
‘ওহো, ডিয়ার সিস্টার । আমাদের জন্ম হয়েছে এই সব মানুষদের শাসন
করার জন্য । সাহায্য করার জন্য নয় । ওরা তোমার পায়ের তলায় থাকার যোগ্য, ওরা শাসিত হওয়ার জন্য জন্মেছে।’
লিলি জোর দিয়ে বললো, ‘ওরা আমার পরিবার ।’
‘শাসন করতে হলে একা হতে হয়,’ আলেকজান্ডার এমনভাবে কথাটা বললো যাতে বোঝা গেল এই কথাটা সে
এর আগে অনেক অনেকবার শুনেছে। ‘ডিয়ার সিস্টার
আমি চাই তুমি মানসিকভাবে আমার মতো শক্ত হবে।’
লিলি এর পর আর একটাও কথা বলেনি
। কয়েক মিনিট বাদেই ওরা নেমে আসে গ্রেট পিরামিডের ওপরে।
টারটারাসের দিন । সময় ঘড়িতে
১১টা বেজে ৩০ মিনিট। আর তিরিশ মিনিট বাদেই সূর্যের ঝাঁঝালো সৌর কলঙ্ক তার ঘূর্ণন
পথে একে বারে পিরামিডের মাথার ওপরে উপস্থিত হবে। এক বিশেষ প্রথা পালন হবে গিজার
পিরামিডের চুড়ায় । এক এমন প্রথা পালনের অনুষ্ঠান যা গত ৪৫০০ বছরে একবারের জন্য
পালিত হয়নি ।
প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে জুডা
সবার আগে নিজেকে একটা সেফটি রোপ দিয়ে বেঁধে নিলো । উচ্চতা ওর কাছে চিরকালই একটা
ভয়ানক রকমের আতঙ্কের ব্যাপার।
গ্রেট পিরামিডের ফাঁকা অংশটার
দিকে তাকালো জুডা । প্রাচীন এক কবিতা খোদিত আছে ওখানে –
“ওহে মানবের দল, তোমরা যারা ভয়ের চাপে অতীষ্ঠ, হতাশা
গ্রস্থ... ভুলে যেও না যিনি ক্ষমতা দেন তিনি সে ক্ষমতা কেড়েও নিতে পারেন...
সেই আশঙ্কা থেকেই বেনবেনকে
রাখা হয়েছে এক অতি পবিত্র স্থানে, এক অতি পবিত্র ভুমি্তে, এক অতি পবিত্র উচ্চতায় ... যখন সাত সূর্যাস্ত
শেষে মহান রা’য়ের বানী প্রচারক এর আবির্ভাব হবে... সপ্তম দিনের চরম মুহূর্তে মহান
রা’য়ের ক্ষমাহীন বিধ্বংসী অগ্নিশিখা সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে আমাদের সবাইকে
গ্রাস করবে...”
খোদাই করা লেখাটার পাশে পাথরের
ঠিক মাঝখানে একজন মানুষের অবয়ব খোদাই করা আছে । যার মাথাটা প্রকৃতির অত্যাচারে
ক্ষয়ে গেছে অনেকটাই । তবু চিনতে অসুবিধা হয়না ...আনুবিসকে। পাতাল জগতের ভয়ঙ্কর
দেবতা শেয়ালমস্তকধারী আনুবিস ।
আনুবিসের হৃদয়ের অবস্থান
যেখানে - সেটা ওপরের এই বর্গাকার স্থানের
একেবারে মধ্যবিন্দু অর্থাৎ এই পিরামিডেরও মধ্য বিন্দু - সেখানে
দেখা যাচ্ছে একটা টেনিস বলের আকারের গোলাকার গর্ত । মনে হচ্ছে যেন একটা পাথরের
বাটি ।
জুডা জানে ওই গোল গর্তের মতো পাথরের
খাঁজ আসলে কি। নাজি প্রত্নতত্ববিদ , হেসলারও সেটা জানে ।
*শক্তিলাভের আচার প্রথা*
“রা’য়ের সর্ব উচ্চ আসনে,
বলিপ্রদত্ত নির্বাচিতর হৃদয়ের
নিচে
যে শুয়ে আছে প্রতিহিংসাকামী
আনুবিশের হাতের ওপর,
ঢেলে দাও মৃত্যুর দেবতার হৃদয়ে
তোমার মাতৃভূমির কিছু পরিমাণ
[ডেবেন] মাটি
পাঠ করো সেই শয়তানী শব্দ গুলো
তাহলেই এ জগতের সমস্ত ক্ষমতা
হয়ে যাবে তোমার
এক হাজার বছরের জন্য”
“ঢেলে দাও মৃত্যুর দেবতার হৃদয়ে
তোমার মাতৃভূমির কিছু পরিমাণ
[ডেবেন] মাটি...”
ডেবেন প্রাচীন ইজিপ্টের মাপের
একক । এক ডেবেন মানে ৯৩ গ্রাম । জুডা জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কাঁচের ভায়াল বার
করলো । বাদামী রঙের মাটি ভরা আছে ওটার ভেতরে। এ মাটি সংগ্রহ করা হয়েছে ইউনাইটেড
স্টেটসের ভেতরে অবস্থিত উটাহ মরুভূমি থেকে – এ এক অনন্য সাধারন জিনিষ আমেরিকার তরফে।
জুডা ঠিক ৯৩ গ্রাম মাটি ঢেলে
দিলো ওই বাটির ভেতরে । এক ডেবেন।
তাকিয়ে থাকলো গর্বের চোখে
কিছুক্ষন তার পর হাঁক দিলো, ‘জেন্টলমেন !
ক্যাপস্টোন সাজাও!’
একটার পরে একটা , জুডার দলের লোকেরা
শুরু করলো গোল্ডেন ক্যাপস্টোন সাজানো।
সবচেয়ে বড় টুকরো – বাতিঘরের টুকরো – রাখা হল সবার প্রথমে । পিরামিডের মাথায় খোদাই করা আনুবিসের মূর্তিটা নিখুঁত
ভাবে ঢুকে গেল টুকরোটার তলায় একই রকম আনুবিসের
মূর্তির এনগ্রেভ করে রাখা ফাঁকা
স্থানে ।
পিরামিডের ওপরের বর্গাকার অংশের
একদিকে একটি নিচু চ্যানেলের মতো অংশ খোদাই করা আছে । ক্যাপস্টোন সেট করার পর ওই
স্থানে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যেতে পারবে ‘নির্বাচিত উৎসর্গ জন’ – যে কোনো একটি
শিশু –
চরম সময় উপস্থিত হলে ওই নির্বাচিত জনকে থাকতে হবে ভেতরে।
একটা করে টুকরো সাজানোর সাথে
সাথে ক্যাপস্টোনটির আকার পরিষ্কার হচ্ছিল।
অসাধারন তার সৌন্দর্য – ঝকমক করছে – বিচ্ছুরণ হচ্ছে শক্তির – এক অতিবিশাল
স্থাপত্যের ওপর বসানো হচ্ছে তার সোনার মুকুটটিকে।
এর সাথেই প্রতি ক্যাপস্টোনের
টুকরোতে থাকা স্ফটিকের সারি এক সারিতে সমাবদ্ধ হচ্ছে আনুবিসের হৃদয়ের সাথে ।
চকচকে চোখে উৎসাহের চরমে পৌছে
পুরো কাজটির তদারক করছে জুডা ।
সব শেষে পিরামিড আকৃতির টুকরোটা
এলো । যা আজ সকালেই উদ্ধার করা হয়েছে আলেকজান্ডারের সমাধি থেকে ...
... প্রায় পাঁচ সহস্রাব্দের ভেতরে এই প্রথম বার সম্পূর্ণ ক্যাপস্টোন
সাজান হলো ।
আবার একবার মানুষের চোখের সামনে
সম্পূর্ণ গিজার পিরামিড । ২৫৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর এই প্রথম ।
ঘড়িতে সময় এখন ১১টা বেজে
৫০মিনিট ।
আর দশ মিনিট বাকি টারটারাসের
ঘূর্ণন কাল সমাগমের ।
০০০০০
জুডা এবার তাকালো লিলি আর
আলেকজাণ্ডারের দিকে।
‘এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবার
আমাকে নিতে হবে,’ বললো । ‘কাকে বেছে নেবো, এই মহান কাজে সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার জন্য...’
‘উৎসর্গ?’ আলেক জান্ডার ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো । ‘কি বলতে চাইছেন আপনি?’
‘এর জন্যেই তো তোমার জন্ম হয়েছিল, ইয়ংম্যান,’ জুডা বললো। ‘এই কাজ করার জন্যই এ পৃথিবীতে তুমি জন্ম নিয়েছো ।’
আলেকজান্ডার হতভম্ব ভাবে ডেল
পিয়েরোর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি পৃথিবীতে
এসেছি শাসন ক-’
জুডা কথার মাঝেই বলে উঠলো, ‘আমি যদি ভুল না করি তাহলে তোমাকে ভুল বোঝান হয়েছে । তোমাকে
যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখার আসল কারন থথের
শব্দাবলী পাঠ করা এবং ফাদার ডেল পিয়েরো এবং তার সঙ্গীদের অনন্ত লাভের পথ প্রশস্ত
করে দিতে আজকের এই মুহূর্তে বলি দেওয়ার জন্য ।
আমি নিশ্চিত তোমার মৃত্যুর পর ওরা সান্তনা প্রাপ্তি রুপে তোমার পূজা অর্চনা করবেন। আহারে ফাদার ডেল পিয়েরো বুঝি এই কথাগুলো
তোমাকে এর আগে বলেন নি ।’
আলেকজান্ডার গনগনে রাগে ভরা
চোখের দৃষ্টিতে ডেল পিয়েরোর দিকে তাকালো ।
লিলি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, মাথা নিচু ।
‘তাহলে, কাকে বেছে নেবো?’ জুডা বেশ মজা পাচ্ছিলো ।
লিলিকে দেখিয়ে আলেকজান্ডার বললো, ‘একে! ও জানেও না ওর নিজের অবস্থান বা গুরুত্ব। আমি জানি।’
জুডা হাসলো এটা শুনে । ‘তাই বুঝি?’ একটু থেমে বললো, ‘না , ডিয়ার । আমার ওই
মেয়ের আচরণ ভালো লেগেছে । চুপচাপ শান্ত তোমার মতো বাচাল নয় । এই জন্য তোমাকেই
উৎসর্গ করা হবে।’
বলেই আলেকজান্ডারকে ঝপ করে তুলে
নিলো দুহাতে । ঠেলে ঢুকিয়ে দিলো মাথার দিকটা ক্যাপ স্টোনের তলায় পাথরের চ্যানেলের
ভেতর । তার পর বন্দুকের নল ঠেকিয়ে বাধ্য করলো হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে
। সেটাই করলো ছেলেটা। ঢুকল এবং শুয়ে পড়লো
আনুবিসের হাতের ওপর । এই মুহূর্তে ওর হৃদপিণ্ড সাতটা টুকরোর স্ফটিক সারির ঠিক তলায়
। আর তার তলায় বাটির মতো স্থানে আমেরিকার মাটি ।
ছেলেটি চিৎকার করে কাঁদছিল।
১১টা বেজে ৫৫মিনিট, জুডা নির্দিষ্ট
স্থানে গিয়ে দাঁড়ালো ।
হাতে তুলে নিলো শক্তি আরোহণের
প্রথার মন্ত্র – যা ও লিখে নিয়েছে লাইন বাই লাইন ক্যাপস্টোনের সাতটা টুকরোর গা
থেকে ।
সকলে তৈরী হও মূল অনুষ্ঠানের
জন্য! আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!’
আর ঠিক এই সময়ে উত্তর দিকের
ক্রেন বাস্কেটে বসে থাকা এক সিয়েফ সদস্য
পূর্ব আকাশে দেখতে পেলো একটা কালো ফুটকি...
দেখে মনে হচ্ছে যেন প্লেনের মতো কিছু একটা ...ধেয়ে আসছে দ্রুত
গতিতে...নিচের দিকে।
একটা ৭৪৭ ...কালো রঙের ।
হ্যালিকারনাসসাস।
সুপারসনিক গতিতে হ্যালিকারনাসসাস
নিচের দিকে মুখ করে এগিয়ে আসছিল। বিমানে সংযুক্ত সবকটা বন্দুকের নল সামনের দিকে
তাক করা ।
স্কাই মনস্টার উত্তেজিত ভাবে
চেঁচিয়ে উঠলো ,’ইইইই-হা! নরকের কীটের দল এসে গেছি তোদের শিক্ষা দিতে ! পুহ বিয়ার
রেডি তো – চলো ওদের তুরকিনাচন দেখিয়ে দাও দেখি!’
বিমানের বাম দিকের ডানার সাথে
যুক্ত গান ট্যারেটের দায়িত্বে বসে থাকা পুহ বিয়ার বললো, ‘নরক গুলজার কাকে বলে এবার
টের পাবে ওরা ।’
‘আশা করছি উইজার্ডের কারিগরি
ব্যবস্থা আমাদের এই খেলায় জয় লাভ করতে সাহায্য ক্রবে...তানা হলে কিন্তু বিরাট বিপদ
অপেক্ষা করে আছে আমাদের সামনে,’ বললো স্কাই মনস্টার । ‘ধ্যাত তেরে কি! আক্রমণ শুরু
হয়ে গিয়েছে!’
আমেরিকানরা দুটো স্টিঙ্গার মিসাইল
ছেড়ে দিয়েছে আগত ৭৪৭ টাকে লক্ষ্য করে।
মিসাইল দুটো গ্রেট পিরামিডের
ওপর থেকে আরো ওপরে উঠে আসছে ...ধেয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে নেমে আসা জাম্বো জেটটার
দিকে। অবশ্য দুটোকেই নষ্ট করে দিলো পুহ বিয়ারের দক্ষতা। একটা ধ্বংস হল চ্যাফ বোমের
আঘাতে । আর অন্যটাকে শেষ করলো, ১৯৯০ সালে ইরাকের সেনাদের জন্য বানানো ফরাসী
প্রযুক্তির, ইন্টার সেপটার মিসাইল... এফ
ভি-৫এক্স হামিং বার্ড। শেষেরটাকে বানানোই হয়েছিল স্টিঙ্গার মিসাইল ধ্বংস করার
জন্য। হ্যালিকারনাসসাসকে যখন ওয়েস্ট চুরি করে তখন ওটাতে ১০টা একেবারে তাজা হামিং
বার্ড লাগানো ছিল।
এবার আমেরিকানরা ক্রেন থেকে
শুরু করলো অ্যান্টি এয়ারক্যাফট হামলা ।
ট্রেসার বুলেট ছিটকে গেল আকাশে
– আকাশ ঢেকে গেল বলা যায় – কিন্তু নিপুনভাবে হ্যালিকারনাসসাসকে ওসবের থেকে বাঁচালো
স্কাই মনস্টার । সাথে সাথেই পুহ বিয়ার একটা হেলফায়ার এয়ার-টু-গ্রাউন্ড মিসাইল দাগলো
ওদের দিকে।
৭৪৭ এর পেটের তলা থেকে হেলফায়ার
ছিটকে ঘুরতে ঘুরতে নেমে গেল একটা আমেরিকান
ক্রেন লক্ষ্য করে এবং-
-সোজা গোঁত্তা মারলো ওটার গায়ে
।
কয়েক লক্ষ টুকরো হয়ে ক্রেনসহ
সেনারা বিদায় নিলো এ ধরাধাম থেকে।
বিস্ফোরণের শব্দে জুডা সহ বাকি
সকলে ঘুরে তাকালো ।
অন্য ক্রেনটা থেকে
হ্যালিকারনাসসাসকে উদ্দেশ্য করে গুলি চালনা থামেনি। হাজার রাউন্ড এ এ বুলেট ধেয়ে
গেছে ওপরের দিকে। সাথেই আর একটা স্টিঙ্গার মিসাইল। সেটাও লক্ষ্য ভেদ করতে পারেনি
পুহ বিয়ারের তৎপরতায়।
স্কাই মনস্টার চিৎকার করে বল
লো, ‘পুহ! তৈরী থাকো ! আমরা শেষ কাজটা করতে যাচ্ছি!’ নিজেকে ফিসফিস করে বললো, ‘হে
ঈশ্বর, উইজার্ড যেন সেটআপটা ঠিক মতো ...’
হ্যালিকারনাসসাস গিজার
অধিত্যকার দিকে নেমে আসছিল আঊট-অফ-কন্ট্রোল একটা মিসাইলের মতো । স্কাই মনস্টার
বিমানের নাকটা সামনের দিকে সামান্য ওঠালো এবং সব কটা থ্রাস্টারকে ঠেলে দিলো পেছনের
দিকে... হ্যালিকারনাসসাসকে হঠাৎ করেই ইচ্ছাকৃতভাবে একটা পজিশনে নিয়ে এলো ...এই
মুহূর্তে ওটা যেন একটা ঘোড়ার মতো ভঙ্গীতে এগিয়ে যাচ্ছে পেছনের পায়ের ওপর
দাঁড়িয়ে...মাথা সামনের দিকে ওঠানো ...লেজ নেমে আছে পেছনে ...
...এবার স্কাই মনস্টার জোরে
একটা শ্বাস নিয়ে বিমান নিয়ন্ত্রনের এক বিশেষ থ্রাস্টারে চাপ দিলো সজোরে –
রেট্রোগ্রেড থ্রাস্ট সিস্টেম।
এর ফলে যা হল সেটা দেখে চমকে
গেল ওখানে উপস্থিত সকলে – শুধু উইজার্ড বাদ।
হ্যালিকারনাসসাস – এক ঝাঁকুনি
দিয়ে আকাশের দিকে নাক উঁচু করে একটা শব্দ
উদ্গীরন করে । সে শব্দ সহস্র বজ্রপাতের সমান বলেই মনে হয় ।
বুউউউউউউউউউউউউউম!
আওয়াজটা আসলে সৃষ্টি হয় আটটা
মার্ক থ্রি হ্যারিয়ার রেট্রোগ্রেড থ্রাস্ট ইঞ্জিন চালু হওয়ার কারনে । ওগুলোই বিশেষ
ভাবে বিমানটার বাইরের বর্মের সাথে লাগানো হয়েছিল।
লাগিয়ে ছিলেন উইজার্ড ।
ফলাফল যেটা হল তা চমকে দেওয়ার
মতোই । নামতে নামতে মাঝ আকাশেই ভেসে থেকে গেল হ্যালিকারনাসসাস। মনে হচ্ছিল কোনো
অদৃশ্য তার দিয়ে বেঁধে ওটাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে । ওই থ্রাস্টারগুলোর কামাল ।
নিখুঁতভাবে ভাসিয়ে রেখে দিয়েছে দৈত্যাকার বিমানটাকে । জমি থেকে ২০০ মিটার ওপরে
...গ্রেট পিরামিড থেকে কয়েকশো গজ উঁচুতে ।
স্কাই মনস্টার হ্যালিকে
ভাসিয়ে নিয়ে এলো পিরামিডের চুড়ায় বানানো
প্ল্যাটফর্মটার কাছে । বাম দিকের দরজাটা এখন একেবারে প্ল্যাটফর্মটার কাছে ।
শিহরন উদ্রেককারী দৃশ্য- নানান
অস্ত্রশস্ত্র মিসাইল দিয়ে সাজানো একটা কালো অতিকায় জাম্বো জেট ভেসে আছে গিজার
গ্রেট পিরামিডের শীর্ষ বিন্দুর কাছে ।
প্ল্যাটফর্মে থেকে দেখলে মনে
হবে এক বিশাল মাপের পক্ষী দেবতা যেন মহাকাশ থেকে নেমে এসেছে নিজের ক্রোধের প্রকাশ
ঘটাতে ।
প্রাথমিক চমকের সমাপ্তি ঘটেছে,
দ্বিতীয় আমেরিকান ক্রেনটার সেনারা নতুন করে এ এ বর্ষণ শুরু করেছে। পয়েন্ট
ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ।
অবশ্য ভেতরে বাম দিকের গান
ট্যারেটে বসা পুহ বিয়ার ও সদা সতর্ক । ওর কাছেও টার্গেট পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জের
ভেতরেই।
এক রাশ আগুনের ঝলক উড়ে গেল ওর
দিক থেকেও – অতি দ্রুত গতির এক ঝাঁক বুলেট – আছড়ে পড়লো, কাঁপিয়ে দিলো, তছনছ করে
দিলো ক্রেন টাকে । ওটায় থাকা সেনাগুলোর ভবলীলা সাঙ্গ হতে বেশি সময় লাগলো না।
ওদিকে প্ল্যাটফর্মে জুডার চোখ
ঠেলে বেরিয়ে আসার যোগাড় ।
সূর্যের দিকে তাকালো...তাকালো
ঘড়ির দিকে ...১১-৫৯-২৯ ।
তিরিশ সেকেন্ড ।
‘যে ভাবেই হোক ওটাকে আটকে
রাখো!’ চেঁচিয়ে বললো দলের লোকেদের উদ্দেশ্যে। ‘আটকাও ওটাকে ! মাত্র তিরিশ সেকেন্ড
দরকার আর !’
হ্যালিকারনাসসাসের অভূতপূর্ব
আগমনের নাটকীয় দৃশ্য দেখে জুডা খেয়াল করতে পারেনি আরো একটা বস্তু পিরামিডের দিকে
ভেসে নেমে এসেছে। একটা খুব ছোট্ট কিছু , উড়ে এসেছে পশ্চিম দিকের মরুভূমি এলাকা
থেকে নিচু হয়ে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।
ওটা আসলে একজন মানুষ, যার পিঠে
লাগানো আছে কার্বন ফাইবারের নকল ডানা ।
অন্যদিকে চলতে থাকা হইচই
হট্টগোলের ফাঁকেই মানবাকৃতিটা নেমে এলো পিরামিডের গায়ে ক্যাপস্টোন থেকে একটু
নিচুতে । তারপর
তরতর করে উঠতে শুরু করলো ক্যাপস্টোনটার দিকে। মনে হচ্ছিল যেন ওখানে সিঁড়ির ধাপ আছে ।
ওই অবয়ব জ্যাক ওয়েস্ট জুনিয়র ।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে
এসেছে...শত্রুপক্ষকে নরক দর্শন করানোর জন্য।
দুপাশে হাত ছড়িয়ে ডানা সহ প্ল্যাটফর্মে
আবির্ভূত হলো ওয়েস্ট । দুহাতে দুটো বড় মাপের .৪৫ ক্যালিবার ডেজারট ঈগল পিস্তল । কাঠের
মেঝেতে পা ঠেকা মাত্র সে দুটো থেকে শুরু
হলো অগ্নিবর্ষণ । চারটে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ । খতম চার সিয়েফ
সেনা।
বুকের কাছে রিলিজ ক্লিপে ডান
হাতের এক হাল্কা চাপ দিতেই কাঁধ থেকে খসে গেল কার্বনের ডানা দুটো। এবার ভারমুক্ত
ওয়েস্ট । আরো বেশী খতরনাক...আক্রমনাত্বক ।
বন্দুক উঁচিয়ে ধেয়ে গেল প্ল্যাটফর্মের
ওপর।
হ্যালিকারনাসসাসের চমকপ্রদ
আবির্ভাবের জবাবে গ্রেট পিরামিডের ভিত্তি
থেকে উঠে এলো চারটে আমেরিকান হেলিকপ্টার । একটা সুপার স্ট্যালিয়ন, যেটায়
করে টুকরোগুলো নিয়ে জুডা এসেছিল, আর বাকি তিনটে অ্যাপাচে অ্যাটাক বার্ড ।
ওদের পেছন পেছন এলো পঞ্চম
চপার-একটা ব্ল্যাক হক- যদিও ওড়ার আগে ওটার ভেতরে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছিল বলে মনে
হলো।
কয়েক সেকেন্ড বাদেই ওটাও উঠে
গেল ওপরের দিকে ...যেখানে চলছে যুদ্ধ ।
প্ল্যাটফর্মের ওপর এক ভয়ঙ্কর
হট্টগোলের রাজত্ব।
হ্যালিকারনাসসাস ভেসে আছে ভিন
গ্রহের মহাকাশ যানের মত... বাম দিকের গান ট্যারেট থেকে পুহ বিয়ারের গুলি চালনা
অব্যাহত... প্ল্যাট ফর্মের ওপরে থাকা
সেনার দল হয় মৃত নয় স্যামসোনাইট বাক্সের অথবা ক্যাপস্টোনের পেছনে লুকিয়ে আছে । অথবা নেমে গেছে ভাড়ার নিচের দিকে ফাঁকা স্থানে।
এই সব ঝামেলার মাঝেই উইজার্ড
লাফিয়ে পড়ে নিজের শরীর দিয়ে ঘিরে রেখেছেন লিলিকে ।
ডেল পিয়েরো ছুটে গেছে প্ল্যাট
ফর্ম এর ওপর দিয়ে ...হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করছে সেই চ্যানেলটার ভেতরে যেখানে
ঢুকে আছে আলেকজান্ডার ।
‘ওহ হ ফাদার অত তাড়াহুড়ো করলে
চলবে!’ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠলো । ডেল পিয়েরো ঘুরে তাকালো –
- দেখতে পেলো মার্শাল জুডা গ্লক
পিস্তলের নল তাক করে আছে ।
ব্যাম!
সেকেন্ডের ভেতরে ছুটে এলো
গুলি...যাজকের মাথার ঘিলু ছিটকে গেল গোল্ডেন ক্যাপস্টোনের গায়ে ।
সিয়েফ দলের সেনারা ঘিরে আছে
জুডাকে । ক্যাপস্টোনের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ওরা । পুহ বিয়ারের গুলি লাগার সুযোগ নেই। দ্রুত নিজের ঘড়ি আর
আকাশের দিকে একবার তাকালো জুডা ।
ঘড়ির কাঁটা জানান দিলো সময় হয়ে
গেছে। এই সেইক্ষণ... শুরু হয়ে গেল ...
মনে হলো স্বর্গ থেকে যেন একটা
লেজার বিম নেমে আসছে।
একটা অত্যুজ্জ্বল সাদা আলোর সরলরেখা
আকাশ থেকে নেমে আসছে... সূর্যের গা থেকে
সেই আলো এসে গ্রেট পিরামিডের মাথায় অবস্থানকারী ক্যাপস্টোনের ওপর আছড়ে পড়ে বুম করে
একটা শব্দের সাথে ।
প্রায় জবাব দেওয়ার মতো করেই সেই
অতি জোরালো আলোক শক্তিকে নিজের স্ফটিক চুড়া
দিয়ে আঁকড়ে ধরে ক্যাপস্টোন - এই অবস্থায়
দূর থেকে দেখলে মনে হবে এই পিরামিড আর সূর্য এখন সংযুক্ত অতি অতি বিশাল এক আলোর
রেখা দ্বারা । সে আলোকরেখার গা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে চোখ ধাঁধানো সাদা আলো।
সব মিলিয়ে যেন এক স্বপ্ন দৃশ্য
– পিরামিডের মাথায় ভাড়ার ঘেরাটোপ আর বিশাল কাঠের প্ল্যাটফর্ম – পাশে ভেসে আছে
হ্যালিকারনাসসাস – ওদেরকে ঘিরে গুন গুন শব্দ তুলে পাক খাচ্ছে হেলিকপ্টারগুলো – তার
সাথেই সাদা আলোর এক অলৌকিক আলোর স্তম্ভ নেমে এসেছে আকাশ থেকে ।
এক অবিশ্বাস্য, অদ্ভুত, অসম্ভব
, সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার ।
তবুও এ এক হিসাববিহীন সত্যি ।
এই জন্যই এই রহস্যময়, গিজার এই সুবিশাল পিরামিডটিকে বানানো হয়েছিল শত শত বছর আগে ।
এই বিশেষ কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য ।
০০০০০
প্ল্যাটফর্মটায় গা থেকে ঠিকরে
যাচ্ছে আলো আর শব্দের লহরী ।
যে সূর্যালোক রশ্মির স্তম্ভ ওপর
থেকে নেমে এসেছে তার চমক অন্ধ করে দেওয়ার মতো । আর যে শব্দ –সৌররশ্মির সাথে
ক্যাপস্টোনের সংঘর্ষের বিশালকায় “বুম” তার সাথেই হ্যালিকারনাসসাসের নিজস্ব ইঞ্জিন
এবং রেট্রো থ্রাস্টারদের শব্দ মিলে মিশে
যা হচ্ছে তা আশেপাশের সব শব্দকে ঢেকে দিচ্ছে ।
এসবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে
মার্শাল জুডা, ক্যাপ স্টোনের সামনে। একহাত উঠিয়ে বাড়িয়ে রেখেছে সামনে গোল্ডেন
ক্যাপস্টোনের দিকে , মুঠো খোলা । শুরু করলো এক মন্ত্র পাঠ । এমন এক প্রাচীন ভাষায়
সেই মন্ত্র লেখা যা কয়েক হাজার বছরে কেউ শোনেনি ।
শক্তি আহরণের প্রথার মন্ত্র ।
এ মন্ত্র সাত লাইনের ।
জুডা যখন এই মন্ত্র পাঠ শুরু
করলো , নানান ঘটনা ঘটছে নানা দিকে।
পুহ বিয়ার।
চার আমেরিকান হেলিকপ্টারের সাথে
লড়ে যাচ্ছে একা । একটা অ্যাপাচে হেলিকপ্টারকে গুলি বর্ষণ করে শেষ করে দিয়েই সুপার
স্ট্যালিয়নকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে দিলো একটা হেলফায়ার মিসাইল । প্ল্যাটফর্মের সাথে
এক লেভেলে আসা মাত্র মিসাইলটা গিয়ে আঘাত হানল বিরাট হেলিকপ্টারটার সামনের
উইন্ডশিল্ডে।
সি এইচ-৫৩ই তে জবরদস্ত একটা
বিস্ফোরণ হলো। একটা অতিকায় আগুনের গোলা কিছু সময়ের জন্য ভেসে থাকলো মাঝ আকাশে ।
তারপরেই আছড়ে পড়লো পিরামিডের গায়ে প্ল্যাটফরমটার কাছে । বাঁই বাঁই করে ঘুরতে
থাকা ওর ব্লেডগুলো একটুর জন্য পাশ কাটিয়ে
গেল প্ল্যাটফর্মের নিচের দিক থেকে ... সবশেষে ওটা গিয়ে পড়লো গ্রেট পিরামিডের
দক্ষিন প্রান্তে।
পড়ে থাকলো ৫২ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে
– এটাই পিরামিডের ঢালের কৌনিক গঠন – ঠিক সেই স্থানে যেখান থেকে প্ল্যাটফর্মের
ভাড়ার শুরু । বিরাট হেলিকপ্টারটাকে চেনার উপায় নেই এই মুহূর্তে শুধু ওর ব্লেডগুলো
ঘুরেই চলেছে।
ইতিমধ্যে জুডা দু লাইন মন্ত্র
পাঠ করে ফেলেছে...
পুহ বিয়ার এবার লক্ষ্য স্থির
করলো আমেরিকান ব্ল্যাক হক চপারটার ওপর – ট্রিগার টিপতে যাবে এমন সময় অবাক হয়ে
দেখলো – ব্ল্যাক হকটা একটা মিসাইল ছুঁড়ে দিলো নিজেদের পক্ষের অ্যাপাচে অ্যাটাক
বার্ডের দিকে।
পুহ দেখতে পেলো ব্ল্যাক হকটার
পাইলটদের- জো আর ফাজি । কিছু আগে উড়ান শুরু করার আগের মুহূর্তে সামান্য সুযোগ
পেতেই নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল ওরা এবং ব্ল্যাক হকটাকেও দখল করে নেয় চকিতে
। এই জন্যই ওটা উড়তে দেরী করেছিল।
এরই মাঝে এক সিয়েফ সেনা লাফিয়ে উঠে
পড়েছে হ্যালিকারনাসসাসের বাম ডানার ওপরে। গেরিলা আক্রমণের ধাঁচে পৌছে গেছে পুহ
বিয়ারের গান টারেটের কাছে । পুহ সময় পায়নি সরে যাওয়ার। সেনাটা উঁচিয়ে ধরেছে কোল্ট
রাইফেল –
ব্যাম!
সিয়েফ সেনাটার মাথায় পেছনে এসে লাগলো একটা দূরপাল্লার স্নাইপার বুলেট
...যেটা ধেয়ে এসেছে –
-স্ট্রেচের রাইফেল থেকে । বসে
আছে চুরি করা ব্ল্যাক হকটার দরজার পাশে, হাতে ওর প্রিয় স্নাইপার রাইফেল।
পুহ তাকালো ইজ্রায়েলী সহ কর্মীর
দিকে, জীবিত আছে এখনো...ওর সাথে আছে আরো দুজন দক্ষ সহযোদ্ধা । একটা ছোট্ট হাসি ছুঁড়ে
দিলো স্ট্রেচের দিকে।
জুডা চতুর্থ লাইনটাও পাঠ করে
ফেললো ...
ওয়েস্ট ।
ক্যাপ স্টোনের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা
জুডাকে ঘিরে রেখেছে যে আটজন তাদের মোকাবিলায় হাজির । ছয় সিয়েফ সেনা,
কোয়েনিগ এবং কালিস।
সোজা এগিয়ে গেল সামনের দিকে
...চোখের পাতা পড়ছে না ...মুখ পাথরের মতো কঠিন ...দুহাতের বন্দুক সামনে ওঠানো ।
এ আমাদের চেনা ওয়েস্ট নয় ...এ
সেই যোদ্ধা ওয়েস্ট যাকে জুডা ট্রেনিং দিয়ে তৈরী করেছিল – আবার ফিরে এসেছে যুদ্ধের
জগতে ...আপাতত ওর মতো ভয়ঙ্কর নির্মম নিষ্ঠুর কেউ নেই।
চারটে বুলেট বের হলো সেকেন্ডের
ভগ্নাংশের ভেতরে ... চার সিয়েফ সেনা লুটিয়ে পড়লো ... চারজনেরই কপাল ভেদ করে চলে
গেছে ওয়েস্টের চালানো বুলেট । একটা শট, একটা মৃত্যু এটাই জানে এটাই শিখেছে
ওয়েস্ট ।
চিতার ক্ষিপ্রতায় আর এক সেনাকে
লাফিয়ে পাকড়ালো পেছন দিক থেকে। ভেঙে দিলো ঘাড় । তারপর সেই মৃত শরীরকেই সামনে ধরলো
ঢাল হিসাবে ক্যাল কালিসের গুলির থেকে বাঁচতে । ছিনিয়ে নিলো মরা সৈনিকটার এম-৪
...এক ঝাঁক গুলি ছুঁড়ে দিলো শেষ সেনাটার
দিকে । বুড়ো নাজি কোয়েনিগ একটা চাকু বার করে ওর দিকে ঝাঁপালো এবং মাঝপথেই
থেমে গেল ওয়েস্টের চালানো দুটো গুলি সরাসরি
মুখে গিয়ে লাগতেই । দুর্বল দেহ সহ্য করতে পারলো না গুলির ধাক্কা । ছিটকে পড়ে গেল
প্ল্যাটফর্মের ওপর থেকে।
ষষ্ঠ লাইনের পাঠ শেষ করলো
জুডা...
‘কালিস ওকে আটকাও!’ চিৎকার করে
উঠলো জুডা, শেষ লাইন পাঠ করার আগে ।
ক্যাল কালিস এসে দাঁড়ালো জুডা আর
ওয়েস্টের মাঝখানে- আলো, শব্দ আর বাতাসের ধুন্ধুমার চলছে তখন চারপাশে ।
এই পরিস্থিতির একটাই অর্থ ...একজনকে
মরতে হবেই...জিতবে একজনই।
কিন্তু এসবের মাঝেই আর একটা
অবয়ব তার কাজ করতে চলেছে।
প্ল্যাটফর্মে যখন হত্যালীলা
চলছে , সকলের নজর এড়িয়ে , হ্যালিকারনাসসাসের বাম ডানার পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে
এসেছে সেই অবয়ব । নিচু হয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে সামনের
দিকে । হাতে ধরে আছে ছোট্ট একটা কিছু।
বিমানের দরজা থেকে বেরিয়ে উঠে
এলো ডানার ওপরে । তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এসে লাফিয়ে নামলো কাঠের প্ল্যাটফর্মের ওপর –
এখনো কেউ দেখতে পায়নি ওকে- এগিয়ে চললো উইজার্ড আর লিলির দিকে ।
ওয়েস্ট আর কালিস মুখোমুখি ।
একই সাথে দুজনে নড়লো , একই সাথে
উঁচিয়ে ধরলো নিজের নিজের আগ্নেয়াস্ত্র । চাপ দিলো ট্রিগারে। একই সাথে ...ঠিক যেন
পশ্চিম বন্য মরুভূমির প্রান্তরে সামনা সামনি দাঁড়িয়েছে দুই বন্দুকবাজ।
ক্লিক! ক্লিক!
দুজনের বন্দুকেই বুলেট শেষ।
‘ধুস শা...!” কালিস চেঁচিয়ে
উঠলো ।
‘বাপরে ...’ ওয়েস্ট ধরে রাখা
শ্বাস ছাড়লো ।
যদিও জানে এসবের এখন আর কোনও
দামই নেই।
জুডাও সেটা বুঝে গেছে। ওরা একে
অপরের দিকে তাকালো। ওয়েস্টের মাথা নিচু হয়ে গেল।
অনেক দেরি হয়ে গেছে ওর।
কয়েক সেকেন্ডের – বা কয়েক
মিটারের জন্য – ওর দেরি হয়ে গেল ।
মুখে এক জান্তব পাগলাটে হাসি
নিয়ে, টারটারাসের ঘূর্ণনের দিনে এক
অপ্রাকৃত আলোয় , মার্শাল জুডা উচ্চারন করলো শক্তি আহরণের প্রথা মন্ত্রের শেষ শব্দগুলো
এবং বিজয়ীর ভঙ্গীতে তাকালো আকাশের দিকে ।
কিছুই ঘটলো না।
সত্যিই কিছু ঘটলো না...ওয়েস্ট
নিশ্চিত নয় ঠিক কি ঘটবে। আকাশ কি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে ? গোটা পৃথিবী কেঁপে উঠবে? জুডার কি
একটা দারন শক্তিশালী ড্রাগন ধরনের কিছুতে বদলে যাওয়া উচিত ছিল? নাকি ওয়েস্টের
বন্দুকটা গলে পড়ে যাবে হাত থেকে?
তবে যেটা ঘটলো তাতে এটাই হওয়া
উচিত ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা আগামী এক হাজার বছরের জন্য পৃথিবী শাসন করার একচ্ছত্র
অধিকার পেলো । কিন্তু সেটা কিভাবে সেটা দেখা বা বোঝার উপায় তো কিছু বোঝা যাচ্ছে
না।
মোট কথা ওয়েস্ট এটাই বুঝলো
কিছুই আদপে বোঝা গেলো না।
ক্যাপস্টোনের অন্যদিকে প্ল্যাটফর্মে
মরে পড়ে থাকা সিয়েফ সেনাদের ভেতর দিয়ে একটা অবয়বকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে দেখা
গেল। অবয়বটা অর্যাকলের ছেলে আলেকজান্ডারের।
অর্থাৎ জুডা যখন মন্ত্র পাঠ
করছিল তখন ক্যাপস্টোনের তলার চ্যানেলের ভেতর ছেলেটা ছিলই না...
আর এই কারনেই ওই প্রথা পালন করে
কোন লাভ হয়নি ।
জুডা ব্যাপারটা দেখে এবং বুঝে
চেঁচিয়ে উঠলো, ‘না ... এ হতে পারে না!’
ছেলেটা পৌছে গেছে প্ল্যাটফর্মের
প্রান্তে , ফিরে তাকালো – দেখতে পেলো ডেল পিয়েরোর মৃতদেহ ...তারপর প্ল্যাটফর্মের
পাশ দিয়ে ঝুলে নেমে গেল পরের ধাপে ।
আলেকজান্ডারের পালিয়ে যাওয়ার
দৃশ্য দেখা ওয়েস্টকে থামাতে হলো কারন ক্যাল কালিসের কে- বার চাকুর চকচকে ফলা ঝলসে
উঠলো ওর চোখের সামনে।
ওয়েস্ট আঘাত এড়াতে নিচু হলো,
কালিসের চাকু ধরা হাত উঠে গেল ওপর দিকে। তারপরেই এক ঝটকায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পর পর
দুটো আঘাত হানলো যান্ত্রিক হাতটা দিয়ে। একটার ঘায়ে কালিসের হাত থেকে খসে গেল
চাকুটা আর দ্বিতীয়টা সম্ভবত ওয়েস্টের জীবনের সবচেয়ে সেরা ঘুষি যা গিয়ে লাগলো
কালিসের নাকে –
আঘাতটা গিয়ে লাগলো নাকে ...
...সেই আঘাতে আদপেই কিছু হলো
বলে মনে হলোনা কালিসের ।
বিশালদেহী সিয়েফ কম্যান্ডো হেসে
তাকালো ওয়েস্টের দিকে। দাঁতগুলো রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে।
পর পর তিনটে দারুন ওজনের ঘুষি
এবার সহ্য করতে হলো ওয়েস্টকে। সবকটাই সরাসরি মুখের ওপর।
পর পর তিনটে ঘুষি খেয়ে ওয়েস্ট পিছিয়ে গেল দু পা।
কালিস ঘর ঘরে উচ্চারনে চিবিয়ে
চিবিয়ে বললো, ‘কি ওয়েস্ট কেমন লাগলো! ভালোই আশা করছি! এই মুহূর্তটার জন্য আমি একসপ্তাহ
ধরে অপেক্ষা করে আছি! তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম একমাত্র তোমাকে ব্যবহার করার জন্য।
প্রত্যেকটা টুকরো পাওয়াটা যাতে সহজ হয়ে
যায়। আর সেটাই তুমি আমাদের জন্য করেছো। আর তোমাকে দরকার নেই। সুদানে আমার লোকেরা
তোমার স্প্যানিশ বন্ধুর ওপরে যাওয়ার টিকিট কেটে দিয়েছিল! কিন্তু কেনিয়াতে তোমাদের
দলের ওই মাথামোটা আইরিশ ছেলেটাকে শেষ করেছিলাম আমি ! জানো না বোধ হয় তোমরা পালিয়ে
যাওয়ার পরেও ও ছোঁড়া বেঁচে ছিল – রক্তবমি করতে করতে কি সব বলছিল। আর একটা বুলেট
...ব্যাস সব ফিনিশ ।’
বলতে বলতেই এগিয়ে গিয়ে চতুর্থ
আর পঞ্চম ঘুষি দুটো মারলো কালিস।
পাঁচ নম্বর আঘাতটা খেয়েই ,
ওয়েস্টের নাক ফেটে গেল, গল গল করে বেরিয়ে এলো রক্ত । পা পিছলে পড়ে গেল প্ল্যাটফর্মের ওপর ... বুঝতে পারলো একেবারে প্ল্যাটফর্মের কানায় এসে পড়েছে ও । সামান্য চমকে
একবার পিছনদিকটা দেখে নিলো ওয়েস্ট।
ওর ঠিক নিচেই , ফুট তিরিশ হবে,
সুপার স্ট্যালিয়ন হেলিকপ্টারটা পড়ে আছে – এখনো বিরাট বিরাট ব্লেডগুলো বাঁই বাঁই
করে ঘুরে চলেছে ।
কালিসও সেটা দেখেছে। ‘ওই আইরিশ
ছেলেটাকে মারতে আমার দারুন লেগেছিল । আর এখন
তোমার জন্য নরকের টিকিটটাও আমিই কেটে দিচ্ছি । বিদায় ওয়েস্ট, নরকেই দেখা
হবে আবার!’
বলেই নিচু হয়ে শেষ ঘুষিটা
চালালো কালিস ।
আর কোনো বাঁচার উপায় নেই দেখেই ওয়েস্ট শরীরের সব শক্তি একত্র করে কোমর থেকে দেহের বাকি
অংশ উঠালো সামনের দিকে... সাথেই ঝাড়লো বাম
হাতের এক ঘুষি ... দুরন্ত ক্ষিপ্রতায়
...হয় এসপার নয় উসপার মানসিকতা নিয়ে ।
ওয়েস্টের ঘুষিটাই আগে আঘাত করলো
কালিসকে।
ধ্যাপাক!!!
কালিস থমকে গেল ঘুষি বাগানো
অবস্থাতেই –
-ওয়েস্টের নকল যান্ত্রিক হাতের
ধাতব ঘুষি সজোরে আছড়ে পড়লো কালিসের মুখের একেবারে মাঝখানে...নাকটাকে একেবারে
থেবড়ে দিলো । এতো জোর সেই আঘাতে যে নাকটার অস্তিত্বই হারিয়ে গেল মুখের ওপর থেকে ...কয়েক
টুকরো হয়ে গেল ওটা । এবার ফোয়ারার মত রক্ত ছিটিয়ে গেল ।
অবিশ্বাস্যভাবে কালিস তাও
দাঁড়িয়ে রইলো দু পায়ে। চোখ বিস্ফারিত । থর থর করে কাঁপছে সারা শরীর । মনে হচ্ছে ওর
অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন ওর মাথার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না।
জীবনের শেষ মুহূর্তে পৌঁছে গেছে
কালিস।
‘এটা ছিল বিগ ইয়ার্সের তরফ
থেকে,’ ওয়েস্ট বললো, ওই যান্ত্রিক হাতেই কালিসকে ধরে নিজের দিকে টেনে এনে ...তারপর
ঠেলে দিলো প্ল্যাটফর্মের ওপর থেকে।
কালিস পড়তে থাকলো – তিরিশ ফুট ,
সোজা নিচের দিকে – চেতনার শেষ মুহূর্তে ওর চোখে পড়লো , আতঙ্কের চূড়ান্ত সুপার
স্ট্যালিয়নের একটা ঘুরন্ত ব্লেড এগিয়ে আসছে ওর দিকে।
জীবনের শেষ চিৎকারটা করার
চেষ্টাটাও সফল হলোনা কালিসের । সেকেন্ডের কয়েক ভগ্নাংশের মধ্যেই ওর
শরীরটা টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে গেল এদিকে ওদিকে।
প্ল্যাটফর্মের আরেক প্রান্তে
দাঁড়িয়ে চরম শিহরনের মুহূর্ত নিয়ে উইজার্ড দেখছিলেন কালিসের সাথে ওয়েস্টের মরণপণ
যুদ্ধ ।
ইচ্ছে করছিল সাহায্য করার
কিন্তু লিলিকে ছেড়ে যেতে পারছিলেন না।
কিন্তু যেই দেখতে পেলেন জ্যাক
হারিয়ে দিলো কালিসকে একটা দুর্দান্ত ঘুষি মেরে ...দেখতে পেলেন কালিসের মুখ থেকে রক্ত
ছিটকে যাওয়া ... ওনার মনে হলো এবার পাল্লাটা ওদের দিকেই ভারী হচ্ছে সম্ভবত-
একটা জোরালো আঘাত এসে পড়লো পেছন
থেকে উইজার্ডের ওপর ... হ্যালিকারনাসসাস থেকে যে অবয়বটা বেরিয়ে এসেছিল এটা তার
কাজ।
উইজার্ড পড়ে গেলেন, আশেপাশের
জগতটা ওর কাছে অন্ধকার হয়ে এলো ।
জ্ঞান হারানোর আগে উনি
শুনতে পেলেন লিলি চিৎকার করে কাউকে বলছে, ‘আলেকজান্ডারের কথা ভুলে যাও ! দরকার পরে
ওর বদলে আমাকে ব্যবহার করো!’
ধুলো আর রক্তে মাখা মাখি হয়ে
আছে ওয়েস্টের মুখটা । উঠে দাঁড়ালো প্ল্যাটফর্মের ওপর , তাকাল ক্যাপস্টোনের দিকে-
-দেখলো মার্শাল জুডার গ্লক
পিস্তলের নলটা তাক করা ওর দিকে... ডেল পিয়েরোর মতোই থমকে গেলো ওয়েস্ট ।
‘তোমার সত্যিই গর্ব করা উচিত
জ্যাক!’ জুডা বললো। ‘আজ যা কিছু হচ্ছে সব তোমার কাজের ফল! তুমিই আজ আমাদের এই
অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছো! সব সময় তুমি আমার জন্যই কাজ করে গিয়েছ! এমন কিছু
ভাবোনি...এমন কিছু করোনি...এমন কিছু পাওনি যা আমি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে না পারি
! সব কিছু নিয়ে নিয়েছি আমি। এমন কি তোমার ওই ছোট্ট মেয়েটাকেও , এই প্রথায় কাজে
লাগানোর জন্য! দুঃখের ব্যাপার এই যে তুমি দেখতে পাবে না তোমার ওই সোনামণির ভাগ্যে
কি ঘটলো! গুডবাই, জ্যাক!’
জুডা ট্রিগারে আঙ্গুলের চাপ
দি...
ওয়েস্ট চিৎকার করে বললো, ‘উহু
ভুল হচ্ছে তোমার জুডা ! একটা জিনিষ আমি তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পেরেছি ! এমন
একটা কিছু যা একসময় তোমার ছিল?’
‘কি সেটা?’
‘হোরাস!’
বলতে না বলতেই একটা বাদামি
বিদ্যুত ছিটকে গেল জুডার মুখের ওপর দিয়ে । আর্ত চিৎকার করে উঠলো জুডা। ছিটকে
বেরিয়ে এলো রক্ত। পিস্তল ধরা হাতেই চেপে ধরলো নিজের চোখ ।
হোরাস চিৎকার করতে থাকা জুডার
থেকে একটু দূরে গিয়ে ডানা ঝাপ্টে ভেসে থাকলো আকাশে... কিছু একটা ধরে আছে ধারলো নখ
যুক্ত থাবায়...সাদা রঙের একটা কিছু, যার থেকে টপ টপ করে রক্তের ফোঁটা পড়ছে।
ওটা জুডার বাম চোখ... হোরাস
খুলির গর্ত থেকে উপড়ে তুলে নিয়েছে অপটিক স্নায়ু সমেত।
জুডা ধপ করে বসে পড়লো হাঁটু
গেড়ে , চিৎকার করতে করতে, ‘আমার চোখ! আমি
...!’
একই সময়ে ভালো চোখটা দিয়ে জুডা দেখতে পেলো ক্যাপস্টোনটাকে । পুনরায় চিৎকার করে
উঠলো আরো করুন স্বরে, ‘হা ঈশ্বর! না! এ হতে ...!’
ওয়েস্টও ঘুরে তাকালো – দেখতে
পেলো এক দুঃস্বপ্ন যেন মূর্ত রুপ নিয়েছে।
ক্যাপস্টোনের কাছে এখন দাঁড়িয়ে
আছে ...লিলিকে উইজার্ডের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে – বন্দুকের নল বাগিয়ে ক্যাপ স্টোনের
তলায় ঢুকতে বাধ্য করেছে লিলিকে – সেই বাটির মতো স্থানটাকে পরিষ্কার করে ঢেলে দিয়েছে ঠিক এক ডেবেন
পরিমাণ দারুন মিহি কমলা আভা যুক্ত বালি, যা রাখা ছিল কালো জেড পাথরের বাক্সে ...
মুস্তাফা জাঈদ। শুরু করেছে জুডার নোট বইটা থেকে মন্ত্র পাঠ। শক্তি আহরণের মন্ত্র !
জাঈদ সবার অগোচরে একটু আগেই
হ্যালিকারনাসসাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল । সবার অলক্ষ্যে উঠে পড়েছিল বিমানে
ঝুলন্ত উদ্যান এলাকা থেকে বের হয়ে আসার পর।
ওয়েস্ট আর পুহ বিয়ারকে অনুসরণ
করে পৌঁছে গিয়েছিল কালো ৭৪৭ এর কাছে । সুযোগ বুঝে নিজে ঝুলে উঠে পড়েছিল ল্যান্ডিং
গিয়ারে। কেউ জানতেও পারেনি। জাঈদ বুঝেই গিয়েছিল ওয়েস্ট আমেরিকানদের সাথে শেষ লড়াই
করার জন্য এখানে আসবেই।
এরপর ঢুকে পড়ে বিমানের ভেতরে ।
নিজের পুরান ট্রাঙ্কটা খুলে বার করে আনে সেই কালো জেড পাথরের বাক্স টাকে । যাতে
রাখা ছিল মিহিদানার বালি । এই বালি সে কবে থেকে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল সৌদি আরবের
গোপন আস্তানায় – খাঁটি আরবিয়ান ভুমির বালি ওটা। এমন বালি যা এই জগতে আগামী হাজার
বছরের জন্য রাজত্ব করার সুযোগ এনে দেবে মুসলিম জগতকে ।
সামান্যক্ষণ আগে পেছন থেকে উইজার্ডের
মাথায় আঘাতটাও করে ওই । সাথে সাথেই দেখতে পায় নিচের প্ল্যাটফর্মে আলেকজান্ডার নিচু
হয়ে বসে আছে । ও এগিয়ে যায় আলেকজান্ডারকে ধরে আনার জন্য । তখনি লিলি বলে ওঠে, ‘‘আলেকজান্ডারের
কথা ভুলে যাও ! দরকার পরে ওর বদলে আমাকে ব্যবহার করো!’
জাঈদ সেটাই করে ।
এবার মাত্র সাতটা লাইন ওকে পাঠ
করতে হবে মন্ত্রর।
এরজন্য ওর দরকার মাত্র পনেরো
সেকেন্ড ।
এই মুহূর্তে গিজার পিরামিডের
চুড়ায় , চোখ ধাঁধানো প্রায় অন্ধ করে দেওয়া টারটারাস সৌর কলঙ্কের ধাক্কায় সৃষ্ট
আলো, জোরালো বাতাস আর প্রচণ্ড গরমের মাঝে দাঁড়িয়ে সবাই ...নিদারুন আতঙ্কে অসহায়
ভাবে দেখছে মুস্তাফা জাঈদ – তার শয়তানি কণ্ঠস্বরে –পাঠ করছে শক্তি আহরন প্রথার
মন্ত্র ।
এবার আর কোনও আশা নেই, ওয়েস্ট
নিশ্চিত যে এবার ওই প্রথা পালিত হতে চলেছে সঠিক ভাবে।
যার একটাই অর্থ এ জগতের বিনাশ ।
আলো ঝলসে উঠলো ।
শোনা গেল বজ্রপাতের শব্দ ।
কেঁপে উঠলো পৃথিবী ।
এরপর যা দেখা গেল তার কাছে মানব
নির্মিত এবং প্রদর্শিত সব আতসবাজির খেলা ম্লান হয়ে গেল।
যে অতি উজ্জ্বল সাদা আলোর
স্তম্ভ সূর্য থেকে নেমে এসেছে নিচে সেটা যেন আর বেশি উজ্জ্বল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে
ওটার ঘনত্ব বেড়ে গেছে অনেক পরিমাণে।
এক অপার্থিব বজ্রপাত হলো , কানে
তালা লেগে গেল ওয়েস্টের সে শব্দে । একটা সাদা রঙের অতি অতি অতি উজ্জ্বল গরম গোলক
ছিটকে এলো আকাশের বুক থেকে আলোর স্তম্ভ ধরে নেমে আসতে থাকলো ক্যাপস্টোন লক্ষ্য করে...
...এটাকেও ধারন করলো ক্যাপস্টোন
তার স্ফটিকের উলম্ব্ব মালায় ।
গোল্ডেন ক্যাপস্টোনের ভেতরের সাত
স্ফটিকের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললো সেই অতিশক্তি প্রবাহ – প্রতি মুহূর্তে স্ফটিকগুলো
ওই আলোকে সুক্ষ থেকে সুক্ষতর মাপে বদলে দিচ্ছিল নামার সময় । আলোর সেই বিন্দু যেন ক্রমশ জমাট বেঁধে
সংকুচিত হচ্ছিল।
তারপর এক সময় সেই অতি সুক্ষ
আলোর স্তম্ভ গিয়ে আঘাত হানল লিলির হৃদয়ে ।
লিলি সেই আলোর ধাক্কায় কেঁপে
উঠলো। আলোর সেই রশ্মি লিলির দেহ ভেদ করে গিয়ে ছুঁলো বাটিতে থাকা বালিকে ।
একটা আলোর চমকের সাথে সাথে ওই
বালি পরিণত হলো জ্বলন্ত কয়লার মতো জিনিষে।
০০০০০
বাইরে থেকেও ক্যাপস্টোনটা ঝকমক
করছিল ওই বিশেষ আলোকশক্তির ছোঁয়া পেয়ে । সহসাই একটা বুক কাঁপানো হোয়াম্ফ ধরনের
শব্দ হলো। সাদা আলোর গোলকটা ঢুকে গেল ক্যাপস্টোনের ভেতরে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল সব
। একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল চরাচর। কেবলমাত্র একটা গম্ভীর গুন গুন শব্দ শোনা যাচ্ছিলো ক্যাপস্টোনের
ভেতর থেকে ...সাথেই মিশে ছিল হ্যালিকারনাসসাসের থ্রাস্টারগুলোর শব্দ ।
ওয়েস্ট তাকিয়ে ছিল ক্যাপস্টোনের
দিকে । বোঝার চেষ্টা করছিল ভেতরে থাকা লিলির কি হলো । এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার
পর কি সে বেঁচে আছে? নাকি জাঈদের কথাই সত্যি এই প্রথা পালন করার জন্য ওকে মৃত্যু বরন করতে হবে?
জাঈদ দাঁড়িয়ে ছিল ক্যাপস্টোনের পাশে
। ওর হাত বিজয়োল্লাসে উঠে গেছে ওপরের দিকে , মুখ আকাশ পানে । ‘এক হাজার বছর ! এক হাজার
বছরের সূচনা হলো ইসলাম শাসনের !’
ঘুরে তাকাল ওয়েস্টের দিকে ,
জ্বল জ্বল করছে চোখ দুটো , হাত ছড়িয়ে আছে দুপাশে ।
‘প্রথা পালন সম্পূর্ণ হয়েছে ,
কাফেরের দল! যার অর্থ আমার জাতির লোকেরা এই মুহূর্তে অপরাজেয়! অপ্রতিরোধ্য ! আর তুমি –তুমি –
হবে আমার প্রথম শিকার!’
‘তাই বুঝি?’ ওয়েস্ট বললো,
ডেজারট ঈগলটায় বুলেটের ক্লিপটা সেট করে নিয়ে
জাঈদের দিকে তাক করে।
‘চালাও কত গুলি আছে তোমার
দেখি!’ ব্যাঙ্গাত্বক সুরে বললো জাঈদ। ‘বুলেট তোমাকে কোনও সাহায্য করতে পারবে না!’
‘বেশ, দেখা যাক,’ ওয়েস্ট উত্তর
দিলো ।
ব্যাম! – ছুটে গেল বুলেট ।
সোজা গিয়ে লাগলো জাঈদের বুকে, এক ধাক্কায় ছিটকে
গিয়ে পড়লো পেছন দিকে । আবার ছিটকে গেল রক্ত, সন্ত্রাসবাদীটা ধপ করে বসে পড়লো হাঁটু
গেড়ে । মুখে একইসাথে চমক এবং বিভ্রান্তির ছাপ ।
একবার নিজের ক্ষতস্থানটা দেখলো
তারপরেই তাকালো ওয়েস্টের দিকে।
‘কিন্তু ... কিভাবে ...?’
‘আমি ভালো করেই আনতাম যে তুমি
ঝুলন্ত উদ্যানের এলাকা থেকে আমাদের অনুসরণ করে এসে প্লেনে চেপেছিলে,’ ওয়েস্ট বললো।
‘ জানতাম এছাড়া এখানে আসার তোমার কাছে আর
কোনো রাস্তা নেই । ঠিক বলছি তো? এই ক্যাপস্টোনের শক্তি আহরণের জন্য তুমি সারা জীবন
কাটিয়ে দিয়েছো । সেই তুমি এসব ছেড়ে নিজের দেশে ফিরে যাবে সেটা কি হয় । সেজন্যই আমি তোমাকে
এখানে আসতে প্লেনে আসার সুযোগ দিয়েছিলাম।’
‘কিন্তু ওই বালি ...’
‘তুমি যখন আমার প্লেনের পেটের
তলায় লুকিয়ে ছিলে সেই সময়েই আমি ওপরে বিমানের ভেতরে তোমার কালো জেড পাথরের বাক্সের
বালি বদলে দিয়েছিলাম,’ ওয়েস্ট বললো। ‘ তুমি যা ঢেলেছো ওটা আরবের বালি ছিল না মোটেই । ওটা আমার দেশের মাটি । জাঈদ তুমি প্রথাটা
পালন করেছো আমার দেশের মানুষের জন্য । তোমার নিজের দেশের জন্য নয় । এরজন্য অনেক
ধন্যবাদ তোমাকে।’
জাঈদ হতভম্বের মতো তাকিয়ে
থাকলো। বুঝতে চেষ্টা করলো ব্যাপারটা কি ঘটলো । ‘তোমার দেশের মাটি? তার মানে
তো...’
কথাটা শেষ করার আগেই ওর প্রান
পাখি ফুরুত করে বেরিয়ে গেল ওর ভেতর থেকে। মুস্তাফা জাঈদ মুখ থুবড়ে পড়ে গেল প্ল্যাটফর্মের
ওপর । মৃত ।
পেছন দিকে থেকে একটা যন্তনাকাতর চিৎকার ভেসে এলো
– ‘ওয়েস্ট!’ – ওয়েস্ট ঘুরে তাকিয়ে দেখলো মার্শাল জুডা এগিয়ে আসছে ওর দিকে ।
হোরাসের খুবলে নেওয়া চোখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে রক্ত মাংস ...হাতে একটা এম-ফোর
অ্যাসল্ট রাইফেল । তুলে নিয়েছে মরে পরে থাকা সিয়েফ সেনার পাশ থেকে ।
পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ।
জুডার লক্ষ্য মিস হয় না ।
চাপ দিলো ট্রিগারে ।
বন্দুকটা জুডার হাতেই ফেটে গেল।
না মিস ফায়ার নয় , কোনও কারিগরী গণ্ডগোলও
হয়নি বিন্দুমাত্র । শুধু বন্দুকটা ফেটে গেল । কয়েকশো টুকরো হয়ে এবং খসে পড়ে গেল জুডার হাত থেকে।
জুডা ভ্রু কুঁচকে, হতবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকলো – তারপর চরম আতঙ্কে কেঁপে উঠে ওয়েস্টের দিকে তাকালো , বললো, ‘ওহ মাই
গড...তুমি ...তুমি বিশেষ শক্তি প্রাপ্ত হয়েছো ...’
ওয়েস্ট সামনের দিকে এগিয়ে গেল, চোখে ক্রোধ । ‘জুডা ,
তুমি মাথায় চিপ সেট করে আমার সাথে যা করেছো তার জন্য হয়তো ক্ষমা করে দিতাম। হোরাসকে
যে ভাবে কষ্ট দিতে তার জন্যেও হয়তো ক্ষমা করে দিতাম । কিন্তু তুমি এমন একটা কাজ
করেছ যার ক্ষমা নেই ...নিরীহ ডরিস এপ্পারকে খুন করেছো তুমি। তার দাম তোমাকে চুকাতে
হবেই।’
বলতে বলতেই ওয়েস্ট হাতে তুলে
নিলো জুডার শরীরের সাথে যুক্ত থাকা সেই দড়িটাকে যা জুডা নিজেই বেঁধেছিল । খুলে
নিলো ওটাকে প্ল্যাটফর্মের গা থেকে ।
জুডা পিছিয়ে গেল , প্ল্যাট
ফর্মের কিনারায়, যেদিকে ভেসে আছে হ্যালিকারনাসসাস। দুহাত ওপরে তুলে বললো, ‘জ্যাক
...আমরা দুজনেই কিন্তু সেনাবাহিনীর মানুষ । আর সেনারা মাঝে মাঝে –’
‘তুমি ডরিসকে হত্যা করেছিলে। আর
এখন আমি তোমাকে হত্যা করবো ।’
হাতে ধরে থাকা দড়িটাকে জুডার
পাশ দিয়েই ছুঁড়ে দিলো ...হ্যালিকারনাসসাসের ঘুরতে থাকা ইঞ্জিন প্রপেলারটার দিকে।
জুডা ঘুরে তাকাল দড়িটার দিকে
...দেখতে পেলো ওটা ঢুকে যাচ্ছে ইঞ্জিনের
খাঁজটায়।
বুঝতে পারলো কি হতে চলেছে...
অবশিষ্ট চোখের মনিটা আতঙ্কে ঠিকরে এলো বাইরের দিকে।
আর্ত চিৎকার করে উঠলো
জুডা...বেশিক্ষণ অবশ্য চ্যাঁচানোর দরকার হলো না ...বিশাল ইঞ্জিনটা টেনে নিলো
দড়িটাকে আর তার সাথে আটকে থাকা বস্তুটাকেও
।
জুডা ভেসে উঠে গেল শুন্যে...হাওয়া
কেটে দ্রুত উড়ে গেল শরীরটা। ঢুকে গেল ইঞ্জিনের গহ্বরে –ছ্যাক ছ্যাআআক ঠং কয়েকটা
শব্দ করে যন্ত্রদানব ওকে চিবিয়ে শেষ করে দিলো ।
এই মুহূর্তে গিজা পিরামিডের
এলাকা একেবারে নিস্তব্ধ ।
সূর্যের ভেতর থেকে ধেয়ে আসা
আলোর গোলকের বিস্ফোরণ এবং দলীয় নেতাদের অন্তিম পরিণতি দেখে ইতি মধ্যেই চাচা আপন
প্রান বাঁচা নীতি অনুসরণ করে পিরামিডের নিচ থেকে কেটে পড়েছে আমেরিকান সেনা দল। প্ল্যাটফর্মের
ওপরে দেখা যাচ্ছে ওয়েস্ট আর উইজার্ডকে ।
কয়েক সেকেন্ড বাদেই প্ল্যাটফর্মে
নেমে এলো ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টারটা। ভেতর থেকে বেরিয়ে ছুটে এলো জো, ফাজি আর স্ট্রেচ
। ওদিকে পুহ বিয়ার ও নেমে এলো হ্যালিকারনাসসাসের ডানা থেকে ।
সবার নজর ওয়েস্ট এর দিকে –
উইজার্ড দেখতে পেলো – বুকে হেঁটে ওয়েস্ট এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাপস্টোনের
দিকে লিলিকে দেখার জন্য ।
সরু চ্যানেলটার ভেতর কোনো মতে ঢুকলো ।
দেখতে পেলো শুয়েই আছে লিলি,
ক্যাপস্টোনের নিচে, নিথর ভাবে সেই মানব সদৃশ মূর্তিটার ওপর । চোখ বন্ধ । মনে হচ্ছে
খুব আরামে শান্তিতে আছে ...শ্বাস নিচ্ছে না ।
‘ওহ লিলি ...’ ওয়েস্ট কনুই এচাপ
দিয়ে চেষ্টা করলো এগিয়ে যাওয়ার লিলির কাছে ।
মাথাটা এগিয়ে দিলো সামনের দিকে
যতটা পারলো । মুখের দিকে তাকালো যদি একটু নড়াচড়া দেখা যায়...যদি চোখে পড়ে প্রানের
স্পন্দন ।
না... একটুও নড়ছে না লিলি ।
ওয়েস্টের শরীর অসাড় হয়ে এলো ।
একটা কষ্ট ওর হৃদয় টাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিলো, চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল আবেগের চাপে ।
‘ওহ, লিলি । আয়াম সরি ডিয়ার। আমাকে মাফ করে দিস কিড্ডো...আয়াম সো সরি!’
মাথা ঝুঁকে গেল সামনের দিকে ,
চোখের দুপাস দিয়ে বেরিয়ে এলো জল। ‘আমি তোকে খুব ভালোবাসিরে কিড্ডো...খুউউউব।’
সুড়ঙ্গের খাঁজের ভেতরে, ক্যাপ
স্টোনের সোনালি আলোর আভায় , গুমড়ে গুমড়ে কাঁদতে থাকলো জ্যাক ওয়েস্ট জুনিয়র । সেই
ছোট্ট ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটার জন্য যাকে সে গত দশবছর ধরে আগলে আগলে রেখেছে।
‘আমিও তোমায় ভালোবাসি
ড্যাডি...’ একটা কোমল স্বর ভেসে এলো কাছ থেকেই ।
ওয়েস্ট চমকে তাকালো বড় বর চোখে
। দেখল লিলি তাকিয়ে আছে ওর দিকেই । মাথাটা একপাশে কাত হয়ে আছে । চোখ কুঁচকে আছে আলোর ছটায় ।
বেঁচে আছে এবং হাসছে ওয়েস্টের
দিকে চেয়ে ।
‘তুই বেঁচে আছিস...’ ওয়েস্ট
অবাক হয়ে বলে উঠলো । ‘তুই বেঁচে আছিস কিড্ডো!’
হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁলো...চেষ্টা
করলো দুহাতে আঁকড়ে ধরার ।
‘এটা কি করে সম্ভব ...?’ ওয়েস্ট
চিৎকার করে উঠলো ।
‘আমি তোমাকে পরে বলবো সেটা,’
লিলি উত্তর দিলো। ‘তার আগে এখান থেকে প্লিজ আমাকে বের করো!’
‘অবশ্যই... ঠিক ঠিক ...’ একটা
বড় মাপের শ্বাস নিয়ে বললো ওয়েস্ট ।
কয়েক মিনিট বাদে আটটা বিশাল
রেট্রো থ্রাস্টারের সহায়তায় হ্যালিকারনাসসাস সোজা খাড়া হয়ে আকাশে উঠে গেল ।
নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠে যাওয়ার
পর মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে সঠিক উড়ান ভঙ্গীতে ফিরে এলো স্কাই মনস্টারের দক্ষ নিয়ন্ত্রনে
। তারপর রেগুলার ইঞ্জিনগুলো চালু করার আগে কিছু টা পথ ধেয়ে গেল সামনের দিকে উড়ান শুরুর ভঙ্গীমায়
। চালু হলো আসল ইঞ্জিনগুলো । হ্যালিকারনাসসাস গিজা অধিত্যকার পিরামিডদের পেছনে
ফেলে এগিয়ে চললো সামনের দিকে।
সুবিশাল পিরামিড দাঁড়িয়ে থাকলো
ওদের পেছনে । আধা ধ্বসে যাওয়া প্ল্যাটফর্ম ঝুলে থাকলো ওটার মাথায় । ভাঙা চোরা
আমেরিকান হেলিকপ্টার আর ক্রেনের ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠছে ধোঁয়া । আমেরিকার সাহায্যপ্রাপ্ত ইজিপশিয়ান সরকারকে এবার এই জঞ্জাল পরিষ্কার
করতে হবে ।
গুরুত্ব পূর্ণ আর একটা ব্যাপার
গিজার পিরামিডের উচ্চতা আবার আগের মতোই নয় ফুট কমে গেছে ।
ওয়েস্ট আর ওর দল পুরো ক্যাপ
স্টোনটাকেই সাথে করে নিয়ে গেছে।
হ্যালিকারনাসসাসের ভেতরে মেইন
কেবিনে ওয়েস্ট সহ সকলেই হাজির । মধ্যমণি
লিলি। এক এক করে সবাই ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, চুমু খাচ্ছে , পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে।
পুহ বিয়ার ওকে দুহাতের ভেতরে
জড়িয়ে ধরে বললো , ‘দারুন দারুন! খুব ভালো... মাই ইয়ং লেডি!’
‘তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ পুহ
বিয়ার। আমাকে বাঁচাতে ফিরে আসার জন্য।’
‘আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার
কথা ভাবিনি সোনা ।’
স্ট্রেচ এগিয়ে এসে বললো, ‘আমিও
কিন্তু ভাবিনি লিলি।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে স্ট্রেচ
ঝুলন্ত উদ্যানে আমাকে বাঁচানোর জন্য । চাইলেই তুমি চলে যেতে পারতে ওদের সাথে ।’
স্ট্রেচ কিছু না বলে সামান্য
মাথা ঝুঁকালো, লিলি এবং অন্যদের দিকে
তাকিয়ে। বিশেষ করে পুহ বিয়ারের দিকে নজরটা রেখে। ‘সুযোগ সাধারণত কমই আসে,’ বললো
স্ট্রেচ, ‘কিন্তু যখন সেটা তোমার জীবনপথে এসে দাঁড়ায় তখন তোমাকে একটা দিককেই বেছে
নিতে হয় । বেছে নিতে হয় সেই দিকটাকে যার জন্য তুমি লড়াইটা করছো । আমিও
বেছে নিয়েছিলাম লিলি...সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমার সাথে থেকে যুদ্ধটা করার । খুব
কঠিন ছিল সিদ্ধান্তটা নেওয়া । কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম ওটাই ছিল সঠিক পথ বেছে
নেওয়ার জন্য।’
‘একদম সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল ,’
পুহ বিয়ার বললো, স্ট্রেচের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে । ‘তুমি সত্যিই একজন ভালো মানুষ হে
ইজ্রায়েলী ...না মানে ইয়ে স্ট্রেচ। আমি সম্মানিত বোধ করছি তোমার বন্ধু হতে পেরে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ,’ স্ট্রেচ বললো এক মুখ
হাসি নিয়ে । ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ বন্ধু ।’
একে অপরের পিঠ চাপড়ানো শুভেচ্ছা
শেষ হলো এক সময়। ওয়েস্ট ছটফট করছিল জানার জন্য লিলি কিকরে বেঁচে গেল ক্যাপস্টোনের
ভেতরে থেকেও ।
‘আমি নিজের ইচ্ছায় ওটায়
ঢুকেছিলাম,’ লিলি বল লো ।
‘বুঝলাম না কি বলতে
চাইছিস,’ওয়েস্ট বললো।
লিলি হাসলো, সে হাসিতে মিশে আছে
নিজের প্রতি গর্ব। ‘যে আগ্নেওগিরি কক্ষের ভেতর আমার জন্ম হয়েছিল তার দেওয়ালে লেখা
ছিল কথাগুলো । তুমি নিজেই তো একদিন এটা পরে শুনিয়েছিলে। ওটায় লেখা ছিল –
“ স্বইচ্ছায়
প্রবেশ করো আনুবিসের আলিঙ্গনে, তবেই তুমি বেঁচে থাকবে রা’য়ের আগমনের পরেও ।
ইচ্ছার
বিরুদ্ধে যদি প্রবেশ করো , তোমার লোকজনেরা এক হাজার বছর ধরে শাসন করবে সব কিছু ।
কিন্তু তুমি বেঁচে থাকবে না ।
ভেতরে
যদি একেবারেই প্রবেশ না করো না, তাহলে এ জগতও থাকবে না।”
‘ইজিপশিয়ানদের
মতোই আমরাও ভেবেছিলাম এটা দেবতা হোরাসের উদ্দেশ্যে লেখা একটা বানী মাত্র। মৃত্যুকে
বরন করো এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে কিছু লাভ করো ধরনের বিষয়। কিন্তু ভাবনাটা ভুল
ছিল। এটা আসলে আমার এবং আলেকজান্ডারের উদ্দেশ্যে লেখা – বা বলা যায় অর্যাকলদের
জন্য উপদেশ। এর অর্থ আদপেই স্বইচ্ছায় মৃত্যু বরন নয় । এর অর্থ ক্যাপস্টোনের নিচের
ওই ফাঁকে প্রবেশ করা । আনুবিসের আলিঙ্গনকে বরন করা, স্বইচ্ছায়।
‘আমি
যদি নিজের ইচ্ছায় ওখানে প্রবেশ করি , আমি বেঁচে থাকবো । আমি যদি ইচ্ছের বিরুদ্ধে
প্রবেশ করি আমি মারা যাবো । আর যদি না যেতাম , ওই প্রথা পালনের আচার পালন
না হতো তাহলে তোমরা সবাই মারা যেতে। আর সেটা আমি হতে দিতে পারিনা । কারন আমি চাই
না আমার পরিবারের কেউ মারা যাক। ’
‘আর
তার জন্য যদি জাঈদ অনন্ত ক্ষমতা পেয়ে যায় তো যাক তাতেও যে ক্ষতি হতে পারে এটা মনে হয়নি ?’ পুহ বিয়ার প্রশ্নটা ছূঁড়ে দিলো ।
লিলি
ঘুরে তাকালো পুহ এর দিকে, চকচকে চোখে,
হাসি মুখে।
‘মিঃ
জাঈদ কোনো দিনই শাসনের অধিকার পাবে না
বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম,’ লিলি উত্তর দিলো। ‘যখন ওই লোকটা আমাকে চেপে ধরে আমি ওর জেড
পাথরের বাক্সের ভেতরের জিনিষটাকে দেখতে পেয়েছিলাম।’ লিলি ঘুরে তাকায় ওয়েস্টের দিকে । ‘দেখেই
চিনতে পারি ওটাকে। কারন এর আগে আমি ওই জিনিষটা অনেকবার দেখেছি । খুব কৌতূহল ছিল ওটা কি
সেটা জানার । ড্যাডির স্টাডী রুমে একটা কাঁচের জারে ওটা রাখা থাকতো । মিঃ জাঈদের
বাক্সের ভেতরে ওটা দেখে আমার চিনতে অসুবিধা হয়নি । ফলে খুব সহজেই বুঝে যাই এ থেকে
মিঃ জাঈদের অন্তত কোনো লাভ হবে না।’
পুহ
বিয়ার জানতে চাইলো, ‘এই ব্যাপারটা ডেল পিয়েরোও কি জানতো? এর জন্যই কি সে
আলেকজান্ডার কে এক শাসকের মতো করে বড় করছিল ? চেয়েছিল সব বুঝে আলেকজান্ডার যাতে
নিজের ইচ্ছেতে ওখানে প্রবেশ করে ?’
‘মনে
হয় সেটাই কারন,’ ওয়েস্ট বললো। ‘কিন্তু আর কিছু ব্যাপার আছে এর সাথে। ডেল পিয়েরো একজন যাজক ।
ফলে ওর ভাবনাও যাজকদের মতোই এগিয়েছে। আলেকজান্ডার ওই প্রথা পালন করে বেঁচে থাকুক
এটা মোটেই বেঁচে থেকে শাসন করবে এই ভাবনা থেকে করেনি। ডেল পিয়েরোর আসলে দরকার ছিল
এক নতুন রক্ষক...এক এমন অলৌকিক চরিত্র যাকে সামনে রেখে আসলে ও নিজেই শাসন চালাবে ।
বলতে পারো এক নতুন যীশু ।’
এসবের
মাঝে , উইজার্ড কেবিনের এক কোনায় বসে ছিল , নির্বাক, মাথা ঝোঁকানো । জো বসে ছিল ওর
কাছে , ধরেছিল হাত । সে নিজেও হতবাক হয়ে গেছে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর জেনে । বিগ
ইয়ার্স।
লিলি
এগিয়ে গেল ওদের দিকে। ওদের কাঁধে হাত রাখলো ।
‘উইজার্ড,
ডরিসের কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । আমি বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট,’ এমন একটা সুরে কথা গুলো
লিলি বললো মনেই হল না কোনো দশ বছরের মেয়ে বলছে । ‘জো, বিগ ইয়ার্সের জন্য তোমার
অবস্থাও অনুভব করতে পারছি।’
উইজার্ডের
ভিজে ভিজে লাল চোখ আর সামলাতে পারলো না নিজেকে ... গাল বেয়ে নেমে এলো জলের ধারা
... কিছুক্ষন আগেই প্ল্যাটফর্মের ওপর ওয়েস্টের মুখ থেকেই জানতে পেরেছে জুডার হাতে ডরিসের
শেষ হয়ে যাওয়ার খবরটা ।
‘উনি
আমাদের বাঁচাতে নিজের প্রান দিয়েছেন,’ লিলি বললো। ‘বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওখান থেকে
পালাতে হবে । নিজের জীবন দিয়ে দিলেন যাতে আমরা পালাতে পারি ।’
‘৪৫ বছর ধরে আমরা একসাথে জীবন কাটিয়েছি,’ উইজার্ড বললেন।
‘সবচেয়ে সেরা মহিলা যার দেখা আমি পেয়েছিলাম এ জীবনে । ওই ছিল আমার জীবন, আমার
পরিবার, আমার সবকিছু ।’
‘সত্যিই
খুব খারাপ লাগছে,’ লিলি বললো ।
উইজার্ডের
একটা হাত নিজের দুহাতে ধরে সোজা মানুষটার চোখের দিকে
তাকিয়ে বললো, ‘তবে আপনি যদি সুযোগ দেন, আমি এখন থেকে আপনার পরিবারের একজন হতে
পারি।’
উইজার্ড
অশ্রুভেজা চোখে তাকালেন লিলির দিকে...মাথা ঝুঁকালেন সম্মতির ভঙ্গীমায় । ‘এটা আমার
কাছে দারুন একটা পাওয়া লিলি । আমি খুব শান্তি পেলাম ।’
কয়েক
ঘণ্টা বাদে , হ্যালিকারনাসসাসের পেছন দিকে নিজস্ব অফিস ঘরে ওয়েস্টকে একা বসে থাকতে
দেখলেন উইজার্ড ।
‘জ্যাক,
তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে,’ উনি বললেন। ‘এসবের আর কি মানে থাকলো উত্তর দাও?
আমরা এই মিশন শুরু করেছিলাম শান্তির প্রথা পালনের উদ্দেশ্য নিয়ে । কিন্তু সেটা তো
শক্তি আহরণের প্রথাতেই শেষ হলো – তোমার দেশের পক্ষে । অস্ট্রেলিয়ানদের ওপর ভরসা
করা যায় কি এতো বড় শক্তির বিষয়ে ?’
‘ম্যাক্স,’
ওয়েস্ট বললো, ‘আপনি ভালো করেই জানেন আমি কোথা থেকে এসেছি । ভালো করেই জানেন আমাদের
পছন্দ অপছন্দের বিষয়ে। আমরা আগ্রাসি মানসিকতার বা যুদ্ধবাজ নই । তাছাড়া আমার দেশের মানুষেরা জানেও না তারা শক্তিটা পেয়েছে ।
যার ফলে এটাই তো সবচেয়ে ভালো হবে এবিষয়ে – কারন আমরাই এ পৃথিবীতে একমাত্র দেশ যারা
ওই শক্তি ব্যবহার করতে আগ্রহী নই।’
উইজার্ড
কথাগুলো বুঝে মাথা নাড়লেন ইতিবাচক ভাবে।
‘যদি
আপনি না চান আমি কোনো দিন ওদেরকে জানাবো না এ বিষয়ে ।’
‘তবে
তাই হোক। ভদ্রলোকের চুক্তি। থ্যাঙ্ক ইউ জ্যাক। অনেক ধন্যবাদ।’
দুজনের
মুখেই ফুটে উঠলো হাসি ।
হ্যালি
কারনাসসাস আকাশের বুক চিরে ভেসে চললো...কেনিয়ার দিকে ... ওদের বাড়ীর পথে ।
০০০০০০০০০০০০০
ও’
শিয়া ফার্ম
কাউন্টি
কেরি, আয়ারল্যান্ড
৯ই এপ্রিল,
২০০৬, বিকেল সাড়ে চারটে
০০০
দশ
বছরে দ্বিতীয়বার, পাহাড়ের মাথার ওপরে অবস্থিত আটলান্তিক মহা সাগরের দিকে মুখ করে
থাকা সেই পুরোনো ফার্ম হাউসটায় আবার একবার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হচ্ছে ।
কিছু
মুখ বদলেছে । কিন্তু বদলায়নি ন’টা দেশের প্রতিনিধিত্ব । বরং এবার একটা নতুন দেশের
প্রতিনিধি এখানে যুক্ত হয়েছে । ইজ্রায়েল।
সেখ
আনজার আল আব্বাস, গর্জে উঠলেন, ‘ওরা আবার দেরী করছে। আবার!’
কানাডিয়ান
প্রতিনিধিরা –আগেরবারের মতোই – জানালো, ‘চিন্তা নেই। ঠিক এসে যাবেন ওরা।’
একটা
দরজার পাল্লা আছড়ে পড়ার শব্দ ভেসে এলো, আর একটু বাদেই আলোচনা কক্ষে প্রবেশ করলেন
ম্যাক্স টি এপ্পার।
জ্যাক
ওয়েস্ট অবশ্য ওর সাথে নেই ।
বদলে
ওর সাথে আছে এক নতুন সঙ্গী – একটা ছোট্ট মেয়ে।
লিলি ।
আব্বাস
জানতে চাইলেন, ‘ ক্যাপ্টেন ওয়েস্ট কোথায়?’
উইজার্ড
সবার উদ্দেশ্যে সম্মান জ্ঞাপন করে জানালেন , ‘ক্যাপ্টেন ওয়েস্ট উপস্থিত থাকতে না
পারার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। আমাদের মিশন সাকসেস ফুল হয়েছে তাই উনি ধরে নিয়েছেন এই
আলোচনা সভায় ওর উপস্থিত না থাকাটাকে আপনারা ক্ষমা করে দেবেন। উনি বলেছেন, উনার
কিছু কাজ বাকি আছে । অসমাপ্ত কিছু কাজ। যাই হোক আসুন আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই
এই ইয়ং লেডির সাথে । যার কাছে আমরা সকলেই কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ। লেডিজ অ্যান্ড
জেন্টলম্যান, লিলি ।’
০০০০০
এরপর উইজার্ড
গত দশ বছরের মিশনের খুঁটিনাটি পেশ করলেন ছোট্ট দেশগুলির এই বিশেষ জোটের
প্রতিনিধিদের সামনে।
অবশাই,
ওরা সকলেই বুঝতে পেরেছেন এই মিশনের সাফল্যের ফলাফল – এই পৃথিবী এখনো ঠিকঠাক আছে।
অতি শক্তিসম্পন্ন সৌর শক্তির কারনে সেখানে কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি। আমেরিকাও সুযোগ
পায়নি অপ্রতিরোধ্য শক্তি হয়ে ওঠার। মিডল ইস্টে চলতে থাকা ল অ্যান্ড অর্ডার সমস্যাই
তার প্রমান। গ্রেট পিরামিডের ওপর ঘটে যাওয়া এক অসম্ভব যুদ্ধের গল্প ছড়িয়ে গেছে
দিকে দিকে অবশ্য তাতে সুবিশাল স্থাপত্যটার
খুব একটা ক্ষতি হয়নি। । ইজিপশিয়ান সরকার অবশ্য আমেরিকার কাছ থেকে টাকা নেওয়া এবং
ওই ঘটনা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।
উইজার্ড
প্রতিনিধিদের কাছে পেস করলেন লিলির কেনিয়াতে বড় হয়ে ওঠার দিন ...ক্যাপস্টোনের
সাতটা টুকরোকে সংগ্রহ করার অভিযান... মুস্তাফা জাঈদকে দলে কিভাবে আনা হলো ...তিনটে
মর্মান্তিক ক্ষতি –নডি, বিগ ইয়ার্স এবং নিজের স্ত্রী, ডরিসের মৃত্যু... এবং গিজার পিরামিডের মাথায় চুড়ান্ত লড়াই ইত্যাদির নানান
খুঁটিনাটি বিবরণ।
একেবারে
শেষ মুহূর্তে এসে অবশ্য উইজার্ড কিছু পরিমাণ সত্য গোপন করে গেলেন প্রতিনিধিদের
সামনে।
যেহেতু
এই মিশনের সাথে বিভিন্ন দেশের স্বার্থ জড়িয়ে আছে – যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল
সূর্যের বিনাশকারী শক্তি থেকে রক্ষা পাওয়া এবং এ জগতে কোনও সুপার পাওয়ার দেশের
জন্ম না দেওয়া – উইজার্ড বললেন গ্রেট পিরামিডের ওপরে শক্তি আহরণের মন্ত্র উচ্চারিত
হয়নি। জগত শান্তির মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে।
সাথে সাথেই জানালেন কি হলো আলেকজান্ডারের । পিরামিডের ওপর যুদ্ধ শেষে ওকে সাথে করে
নিয়ে এসেছিলেন উইজার্ড। নিজের বিশেষ কিছু বিশ্বাসী বন্ধুদের কাছে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছেন
উনি। যারা ওকে সুস্থ স্বাভাবিক
একটি ছেলে হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। সাথে সাথে ওরাই ছেলেটি সাবালক হয়ে ওঠার পরেও নজর রাখবে এবং ওর
কোনো সন্তান জন্মালে তার দিকেও লক্ষ্য
রাখা হবে।
‘অতএব , লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান , আমাদের মিশন ভালভাবেই শেষ হয়েছে এটাই বলা
যায়,’ উইজার্ড বললেন। ‘এই ধরনের ঘটনা আগামী ৪৫০০ বছরে ঘটার আর সম্ভাবনা নেই । সেই
সময় যখন আসবে , আমি বলতেই পারি, তখন এই
দায়িত্ব আবারও কেউ ভালো ভাবেই সম্পন্ন করবে।’
সমস্ত প্রতিনিধিরা উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে , হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন উইজার্ডকে ।
তার পর একে অপরের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছাজনক শব্দ উচ্চারন করে এবং নিজ নিজ দেশে
ফোন করে পাঠিয়ে দিলেন সুসংবাদ।
কেবলমাত্র একজন বসে থাকলেন।
শেখ আব্বাস ।
‘উইজার্ড!’ গুঞ্জন ছাপিয়ে সোনা গেল তার কণ্ঠস্বর। ‘তুমি কিন্তু একটা বিষয়ে
আমাদের কিছুই জানালে না । ক্যাপস্টোনটা এখন কোথায় আছে?’
কক্ষে নেমে এলো নীরবতা ।
উইজার্ড আব্বাসের দিকে তাকালেন, সরাসরি চোখের দিকে। ‘ক্যাপস্টোনের বিশেষ গতি
করাটাই ক্যাপ্টেন ওয়েস্টের এখানে না আসার অন্যতম একটা কারন।’
‘ঠিক কোথায় ওটাকে লুকিয়ে রাখার কথা ভাবছে ক্যাপ্টেন জ্যাক ওটাকে?’
উইজার্ড একদিকে ঘাড় কাত করে বললেন, ‘দ্যাখো আনজার , যত কম মানুষ জানবে
ক্যাপস্টোন কোথায় রাখা হচ্ছে ততই ভালো । এই বিরাট মিশনে তুমি আমাদের বিশ্বাস করেছো । আর
একবার সেটাই করার অনুরোধ রাখছি।
‘এর সাথেই আমি তোমাকে আর একটা বিষয়েও নিশ্চিত করে দিতে চাই – ক্যাপ্টেন ওয়েস্ট
দেশের জন্য কাজ করার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। উনি চান না ওকে কেউ খুঁজে বার
করুক। তবে তুমি যদি ওকে খুঁজে বার করতে পারো , আশা করছি ক্যাপস্টোনটাকেও খুঁজে পাবে।
তবে যে এই কাজ করার চেষ্টা করবে তারজন্য আমার সহানুভুতি রইলো ।’
এই কথাগুলো আব্বাসকে খুশি করলো বলেই মনে হলো ।
ঘরের ভেতরটা আবার সরগরম হয়ে উঠলো আগের মতো ।
নিস্তব্ধ রাত মুখর হয়ে থাকলো প্রতিনিধি দের মিশন সাফল্যের সেলিব্রেশনের শব্দলহরীতে
।
পরের দিন সকালে উইজার্ড আর লিলি আয়ার ল্যান্ড ত্যাগ করলো ।
কর্ক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে প্রাইভেট বিমানে ওঠার মুহূর্তে লিলি জানতে
চাইলো , ‘উইজার্ড, ড্যাডি কোথায় গিয়েছেন?’
‘বললাম যে কালকে , কিছু অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে গেছেন।’
‘তারপর কি হবে? মানে ওই সব কাজ শেষ হলে উনি কোথায় যাবেন?’
উইজার্ড আড়চোখে তাকালেন । ‘আমি সত্যিই জানিনা লিলি । তবে এটা জেনে রাখো ।
আমাদের সবার সুরক্ষার স্বার্থে জ্যাক কাঊকেই জানাতে চায় না তার শেষ গন্তব্য কোথায়।
তবে সে এটা আমাকে জানিয়ে গেছে যে সে নাকি একবার একটা ধাঁধা তোমাকে দিয়েছিল । এমন
ধাঁধা যার সমাধান করতে পারলে সে কোথায় আছে তা জানতে অসুবিধা হবে না। অত এব এখন সব
ই তোমার হাতে সোনামণি । জ্যাককে খুঁজে বার করতে হলে তোমাকেই ওই ধাঁধার সমাধান করতে হবে।’
০০০০০০
গ্রেট স্যান্ডি ডেজারট
উত্তর – পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া
২৫শে এপ্রিল, ২০০৬, সকাল সাড়ে এগারোটা
০০০
শুন সান মরুভূমির হাইওয়ে দিয়ে চার চাকার টয়োটা ছুটে চলেছে।
পেছন দিকে বসে লিলি দেখছে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী এক রুক্ষ এলাকা । এরকম সে
আগে দেখেনি। উইজার্ড গাড়ী চালাচ্ছে । জো বসে আছে লিলির সাথে। লিলি মাথা ঝাঁকালো । না, সভ্যতার নাগালের বাইরেএরকম কোনো স্থান ওর মনে
পড়ছে না এ জগতে আছে ।
চারদিকে ন্যাড়া পাহাড়ের সারি ছড়িয়ে আছে । মরুভূমির বালি পড়ে আছে হাইওয়ের ওপরে
। রাস্তাটাকেও গিলে খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে যেন ।
এ এক অদ্ভুত রঙের বালি। লালছে কমলা । ঠিক যেমনটা দেখতে পেয়েছিল লিলি ওয়েস্টের
ঘরের কাঁচের জারে ।
একটাও গাড়ী চলাচল করতে দেখা যায়নি রাস্তাটায় গত কয়েক ঘণ্টায় । শেষ জ্যান্ত
প্রানী যা ওরা দেখেছে সেটা একটা বিরাট মাপের নোনা জলের কুমীর । একটা প্রায় শুকনো
নদীর খাতের ভেতরে । তাও ঘণ্টা দুয়েক আগে ওই নদীটার অপরের সেতুদিয়ে আসার সময়।
সেতুর শুরুতে লাগানো একটা বোর্ড থেকে ওরা জানতে পেরেছিল নদীটার নাম। স্টিক্স
নদী । নরকে এই নামের এক নদীর উল্লেখ আছে । আর কিছুটা পথ যাওয়ার পর ওরা পৌছায় একটা
তেমাথার মোড়ে। তিনটে পথ তিনদিকে চলে গেছে ওখান থেকে । বাম দিকে ৫০ মাইল দূরে
সিম্পস ন ক্রসিং। সোজা গেলে ৭৫ মাইলের মাথায় ডেথ ভ্যালী । আর ডান দিকে গেলে যে জায়গায় যাওয়া যাবে তার নাম ফ্র্যাঙ্কলিন
ডাউনস।
লিলি বললো, ‘সোজা চলুন। ডেথ ভ্যালী ।’
আরো দুঘণ্টা বাদে, এখন ও বললো, ‘এখানেই কোথাও হওয়া উচিত জায়গাটা ...’
ধাঁধাটা বার করে দেখলো –
“যেথায়
আমার নতুন নিবাস সেথায় একসাথে থাকে বাঘ আর কুমীর
খুঁজে
পেতে সেই স্থান মাঝিকে দাও অর্থ, এবার চলো সফরে কুকুরের সাহায্য নিয়ে,
মৃত্যুর
হাঁয়ের ভেতর,
নরকের
মুখ গহ্বরে ।
সেখানেই
মিলবে আমার দেখা, এক বিরাট মাপের খলনায়কের ছত্রছায়ায় ।”
‘
“মাঝিকে দাও অর্থ, এবার চলো সফরে কুকুরের সাহায্য নিয়ে ।” গ্রীক পৌরানিক কাহিনী অনুসারে পাতাল জগতে প্রবেশ করতে হলে প্রথমে তোমাকে
স্টিক্স নদী পার হতে হবে। এর জন্য মাঝিকে
দিতে হবে অর্থ এবং নিতে হবে সুযোগ
সেরবেরাস নামক কুকুরের বিরুদ্ধে । যে আসলে হেডিস এর পাহারাদার । আমরা
স্টিক্স নদী খুঁজে পেয়েছি ।’
উইজার্ড
এবং জো একে অপরের দিকে তাকালেন।
‘আর
ডেথ ভ্যালী?’ জো জানতে চাইলো, ‘ওটার কথা কি কারনে মাথায় এলো তোর ?’
‘ধাঁধার
পরের লাইন দুটো শোনো, ‘ “মৃত্যুর হাঁয়ের ভেতর,
নরকের
মুখ গহ্বরে” , এ দুটোই একটা কবিতার অংশ যা আমাকে উইজার্ড পড়িয়েছিলেন । “দ্যা চার্জ
অফ দ্যা লাইট ব্রিগেড”। কবিতায় বলা হয়েছিল লাইট ব্রিগেডের ৬০০ সদস্য “দ্য ভ্যালী
অফ ডেথ” আক্রমণ করেছিল । ডেথ ভ্যালী ।’
কয়েক
মিনিট বাদে বেশ কিছু নিচু অট্টালিকার সারি দেখা গেল গরমের তরঙ্গের মাঝ খানে ।
ডেথ
ভ্যালী শহর ।
শহরে
প্রবেশের পথের মুখেই এক আব হাওয়ার মার খেয়ে জীর্ণ বোর্ড দেখা গেল। লেখা আছে –
“ওয়েল কাম
টু ডেথ ভ্যালী... হোম অফ দ্যা মাইটি ডেথ ভ্যালী টাইগারস ফুটবল টিম!”
লিলি
বলে উঠলো, ‘সেথায় একসাথে থাকে বাঘ আর কুমীর!’
ডেথ
ভ্যালীকে দেখে মনে হচ্ছিল ভুতুড়ে শহর – চারদিকে ভাঙা চোরা কাঠের ঘর বাড়ী দাঁড়িয়ে
আছে । ধুলোয় ভরা ক্ষয়ে যাওয়া একটা রাস্তা । কবে থেকে পরিত্যক্ত পড়ে আছে ।
ওরা
কিছুক্ষণ এদিকে ওদিকে ঘোরাফেরা করলো ।
লিলি
জানলা দিয়ে চারদিক দেখছিল মন দিয়ে ...খুঁজছিল কিছু একটা ক্লু । ‘ খুঁজে বার করতে
হবে একজন বিরাট মাপের খলনায়ককে... বিরাট
মাপের খলনায়ক ... ওই তো! উইজার্ড! গাড়ী থামান!’
টানা
চলে আসা একটা গাড়ি চলার উপযুক্ত ধুলো ভর্তি পথের
প্রান্তে এসে গাড়িটা থামলো ।
এতোটাই লম্বা সেই রাস্তা যে ওর শেষে অবস্থান কারি ফার্মহাউসটাকে দেখে মনে হচ্ছে
দিগন্তরেখায় আছে ।
যেখানে
রাস্তার সাথে ওই গাড়ি চলার পথ জুড়ে আছে সেখানে একটা মরচে ধরা মেইলবক্স ঝুলছে
খুঁটির গায়ে। এরকম মেইলবক্স গ্রামীন অস্টেলিয়াতে হামেশাই দেখা যায় । এই মেইলবক্সটা
দোকান থেকে কেনা হয়নি । বাড়িতে বানানো ।
তৈরী
করা হয়েছে একটা জং ধরা তেলের পিপে এবং ট্র্যাক্টর এর পার্টস দিয়ে । দেখে মনে হচ্ছে
একটা বড় ইঁদুর ... কান এবং গোঁফও আছে ।
শুধু এই ইঁদুরের মাথায় একটা মুকুট পড়ানো আছে ।
‘মাউস
কিং ...’ একটা বড় করে শ্বাস নিলো লিলি । ‘দ্যা মাউস কিং। এটাই সেটা ।’
জো
জানতে চাইলো, ‘মানেটা কি?’
লিলি
মুচকি হাসলো । ‘মাউস কিং এক বিরাট মাপের খলনায়ক । দ্য নাটক্র্যাকার স্যুইট কাহিনীর
ভিলেন।’
ওদের
গাড়ী ধুলো ভরা পথে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চললো । অনেকটা রাস্তা চলার শেষে, মূল
রাস্তা থেকে অনেকটাই দূরে , ওরা দেখতে পেলো একটা নিচু পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ফার্ম হাউসটাকে । পাসেই একটা উইন্ড মিল আস্তে আস্তে ঘুরছে ।
একজন
মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেই বাড়ীর সামনের দালানে । পরনে জিনস আর টিশার্ট। সূর্যের আলোয়
ঝিকমিক করছে শরীরের সাথে সংযুক্ত ধাতব হাতটা । তাকিয়ে আছে এগিয়ে আসা চারচাকার
গাড়িটার দিকে ।
জ্যাক
ওয়েস্ট জুনিয়র।
লিলি
গাড়ি থেকে নেমে সোজা গিয়ে জড়িয়ে ধরলো
ওয়েস্টকে ।
‘খুঁজে
বার করতে পারলি তাহলে,’ বললো ওয়েস্ট । ‘একটু বেশি সময় লেগে গেল যদিও।’
‘কোথায়
ছিলে তুমি এতোদিন?’ লিলি জানতে চাইলো । ‘কি এমন সব কাজ বাকি ছিল যা শেষ করতে একমাস
লেগে গেল?’
ওয়েস্ট
হাসলো । ‘ তুই নিজেই এসে দেখেইনে ব্যাপারটা?’
ফার্ম
হাউসের পেছন দিকে ওদেরকে নিয়ে গেল ওয়েস্ট
। ওখানে পাহাড়ের গায়ে দেখা যাচ্ছে আছে
একটা পরিত্যক্ত খনি । হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না।
‘আজকে
দিনের শেষে, তৃতীয় ইমহোটেপ যেমন করেছিলেন ঝুলন্ত উদ্যানের ক্ষেত্রে , আমিও সেরকম
করতে চলেছি । এই খনিটার প্রবেশপথটাকে ঢেকে দেব ভুমিতধ্বস ঘটিয়ে,’ হাঁটতে
হাঁটতে ওয়েস্ট বললো। ‘আর তাহলেই কেউ
জানতেও পারবেনা কোনো দিন এখানে একটা খনি ছিল । বা সেইখনির ভেতরে কি রাখা আছে।’
খনির
একশো মিটার ভেতরে ঢোকার পর ওরা একটা চওড়া কক্ষের মতো স্থানে পৌছালো । কক্ষের ঠিক
মাঝখানে রাখা ...
...
গোল্ডেন ক্যাপ স্টোন ।
নয় ফুট
লম্বা, ঝক ঝক করছে সোনালী রঙের অদ্ভুত শিল্প কর্মটা ।
‘পুহ
বিয়ার আর স্ট্রেচ আমাকে সাহায্য করেছে এটাকে অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ে আসার জন্য। সাথে
স্কাই মনস্টার ও ছিল,’ওয়েস্ট জানালো । ‘যদিও ওদের সবাইকে আমি ফ্রীম্যান্টল এর
জাহাজঘাটাতেই বিদায় জানিয়েছি । আরো কিছু সময় বাদে ওদের সাহায্য নিয়েই আমি নিয়ে এসেছি আরো কিছু
জিনিষ যা আমরা আমাদের অভিযানের সময় দেখেছিলাম। আমার মনে হয় উইজার্ড আপনি ওর ভেতর
থেকে দু একটা জিনিষ নিজের কাছে রাখতে পছন্দ করবেন।’
ক্যাপস্টোন
থেকে কিছু দূরে অর্ধ চন্দ্রাকার ভাবে সাজিয়ে রাখা আছে প্রাচীন সপ্ত আশ্চর্যের
কয়েকটা নমুনা।
আলেকজান্দ্রিয়ার
লাইট হাউসের আয়না ।
হ্যালিকারনাসসাসের
সমাধি মন্দিরের সেই স্তম্ভ ।
যা দেখা
গিয়েছিল তিউনিশিয়াতে হ্যামিলকারের ভুলে
যাওয়া বাসস্থানের ভেতরে ।
‘উইজার্ড
ইয়ার্কির ছলে বললেন রোডসের কলোসাসের মাথাটা আনতে পারোনি?’
‘ভাবছি
দু এক মাস বাদেই ওটা আনতে যাবো , যদি আপনি আমার সাথে যেতে চান তবেই,’ ওয়েস্ট উত্তর
দিলো । ‘আমি সাহায্য করতে পারি । ওহ, আর একটা কথা জো ...’
‘ইয়েস,
জ্যাক...’
‘আমার
মনে হয় এই মিশনে দশ বছর ধরে নিরলস কাজ করার উপহার স্বরুপ এই ফুলটা পেতে তোমার ভালো
লাগবে ।’ প্রায় ম্যাজিক দেখানোর মতো করেই পেছন থেকে একটা ফুল সামনে এগিয়ে ধরলো
ওয়েস্ট ।
একটা
গোলাপ ফুল...সাদা গোলাপ ফুল ...অন্যরকম ধরনের একটা সৌন্দর্য সে ফুলের।
জো এর
চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ‘এটা তুমি কোথায় পেলে -?’
‘একটা
বাগান যা আমি একবারই দেখার সুযোগ পেয়েছি,’ ওয়েস্ট উত্তর দিলো । ‘দুঃখের বিষয় এটাই
যে ওটা যেখানে ছিল সেখানে আর নেই । তবে এই ধরনের গোলাপের জীবনীশক্তি দারুন। আমার
বাড়ির সামনের বাগানে ভালোই ডালপালা মেলেছে । ইচ্ছে আচ্ছে একটা গোলাপ গাছের সারি
বানানোর। এবার চলো এখান থেকে যাওয়া যাক। দারুন গরম এখানে। ঘরে ভালো ড্রিঙ্কসের
ব্যবস্থা আছে ।’
পরিত্যক্ত
খনি পেছনে ফেলে ওরা ফিরে এলো ফার্ম হাউসের ভেতরে । ওদের জুতো আর বুট মাখামাখি হয়ে
আছে লালছে-কমলা মাটিতে ।
এই
মাটি সত্যিই একেবারে আলাদা রক্মের...লোহা আর নিকেল সমৃদ্ধ...কেবলমাত্র এই এলাকাতেই
পাওয়া যায় । এই মুহূর্তে এই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে
... অবশ্য এই শক্তির কথা বাইরের জগত জানেই না ।
দেশের
নাম অস্ট্রেলিয়া।
0000000
***ধন্যবাদ সকল পাঠক পাঠিকাকে আমার এই
অনুবাদ পড়ার জন্য । আশা রাখছি ভালো লেগেছে ।
শীঘ্র আসছে H P
Lovecraft এর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখা The Call of CThulu এর ভাবানুবাদ
“সিথুলুর আহ্বান” । ১৫ কিস্তিতে । আশা করবো এবারেও আপনারা পাশে
থাকবেন।***