সঙ্গীহীন
প্রতিম দাস
রাতের নিস্তব্ধতা চিরে এক ভয়ালো হাড়কাঁপানো আওয়াজ ছড়িয়ে গেল চরাচরে। চাঁদের ফ্যাকাসে আলোয়, এক প্রাচীন ভবনের ধ্বংসস্তূপের কাছে বসে থাকা লোমশ দেহটা নিজের মোটাসোটা থাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। এক মিনিট বাদেই আবারও মাথা তুলে সেই একইরকম রক্তজল করা চিৎকার করে উঠল—চারপাশ যেন কেঁপে উঠল।
বেচারা সেই সন্ধে থেকে এভাবেই চিৎকার করে চলেছে লোমশ প্রাণীটা। একটা কথা বলার কেউ বা একটা খেলার সঙ্গীও নেই বেচারার। কিন্তু এতে ওর দোষ কোথায়? ও একটা ভুতুড়ে ‘সত্ত্বা’র মতোই। মৃত্যুর দরজা পার হয়ে যাওয়া এক অচেনা দানব বলেই ভাবে সবাই ওকে! সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিলাম, স্বয়ং ভূতেরাও তাকে দেখে পালিয়ে যায়। অন্ধকার নিঃসঙ্গ প্রাণীটাকে যেন গিলে খাচ্ছিল।
চাঁদের আলো দেখা গেল মেঘের ফাঁক দিয়ে। সেই আলো গায়ে মেখে তার ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে ছিল প্রাচীন জমিদারবাড়িটা। বহু বছর আগেই মানুষ এই ভবন ছেড়ে চলে গিয়েছে। আতঙ্কে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, ভূতের। যদিও সে ভুতেরা বড়ই অলস। ভয় দেখায় না। একদা ওরা চেয়েছিল তাদের বংশধরদের সঙ্গে থাকতে। কিন্তু মানুষ কী সেটা পারে! আপাতত ওটার ধুলো মলিন ঘরগুলোতে ভেসে বেড়ায় সেই তিন বুড়ো ভূতের নিশ্বাস।
দোতলায় ভাঙা কাঠের বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে ছিল শিবনাথ। লোমশ প্রাণীটার প্রথম চিৎকারটা শুনেই সে এক ঝটকায় ছেঁড়াখোঁড়া কম্বলটা মাথার উপর টেনে নিল।
নীচে, গোবিন্দ নামের আর একজন তার ভাঙা সোফা থেকে ধপাস করে পড়েই গেল।
“আবার? আবার সেই ভয়ঙ্কর চিৎকার! হতচ্ছাড়াটা কী একটু ঘুমাতে পারে না!” বিড়বিড় করে উঠল গোবিন্দ।
ওদিকে লাইব্রেরি ঘরের লুকানো কুঠরির অন্ধকার থেকে খটখট শব্দ করে বেরিয়ে এল আনন্দমোহন— কঙ্কালসার দেহ। “নিকুচি করেছে! ওই শব্দটা যেন আমার খুলির ভিতর ছুরি গেঁথে দিচ্ছে!” চেঁচিয়ে উঠল।
শেষমেশ যখন লোমশ প্রাণীটা তার চিৎকার থামাল, তিন অশরীরী নাচঘরের ধুলোমাখা অন্ধকারে একে অপরের মুখোমুখি হলো।
“একজন মৃত আত্মার পক্ষেও এটা সহ্য করা অসম্ভব,” ফিসফিস করে বলল শিবনাথ।
“শান্তিতে একটু ভৌতিক জীবন কাটাতে চাই—এটা কি খুব বেশি দাবি?” প্রশ্ন করল গোবিন্দ।
“হতচ্ছাড়াটার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে!” দৃঢ়স্বরে বলল আনন্দমোহন।
কিন্তু ওরা করবেটা কী? ও ব্যাটার চিৎকার শুনলে যে কেউ ভাববে নিশ্চিত নরকের অতল গহ্বর থেকে উঠে আসা কোনও ভয়ঙ্কর জন্তু। আর জমিদার বাড়ির এই তিন ভূত, আগেই বলেছি খুবই অলস এবং দুর্বল। কর্মচঞ্চলতা শব্দটা ওদের অভিধানেই নেই। থাকার আসলে দরকারি তো নেই। মানুষকে ভয় দেখানো ছাড়া ভূতেদের আর কোনও কাজ আছে নাকি। আর এই কাজটা করতেও ওদের অনীহা একশো শতাংশ!
গোটা চল্লিশেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে গজগজ করতে করতে অসহায়ভাবে ওরা সিদ্ধান্ত নিল, যা হয় হবে, আমরা কিছুই করব না। এ ভবন ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। একটা কবরখানার থেকেও বেশি নিস্তব্ধতা এই জমিদারবাড়িতে বিরাজ করে। আমাদের মতো ভূতেদের জন্য যেটা আদর্শ স্থান।
ঠিক তখনই আবার ওদের কানে ভেসে এল সেই আগের মতোই হাড়ে ঠকঠকি লাগান আওয়াজ - “আ-উ-উ-উ-উ...!”
শিবনাথের বুকের ভিতরটা ধক ধক করে উঠল।
“আর না… আর না! এবার থাম!”
এরকম সময়ে, একটা ক্যাঁচকেঁচে স্বর প্রশ্ন করল উপর থেকে, “হলোটা কি শুনি?”
ভয়ে ভয়ে উপরের দিকে তাকাল শিবনাথ। ভাঙা ছাদের ফুটো দিয়ে একটা হুতুম প্যাঁচা নিচে নেমে এল। “ওহ, তুমি! কবে এলে?” হাঁপ ছেড়ে বাঁচল শিবনাথ।
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্যাঁচাটা ব্যঙ্গের সুরে চোখ টিপে বলল, “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি যেন কোন মানুষকে দেখেছ!”
“মানুষ হলে এত খারাপ হতো না। তোমার কানে কি ওই জঘন্য চিৎকার ঢুকছে না?
ঘণ্টাখানেকের জন্য যদি একবার থামত!”
“সে থামতেই পারে। ভালোভাবে যদি তোমরা তাকে বলো,” প্যাঁচাটা শান্ত গলায় বলল।
শিবনাথা একথা শুনে যেন জমে গেল। “আ-আমি? ও- ওকে থামতে বলব? ওই লোমশ দানবটাকে?”
“অবশ্যই! কাউকে না কাউকে তো বলতেই হবে। সবেমাত্র তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে কাল আমি এখানে এসেছি। এর মধ্যেই আমার জান কয়লা হয়ে গেল ওই চিৎকারের ঠ্যালায়! তোমরা যাচ্ছ না কেন?”
শিবনাথ ব্যাজার মুখে বলল, “আমার সাহস নেই। অন্য দু’জনের তো প্রশ্নই নেই। আনন্দ একটা অকম্মের ধারি, আর গোবিন্দ-”
“তার মানে যা করার আমাকেই করতে হবে,” বলল প্যাঁচাটা । “ঠিক আছে, অপেক্ষা করো। দেখি কী করতে পারি।”
কিছুক্ষণ বাদেই প্যাঁচাটা ফিরে এল—কিন্তু একা নয়!
“তাড়াতাড়িই কাজটা হয়ে গেল বুঝলে!” প্যাঁচাটা চেঁচিয়ে জানাল।
কথাটা শেষ হতে না হতেই পুরনো ভবনের দেয়ালগুলো থরথর করে কেঁপে উঠল। খসে পড়ল চুন সুরকির পলেস্তারা। আবার সেই ভয়ঙ্কর চিৎকার-
“আআআউউউউউউউ!!!”
ধড়াম করে সদর দরজাটার কোনোমতে ঝুলে থাকা পাল্লা দু’টো আছড়ে পড়ল চিড় ফাটলে ভরা শান বাঁধানো মেঝেতে। একরাশ ধুলো উড়ে গেল চারদিকে ঝড়ের মতো। তার ভিতর থেকেই ছায়াছায়া শরীরটা এগিয়ে এল—
একটা অতিকায় লোমশ কুকুর।
চোখ জ্বলজ্বল করছিল দুটো লাল বলের মতো। নিঃশ্বাসের বদলে বের হয়ে আসছিল ঠান্ডা কুয়াশার স্রোত।
শিবনাথ এ দৃশ্য দেখে অদৃশ্য হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। খটখটাখট শব্দ তুলে নড়তে থাকল আনন্দমোহনের চোয়াল। গোবিন্দর চোখের কোটর থেকে ঠেলে বের হয়ে এসেছিল শুধু দুটো মণি-
এসব দেখে শুনে হুতুম প্যাঁচাটা বলল, “আরে তোমরা এত ভয় পাচ্ছ কেন। ওর আওয়াজ যতটা ভয়ঙ্কর, তার একভাগও ভয়ঙ্কর ও নিজে নয়।”
কুকুরটার চিৎকার হঠাৎ থেমে গেল। জ্বলজ্বলে চোখে একরাশ আকুলতা।
“ও বেচারা একাকিত্বের জ্বালায় কাঁদে,” প্যাঁচাটা কোমল স্বরে বলল। “ভাবো দেখি, বেচারার কেউ নেই, কোথাও থাকার জায়গা অবধি নেই—এমনকি ভূতেরাও ওকে ভয় পায়।”
আনন্দমোহন দু হাত দিয়ে চোয়ালের ঠকঠক থামিয়ে ভালো করে তাকাল। ভূতুড়ে কুকুরটাও ওর দিকে তাকাল, দৃষ্টিতে আকুলতা। সঙ্গ লাভের। কুঁইকুঁই করে আওয়াজ করল।
প্যাঁচাটা ডানা ঝাপটে বলল, “ ও বলছে একটু থাকার জায়গা চায়, একটু সঙ্গ চায়। তোমরা যা অলস দেখছি তোমাদের তিনজনের একটা পাহারাদার দরকার। আর ওর দরকার একটা পরিবার। ব্যাপারটা খুব সহজ।”
গোবিন্দ এটা শুনে বলে উঠল, “মন্দ বলোনি… যুক্তি আছে তোমার কথায়।”
এটা শুনে সেই লোমশ প্রাণীটা তার একটা থাবা তুলে সামনের দিকে নাড়াল। আস্তে করে ডাক দিল “ওউ, ও উ, ওউউউ!”
“ও বলছে আমি তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি… আর কখনও চিৎকার করব না… যদি তোমরা আমাকে থাকতে দাও।”
গোবিন্দ বলল, “ঠিক আছে… ঠিক আছে! শুধু ওই ভয়ংকর শব্দ একদম করবি না !”
শিবনাথ হাসল, “তুই চাইলে আমার বিছানার পাশে শুতে পারিস।”
এটা শুনে কুকুরটার চোখ চকচক করে উঠল। চিৎকার করে সেটা জানান দিতে যাচ্ছিল সম্ভবত, তার আগেই আনন্দমোহন চেঁচিয়ে উঠল, “অ্যাই, খবরদার একদম চিৎকার করবি না! তা সে যতই আনন্দ হোক!”
সব দেখে শুনে প্যাঁচটা বলে উঠল, “আহারে বেচারা! এ জগতে সবাই সঙ্গ চায়। পরিবার চায়, সে জীবিত হোক বা অশরীরী। এটা কবে যে সবাই বুঝবে। যাই এবার একটু শান্তিতে ঘুমাই।”
