Search This Blog

Sunday, December 7, 2025

মোস্ট নটো্রিয়াস ডাবল এজেন্ট


মোস্ট  নটো্রিয়াস ডাবল এজেন্ট

 ১৯০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। প্যারিসে রাশিয়ান বিপ্লবীদের ‘কোর্ট অফ অনার’ একজন মানুষের ‘ডাবল এজেন্ট’ পরিচয় ফাঁস হওয়ার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। এর পরেই সেই মানুষটা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। তার নিখোঁজ হওয়ার খবর বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নিউইয়র্ক টাইমস-এর শিরোনামে লেখা হয়েছিল – ‘পুলিশ অ্যান্ড রেডস বোথ হান্ট আজেফ’ ‘আজেফ কোথায়?’ সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ‘কে প্রথমে তার কাছে পৌঁছাবে? কে তাকে হত্যা করবে, রাশিয়ান পুলিশ না বিপ্লবী?’ এর মাঝেই রাশিয়ার কিছু সংবাদপত্র দাবি করে যে, তাকে ইতিমধ্যেই খুঁজে বের করে যা শাস্তি দেওয়ার সেটাই দেওয়া হয়েছে। আবার অন্য কিছু সংবাদপত্র মানুষটাকে উরুগুয়ে, ভিয়েনা, সিম্ফেরোপল এবং নিসে দেখা গিয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ব্রিটেনের ইভিনিং নিউজ’ এক পা এগিয়ে লন্ডনের এক হোটেলে তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার দাবিও জানায়। সেই সাক্ষাৎকার নিশ্চিতভাবেই কাল্পনিক ছিল, কিন্তু ওই মানুষটার কৃতিত্ব তাতে খাটো করা যায় না। ওই সময় অবধি মানুষটা ছিল কোনও পুলিশ বিভাগের হয়ে কাজ করা সবচেয়ে সফল ‘ডাবল’ এজেন্ট। রাশিয়ায়, এরকম কাজ করা মানুষেরা খুব বেশি হলে দু’ থেকে তিন বছর কাজ করতে পারত ধরা পড়ার আগে অবধি। সেখানে আজেফ পনের বছর ধরে সফলভাবে দু’পক্ষের হয়েই কাজ করে গিয়েছিল। ধরা পড়ার সময় তার মাসিক আর্থিক প্রাপ্তির পরিমাণ ছিল এক হাজার রুবল

কে এই আজেফ?

তাকে বলা হয় মোস্ট নটোরিয়াস ডাবল এজেন্ট

ইয়েভনো আজেফ। জন্ম ১৮৬৯ সালে লিস্কাভায় এক দরিদ্র ইহুদি দর্জির পরিবারে। সাত সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। দেখতে ছিল অত্যন্ত সাধারণ। ছোটো থেকেই বিন্দুমাত্র দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো চেহারা ছিল না তার। সম্ভবত এটাই তাকে সুযোগ করে দিয়েছিল বিনা সন্দেহে এরকম কাজ করার ক্ষেত্রে। ১৮৯০ সালে পড়াশোনা শেষে সাংবাদিক ও ভ্রাম্যমাণ সেলসস্ম্যানের কাজ শুরু করে। পুলিসের বয়ান অনুসারে আজেফ, অনেক তরুণ রাশিয়ান ইহুদির মতোসরকারবিরোধী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এমন একটা দলে যোগ দে যেখানে ভিন্নমতাবলম্বী সাহিত্য নিয়ে আলাপ আলোচনা করা হতো। পুলিশ সেই দল ভেঙে দেয় এবং কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। পরিস্থিতি দেখে আজেফ ভয় পেয়ে আটশো রুল চুরি করে এবং জার্মানির কার্লসরুহ-তে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে যায় ড্যামস্ট্যাডে।

১৮৯২ সালে জার্মানিতেই আজেফ তার দ্বৈত জীবন শুরু করে। ইউরোপের এলাকায় তখন অনেক রাশিয়ান বিপ্লবী রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত হয়ে জীবনযাপন করছিলেনরাশিয়ান সিক্রেট পুলিশ সংস্থা ওখরানার কর্মীরা ওদের দিকে সতর্ক নজরদারি বজায় রেখেছিল। তরুণ ‘বিপ্লবী’ আজেফের অবস্থা তখন শোচনীয়। অর্থ নেই, খাবার জুটছে না। সিদ্ধান্ত নেয় যে সমস্ত বিপ্লবীপন্থী মানুষদের ও দেখতে পায় তাদের গতিবিধির খোঁজখবর জানাবে পুলিসকে। পুলিশ বিভাগ আজেফের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারে সত্যিই এর পক্ষে এ কাজ সম্ভব। তাকে কাজে বহাল করে।

সাতবছর কেটে যায় এরকম টুকটাক কাজ করতে করতে। ১৮৯৯ সালে, ওখরানা [রাশিয়ান সিক্রেট পুলিস] নির্দেশে, আজেফ রাশিয়ায় ফিরে যায়। ওকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মস্কোর বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করার। নিজের বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে ‘নর্দার্ন ইউনিয়ন অফ সোশ্যাল রেভোলিউশনারিজ’ এর নেতা আন্দ্রেই আরগুনভের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠে সে। ওর কাছে সহজেই এসে যায় এই সংগঠনের একাধিক সদস্যর নামপুলিশ সহজেই ওইসব বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করে।

১৯০১ সালে নিজের সংগঠনের হাল দেখে আজেফকে আরগুনভ তার ফরেন নেটওয়ার্কের প্রধান নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। আজেফের পোয়াবারো হয় এর ফলে। বিপ্লবী আন্দোলনের নানান তথ্য সে পাঠাতে থাকে পুলিস বিভাগে। কাজ দেখে সন্তুষ্ট হয়ে আজেফের মাসিক প্রাপ্তি পঞ্চাশ থেকে বেড়ে পাঁচশো রুবল হয়। এভাবেই আজেফ নজরে পড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভায়াচেস্লাভ প্লেহভের।

১৯০ সালে আজেফ আরেক বিপ্লবী গোষ্ঠী, ‘সোশালিস্ট রেভোলিউশনারী’ সংগঠনের সদস্যপদ পায়। ‘ফাঊন্ডিং মেম্বার’ ছিল সে। এই সংগঠনের সামরিক শাখা, কমব্যাট অর্গানাইজেশনসন্ত্রাসবাদ এবং হত্যাকেই বেশি গুরুত্ব দিত তাদের কাজের পদ্ধতি হিসাবে। ‘সোশালিস্ট রেভোলিউশনারী’র এক সদস্য প্লেহভের পূর্বসূরীকে একটা চিঠি দেওয়ার ছল করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল। ওই চিঠিতে ওই সংগঠন তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, সেটাই লেখা ছিল।

 সোশালিস্ট রেভোলিউশনারী’ এর কমব্যাট অর্গানাইজেশন’ এর ডেপুটি কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় আজেফকে। এই ব্যপারটা আজেফকে এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। যতদিন সে সাধারণ সদস্য ছিল খবর পাচার করতে অসুবিধা হয়নি। সংগঠনের নেতৃত্ব পাওয়ার পর সেই কাজ করাটা অনেকটাই সমস্যাজনক হয়ে পড়ে তার পক্ষে।

 যদিও আজেফের এই পদপ্রাপ্তি দেখে প্লেহভের মনে হয় ওই সংগঠনের দিক থেকে তার আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। "আমার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র," প্লেহভ এক ফরাসি সংবাদপত্রকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেছিলেন। কিন্তু সোশালিস্ট রেভোলিউশনারী র সদস্যরা ইতিমধ্যেই তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল।নিজেকে বাঁচানোর জন্য আজেফ এই হত্যা পরিকল্পনার ব্যবহারিক দিকগুলোর দায়িত্ব অন্য সদস্যদের কাঁধে চাপিয়ে দেয়। নিশ্চিত করে, যা ঘটছে বা ঘটবে তার বিস্তারিত তথ্য সম্পর্কে তার কিছুই জানা ছিল না এটাই যেন প্রমাণিত হয়। [যদিও মনে করা হয় এই হত্যা পরিকল্পনাও সাজিয়ে ছিল আজেফ নিজেই। গ্র্যান্ড ডিউক সেরগেই আলেজান্দ্রোভিচ কেই হত্যার পরিকল্পনা করেছিল এই আজেফ। যা সফল হয়। ] উল্টোদিকে বিপ্লবীদের বিষয়ে পুলিশকে সাধারণ এবং অস্পষ্ট তথ্য সরবরাহ করতে থাকে। জানিয়ে দেয় একটা গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসী হামলা ঘটতে চলেছে নাম না জানিয়ে এমন কিছু মানুষের বিষয়ে তথ্য জানায়, যারা ছিল বিপ্লবী সংগঠনের নিচুস্তরের কর্মী। রাস্তায় যাদের পিছু নিয়ে পুলিস সহজেই গ্রেপ্তার করে। ফলে সংগঠনের সদস্যদের মনে হয় এটা নিছক দক্ষ পুলিশি নজরদারির ফলাফল। কেউ ভাবতেই পারেনি কেউ তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এছাড়াও নানান অছিলায় প্লেহভের উপর আক্রমণ করার দিন পিছিয়ে যেতে থাকে আজেফ। কিংবা, প্লেহভের গতিবিধি সম্পর্কে ভুল তথ্য সরবরাহ করে। প্লেহভকে বাঁচিয়ে রাখার এই চেষ্টা করে গিয়েছিল একটাই কারণে- ভালো করেই জানত ওই মানুষটার কারণেই সে নিরাপদে এভাবে কাজ করতে পারছে।

কিন্তু ওই যে বলে ভাগ্য। চাইলেও সবকিছু আটকানো যায় না। ১৯০৪ সালের জুলাই মাসে, আজেফ ওয়ারশ থেকে অন্য এক জায়গায় গিয়েছিল বিশেষ কাজে। ওই সময় তার বিপ্লবী সংগঠনে এক সদস্য সেন্ট পিটার্সবার্গের মধ্য দিয়ে যেতে থাকা প্লেহভের গাড়িতে বোমা মারে। বিস্ফোরণে প্লেহভ ছাড়াও চালক এবং ঘোড়াগুলোও মারা যায়। এই সফল হত্যাকাণ্ডর সূত্রে সোশালিস্ট রেভোলিউশনারী’দের বিপ্লবী মহলে মর্যাদা বেড়ে গিয়েছড়িয়া

আজেফের রক্ষক প্লেহভের মৃত্যু কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আজেফের জন্য একদিক থেকে আশীর্বাদেই পরিণত হয়েছিল। দলের নেতা হিসাবে এটা তার খ্যাতি বাড়িয়ে দেয়। হঠাৎ করেই যখন পুলিশের সাথে তার যোগাযোগ সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, তখন বিপ্লবী মহলে একটা কথা ভাসতে থাকে, তাই যদি হবে, তাহলে প্লেহভকে হত্যার আদেশ কী করে জারি হলো?’ যদিও অনেকেই আজেফের চালচলনকে বিশ্বাস করতেন না। ভ্লাদিমির বার্টসেভ নামে একজন একগুঁয়ে সাংবাদিক আজেফের কার্যকলাপের প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তার নানান ‘সোর্স’ ব্যবহার করেছিলেন। সেই সূত্রে যা প্রমাণ মেলে তা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আজেফের গতিবিধির নানান খবর। তবুও আজেফের সোশালিস্ট রেভোলিউশনারী দলের সহকর্মীরা এসব কথা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে। এমনকি বার্টসেভের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে, আজেফকে কালিমালিপ্ত করার জন্য পুলিশের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে উনি এসব করছেন।

কিন্তু বার্টসেভের কাছে এমন অনেক প্রমাণ ছিল, যার ভিত্তিতে তাকে বিচারসভার সামনে হাজির হতে হয়। সেসব অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য। প্যারিসে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সোশালিস্ট রেভোলিউশনারী দলের তরফ থেকে এক কমিটি গঠন করা হয়। নানান তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা - যারা সকলেই ছিলেন আজেফের দীর্ঘদিনের সহকর্মী – তারা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন যে, সমস্ত অভিযোগ সত্যি। আজেফ প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাসঘাতক। এসব সত্ত্বেও আজেফ সেই কমিটিকে কোনওভাবে রাজি করায়, তাকে রাশিয়া ফিরে যেতে দেওয়ার জন্য, যাতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার উপযুক্ত নথি পেশ করতে পারে। বলেছিল জলদিই গুলো নিয়ে ফিরে আসবে। ওই রাতেট্রেনে চেপে পালায় আজেফ। স্ত্রী লিউবা ম্যাঙ্কিনকে বলেছিল ভিয়েনা পৌঁছে চিঠি পাঠাবে। ওই সময় তার কাছে ছিল রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ দ্বারা জারি করা একটা জাল পাসপোর্ট এবং আর প্রচুর অর্থ। বছরের পর বছর ধরে এরকম একটা দিন আসতে পারে জেনেই আজেফ ওই অর্থ জমিয়েছিল।

আজেফের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে দলের সেন্ট্রাল কমিটি । চেষ্টা করা হয় ফ্রান্সের এক নির্জন ভিলায় তাকে নিয়ে এসে কাজ সম্পন্ন করার। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। সেদিন আজেফ মোটেই ভিয়েনা যায়নি। গিয়েছিল তার জার্মান উপপত্নীর গ্রাম ফ্রিডরিচসডর্ফে। কর্মজীবনের মতোই ব্যক্তিগত জীবনেও আজেফের গোপন পরিবার ছিল। এই মহিলার নাম হেডি ডে হিরোএকজন ক্যাবারে গায়িকা, সেন্ট পিটার্সবার্গে যাকে অনেক মানুষই চিনতেন

সংবাদপত্রের হৈচৈ থেমে যাওয়ার পর, আজেফ এবং হেডি ইউরোপ ভ্রমণ শুরু করে। এটাকে , এক ধরণের মধুচন্দ্রিমা যাপন বলাই যায়। হেডিকে দামি দামি গয়না কিনে দেয় এবং নিজে মেতে ওঠে জুয়া খেলায়। যে হোটেলেই আজেফ ঘর ভাড়া নিত, সেখানে থাকা মানুষদের তালিকা পরীক্ষা করে দেখে নিত। সবসময় ভয় পেত সোশালিস্ট রেভোলিউশনারী র সদস্যরা হয়তো তার পিছু নিয়েছে ।

এই সময়ে স্ত্রীকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছিল বলে জানা যায়। যেখানে জানিয়েছিল পুলিসকে সে যত না সাহায্য করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছে বিপ্লবীদের জন্য। আশা করেছিল, স্ত্রীকে লেখা এই সব কথা দলের কাছে পৌঁছাবে এবং তারা তাকে ক্ষমা করে দেবে। তার স্ত্রী অবশ্য তার এই দ্বৈত জীবনের কথা জানতন না বলেই জানিয়েছিল এবং সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকা চলে যায়।

এভাবে দীর্ঘ সময় ঘুরে বেড়ানোর পর আজেফ এবং হেডি বার্লিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেযেখানে তাদের পরিচয় ছিল মিস্টার এবং মিসেস নিউমায়ার হিসেবে১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অবধি ওরা বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু সমস্য হলো আর্থিক ব্যাপারে। পুঁজি খুব একটা কমেনি, কারণ স্টক মার্কেটে অর্থ লগ্নী করত আজেফ।। সেসব ভালো পরিমাণেই ছিল আজেফের কাছে। কিন্তু তার পুঁজির বেশিরভাগটাই ছিল রাশিয়ান বন্ড, যা হঠাৎ করেই ওই সময়ের জার্মানিতে প্রায় মূল্যহীন হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে আজেফ একটা ছোট্ট দোকানে হেডির সেলাই করা পোশাক বিক্রি করা শুরু করে।

১৯১৫ সালে জার্মান কর্তৃপক্ষ আজেফকে একজন বিপজ্জনক বিদেশী শত্রু হিসেবে গ্রেপ্তার করে। স্যাঁতস্যাঁতে কারাগারে থাকার সময় কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে আজেফ। ১৯১৭ সালে অসুস্থতার কারণে মুক্তি পা। এর কিছুদিন বাদে ১৯১৮ সালের ২৪শে এপ্রিল মারা যায় সে। ফ্রিডফ উইল্মার্সডফ এর নামহীন এক কবরে তাকে সমাহিত করা হয়। সে কবর কোথায় সেটা কেবলমাত্র হেডিই জানতেন।

 ১৯১৮ সালের বসন্তকাল - রুশ বিপ্লব সাফল্য লাভ করে। এমন এক বিপ্লব যাকে সফল এবং অসফল দুটো কাজ করার জন্যই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল বলা যায়।

 ০০০০০০

ইয়েভনো আজেফ সেই অর্থে অসাধারণ কোনও গুপ্তচরও ছিল না, প্রতারণার কাজেও সেই অর্থে ওস্তাদ ছিল না - তাহলে এতদিন ধরে তার দ্বৈত জীবন কীভাবে চালিয়ে গিয়েছিল?

মধ্যমপন্থা বলে একটা শব্দ আছে। আজেফকে সেটাই বাঁচিয়ে দিয়েছিল। শুরু থেকেই সে ছিল পরিশ্রমী মানুষ। এমনভাবে কাজ করত পুলিশ এবং বিপ্লবী উভয়ের জন্যই কিছু না কিছু সাফল্য এনে দিত। এই ছোটো ছোটো সাফল্য উভয় পক্ষর কাছেই বাড়িয়ে দিয়েছিল তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও সদিচ্ছার মাত্রা। আজেফ নিজের হাতে কখনও বোমা বা বন্দুক চালায়নি। সন্ত্রাসবাদের মতো কাজ করার বুকের পাটা তার ছিল না। রাজনৈতিকভাবে ছিল উদাসীন - বিপ্লবে আগ্রহী ছিল না, আবার জার শাসনের প্রতিও নিবেদিতপ্রাণ ছিল না। উভয় ক্ষেত্রেই একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে চেয়েছিল । সেই অর্থে কোনও আদর্শ অনুসরণ করত না বলে স্পষ্টতই বিবেকের কোনও যন্ত্রণা অনুভব করত না। এই জটিল আনুগত্য তাকে কেবলমাত্র তখনই সমস্যায় ফেলে দিত যখন আজেফ বুঝত তার নিজের নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। আজেফের মানসিকতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিওন ট্রটস্কি বলেছিলেন - ‘চতুর হওয়া এবং সূক্ষ্মতার সঙ্গে কাজ করা মানেই সবসময় সুবিধাজনক পরিস্থিতি নয়। আজেফ যদি সূক্ষ্মতা মেশানো কার্য পদ্ধতির জাল বোনার চেষ্টা করত, তাহলে সে নিশ্চিতভাবেই নিজের জালে জড়িয়ে পড়ত। শারীরিক এবং মানসিক স্তরে সে কতটা নিচ প্রবৃত্তির সেটা সবাইকে বুঝতে দিয়েই কাজ করে গিয়েছিল সবসময়। সকলেই তার সহজ সরল কাজের পদ্ধতি দেখে ভেবেছে, এ যা করে তাতে কোনও ভুল থাকে না। আর এটাই ওকে ঢাল হয়ে বাঁচিয়ে দেয়

শুরুতে যে ইভিনিং নিউজের সাক্ষাৎকারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আজেফ নাকি বলেছিল, “আমি তো আমার নীতি থেকে ভ্রষ্ট হইনি, কারণ আমার কোনোদিনই কোনও নীতি ছিল না। একজন বিপ্লবী এবং একজন গুপ্তচর হিসেবে আমি আমার আমার অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় সবসময় পেশ করেছি...’ এই বয়ান সত্যি হোক বা মিথ্যে এটা কিন্তু ট্রটস্কির বিশ্লেষণের সঙ্গে ভালোভাবেই খাপ খায়।

০০০০

একাধিক বই লেখা হয়েছে এই মানুষটাকে নিয়ে। সেসব থেকে এবং রিডার্স ডাইজেস্ট থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই নিবন্ধ লেখা হয়েছে।

ছবি সৌজন্য ইন্টারনেট

 

 


 

Tuesday, November 18, 2025

সঙ্গীহীন - প্রতিম দাস

 

সঙ্গীহীন
প্রতিম দাস

“আ...উ...উ...উ...উ...!”
রাতের নিস্তব্ধতা চিরে এক ভয়ালো হাড়কাঁপানো আওয়াজ ছড়িয়ে গেল চরাচরে। চাঁদের ফ্যাকাসে আলোয়, এক প্রাচীন ভবনের ধ্বংসস্তূপের কাছে বসে থাকা লোমশ দেহটা নিজের মোটাসোটা থাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। এক মিনিট বাদেই আবারও মাথা তুলে সেই একইরকম রক্তজল করা চিৎকার করে উঠল—চারপাশ যেন কেঁপে উঠল।
বেচারা সেই সন্ধে থেকে এভাবেই চিৎকার করে চলেছে লোমশ প্রাণীটা। একটা কথা বলার কেউ বা একটা খেলার সঙ্গীও নেই বেচারার। কিন্তু এতে ওর দোষ কোথায়? ও একটা ভুতুড়ে ‘সত্ত্বা’র মতোই। মৃত্যুর দরজা পার হয়ে যাওয়া এক অচেনা দানব বলেই ভাবে সবাই ওকে! সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিলাম, স্বয়ং ভূতেরাও তাকে দেখে পালিয়ে যায়। অন্ধকার নিঃসঙ্গ প্রাণীটাকে যেন গিলে খাচ্ছিল।
চাঁদের আলো দেখা গেল মেঘের ফাঁক দিয়ে। সেই আলো গায়ে মেখে তার ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে ছিল প্রাচীন জমিদারবাড়িটা। বহু বছর আগেই মানুষ এই ভবন ছেড়ে চলে গিয়েছে। আতঙ্কে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, ভূতের। যদিও সে ভুতেরা বড়ই অলস। ভয় দেখায় না। একদা ওরা চেয়েছিল তাদের বংশধরদের সঙ্গে থাকতে। কিন্তু মানুষ কী সেটা পারে! আপাতত ওটার ধুলো মলিন ঘরগুলোতে ভেসে বেড়ায় সেই তিন বুড়ো ভূতের নিশ্বাস।
দোতলায় ভাঙা কাঠের বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে ছিল শিবনাথ। লোমশ প্রাণীটার প্রথম চিৎকারটা শুনেই সে এক ঝটকায় ছেঁড়াখোঁড়া কম্বলটা মাথার উপর টেনে নিল।
নীচে, গোবিন্দ নামের আর একজন তার ভাঙা সোফা থেকে ধপাস করে পড়েই গেল।
“আবার? আবার সেই ভয়ঙ্কর চিৎকার! হতচ্ছাড়াটা কী একটু ঘুমাতে পারে না!” বিড়বিড় করে উঠল গোবিন্দ।
ওদিকে লাইব্রেরি ঘরের লুকানো কুঠরির অন্ধকার থেকে খটখট শব্দ করে বেরিয়ে এল আনন্দমোহন— কঙ্কালসার দেহ। “নিকুচি করেছে! ওই শব্দটা যেন আমার খুলির ভিতর ছুরি গেঁথে দিচ্ছে!” চেঁচিয়ে উঠল।
শেষমেশ যখন লোমশ প্রাণীটা তার চিৎকার থামাল, তিন অশরীরী নাচঘরের ধুলোমাখা অন্ধকারে একে অপরের মুখোমুখি হলো।
“একজন মৃত আত্মার পক্ষেও এটা সহ্য করা অসম্ভব,” ফিসফিস করে বলল শিবনাথ।
“শান্তিতে একটু ভৌতিক জীবন কাটাতে চাই—এটা কি খুব বেশি দাবি?” প্রশ্ন করল গোবিন্দ।
“হতচ্ছাড়াটার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে!” দৃঢ়স্বরে বলল আনন্দমোহন।
কিন্তু ওরা করবেটা কী? ও ব্যাটার চিৎকার শুনলে যে কেউ ভাববে নিশ্চিত নরকের অতল গহ্বর থেকে উঠে আসা কোনও ভয়ঙ্কর জন্তু। আর জমিদার বাড়ির এই তিন ভূত, আগেই বলেছি খুবই অলস এবং দুর্বল। কর্মচঞ্চলতা শব্দটা ওদের অভিধানেই নেই। থাকার আসলে দরকারি তো নেই। মানুষকে ভয় দেখানো ছাড়া ভূতেদের আর কোনও কাজ আছে নাকি। আর এই কাজটা করতেও ওদের অনীহা একশো শতাংশ!
গোটা চল্লিশেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে গজগজ করতে করতে অসহায়ভাবে ওরা সিদ্ধান্ত নিল, যা হয় হবে, আমরা কিছুই করব না। এ ভবন ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। একটা কবরখানার থেকেও বেশি নিস্তব্ধতা এই জমিদারবাড়িতে বিরাজ করে। আমাদের মতো ভূতেদের জন্য যেটা আদর্শ স্থান।
ঠিক তখনই আবার ওদের কানে ভেসে এল সেই আগের মতোই হাড়ে ঠকঠকি লাগান আওয়াজ - “আ-উ-উ-উ-উ...!”
শিবনাথের বুকের ভিতরটা ধক ধক করে উঠল।
“আর না… আর না! এবার থাম!”
এরকম সময়ে, একটা ক্যাঁচকেঁচে স্বর প্রশ্ন করল উপর থেকে, “হলোটা কি শুনি?”
ভয়ে ভয়ে উপরের দিকে তাকাল শিবনাথ। ভাঙা ছাদের ফুটো দিয়ে একটা হুতুম প্যাঁচা নিচে নেমে এল। “ওহ, তুমি! কবে এলে?” হাঁপ ছেড়ে বাঁচল শিবনাথ।
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্যাঁচাটা ব্যঙ্গের সুরে চোখ টিপে বলল, “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি যেন কোন মানুষকে দেখেছ!”
“মানুষ হলে এত খারাপ হতো না। তোমার কানে কি ওই জঘন্য চিৎকার ঢুকছে না?
ঘণ্টাখানেকের জন্য যদি একবার থামত!”
“সে থামতেই পারে। ভালোভাবে যদি তোমরা তাকে বলো,” প্যাঁচাটা শান্ত গলায় বলল।
শিবনাথা একথা শুনে যেন জমে গেল। “আ-আমি? ও- ওকে থামতে বলব? ওই লোমশ দানবটাকে?”
“অবশ্যই! কাউকে না কাউকে তো বলতেই হবে। সবেমাত্র তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে কাল আমি এখানে এসেছি। এর মধ্যেই আমার জান কয়লা হয়ে গেল ওই চিৎকারের ঠ্যালায়! তোমরা যাচ্ছ না কেন?”
শিবনাথ ব্যাজার মুখে বলল, “আমার সাহস নেই। অন্য দু’জনের তো প্রশ্নই নেই। আনন্দ একটা অকম্মের ধারি, আর গোবিন্দ-”
“তার মানে যা করার আমাকেই করতে হবে,” বলল প্যাঁচাটা । “ঠিক আছে, অপেক্ষা করো। দেখি কী করতে পারি।”
কিছুক্ষণ বাদেই প্যাঁচাটা ফিরে এল—কিন্তু একা নয়!
“তাড়াতাড়িই কাজটা হয়ে গেল বুঝলে!” প্যাঁচাটা চেঁচিয়ে জানাল।
কথাটা শেষ হতে না হতেই পুরনো ভবনের দেয়ালগুলো থরথর করে কেঁপে উঠল। খসে পড়ল চুন সুরকির পলেস্তারা। আবার সেই ভয়ঙ্কর চিৎকার-
“আআআউউউউউউউ!!!”
ধড়াম করে সদর দরজাটার কোনোমতে ঝুলে থাকা পাল্লা দু’টো আছড়ে পড়ল চিড় ফাটলে ভরা শান বাঁধানো মেঝেতে। একরাশ ধুলো উড়ে গেল চারদিকে ঝড়ের মতো। তার ভিতর থেকেই ছায়াছায়া শরীরটা এগিয়ে এল—
একটা অতিকায় লোমশ কুকুর।
চোখ জ্বলজ্বল করছিল দুটো লাল বলের মতো। নিঃশ্বাসের বদলে বের হয়ে আসছিল ঠান্ডা কুয়াশার স্রোত।
শিবনাথ এ দৃশ্য দেখে অদৃশ্য হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। খটখটাখট শব্দ তুলে নড়তে থাকল আনন্দমোহনের চোয়াল। গোবিন্দর চোখের কোটর থেকে ঠেলে বের হয়ে এসেছিল শুধু দুটো মণি-
এসব দেখে শুনে হুতুম প্যাঁচাটা বলল, “আরে তোমরা এত ভয় পাচ্ছ কেন। ওর আওয়াজ যতটা ভয়ঙ্কর, তার একভাগও ভয়ঙ্কর ও নিজে নয়।”
কুকুরটার চিৎকার হঠাৎ থেমে গেল। জ্বলজ্বলে চোখে একরাশ আকুলতা।
“ও বেচারা একাকিত্বের জ্বালায় কাঁদে,” প্যাঁচাটা কোমল স্বরে বলল। “ভাবো দেখি, বেচারার কেউ নেই, কোথাও থাকার জায়গা অবধি নেই—এমনকি ভূতেরাও ওকে ভয় পায়।”
আনন্দমোহন দু হাত দিয়ে চোয়ালের ঠকঠক থামিয়ে ভালো করে তাকাল। ভূতুড়ে কুকুরটাও ওর দিকে তাকাল, দৃষ্টিতে আকুলতা। সঙ্গ লাভের। কুঁইকুঁই করে আওয়াজ করল।
প্যাঁচাটা ডানা ঝাপটে বলল, “ ও বলছে একটু থাকার জায়গা চায়, একটু সঙ্গ চায়। তোমরা যা অলস দেখছি তোমাদের তিনজনের একটা পাহারাদার দরকার। আর ওর দরকার একটা পরিবার। ব্যাপারটা খুব সহজ।”
গোবিন্দ এটা শুনে বলে উঠল, “মন্দ বলোনি… যুক্তি আছে তোমার কথায়।”
এটা শুনে সেই লোমশ প্রাণীটা তার একটা থাবা তুলে সামনের দিকে নাড়াল। আস্তে করে ডাক দিল “ওউ, ও উ, ওউউউ!”
“ও বলছে আমি তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি… আর কখনও চিৎকার করব না… যদি তোমরা আমাকে থাকতে দাও।”
গোবিন্দ বলল, “ঠিক আছে… ঠিক আছে! শুধু ওই ভয়ংকর শব্দ একদম করবি না !”
শিবনাথ হাসল, “তুই চাইলে আমার বিছানার পাশে শুতে পারিস।”
এটা শুনে কুকুরটার চোখ চকচক করে উঠল। চিৎকার করে সেটা জানান দিতে যাচ্ছিল সম্ভবত, তার আগেই আনন্দমোহন চেঁচিয়ে উঠল, “অ্যাই, খবরদার একদম চিৎকার করবি না! তা সে যতই আনন্দ হোক!”
সব দেখে শুনে প্যাঁচটা বলে উঠল, “আহারে বেচারা! এ জগতে সবাই সঙ্গ চায়। পরিবার চায়, সে জীবিত হোক বা অশরীরী। এটা কবে যে সবাই বুঝবে। যাই এবার একটু শান্তিতে ঘুমাই।”

Monday, September 29, 2025

অচীন গ্রহের আগন্তুক অনুবাদ - প্রতিম দাস

 


অচীন গ্রহের আগন্তুক

অনুবাদ - প্রতিম দাস

Mystery of the missing meteorite

Sonia Bhattacharya

 

 

ব্লু ফেয়ারী

১২ আগস্ট ২০০২

দ্বারিকপুর

প্রিয় প্রশান্ত

সত্যিই আমার ভাগ্যটাই খারাপ। আমার স্কুল জীবনের প্রিয় বন্ধু আমার খোঁজ নিচ্ছে তাও কেবল মাত্র একটা বিভ্রম সৃষ্টিকারী উল্কাপিন্ডের বিষয়ে জানার জন্য। না বন্ধু, দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি এ ব্যাপারে আমার কাছে তেমন কোনও তথ্য নেই । থাকবেই বা কী করে! ওটা তো একটা গুজব ছাড়া আর কিছু নয়।

গত সপ্তাহে বেশ কয়েকটা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকারি দল তাদের বিজ্ঞানী আর মিডিয়ার লোকেদের নিয়ে আমাদের শহরের আনাচে কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে। কিন্তু এক কনা অপার্থিব বস্তুর খোঁজ মেলেনি । যারা নাকি ওই উল্কা পতন দেখেছিল তাদের বয়ানেও অনেক অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। প্রায় সকলেই আলাদা আলাদা পতন স্থানের কথা বলেছে। আর সেটাও নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেনি মোটেই।

বলাবাহুল্য বেশির ভাগ মানুষ জলাভূমির কথা বলেছে। যেখানে আমি পাখি দেখতে যাই। হ্যাঁ ওই একটা জায়গা যেখানে উল্কাটা লুকিয়ে থাকতে পারে আমি স্বীকার করছি। আর সে কারণেই ওই সব লোকগুলো জায়গাটাকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। ওদের পদচারণায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনেক গাছ । পাখিগুলো পালিয়েছে এলাকা ছেড়ে।

এই হলো অল্প কথায় উল্কাপিন্ড বিষয়ক গল্প।তবে বুঝে উঠতে পারছি না তোর মতো বোটানিস্ট হঠাৎ উল্কা পিন্ডের খবর জানতে চাইছে কেন? আরে দ্বারিকপুরে কিন্তু উল্কাপিন্ডর চেয়ে আরও অনেক অনেক ভালো জিনিষ আছে দেখার জন্য । অবশ্য তোর যদি সময় হয় সে সব দেখার । দ্যাখ না চেষ্টা করে আগামী ছুটিতে এখানে আসতে পারিস কিনা ?

তোর প্রাণের বন্ধু

রমেশ

০০০০০০০০০০০০০০

১৮ই আগস্ট ২০০২

দ্বারিকপুর

প্রিয় প্রশান্ত

এত তাড়াতাড়ি আবার একটা চিঠি পেয়ে নিশ্চিত অবাক হচ্ছিস। আসলে এমন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে যে তোকে না জানিয়ে থাকতে পারলাম না। আমি চাই অন্য কেউ দেখার আগে তুই এসে ব্যাপারটা দেখে যা একবার।

তার আগে খুলে বলি তোকে। দু দিন আগে, জলাভুমিটার কাছে গিয়েছিলাম। বসেছিলাম ঠিক সেই জায়গায় যেখানে আমি বসি। দেখতে পেলাম একটা সুন্দর ছোট্ট পাখি কিছু একটা জিনিষকে ঘিরে উড়ছে। দূরবীন তাক করে দেখার চেষ্টা করলাম কী এমন জিনিষ যা পাখিটাকে আকর্ষিত করছে । একটা উদ্ভিদ। ছোট্ট । এরকম সুন্দর  উদ্ভিদ আমি আগে কখনো দেখিনি। ঘাস গোত্রের। পাতা গুলো প্রজাপতির ডানার মতো। নীলছে সবুজ রঙ ।আশে পাশের সব গাছগাছালির থেকে একেবারে আলাদা । এরকম রঙ ও আমি আগে কখনো দেখিনি কোন উদ্ভিদের। যতটা সম্ভব এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখলাম। না, আমার চেনা শোনা কো নো  ক্যাটাগরিতে এ উদ্ভিদ পড়ে না। ওটার একটা নামও দিয়ে দিলাম বুঝলি, ‘ব্লু ফেয়ারী’।

আজ সকালে জলাভুমির দিকে যাওয়ার সময় মনে হল ওখানকার পাখিগুলো যেন একটু বেশি পরিমাণে চিৎকার করছে। প্রায় পাগলের মতো । প্রথমে তেমন কিছু অস্বাভাবিক চোখে পড়েনি।  তারপরেই চোখ গেল ব্লু ফেয়ারীর দিকে। দেখলাম একটা সাদা নলের মতো জিনিষ ওটার মাথার দিকটায় জড়িয়ে আছে । আমি এগিয়ে যেতেই কুন্ডলি খুলে ওটা অতি ধীর গতিতে আমার দিকে ঘুরে গেল। একই সঙ্গে খাড়াও হয়ে গেল নলটা। অন্তত দু ফুট তো বটেই। এরপর যা দেখলাম তাতে বেশ চমকে গেলাম । ওটার একেবারে ওপরে একটা মুখ আর দুটো চোখের মতো অংশ । মাথাটা সরীসৃপের মতো। মাথা বলছি বটে আলাদা করে কোনও মাথা ওটার ছিল না বলাই ভালো। নলাকৃতি অংশটা ভালো ভাবেই আটকে ছিল ব্লু ফেয়ারির গায়ে। মনে হলো যে পরিমাণ কৌতূহলের সঙ্গে আমি ওটাকে দেখছি ঠিক সেই একই কৌতূহলের সঙ্গে ওটাও আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

প্রথমে মনে হলো ওটা সাপ জাতীয় কোনও প্রাণী যা ব্লু ফেয়ারীর পাতার ভেতরে বাসা করেছে। কয়েক পা পিছিয়ে এলাম ওটার কাছে থেকে। পাখিগুলোর চিৎকার কিন্তু থামেনি। তিন ঘণ্টা ধরে আমি ওটাকে পর্যবেক্ষণ করলাম । ওই সময়ে ওটা আবার ধীরে ধীরে [ এতোটাই ধীরে যে খালি চোখে ধরাই মুশকিল] ছোটো হয়ে গেল এবং ঢুকে পড়লো ব্লু ফেয়ারীর  পাতার আড়ালে ।

বুঝতে পারলাম ওটা মোটেই আলাদা প্রাণী নয়। প্রাণীর মতো দেখতে একটা নড়াচড়া করতে সক্ষম অঙ্গ... ব্লু ফেয়ারীর ।

প্রশান্ত ভেবে দ্যাখ একবার । ওই ব্লু ফেয়ারি হয়তো গাছ আর প্রানী জগতের ভেতর সংযোগ রক্ষাকারী কোন এক বস্তু ! এক মিসিং লিঙ্ক! সম্ভবত এ শতাব্দীর সেরা চমকপ্রদ আবিষ্কার !

একবার অন্তত এখানে আয় বন্ধু। আমি চাই, তোর গাছপালার জ্ঞান আর আমার প্রাণী জগতের জ্ঞান মিলিয়ে একবার তদন্ত করে দেখতে।

তোর প্রত্যাশায় রইলাম

ইতি রমেশ

০০০০০০০০০০০০০০০০০০

ফ্রম – রমেশ

[রমেশ <এস আর@এভিয়ানইন্সটিটিউট.ও আর জি>]

সেন্ট – টিউ ৮/২০/০২

টু – বিপ্রশান্ত@একুনিভ.এডু

সিসি

বিসিসি

সাবজেক্ট – ব্লু ফেয়ারী

ডিয়ার প্রশান্ত

আশা করি তুই আমার চিঠি [১৮ আগস্ট] ইতিমধ্যে পেয়ে গিয়েছিস। এর মধ্যে একটা চাঞ্চল্যকর পরিবর্তন ঘটে গেছে। ব্লু ফেয়ারীর আশে পাশে থাকা শালুক গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে । মরে যাচ্ছে । ব্লু ফেয়ারি কি পরজীবী? নাকি গাছেদের জগতের ভ্যাম্পায়ার? আমি জানতে সত্যিই আগ্রহী। তুই আসছিস তো? প্লিজ একটা ইমেল করে জানা ।

রমেশ

পি এস – ব্লু ফেয়ারী আমাকে চিনে গেছে । ওটা ওর চারপাশে থাকা ঘাস পাতার ওপর ৩৬০ ডিগ্রীর গোল পাকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আগের মতো কাছে গেলে আমাকে আর দেখে না। পাত্তা দেয় না বলা ভালো ।  পাখিগুলোও ওটাকে বুঝে গেছে। আর আগের মতো চিৎকার করে না।

আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে একদিন দেখব ওটা উড়ে যাবে ওর ওই প্রজাপতির মতো পাতাগুলো [নাকি ডানা!] মেলে ।

০০০০০০০০০০০০০০০০

২২ আগস্ট ২০০২

দ্বারিকপুর

প্রিয় রমেশ

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তোকে এই চিঠি লিখছি । আমরা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ হারালাম। তুই জবাব দিতে অনেক দেরি করে ফেললি। ব্লু ফেয়ারী আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। আর ওর উত্তরসুরীও চলে গেছে আমাদের ছেড়ে, মহাকাশে অন্য এক জগতের পথে ।

আজ সকালে ওকে শেষবারের মতো দেখেছি। ও পরিনত হয়েছে জৈবিক পচনশীল বস্তুতে। আশেপাশের গাছপালার সঙ্গে ওর কোনও পার্থক্য আর নেই। শেষ কয়েকদিন ধরে ও ওর চারপাশের সব গাছপালাকে শিকার করেছে । যে কারনে ওর আশেপাশের সব গাছপালা মরে পচে দুমড়ে মুচড়ে গেছে। এদিকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।  পচনশীলতার কাজটা দ্রুত হবে আরো। তাই যতটা পেরেছি নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দিয়েছি। যদিও আমি নিশ্চিত ব্লু ফেয়ারীর গা থেকে সাধারণ গাছপাতার মতোই রিপোর্ট পাওয়া যাবে।

ভাবতেই অবাক লাগছে জানিস যে গতকাল পর্যন্তও ওটা জীবিত ছিল। নড়াচড়া করছিল । ছোবল মারার মতো করে মাথা ঝাড়ছিল । সত্যি বলছি । কাল আমি সন্ধে হওয়ার একটু আগে যখন কাছে গিয়েছিলাম দেখলাম ওর দেহ মধ্যস্থ স্থানে স্ফীত একটা গোলকের উদ্ভব হয়েছে । আর সেটা দেখতে যেতেই ওটার মাথাটা দুলে উঠল [অবশ্য ওটাকে মাথা বলে যদি মেনে নিই] আগের চেয়ে অনেক জোরে । মনে হলো কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। যদিও আমি ভেবেছিলাম ওটা বোধহয় ব্লু ফেয়ারীর আনন্দের নাচ । বড় কোন শিকার ধরে গিলেছে সেই খুশিতে । কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আসলে ওই সময় ওর শরীরে অস্বস্তি হচ্ছিল। কষ্ট হচ্ছিল ।

দেখে বোঝা যাচ্ছিল পেটের ওই গোলাকার স্থানের কারণে নলাকৃতি অংশটার উচ্চতা বেশ খানিকটা কমে গেছে। আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামছিল মাথাটা । ভাবলাম এবার বোধ হয়  ওর ঘুম পেয়েছে । ঠিক তখনি, যেটাকে এতো দিন মুখ বলে ভেবে এসছি সেটা খুলে গেল । স্পষ্ট হলো একটা কালো ছোট্ট ফুটো।   ধীরে ধীরে ওটা চওড়া হয়ে গেল একটা কালো গর্তের মতো । [তুই হয়তো অবাক হতে পারিস এটা জেনে যে ওই মুখ গহ্বরে কোন দাঁত বা জিভ ছিল না!] শুনতে  পেলাম একটা গার্গল করার মতো শব্দ। আমি দু পা পিছিয়ে এলাম। তারপরই ঘটল সেই অত্যাশ্চর্য ঘটনা !

এক বীভৎস কিঁচগকিঁচে গা শিউরানো শব্দ করে নলটা খাড়া হয়ে গেল আকাশের দিকে মুখ তুলে। ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল বা আমার ব্লু ফেয়ারি উগড়ে দিল বলাই ভালো একটা কালো গোলাকৃতি বস্তু । যা সটান ধেয়ে গেল আকাশপানে। বিশ্বাস কর একটা রকেটও বোধহয় ওই গতিতে ধেয়ে যায় না মহাশুন্যের দিকে । অজ্ঞাত শব্দের চাপে আমার কানে তালা ধরে গেল । একটা দমকা বাতাস ছুটে এলো আমার দিকে । আমি টাল সামলাতে না পরে পড়ে গেলাম মাটিতে। তবু চোখ বন্ধ না করে পলক না ফেলে তাকিয়েছিলাম গোলকটার দিকে। যতক্ষণ দেখা যায় । বায়ুমন্ডলের শেষ সীমায় পৌঁছে সম্ভবত আগুন লেগে গিয়েছিল ওটার গায়ে। দৃষ্টি সীমার বাইরে যাওয়ার আগে  অন্ধকার আকাশের গায়ে রেখে গেল একটা উজ্জ্বল আলোর রেখা।

নেশাচ্ছন্নের মতো আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মেনে ওটার পৃথিবীর বুকে ফিরে আসার জন্য । কিন্তু না ওটা আর ফিরে এল না। সহসাই আমার ঘোর কাটল। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আশেপাশের পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন হলাম। হয় ওখানে চরম নিস্তব্ধতা ছিল বা আমার শ্রবণ যন্ত্র সাময়িক ভাবে বিকল হয়ে গিয়েছিল। টর্চের আলো ফেলে তাকালাম ব্লু ফেয়ারীর দিকে। আগের মতোই রুপের ডালি সাজিয়ে ধীরে ধীরে বাতাসের ধাক্কায় নড়ছিল ওটা। যেন কিছুই হয়নি ।

একটু ভাবতেই আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম বুঝলি। সব কিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। ওই অদ্ভুত প্রাণীটি, যাকে আমি ব্লু ফেয়ারি নাম দিয়েছি সে তার সন্তানকে পাঠিয়ে দিলো মহাকাশে। যে রকম ও এসেছিল আমদের এই জগতে। হয়তো কোনদিন ওর পাঠানো সন্তান ওর মতোই নামবে অন্য কোনও গ্রহে । সেখানেও জন্ম নেবে আবার একটা ব্লু ফেয়ারী । সেও তার সন্তানকে এভাবেই পাঠিয়ে দেবে মহাশূন্যে। চলতে থাকবে জীবন চক্র ।

পরের দিন  শুনতে পেলাম সন্ধে বেলায় এক অতি উজ্জ্বল বস্তুকে আকাশের দিকে ধেয়ে যেতে দেখেছেন অনেকেই। নিশ্চিত মিডিয়ার কাছেও খবরটা পৌছে যদিও ওরা আর একে গুরুত্ব দেয়নি আগের মতো। কে আর বারবার লোক হাসাতে চায় বল। অতএব অবাক হয়ে যাস না এই আলোর খবর কোনও কাগজে প্রকাশ হতে না দেখলে।

সব কিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ব্লু ফেয়ারী মরে যাওয়ার পর। তবু নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিচ্ছি যে ব্লু ফেয়ারি মরে গেল বলেই আমাদের পৃথিবীর গাছপালাগুলো বেঁচে গেল। ভাগ্যিস ওদের জন্মদান পদ্ধতিটা ওই রকম ।

যদিও বিজ্ঞানের দিক থেকে ভাবলে এক অপূরণীয় ক্ষতি। ভিনগ্রহী প্রাণকে হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখার এত বড়ো সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।

যাকগে, যা হবার তা তো হলো। এবার বল তুই কবে আসবি বলে ভাবছিস? ভুলে যাস না আমার আমন্ত্রণটা কিন্তু থাকছেই। এই দ্বারিকপুরে আরও অনেক কৌতূহলজনক জিনিষ আছে যা তোর ভালো লাগবে ।

ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা সহ

তোর চিরদিনের বন্ধু

রমেশ