Search This Blog

Monday, September 29, 2025

অচীন গ্রহের আগন্তুক অনুবাদ - প্রতিম দাস

 


অচীন গ্রহের আগন্তুক

অনুবাদ - প্রতিম দাস

Mystery of the missing meteorite

Sonia Bhattacharya

 

 

ব্লু ফেয়ারী

১২ আগস্ট ২০০২

দ্বারিকপুর

প্রিয় প্রশান্ত

সত্যিই আমার ভাগ্যটাই খারাপ। আমার স্কুল জীবনের প্রিয় বন্ধু আমার খোঁজ নিচ্ছে তাও কেবল মাত্র একটা বিভ্রম সৃষ্টিকারী উল্কাপিন্ডের বিষয়ে জানার জন্য। না বন্ধু, দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি এ ব্যাপারে আমার কাছে তেমন কোনও তথ্য নেই । থাকবেই বা কী করে! ওটা তো একটা গুজব ছাড়া আর কিছু নয়।

গত সপ্তাহে বেশ কয়েকটা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকারি দল তাদের বিজ্ঞানী আর মিডিয়ার লোকেদের নিয়ে আমাদের শহরের আনাচে কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে। কিন্তু এক কনা অপার্থিব বস্তুর খোঁজ মেলেনি । যারা নাকি ওই উল্কা পতন দেখেছিল তাদের বয়ানেও অনেক অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। প্রায় সকলেই আলাদা আলাদা পতন স্থানের কথা বলেছে। আর সেটাও নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেনি মোটেই।

বলাবাহুল্য বেশির ভাগ মানুষ জলাভূমির কথা বলেছে। যেখানে আমি পাখি দেখতে যাই। হ্যাঁ ওই একটা জায়গা যেখানে উল্কাটা লুকিয়ে থাকতে পারে আমি স্বীকার করছি। আর সে কারণেই ওই সব লোকগুলো জায়গাটাকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। ওদের পদচারণায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনেক গাছ । পাখিগুলো পালিয়েছে এলাকা ছেড়ে।

এই হলো অল্প কথায় উল্কাপিন্ড বিষয়ক গল্প।তবে বুঝে উঠতে পারছি না তোর মতো বোটানিস্ট হঠাৎ উল্কা পিন্ডের খবর জানতে চাইছে কেন? আরে দ্বারিকপুরে কিন্তু উল্কাপিন্ডর চেয়ে আরও অনেক অনেক ভালো জিনিষ আছে দেখার জন্য । অবশ্য তোর যদি সময় হয় সে সব দেখার । দ্যাখ না চেষ্টা করে আগামী ছুটিতে এখানে আসতে পারিস কিনা ?

তোর প্রাণের বন্ধু

রমেশ

০০০০০০০০০০০০০০

১৮ই আগস্ট ২০০২

দ্বারিকপুর

প্রিয় প্রশান্ত

এত তাড়াতাড়ি আবার একটা চিঠি পেয়ে নিশ্চিত অবাক হচ্ছিস। আসলে এমন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে যে তোকে না জানিয়ে থাকতে পারলাম না। আমি চাই অন্য কেউ দেখার আগে তুই এসে ব্যাপারটা দেখে যা একবার।

তার আগে খুলে বলি তোকে। দু দিন আগে, জলাভুমিটার কাছে গিয়েছিলাম। বসেছিলাম ঠিক সেই জায়গায় যেখানে আমি বসি। দেখতে পেলাম একটা সুন্দর ছোট্ট পাখি কিছু একটা জিনিষকে ঘিরে উড়ছে। দূরবীন তাক করে দেখার চেষ্টা করলাম কী এমন জিনিষ যা পাখিটাকে আকর্ষিত করছে । একটা উদ্ভিদ। ছোট্ট । এরকম সুন্দর  উদ্ভিদ আমি আগে কখনো দেখিনি। ঘাস গোত্রের। পাতা গুলো প্রজাপতির ডানার মতো। নীলছে সবুজ রঙ ।আশে পাশের সব গাছগাছালির থেকে একেবারে আলাদা । এরকম রঙ ও আমি আগে কখনো দেখিনি কোন উদ্ভিদের। যতটা সম্ভব এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখলাম। না, আমার চেনা শোনা কো নো  ক্যাটাগরিতে এ উদ্ভিদ পড়ে না। ওটার একটা নামও দিয়ে দিলাম বুঝলি, ‘ব্লু ফেয়ারী’।

আজ সকালে জলাভুমির দিকে যাওয়ার সময় মনে হল ওখানকার পাখিগুলো যেন একটু বেশি পরিমাণে চিৎকার করছে। প্রায় পাগলের মতো । প্রথমে তেমন কিছু অস্বাভাবিক চোখে পড়েনি।  তারপরেই চোখ গেল ব্লু ফেয়ারীর দিকে। দেখলাম একটা সাদা নলের মতো জিনিষ ওটার মাথার দিকটায় জড়িয়ে আছে । আমি এগিয়ে যেতেই কুন্ডলি খুলে ওটা অতি ধীর গতিতে আমার দিকে ঘুরে গেল। একই সঙ্গে খাড়াও হয়ে গেল নলটা। অন্তত দু ফুট তো বটেই। এরপর যা দেখলাম তাতে বেশ চমকে গেলাম । ওটার একেবারে ওপরে একটা মুখ আর দুটো চোখের মতো অংশ । মাথাটা সরীসৃপের মতো। মাথা বলছি বটে আলাদা করে কোনও মাথা ওটার ছিল না বলাই ভালো। নলাকৃতি অংশটা ভালো ভাবেই আটকে ছিল ব্লু ফেয়ারির গায়ে। মনে হলো যে পরিমাণ কৌতূহলের সঙ্গে আমি ওটাকে দেখছি ঠিক সেই একই কৌতূহলের সঙ্গে ওটাও আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

প্রথমে মনে হলো ওটা সাপ জাতীয় কোনও প্রাণী যা ব্লু ফেয়ারীর পাতার ভেতরে বাসা করেছে। কয়েক পা পিছিয়ে এলাম ওটার কাছে থেকে। পাখিগুলোর চিৎকার কিন্তু থামেনি। তিন ঘণ্টা ধরে আমি ওটাকে পর্যবেক্ষণ করলাম । ওই সময়ে ওটা আবার ধীরে ধীরে [ এতোটাই ধীরে যে খালি চোখে ধরাই মুশকিল] ছোটো হয়ে গেল এবং ঢুকে পড়লো ব্লু ফেয়ারীর  পাতার আড়ালে ।

বুঝতে পারলাম ওটা মোটেই আলাদা প্রাণী নয়। প্রাণীর মতো দেখতে একটা নড়াচড়া করতে সক্ষম অঙ্গ... ব্লু ফেয়ারীর ।

প্রশান্ত ভেবে দ্যাখ একবার । ওই ব্লু ফেয়ারি হয়তো গাছ আর প্রানী জগতের ভেতর সংযোগ রক্ষাকারী কোন এক বস্তু ! এক মিসিং লিঙ্ক! সম্ভবত এ শতাব্দীর সেরা চমকপ্রদ আবিষ্কার !

একবার অন্তত এখানে আয় বন্ধু। আমি চাই, তোর গাছপালার জ্ঞান আর আমার প্রাণী জগতের জ্ঞান মিলিয়ে একবার তদন্ত করে দেখতে।

তোর প্রত্যাশায় রইলাম

ইতি রমেশ

০০০০০০০০০০০০০০০০০০

ফ্রম – রমেশ

[রমেশ <এস আর@এভিয়ানইন্সটিটিউট.ও আর জি>]

সেন্ট – টিউ ৮/২০/০২

টু – বিপ্রশান্ত@একুনিভ.এডু

সিসি

বিসিসি

সাবজেক্ট – ব্লু ফেয়ারী

ডিয়ার প্রশান্ত

আশা করি তুই আমার চিঠি [১৮ আগস্ট] ইতিমধ্যে পেয়ে গিয়েছিস। এর মধ্যে একটা চাঞ্চল্যকর পরিবর্তন ঘটে গেছে। ব্লু ফেয়ারীর আশে পাশে থাকা শালুক গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে । মরে যাচ্ছে । ব্লু ফেয়ারি কি পরজীবী? নাকি গাছেদের জগতের ভ্যাম্পায়ার? আমি জানতে সত্যিই আগ্রহী। তুই আসছিস তো? প্লিজ একটা ইমেল করে জানা ।

রমেশ

পি এস – ব্লু ফেয়ারী আমাকে চিনে গেছে । ওটা ওর চারপাশে থাকা ঘাস পাতার ওপর ৩৬০ ডিগ্রীর গোল পাকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আগের মতো কাছে গেলে আমাকে আর দেখে না। পাত্তা দেয় না বলা ভালো ।  পাখিগুলোও ওটাকে বুঝে গেছে। আর আগের মতো চিৎকার করে না।

আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে একদিন দেখব ওটা উড়ে যাবে ওর ওই প্রজাপতির মতো পাতাগুলো [নাকি ডানা!] মেলে ।

০০০০০০০০০০০০০০০০

২২ আগস্ট ২০০২

দ্বারিকপুর

প্রিয় রমেশ

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তোকে এই চিঠি লিখছি । আমরা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ হারালাম। তুই জবাব দিতে অনেক দেরি করে ফেললি। ব্লু ফেয়ারী আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। আর ওর উত্তরসুরীও চলে গেছে আমাদের ছেড়ে, মহাকাশে অন্য এক জগতের পথে ।

আজ সকালে ওকে শেষবারের মতো দেখেছি। ও পরিনত হয়েছে জৈবিক পচনশীল বস্তুতে। আশেপাশের গাছপালার সঙ্গে ওর কোনও পার্থক্য আর নেই। শেষ কয়েকদিন ধরে ও ওর চারপাশের সব গাছপালাকে শিকার করেছে । যে কারনে ওর আশেপাশের সব গাছপালা মরে পচে দুমড়ে মুচড়ে গেছে। এদিকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।  পচনশীলতার কাজটা দ্রুত হবে আরো। তাই যতটা পেরেছি নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দিয়েছি। যদিও আমি নিশ্চিত ব্লু ফেয়ারীর গা থেকে সাধারণ গাছপাতার মতোই রিপোর্ট পাওয়া যাবে।

ভাবতেই অবাক লাগছে জানিস যে গতকাল পর্যন্তও ওটা জীবিত ছিল। নড়াচড়া করছিল । ছোবল মারার মতো করে মাথা ঝাড়ছিল । সত্যি বলছি । কাল আমি সন্ধে হওয়ার একটু আগে যখন কাছে গিয়েছিলাম দেখলাম ওর দেহ মধ্যস্থ স্থানে স্ফীত একটা গোলকের উদ্ভব হয়েছে । আর সেটা দেখতে যেতেই ওটার মাথাটা দুলে উঠল [অবশ্য ওটাকে মাথা বলে যদি মেনে নিই] আগের চেয়ে অনেক জোরে । মনে হলো কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। যদিও আমি ভেবেছিলাম ওটা বোধহয় ব্লু ফেয়ারীর আনন্দের নাচ । বড় কোন শিকার ধরে গিলেছে সেই খুশিতে । কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আসলে ওই সময় ওর শরীরে অস্বস্তি হচ্ছিল। কষ্ট হচ্ছিল ।

দেখে বোঝা যাচ্ছিল পেটের ওই গোলাকার স্থানের কারণে নলাকৃতি অংশটার উচ্চতা বেশ খানিকটা কমে গেছে। আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামছিল মাথাটা । ভাবলাম এবার বোধ হয়  ওর ঘুম পেয়েছে । ঠিক তখনি, যেটাকে এতো দিন মুখ বলে ভেবে এসছি সেটা খুলে গেল । স্পষ্ট হলো একটা কালো ছোট্ট ফুটো।   ধীরে ধীরে ওটা চওড়া হয়ে গেল একটা কালো গর্তের মতো । [তুই হয়তো অবাক হতে পারিস এটা জেনে যে ওই মুখ গহ্বরে কোন দাঁত বা জিভ ছিল না!] শুনতে  পেলাম একটা গার্গল করার মতো শব্দ। আমি দু পা পিছিয়ে এলাম। তারপরই ঘটল সেই অত্যাশ্চর্য ঘটনা !

এক বীভৎস কিঁচগকিঁচে গা শিউরানো শব্দ করে নলটা খাড়া হয়ে গেল আকাশের দিকে মুখ তুলে। ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল বা আমার ব্লু ফেয়ারি উগড়ে দিল বলাই ভালো একটা কালো গোলাকৃতি বস্তু । যা সটান ধেয়ে গেল আকাশপানে। বিশ্বাস কর একটা রকেটও বোধহয় ওই গতিতে ধেয়ে যায় না মহাশুন্যের দিকে । অজ্ঞাত শব্দের চাপে আমার কানে তালা ধরে গেল । একটা দমকা বাতাস ছুটে এলো আমার দিকে । আমি টাল সামলাতে না পরে পড়ে গেলাম মাটিতে। তবু চোখ বন্ধ না করে পলক না ফেলে তাকিয়েছিলাম গোলকটার দিকে। যতক্ষণ দেখা যায় । বায়ুমন্ডলের শেষ সীমায় পৌঁছে সম্ভবত আগুন লেগে গিয়েছিল ওটার গায়ে। দৃষ্টি সীমার বাইরে যাওয়ার আগে  অন্ধকার আকাশের গায়ে রেখে গেল একটা উজ্জ্বল আলোর রেখা।

নেশাচ্ছন্নের মতো আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মেনে ওটার পৃথিবীর বুকে ফিরে আসার জন্য । কিন্তু না ওটা আর ফিরে এল না। সহসাই আমার ঘোর কাটল। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আশেপাশের পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন হলাম। হয় ওখানে চরম নিস্তব্ধতা ছিল বা আমার শ্রবণ যন্ত্র সাময়িক ভাবে বিকল হয়ে গিয়েছিল। টর্চের আলো ফেলে তাকালাম ব্লু ফেয়ারীর দিকে। আগের মতোই রুপের ডালি সাজিয়ে ধীরে ধীরে বাতাসের ধাক্কায় নড়ছিল ওটা। যেন কিছুই হয়নি ।

একটু ভাবতেই আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম বুঝলি। সব কিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। ওই অদ্ভুত প্রাণীটি, যাকে আমি ব্লু ফেয়ারি নাম দিয়েছি সে তার সন্তানকে পাঠিয়ে দিলো মহাকাশে। যে রকম ও এসেছিল আমদের এই জগতে। হয়তো কোনদিন ওর পাঠানো সন্তান ওর মতোই নামবে অন্য কোনও গ্রহে । সেখানেও জন্ম নেবে আবার একটা ব্লু ফেয়ারী । সেও তার সন্তানকে এভাবেই পাঠিয়ে দেবে মহাশূন্যে। চলতে থাকবে জীবন চক্র ।

পরের দিন  শুনতে পেলাম সন্ধে বেলায় এক অতি উজ্জ্বল বস্তুকে আকাশের দিকে ধেয়ে যেতে দেখেছেন অনেকেই। নিশ্চিত মিডিয়ার কাছেও খবরটা পৌছে যদিও ওরা আর একে গুরুত্ব দেয়নি আগের মতো। কে আর বারবার লোক হাসাতে চায় বল। অতএব অবাক হয়ে যাস না এই আলোর খবর কোনও কাগজে প্রকাশ হতে না দেখলে।

সব কিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ব্লু ফেয়ারী মরে যাওয়ার পর। তবু নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিচ্ছি যে ব্লু ফেয়ারি মরে গেল বলেই আমাদের পৃথিবীর গাছপালাগুলো বেঁচে গেল। ভাগ্যিস ওদের জন্মদান পদ্ধতিটা ওই রকম ।

যদিও বিজ্ঞানের দিক থেকে ভাবলে এক অপূরণীয় ক্ষতি। ভিনগ্রহী প্রাণকে হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখার এত বড়ো সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।

যাকগে, যা হবার তা তো হলো। এবার বল তুই কবে আসবি বলে ভাবছিস? ভুলে যাস না আমার আমন্ত্রণটা কিন্তু থাকছেই। এই দ্বারিকপুরে আরও অনেক কৌতূহলজনক জিনিষ আছে যা তোর ভালো লাগবে ।

ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা সহ

তোর চিরদিনের বন্ধু

রমেশ

 


No comments:

Post a Comment