হাইবোরিয়ান এজ
রবার্ট ই হাওয়ার্ড
মুছে যাওয়া ইতিহাস
অনুবাদ – প্রতিম দাস
[১৯৩২ সালে লেখা, প্রকাশিত হয় ১৯৩৮
সালে]
০০০
(স্বীকৃত ইতিহাসের কোনও তত্ত্বের কোনোভাবে
বিরোধিতা করে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা এই নিবন্ধতে করা হয়নি। এটা কেবলমাত্রই এক ধারাবাহিক কল্পকাহিনীর জন্য রচিত কাল্পনিক পটভূমির নির্মাণ। কয়েক বছর আগে আমি যখন
কোনানের গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম, তখন
তার সময় বা যুগ এবং সেখানকার মানুষের এই কল্পিত ইতিহাস নির্মাণ করেছিলাম। চেয়েছিলাম চরিত্রটাকে
এক বিশেষ সময়ের প্রেক্ষিতে বাস্তবতা দিতে। আর সেটা করতে গিয়ে বুঝেছিলাম এরকম একটা
কল্পিত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে চরিত্রটাকে স্থাপন করতে সুবিধা হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে
এক ‘রেডিমেড প্রোডাক্ট’ নয় বরং সত্যিকারের রক্তমাংসের
চরিত্র রূপে। বিভিন্ন রাজ্যে সেই সময়কালে করা কোনানের দুঃসাহসিক অভিযান ও
কর্মকান্ডগুলো সম্পর্কে লেখার সময় আমি কখনই ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাইনি। ঠিক সেভাবেই ইতিহাসের
গতিপথকে ব্যবহার করেছি যেভাবে একজন প্রকৃত ঐতিহাসিক-কল্পকাহিনী লেখক প্রকৃত ইতিহাসের অনুসরণ করেন। আমি এই স্বনির্মিত ‘ইতিহাস’কে আমার সবকটা রচনার গাইড হিসাবে ব্যবহার
করেছি।)
কিংবদন্তীর কুয়াশায় ঢেকে বসে থাকা প্রাক-ক্যাটাক্লিসমিক যুগের কথা নেমেডিয়ান ক্রনিকল অনুসারে জানা যায়। তাও আবার সেসব সেই যুগের
শেষদিকের কিছু বিবরণ মাত্র। সেই ইতিহাস অনুসারে প্রাক-ক্যাটাক্লিসমিক যুগ যখন বিলুপ্তির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন
সেখানে ছিল কামেলিয়া, ভালুশিয়া, ভেরুলিয়া,
গ্রোন্ডার, থুলে এবং কমোরিয়ার আধিপত্য।
এই সব স্থানের লোকেরা একটা ভাষাতেই কথা বলত এবং একটাই উত্স এদের উৎপত্তির,
সেটাও বিশ্বাস করত। এদের আশেপাশে আরও অনেক রাজ্য ছিল, যেখানে এদের চেয়ে পুরনো জাতির মানুষেরা বসবাস করত।
সেই যুগের বর্বর জাতি রূপে যাদের নাম
উচ্চারিত হত তারা পিক্ট। এরা পশ্চিম সমুদ্রের অনেক দূরের নানা দ্বীপে বাস করত। পিক্টদের দ্বীপপুঞ্জ
আর থুরিয়ান মহাদেশের মাঝে ছিল আটলান্টিয়ানদের বিচরণস্থল, একটা ছোটো মহাদেশ। আর ছিল লেমুরিয়ানরা, যারা পূর্ব গোলার্ধ জুড়ে থাকা বিশাল দ্বীপের একটা সারিতে বসবাস
করত।
এমন অনেক জায়গা ছিল যেখানে মানুষের পায়ের
চিহ্নই পড়েনি। সভ্য রাজ্যর পরিমাণ সে সময় বেশ ভালো পরিমাণে থাকলেও, তারা এই গ্রহের তুলনামূলকভাবে খুব ছোটো একটা অংশই দখল করতে পেরেছিল। থুরিয়ান মহাদেশের একেবারে
পশ্চিম প্রান্তের রাজ্য ছিল ভালুসিয়া। গ্রোন্ডারের অবস্থান ছিল পূর্ব প্রান্তে। এখানকার লোকেরা মরুভূমির
বুনো ও বন্ধ্যা এলাকায় ছড়িয়ে থাকা তাদের স্বজাতীয় রাজ্যগুলোর তুলনায় খুব একটা সভ্য
ছিল না। মরুভূমিতে সেই অর্থে কম শুকনো অঞ্চল, জঙ্গল
এবং পাহাড়গুলোতে মধ্যে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত একাধিক আদিম
বর্বর গোষ্ঠী এবং উপজাতি। সুদুর দক্ষিণে এক রহস্যময় সভ্যতা ছিল, যার সাথে থুরিয়ান সংস্কৃতির যোগাযোগ ছিল না। যারা আচার আচরণে ছিল
প্রাক-মানব প্রজাতির। মহাদেশের সুদূর পূর্ব
তীরেও বসবাস করত অন্য আর একটা জাতি। এরা মানুষ, তবে
একইরকম রহস্যময় এবং অ-থুরিয়ান। যাদের সাথে লেমুরিয়ানদের
যোগাযোগ ছিল। লেমুরিয়ান দ্বীপপুঞ্জের পূর্ব দিকে অবস্থিত কোনও এক নামহীন
অজ্ঞাত এলাকা থেকে এদের আগমন হয়েছিল।
থুরিয়ান সভ্যতা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল; তাদের সেনাবাহিনীর বেশিরভাগই ছিল ভাড়াটে বর্বর। পিক্ট, আটলান্টিয়ান এবং লেমুরিয়ানরা ছিলেন তাদের সেনাপতি, তাদের নেতা, এমন কী কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের রাজাও। রাজ্যগুলির মধ্যে
চলতে থাকা দ্বন্দ্ব, ভ্যালুসিয়া ও কমোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ এবং মূল ভূখণ্ডে আটলান্টিয়ানদের
আগ্রাসী অভিযান দ্বারা প্রতিষ্টিত রাজত্বর সূত্রে মূল ইতিহাস চাপা পড়ে যায় একাধিক কিংবদন্তির
তলায়।
এরপরে ঘটে এক মহাবিপর্যয়। কেঁপে ওঠে
তৎকালীন বিশ্ব। আটলান্টিস এবং লেমুরিয়া ডুবে যায়। পিক্ট দ্বীপপুঞ্জর
পাহাড়ী এলাকাগুলো একত্রিত হয়ে একটা নতুন মহাদেশের গঠন করে। থুরিয়ান মহাদেশের অংশগুলো
অদৃশ্য হয়ে যায় সামুদ্রিক তরঙ্গের দাপটে। সেখানে সৃষ্টি হয় বড় বড় হ্রদ। বিস্তার
ঘটে সামুদ্রিক এলাকার। এর সাথেই আগ্নেয়গিরিগুলি ভয়াবহ বিস্ফোরণের গ্রাসে হারিয়ে
যায় অসংখ্য নগর। সোজা কথায় পৃথিবীর বুক থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় পুরো এক একটা
দেশ।
বর্বর জাতির মানুষেরা সভ্য জাতিগুলোর
চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থানে ছিল। পিকটিশ দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা ধ্বংস হয়ে
গেলেও, তাদের থেকে বেঁচে যাওয়া একটা বড়সড় জনসংখ্যা ভালুশিয়ার দক্ষিণ সীমান্তের পাহাড়ের
মধ্যে বসতি স্থাপন করে। প্রাকৃতিক পরিবেশ
তাদের সুবিধা করে দিয়েছিল বিদেশী আক্রমণ থেকে বাঁচার। ফলে তারা নিরাপদেই থেকে যায়।
একেবারে রাজধানী এলাকায় থাকা আটলান্টিয়ানরাও এই সাময়িক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়েছিল
এবং ডুবতে থাকা মহাদেশ থেকে তাদের হাজার হাজার উপজাতিয় মানুষ জাহাজে করে পালাতে
সক্ষম হয়। অনেক লেমুরিয়ান পালিয়ে গিয়েছিল থুরিয়ান মহাদেশের পূর্ব উপকূলে, যা তুলনামূলকভাবে অনাঘ্রাতাই ছিল। সেখানে তারা ওখানে বসবাসকারী
প্রাচীন জাতির ক্রীতদাসে পরিণত হয় এবং কয়েক হাজার বছর ধরে নির্মম দাসত্বের ইতিহাসে
সামিল হয়ে যায়।।
পরিবর্তিত প্রাকৃতিক অবস্থার ফলে
মহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর অদ্ভুত সব রূপের জন্ম হয়। ঘন জঙ্গলে
ঢেকে যায় সমভূমি। দুর্দম নদীগুলো নিজের মতো করে রাস্তা খুঁজে নিয়ে এগিয়ে যায় সমুদ্রের
দিকে। নতুন অজ্ঞাত পাহাড়
মাথা তুলে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। উর্বর উপত্যকায় পুরানো শহরগুলোর ধ্বংসাবশেষ
চলে যায় বিশাল বিশাল হ্রদের তলায়। আটলান্টিয়ানদের মূল রাজধানী এলাকা, ডুবে যাওয়া অঞ্চল, সর্বত্র বিচরণ করতে থাকে নানা ধরণের বন্য
জীবজন্তু এবং বর্বর প্রজাতির মানুষ আর বানরের দল।
জীবন বাঁচানোর জন্য অবিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করতে এরা বাধ্য হয়। যদিও একদা যে অত্যন্ত উন্নত বর্বরতা তারা আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিল সেই মানে পৌছাতে পারে না। ধাতু এবং আকরিক দ্রব্যাদি পাওয়ার সূযোগ তাদের হাতছাড়া হয়েছিল প্রাকৃতিক রদবদলে। ফলে আদিম যুগের মানুষের মতো এরা আবার পাথরের যুগে ফিরে যায়। শক্তিশালী পিকটিশ জাতির সংস্পর্শে এসে এই পরিশ্রমী মানুষেরা উন্নীত হয় এক অসাধারণ শৈল্পিক স্তরে। পিক্টরাও অবশ্য পাথুরে যুগে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু জনসংখ্যা এবং যুদ্ধ-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ওরা একটু বেশি উন্নতি করে ফেলে। যদিও এদের ভেতর আটলান্টিয়ানদের মতো কোনও শৈল্পিক প্রকৃতি ছিল না; কিন্তু রুক্ষ আচরণ যুক্ত পিক্টরা ব্যবহারিক স্তরে উন্নত জাতি ছিল। এরা নিজেদের শত্রুদের মতো হাতির দাঁত খোদাই করা বা ছবি আঁকার মতো শিল্প করতে না জানলেও লক্ষণীয়ভাবে প্রচুর পরিমাণে উন্নত মাত্রার পাথুরে অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ করেছিল।
এই পাথুরে যুগের রাজ্যগুলোর সংঘর্ষ
শুরু হয়। একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পিছিয়ে যেতে থাকে আটলান্টিয়ানরা, প্রায় বর্বর
অবস্থায় ফিরে যেতে হয় তাদের। আর এর সঙ্গেই পিক্টদের বিবর্তন থমকে যায়। মহা বিপর্যয়ের পাঁচশ বছর পর বর্বর রাজ্যগুলো বিলুপ্ত
হয়ে যায়। পিক্টদের যে রূপ তখন দেখা যায় তারা আচরণে বন্য প্রকৃতির। আটলান্টিয়ান
বন্য উপজাতিদের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন যুদ্ধ চলতেই থাকে তাদের। পিক্টদের সুবিধা ছিল জনসংখ্যার
আধিক্য এবং একতা। অন্যদিকে আটলান্টিয়ানরা
ছুটকো-ছাটকা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এটাই ছিল সেই সময়ের পশ্চিম
প্রান্তের ছবি।
সুদূর পূর্বদিকের এলাকা, বিশালাকৃতির পাহাড় এবং বিশাল বিশাল হ্রদগুলোর অবস্থানের কারণে
পৃথিবীর অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। লেমুরিয়ানরা প্রাচীন অধিবাসীদের
দাস হয়ে করে চলেছিল কঠোর পরিশ্রম। আরও দূরের দক্ষিণের অঞ্চল তখনও রহস্যের
আড়ালেই ঢাকা পড়ে আছে। মহা বিপর্যয়ের
ধাক্কা না লাগার কারণে সেখানে এখনও প্রাক-মানব যুগের পরিবেশ বর্তমান। থুরিয়ান মহাদেশের
সভ্য জাতিগুলোর ভেতর ভ্যালুশিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত নয় এমন এক জাতি বসবাস করত দক্ষিণ-পূর্বের নীচু পাহাড়ি এলাকায়, নাম ঝেম্রি। বিশ্বের নানা জায়গায় প্রায়
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্য বর্বর মানব সদৃশ গোষ্ঠীরা এসব মহা সভ্যতার উত্থান ও পতন
সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবহিত ছিল। তবে সুদূর উত্তরে একদল মানুষ আস্তে আস্তে তাদের অস্তিত্বর
বিকাশ ঘটাতে শু্রু করে।
মহা বিপর্যয়ের সময়, বন্য বর্বর একদল মানুষ, যাদের মানসিক বিকাশ
নিয়ান্ডারথালদের চেয়ে বেশি ছিল না, ওই ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে
উত্তরে পালিয়ে যায়। তুষার আবৃত ওই অঞ্চলে তারা দেখতে পায় ওখানকার বাসিন্দাদের। হিংস্র
বিশাল আকৃতির সাদা শরীরের তুষার মানব ধরণের কিছু প্রাণী - নিশ্চিতভাবেই
ওরা ওই জলবায়ুর সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। যাদেরকে নয়া আগন্তুকের দল রক্ত
ঝড়ানো সংগ্রাম করে আর্কটিক বৃত্ত পার হয়ে চলে যেতে বাধ্য করে। ভেবে নেয় এর ফলে
ওদের আর বেঁচে থাকার কোন সম্ভবনা থাকবে না। আর নিজেরা এই নতুন কঠোর পরিবেশের সঙ্গে
নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে।
পিক্ট–আটলান্টিয়ান যুদ্ধ এক সম্ভাব্য নতুন সংস্কৃতির সূচনাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আরেণীটা কমমাত্রার ভৌগোলিক বিপর্যয় মূল মহাদেশের
চেহারায় নিয়ে আসে আরও পরিবর্তন। যেখানে সারি সারি হ্রদ ছিল সেখানে জন্ম নেয় এক
অভ্যন্তরীণ সমুদ্র। যার ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের
এলাকা একেবারের বিছিন্ন হয়ে যায়। উপজাতি যুদ্ধের ফলে বর্বরদের যে ধ্বংসের সূচনা
হয়েছিল তা সম্পূর্ণ করে ভূমিকম্প, বন্যা এবং আগ্নেয়গিরির
প্রকোপ।
কম মাত্রার বিপর্যয়ের এক হাজার বছর পরে, যে পশ্চিমী জগত দেখা যায়, তা জঙ্গল, হ্রদ এবং প্রবলবেগ
সম্পন্ন একাধিক নদীর এক বন্য এলাকা। উত্তর-পশ্চিমের বনাঞ্চল আবৃত
পাহাড়গুলোতে বসবাস করে একদল নরবানর, যারা কথা বলতে জানে না। আগুনের জ্ঞান বা জিনিসপত্র
ব্যবহার করার পদ্ধতিও তাদের আয়ত্ত হয়নি। এরা আটলান্টিয়ানদের বংশধর। মহা বিশৃঙ্খলার পর একাধিক কারণে এদের পূর্বপুরুষরা
অরন্যের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। দক্ষিণ-পশ্চিমে
বাস করত গুহাবাসী বর্বরদের বিক্ষিপ্ত গোষ্ঠী। এরা কথা বলতে জানলেও সেটা ছিল কথনের একেবারে আদিম
রূপ। এদের পরিচয় এখনও পিক্টস
রুপেই আছে। যদিও এই শব্দটি তাদের কাছে মানুষ শব্দের সমার্থক মাত্র। যা তাদের আলাদা
করে রেখেছে পশুদের থেকে। সেই পশু যাদের সঙ্গে রোজ ওদের করতে হয় লড়াই জীবন বাঁচানো এবং
খাদ্যের জন্য। পূর্ব পুরুষদের সঙ্গে
তাদের এটাই একমাত্র সংযোগ সূত্র। এই আদিম জীবনে অভ্যস্ত পিক্ট বা বানর সদৃশ আটলান্টিয়ানদের
সঙ্গে অন্যান্য উপজাতির মানুষের কোনও যোগাযোগ ছিল না।
পূর্ব দিকে, লেমুরিয়ানরা দাসত্বর অত্যাচার শিকার করতে করতে এতটাই বর্বরতার
দ্বারা আচ্ছন্ন হয় যে, একদা তারা বিদ্রোহ গোছের কিছু একটা করে তাদের তথাকথিত
প্রভুদের খতম করে দেয়। এরপর এক অদ্ভুত সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ওরা বিচরণ করতে
থাকে। এই বর্বরদের নরমেধ থেকে সেই আদি সভ্যতার বেঁচে পালাতে পারা মানুষেরা চলে যায়
পশ্চিম দিকে। এরা দক্ষিণের সেই রহস্যময়
প্রাক-মানব প্রজাতির রাজ্য আক্রমণ করে এবং ওদের উৎখাত
করে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপন
করে সেখানকার প্রাচীন ভাবধারায়। এই নতুন রাজত্ব পরিচিত হয় স্টিগিয়া নামে। প্রাচীন
জাতিটা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল মনে করা হলেও, সেই জাতির কিছু প্রবীণ বেঁচে
গিয়েছিলেন, যাদের বিশেষ কোনও কারণে উপাসনা করাও শুরু হয়।
ওই মুহূর্তে বিশ্বের নানা স্থানে ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র বন্য বর্বর মানুষের অনেক দল বা গোষ্ঠীর উত্থানের প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। ছড়িয়ে
ছিটিয়ে থাকার ফলে সেভাবে এদের শ্রেণীবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে উত্তরের উপজাতিরা
সংখ্যায় বাড়ছিল। এদের পরিচিতি জন্মেছিল হাইবোরিয়ান বা হাইবোরি নামে। এদের দেবতা ছিলেন বোরি - এমন কিছু মহান গোষ্ঠীপ্রধান, যাদের কিংবদন্তি
একসঙ্গে মিলে মিশে গিয়ে কিছু গল্পকথার রূপে এক মহান রাজার চরিত্র হয়ে টিকে গিয়েছিল। প্রাচীন সময়ের সেই মহা বিপর্যয়ের দিনগুলোতে এই
গোষ্ঠীপ্রধানেরাই এদের উত্তর দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এরা উত্তরের নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং দক্ষিণের দিকেও এগোতে শুরু করেছে। তখনও অবধি এদের সঙ্গে অন্য কোনও গোষ্ঠীর দেখা সাক্ষাৎ ঘটেনি। হয়নি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। পনেরশো বছরের মধ্যে উত্তরের এই জনগোষ্ঠীতে যে মানুষদের দেখা যেতে লাগল, তারা যথেষ্ট লম্বা, চুল বাদামী, চোখের মনি ধূসর, শক্ত সমর্থ যোদ্ধাসুলভ চেহারা। সঙ্গেই মানসিক প্রকৃতিতে শিল্পকলা এবং কাব্যর মিশ্রণ ঘটেছে। এরা এখনও বেশিরভাগ সময়টাই শিকার করেই যাপন করলেও, দক্ষিণের উপজাতিরা কয়েক শতাব্দী ধরে গবাদি পশু পালন করে চলেছে। এর ভিতরেই এমন এক ঘটনা ঘটে যা এদেরকে অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে ব্যতিক্রমী হিসাবে চিহ্নিত করে দেয়। সুদূর উত্তরে ঘুরে বেড়াতে থাকা এক মানুষ এক চমকপ্রদ খবর নিয়ে আসে। সে জানায়, জনশূন্য বলে কথিত বরফের এলাকায় বানর-সদৃশ মানুষের একটা বিস্তৃত উপজাতি বসবাস করে। হাইবোরিয়ানদের পূর্বপুরুষদের নামে মানুষটা শপথ করে বলে সে ওই পশুদের বিতাড়িত করে আরও বাসযোগ্য জমি নিজেদের দখল করবে। ওদেরকে নির্মূল করার জন্য, কারণ তার ধারণা এরা একদিন সভ্য মানুষে পরিণত হয়ে বিপদ ঘটাবে, আর্কটিক বৃত্তের বাইরে এক বড় মাপের যোদ্ধার দলকে তার সঙ্গে পাঠানোর আবেদন জানায় সে। বিদ্রুপের শিকার হয় মানুষটা। তবুও তাকে অনুসরণ করে দুঃসাহসী একদল যুবক উত্তরের দিকে যায়, কিন্তু কেউই আর ফিরে আসেনি।
হাইবোরিয়া উপজাতির মানুষেরা দক্ষিণের দিকে চলতে
শুরু করে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে এরকম কিছু হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। তাদের কাছে এর
পরবর্তী যুগটা ছিল বিচরণ এবং বিজয়ের এক মহাগাথা স্বরুপ। আসলে বিশ্ব ইতিহাস ছেয়েই
আছে শুধুই উপজাতিদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া, বসতি স্থাপন এবং একের সঙ্গে
অন্যের যুদ্ধর প্রবহমান ধারার বিবরণীতে।
এর পাঁচশো বছর পরে পৃথিবীর দিকে তাকানো
যাক। বাদামী চুলের হাইবোরিয়ান উপজাতি স্থানান্তরিত হয়েছে দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকে। ছোটো ছোটো অনেক অসংবদ্ধ
উপজাতির ‘নাম ও নিশান’ মিটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে। নানা কারণে প্রাচীন উপজাতির
এই বিজয়ী গোষ্ঠীর মানুষের রক্তর সঙ্গে মিশেছে অন্য গোষ্ঠীর রক্তধারা। শারীরিক ও
মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলোতে ঘটেছে সংশোধন এবং পরিবর্তন। এই মিশ্র জাতির মানুষদেরকে আক্রমণ
করেছে আদি শুদ্ধ রক্তের অধিকারী নতুন প্রজন্ম। তাদের তীব্র আক্রমণে বাছবিচারহীনভাবে
ঝাঁট দেওয়ার মতো একদিকে যেমন একাধিক গোষ্ঠী ধুয়ে মুছে সাফ হয়েছে, আবার অন্যদিকে করে
আরও বেশি মিশ্রিত জাতির উদ্ভবও ঘটেছে।
এখনও বিজয়ীরা প্রাচীন কোনও জাতির
মুখোমুখী হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঝেম্রিদের
বংশধরদের সঙ্গে অসংবদ্ধ গোত্রর কোনও নয়া গোষ্ঠীর মিলনে যে নতুন রক্তের শ্রেনীর জন্ম
হয়েছে তারা তাদের প্রাচীন সংস্কৃতির কিছু ম্লান ছায়া পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেছে। পশ্চিমে বানর সদৃশ আটলান্টিয়ানরা
পৌছে গিয়েছে নিজেদের পূর্ণ বিকাশের মাত্রায়। তাদের আসল অস্তিত্বর চক্র খতম হয়ে
গেছে অনেক আগেই। একদা যে তারা মানুষ ছিল সেটাই ভুলে গেছে; অন্য কোনোরকম কিছুও যে হতে পারে এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানে
না। মানব স্মৃতির প্রভাব ছাড়াই তাদের নিরবচ্ছিন্ন উত্তরণ ঘটছে। এদের বাসস্থানের দক্ষিণে
পিক্টরা এখনও বন্য প্রকৃতিরই থেকে গেছে। প্রকৃতির আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে তাদের উন্নতি
বা পশ্চাদপসরণ কিছুই ঘটেনি। ।
আরও দক্ষিনে স্বপ্নসম অবস্থান করছিল
স্টিগিয়ার প্রাচীন রহস্যময় রাজত্ব। এর পূর্ব সীমানায় ঘুরে বেড়ায় এক যাযাবর বর্বর গোষ্ঠী, ইতিমধ্যেই যারা শেমাইট বা শেমের সন্তান বলে হিসাবে পরিচিতি
লাভ করেছে।
পিক্টদের বাসস্থানের পর ছিল জিংগের বিস্তৃত
উপত্যকা, বিশাল বিশাল পাহাড় দিয়ে সুরক্ষিত। এখানে নামহীন এক আদিম জনজাতি বাস করত। যাদের
সাময়িকভাবে শেমাইটদের অনুরূপ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে। এরা উন্নত কৃষি ব্যবস্থার
প্রচলন করে নিজেদের অস্তিত্বকে বিকশিত করেছিল।
আরেকটা বিষয় হাইবোরিয়া সংস্কৃতি প্রবাহকে
বিশেষ প্রেরণা জ্ঞাপন করেছিল। এই জাতির এক উপজাতি তাদের ভবন নির্মাণ ক্ষেত্রে
পাথরের ব্যবহার আবিষ্কার করে। এই সূত্র ধরেই প্রথম হাইবোরিয়ান রাজত্বর সুচনা ঘটে – অতিমাত্রায় অসভ্য এবং বর্বর প্রকৃতির হাইপারবোরিয়া রাজত্ব। যার
শুরুই হয়েছিল পাথরের বোল্ডার দিয়ে এক আদিম স্তরের দুর্গ নির্মাণ দ্বারা। যা তাদের
বাঁচিয়েছিল অন্য আদিবাসীদের আক্রমণ থেকে। এই উপজাতির লোকেরা ঘোড়ার চামড়া দিয়ে
বানানো তাঁবুর তলায় রাত কাটানোর অভ্যাস বর্জন করে পাথরের ঘরগুলোতে থাকতে অভ্যস্ত
হয়ে পড়ে। যা তাদের অতিরিক্ত সুরক্ষা দেয়। কমে যায় অযাচিত আক্রমণে জীবন হানির
মাত্রা, শক্তিশালী হয়ে উঠে তুলনামুলকভাবে। ইতিহাসের একাধিক নাটকীয় ঘটনার ভেতর
নিঃসন্দেহে অসভ্য, বর্বর হাইপারবোরিয়ার রাজত্বর ভয়াবহ উত্থান এক অতুলনীয় বিষয়।
যাযাবর জীবনকে পিছনে ফেলে আত্মরক্ষার স্বার্থে সাধারন পাথরের বাসস্থান এবং
সাইক্লোপিয়ান প্রাচীরের আড়ালে বসবাস শুরু করা, নিশ্চিতভাবেই উন্নত পাথরের যুগে এক
বিশেষ ঘটনা। কোন অজানা সুত্রে আদিম স্থাপত্য বিদ্যার একেবারে প্রাথমিক ধাপ অর্জন
করে এই জাতি অন্যদের চেয়ে প্রতিযোগিতায় একটু এগিয়েই গিয়েছিল।
এই রাজত্বের উত্থানের ফলে অনেক উপজাতিকেই
যুদ্ধে পরাজিত হতে হয়েছিল। যারা এদের দাস হতে অস্বীকার করে, সেই সব গোষ্ঠী শুরু করে নতুন বাসস্থানের
অন্বেষণ। পাড়ি দেয় লম্বা পথ। অর্ধেক বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তারা। এছাড়াও ইতিমধ্যেই
উত্তরাঞ্চলের উপজাতিরাও সেখানকার দৈত্যাকার স্বর্ণকেশী নরবানরদের আক্রমণে যথেষ্ট
পরিমাণে ক্ষতি স্বীকার করে চলেছিল।
এর পরের হাজার বছরের গল্প শুধুই হাইবোরিয়ানদের
উত্থানের কাহিনী। যাদের যুদ্ধ লোলুপ উপজাতিগুলো পশ্চিমা বিশ্বে তাদের আধিপত্য
বিস্তার করে। আদিম রাজত্ব ধীরে ধীরে একটা ভদ্রস্থ আকার নিতে থাকে। বাদামী চুলের আক্রমণকারীরা
পিক্টদের মোকাবিলা করে। খেদিয়ে পাঠিয়ে দেয় পশ্চিমের বন্ধ্যা জমিতে। উত্তর পশ্চিম দিকে, আটলান্টিয়ানদের বংশধরদের বানর প্রকৃতি পরিবর্তিত হয় প্রাথমিক
বর্বরতার মাত্রায়। এদের সঙ্গে এখনও আমাদের পরিচিত বিজয়ী গোষ্ঠীর দেখা হয়নি। পূর্বদিকে
লেমুরিয়ানরা এক অদ্ভুত অর্ধ-সভ্য পরিস্থিতির বিকাশ ঘটিয়েছে।
দক্ষিণে হাইবোরিয়ানরা শেম নামের তৃণভুমি এলাকার সীমান্তে কোথ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
এর ফলে ওই এলাকায় বসবাসকারী আদিম বুনো মানুষেরা যারা স্টিগিয়ানদের দ্বারা
নিষ্পেষিত হচ্ছিল, তারা কিছু পরিমাণে হাইবোরিয়া সংস্কৃতির ছোঁয়া পেয়ে তাদের বর্বর
আচরণ ছেড়ে একটু একটু করে উন্নত হচ্ছে। সুদূর উত্তরের স্বর্ণকেশী দৈত্যাকার নরবানরদের
শক্তি এবং সংখ্যা বেড়েছে। ফলে উত্তরের হাইবোরিয়ান উপজাতিগুলি দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। চলার
পথে যে সমস্ত গোষ্ঠীর দেখা পাচ্ছে তাদের হয় খতম করে দিচ্ছে না হয় নিজেদের দাসে
পরিণত করছে। প্রাচীন হাইপারবোরিয়া রাজত্ব এরকম এক উত্তরের গোষ্ঠী দ্বারা উৎখাত হয়েছে, যদিও পুরানো নামটা থেকেই গেছে। হাইপারবোরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে ঝেম্রি নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে জামোরা নামে। দক্ষিণ-পশ্চিমে, পিক্টদের একটা উপজাতি জিংগের উর্বর
উপত্যকা আক্রমণ করে, ছিনিয়ে নিয়েছে কৃষিক্ষেত্র সমৃদ্ধ অঞ্চল
এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করেছে তাদের সঙ্গেই। এই মিশ্র জাতিটিকে পরবর্তী
সময়ে পদানত করে হয়েছিল হাইবোরি নামের আর এক উদ্ধত উপজাতি। আর এই সুত্রেই জন্ম নেয় এক মিশ্রিত উপজাতির নতুন
রাজপাট, জিঙ্গারা।
আরও পাঁচশো বছর পর আমাদের আলোচ্য বিশ্বের রাজ্যগুলিকে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। হাইবোরিয়ানদের রাজ্য - অ্যাকুইলোনিয়া, নেমেডিয়া, ব্রাইথুনিয়া, হাইপারবোরিয়া, কোথ, ওফির, আরগোস, করিন্থিয়া এবং এক সীমান্ত রাজ্য। এরাই পশ্চিমা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এইসব রাজ্যের পূর্বদিকে ছিল জামোরা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে জিঙ্গারার অবস্থান। হাইবোরিয়ান নানান রাজত্বের মানুষদের শ্যামলা ত্বক এবং অদ্ভুত রকমের আচার আচরণগত কিছু মিল ছাড়া আর কোন সম্পর্ক ছিল না। দক্ষিণে অবস্থান করছিল স্টিগিয়া, বিদেশী আগ্রাসনের ছোঁয়া লাগেনি তাদের গায়ে। যদিও শেমের মানুষেরা কোথের এক অপ্রীতিকর ঘটনার সুত্রে স্টিগিয়ার জোয়ালে নিপিড়িত হচ্ছিল। ওখানকার কৃষ্ণবর্ণের মালিকদের খেদিয়ে দেওয়া হয় স্টিক্স এবং নিলাস বা নীলনদের দক্ষিন প্রান্তে। সেই নীল নদ যা ছায়াবৃত অঞ্চল থেকে জন্ম নিয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে প্রায় সমকোণে বেঁকে পশ্চিমে শেমের যাযাবর ভূমির মধ্য দিয়ে চলে গেছে মহাসমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হতে। হাইবোরিয়া রাজত্বের একেবারে পশ্চিমে অবস্থিত অ্যাকুইলোনিয়ার উত্তরে বসবাস করে সাঙ্ঘাতিক আক্রমণাত্মক বন্য বর্বর এক গোষ্ঠী। আটলান্টিয়ানদের বংশধর এরা, পরিচয় সিমেরিয়ান নামে। এরা কোন আক্রমনকারী উপজাতির অধীন নয়। দ্রুত নিজেদের উন্নতি ঘটিয়েছে আক্রমণকারীদের গতিবিধির ওপর নজর রেখে। অ্যাকুইলোনিয়ার পশ্চিমে প্রান্তরে দাপট দেখিয়ে বেড়ানো চিরন্তন শত্রু পিক্টদের থেকে এদের অগ্রগতির মাত্রা অনেক বেশী।
আরও পাঁচ শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পর হাইবোরির
কর্মঠ জনগণ এমন সভ্যতার মালিক হয়েছে যে, কোন বুনো উপজাতি এদের সংস্পর্শে এলেই
নিজেদেরকে বদলে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজত্বর দাবিদার অ্যাকুইলোনিয়া, তবে অন্যরাও টক্কর দিচ্ছে এর সঙ্গে নিজস্ব মিশ্র জাতির শক্তিতে
ভর দিয়ে। অ্যাকুইলোনিয়ার উত্তরে অবস্থিত এক প্রদেশ গান্ডারল্যান্ড। এদের
অধিবাসীদের শরীরে বইছে আদিম রক্তের স্রোত। অন্য উপজাতির সঙ্গে এদের মিশ্রণ জাতটিকে
দুর্বল করতে পারেনি। বরং তারাই পশ্চিমা বিশ্বে অবস্থান করছে সর্বোচ্চ
স্থানে। অবশ্য চারদিকে বর্বর উপজাতিগুলোর শক্তি বাড়ছে।
উত্তরে, সোনালী চুলের নীল চোখের বর্বর উপজাতির মানুষেরা, যারা আর্কটিক
এলাকার সেই স্বর্ণকেশী বুনো জাতির বংশধর, তাদের তুষার আবৃত এলাকা থেকে খেদিয়ে দিয়েছে
সব হাইবোরিয়ানদের, শুধু বাদ থেকেছে হাইপারবোরিয়ার প্রাচীন রাজধানী। ওখানকার
বাসিন্দারা নিজেদেরকে বাঁচাতে পেরেছিল ওই আক্রমণকে প্রতিহত করে। এদের দেশের পরিচয় নর্ডহেইম
নামে। এদের ভেতর আবার দুটো ভাগ। ভ্যানাহেইমের লাল চুলওয়ালারা ভানির এবং আসগার্ডের হলুদ
চুলওয়ালারা হল আসির।
এই সময়ে ইতিহাসের মঞ্চে আবার প্রবেশ
ঘটেছে লেমুরিয়ানদের, যাদের পরিচিতি এখন হিরকানিয়ান নামে। কয়েক শতাব্দী ধরে এরা
সরে যেতে বাধ্য হয়েছে ক্রমাগত পশ্চিমের দিকে। এরাই এখন ভিলায়েত নামক অভ্যন্তরীণ সমুদ্রের
দক্ষিণ প্রান্ত এলাকায় একটা উপজাতি রূপে দক্ষিণ-পশ্চিম তীরে তুরান রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। অভ্যন্তরীণ সমুদ্র এবং
পূর্ব সীমান্তের আদিম রাজ্যগুলির মাঝখানে স্তেপ সমভূমির বিস্তৃত অঞ্চল এবং একেবারে
উত্তর ও দক্ষিণের শেষ প্রান্তে মরুভূমি। এই অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে অ-হিরকানিয়ান বাসিন্দারা। উত্তরাঞ্চলে যারা আছে তাদের কোনও
পরিচিতি নেই। দক্ষিণে শেমিটিশ আদিবাসীর দল, যাদের
রক্তে কিছু পরিমাণে মিশে আছে হাইবোরিয়ান রক্ত। এই সময় যত এগিয়ে যেতে থাকল অন্যান্য
হিরকানিয়ান গোষ্ঠীগুলো চলে গেল পশ্চিম দিকে, অভ্যন্তরীণ সমুদ্রের উত্তর সীমানা ঘিরে
স্থাপন করল বসতি। এদের সঙ্গে পূর্বের
এলাকায় সংঘর্ষ চলতেই থাকল হাইপারবোরিয়ানদের।
এই সময়ের মানুষদের দিকে এক ঝলক
তাকানো যাক। প্রভাবশালী হাইবোরিয়ানরা আর একই রকম বাদামী চুল এবং ধূসর চোখের তারার
অধিকারী নেই। অন্যান্য জাতের সঙ্গে ঘটেছে তাদের মিশ্রণ। শেমাইটদের এক শক্তিশালী জাতের
উদ্ভব হয়েছে। কোথ বা আরগোস জাতের সঙ্গে স্টিগিয়ার মিশ্রণ ঘটেছে। যদিও পরবর্তীকালে শেমাইটদের তুলনায় জিংগারদের সঙ্গে
মিলিত হওয়ার একটা স্রোত দেখা গিয়েছিল এই সব জাতের ভেতর। যতদিন অবধি দক্ষিণের প্রদেশ
পোয়েটেইনের শক্তিশালী কালচে চুল এবং বাদামী চোখের মানুষদের দেখা পাওয়া গেছে ততদিন
পূর্ব ব্রাইথুনিয়ানরা শ্যামলা গাত্র বর্ণের জামোরিয়ানদের সঙ্গে এবং দক্ষিণ অ্যাকুইলোনিয়ানরা
বাদামী জিঙ্গারিয়ানদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। হাইপারবোরিয়ার প্রাচীন রাজ্যর অবস্থান অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি
দূরে হলেও তাদের শরীরেও মিশছিল অন্য উপজাতির রক্ত। হিরকানিয়ান, আসির এবং জামোরিয়া থেকে ধরে আনা নারীদের সঙ্গে সংসর্গ ছিল তার কারণ।
একমাত্র গান্ডারল্যান্ড প্রদেশে, কোনরকম দাস দাসী ব্যবস্থা
প্রচলিত না থাকায়, খাঁটি হাইবোরিয়ান রক্ত সুত্রের মানুষেরা
বেঁচে আছে। বর্বররাও কিন্তু তাদের রক্ত প্রবাহকে বিশুদ্ধ রেখেছে; সিমেরিয়ানরা লম্বা এবং শক্তিশালী, মাথায় কালো চুল এবং
নীল বা ধূসর চোখের মনি। নর্ডহেইমের লোকেদের গঠনও একই রকম,
শুধু তাদের গায়ের চামড়া সাদা, নীল চোখ এবং সোনালি বা লাল চুল।
পিক্টরা আগেও যেমন ছিল তেমনই আছে–ছোটোখাটো আকার, কালো ত্বক, কালো চোখ এবং চুল। হিরকানিয়ানদের
চামড়া আরও বেশী কালচে, তবে লম্বা এবং পাকানো চেহারা। এর সঙ্গেই এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য
তাদের আধখোলা চোখ। যার কারণ এদের সঙ্গে এক কৌতূহলজনক বুদ্ধিমান জাতির মানুষের মিশ্রণ। যাদেরকে তারা ভিলায়েতের পূর্ব দিকের পাহাড়ি
এলাকা থেকে খেদিয়ে দিয়েছিল পশ্চিম দিকে আসার সময়। শেমাইটরা ছিল সাধারণত মাঝারি উচ্চতার। তবে মাঝে মাঝে স্টিগিয়ান রক্তের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে
তাদের ভেতরেও জন্ম নিত তুলনামূলকভাবে হুকের মতো ব্যাঁকা নাক, কালো চোখের মণি আর নীলচে-কালো চুলের দৈত্যাকার কিছু মানুষ। স্টিগিয়ানরা ছিল লম্বা,
পেশি বহুল, খাড়া মেরুদন্ডের অধিকারী-সোজা কথায় শাসক শ্রেণির
চেহারা যেমনটা হয় সেই ধরণের। সমাজে নিচুস্তরের মানুষেরা ছিল মানসিকভাবে শিরদাঁড়া
বেঁকে যাওয়া, সংকর প্রজাতির একদল মানুষ, যাদের শরীরে নিগ্রো, স্টিগিয়ান, শেমাইট
এমনকি হাইবোরিয়ান রক্তেরো মিশ্রণ ছিল। স্টিগিয়ার দক্ষিণে ছিল অ্যামাজনের বিস্তৃত এলাকা। যেখানে বাস করত কুশাইট, আটলান্টিয়ান এবং দো-আঁশলা জিম্বাবোয়ের মানুষদের এক বিশাল
কৃষ্ণাঙ্গ সাম্রাজ্য।
অ্যাকুইলোনিয়া এবং বুনো পিক্টদের মাঝামাঝি স্থানে ছিল বসসোনিয়ানদের বিচরণ ক্ষেত্র। এরা এক আদিবাসি জাতির বংশধর। যাদের এক হাইবোরিয়ান উপজাতি নিজেদের পদাণত করেছিল। হাইবোরিয়ানদের বিস্তার ঘটছিল নানান এলাকায়। এই মিশ্র জাতের মানুষেরা কখনই বিশুদ্ধ হাইবোরীয় সভ্যতা অর্জন করতে পারেনি। বরং বলা যায় এদের অবস্থান ছিল সভ্য বিশ্বের একেবারে প্রান্তসীমানায়। উচ্চতায় মাঝারী বসসোনিয়ানদের গাত্রবর্ণ মিশ্র প্রকৃতির, চোখ বাদামী বা ধূসর এবং মাঝারী আকারের করোটির অধিকারী। উঁচু প্রাচীর ঘেরা গ্রামের ভেতর প্রধানত কৃষি কাজ করেই জীবন ধারণ করত। সঙ্গেই ছিল অ্যাকুইলোনিয়া রাজত্বের অংশ। এদের বিচরণ ক্ষেত্র উত্তরে সীমান্ত রাজত্ব উত্তর-পশ্চিমের জিঙ্গারা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এক অর্থে এরা অ্যাকুইলোনিয়ার ঢালের কাজ করত সিমেরিয় এবং পিক্টদের বিরুদ্ধে। বেপরোয়া প্রতিরক্ষামূলক যোদ্ধা হিসাবে এদের খ্যাতি ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উত্তর এবং পশ্চিমা বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে তারা এমন এক প্রকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটিয়েছিল যা প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রায় দুর্ভেদ্য বলেই বিবেচিত হত।
আরও পাঁচশো বছর পরে হাইবোরিয়ান সভ্যতা ধুয়ে
মুছে সাফ হয়ে গেল। এই পতন ছিল এক অনন্য ঘটনা। যা তাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষয়ের কারণে
ঘটেনি। বর্বর দেশগুলো এবং হিরকানিয়ানদের ক্রমবর্ধমান শক্তি ছিল মূল কারণ। হাইবোরিয়ানদের
পতন তখনই ঘটে যখন তাদের প্রাণবন্ত সংস্কৃতি সবচেয়ে উন্নত স্তরে পৌছে গিয়েছিল।
পরোক্ষভাবে যদিও এর পেছনে ছিল অ্যাকুইলোনিয়ার
লোভ যা এই উচ্ছেদ ক্রিয়ায় সহায়তা করে। নিজেদের সাম্রাজ্য প্রসারিত করার ইচ্ছে
থেকেই এর অধিপতিরা প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। জিঙ্গারা, আরগোস এবং ওফির সংযুক্ত ছিল সরাসরি শেমের পশ্চিমাঞ্চলীয় নগরগুলোর
সঙ্গে। যারা সম্প্রতি কোথের নাগপাশ মুক্ত হয়েছিল। কোথ, করিন্থিয়া
এবং পূর্ব শিমিটিশ উপজাতির সঙ্গে এরা বাধ্য হয়েছিল অ্যাকুইলোনিয়াকে যুদ্ধে
সহায়তা করতে। অ্যাকুইলোনিয়া এবং হাইপারবোরিয়ার মধ্যে একটা প্রাচীন বিরোধ ছিলই। দ্বিতীয়
রাজত্বর সেনাদেরকে যেতে হয়েছিল তাদের পশ্চিম প্রান্তের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা
করার জন্য। সীমান্ত রাজত্বর সমভূমি রূপ নিয়েছিল দুর্দান্ত এবং বর্বর এক রণক্ষেত্রের।
যেখানে উত্তরাঞ্চলের সেনাবাহিনী পুরোপুরি পরাজিত হয়। দ্রুত তারা পালিয়ে যায় তাদের তুষারাবৃত
এলাকায়। বিজয়ী অ্যাকুইলোনিয়ানরা এদের পিছু ধাওয়া করেনি। কয়েক শতাব্দী ধরে সফলভাবে
পশ্চিমের রাজ্যকে নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ হওয়া নেমেডিয়া ঘোঁট পাকায় ব্রাইথুনিয়া
এবং জামোরার সঙ্গে। গোপনে এতে যোগ দেয় কোথ। উদীয়মান সাম্রাজ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার সংকল্প
গ্রহণ করে এই জোট। কিন্তু তাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগেই
পূর্ব দিকে এক নতুন শত্রুর আবির্ভাব ঘটে। এটাই ছিল হিরকানিয়ানদের পশ্চিমা বিশ্বের
প্রতি নিজেদের প্রথম ক্ষমতা প্রদর্শন। তুরানের অশ্বারোহী বাহিনী ভিলায়েতের পূর্বদিক
থেকে আগত অভিযাত্রীদের সঙ্গে মিলে আরও শক্তিশালী দল বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জামোরার ওপর। পূর্ব করিন্থিয়াকে ধ্বংস করে এবং ব্রাইথুনিয়ার সমভূমিতে
দেখা পায় অ্যাকুইলোনিয়ানদের। যারা এই হানাদারদের পরাজিত করে এবং পূর্ব দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। এদিকে জোটের
কোমর ভেঙে গিয়েছিল। নেমেডিয়া ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলোতে প্রতিরক্ষামূলক পথ বেছে নেয়। মাঝে
মাঝে তাদের পাশে পাশে এসে দাঁড়ায় ব্রাইথুনিয়া আর হাইপারবোরিয়া এবং যথারীতি গোপনে
সহায়তা করে কোথ। হিরকানিয়ানদের এই পরাজয় অন্যান্য সাম্রাজ্যদের দেখিয়েছিল পশ্চিমা
রাজ্যের আসল শক্তি। যাদের দুর্দান্ত সেনাবাহিনী
মূলত ছিল ভাড়াটে সেনা দিয়ে গঠিত। বিদেশী জিঙ্গারা এবং বর্বর পিক্ট এবং শিমিটিস
সবই ছিল সেখানে। হিরকানিয়ানদের কাছে থেকে জামোরা পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল, কিন্তু ওখানকার অধিবাসীরা জলদি এটা বুঝতে পারে যে এবার তারা পূর্ব
দেশীয় প্রভুদের বদলে পশ্চিমা প্রভুদের অধীনস্থ হলো মাত্র। অ্যাকুইলোনিয়ান সৈন্যদের
ঘাঁটি স্থাপন করা হল সেখানে। শুধুমাত্র বিধ্বস্ত দেশটাকে রক্ষা করার জন্য নয় বরং জনগণকে
নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। হিরকানিয়ানরা এত সহজে হাল ছাড়েনি। তারা পর পর তিনবার
জামোরার সীমানা এবং শেমের ভূখণ্ড জুড়ে আক্রমণ চালায় এবং প্রত্যেকবারই তারা ফিরে
যেতে বাধ্য হয় অ্যাকুইলোনিয়ানদের প্রতিরোধের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে। ওদিকে
পূর্ব দিকে ইস্পাতের বর্মে সারা শরীর ঢাকা তুরানিয়ান সেনাবাহিনীর অশ্বারোহী সৈন্যদলের
শক্তি বাড়ছিল একটু একটু করে। তৈরি হচ্ছিল অভ্যন্তরীণ সমুদ্রের দক্ষিণ সীমানা পার
করার জন্য।
এরসঙ্গেই অ্যাকুইলোনিয়ার অধিপতিদের ধ্বংস
করার অভিপ্রায়ে একটা শক্তি বাড়ছিল পশ্চিম প্রান্তে। উত্তরে সিমেরিয়ান সীমান্তে অবিরাম
দ্বন্দ্ব চলছিল কালো চুলের যোদ্ধাদের সঙ্গে নর্ডহেইমারদের। যুদ্ধ হচ্ছিল আসিরদের সঙ্গে ভানিরদেরও। তএর ভেতরেই হাইপারবোরিয়ায় আক্রমণ হয়, নগরের পর নগর শহর
ধ্বংস হয়ে যায়। সিমেরিয়ানরাও লিপ্ত থাকে পিক্ট এবং বসসোনিয়ানদের সঙ্গে লড়াইয়েতে।
বেশ কয়েকবার অ্যাকুইলোনিয়াতেও আক্রমণ চালায়। যদিও সেগুলো দেশ জয়ের তুলনায় নিছক লুণ্ঠনের
জন্যই করা হয়।
এদিকে পিক্টদের জনসংখ্যা এবং শক্তি আশ্চর্যজনকভাবে
বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভাগ্যের এক অদ্ভুত মোড় বলা যায় একে। মূলত একজন ব্যক্তির প্রচেষ্টার
ফলে এটা ঘটেছিল এবং মানুষটা ছিলেন বিদেশী। যার সুত্র ধরে যে পথে তারা পা রেখেছিল
সেটাই তাদের এক সাম্রাজ্য নির্মাণে সহায়তা করে। এই ব্যক্তি ছিলেন আরুস, একজন নেমেডিয়ান পুরোহিত, একজন সহজাত সংস্কারক। ঠিক কী কারণে মানুষটার
মনে পিক্টদের প্রতি অনুরাগ জন্মায় তা জানা যায়নি কিন্তু ইতিহাস অনুসারে - উনি পশ্চিমের বন্য অঞ্চলে গিয়ে মিত্রার উপাসনা প্রবর্তন করে,
ওই স্থানে বসবাসকারী জাতির মানুষদের বিভিন্ন অভদ্র আচরণ পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর আগে ওই স্থানে যাওয়ার
কারণে ব্যবসায়ী এবং অন্বেষণকারীদের কী ভয়াবহ পরিণতি ঘটেছিল সেসব কাহিনী শুনেও
তিনি পিছিয়ে আসেননি। অসাধারণ কোনও এক ভাগ্যের ছত্রছায়া মাথায় নিয়ে উনি একাকী
নিরস্ত্র অবস্থায় ওদের কাছে যান। যে কোনও কারণেই হোক ওরা ওকে হত্যা করেনি।
হাইবোরিয়ান সভ্যতার সংস্পর্শে এসে পিক্টদের উপকারই হয়েছিল, কিন্তু ওরা সব সময়ে এরকম যোগাযোগের তীব্রভাবে প্রতিরোধ করে এসেছে। বলা হয়ে থাকে যে, ওরা তামা এবং টিন ধাতু ব্যবহার মোটামুটিভাবে শিখেছিল। যা ওদের দেশে খুব একটা পাওয়া যেত না। পরবর্তী সময়ে এই দুই ধাতুর জন্য ওরা জিঙ্গারার পাহাড়ে আক্রমণ চালায়। অথবা বেছে নেয় চামড়া, তিমির দাঁত, ওয়ালরাসের শুড় জাতীয় সেই সব জিনিস লেনদেনের পথ যা বন্য সংস্কৃতির মানুষেরা পছন্দ করত। ওরা এখন আর গুহাকন্দর বা গাছে বসবাস করে না। চামড়ার তাঁবু এবং ডালপালার ঝুপড়ি তৈরি করতে শিখেছিল বসসোনিয়ানদের অনুকরণে। খাবার এখনও ওরা মূলত শিকারের পেছনে তাড়া করেই সংগ্রহ করে। বন্য যেকোনো জীবজন্তুই তাদের শিকারের তালিকায় থাকে। নদী এবং সমুদ্র থেকে মাছও ধরে। এর সঙ্গেই শিখেছে কীভাবে শস্যরোপণ বা উৎপাদন করতে হয়। তবে সেটা খুব একটা করতে দেখা যায় না ওদের। বরং প্রতিবেশী বসসোনিয়ান এবং জিঙ্গারাদের কাছ থেকে চুরি করতেই বেশি পছন্দ করে। ছোটো ছোটো গোষ্ঠী বানিয়ে ওরা বসবাস করত। একের সঙ্গে অপরের বিরোধ ছিল দৈনন্দিন ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদের সাধারণ রীতিনীতিগুলো নৃশংস ধরণের রক্ত ঝরানোর সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত ছিল যা ঠিকঠাক অনুমান করা কোনও সভ্য জাতের মানুষের পক্ষে বেশ কঠিন ছিল। বিশেষ করে নেমেডিয়ার আরুসদের মতো মানুষদের পক্ষে। যতদিন বসসোনিয়ানরা মাঝখানে ছিল ততদিন হাইবোরিয়ানদের সঙ্গে এদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। তবে আরুস জানিয়েছিলেন এরা উন্নতির পথে হাঁটতে শুরু করেছিল। নানা ঘটনাবলী তার সত্যতা প্রমাণ করেছে - যদিও সেটা দারুন কিছু ছিল না।
আরুসের ভাগ্য একটু ভালোই ছিল বলা
যায়। কারণ উনি গর্ম নামে এক নেতার দেখা
পেয়েছিলেন। যার বুদ্ধির মাত্রা সাধারণের চেয়ে একটু বেশিই ছিল। গর্মের চরিত্রের তুলনা বা ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়, চেঙ্গিস খান,
ওথম্যান, অ্যাটিলা বা এরকম ব্যক্তিদের চেয়ে
এমন কিছু উচ্চমানের ছিল না সে। সভ্যতার আদিম ধরাতলে অশিক্ষিত অসভ্যদের মধ্যে জন্মগ্রহণ
করলেও যেকোনোভাবেই হোক তার মনে বিজয়ী হওয়ার প্রবণতা এবং সাম্রাজ্য স্থাপনের
আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছিল। বসসোনিয়ান জারজ সন্তান গর্ম দারুন অবাক হয়ে যায়
নেমেডিয়ার পুরোহিত আরুসের কথাবার্তা শুনে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গর্মকে তার উদ্দেশ্য বোঝাতে
সক্ষম হন আরুস। তাকে মেরে না ফেলে নিজের উপজাতির মধ্যে বসবাস করার অনুমতি দেয়
গর্ম। যা ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য নজির। আরুস সবার আগে ওদের ভাষা শেখেন, তারপরে শুরু
করেন পিক্টদের জীবনযাত্রার নানান অপ্রীতিকর পর্যায় নির্মূল করার কাজ - যেমন মানুষ বলি, রক্ত সম্পর্কের বিরোধিতা এবং বন্দীদের জীবিত পুড়িয়ে মারার
প্রথা। একের পর এক উচ্চকিত বক্তৃতা দিয়েছেন গর্মের সামনে যাকে তার বেশ আগ্রহী বলেই
মনে হয়েছিল, কারণ উলটো দিকে শ্রোতা প্রায়শই প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে থেকে যেতেন। কল্পনাশক্তির
সাহায্যে যদি সেই দৃশ্যের পুনর্গঠন করা হয় – কালো চুলওয়ালা
গোষ্ঠী প্রধান, পরনে বাঘের চামড়া এবং গলায় ঝুলছে মানুষের দাঁত
দিয়ে বানানো মালা, কোনো মতে বানানো কুঁড়েঘরের মেঝেতে ময়লার ওপরে থেবড়ে বসে বেশ
আগ্রহের সঙ্গেই নেমেডিয়া থেকে আগত পুরোহিতের কথা শুনছে। যাকে সম্ভবত সম্মান
দেখাতে বসতে দেওয়া হয়েছে একটা চামড়া দিয়ে ঢাকা মেহগনি কাঠের বড়সড় টুকরোর ওপর। নেমেডিয়ান
পুরোহিতের পরনে সিল্কের পোশাক, রোগা পাতলা সাদা
হাত নেড়ে নেড়ে তিনি শোনাচ্ছেন তাদের আরাধ্য মিত্রা নির্ধারিত চিরন্তন অধিকার এবং বিচারের
কথা। নিঃসন্দেহে তার ইঙ্গিত পিক্টদের দেওয়ালে সাজানো সারি সারি নরকরোটির দিকে। যা তারা কেটে
নিয়েছে শত্রুদের শরীর থেকে। গর্মকে তিরস্কার করে বলছেন, এসব জঘন্য প্রথা ত্যাগ
করতে হবে। শিখতে হবে শত্রুকে ক্ষমা করতে। আরুস জন্মগতভাবে লাভ করেছিলেন সেই সময়ের
প্রেক্ষিতে এক শৈল্পিক জাতির সর্বোচ্চ স্তরের মানসিকতা, যার বিবর্তন ঘটেছিল কয়েক শতাব্দীর সভ্যতার বিকাশে। সে তুলনায়
গর্ম ছিলেন অন্ততপক্ষে এক লক্ষ বছর পিছিয়ে থাকা মানুষ। যারা শুধুই হইচই হট্টগোলের বন্যতায় অভ্যস্ত। ওরা
এখনও বাঘের থাবার সঙ্গে পা মেলায়, কালো নখ দিয়ে চেপে ধরে গরিলার গলা, অন্ধকারে
ওদের চোখে জ্বলে চিতাবাঘের মতো।
আরুস ছিলেন ব্যবহারিক বিদ্যায়
অভ্যস্ত মানুষ। উনি বর্বরতাকে ব্যবহার করে জাগতিক উপাদান লাভের
দিকে পিক্টদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন। হাইবোরিয়ান রাজ্যগুলির শক্তি এবং
জাঁকজমককের কথা শোনাতে থাকেন ওদের। যার কারণ হিসাবে ব্যক্ত করেন দেবতা মিত্রার শক্তিকে।
যার শিক্ষাদান এবং কাজের পদ্ধতি অনুস্রন করে তাদের উন্নতি হয়েছে। শোনান হাইবোরিয়ার
শহর এবং উর্বর সমভূমির কথা। সেখানকার শ্বেত পাথরের দেওয়াল, লোহার রথ, রত্নখচিত মিনার এবং সেই সব ঘোড়সওয়ারদের গল্প যারা চকচকে বর্ম
পড়ে যুদ্ধ করতে যায়। উলটো দিকে গর্ম এসব শুনে নিজস্ব অসভ্য বর্বর প্রবণতার
ভিত্তিতে দেবতা এবং তাদের শিক্ষাদান সম্পর্কে তার নিজের মতামত জানায়। সঙ্গেই জানায়
তাদের বিশ্বাস বস্তুগত প্রাকৃতিক শক্তির ওপর স্থিত, কারণ সে এসবকে বুঝতে পারে। আর
এভাবেই সেই কাদামাটির মেঝের অপরিষ্কার কূটিরের ভেতরে এক সিল্কের পোশাক পরা পুরোহিত
মেহগনি কাঠের টুকরোর ওপর বসে সেখানকার
বাঘের চামড়া পরা প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে- এক নয়া সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন
করার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল।
আগেই বলা হয়েছে, আরুস ছিলেন হাতে কলমে কাজ করতে অভ্যস্ত মানুষ। তিনি পিক্টদের সঙ্গে থাকতে থাকতে এমন অনেক কিছু দেখতে পেলেন যার দ্বারা একজন বুদ্ধিমান
মানুষ চিরন্তন মানবতাকে সাহায্য করতে পারে। এমনকি যখন সেই মানবতা যদি বাঘের চামড়া এবং মানুষের দাঁতের
মালার আড়ালে আবদ্ধ থাকে তবুও। মিত্রার বাকি সমস্ত পুরোহিতের মতো
তাকেও অনেক কিছুই শিখতে ও জানতে হয়েছিল। সেই জানার সুত্রে উনি বুঝতে পারলেন পিক্ট
এলাকার পাহাড়ে লোহার আকরিকের বিশাল সম্ভার মজুদ রয়েছে। স্থানীয় মানুষদের
উনি শেখালেন খনির কাজ। শেখালেন তার নিষ্কাষণ। সেই লোহা ব্যবহার করে যা বানানো হলো,
তাকে কৃষি কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে শিখিয়ে দিলেন। এছাড়াও আরও অনেক রকম
সংস্কারের কাজ উনি করেছিলেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
কাজ যা আরুস করেছিলেন তা হলো, উনি গর্মের মনে বহিঃবিশ্বের সভ্যতাকে দেখার ইচ্ছা জাগিয়ে
দিয়েছিলেন। পিক্টদেরকে শুধুমাত্র লোহার কাজ কীভাবে করতে হয় তা শিখিয়েই থেমে যাননি; যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন পিক্ট আর সভ্য বিশ্বের মধ্যে। গোষ্ঠী প্রধানের অনুরোধে উনি তাকে এবং তাঁর কিছু যোদ্ধাকে বসসোনিয়ান এলাকায়
নিয়ে গিয়েছিলেন। যেখানে গর্মের বর্তমান বাসস্থানের গ্রামবাসীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখেছিল বহিঃবিশ্বের
উজ্জ্বল ঝকমকে জীবনযাত্রা।
আরুস নিঃসন্দেহে ভেবেছিলেন যে, উনি
ওদের পুরোপুরই রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন, কারণ
পিক্টরা তার কথা শুনেছিল, তাদের তামার কুঠার দিয়ে তাকে
হত্যা করেনি। কিন্তু পিক্ট প্রধান নিশ্চিতভাবেই আরুসের কথাকে পুরোপুরি গুরুত্ব দেয়নি।
বিশেষ করে শত্রুকে ক্ষমা করে সৎপথে চলার জন্য যুদ্ধের পথ ত্যাগ করার ব্যাপারটাকে
মেনে নিতে পারেনি। অস্বীকার করার উপায় নেই গর্মের শৈল্পিক বোধের অভাব ছিল; জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে যুদ্ধ এবং হত্যায়। নেমেডিয়ান পুরোহিত যখন সভ্য
দেশগুলির গৌরব নিয়ে কথা বলছেন, তখন তার সামনে থাকা কালো চামড়ার শ্রোতাদের আগ্রহ তার
বলা ধর্মের আদর্শের উপর জাগেনি মোটেই। বরং তারা কান খুলে শুনেছে সমৃদ্ধ শহর এবং উজ্জ্বলতায়
পরিপূর্ণ দেশের সম্পদের কথায়। কারণ সম্ভাবনা আছে সেসব লুটপাট করার। যখন আরুস
বলছেন, মিত্রা কীভাবে নির্দিষ্ট রাজাদের শত্রুদের পরাস্ত করতে সহায়তা করেছিলেন, তখন তার শ্রোতারা মিত্রার অলৌকিক ক্ষমতার কথা শোনায় মন না দিয়ে মনোযোগ দিয়েছিল,
যুদ্ধের সময় সভ্যদেশের নানা ধরণের অস্ত্র ব্যবহারকারী যোদ্ধাদের কথা
শোনার দিকে। কালচে চোখের মণি বিস্ফারিত করে অপঠন যোগ্য মুখাবয়ব নিয়ে সব কথা শুনেছে,
কিন্তু কোনও মন্তব্য না করেই ফিরে গেছে নিজেদের কাজে। চাটুকারিতার ভান করে শিখেছে লোহার
কাজ এবং নানাবিধ বিষয়।
আরুস আসার আগে তারা বসসোনিয়ান ও জিঙ্গারানদের
কাছ থেকে ইস্পাতের অস্ত্র এবং বর্ম চুরি করে আনত, অথবা অপরিশোধিত তামা ও ব্রোঞ্জ পিটিয়ে
নিজেদের মতো করে অস্ত্র বানিয়ে নিত। এখন তাদের জন্য খুলে গিয়েছিল এক নতুন পৃথিবীর
দরজা। উন্নত ধাতব শব্দে এখন মুখরিত হয় তাদের এলাকা। আর গর্ম, এই নতুন ধাতুর ব্যবহার বিধি জেনে নেওয়ার সুত্রে আংশিকভাবে যুদ্ধ
আর আংশিক নৈপুণ্য ও কূটনীতির ব্যবহার করে অন্য গোষ্ঠীর উপর তার আধিপত্য আরোপ করতে
শুরু করে। পরে তার নিজস্ব ভাবনায় সে জারিত করে অন্যান্য বর্বরদেরকেও।
পিক্টরা এখন নিরাপদ আচরণের প্রমান
পেশ করে অ্যাকুইলোনিয়াতে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করার অধিকার লাভ করেছে। একটু একটু
করে তারা উন্নত বর্ম এবং তরোয়াল তৈরি সম্পর্কে তথ্য আহরণ করছে। সঙ্গেই, তারাও এখন অ্যাকুইলোনিয়ার ভাড়াটে সেনাদের দলে প্রবেশ করার সুযোগ
পাচ্ছে। যা একদমই পছন্দ হচ্ছে না বসসোনিয়ানদের। অ্যাকুইলোনিয়ার রাজারা সিমারিয়ানদের
সঙ্গে পিক্টদের লড়াই বাঁধিয়ে দুটো গোষ্ঠীকেই শেষ করে দেওয়ার একটা ছক কষছিল। কিন্তু দক্ষিণ এবং পূর্ব
তাদের আগ্রাসনের নীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পশ্চিমের দেশগুলোর দিকে সেভাবে নজর দিতে
পারছিল না। আর এই সুযোগেই ওই স্থান থেকে আরও বেশি সংখ্যক ভাড়াটে যোদ্ধার আগমন
হচ্ছিল তাদের সেনাবাহিনীতে।
এইসব যোদ্ধারা, তাদের নির্ধারিত কাজের সময়সীমা শেষ হলেই ফিরে যেত নিজেদের এলাকায়। সভ্য মানুষদের যুদ্ধ ঠিক কীরকম সেই ধারণা এদের হয়ে যাচ্ছিল বেশ ভালোই। আর সেটা শিখিয়েও দিচ্ছিল নিজেদের গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের। শুরু হলো নিরবচ্ছিন্ন ছন্দের যুদ্ধের তালবাদ্য বাদন, আগুনের শিখা জ্বলতে থাকল নিরন্তর এবং বর্বর তরোয়াল-নির্মাতারা তাদের নিজস্ব আহরিত ইস্পাত থেকে হাজার খানেক কামারখানায় প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র নির্মাণ করতে শুরু করল। গর্ম এখন পরিণত হয়েছেন প্রধানদের মহাপ্রধানে। রাজা নয়, সেটা হতে পিক্টদের এখনও হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে। অনেক অপেক্ষা শেষে মধ্য বয়সে পৌছে গর্ম এই সম্মান অর্জন করেছেন। এখনও তার নজর সীমান্তের দিকেই আছে, তবে আর সেটা ব্যবসার জন্য নয় বরং যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য।
আরুস তার ভুলটা অনেক দেরিতে দেখতে
পেয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন ওই মানুষগুলোর আত্মাকে তিনি স্পর্শ করতে পারেননি। যেখানে বছরের পর
বছর ধরে সঞ্চিত উগ্রতা যেমনকার তেমনই থেকে গিয়েছিল। তার প্ররোচনা মূলক বক্তৃতার
শিলাখন্ড পিক্টদের বিবেক সমুদ্রে একটাও তরঙ্গ ছড়িয়ে দিতে পারেনি। গর্ম এখন বাঘের চামড়ার
পরিবর্তে রৌপ্য খচিত বর্ম পরে থাকে। তাতে অবশ্য তার আসল মানসিকতার কোন বদল ঘটেনি।
সে অপরিবর্তিত থেকে গেছে – চিরন্তন এক বর্বর,
ধর্মতত্ত্ব বা দর্শন যার মনে দাগ কাটতে পারে না। তার প্রবৃত্তি স্থিত
হয়ে আছে হত্যা, অত্যাচার ও লুণ্ঠন করার মানসিকতাতেই।
বসসোনিয়ার সীমান্ত এলাকায় পিক্টরা
আক্রমণ চালাল আগুন আর তরোয়াল হাতে নিয়ে। এখন আর তাদের গায়ে নেই বাঘের চামড়া বা
পেতলের কুঠার। এখন তাদের শরীর ঢাকা আছে সুগঠিত বর্ম দিয়ে। হাতে তুলে নিয়েছে
তীক্ষ্ণ ইস্পাতের কৃপাণ।
ওদিকে আরুস প্রাণ হারালেন এক মাতাল পিক্টের
হাতে। যখন তিনি একটা শেষ চেষ্টা
করার উদ্যোগ নেন নিজের ভুলটাকে শুধরানোর, ওদের পুনরায় বোঝানোর। গর্ম অকৃতজ্ঞ ছিল না; সে হত্যাকারীর মাথা কেটে নিয়ে সেটাকে টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল
নেমেডিয়ান পুরোহিতের সমাধির ওপর। একে মহাবিশ্ব নিয়ন্ত্রার এক মারাত্মক ব্যঙ্গ বলে
ধরে নেওয়া যেতেই পারে। যে মানুষটা রক্তক্ষয় এবং যুদ্ধের বিরোধিতা করে বর্বরতার
অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন, তার শেষ আশ্রয়স্থলের পাথরগুলো সেই রক্তরঞ্জিত হয়েই থেকে গেল।
তবে নতুন অস্ত্র এবং বর্ম দিয়ে যুদ্ধ
করলেই যে জয় লাভ হবে তা তো নয়। বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ ও অস্ত্রবিদ্যার কারিগরিকে
উন্নত করেছিল বসসোনিয়ানরা। আক্রমণকারীদের উপসাগরীয় কিনারাতেই তারা থামিয়ে দিয়েছে
বারবার। প্রয়োজনে তাদের সহায়তা করেছে অ্যাকুইলোনিয়ার রাজকীয় সেনাবাহিনী। এই সময়ের
ভেতরেই হিরকানিয়ানরা আক্রমণ চালিয়েছে এবং ফিরেও গেছে। জামোরা যুক্ত হয়েছে
সাম্রাজ্যের সঙ্গে।
বিশ্বাসঘাতকতা এল এক অপ্রত্যাশিত উত্স
থেকে, ভেঙে গেল বসসোনিয়ান প্রতিরোধের প্রাচীর। এই বিশ্বাসঘাতকতার
বিষয়ে জানার আগে অ্যাকুইলোনিয় সাম্রাজ্যের দিকে সংক্ষেপে একবার নজর দিয়ে নেওয়া
যাক। সর্বদা সমৃদ্ধ এক রাজ্য, অবিচ্ছিন্ন বিজযয়ের
ধারায় জমা হয়েছে প্রচুর ধনসম্পত্তি। যার সূত্রে জাঁকজমকে ভরা জীবনযাত্রার তলায়
চাপা পড়ে গেছে সহজ স্বাভাবিক কঠোর খাটাখাটনির জীবনটা। যদিও অধঃপতনের স্রোত তখনও এই
সাম্রাজ্যের রাজা বাদশাহ এবং জনগণকে ছুঁতে পারেনি। রেশমের ওপর সোনার সুতোর কাজ করা পোশাক প্রায় সবার
অঙ্গেই। এসব সত্বেও তারা ওই মুহূর্তের বিশ্ব সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক অত্যাবশ্যক, প্রভাবশালী জাতি ছিল। যদিও অহংকার তাদের পূর্বের
সরলতাকে গ্রাস করেছে। প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই কম শক্তিশালী জাতির মানুষদের উপর ক্রমবর্ধমান
অবজ্ঞার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে তাদের তরফ থেকে। বিজয়ী রাজ্য রূপে বাড়িয়ে চলেছে
চাহিদার পরিমাণ। আরগোস, জিঙ্গারা, ওফির, জামোরা এবং শেমাইট রাজ্যগুলো বিবেচিত হচ্ছিল পরাধীন
প্রদেশ রূপে। যা বিশেষ করে আপন গর্বে গর্বিত জিঙ্গারানদের পছন্দ হয়নি। প্রায়শই বিদ্রোহ
করেছে, কিন্তু তা প্রতিহত হয়েছে নৃশংস বর্বরতার দ্বারা।
হিরকানিয়ানদের বিরুদ্ধে অ্যাকুইলোনিয়ার ‘সুরক্ষার’ ছায়ায় থাকা কোথ কার্যত এক
সরবরাহকারী রাজ্যের ভুমিকা পালন করত। কিন্তু পশ্চিমা সাম্রাজ্য নেমেডিয়া
কখনই পরাধীনতা স্বীকার করেনি। যদিও পরবর্তীকালের কিছু যুদ্ধে জয় লাভ করাটা এক
অর্থে ছিল প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ। যাতে সাহায্য করেছিল হাইপারবোরিয়ান সেনাবাহিনী।ওই সময়কালটায় অ্যাকুইলোনিয়ার একমাত্র
ব্যর্থতা ছিল, নেমেডিয়াকে নিজেদের অধীনস্থ
করতে না পারা। সিমেরিয়ায় প্রেরিত সেনাবাহিনী আসিরদের হাতে প্রায় সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস
হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা হিরকানিয়ানরা অ্যাকুইলোনিয়ানদের অশ্বারোহী
আক্রমণ সামলাতে পারেনি। এসব থেকে সরে গিয়ে অ্যাকুইলোনিয়ানরা তুষার আবৃত এলাকা
দখলের চেষ্টা করে এবং নর্ডিকদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। অ্যাকুইলোনিয়ার রাজ্য দখল এবার সরে যায় নাইলাসের দিকে।
যেখানে এক যুদ্ধে স্টিগিয়ান সেনাবাহিনীর একজনও প্রাণে বাঁচনি। এই
সময়ে অন্তত একবার হলেও স্টিগিয়ার রাজা নিজের রাজ্যকে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর
জন্য নিজেদের আনুগত্য পেশ করে। ব্রাইথুনিয়ার আকার হ্রাস পেতে
থাকে একের পর এক ধারাবাহিক যুদ্ধের কারণে এবং এই সময়েই প্রাচীন প্রতিদ্বন্দ্বী,
নেমেডিয়াকে পরাধীন করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
নিজেদের ভাঁড়ারে ভাড়াটে সৈন্য
সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ ঘটে যেতেই, অ্যাকুইলোনিয়ানরা তাদের
পুরাতন সময়ের শত্রুর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগল। দেখে মনে হয়েছিল এবার ওরা যেনতেন
প্রকারে নেমেডিয়ার স্বাধীনতাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে। কিন্তু এই সময়েই অ্যাকুইলোনিয়ানদের
সঙ্গে তাদের বসসোনিয়ান সহায়তার মাঝে খিটিমিটি বেঁধে গেল।
অবিরত সাম্রাজ্য বিস্তারের অনিবার্য ফলস্বরূপ, অ্যাকুইলোনিয়ানরা অহঙ্কারী ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিল। বসসোনিয়ানদের চিরাচরিত অসংস্কৃত আচার আচরণ নিয়ে উপহাস করার পরিমাণ গিয়েছিল
বেড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তিক্ততার অনুভূতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বসসোনিয়ানদের তুচ্ছ
তাচ্ছিল্য করা, তাদের ওপর অ্যাকুইলোনিয়ানদের প্রভুত্ব জাহির করার মাত্রা বাড়ছিল
দিনকে দিন। বিজয়ীর ঔদ্ধত্যে তারা বসসোনিয়ানদেরকে নিজেদের সাহায্যকারী নয় বরং
অধীনস্থ এক রাজ্যের মতো মনে করতে শুরু করেছিল। নানান কর চাপিয়ে দেয় তাদের ওপর। অঞ্চলগত
সম্প্রসারণের যুদ্ধে তাদের ব্যবহার করতে শুরু করে। এতে যা প্রাপ্তি হয় তার খুব কম অংশই বসসোনিয়ানদের
ভাগ্যে জোটে। সীমান্ত এলাকা রক্ষার জন্য অল্প কিছু সেনা রেখে নেমেডিয়ার অভিযান
থেকে বসসোনিয়ার সেনারা নিজেদের জন্মভূমিতে ফেরার পথ ধরে। যার অন্যতম কারন সেখানে
পিক্টদের আক্রমণ শুরু হয়েছিল। এগিয়ে যায় পশ্চিম সীমান্তের দিকে এবং সেখানেই তারা কৃষ্ণাঙ্গ
আক্রমণকারীদের পরাজিত করে।
বসসোনিয়ানদের এই চলে আসাটাই ছিল নেমেডিয়ানদের
দ্বারা অ্যাকুইলোনিয়ার পরাজয়ের প্রত্যক্ষ কারণ। যার সুত্রে বসসোনিয়ানদের উপর নেমে আসে অসহিষ্ণু ও
আত্মগর্বী সাম্রাজ্যবাদীদের নিষ্ঠুর ক্রোধ। অ্যাকুইলোনিয়ান সেনাবাহিনীকে গোপনে নিয়ে যাওয়া হয় ওদের সীমানায়। বসসোনিয়ান সেনাপতিদের
এক মহাসম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং পিক্টদের বিরুদ্ধে অভিযান
চালানোর ছদ্মবেশে শেমাইট সেনাদল ঢুকে পড়ে গ্রামের ভেতর। গ্রামবাসীরা এ নিয়ে
কিছুই সন্দেহ করেনি। নিরস্ত্র নেতাদের হত্যা করার পর শেমাইট হন্তারকের
দল নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মশাল এবং তরোয়াল হাতে। ধ্বংস করে দেয় সবকিছু। উত্তর থেকে দক্ষিণে্র
সমস্ত এলাকা এই সেনাবাহিনীর দাপটে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। সীমান্ত এলাকা থেকে
অ্যাকুইলোনিয়ানরা যখন ফিরে আসতে বাধ্য হয় তখন তাদের, পিছনে পড়ে থাকে বিধ্বস্ত জনভুমির
এক ধ্বংসস্তূপ।
এরপরেই পিক্টরা সীমান্ত এলাকায় সর্বশক্তি
নিয়ে আক্রমণ চালায়। যা কোন নিছক অভিযান ছিল না। অ্যাকুইলোনিয়ান সেনাবাহিনীতে
থেকে প্রকরণ পদ্ধতি শিখে নিয়েছিল তাদের নেতারা। এদের নেতৃত্ব প্রদান ও পরিচালনার
দায়িত্ব নিয়েছিল বর্ষীয়ান গর্ম। কিন্তু তার মনের উগ্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগুন জ্বলছিল দাঊদাঊ
করে। এবার আক্রমণ করার সময় তাদের বাধা দেওয়ার জন্য দক্ষ তীরন্দাজে সমৃদ্ধ প্রাচীর
ঘেরা কোন গ্রাম ছিল না। যারা এই আক্রমণ আটকাবে আর সেই অবসরে রাজকীয় বাহিনী
এসে যাবে। বসসোনিয়ানদের বাকি যারা বেঁচেবর্তে ছিল এই ভীষণ আক্রমণের
পর তারাও এবার খতম হয়ে গেল। রক্তলোলুপ বর্বররা অ্যাকুইলোনিয়ায় ঢুকে শুরু করে দিল
লুটপাট এবং অগ্নি সংযোগ। নেমেডিয়ানদের সঙ্গে লড়াই করার পর অ্যাকুইলোনিয়ায় সৈন্যবাহিনী
পশ্চিম দিকে অগ্রসর হওয়ার আগেই জিঙ্গারা এই সুযোগকে কাজে লাগাল। তাদের ঘাড়ের ওপর
বসে থাকা জোয়াল ফেলে দেওয়ার এটাই ছিল সেরা সময়। আর এই পথটা একই সঙ্গে বেছে নিল করিন্থিয়া
এবং শেমাইটরাও। ভাড়াটে হিসাবে কাজ করা তাদের দেশের সেনাদল
বিদ্রোহ ঘোষণা করে ফিরে যেতে শুরু করল নিজের নিজের দেশে। যাওয়ার পথে যথেচ্ছ লুটপাট করল তারাও। পিক্টরা পূর্বের
দিকে অপ্রতিরোধ্যভাবে অগ্রসর হতে থাকল। একের পর এক এলাকা তাদের পদানত হল এই সময়। বসসোনিয়ান তীরন্দাজদের সহায়তা
না থাকায় বর্বর পিক্টদের ভয়ঙ্কর আগুনতীরের মোকাবিলা করার ক্ষমতা
অ্যাকুইলোনিয়ানদের ছিল না। সাম্রাজ্যের সমস্ত এলাকা থেকে সৈন্যদের
ডেকে পাঠানো হল এই হামলা প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু প্রায় বন্যার জলস্রোতের মতো
ধেয়ে আসা বর্বর সেনাদের আক্রমণ সামলানো আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এই বিশৃঙ্খলার
মাঝেই, সিমেরিয়ানরাও ধেয়ে এলো তাদের পাহাড়ি এলাকা
থেকে। ধ্বংসলীলার শেষ পেরেক পোঁতার জন্য। এরাও শহর লুট করল, রাজ্য
ছারখার করল এবং লুঠের মালপত্র নিয়ে ফিরে গেল পাহাড়ে। কিন্তু পিক্টরা
ফিরল না। থেকে গেল সেইসব স্থানে যা তারা দখল করেছে। অ্যাকুইলোনিয়ান সাম্রাজ্য
এভাবেই আগুন আর রক্তের স্রোতে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল।
পূর্ব প্রান্তের এলাকা থেকে আবার হিরকানিয়ানরা শুরু করল তাদের অভিযান। জামোরার সেনাবাহিনী থেকে নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার এটাই ছিল উপযুক্ত সুযোগ। তাদের সহায়তা নিয়ে খুব সহজেই এরা জামোরা দখল করল তার এবং ওই রাজ্যের বৃহত্তম নগরে নিজের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করল হিরকানিয়ার রাজা। এই আক্রমণটা হয়েছিল অভ্যন্তরীণ সমুদ্রের তীরে অবস্থিত তুরানের প্রাচীন হিরকানিয়ান এলাকা থেকে। তবে আরও একটা বর্বর হিরকানিয়ান আক্রমণের ধাক্কা এসেছিল উত্তর দিক থেকে। ইস্পাত বর্ম পরিহিত অশ্বারোহী আক্রমণকারীরা হোস্টগুলি অভ্যন্তরীণ সমুদ্রের উত্তরের সীমানায় দাপিয়ে বেড়ায়। পাড়ি দেয় বরফশীতল মরুভূমির এলাকায়। ঢুকে পড়ে স্তেপের বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চলে। ওখানকার আদিবাসীদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বাধ্য করে পশ্চিমের রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। এই নবাগতদের সঙ্গে তুরানিয়ানদের প্রথমে মিত্রতার সম্পর্ক ছিল না, হাইবোরিয়ানদের মতোই বিরোধিতাই হয়। পূর্ব প্রান্ত থেকে আসা যোদ্ধাদের সঙ্গে এদের লড়াই চলতে থাকে ততদিন অবধি যতদিন না এরা সবাই এক মহান গোষ্ঠী প্রধানের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়। এই মানুষটা এসেছিল পূর্ব সমুদ্রের এলাকা থেকেই। কোনো অ্যাকুইলোনিয় সেনাবাহিনী ছিল না এই গোষ্ঠী প্রধান মানুষটার বিরোধিতা করার জন্য। ফলে অজেয় দুর্বার গতিতে এরা এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাইথুনিয়াকে পরাধীন করে এবং দক্ষিণ হাইপারবোরিয়া আর করিন্থিয়াকে ছারখার করে দেয়। প্রবেশ করে সিমেরিয়ার পাহাড়ি এলাকায়। সেখানকার কালো চুলের বর্বরদের খেদিয়ে নিয়ে যেতে থাকে আগে আগে। কিন্তু পাহাড়ি পথে অশ্বারোহী বাহিনীর গতি নানা কারণে ব্যহত হতে থাকার উযোগ নিয়ে সিমেরিয়ানরা ফিরতি আক্রমণ চালায়। একটা গোটা দিন ধরে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয় হিরকানিয়ানরা। যা না করলে হয়ত তারা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত সেদিন।
এইসব ঘটনা যখন ঘটে চলেছে তখন শেমের রাজ্যগুলো
একত্রিত হয়ে তাদের প্রাচীন শাসক রাজ্য কোথ আক্রমণ করে এবং জিতে নেয়। হাত বাড়ায় স্টিগিয়ার
দিকে। কিন্তু পরাজিত হয়। কোথকে পুরোপুরি শেষ করে দেওয়ার আগেই তাদের ওপর আক্রমণ
চালায় হিরকানিয়ানরা। ফলে এবার তাদের প্রভু হয় যারা তারা হাইবোরিয়ানদের চেয়ে নিষ্ঠুর প্রকৃতির। ইতিমধ্যে পিক্টরা অ্যাকুইলোনিয়াতে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেছে। ব্যবহারিক অর্থেই সেখানকার বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। জিঙ্গারার সীমানা
পার হয়ে আক্রমণ চালিয়ে কয়েক হাজার জিঙ্গারা অধিবাসীকে বাধ্য করেছে প্রান বাঁচাতে আরগোসের
দিকে পালিয়ে যেতে। সেখান থেকেও তাদের তাড়িয়ে ছেড়ে দেয় পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাতে
থাকা হিরকানিয়ানদের করুণার ওপর। যারা ওই সময়ে জামোরায় ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। আরগোসেও পিক্টরা তাদের হত্যালীলা বজায় রেখেছে এবং এগিয়ে গেছে ওফিরের দিকে। পশ্চিমের অশ্বারোহী
হিরকানিয়ানদের মুখোমুখী হয়েছে। এই হিরকানিয়ানরা শেম জয়ের পরে নাইলাসে স্টিগিয়ার
সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দক্ষিণে কৃষ্ণাঙ্গ আমাজন সাম্রাজ্য অবধি অভিযান
চালায়। সঙ্গে নিয়ে আসে কয়েক হাজার বন্দীকে। যাদেরকে বাধ্য করে শেমাইটদের সঙ্গে
মিলে মিশে বসতি স্থাপন করতে। সম্ভবত তারা স্টিগিয়া জয় করে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত
করার চেষ্টা করত। কিন্তু পিক্টদের পশ্চিম দিকের অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের বিরুদ্ধাচরণ
করার সাহস দেখাতে পারেনি।
নেমেডিয়া তখনও হাইবোরিয়ানদের
নাগালের বাইরেই আছে। পূর্বদিক থেকে আগত অশ্বারোহী বাহিনী আর পশ্চিমের তরোয়ালবাজ
যোদ্ধাদের দ্বারা নিস্পেষিত হয়ে চলেছে। এই সময় আসিরদের একটা উপজাতি তাদের বরফের রাজ্য
থেকে নেমে আসে এবং ভাড়াটে সেনা হিসাবে নিযুক্ত হয়। এরা এতটাই দক্ষ যোদ্ধা ছিল যে,
তারা শুধু হিরকানিয়ানদের পরাজিতই করেনি, আটকে দিয়েছিল পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে আসা
পিক্টদের আগ্রাসন।
সেই সময়কার বিশ্বের মানচিত্র আঁকা হলে দেখা যাবে, বন্য, অভদ্র এবং বর্বরোচিত আচার আচরণের পিক্টদের এক সুবিশাল সাম্রাজ্য। যার
অবস্থান উত্তরের ভানাহেইম উপকূল থেকে জিঙ্গারার দক্ষিণ-তীরবর্তী
অঞ্চল অবধি প্রসারিত। পূর্বদিকটাও পুরো এসে গেছে এদের অধীনে। শুধু বাদ আছে
গান্ডারল্যান্ড, যা অ্যাকুইলোনিয়া সাম্রাজ্যের একেবারে উত্তর প্রান্তে অবস্থিত
ছিল। পৃথক এক পাহাড়ি সাম্রাজ্য যারা নিজেদেরকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছে এবং
এখনও তার স্বাধীনতা বজায় রেখেছে। পিক্ট সাম্রাজ্যের মধ্যে রয়েছে
আরগোস, ওফির, কোথের পশ্চিম অংশ
এবং শেমের পশ্চিমদিকের বেশিরভাগ এলাকা। এই বর্বর সাম্রাজ্যের বিরোধিতা করার জন্য
আছে হিরকানিয়দের সাম্রাজ্য, যার মধ্যে উত্তরের সীমানায়
বিধ্বস্ত হাইপারবোরিয়ার সীমারেখা। দক্ষিণে শেমের মরুভূমি। জামোরা, ব্রাইথুনিয়া, সীমান্ত রাজ্য, করিন্থিয়া, কোথের বেশিরভাগ এলাকা এবং শেমের সমস্ত পূর্ব
অঞ্চল এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। সিমেরিয়ার সীমানা অক্ষত; পিক্ট বা হিরকানিয়ান কেউই সক্ষম হয়নি এই যুদ্ধ নিপুন বর্বরদের
বশীভূত করতে। সব রকম আক্রমণ প্রতিহত করে আসির ভাড়াটে সেনাদের দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নেমেডিয়া। উত্তরদিকে নর্ডহেইম, সিমেরিয়া এবং নেমেডিয়া অস্তিত্ব বজায় রেখে বিজয়ী রূপেই। কিন্তু
দক্ষিণে, কোথ পরিণত হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। যেখানে পিক্স এবং হিরকানিয়দের অবিরাম যুদ্ধ হয়েই চলেছে। কখনও কখনও পূর্বদিকে
যোদ্ধারা বর্বরদের পুরোপুরি রাজ্য থেকে বহিষ্কার করতে সক্ষম হচ্ছে ; সমভূমি এবং শহরগুলো তারা ছিনিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমা আক্রমণকারীদের
হাত থেকে। সুদূর দক্ষিণে স্টিগিয়া কেঁপে কেঁপে উঠছে হিরকানিয়ান
আক্রমণে। সঙ্গেই আছে কৃষ্ণাঙ্গ রাজ্যগুলোর ঝটিকা আক্রমণ। সুদূর উত্তরে নর্ডিক উপজাতিরাও
স্থির বসে নেই, ক্রমাগত সিমেরিয়দের সঙ্গে লড়াই
করা এবং হাইপারবোরিয়ান সীমান্তগুলিকে সাফ করার কাজে সময় কাটছে তাদের।
অতি বৃদ্ধ, শতবর্ষজীবী গর্মকে হত্যা করে
নেমেডিয়ান আসির প্রধান হিয়ালমার। আরুসের মুখ থেকে নিজেদের এলাকার বাইরের সভ্যতা সাম্রাজ্যের কাহিনী
সর্বপ্রথম শোনার ভিত্তিতে, পঁচাত্তর বছর বয়সে যে উদ্যোগ গর্ম শুরু করেছিলেন এবং
তারপরে যে সময় অতিবাহিত করেছেন তা একজন মানুষের জীবনে এক দীর্ঘ সময়। কিন্তু একটা জাতির গল্পগাথায় তার স্থান বড়ই অল্প, সংক্ষিপ্ত- উনি এক বন্য বিপথগামী গোষ্ঠীকে উন্নীত করে একটা সাম্রাজ্য
স্থাপন করেন। পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন এক সভ্যতার। কাদামাটির প্রাচীর ঘেরা, আদিম ছাঁদের কুঁড়ে ঘরে জন্মগ্রহণ করেও, বৃদ্ধ বয়সে
আরোহণ করেছিলেন সোনার সিংহাসনে। নগ্ন দাসী তথা রাজা রাজড়াদের কন্যারা তার সামনে সাজিয়ে দিত সোনার
পাত্রে গরুর মাংস। বিজয় এবং সম্পদ অবশ্য অর্জন পিক্টদের আচার ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। চূর্ণবিচুর্ণ
সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে কোনও নতুন সংস্কৃতি ফিনিক্সের মতো উত্থিত হয়নি। তাদের তমসাচ্ছন্ন মানসিকতার কালো হাত যে শৈল্পিক সভ্যতাকে ধ্বংস করেছিল,
সেটাকে তারা কখনও নকল করার চেষ্টা করেনি। গর্ম যদিও ভুলুন্ঠিত প্রাচীন
প্রাসাদের উজ্জ্বল ধ্বংসাবশেষের ভেতরেই তার সাম্রাজ্য পেতে বসে। পরাজিত রাজাদের রেশমের
পোশাক চাপায় নিজের গায়ে। কিন্তু পিক্টদের চিরন্তন বর্বর নিষ্ঠুর নগ্ন জীবন প্রবৃত্তিগুলোর
বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি। জীবনের প্রাথমিক নীতিগুলোই তাদের সামনে থাকে, বাঁচার
জন্য যুদ্ধ ও লুণ্ঠন। চারুকলা এবং মানবিকতার সংস্কৃতিকে অগ্রগতির দিকে
নিয়ে যাওয়ার কোনও ভাবনাই ছিল না তাদের। নেমেডিয়ায় বসতি স্থাপনকারী আসিরেরা
কিন্তু এভাবে নতুন জীবন শুরু করেনি। তারা নতুন নতুন উপায় অবলম্বন করেছে তাদের সভ্য
মিত্রশক্তির সংস্কৃতিকে নিজেদের ভেতর জারিত করার। সেই রীতিনীতিকে নিজস্ব তীব্র বৌদ্ধিক
মানসের সহায়তায় বদলে নিয়েছে অবশ্যই। করেছে শক্তিশালী।
স্বল্প সময়ের জন্য পিক্ট এবং হিরকানিয়ানরা
একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁত নখ বার করে সংগ্রাম করেছে নিজস্ব জিতে নেওয়া ধ্বংসস্তূপগুলোর
অধিকার রক্ষায়। এরপরেই শুরু হয় হিমবাহের যুগ এবং দুর্দান্ত নর্ডিক আক্রমণ প্রবাহ। বরফের রাজত্ব দক্ষিণ
দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছিল উত্তরের উপজাতিগুলোও তার হাত থেকে বাঁচতে এগোচ্ছিল সেই একই
অভিমুখে। তাদের সামনে যে সমস্ত গোষ্ঠী এসে যাচ্ছিল তাদেরকেও তারা খেদিয়ে নিয়ে
চলেছিল নিজেদের সঙ্গে। আসিররা প্রাচীন হাইপারবোরিয়ার সাম্রাজ্যকে মুছে দিয়েছিল
পৃথিবীর বুক থেকে। সেই ধ্বংসস্তূপ পার হয়ে এসে উত্তরের উপজাতির মানূষেরা
হিরকানিয়ানদের মোকাবিলা করে। নেমেডিয়া ইতিমধ্যেই পরিণত হয়েছে
নর্ডিক রাজ্যে। যার শাসনভার এখন আসিরের ভাড়াটে
যোদ্ধাদের বংশধরদের হাতে। নর্ডিক আক্রমণের জোয়ার সহ্য করতে না পেরে সিমেরিয়ানদের
সফর শুরু হয়েছে। কোনো সেনাবাহিনী বা নগর তাদের আক্রমণ সামলাতে পারছে না। গান্ডারল্যান্ডের রাজ্য সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং প্রাচীন অ্যাকুইলোনিয়ার ভেতর
দিয়ে অগ্রসর হয়ে সেই অপ্রতিরোধ্য বাহিনী মুখোমুখি হল পিক্টদের। নর্ডিক-নেমেডিয়ানদের পরাজিত করে এবং তাদের কয়েকটা নগর ছারখার করে
দিয়েও তারা থামল না। এগিয়ে চলল অবিরাম পূর্ব দিকে, ব্রাইথুনিয়ার
সীমান্তে এক হিরকানিয়ান সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করল এই যাত্রাপথে।
তাদের পিছন পিছন এল আসির ও ভানিরদের সৈন্যদল।
পিক্টদের সাম্রাজ্য বারংবার লাঞ্ছিত হলো তাদের আক্রমণে। নেমেডিয়া ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল
এবং অর্ধ-সভ্য নর্ডিকরা তাদের বন্য স্বভাবের আত্মীয়স্বজনদের
আগেই পালিয়েছিল ওখান থেকে। নেমেডিয়ার ধ্বংস প্রাপ্ত নগরগুলো এক এক করে জনমানব শুন্য
হয়ে পড়ে থাকল। এইসব পালানো নর্ডিকরা তাদের প্রাচীন রাজ্যর নামেই
পরিচিত ছিল, নেমেডিয়ান। এসে উপস্থিত হলো কোথের প্রাচীন ভূমিতে। পিক্ট এবং হিরকানিয়ানদের তাড়াল ওখান
থেকে। শেমের মানুষদেরকে সাহায্য করল হিরকানিয়ানদের হাত থেকে মুক্ত হতে। পুরো
পশ্চিমী বিশ্ব জুড়ে, পিক্ট এবং হিরকানিয়ানরা
হতবাক হয়ে গেল এই উগ্র আচরণ যুক্ত নতুন বাহিনীর প্রত্যাঘাতে। আসিরদের একটা দল ব্রাইথুনিয়ার
পূর্বদিক থেকে আগত অশ্বারোহী তাড়িয়ে দেয় এবং সেখানেই স্থি্ত হয়ে বসে। এদের
পরিচিতি হয় নিজেদের জাতের নামেই। হাইপারবোরিয়া জয়ী নর্ডিকরা তাদের পূর্ব শত্রুদের
এতোটাই বর্বরতার সঙ্গে আক্রমণ করে যে, লেমুরিয়ানদের সেই কালো চামড়ার বংশধররা ফিরে
যায় স্তেপের এলাকায়, বাধ্য হয় ভিলায়েতের দিকে চলে যেতে।
ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঘুরে বেড়ানো সিমেরিয়ানরা তুরানে প্রাচীন হিরকানিয়ান
রাজ্যটিকে ধ্বংস করার পর অভ্যন্তরীণ সমুদ্রের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে
বসতি স্থাপন করেছে। পূর্বদিকের বিজয়ীদের শক্তিজোট ভেঙ্গে
যায়। নর্ডহেইমা এবং সিমেরিয়দের
আক্রমণ হওয়ার আগে এরা নিজেদের সমস্ত শহর ধ্বংস করে দেয়। দীর্ঘ পথ চলতে পারবে না এমন
বন্দীদের মেরে ফেলে এবং সমুদ্রের উত্তর প্রান্ত ধরে কয়েক হাজার দাসদাসী সঙ্গে
নিয়ে রহস্যময় পূর্ব দিকে অদৃশ্য হয়ে যায় পশ্চিম জগতের ইতিহাস থেকে। কয়েক হাজার বছর পরে
এদের আবার দেখা মেলে। যাদের আমরা চিনি হান, মঙ্গোল, তাতার এবং তুর্ক নামে। এই একদা
বিজয়ী জাতটার পশ্চাদপসরণে তাদের সঙ্গে কয়েক হাজার জামোরীয় এবং জিঙ্গারান অধিবাসীও
ছিল, যারা পূর্ব দিকে একত্রিত হয়ে এক মিশ্র জাতির
জন্ম দেয় এবং পরবর্তীকালে জিপসি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
এসবের মাঝেই ভানিরদের এক সাহসী
গোষ্ঠী দক্ষিণ পিক্ট উপকূল ধরে এগিয়ে গিয়ে প্রাচীন জিঙ্গারা ধ্বংস করে, স্টিগিয়ায়
প্রবেশ করে। যা সে সময় দক্ষিণের কৃষ্ণাঙ্গ রাজ্যগুলির অধীনে থাকা নির্মম অভিজাত শাসক
শ্রেণীর দ্বারা নিপীড়িত হচ্ছিল। লালচুলের ভানিরদের নেতৃত্বে সেখানকার দাসেরা এক
বিদ্রোহে অংশ নিয়ে শাসক শ্রেণীকে উৎখাত করে এবং নিজেদেরকে এক বিজয়ী জাতি হিসাবে
নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। উত্তরাঞ্চলীয় কৃষ্ণাঙ্গ রাজ্যগুলিকে দখল করে এক বিশাল
দক্ষিণ প্রদেশিয় সাম্রাজ্যর জন্ম দেয়। যাকে তারা উল্লেখ করত ইজিপ্ট নামে। এই লালচুলের
বিজয়ীদের সূত্রেই প্রাথমিক ফ্যারাও সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।
পশ্চিমা বিশ্বে ওই সময় জারি রয়েছে নর্ডিক
বর্বরদের আধিপত্য। পিক্টরা এখনও অ্যাকুইলোনিয়া এবং জিঙ্গারার কিছু অংশ এবং মহাদেশের পশ্চিম উপকূলের
দখল রেখেছে নিজেদের হাতে। তবে ভিলায়েতের পূর্ব দিক থেকে এবং আর্কটিক বৃত্ত থেকে
শেমের দেশগুলো বাসিন্দা কেবলমাত্র নর্ডহেইমের উপজাতির মানুষ। যদিও পুরানো তুরানিয়ান
রাজ্যে এখনও সিমারিয়ানদের আধিপত্য। স্টিগিয়া এবং শেম এর এলাকা ছাড়া আর কোথাও কোন
নগর নেই। পিক্ট, হিরকানিয়ান, সিমারিয়ান এবং নর্ডিকদের একের পর এক আক্রমণের জোয়ারে সব ধ্বংসস্তূপে
পরিণত হয়েছে। এককালের প্রভাবশালী হাইবোরিয়ানদের এ পৃথিবীতে আর কোনও অস্তিত্বই নেই।
তাদের বিজয়ীদের বংশধরদের শিরা উপশিয়াতে শুধু মিশে আছে তাদের সামান্য রক্তের ধারা।
অল্প কিছু স্থান, উপজাতি এবং নগরগুলোর নাম বর্বরদের কথাবার্তায় মাঝে মাঝে উঠে আসে।
কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস বিকৃত কিংবদন্তি আর পৌরাণিক কাহিনীতে বদলে গেছে। হাইবোরিয়ান
যুগের পুরো ইতিহাস মিথ ও কল্পিত কাহিনীর মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে এভাবেই। জিপসিদের
কথাবার্তায় জিঙ্গারা এবং জামোরা শব্দদুটো মাঝে মাঝে উচ্চারিত হয়। নেমেডিয়ায় যে
আসিরদের আধিপত্য ছিল তারা নেমেডিয়ান নামেই পরিচিত হয় এবং পরে আইরিশ ইতিহাসে তারা
স্থান পায়। ব্রাইথুনিয়াতে যে নর্ডিকরা বসতি স্থাপন করেছিল তারাই ব্রাইথুনিয়ান,
ব্রাইথন বা ব্রিটন নামে পরিচিতি পায়।
সেই সময়ে একীভূত নর্ডিক সাম্রাজ্য
বলতে কিছু ছিল না। চিরন্তন পদ্ধতি অনুসারে উপজাতিদের প্রত্যেকের নিজস্ব প্রধান বা রাজা
ছিল, যাদের নেতৃত্বে এরা নিজেদের মধ্যে সব সময়েই রক্তক্ষয়ী লড়াইতে মত্ত থাকত। এদের
ভাগ্যে ঠিক কী ঘটেছিল তা জানা যায় না, কারণ পৃথিবী জুড়ে আবার ঘটে যায় এক মহা
প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই উঠে আসে নতুন জমি। যা আধুনিক পৃথিবী
রূপে পরিচিতি লাভ করে। পশ্চিম উপকূলের বিশাল ভূখন্ড ডুবে যায়। ভানাহেইম
এবং পশ্চিম অ্যাসগার্ড-জনহীন এবং হিমবাহ-জর্জরিত এলাকা হিসাবেই পড়ে ছিল একশো বছর ধরে– দুটোই জলের
তলায় হারিয়ে যায়। উত্তর সাগর থেকে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সমুদ্র প্রবাহিত হয় পশ্চিম সিমেরিয়ায়।
এই পর্বতগুলো পরে দ্বীপপুঞ্জ হয়ে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং
আয়ারল্যান্ড নামে পরিচিত হয়। মহাসাগরের তরঙ্গ গড়িয়ে যায় সেইদিকে যা একদা বুনো
পিক্টদের এবং বসসোনিয়ানদের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। উত্তরে জন্ম হয় বাল্টিক সাগরের। অ্যাসগার্ড
বিভক্ত হয়ে যায় যে সমস্ত এলাকায়, তারাই পরে নরওয়ে, সুইডেন এবং
ডেনমার্ক রূপে আত্মপ্রকাশ করে। আরও দূরে দক্ষিণে স্টিগিয়ান মহাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে
বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নাইলাস নদীর তীরে পশ্চিম প্রদেশের প্রবণতায়
গড়ে ওঠে নতুন জনপদ। আরগোস, পশ্চিম কোথ এবং শেমের পশ্চিমের ভূখণ্ড
চলে যায় জলের তলায়, নতুন নামকরণ হয় ভূমধ্যসাগর। তবে যেখানে প্রায়
সব জায়গাতেই ভুখন্ড ডুবে যায় সেখানে স্টিগিয়ার পশ্চিমে এক বিস্তৃত এলাকা জলের
ভেতর থেকে উঠে এসেছিল। যা আফ্রিকা মহাদেশের পুরো পশ্চিম দিক।
জমির অস্বাভাবিক উত্থানের নজির
হিসাবে উত্তরের মহাদেশের কেন্দ্রীয় অংশে মহাকায় পর্বতশ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। পুরো নর্ডিক
উপজাতিই ধ্বংস হয়ে যায়। যারা নিজেদের বাঁচাতে পারে তারা চলে যা পূর্ব দিকে। আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে থাকা অভ্যন্তরীণ সমুদ্র অঞ্চল এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রভাবিত
হয়নি। সেখানেই পশ্চিম উপকূলে
নর্ডিক উপজাতিরা শুরু করে যাযাবরের জীবন যাপন। মোটামুটি শান্তিতেই থাকতে শুরু করে
সিমারিয়ানদের সঙ্গে এবং তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়াও শুরু হয়। পশ্চিমে পিক্টদের ভেতর যারা অবশিষ্ট ছিল, তারা এই সর্বনাশা বিপর্যয়ের ধাক্কায় আবার প্রস্তর যুগের বর্বরতা্র
মাত্রায় ফিরে যায়। এই জাতটা অবিশ্বাস্যভাবে জগতে টিকে থাকার উদ্দীপনায় পুনরায় জমি অধিকার
করা শুরু করে। অবশ্য পরবর্তী যুগে, এরা পশ্চিমদিকে এগিয়ে
আসতে থাকা সিমেরীয়ান এবং নর্ডিকদের দ্বারা অপসারিত হয়। এসব মহাদেশ ভেঙেচুরে যাওয়ার
অনেক পরের ঘটনা। যখন তাদের একদা গৌরবময় সাম্রাজ্যের কাহিনী কেবলমাত্র অর্থহীন কিংবদন্তিতে
পরিণত হয়েছে।
ইতিহাসের এই প্রবাহ এরপর আধুনিক ইতিহাসের
জানাশোনা গণ্ডির ভেতরে চলে আসে, ফলে এর পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নেই। এর ফলস্বরুপ অভ্যন্তরীন সমুদ্রের পশ্চিমে অবস্থিত স্তেপের এলাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা
– যা পরে আকারে আর ছোটো হয়ে গিয়ে ক্যাস্পিয়ান
হিসাবে পরিচিতি পায় - যা এমন এক পর্যায়ে পৌছায় যে, অর্থনৈতিক
কারণে বাধ্যতামূলক মাইগ্রেশন বা দেশান্তর নীতি বেছে নিতে বাধ্য হয় তারা। উপজাতিগুলি
দক্ষিণ, উত্তর এবং পশ্চিমে চলে যায়, সেই
ভূখণ্ড যাকে আমরা চিনি ভারত, এশিয়া মাইনর এবং মধ্য ও পশ্চিম
ইউরোপ নামে।
তারা আর্য হিসাবে এইসব দেশে গিয়েছিল। যদিও এই আদিম আর্যদের
মধ্যে বিভিন্নতা ছিল। যার সূত্র কিছু আজও চেনা যায়, বাকি সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। সব ভুলে গেছে
মানুষ। স্বর্ণকেশী আকাইয়া্ন, গল
এবং ব্রীটনরা ছিল আসির শুদ্ধ রক্তের বংশধর। আইরিশ কিংবদন্তির
নেমেডিয়ানরা ছিলেন নেমেডিয়ান আসির। ডেনরা ভানিরদের শুদ্ধ রক্তজাত বংশধর ; গথরা -অ্যাংলো-স্যাক্সনস
সহ অন্যান্য স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এবং জার্মানিক উপজাতির পূর্বপুরুষ ছিল – এক মিশ্র জাতির
বংশধর যাদের শরীরে বইছিল ভ্যানির, আসির এবং সিমারিয়ানদের
রক্ত। গ্যাল -আইরিশ এবং হাইল্যান্ড স্কচেদের পূর্বপুরুষরা ছিল খাঁটি সিমেরিয়ান বংশ
থেকে আগত। ব্রিটেনের সিম্রিক উপজাতির মানুষেরা মিশ্র নর্ডিক-সিমেরিয়ান জাতি ছিল, যাদের সুত্রে নরডিক ব্রিটিশদের এই সব দ্বীপগুলোতে
আগমন হয়। এভাবেই গ্যালিকদের অগ্রাধিকারের এক কিংবদন্তি জন্ম নেয়। রোমে যুদ্ধ করেছিল
যে সিম্ব্রিরা, আসিরিয়া এবং গ্রীসের জিম্মেরাই এবং হিব্রুদের গোমার সব এক রক্তের
বংশধর। সিমেরিয়ানদের অন্যান্য উপজাতির মানুষের শুকিয়ে যেতে থাকা অভ্যন্তরীণ সমুদ্রের
পূর্বদিকে অভিযান চালায় এবং কয়েক শতাব্দী পরে হিরকানিয়ানদের সঙ্গে মিশে যায়।
যারা পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে ফিরে আসে স্কাইথিয়ান নামে। গ্যালের আসল পূর্বপুরুষরা
তাদের নাম বাঁচিয়ে রেখে আধুনিক ক্রিমিয়ার সুত্রে।
প্রাচীন সুমেরীয়দের সঙ্গে এই পশ্চিমা
জাতিটার কোনও যোগাযোগ ছিল না। এরা ছিল মিশ্র রক্তের মানুষ।
শরীরে ছিল হিরকানিয়ান এবং শিমিটিশ রক্ত, যাদেরকে
পশ্চাদপসরণে কালে তাদের বিজয়ী প্রভুরা সঙ্গে নিয়ে যায়নি। শেমের অনেক উপজাতিই
তাদের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। খাঁটি রক্তের শেমাইট বা হাইবোরিয়ান বা নর্ডিক রক্ত
মিশ্রিত শেমাইটদের সুত্রেই আরব, ইজ্রায়েল এবং অন্যান্য
লম্বা টান টান চেহারার বৈশিষ্ট্যযুক্ত শেমাইটদের উত্পত্তি হয়েছিল। ক্যানানাইট বা আলপাইন শেমাইটদের পূর্বপুরুষ ছিল সেই সব শেমাইটরা যাদের সঙ্গে
হিরকানিয়ান প্রভুদের ধরে আনা কুশাইটদের মিলন ঘটেছিল। এলামাইটরা এই ধরণের একটা জাতির
এক উদাহরণ। একদা প্রাচীন কোথের মূল ভুখন্ডে বসবাস করত
স্টিগিয়ান, হিরকানিয়ান এবং পিক্টদের
মিশ্রনে জাত একদল মানুষ। এরাই খাটো উচ্চতার, শক্ত সবল হাত পায়ের অধিকারি ইট্রুস্ক্যানসদের,
রোমান জাতির ভিত্তি, পূর্বপুরুষ। হিরকানিয়ানরা
মহাদেশের পূর্ব উপকূলে ফিরে যাওয়ার পর বিবর্তিত উপজাতিতে পরিণত হয়। যারা পরে পরিচিত
হয়েছিল তাতার, হান, মঙ্গোল এবং তুর্ক রূপে।
আধুনিক বিশ্বের অন্যান্য জাতের
মানুষদের উত্স একইভাবে সনাক্ত করা যেতে পারে। প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই
দেখা যাবে তাদের উৎস, তারা যতটা পুরানো মনে
করে তার চেয়েও বেশি প্রাচীন। খুঁজতে শুরু করলে তাদের ইতিহাসও
সম্ভবত আমাদের বিস্মৃত হাইবোরিয় যুগের কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে নিয়ে যাবে ...
No comments:
Post a Comment