প্রতিম দাস
[প্রসঙ্গত সিনেমায় যেভাবে শুরুতে বলে দেয়, সেভাবেই জানিয়ে রাখি এই চরিত্রর সৃষ্টি করেছি ব্রিটেনের একজন প্রয়াত ভবিষ্যতদ্রষ্টা এবং আত্মা দর্শনকারী মিডিয়ামের ছায়ায়। - লেখক]
শুরু হতে চলেছে জনপ্রিয় একটা লাইভ পডকাস্ট। মঞ্চে দুটো চেয়ার। একটায় বসে আছেন সঞ্চালক এবং অন্যটায় একজন বিশিষ্ট মানুষ। যিনি ভূত নিয়ে ‘কালচার’ করেন। এমন একজন মানুষ যাকে অনেকেই খুব ভালো করে চেনেন। না উনি ভুতের গল্প লেখেন না কিন্তু ভূতেদের খুঁজে বেড়ান। বা বলা ভালো আত্মাদের খুঁজে বেড়ান। কীভাবে তাদের খুঁজে পাওয়া যেতে পারে তার সন্ধান দেন এবং সরাসরি পরলোকের বাসিন্দাদের কথা মানুষদের জানান। নাম কেশব নাগ। ভূততত্ত্ববিদ। উপর থেকে জোরালো আলো এসে পড়েছে ওদের উপর। মেঝে থেকে প্রতিফলিত আলোয় কারোর মুখই খুব একটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। যে অনুষ্ঠানে আজ উনি হাজির হয়েছেন সেটা যেখানে এরকম অদ্ভুত কাজকর্ম যারা করেন তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
সঞ্চালক নমস্কারের ভঙ্গীতে দুহাত একত্রিত করে বললেন, “আজকের সন্ধ্যায় আপনাকে স্বাগত জানাই মিস্টার কেশব নাগ।”
ফিরতি জবাবে মিস্টার নাগও নমস্কার এবং ধন্যবাদ জানালেন স্মিত হাসি সহকারে। ভদলোকের কন্ঠস্বরটাও বেশ গুরুগম্ভীর। তার সঙ্গেই কিছুটা ‘হাস্কি’ ধরণের।
“আপনার জগতের মানুষেরা তো আপনাকে ভূততত্ত্ববিদ বলে থাকেন। আপনি নিজেকে কী বলেন? মানে কী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন? ”
“আমি আসলে একজন মিডিয়াম এবং তার সঙ্গেই প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর। মিডিয়াম হিসাবে মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করি, আর দ্বিতীয় রূপে সেই সমস্ত স্থানে যাই যেখানে ভূতের উপদ্রব আছে বলে জানা যায়। চেষ্টা করি সেখানে থাকা আত্মাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করতে।”
সঞ্চালক ভুরু কুঁচকে বললেন, “তার মানে আপনি বলছেন আপনি আত্মাদের সঙ্গে কথা বলেন?”
মিস্টার নাগ জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, আমি আত্মাদের দেখতে পাই, ওদের কথা শুনতে পাই। ওদের বার্তা আপনাদের কাছে পৌছে দিই। তবে আমি জোর করে কিছু করতে পারি না। বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছু করা গেলে শুধু সেটাই করতে পারি।”
“ইন্টারেস্টিং! শুনব আপনার অভিজ্ঞতার গল্প। তার আগে আপনি আমাদের শ্রোতা-দর্শকদের বলুন, কীভাবে আপনি জানতে পারলেন বা কবে জানতে পেরেছিলেন আপনার এই ক্ষমতা আছে?”
সঞ্চালক প্রশ্ন করলেন, “আমরা যেতাম মানে, কে কে যেতেন?”
“আমি, মা, আমার দুই দাদা এবং সবসময়ের কাজের লোক পঞ্চানন কাকা।”
অবিশ্বাসের সুরে সঞ্চালক বললেন, “এত অল্প বয়সের কথা আপনার মনে আছে! আমার তো কিছুই মনে নেই।”
মিস্টার নাগের মুখে ফুটে উঠল স্মিত হাসি। “আসলে যা দেখেছিলাম বা বলা ভালো যাকে দেখেছিলাম তাঁকে পরে আর বেশ কয়েকবার দেখতে পাই। আর কি দেখেছিলাম সেটা ওই সময়ে ভয় পেয়ে মা-দিদিমার সামনে বলেছিলাম। ফলে কবে বলেছিলাম সেটা ওদের কাছ থেকেই পরে জানতে পারি।”
“বুঝলাম। আপনি ঠিক কী দেখেছিলেন মিস্টার নাগ, আর সেটার গুরুত্ব কি ছিল?”
“দেখেছিলাম রক্তাম্বরধারী জটাজুট সম্বলিত একজন মানুষকে। উনি ছিলেন আমার লতায় পাতায় সম্পর্কের এক পূর্বপুরুষ । উনিই আমাদের বাড়ির কালী মন্দিরের আদি উপাসক। তন্ত্র সিদ্ধ মানুষটা আত্মা জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন এবং আজও উনি তার কাজ করে চলেছেন।” কথা শেষে একবার কপালে হাত ছোঁয়ালেন মিস্টার নাগ।
“ওই মানুষটা দেখা আর আজ আপনার এই পেশায় নিযুক্ত থাকার মধ্যে সম্পর্কটা কোথায়?”
“দেখুন পাঁচ বছর বয়সটা খুব একটা কম নয় মানুষের হাবভাব বোঝার জন্য। সেদিন ওই মানুষটাকে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সোজা ছুটে গিয়েছিলাম দিদিমার কাছে। বলেছিলাম, একজন অদ্ভুত মানুষ আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। ঘরে আমার মাও ছিলেন। দিদিমা জানতে চেয়েছিলেন, ‘যে লোকটাকে তুমি দেখলে সে কেমন দেখতে ছিল?’ আমি বলেছিলাম, সেই মানুষটাকে কেমন দেখতে। আর এই কথা বলার পরেই আমার মা এবং দিদিমা একে অপরের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি বিনিময় করেন। আমাকে নিয়ে যান একটা তালা বন্ধ ঘরের সামনে। দরজা খোলেন। ভিতরে ছিল একটা পূর্ণাবয়ব ছবি। দেখেই আমি নাকি চিৎকার করে বলেছিলাম, হ্যাঁ এই সেই মানুষ।”
“তারপর?” সঞ্চালকের মুখে চোখে আগ্রহ প্রকাশ পেল।
“এরপরের তিন বছর ওই একই সময়ে মামার বাড়িতে আমি আবার ওঁর দেখা পাই। ওই এক ঝলক। বুঝতেই পারছেন বয়স বেড়েছে। বেড়েছে কৌতূহল। জানতে চেয়েছিলাম দিদিমার কাছে, কে উনি? কেনই বা আমি ওঁকে দেখতে পাচ্ছি? তখন দিদিমা বলেন, ‘এটা একটা ইঙ্গিত, আমি ভবিষ্যতে কী কাজ করব তার।‘ মানে, সটান প্রশ্ন করেছিলাম। উনি বলেন, ‘এ বংশে যার কাঁধে ওই কাজের দায়িত্ব চাপে একমাত্র তাকেই নাকি উনি দেখা দেন।’”
“তারমানে, আপনার দুই দাদা বা আপনার মা বা অন্য কেউ ওই মানুষটাকে দেখতে পেতেন না?” সঞ্চালকের কন্ঠস্বরে এবার আগ্রহের ছাপ স্পষ্ট।
“এরপর প্রতিবছর আপনি ওই অবয়বের দেখা পেয়েছেন?”
“না। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার আগে অবধি আর দেখতে পাইনি। ধীরে ধীরে ওই ঘটনার কথা আমি ভুলে যাই। সেই সময় আমার খুব প্রিয় জিনিস হয়ে উঠল ফুটবল খেলা। আমি সবাইকেই বলতাম যে আমি বড় হয়ে ফুটবলার হব। সেটা যে হইনি, সে তো বুঝতেই পারছেন। পড়াশোনায় আমি ভালোই ছিলাম। একটা স্কলারশিপ পেয়ে চলে যাই বিদেশে। আর ওখানেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার নিয়তি কোথায় বাঁধা আছে। বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে জীবিত মানুষ এবং আত্মাদের যোগসুত্র হয়ে কাজ করতে হবে। সেই ছোটবেলাতেই যে নিয়তি স্থির হয়ে গিয়েছিল সেটার সূচনা হয়েছিল ওখানেই।”
“অদ্ভুত! বিদেশে যাওয়ার পর আপনি নিশ্চিত হতে পারলেন আজকে যে কাজ আপনি করেন সেটাই আপনার কপালে লেখা আছে?”
পুনরায় স্মিত হেসে মিস্টার নাগ বললেন, “সেটাই তো বললাম মনে হয়। কী জানেন মিস্টার-” থমকে গেলেন, “আপনার নামটা –”
সঞ্চালক বলতে যেতেই হাত তুলে থামালেন মিস্টার নাগ। সামনের দিকে তাকালেন, তারপর ইতিবাচক ভাবে ঘাড় নাড়লেন, “সুমন রায়। তাই তো?”
জবাবে মাথাটা একপাশে কাত করে সঞ্চালক সুমন বললেন, “মিস্টার নাগ এভাবে আমাকে ইম্প্রেস করতে পারবেন না। আপনাকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তাতেই আমার নাম দেওয়া ছিল। ফলে...”
আরও একবার সেই একইরকমভাবে হাসলেন ভূত তত্ত্ববিদ কেশব নাগ। “না মিস্টার রায়, আপনাকে ইম্প্রেস করার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই। তবে অনুষ্ঠান শেষের আগে একটা এমন বিষয় বলব যা শুধুমাত্র আপনি এবং আপনার বাবা-মা আর আপনাদের খুব নিকট আত্মীয়েরা জানলেও জানতে পারেন। যাই হোক কথা বলছিলাম, কী জানেন মিস্টার রায় মানুষের জীবনে কখন কীভাবে মোড় বদলায় সেটা তা নিজের পক্ষে যান ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। মার্থার সঙ্গে পরিচয় হওয়াটা ছিল আমার জীবনের সেই মোড়।”
সঞ্চালক এই সময় বললেন, “যারা এই অনুষ্ঠান দেখছেন বা শুনছেন তারা অনেকেই হয়তো জানেন মাননীয় মিস্টার নাগের স্ত্রী বিদেশিনী। মার্থা কেন্ট । ঠিক বললাম তো মিস্টার নাগ?”
“একদম। সে ছিল আমার সহপাঠিনী। পাকেচক্রে আমাদের মধ্যে প্রেম হয়। তার থেকেই আজ এই জগত। ওর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার এক বছর পর থেকে আমিও ওর সঙ্গে ওদের চার্চের নানান অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম। লিভারপুলে স্পিরিচুয়ালিস্ট একটা চার্চে একবার মার্থা আমাকে নিয়ে যায়। সেখানেই ঘটনাটা ঘটে।”
সঞ্চালক সুমন প্রশ্ন করলেন, “স্পিরিচুয়ালিস্ট চার্চ! এটা কি সাধারণ যে চার্চ আমরা জানি তার থেকে আলাদা?”
“হ্যাঁ। এই চার্চে শুধুমাত্র প্রার্থনা বা অন্যান্য নিয়মিত কাজ কর্ম ছাড়াও একটা আলাদা ব্যাপার আয়োজন করা হয়। প্রতি রবিবার বিশেষ প্রার্থনার পর একজন ‘মিডিয়াম’ ওখানে উপস্থিত থাকেন যিনি উপস্থিত মানুষদের কাছ থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়া মানুষদের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে নানান বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন।”
“মানে আপনি যা করেন ঠিক সেরকম।”
“হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। তবে ওদের কাজে মিশে থাকে ১০০ শতাংশ ধর্মীয় আবেগ, যা আমার ক্ষেত্রে থাকে না। ওরা করেন নিজেদের ধর্ম প্রচার করার তাগিদ থেকে, আর আমি করি মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে।”
“বুঝলাম। সেদিন কী এমন ঘটল মিস্টার নাগ?”
সঞ্চালক চোখ বড় বড় করে বললেন, “সেই রক্তাম্বরধারী মানুষটা?”
“হ্যাঁ। শ্রদ্ধেয় গোরক্ষনাথ মশাই।”
“তারপর?”
“দেখলাম সেই মিডিয়াম মহিলা কেমন যেন ছটফট করে উঠলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মিস্টার কেশোব ন্যাগ নামের একজন এখানে উপস্থিত আছেন। তাকে এখানে আসার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’ না, না ওভাবে তাকানোর কিছু নেই, কথাটা উনি মোটেই বাংলায় বলেননি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। দেখলাম গোরক্ষ নাথ মশাই দাড়ি গোঁফের ফাঁক দিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। চোখ জ্বলজ্বল করছে।”
“কিছু মনে করবেন না মিস্টার নাগ, আপনার ওই গোরক্ষনাথ মশাই মিডিয়াম ভদ্রমহিলাকে যা বলেছিলেন সেটা নিশ্চয় বাংলায় নয়। তাহলে কী ধরে নেব উনি ইংরেজি জানেন?”
“সেটা যে জানেন বা বলতে পারেন তার একাধিকবার প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু কীভাবে শিখলেন তা জানি না। আত্মাদের জগত বড়ই রহস্যময়। আমি নিজেই অনেক বিদেশী বা অন্য ভাষায় কথা বলা আত্মার সম্মুখীন হয়েছি। তারা তাদের ভাষাতেই কথা বলেছে, কিন্তু আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কীভাবে এর উত্তর দিতে পারব না।”
“বেশ, তারপর কি হলো?”
“সেই মহিলা বললেন, ‘মিস্টার ন্যাগ আপনি ডানদিকের পিছনের বেঞ্চে দুজনের পর বসে আছেন। আপনার পাশে আপনার গার্লফ্রেন্ড মার্থা কেন্টও আছেন।‘ একথা বলতেই চার্চে উপস্থিত সবাই আমার দিকে ফিরে তাকায়। বাধ্য হয়েই এবং মার্থার বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে আমি উঠে যেতে বাধ্য হই।” কপালে আবার একবার হাত ছোঁয়ান মিস্টার নাগ। “সেই প্রথম শুনতে পাই গোরক্ষ নাথ মশাইয়ের কন্ঠস্বর। দেখে ভয়ানক লাগলেও সেই স্বরে এমন কিছু মেশানো আছে যা কাউকে ভরসা যোগাতে পারে। সেই দিন থেকে আজ অবধি যেখানে যত আত্মাদের মুখোমুখী হয়েছি, সবসময় উনি আমার পাশে থেকেছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য।”
“একেবারে নির্ভেজাল গল্প মনে হচ্ছে মিস্টার নাগ। কিন্তু আমি খোঁজখবর নিয়ে যা জেনেছি, তাতে এ পৃথিবীর নানান স্থানের একাধিক মানুষ আপনার এবং আপনার শ্রদ্ধেয় গোরক্ষনাথ মশাইয়ের সাহায্য পেয়েছেন। অকপটে তারা স্বীকার করেছেন। আবার অনেক সময় আপনি ব্যর্থ হয়েছেন সেটাও জানি।”
“হ্যাঁ ব্যর্থ হয়েছি। এটা স্বীকার করতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। দেখুন মিস্টার রায় আত্মাদের জগত আমার নিয়ন্ত্রণে নয়। তারা দেখা দিতে চাইলে, কথা বলতে চাইলে তবেই আমি কথা বলতে পারি। কোনও মন্ত্র তন্ত্র আমার জানা নেই।”
“যাইহোক, আমরা মূল ঘটনা থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। সেদিন তারপর কী হয়েছিল সেটাই এবার শ্রোতা-দর্শকদের বলুন।”
সুমন কিছুটা ইতস্তত করে হাত তুললেন, “ক্ষমা করবেন মিস্টার নাগ, একটা প্রশ্ন না করে থাকতে পারছি না। খ্রিস্টান ধর্মের ধর্ম স্থানে আপনার কালী উপাসক গোরক্ষনাথ মশাইয়ের সমস্যা হচ্ছিল না?”
“ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই মিস্টার রায়। এ প্রশ্ন আমি নিজেই ওঁকে করেছিলাম। জবাবে উনি বলেছিলেন, ‘বস্তুগত জগতের এই পৃথিবী ত্যাগ করার পর আত্মাদের গায়ে আলাদা করে আর কোনও ধর্মের ছাপ থাকে না। ওখানে একটাই জগত। ওখানে যারা থাকেন তাদের মাত্র দুটো ভাগ - অতৃপ্ত আত্মা আর চাহিদাহীন আত্মা।”
“বুঝলাম। এরপর আপনি কি করলেন?”
“আমি তো ওই যকে বলে কম্পিত বক্ষে গিয়ে দাঁড়ালাম ওদের কাছে। শুনতে পেলাম গোরক্ষনাথ মশাইয়ের কন্ঠ, ‘ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি। যেমন যেমন দেখবি বা শুনবি সেটাই করবি।‘ এরপর ওই মিডিয়াম মহিলা বললেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য যে একজন ভারতীয় যোগীর আত্মা এবং একজন মিডিয়াম আজ এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আমি চাইছি আজ এরপরের সময়টায় উনিই আপনাদের সঙ্গে কাজ করুন।’ বুঝতেই পারছেন এটা শুনে আমার হাঁটু কেঁপে গিয়েছিল। ওরা বা উনি যা করেন সেটা আমি কী করে করব। আবারও গোরক্ষনাথের কন্ঠ শুনতে পেলাম। ‘চোখ বন্ধ করে মন কে শান্ত করো কেশব। তারপর দেখো কি ঘটে।’”
কথাটা বলে মিস্টার কেশব নাগ চোখ বন্ধ করলেন। সুমন রায় কিছু না বলে তাকিয়ে রইল। সেকেন্ড দশেক খ্যাতনামা মিডিয়ামের চোখ বন্ধ থাকার পর আবার খুলে গেল। সুমন অবাক হয়ে দেখলেন চোখদুটো আক্ষরিক অর্থেই জ্বলজ্বল করছে। অথচ স্টুডিও কোনও আলো সরাসরি মানুষটার চোখে পড়ছে না।
“চোখ খোলার পর দেখলাম আমার সামনে একটা আবছা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। যার ভিতর দিয়ে আমি সামনে বসে থাকা ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছিলাম। অন্তত একশো বছর আগে মানুষ যেমন পোশাক পড়ত সেরকম পোশাক ওই অবয়বের পরনে। মাথায় খড়ের টুপি। ইংল্যান্ডের কাঊন্টি এলাকার গ্রামীণ উচ্চারণে সে মানুষ আমাকে বলল, ‘আমি অ্যাডাম জনসন। এই ঘরে আমার নাতি জন হবসন উপস্থিত আছে। তাকে একটু জানিয়ে দিন তার সদ্য প্রয়াত পিতা আমার ছেলে এখানে আমাদের জগতে ভালোই আছে। ও যেন বেশি চিন্তা না করে।’ কথা শেষ করেই অবয়ব মিলিয়ে গেল। আমি ফিরে তাকালাম গোরক্ষনাথের দিকে। উনি স্মিত হেসে ইতিবাচক ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন। আমি অচেনা জন হবসনকে উদ্দেশ করে তার দাদুর কথাটা জানাতেই এক যুবক মাঝের সারি থেকে উঠে প্রায় ছুটে এল। দুহাতে জড়িয়ে ধরল আমার হাত। কয়েক ফোঁটা জল এসে পড়েছিল আমার হাতে।”
“অর্থাৎ গোরক্ষনাথ মশাই কে বাদ দিলে সেটাই ছিল আপনার প্রথম ভূত, সরি আত্মা দর্শন।”
“হ্যাঁ,” গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলেন মিস্টার নাগ।
‘সেদিন কি আর কোনও আত্মার দেখা পেয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, আরও চারজনের দেখা মিলেছিল। যাদের মধ্যে একজন তার মেয়ের হারিয়ে যাওয়া আংটিটা কোথায় পড়ে আছে তার হদিস জানিয়ে দিয়েছিলেন।”
সুমন একটু হেসে বললেন, “তারমানে আপনাদেরকে ব্যবহার করা গেলে অনেক হত্যা রহস্যের সমাধান করা যেতে পারে। গোয়েন্দাদের প্রয়োজন হবে না।”
মিস্টার নাগ বললেন, “বুঝতে পারছি ঠাট্টা করছেন। কিন্তু স্বীকার করছি বাস্তবে এটা করা সম্ভব। তবে সব ক্ষেত্রে সফল হওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ আত্মাদের মর্জি। তারা উপস্থিতির জানা না দিলে বা কিছু না জানলাএ আমরা অসহায়। আরও একটা ব্যাপার হলো বিশ্বাস। এভাবে জটিল কিছুর সমাধান সম্ভব এটা আপনি কজন কে বিশ্বাস করাতে পারবেন মিস্টার রায়?”
সুমন একটু চুপ করে থেকে বললেন, “‘হুম সেটা ভুল বলছেন না আপনি, স্বীকার করছি। এভবাএ কিছু করতে গিয়ে যদি ভিক্টিমের আত্মা সাহায্য না করে তাহলে তো আরও সমস্যা।”
এই সময় স্টুডিওর ভিতর একটা লাল আলো দুবার দপদপ করে উঠল। সেটার দিকে নজর যেতেই সুমন বলে উঠলেন, “ মিস্টার নাগ, আজকের মতো সময় প্রায় শেষ। তবে আপনাকে আমি ছাড়ব না। প্রতি সপ্তাহে একবার করে আপনার সঙ্গে এই শো করার ইচ্ছে রইল। এরপরে যেদিন বসব সেদিন আপনার কাছ থেকে জেনে নেব, কেউ যদি প্যারা নরম্যাল অ্যাক্টিভিস্ট হতে চায় তাহলে তার কী কি করা উচিত বা কোন দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। আশা করি আপনার আপত্তি নেই?”
মিস্টার নাগ স্মিত হেসে বললেন, “গোরক্ষনাথ মশাই যদি চান আমি অবশ্যই আসব?”
“ ধন্যবাদ মিস্টার নাগ। ও হ্যাঁ, আপনি শোয়ের শেষে আমাকে নিয়ে কিছু একটা বলবেন বলেছিলেন। তারসঙ্গেই আর একটা প্রশ্ন আছে। গোরক্ষনাথ মশাই কি এখানে উপস্থিত আছেন? তাকে আমার প্রণাম জানাবেন।”
দুহাত কপালে ঠেকিয়ে মিস্টার নাগ বললেন, “আপনার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন উনি।”
কথাটা শুনে চমকে পিছনের দিকে তাকালেন সুমন।
শোনা গেল মিস্টার নাগের গম্ভীর স্বর, “উনিই তো জানালেন আপনার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এমন এক ঘটনা যা আপনি সম্ভবত নিজেও জানেন না।”
“আমার জীবনের ঘটনা আর আমিই জানি না!”
“হ্যাঁ মিস্টার রায়। বাড়ি ফিরে গিয়ে আপনার মাকে জিজ্ঞেস করবেন, সুরঞ্জনা নামটা তাদের আজও মনে আছে কিনা। বাকি উত্তর আশা করি উনিই দিয়ে দেবেন।”
০০০০০
আপাতত এখানেই থামছি। সুমন তার মার কাছে কি জানতে পেরেছিলেন এবং প্যারা নরম্যাল অ্যাক্টিভিস্ট হতে চাইলে কী করতে হবে বা কী জানতে হবে, সে নিয়ে মিস্টার নাগ কী বললেন, সেসব নিয়ে ফিরে আসব ‘ভূততত্ত্ববিদ – কেশব নাগ’ আখ্যানের দ্বিতীয় পর্বে। অবশ্য যদি আপনারা চান তবেই?
০০০০
অনুষ্ঠান শেষে সেদিন একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়েই বাড়ি ফিরেছিলেন সুমন। যা শুনলেন এবং যে প্রশ্ন মিস্টার নাগ তার মনে জাগিয়ে দিয়েছেন সেটা তোলপাড় করে দিচ্ছিল তার মনের জগত। বাড়িতে ঢুকে সোজা চলে গিয়েছিলেন মায়ের ঘরে। কোনও ভণিতা না করে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মা, সুরঞ্জনা এই নামটার কি কোনও বিশেষ অর্থ আছে?”
প্রশ্নটা শুনে সুমনের ষাট পার হয়ে যাওয়া মায়ের মুখে ফুটে উঠেছিল বিস্ময়। তার সঙ্গেই মিশে গিয়েছিল বিষাদ। উনি কিছু বলার আগেই, পিছন থেকে ভেসে এসেছিল সিনিয়র রায়, মানে সুমনের বাবার গলা। “এ নাম তুই কোথায় শুনলি? মানে বিশেষ করে এ নামটা নিয়ে প্রশ্ন করছিস কেন?”
“আমি জানি না বাবা। কেউ একজন আজ আমার শোয়ে এসেছিলেন। তিনিই এ বিষয়ে তোমাদের কাছ থেকে জানতে বললেন?”
“কে তিনি?”
“ভূততত্ত্ববিদ কেশব নাগ।”
“এ নামের কাউকে আমরা চিনি বলে তো মনে হচ্ছে না। যে বিষয়ে তুই প্রশ্ন করছিস সেটাও তোর বড়মামা, সেদিনের ডাক্তারবাবু, উপস্থিত থাকা নার্স আর আমরা ছাড়া কেউ জানে না। উনি কীভাবে জানলেন? আর এতদিন পর সে প্রসঙ্গ কথা উঠে এলই বা কীভাবে?”
সুমন সংক্ষেপে জানাল কী ঘটেছিল। সব শুনে বেশ কিছুক্ষণ চূপ করে থাকার পর সুমনের মা বললেন, “সে ছিল তোর যমজ বোন।”
সুমন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘মানে? ছিল মানে টা কি?”
“ দশমাসের বেশি সময় তাকে তোর সঙ্গেই পেটে ধরে রেখেছিলাম রে সমু। কিন্তু...”
“কিন্তু কী মা?” উত্তেজনায় মাথা দপদপ করছিল সুমনের।
উত্তরটা দিলেন ওর বাবা, “ও এ জগতের আলো দেখার সুযোগ পায়নি। অ্যাম্বিলিক্যাল কর্ড জড়িয়ে যায় ওর গলায়...”
“মেয়ে হলে সুমন আর ছেলে হলে সুরঞ্জনা নাম রাখব এটাই ঠিক ছিল। আমাদের সময়ে মফস্বল শহরে পেতে যমজ বাচ্চা আছে কিনা বোঝার মতো সুযোগ সুবিধা ছিল না।”
সুমন আর কোন কথা না বলে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিলেন নিজের ঘরে। সেদিন ভালোভাবে ঘুম হয়নি। সকালে উঠেই ফোন করেছিলেন মিস্টার নাগকে। চেয়ে নিয়েছিলেন অ্যাপয়েনমেন্ট।
শুধুমাত্র মানুষটার সঙ্গে আর একবার দেখা করাই নয়, আর একটা স্বার্থও ছিল সুমনের। সকালে উঠে দেখেছিলেন গতকালের অনুষ্ঠানে যে পরিমাণ দর্শক-শ্রোতা সাড়া দিয়েছেন, কমেন্ট করেছেন তা এর আগে একদিনে কোনও শো’য়ে পাওয়া যায়নি। অবশ্যই তার ভিতর নেগেটিভ কমেন্টও ছিল অনেক। যেমন একজন বলেছেন, “ওনার সিজোফ্রেনিয়া আছে। সত্বর মনোবিদ্যার কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।” এরকম ধরনের কমেন্টে সুমনের কিছু যায় আসে না। যত চাপান উতোড় হবে তত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে তার শো। সেটাই আসল কথা।
০০০০০
মিস্টার নাগ সুমনের শহরের বাসিন্দা নন। এখানে একটা কাজে এসেছিলেন খবর পেয়ে সুমন যোগাযোগ করে তাকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের শো’য়ে। যে হোটেলে ভূত তত্ত্ববিদ উঠেছিলেন সেখানেই চলে গেলেন সময় মতো।
ঘরেই ছিলেন মিস্টার নাগ। সুমনকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। ইন্টারকমে চায়ের অর্ডার দিলেন। সুমন কীভাবে কথা শুরু করবেন বুঝতে পারছিলেন না। সেটা অনুমান করতে অসুবিধা হলো না মিস্টার নাগের। বললেন, “কোনও ধন্যবাদ বা অন্য কিছু বলার দরকার নেই মিস্টার রায়। এটাই আমার কাজ। যদিও আপনাকে যা বলেছি সেটা পোক্ত প্রমাণ বলে বিশ্বাস করাও অনেকের পক্ষে সম্ভব হবে না। আপনাকে প্রভাবিত করার জন্য আপনার অতীত নিয়ে আমি ’হোমওয়ার্ক’ করে ওই খবর সংগ্রহ করিনি তার কোনও প্রমাণ আপনার কাছে নেই। তবে নিশ্চিন্ত হতে পারেন, আমি সেটা করিনি। সব জেনেছি গোরক্ষনাথ মশাইয়ের কাছ থেকে।
একথা শুনে সুমন আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। জানতে চাইলেন, “আপনি আর কদিন থাকবেন এখানে?”
“যে কাজে এসেছি তার সুলুকসন্ধান সবই বুঝে নিয়ে সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি। আজ আপনাদের এখানকার বিখ্যাত কাল মন্দির দর্শন করতে যাব। আগামীকালই বিদায় নেওয়ার ইচ্ছে আছে।”
“কী কাজে এসেছিলেন সেটা বলা যাবে কি?” সুমন একটু ইতস্ততভাবেই প্রশ্ন করলেন।
সুমন বললেন, “ না, না আমি সেটা জানতেও চাইব না। আপনার বক্তব্য রেকর্ড করার অনুমতি পেতে পারি কি?”
ইতিবাচকভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন ভূততত্ত্ববিদ।
সুমন ব্যাগ থেকে হ্যান্ডি ক্যামটা বার করে অন করল।
মিস্টার কেশব নাগ শুরু করলেন তার কথা বলা।
“আমার কাজের সূত্রে একাধিক ইমেল বা চিঠি আসে আমার কাছে। যে কাজের সূত্রে এখানে এসেছি সেটা পেয়েছিলেম আপনাদের এখানকার এক বৃদ্ধাশ্রমের এর দেখাশোনাকারী সংস্থার কাছ থেকে। উনি জানিয়েছিলেন, বৃদ্ধাশ্রমের সদস্যা তাকে অদ্ভুত কিছু ঘটনার কথা জানিয়েছে। যার আসল নাম আমি প্রকাশ করছি না। ধরে নিন তার নাম স্বাতী। তা সেই স্বাতী জানিয়েছেন, ‘তাকে নাকি রাত্রিবেলায় ঘরের আলো নেভালেই কেউ একজন জ্বালাতন করছে। আলো জ্বালালেই সেসব থেমে যাচ্ছে এবং আর কাউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। যদি সম্ভব হয় আমি যদি একবার এসে ঘটনাটা আসলে কী ঘটছে সেটা পরীক্ষা করে দেখি তাহলে খুব ভালো হয়।’
সেই সূত্রেই আমি এখানে এসেছি। বৃদ্ধাশ্রম থেকে যিনি চিঠি পাঠিয়েছিলেন তার সঙ্গে দেখা করি এবং জানতে পারি, স্বাতী প্রায় পনের দিন ক্রমাগত ওই বিষয়ে অভিযোগ জানাচ্ছেন। সেই অভিযোগের সময় তার গলা এতটাই চড়ছে যে, তার ফলে এই স্থানের অন্যান্য যে সমস্ত সদস্যরা আছেন তাদের শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে রাতের বেলায়। শুধু তাই নয় উনি চাইছেন আমি যেন এ ঘটনার একটা সুরাহা করি। বুঝলাম যেভাবেই হোক স্বাতী আমার বিষয়ে জানেন।
সময় নষ্ট না করে আমাকে স্বাতীর ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম। নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। ছোটোখাটো বেশ সুন্দর দেখতে মহিলা আমাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই স্বাতী বললেন, “আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি কেশব বাবু। আপনাকে নিয়ে লেখা বই আমি পড়েছি। আমার নাতি আমাকে সেই বই উপহার দিয়েছিল।”
এই জায়গায় সুমন বলে উঠলেন, “মাফ করবেন মিস্টার নাগ, বুঝতে আমার আপনার বিষয়ে ‘হোমওয়ার্ক’টায় খামতি থেকে গিয়েছে। আপনাকে নিয়ে লেখা বইটার নামটা যদি বলেন, আমি সংগ্রহ করে নেব।”
মিস্টার নাগ হেসে বললেন, “আরে অত ইতস্তত করার কী আছে। সবার পক্ষে সব কিছুর খবর রাখা সম্ভব নয়। বইটার নাম ‘ভূততত্ত্ববিদ – কেশব নাগ’। আপনার মতোই ওটার লেখক প্রতিম দাস প্রায় একমাস ধরে আমার সঙ্গে কথা বলে তবে লিখেছিলেন। আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তরই ওখানে পেয়ে যাবেন।”
সুমন বললেন, “সে হয়ত পাব, কিন্তু তারমানে এই নয় যে আমার শো’য়ে আপনি আর আসবেন না। আগামী সপ্তাহেই আসতে হবে। বিষয় থাকবে ‘প্যারা ন রম্যাল অ্যাক্টিভিস্ট হতে হলে কি করতে হবে?’”
“ঠিক আছে, ও নিয়ে পরে কথা হবে। আপাতত যা বলছিলাম সেটাই বলি।”
সুমন খুশি মনে ইতিবাচকভাবে ঘাড় নাড়লেন।
“স্বাতী যখন কথা বলে যাচ্ছিলেন আমি তখন আমি ওর ঘরের চারদিকটা দেখছিলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আরামদায়ক ঝকঝকে-তকতকে ঘর। স্বীকার করতেই হবে এই বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে ভালো। এই ঘরের মধ্যে এমন কোনও পরিবেশ নেই যাতে কোনও রকম প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটি জায়গা নিতে পারে।
স্বাতী বলে চললেন, “আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি এখানে থাকি । আমরা নিঃসন্তান। কী হলো? ও ভাবছেন তাহলে নাতি কোথা থেকে এল, তাই না? ও আমার বোনের মেয়ে। যার কাছে গিয়ে থাকতেই আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে সেই সময়ে আলাদা করে আমার থাকার মতন কোনও ঘর খালি ছিল না। কিছুদিন আগেই বোন আমার সাথে যোগাযোগ করেছে এবং জানিয়েছে, ওর ছেলে দোতলার অংশটা বানিয়েছে। আপাতত আমি চাইলেই ওখানে গিয়ে থাকে পারি।” কথাটা শুনেই আমি স্বাতীর দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং চোখ টিপলেন।
আমি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিলাম যে, এটা আসলে বানানো গল্প। স্বাতী এই বৃদ্ধাশ্রমে আর থাকতে চাইছেন না। যেনতেন প্রকারে তার বোনের কাছে গিয়ে থাকার উদ্দেশ্য নিয়েই এই গল্প বানানো হয়েছে। এখানে কোনও জ্বালাতনকারী আত্মার উপস্থিতি নেই। কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তে হঠাৎ করেই আমি একটা জিনিস দেখতে পেলাম।”
“কী দেখতে পেলেন মিস্টার নাগ?” না চাইতেও প্রশ্নটা করে ফেললেন সুমন।
“দেখলাম স্বাতী যেখানে বসে আছেন তারপাশেই একটা ভূতুড়ে অবয়ব রূপ ধারণ করেছে। ছোটখাটো আকৃতির মানুষ। চেহারা শীর্ণকায়। পরনে ধুতি, আর হাতা গয়ানো শার্ট। মুখটায় হাসিখুশি বন্ধুত্বের ছাপ মাখা। তাকিয়ে আছেন স্বাতীর দিকে। যেন মন দিয়ে ওঁর বলা গল্প শুনছে্ন। এই সময় কানের পাশে শুনতে পেলাম গোরক্ষনাথ মশাইয়ের ফিসফিসে কণ্ঠস্বর, ‘উনি স্বাতীর মৃত স্বামী, গোবিন্দ বসাক।’ এরপরেই কানে এল সামনের অশরীরীর কন্ঠস্বর। বেশ পুরুষোচিত । ‘ওরে আমার দুষ্টু স্বাতী! তোমার স্বভাব একটুও বদলায়নি দেখছি। আরে ও নাগমশাই, শুনুন!’ বুঝলাম আমাকে উদ্দেশ করেই বলছেন, ‘ও গল্প বানাচ্ছে। আমি বেঁচে থাকতে ওর এই গল্পের ঠ্যালায় জেরবার হতাম। ওকে কিছুতেই এখানে আটকে রাখা যাবে না আর। আসলে কী জানেন, ওরা দু বোন একে অপরকে খুব ভালোবাসে।’
“মিস্টার রায়, আমি আর কথা না বাড়িয়ে স্বাতীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম বৃদ্ধাশ্রমের অফিস ঘরে। যিনি আমাকে ডেকে এনেছিলেন তাকে বললাম, সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। একান্তে কিছু কথা আপনাকে বলতে চাই। দয়া করে দরজাটা একটু বন্ধ করে দিন। উনি সে কাজটা করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন? কীরকম?’
উত্তরে বললাম, ওই ঘরে কোনোরকম আত্মা জাতীয় কিছু নেই। আমার যা মনে হলো, উনি এখানে আর থাকতে চাইছেন না। বোনের কাছে গিয়ে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন কাটাতে চান। তার জন্য কোনও একটা ছুতো বানানোর দরকার ছিল। সেজন্যই ওই ভুতের গল্পটা উনি আপনাদের শোনাতে শুরু করেছেন।
আমার সামনে থাকা মানুষটার চোখ অবাক বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গিয়েছিল একথা শুনে। “ সত্যি! তাই নাকি? ঠিক আছে উনি যদি সত্যিই এতা চেয়ে থাকেন আমি সর্বান্তকরণে চেষ্টা করব ওঁর মনের ইচ্ছে পূর্ণ করার। মিস্টার নাগ, যদিও বৃদ্ধাশ্রম চালাই তবু আমি নিজে মনে প্রাণে চাই মানুষগুলো জীবনের শেষ দিন গুলোতে তার আপনজনের সঙ্গেই থাকুন। দেখছি আমি কী করতে পারি। অন্তত এই স্থানের শান্তি বজায় রাখার জন্য আমাকে এটা করতেই হবে।’ বলে একটু হাসলেন।”
মিস্টার নাগ কথা থামাতেই সুমন বললেন, “তারমানে এক অর্থে এটা একটা অনন্য অভিজ্ঞতা আপনার কাছে?”
”হ্যাঁ, সেটা বলাই যায়। আত্মা যদি ভা্লো হয় তাহলে তারা সব জায়গায় বিচরণ করতে পারে। মুস্কিল হয় খারাপ মানসিকতার আত্মাদের নিয়। তারা আটকে থেকে যায় এক জায়গায়।”
“সেরকম আটকে থাকা আত্মাদের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে নিশ্চয়?”
“অবশ্যই হয়েছে। এরকম ক্ষেত্রেই তো সমস্যা জন্ম নেয়। আর তার সমাধান করতে আমার ডাক পড়ে।” হাতের ঘড়ির দিকে তাকালেন মিস্টার নাগ। “ আজ আর নয়। আমি একটু বের হবো। আমাকে ক্ষমা করতে হবে মিস্টার রায়।”
সুমন সঙ্গে সঙ্গে হ্যান্ডি ক্যাম অফ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, “আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন, ওটা আমার চাওয়া উচিত। সকালে এসে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম। তবে একটা কথা কিন্তু আপনাকে দিতে হবে। আগামী মাসে যেকোনো একটা দিন আবার আপনাকে আমার শো’য়ে আসতে হবে। ওই প্যারা নরম্যাল অ্যাক্টিভিটির তদন্ত কারী কেমন হওয়া উচিত-”
কথার মাঝেই মিস্টার নাগ বললেন, “ সে তো আগেই আপনাকে কথা দিয়েছি। আমি আসব।”
০০০০০
তাহলে কেশব নাগের পরের আখ্যানে আমরা জানতে পারব একজন প্যারা নরম্যাল অ্যাক্টিভিস্ট হতে হলে কী কী জানা দরকার। জানার ইচ্ছে থাকলে জানাবেন।
৩য় আখ্যান
শোনা
গেল সুমন রায়ের কন্ঠস্বর। “নমস্কার। আজকের অনুষ্ঠান শুরু করতে চলেছি। আবার একবার
আপনাদের সামনে হাজির হয়েছেন খ্যাতনামা স্বঘোষিত ‘মিডিয়াম’ এবং প্যারা-নরম্যাল
ঘটনার তদন্তকারী মাননীয় শ্রী কেশব নাগ মহাশয়। পুনরায় স্বাগত এই মঞ্চে। ধরেই নিচ্ছি
নাগ মশাইয়ের শ্রদ্ধেয় আত্মা গুরু গোরক্ষনাথ মশাইও এখানে উপস্থিত আছেন। তাকেও প্রণাম
জানাই। আজ আমরা এক বিশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। হয়তো তার সূত্রে ভৌতিক কোনও
অভিজ্ঞতার কথা আসতে পারে আবার নাও আসতে পারে। বিষয়টা হলো, একজন মানুষ
প্যারানরম্যাল বিষয়ে চর্চা বা সোজা কথায় ভৌতিক ঘটনার তদন্ত করতে চাইলে তাকে কোন কোন
বিষয়ে অবহিত থাকতে হবে।”
নমস্কারের ভঙ্গীতে একবার হাতদুটো
কপালে ছুঁইয়ে মিস্টার নাগ বললেন, “প্যারা-নরম্যাল অ্যাক্টিভিস্টদের আর একটা নামেও
ডাকা হয় ‘গোস্ট হান্টার’। একজন সফল ঘোস্ট হান্টার হতে গেলে কিছু বিশেষ প্রস্তুতি অবশ্যই দরকার। যা একইসঙ্গে কোনও আত্মার উপস্থিতির সন্তোষজনক প্রমাণ দিতে পারে এবং অন্যান্য নানান ভাবনা বা বিরোধী মতামতকে দূরে সরাতে সাহায্য করে। সেই প্রস্তুতির প্রধান অঙ্গ
হলো ভূত বা আত্মার গতিবিধি যাচাই করার নানান সরঞ্জাম।”
“সেই
সরঞ্জামগুলো কী?”
“বলছি।
তার আগে কিছু কথা বলা দরকার। সরঞ্জামগুলো কী জেনেই আপনি ব্যাগ গুছিয়ে ভূত খুঁজতে চলে গেলেন এটা কিন্তু কখনোই করবেন না। জিনিসপত্র
নেওয়ার পরেও আরও কিছু প্রস্তুতি নেওয়া দরকার থাকে তদন্ত শুরু করার জন্য।“
“কীরকম?”
“সবার আগে একটা কথা মাথায় রাখবেন, এই কাজ করার সময় যেকোনো ধরণের শব্দ বা নড়াচড়া আপনাকে কৌতূহলী বা উত্তেজিত করে দিতে পারে। তার মানে এই নয় যে সবসময় আত্মা তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।”
‘মিস্টার নাগ আমাদের শ্রোতা
দর্শকদের যদি একটু উদাহরণ দিয়ে বলেন ভালো হয়। মানে আপনার নিজের কোনও অভিজ্ঞতার
গল্প।“
মিস্টার নাগের মুখে উঠল
মৃদু হাসি। “গল্প শুনতে চাইছেন? বেশ। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। যেখানে সবাই মনে করত যখনই ঘরের ঝাড়-লন্ঠনটা দোলে তখনই আত্মার আগমন হয়। আমাকে এটা পরীক্ষা করে
দেখার জন্য ডাকা হয়েছিল। সবার আগে আমি ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখি ওই ঝাড়-লন্ঠনটা কীভাবে ঝুলানো আছে। আর সেটা করতে গিয়েই চোখে পড়ে ঘরের উপরের দিকের পুরনো একটা
বন্ধ জানালার পাল্লা ঢিলে হয়ে ফাঁক হয়ে গেছে। যেখান
দিয়ে হাওয়া এসে ধাক্কা মারে ওই ঝাড়-লন্ঠনটাকে। আশা করি বলার প্রয়োজন নেই যে, কেবলমাত্র যেদিন বা যখন জোরে বইতো সেদিনই ওই বাড়িতে ভূতের আগমন হতো।“
“ইন্টারেস্টিং। এরকম ভুলভাল
ভূত প্রচুর খুঁজে পান তারমানে আপনারা?”
“একদম। একটা বিষয় হয়তো আপনারা
অনেকেই লক্ষ্য করেছেন, ইদানীংকালে ভূত দেখার বা ভুতুড়ে শব্দ শোনার বাপারটা অনেক
কমে গিয়েছে। না তার মানে এই নয় যে ওরা সব এ জগত থেকে বিদায় নিয়েছেন। আসলে ভুলভাল
ভূত বা আত্মা দেখাটা কমেছে। যার মূল কারণ কংক্রিটের বাড়ি এবং ধাতব জানলা দরজা।”
“মানে?”
“আগেকার দিনে বাড়িতে প্রায়
সব কিছুই কাঠের হতো। ইংরেজরা আসার পর এমন অনেক কিছু বানিয়েছিলেন যাতে কাঠের পরিমাণ
বেশী। এবং সেইসব স্থানেই বেশি ভুতের আড্ডা। কাঠের মেঝে, দরজা, ছাদ বা সিঁড়ি আবহাওয়ার বদলের সঙ্গে সঙ্গে নানান রকম শব্দ করে। যা ভুতুড়ে আবহাওয়া সৃষ্টি করার অতিসাধারণ উৎস। পুরনো বাড়ির দরজার পাল্লা খোলার এমন শব্দ হয় যা আপনার ঘাড়ের রোম খাড়া করে দিতে পারে।”
এটা একদম ঠিক বলেছেন, এমন
কোনও ভূতের সিনেমা বোধ হয় নেই যাতে দরজা খোলার ওই পিলে চমকানো শব্দ শোনা যায় না।”
“এমনকি
মিস্টার রায়, আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি পুরনো বাড়িতে থাকা ইঁদুরদের চলাচলকে অনেক সময় এরকম ঘটনা বলে মনে করা হয়। এছাড়াও বাড়ির আশেপাশে থাকা বড় গাছের ডাল হাওয়াতে বাড়ির ছাদে বা জানলায় অনেক সময়েই আঘাত করে। সেই অর্থে খোঁজখবর না নেওয়া তদন্তকারী ওইসব ডালপালার শব্দ শুনে কিন্তু ভেবে নিতেই পারে যে বাড়িতে সে তদন্ত করতে এসেছে সেখানে সে একা নয়।”
“সোজা কথায় কাজ শুরুর আগে
ভালভাবে সব খুঁটিয়ে দেখে নিতে হবে।”
“একদম। প্রাকৃতিক কারণে যখন কোনও বাড়ি রাতের দিকে ঠাণ্ডা হয় তখন নানা রকমের শব্দ সৃষ্টি হয়। বিদেশে দেখেছি, ফায়ার-প্লেসের আগুন যখন নিভে যায় ওর চিমনির দেওয়াল থেকে
অদ্ভুত সব শব্দ নেমে আসে।”
সুমন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে
থেকে বললেন, “আপনি তো জন্ম সূত্রে একজন ‘স্পিরিট মিডিয়াম’। মানে তেনাদের দেখার এবং শোনার ক্ষমতা আছে আপনার। এটা নিশ্চয় একটু বেশি সুবিধা দেয়
আপনাকে?”
“অবশ্যই দেয়। কোনও জায়গায় গেলেই গোরক্ষনাথ মশাইয়ের আশীর্বাদে সেখানকার কোনও পুরানো বাড়ি বা যেকোনো স্থানের পরিবেশ থেকেই আমি সেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনা অনুভব করতে পারি। এগুলো অনেকটা সময়ের গায়ে আটকে থাকা ফটোগ্রাফের মতন। আত্মা জগত নিয়ে যারা চর্চা করেন তাদের ভাষায় একে বলা হয় ‘রিসাইডুয়াল এনার্জি’। এমন কিছু আবেগ স্রোত যা সময় চলে গেলেও সময়ের অদৃশ্য সুতোতেই আবদ্ধ হয়ে একটা ছাপ রেখে যায়।” “তারমানে আপনি কি
এটাই বলতে চাইছেন, এটাই আত্মা দেখতে পাওয়ার আসল কারণ মিস্টার নাগ?”
“আসল
নকল জানি না। তবে সাধারণ মানুষের অযথা ভূত দেখার এটা একটা কারণ বলতেই পারি। এরকম
কিছু ঘটনার কথা প্রতিম বাবুর লেখা ‘ভূততত্ত্ববিদ - কেশব নাগ’ এ আছে। পড়ে দেখতে
পারেন।”
সুমন বললেন, “পড়া নয়
মিস্টার নাগ, আপনার মুখ থেকে দর্শক শ্রোতাদের শোনাব আগামী কোনও পর্বে। আপাতত, আমরা
আমাদের আজকের বিষয়ে ফিরে যাই। প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন করতে হলে কী কি সরঞ্জাম লাগবে এবার সেটা
বলুন।”
মিস্টার নাগ জামার পকেট
থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বার করলেন, “কিছু যাতে বাদ না যায় তার জন্য লিখে এনেছি।
শুনুন তাহলে, কী কী
সরঞ্জাম থাকা
প্রয়োজন আপনার
কিট-ব্যাগে।
টর্চ, নোটবুক এবং পেন, তুলো এবং টেপ, মোমবাতি, ময়দা, ওয়াকি টকি, থার্মোমিটার, ই এম এফ মিটার, পেন্ডুলাম, ডাউসিং রড, টেপরেকর্ডার, ক্যামেরা এবং মানুষের সেরা বন্ধু কুকুর।
আমি তো পুরনো সময়ের মানুষ,
তাই এসব নিয়ে বেশিরভাগ কাজ করেছি। আজ একটা ভালো মোবাইল ফোন থাকলে এর ভিতর অনেকগুলো
জিনিস নেওয়ার দরকার পড়বে না।”
সুমন বললেন, “এবার যদি
এগুলো কী কাজে লাগে একটু বলেন।”
“অবশ্যই। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম হলো টর্চ। তার সঙ্গেই রাখতে হবে চট করে বদলানো যায় এমন ব্যাটারি। কারণ দুষ্টুমি করতে ভালোবাসে এমন আত্মারা টর্চের ভেতরে থাকা ব্যাটারির শক্তি শুষে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ফলে ব্যাগে অতিরিক্ত ব্যাটারি না থাকলে একজন অসহায় তদন্তকারীকে অন্ধকারের মধ্যে এদিকে-সেদিকে হাতড়ে বেড়াতে হবে।”
“তারমানে ভূতের সিনেমায়
টর্চের আলো কমে যাওয়ার যে দৃশ্য দেখি, সেটা মিথ্যে নয়। সঞ্চালক প্রশ্ন করলেন।
“না। সিনেমা যারা বানান
তারা ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনার সাহায্য তো নেন। সবটাই অবাস্তব থাকে না সেখানে।”
‘বুঝলাম। নোটবুক এবং পেন তদন্ত-কালীন সময়ে যে সমস্ত ঘটনা ঘটছে সেগুলোকে নথিবদ্ধ করে রাখার জন্য আশা করি।”
“হ্যাঁ শুধুমাত্র স্মৃতির উপর ভরসা করে থাকাটা ঠিক নয়। একটা গোটা রাতের নানান তথ্যর সবকিছুই যে সকালবেলায় মনে থাকবে এটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সম্ভব নয়। তার ওপর যদি সারা রাত্রি ধরে অনেক রকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, তাহলে তো তার ভেতরের দু একটা বিষয় ভুলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। তাই সময় সুযোগ পেলেই নোট করতে
হবে। এছাড়াও যে স্থানে আপনি যাচ্ছেন, সেই জায়গার একটা স্কেচ করে নিতে পারলে তদন্ত করতে সুবিধা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে বাড়িতে আপনি ঢুকছেন সেখানকার ঘরগুলোর অবস্থান, কার পাশে কোনটা, কোথায় সিঁড়ি ইত্যাদি।”
“আশা করি আমাদের দর্শক
শ্রোতাদের কাছে একটা নতুন জগত খুলে যাচ্ছে।”
“ওহ, এই দেখুন লিখে এনেও
একটা বিষয় বাদ গিয়েছে। সাধারণ সাদা কাগজ এবং পেন্সিল নেওয়াটাও জরুরি। কারণ তদন্ত করার সময় কোনও একটা বিশেষ বস্তু, যাকে ‘ট্রিগার অবজেক্ট’ বলা হয়
সেটাকে সাদা কাগজের উপর রেখে তার চারদিকে ‘আউটলাইন বর্ডার’ এঁকে নেওয়ার দরকারও আছে।”
“’ট্রিগার অবজেক্টটা ঠিক কী
জিনিস?”
“যে আত্মার খোঁজ বা
মোকাবিলা করতে যাই তার জীবনকালে ব্যবহৃত কোনও একটা বস্তু। খ্রিস্টান ধর্মমতে বিশ্বাসী অনেক ‘গোস্ট
হান্টার’ রা ছোটো ক্রশ ব্যবহার করে থাকেন এই কাজে। আত্মা শক্তির প্রভাবে ওই ‘ট্রিগার অবজেক্ট’ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নড়ে উঠে আত্মার
উপস্থিতি জানান দেয়।”
“ইন্টারেস্টিং!” সুমনের
মুখে চোখে বিস্ময়ের ছাপ। “আচ্ছা তুলো বা টেপ এগুলো কী কাজে লাগে। কোনোভাবে আহত হলে
ব্যান্ডেজ করার জন্য?”
প্রশ্নটা শুনে মিস্টার নাগ
হাসলেন, “আরে না না। তবে দরকার পড়লে সেটাও হয়ে যাবে ওই দিয়ে। দেখুন, তদন্তের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বা জরুরি একটা বিষয় হলো, যে ঘরে আপনি কাজ করবেন সেই ঘরটা চারিদিক থেকে সুরক্ষার বাতাবরণে ঘিরে ফেলা। এখানে সুরক্ষা মানে কিন্তু নিরাপত্তা নয়। এর জন্যই সাধারণ তুলো এবং টেপ কাজে লাগানো হয়। যে ঘরে তদন্ত হবে সেখানের সূক্ষ্ম হাওয়া চলাচলের পথ
বন্ধ করতে এদের প্রয়োজন। এইরকম একটা হাওয়া চলাচলবিহীন সুরক্ষিত ঘরে ‘ট্রিগার অবজেক্ট’কে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়।”
“মোমবাতি কী কাজে লাগে? টর্চ
তো আছেই। বিশেষ কোনও মোমবাতি নাকি?”
“না, সাধারণ মোমবাতি। এটাও আপনার সঙ্গে থাকা দরকার। কারণ মোমবাতির আলোর নড়াচড়াতেই আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ অনেকক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। তবে তদন্ত শুরুর আগে আপনাকে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যেখানে আপনি কাজ করছেন সেখানে সূক্ষ্ম হাওয়া চলাচলের পথ যেন বন্ধ হয়। যেটা আগেই বললাম। ফলে মোমবাতির শিখা অকারণে নড়বে না।
হাওয়ার কারণে নড়লে সেটা তদন্তে আত্মার উপস্থিতির ভুল প্রমাণ বলে নথিবদ্ধ হতে পারে। আর একটা কথা, তদন্ত শেষে কোথাও যেন জ্বলন্ত মোমবাতি থেকে না যায়। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”
সুমন ইতিবাচকভাবে মাথা নেড়ে
বললেন, “ঠিক, এটা কিন্তু মাথায় রাখবেন যারা আগামীদিনে ‘গোস্ট হান্টিং’ করার কথা
ভাবছেন। যাইহোক তালিকায় এবার দেখছি ময়দা। এটা কী কাজে লাগে?”
মিস্টার নাগ জবাব দিলেন, “বিশেষ
ধরণের কিছু নয় খুব সাধারণ ময়দা।”
“শ্রী মিস্টার নাগ, কথার
মাঝে কথা বলার জন্য। ময়দাই কেন, ট্যাল্কম পাওডার কেন নয়?”
“কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
আপনি পাওডার ব্যবহার করতেই পারেন। তবে সেটা ব্যয়সাপেক্ষ এবং ময়দার তুলনায় হাল্কা।
ফলে সামান্য হাওয়াতে উড়ে গিয়ে আপনার প্রমান নষ্ট করতে পারে।”
“প্রমাণ মানে! ভূতের
উপ্সথিতির প্রমাণ?” সুমন চোখ বড় বড় করে প্রশ্নটা করলেন।
“হ্যাঁ ভূত এবং ভূত নয় এমন
কিছুর প্রমান দিতে পারে। ট্রিগার অবজেক্ট কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে সাহায্য করে। সেটা
ভুতে নাকি অনয কিছুতে নিয়ে যাচ্ছে সেটাও ধরা পড়ে। শুধুমাত্র মেঝে নয় যেখানেই আত্মার উপস্থিতি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, যেমন টেবিলের উপরিভাগ, সেখানেও ময়দা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি সব বাড়ির মালিক হয়তো তদন্তের সময় ময়দা ছড়ানোর অনুমতি নাও দিতে পারেন, সেই জন্য পুরনো খবরের কাগজ সঙ্গে রাখবেন। সেটা পেতে তার ওপর ময়দা ছড়িয়ে দেওয়া যেতেই পারে।”
“সত্যি যে কাজই করি না কেন
আমাদের নানান দিকে খেয়াল রাখতেই হবে।”
মিস্টার নাগ একটু হাসলেন।
“পরের বস্তু ওয়াকি টকি,” সুমন বললেন, “ওয়াকি
টকি নেওয়ার দরকার পড়বে যদি দুই বা ততোধিক তদন্তকারি থাকেন। কিন্তু ওয়াকি টকিই কেন?
মোবাইল ফোন দিয়েও তো কাজ হতে পারে।”
আবার একটু হাসলেন মিস্টার
নাগ, “ মিস্টার রায়, আত্মা নিয়ে কাজ করলেও আমি সায়েন্স ফিকশন সিনেমা বা গল্পের
একজন পোকা বলতে পারেন। ওখানে একটা ব্যাপার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অ্যানালগ
সিস্টেম দিয়ে অনেক কাজ শজে প্রতিপক্ষের নজর এড়িয়ে করা যায়। এখানেও সেরকম বলতে
পারেন।”
“মানে আপনি কী এটাই বলতে
চাইছেন, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কে আত্মাদের আগমনের কারণে যোগাযোগে সমস্যা হয়?”
“একজ্যাক্টলি সেটাই হয়।
ব্যাটারির শক্তি শুষে নেওয়ার মতো, ওরা নেটওয়ার্ক স্পেকট্রামে অনায়াসেই বাধার
সৃষ্টি করতে পারে।”
“বুঝলাম। এবার থার্মোমিটার।
সিনেমা দেখা বা গল্প পড়ার সূত্রে এটা সঙ্গে কেন রাখা দরকার তার কারণ মনে হচ্ছে
বুঝতে পারছি।”
“বেশ ত বলুন না, আপনার কি
মনে হচ্ছে,” মিস্টার নাগ বললেন।
“ঘরের তাপমাত্রা নির্ণয় করার জন্য। যখন প্রবেশ করলাম তখন ঘরের তাপমাত্রা দেখা
দরকার। কারণ, আতামাদের উপস্থিতিতে নাকি ঘরের তাপমাত্রা কমে যায়।”
সুমন কথা থামিয়ে দেয়, “একদম
সঠিক। মাঝে মাঝেই এটা ‘চেক’ করে দেখার দরকার পড়ে। আমি নিজে সাধারণ ঘরে ব্যবহার করা থার্মোমিটার ব্যবহার করেছি। বর্তমানে এ কাজটা মোবাইল ফোন দিয়েই হয়ে যায়।”
“বেশ, বেশ। এবার তালিকায় যেটা
দেখছি সেটাকে বলা হয়েছে ই এম এফ মিটার।”
প্রশ্ন আসার আগেই মিস্টার
নাগ বলে উঠলেন, “ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড মিটার একজন গোস্ট হান্টারের কাছে থাকাটা খুব লাভজনক। এর নির্ণায়ক মাত্রার ওঠানামা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক এনার্জির প্রমাণ দেয়। সাইকোলজিস্ট এবং প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটরদের কাছে ওই ওঠানামা আত্মার উপস্থিতি রূপেই জানান দেয় অনেক ক্ষেত্রে। যখন কোন তদন্তকারী দল একটা ই এম এফ. মিটার ব্যবহার করে তখন যেকানে তদন্ত করছে সেখানকার সমস্ত রকম ইলেক্ট্রিসিটির উৎস, সেটা কেবল মাধ্যমেই হোক বা যে কোন ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসই হোক আগে থেকে জেনে রাখাতে হবে। কারণ এই ধরনের ডিভাইসগুলো ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড সৃষ্টি করে। ই এম এফ মিটারে মাত্রার ওঠানামা যখন ঘটতে থাকে তখন মাথায় রাখতে হবে তদন্তকারী কোন অবস্থানে আছে এবং আশেপাশে কোন ইলেকট্রিক তার অথবা যন্ত্রাদি আছে কিনা। সব ইলেক্ট্রিসিটির সূত্র এবং তাদের নির্ণায়ক মাত্রা নথিভুক্ত করার পরেও যদি
আলাদা ভাবে ২.৫ মিলিগাস
মাত্রার মিটার রিডিং পাওয়া যায় তাহলে সেটাকে ভৌতিক অস্তিত্বের প্রমাণ বলে ধরতে হবে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, আমি নিজে এই ইএম এফ মিটারের সাহায্যে আত্মার উপস্থিতিকে সবসময় মেনে নিতে পারি না। আমি নিজের ক্ষমতা এবং গোরক্ষনাথ মশাইয়ের উপর বেশি ভরসা
রাখি।”
সুমন ইতিবাচকভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “বুঝলাম।”
মিস্টার নাগ বললেন, ‘এর
পরের বস্তু সম্ভবত পেন্ডুলাম?”
“হ্যাঁ তারপর আছে ডাউসিং রড।”
“কিছু গোস্ট হান্টার ডাঊসিং রড এবং পেন্ডুলাম সাথে রাখায় বিশ্বাসী। তারা মনে করেন এই দুটো যন্ত্র ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক এনার্জি যা কোন আত্মার উপস্থিতিতে সৃষ্টি হয় তাকে অনুমান করতে সক্ষম। পেন্ডুলাম হল একটা দড়িতে বাঁধা ছোট্ট ওজনের বস্তু। যা কাঠ বা ধাতু দিয়ে বানানো হয়। এই বস্তুটার ছবি টিনটিন কমিক্সে প্রফেসর ক্যালকুলাসের হাতে
দেখা যায়।”
“তার মানে আপনি কমিক্স
পড়েন?” সুমন অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন।
“আচ্ছা, আতাম নিয়ে কাজ করি
বলে কি আমি মানুষ নই মিস্টার রায়?”
সুমন অপ্রস্তুতের ভঙ্গীতে
দু হাত জড়ো করে বলেন, “আরে না না, আমি সেভাবে বলতে-”
“আরে, অত ভাবার কিছু নেই।
আমি একটু মজা করছিলাম। এক ঘেয়ে বকর বকর আপনার শ্রোতা দর্শকদের যাতে বোর না করে তার
চেষ্টা আর কি। যাইহোক, আমি নিজে পছন্দ করি ৭ বা ৮ ইঞ্চির হালকা চেনের সঙ্গে বাঁধা ছোট্ট কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল। চেনের এক প্রান্ত ধরে পেন্ডুলামকে সোজা ঝুলাতে হয়। প্রথম অবস্থায় পেন্ডুলাম যেন একদম স্থির থাকে। তারপর এর দুলুনি অনুসারে হ্যাঁ এবং না উত্তরের নির্ধারণ করতে হয়। উত্তর জানাতে ওটা কখনও ‘ক্লকওয়াইজ’ আবার কখনও ‘অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ’ দিকে দোল খেয়ে উত্তর বুঝিয়ে দেয়। কখনও পাশাপাশি আবার কখনও সামনে-পেছনেও দোলে। এটা যিনি হাতে ধরে ব্যবহার করছেন তার ব্যবহার পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ মানুষ থেকে মানুষের ক্ষেত্রে এর উত্তর প্রদান পদ্ধতি বদল হয়। একবার আপনি যদি নিজের পেন্ডুলামের হ্যাঁ এবং না এর দিকটা চিহ্নিত করে নিতে পারেন, তাহলে পেন্ডুলামের সাহায্যে আপনি অনেক প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পেয়ে যাবেন। এর সাহায্যে আপনি সাইকিক ক্ষমতাসম্পন্ন এলাকার খবরও সংগ্রহ করতে পারবেন। এইরকম কোন শক্তি সম্পন্ন এলাকায় পৌঁছালে পেন্ডুলাম খুব জোরে জোরে দুলবে অথবা লাট্টুর মতো ঘুরপাক খাবে। এর মাত্রা আরও বেড়ে যাবে আপনি যত সেই সাইকিক এনার্জি ক্ষেত্র অথবা আত্মাটির কাছে পৌঁছাবেন। সব তদন্তকারীরাই যে পেন্ডুলাম ব্যবহার করে তা নয়। তবে তদন্ত ক্ষেত্রে প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনে এই বস্তুটি বেশ আকর্ষণীয় একটি বিষয়।”
“আমার দর্শক শ্রোতাদের মনে
কী ভাবনা কাজ করছে জানি না, তবে আমি কালকেই একটা পেন্ডুলাম বানিয়ে নেব নিজের জন্য।
দেখব আমার বাড়ির আশেপাশে কোথাও ওরকম কোনও এলাকা আছে কিনা।”
সুমনের কথা শুনে হাসলেন
ভূততত্ত্ববিদ। “এবার বলি ডাউসিং রডের কথা।
এর ব্যবহার অনেক বছর ধরেই চলে আসছে এক বিশেষ কাজের জন্য। ওয়াই আকৃতির এই বস্তু দিয়ে একদা ভূগর্ভস্থ জলের উৎস খুঁজে বার করা হত। এখনকার দিনে মোটা তার দিয়ে যা বানানো এল আকৃতির এই রড ব্যবহার করা হয়। যার তলার অংশটা হয় খুব ছোট এবং উচ্চতায় বেশ লম্বা। দুহাতে একটা করে রড ধরা হয়। লম্বা অংশটাকে সামনের দিকে সোজা করে রেখে ছোট অংশটাকে ধরে থাকতে হয়। এরপর
তদন্তকারী হাঁটতে শুরু করেন। যদি সাইকিক অ্যাক্টিভিটি ওই এলাকায় থাকে তাহলে রডগুলো নিজে নিজে নড়তে শুরু করে এবং লম্বা অংশ একে অপরকে আড়াআড়িভাবে পার করে যায়। সেটাকে ‘প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটি’র প্রমাণ বলে ধরা হয়। তবে এক্ষেত্রেও আগে থেকে খোঁজ নিতে হবে ওই এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলের উৎস বা অন্য কোনও রকম জলের স্রোত মাটির নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কিনা। সাধারণত দেখা গেছে অনেক ‘প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটি’র জায়গা বলে পরিচিত স্থানে মাটির তলা দিয়ে এরকম জল বয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তদন্তকারীরা যদি এই ধরনের খবরগুলো জানতে না পারেন তাহলে তারা যে তথ্য সংগ্রহ করবেন সেটা ভ্রান্ত তথ্য হবে। অর্থাৎ আগে থেকে রিসার্চেরও প্রয়োজন থাকছে। কিছুটা সময় নষ্ট করে এদিকে ওদিকে ঘুরে সেই জলস্রোতের পথ খুঁজতে হবে। যদি না করা হয় তাহলে ওই জলের সূত্রে ভুতের ভুল প্রমাণ মানুষের সামনে পেশ হতে পারে।”
“কী কান্ড! ভূগর্ভস্থ জল,
ভূতের ভুমিকায়! এবার বলুন টেপরেকর্ডার কি কাজে লাগে?” সঞ্চালক জানতে চান।
“মিস্টার রায় টেপরেকর্ডার অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিস। এক্ষেত্রেও মোবাইল ফোন ওই যন্ত্রের ভার বওয়ার
ধাক্কাটা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। একটা সময়ে অনেককেই দেখেছি নানা ধরণের শব্দ রেকর্ড করে রাখার জন্য, যাতে পরে যাচিয়ে দেখতে পারা যায়, ওই
বস্তুটাকে বয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। ওই সব শব্দ অনেক প্রমাণ পরিবেশন করতে সক্ষম। আজ অবধি অনেক মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া এরকম একাধিক চমকপ্রদ শব্দ রেকর্ড করে শুনিয়েছেন। যাকে ‘ইলেকট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনন’ বলা হয়ে
থাকে। একাধিক মানুষের ধারণা বা বিশ্বাস ওগুলো নাকি আত্মাদের কথা বলার শব্দ।”
“আর আপনার?” সুমন প্রশ্ন
ছুঁড়ে দেন।
মিস্টার নাগ কপালে দুহাত
ছুঁইয়ে বলেন, “যার সহায় স্বয়ং গোরক্ষনাথ, তার ওসবে কী দরকার?”
সুমন বললেন, “আমরা তালিকার
সেকেন্ড লাস্ট বস্তুতে এসে গিয়েছি। ক্যামেরা। ওটা কি ভূতের ছবি তোলার জন্য?”
“সবার আগে বলি আত্মার ছবি
তলা যায় কিনা এ নিয়ে প্যারানরম্যাল অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যেই কিছু পরিমাণ মতবিরোধ
আছে। ফলে এর ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভালো লাগা না লাগার উপর নির্ভর করে। বলা হয়ে থাকে ক্যামেরার সাহায্যে মানুষ কেবলমাত্র ‘অর্ব’ বা আত্মাদের প্রাথমিক রূপ পরিগ্রহের ছবি তুলতে পারে। যাকে ব্রিটেনের আমার মতোই এক মিডিয়াম ডেভিড অ্যাকোরা
বলতেন ‘লাইফ লাইট’। যে ছবি তোলার জন্য উনি ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।”
“আচ্ছা মিস্টার নাগ
ক্যামেরাটা তদন্ত কারী নিজের কাছেই রাখবে, মানে গলায় ঝুলিয়ে অপেক্ষা করবে ভূতের
ছবি তোলার জন্য?”
“মোটেই না। কিছু নড়া চড়া
করলেই ছবি উঠবে এমন সেন্সর ক্যামেরা সংগ্রহ করা যদি সম্ভব না হয় তা হলে ট্রাইপড সহ
একটা ভিডিও ক্যামেরা থাকাটা তদন্তকারীর
জন্য অত্যন্ত জরুরী। যে ঘরে আত্মার উপস্থিতির তথ্য জোগাড় করার জন্য তদন্তকারী যাবে সেখানে কোনও এক কোনে স্থায়ীভাবে ক্যামেরাটিকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে তার সাহায্যে ভাসতে থাকা ‘অর্ব’ বা ‘এক্টোপ্লাজম’ অথবা খুব বিরল ব্যাপার রূপে পরিচিত, জিনিসপত্র বা অন্য কিছুর নড়াচড়ার ছবি তুলতে পারা যায়। যদি দুটো বা তিনটে ভিডিও ক্যামেরা ঘরের বিভিন্ন স্থানে রাখা যায় তাহলে পুরো ঘরটার ছবি দেখানো সম্ভব। কারণ এর ফলে ঘরের যেকোনো প্রান্তে কোনোরকম নড়াচড়ার ঘটনা ঘটলেই সেটা ক্যামেরায় নথিভুক্ত হবে এবং যার সাহায্যে প্রমাণ করা যাবে কোনোরকম মানুষ নির্মিত ঘটনা এখানে দেখানো হচ্ছে না। একটা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললে অনেক ক্ষেত্রেই এরকম প্রশ্ন ওঠে। বলা হয় কেউ হয়তো ওই নড়াচড়াগুলো ঘটাচ্ছে। আর এই ‘কেউ হয়তো’টা নিশ্চিতভাবেই একজন মানুষকেই ইঙ্গিত করে।”
“ অনেক ধন্যবাদ মিস্টার
নাগ, এভাবে বুঝিয়ে বলার জন্য। এবার আমরা তালিকার শেষ ‘আইটেম’ মানুষের সেরা বন্ধু কুকুর নিয়ে কথা বলব,” সঞ্চালক বললেন।
“যদিও তালিকা অনুসারে ওটাই
শেষ, তবুও আর একটা থেকে যায়। সেটা আমার মতো কোনও মানুষ। আসলে প্যারানরম্যাল
ইনভেস্টিগেশনের অনেক দলই তাদের প্রয়োজনীয় বস্তুর তালিকায় আমাকেও সংযুক্ত করে নেন।
যতই হোক যে মানুষ সরাসরি আত্মাদের দেখতে পায় তাকে সঙ্গে রাখলে লাভ বই ক্ষতি নেই,”
কথাটা বলেই বেশ জোরেই হেসে উঠলেন ভূততত্ত্ববিদ কেশব নাগ।”
সুমনও রসিকতাটা অনুভব করে
হাসিতে যোগ দিল।
“মিস্টার রায় কুকুর কিন্তু প্যারানরমাল তদন্তের সময়ে
সত্যিই সেরা বন্ধু তথা সরঞ্জাম হতে পারে।”
সুমন বললেন, “মিস্টার নাগ
আমার নিজেরই কুকুর আছে, তাই ওদের ঠিক কীভাবে আপনারা ব্যবহার করেন একটু যদি খুলে
বলেন ভালো হয়।”
“দেখুন, প্রকৃতি অনুসারে সব প্রাণীই সাইকিক শক্তির অধিকারী। আমরা অনেক সময় এর প্রমাণ পাই। পোষা কুকুর বা বিড়াল আগে থেকেই বুঝতে পারে কখন তার মালিক কখন সদর দরজার কাছে এসে উপস্থিত হবে।”
“ঠিক বলেছেন, আমি অনেকবার অনেক মানুষের কাছ থেকে শুনেছি যে, তাদের প্রিয় পোষা কুকুর বা বিড়াল সবসময় বুঝতে পেরে গেছে কখন তারা বাড়ি ফিরে আসবে। আমার নিজেরই এরকম অভিজ্ঞতা আছে।”
মিস্টার নাগ বললেন, “এমনকি যদি তারা নির্দিষ্ট সময়ে নাও ফেরেন তবুও তারা আগমনের সময়টা ঠিক বুঝতে পেরেছে। আমার এক বন্ধু আমাকে অনেকবার বলেছে যে, তাদের কুকুরটা তাঁর রান্নাঘরের দরজার সামনে দিয়ে পায়চারী করতে শুরু করে দেয় যে কোনও মুহূর্তে তার বাড়ি ফেরার বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকে। তারপর দরজার কাছে গিয়ে বসে থাকে।”
সুমন প্রশ্ন করেন, “যতদূর জেনেছি আপনার
নিজেরও পোষা কুকুর আছে বা ছিল। আপনার এরকম কোনও অভিজ্ঞতা নেই?”
“অবশ্যই আছে। এখন যেটা আছে তার আগেও আমার
একটা কুকুর ছিল। সেটার
গতিবিধি দেখে মার্থার ফিরে আসার সময়টা অনুমান করতে পারতাম। ও ফিরে আসার কিছু সময় আগে থেকেই জানলার কাছে চলে গিয়ে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে থাকত। ওকে নিয়ে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। সেটার কথা আপনাকে
একদিন বলব।”
“ওরা কি সত্যিই মৃত প্রানীর
উপস্থিতি অনুভব করে মিস্টার নাগ?”
“দেখুন, অনেক গল্প শোনা যায় যেখানে কোনও প্রাণী তার মৃত মালিকের উপস্থিতি অনুভব করে । এরকমও দেখা গেছে যে, পাহারাদার কুকুর অনেক সময় অনেক জায়গায় প্রবেশ করতে চায় না। বিদেশের একটা ঘটনা বলি। সেন্ট জন সেন্টার, লিভারপুলের কাছে এক সিকিউরিটি গার্ড তার কুকুর নিয়ে প্রত্যহ পাহারা দিত। বড় কালো রঙের জার্মান শেফার্ড। নাম সেবার। যে বিখ্যাত ছিল তার অকুতোভয় মানসিকতার জন্য। কোন অচেনা মানুষকে দেখতে পেলেই কোন রকম চিন্তা না করেই তার দিকে এগিয়ে যেত। কিন্তু সেই কুকুরটাই শপিং-মল এলাকার একটা বিশেষ জায়গায় কিছুতেই যেতে চাইত না। চিৎকার করে গায়ের জোরে রাগ দেখিয়ে সে ওখানে যেতে না চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করত। আসলে সেই জায়গাটা ছিল একটা দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনার স্থান। যখন ওই শপিং-মল তৈরি হচ্ছিল একজন অল্প বয়সী যুবক উপর থেকে পড়ে গিয়ে ওখানে মারা যায়। তার আত্মা ওখানেই অবস্থান করে আছে। এর থেকেই আমি ভালোভাবে বুঝতে পারি যে, একজন সাইকিক তদন্তকারী বা প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর এর কাছে কুকুর হল সবচেয়ে সেরা সরঞ্জাম।”
“সব কুকুরই কি এ কাজ করতে
পারে?”
“ক্ষমতা মনে হয় সবার থাকে। কিছু কিছু কুকুর ভয় পাওয়ার মাধ্যমেই আত্মার উপস্থিতি বুঝিয়ে দিতে পারে। আবার কিছু কিছু কুকুর আত্মার উপস্থিতি বুঝতে পারলে নিজের লেজ নাড়তে থাকে কোনও একটা দিকে তাকিয়ে থাকে। যেদিকে হয়তো আপনি কিছুই দেখতে পাবেন না। কিন্তু সে কিছু একটা দেখতে বা বুঝতে পারে। আবার কিছু কুকুর শুধু শুধু চিৎকার করে সামনে কিছু না থাকা সত্বেও সেদিকে বারবার ছুটে চলে যায়। এমন কোনও জায়গায় যেখানে যাওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই। তাই যদি আপনার পোষা কুকুর থাকে এরকম তদন্ত করতে গেলে অবশ্যই তাকে সঙ্গে নেবেন। শুধুমাত্র আত্মার উপস্থিতি বোঝার জন্য নয়। এরকম একটা বন্ধু যদি আপনার সাথে থাকে তাহলে একাকী রাত কাটাতে খুব একটা অসুবিধা হয় না।”
" তাহলে সম্মানীয় দর্শক শ্রোতাগন আশা রাখছি আজকের এই
সাক্ষাৎকার আপনাদের ভালো লাগল। প্যারা নরম্যাল ইনভেস্টিগেটর হওয়ার ভাবনা নিয়ে আত্মার
খোঁজ করতে
যাওয়ার জন্য যে যে সাজেশন উনি দিলেন তা আপনারা মন দিয়ে শুনলেন। সব শেষে পুনরায় মিস্টার নাগের কাছেই ফিরে যাব, একেবারে
শেষে উনি আগামীদিনের গোস্ট হান্টারদের জন্য কি বলতে চান সেটা জেনে আমাদের অনুষ্ঠান
শেষ করব।”
মিস্টার নাগ কিছুক্ষণ চুপ
করে থেকে বললেন, “ যারা
এ পথে আসতে চাইছেন, আমি ধরে নিতে পারি যে, তারা সকলেই বুদ্ধিমান মানুষ। আমি যা বলছি সেটাই যে করতে হবে এমন কোনও মানে নেই। আপনি নিজে যেভাবে কাজ করতে সুবিধা বোধ করবেন সেটাই করবেন। বর্তমান প্রযূক্তির সহায়তায়
এমন অনেক জিনিস বানান হয়েছে যা আমাদের কাজে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে ভুল
ধারণা করে নেওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। যেমন, ইনফ্রা-রেড রশ্মি বের হয় এমন যন্ত্র। যার সাহায্যে একটা অ্যালার্ম বেজে ওঠে যখন কোনও অযাচিত মানুষের আগমন ঘটে। একইভাবে আত্মার উপস্থিতিতেও হয়তো এই জিনিস কাজ করতে পারে। যাইহোক
মাথা ঠান্ডা রাখবেন। উত্তেজিত হবেন না। আশা করছি তাহলেই গোস্ট হান্টিং করার সময় আপনি সন্তোষজনক ফল পাবেন। নমস্কার।“
০০০০০
মিস্টার নাগের অভিজ্ঞতা
জানার কেমন যেন একটা নেশা ধরে গিয়েছিল সুমনের। এরপর যখন তার সঙ্গে ভূততত্ত্ববিদের
দেখা হয় উনি জানতে চেয়েছিলেন, কত রকমের আত্মা হতে পারে। সোজা কথায় ভুতেদের প্রকার
ভেদ। না, মিস্টার নাগ ওকে আমাদের চেনা জানা , মামদো, ব্রহ্ম দত্যি বা শাঁকচুন্নি
জাতীয় কিছুর গল্প বলেননি। কাদের কথা বলেছিলেন উনি? জানতে আগ্রহ থাকলে অনুগ্রহ করে
জানান। ফিরে আসব, এই উপন্যাস সম ধারাবাহিকের চতুর্থ আখ্যানে।
No comments:
Post a Comment