Search This Blog

Wednesday, August 7, 2024

দিকশূন্যপুরের মাত্রা - প্রতিম দাস

 



দিকশূন্যপুরের মাত্রা

প্রতিম দাস

আমাদের এই মফস্বল শহরটায় দু দিন দোল হয়। আগে খুব মাতামাতি হতো। এখন প্রথম দিনটা নিতান্তই নিস্তরঙ্গ হয়ে কাটে। আমরা কয়েকজন বন্ধু রাস্তার মোড়ে বুদ্ধুদার গ্যারেজে বছর কয়েক ধরে আড্ডা মেরেই কাটিয়ে দিই দিনটা। সেখানেই আমার অনুবাদ করা সদ্য প্রকাশিত লাভক্র্যাফট অমনিবাসটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। দেখলাম পি সি মানে অবসর প্রাপ্ত গোয়েন্দা প্রবাহ চাকলাদার এসে গেছেন। উনি বইটা দেখে বললেন, ‘বাহ এটা একটা ভালো কাজ করেছিস প্রতিম। কিন্তু এটা কী জানিস, ওই লোকটা যে সমস্ত অন্ধকার নক্ষত্র জগতের সত্তাদের কথা লিখেছিলেন তারা কিন্তু একেবারে মিথ্যে নয়।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে! কী বলতে চাইছেন আপনি?
‘তোদের বলেছিলাম কিনা জানি না প্রাইভেট এজেন্সিতে কাজ করার আগে দেড় বছর পুলিসের চাকরীও করেছিলাম। কোথায়? না সেটা বলতে পারব না। সরকারী বিধি নিষেধ আছে। জায়গাটা এই বাংলাতেই। আর নাম ধরে নে দিকশূন্যপুর। সেখানেই একবছরের মাথায় এমন এক অভিজ্ঞতা হয় যে, আমি তার ছ’মাস পরেই চাকরী থেকে ইস্তফা দিই। দ্যাখ,’ হাতটা এগিয়ে দিলেন, ‘আমার গায়ের রোম এখনো খাড়া হয়ে যায় সে রাতের কথা ভাবলে?’
ব্যাস, রোমাঞ্চকর গল্পের গন্ধ পেতেই সবাই চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম প্রবাহদাকে ঘিরে।
উনি শুরু করলেন –

দিকশূন্যপুরের অফিসার ইন চার্জ জ্যোতিষ চট্টরাজ আমায় বলেছিলেন, 'জানো প্রবাহ, আমি প্রায়ই মাত্রা সম্পর্কে অবাক হয়ে ভাবি।'
'মাত্রা?' আমি ততোধিক অবাক স্বরে বলে উঠেছিলাম।
'হ্যাঁ রে বাবা, মাত্রা, ডাইমেনশন। কল্পবিজ্ঞান কথাসাহিত্যিকরা সবসময় মাত্রা সম্পর্কে কথা বলেন। জানো তো নাকি?’ আমি উত্তর দেওয়ার আগেই উনি আরও একটা প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা প্রবাহ, তুমি কখনও বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনী পড়েছ?'
'না,' উত্তর দিলাম। প্রয়োজনের বাইরে সাহিত্য চর্চা বা বই পড়া তেমন আমার হয়নি সেই সময়। পরে অবশ্য অভ্যাস অনেক বদলেছে। পেশার কারণেই পড়তে হয়েছে একাধিক রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দাকাহিনী।
'লাভক্র্যাফটের কোনও লেখা পড়েছ প্রবাহ?'
'এই নামটাই কখনও শুনিনি,' উত্তর দিয়েছিলাম আমি। ওই সময় শেষ যে গল্পের বইটা পড়েছিলাম সেটাও শুধু সময় কাটানোর তাগিদে। তার ওপর আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগের সময়টায় এই বাংলায় লাভক্র্যাফটের নাম খুব বেশি মানুষ জানতোই না। প্রতিম এটা ভালো বুঝবে। কী আমি ঠিক বলছি তো?
উত্তর দিলাম, ‘একদম দাদা। অদ্রীশ বর্ধন চার্লস ডেক্সটারের অনুবাদ করার আগে হাতে গোনা কিছু মানুষ লাভক্র্যাফটের নাম জানত।’
‘তাহলেই বোঝো। তবে জ্যোতিষদা এসব নিয়ে একটু পড়াশোনা করতেন। শান্ত নিরিবিলি থানা ছিল আমাদের। কাজের চাপ তেমন ছিল না। প্রায়ই দেখতাম ইংরেজি পেপারব্যাক নাকের সামনে ধরে বসে আছেন চেয়ারে। যাই হোক সেদিন উনি বললেন -'বুঝলাম। বেশ তাহলে শোনো। এই লাভক্র্যাফট ভদ্রলোক অনেক কাহিনিতেই ক্ষেত্রে এই মাত্রা বা ডাইমেনশন ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে গুরুত্ব দিতেন। নানান মাত্রা বা ডাইমেনশন অবস্থান করে থাকে আমাদের খুব কাছাকাছি। আশেপাশেই বলা যায়। তার মতে কিছু কিছু মাত্রায় এমন সব দানবেরা থাকে যাদের একবার দেখলেই মানুষ পাগল হয়ে যাবে। অযৌক্তিক উল্টোপাল্টা ভাবনা অবশ্যই। কিন্তু এই ভাবনাটাই বদলে যাবে, যখনই একজন মানুষ ভিন্ন মাত্রা দ্বারা দলিতমথিত হবে।‘
অবাক বিস্ফারিত চোখেই সেদিন তাকিয়ে ছিলাম জ্যোতিষদার দিকে। সম্ভবত সেটা দেখেই উনি বললেন, ‘পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে তাই না? বুঝলে প্রবাহ, আমি মাঝে এরকম অবস্থাটা নিজে ভাবার চেষ্টা করি - যখন রাত গভীর হয়, শান্ত নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় চারদিক, এই ঠিক এখনকার মতো – যখন আমাদের মনে হয় এই পৃথিবীর সব কিছু সুন্দর এবং স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে যদি সেটা না হয়, তাহলে কি হবে?’
‘বাস্তবে যদি সেটা না হয় মানে?’ প্রশ্ন করেছিলাম।
‘মানে ধরো, আসলেই যদি এই গোটা পৃথিবীটা একটা বাতাস ভরা বড় চামড়ার বলের মতো হয়? এমন একটা বল যেখানে কিছু জায়গার চামড়া চেপে বসে নেমে গেছে নিচের দিকে। আর নেমে যাওয়া সেই অংশটা হারিয়ে গেছে কোনও সীমাহীন অতলে। যে অতলে অজ্ঞাত সত্তাদের বসবাস। এই অতল পৃথিবীর অভ্যন্তর নয় কিন্তু। এ এমন এক জায়গা যেখানে বাধ্যবাধকতার বন্ধন বা সীমানা খুব ক্ষীণ। সেই চেপে বসে যাওয়া জায়গাতেই যদি আমাদের পা পড়ে, তাহলে কি হবে? তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?'
উত্তরে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ কিছুটা।’ আসলে অফিসার ইন চার্জ বলে কথা। তো তার কথা বুঝতে পারছি না বলার মতো সাহস তখনও আমার হয়নি। সত্যি বলতে ওই মুহূর্তে কিছুই মাথায় ঢোকেনি সেদিন।
'বেশ। ওই রকম জায়গায় যদি আমাদের পা পড়ে তাহলে আমরা পৌছে যাব ভিন্ন মাত্রার জগতে। তা এইরকম সব কথা ভাবতে ভাবতেই, বুঝলে আমার ধারণা হয়েছে, এই দিকশূন্যপুর ঠিক সেইরকম একটা জায়গা যেখানকার মাত্রাটা একটু আলাদা। এখানেও এমন জায়গা আছে যা কোন অজ্ঞাত অজানার জগতে নিয়ে যায়। শুনতে বোকা বোকা লাগলেও, আমি সত্যিই এরকম ভাবি। একটু বেশিই কল্পনাপ্রসূত মনে হচ্ছে, তাই না? আমার মাও সবসময় এটাই বলেন, বুঝলে কিনা। '
'সত্যিই মাসিমা এরকম ভাবেন আপনার সম্বন্ধে?'
'হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে বাড়িতে গিয়ে জেনে এসো। আচ্ছা তুমি কি আন্দাজ করতে পারো, আমি আর কী কী ভাবি? '
'না স্যার, ইয়ে দাদা - কোনও ক্লু নেই আমার কাছে।'
'আমার মনে হয় ওই যে পুরনো আরমেনিয়ান গির্জাটা আছে না, ওটার বেশিরভাগ এলাকাটাই ঠিকঠাক আছে – মানে ওখানে মাত্রা একেবারে স্বাভাবিক । যতটা মোটা হলে অন্য জগতে যাওয়া যায় না, ঠিক ততটা। এরপর ধরা যাক পাম্প হাঊস আর স্বাধীনবাবুর মুরগী খামারের এলাকা। ওই দুটো জায়গা দিকশুন্যপুরের দুই সীমান্ত। উভয় জায়গাতেই আমার চেনা মানুষ আছে। তারা আমার আগ্রহ সম্পর্কে জানে। বুঝতেই পারছ আশা করি, কী বলতে চাইছি - সেই সব বিষয়, যা কোনওভাবেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না। আসলে উদ্ভট কিছু গালগল্প ওখানেও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু এই সব উদ্ভট গল্প বানিয়ে ওইসব মানুষগুলোর কী লাভ হয় তাও তো বুঝি না।‘
সত্যি বলতে জ্যোতিষদা ঠিক কী বলতে চাইছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

তারপরেই উনি বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা প্রবাহ, তুমি কী কিছু আন্দাজ করতে পারছ, একটু আগে ওই যে মেয়েটা এখানে এসেছিল, সে কেন সেই সব কিছুর কথা বলে গেল যা সে আদপেই করেনি? বানিয়ে বানিয়ে এসব বলার কোনও উদ্দেশ্য তো থাকতে হবে! যদি সত্যি নাই হবে তাহলে কেন বলল?’

'ইয়ে মানে...'
জ্যোতিষদা আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিয়ে ড্রয়ার থেকে দেশলাই বার করে ওটাকে জ্বালিয়ে কিছুটা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, 'বয়স ছাব্বিশ, ভালোই সুন্দরী, রোহনপুরের সার্কিট হাউসে উঠেছেন। তার মানে বেশ কেউকেটা। স্বামী তরুণ আইনজীবী। লালবাগ না কোথায় যেন ভালই রোজগারপাতি করেন। যে কারণে বাচ্চাদের দেখাশোনা করার আয়া সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন। এরকম একজন মহিলা, হঠাৎ করে এসে কেন সেই সব কথা আমাদের বললেন, যা কেবলমাত্র ভুতুড়ে উদ্ভট ফিল্মে দেখতে পাওয়া যায়?’

'আমি জানি না,' আমি উত্তর দিলাম। 'তবে কিছু থাকলেও থাকতে -'

'এই, ঠিক এই কথাটাই আমিও নিজেকে বলি' - জ্যোতিষদা কথার ভেতরে ঢুকে বলতে শুরু করে দিলেন, 'কিন্তু যদি সত্যিই এরকম মাত্রা বদলকারী কোনও স্থান থাকে এখানে থাকে, তাহলে সেটার সূত্রে কিছু হওয়া উচিত পাম্প হাউস আর স্বাধীনবাবুর মুরগী খামারের এলাকায় । কিন্তু সেখানে কিছুই ঘটে না। যা ঘটে সব এই দিকশূন্যপুরের ভিতর। আসলে যেমনটা বললাম ঠিক সেরকম ক্ষীণ মাত্রা বিশিষ্ট জায়গা এই দিকশূন্যপুর। সেটা জানি বলেই, আমি নিজেকে প্রশ্ন করি - এরকম একটা দিন কী আসবে না, যেদিন আমাদের আর ওই অন্য মাত্রার মাঝের চামড়ার আস্তরণটা ধুয়ে মুছে ঘষে সাফ হয়ে যাবে? এরকম কোনও দিন কী আসবে না যেদিন ওই মেয়েটা সত্যি ঘটনা বলে যা শুনিয়ে গেল তার অর্ধেকটা অন্তত বাস্তব হবে? সেই দিনটা দেখার জন্যই তো আমি এই থানা ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। প্রমোশন পেলেও নিই না। ’

আমি চুপ করেই থেকেছিলাম। সেদিন মনে হয়েছিল জ্যোতিষদার মাথাটা গাদা গাদা বিদেশি ফিকশন পড়ে একেবারেই গিয়েছে। তারপর ওই লাভক্র্যাফট না কী যেন একটা নাম বলল । তার ছাতার মাথা লেখাগুলো পড়েই মাথাটা বিগড়েছে।

'প্রবাহ পিছনের ঘরে একটা লোহার র্যাক আছে। ওখানকার ফাইলগুলো পড়ে দেখো,' জ্যোতিষদা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন। তারপর হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতেই কট কট করে কিছু শব্দ শোনা গেল। 'আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। তাজা বাতাস চাইছে ফুসফুস।'

কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলেন উনি। হতভম্বের মতো লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে গেলাম।
নিশ্চিতভাবেই কিছুটা ছিটগ্রস্থ। প্রায় তেরো বছর ধরে এই থানায় আছেন। বদলীর সুযোগ আসা সত্বেও নেননি। একটু বেশি মাত্রায় সাহসীও। খুব সহজে এধরনের মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না এসব এলাকায়। জ্যোতিষদার নোটবুকটা তুলে নিয়ে পাতা উল্টে একটু আগে আসা মেয়েটা যা বলে গেল সেটাই এবার পড়তে শুরু করলাম।”

প্রবাহদা এখানে একটু থামলেন। বললেন, “কী ব্যাপার রে আজ দোলের দিনে কিছু খাবারদাবারের ব্যবস্থা এবার করিসনি নাকি?”
বুদ্ধুদার গলা পাওয়া গেল, “আরে তুমি গল্প চালিয়ে যাও। এদিকে প্লেট সাজাচ্ছি।”
“বেশ বেশ। সেদিন রাত দশটা বাইশ মিনিটে মেয়েটার আসা এবং প্রায় দুটো নাগাদ একটানা বকবক করে চলে যাওয়ার পর জ্যোতিষদা তার নোটবুক বন্ধ করেন। ওটার প্রায় পুরোটাই মেয়েটার আজব গজব কাহিনীতে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। কী লেখা হয়েছিল সেটা বলার আগে মেয়েটা চলে যাওয়ার পর জ্যোতিষদার সাথে আমার আরও কিছু কথা হয়েছিল, সেগুলো বলা দরকার।'

মিসেস রায় বিদায় নিতেই একটা সিগারেট ধরিয়ে জ্যোতিষদা বললেন, ‘বুঝলে প্রবাহ, যা লেখা হলো সেই ব্যাপারটা দিনের আলোতে বসে পড়লে আজব বলেই মনে হবে।'

আমি বললাম, 'মেয়েটার মাথায় গন্ডগোল নেই তো?’ এমনভাবে বললাম নিজেরই কেমন যেন মনে হলো এতেই সব রহস্যর সমাধান হয়ে যাবে।

আমার কথা না শোনার ভান করেই কিনা কে জানে জ্যোতিষদা বললেন, 'জানি এই ফাইলটাও আরও অনেক ফাইলের নিচে চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু আমার অবাক লাগছে...'

আমি বললাম, ‘আপনি নিশ্চয় এটা বলতে চাইছেন না যে, ওই গল্পের কিছু কিছু অংশ আপনার সত্যি মনে হয়েছে? বাদ দিন তো! অন্য কিছুতে মন দিন! '

'আমি এরকম কিছু বললাম নাকি? না, না, সেটা মোটেই বলিনি। তবে তুমি এখানে নতুন এসেছ তাই...।'
আমি একটু সোজা হয়ে বসলাম। কেন আমাকে এরকম একটা জায়গায় পোস্টিং করা হয়েছে তখন তো বুঝতে পারিনি। এ জায়গা নিয়ে অনেক অদ্ভুত গল্প ছড়িয়ে আছে এটা এখানে আসার পরই শুনেছিলাম। সাধারণত এখানে নাকি কেউ আসতে চায় না। সেরকম একটা জায়গায় আমার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বয়সী জ্যোতিষদা কেন পড়ে আছেন তার উত্তর একটু আগে পেয়ে গিয়েছি। কিন্তু এই কথা চলাকালীন সময়ে জানা ছিল না আমার।
'স্যার, না মানে জ্যোতিষদা, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, মিসেস রায় সব মিথ্যা কথা বলে গেল, তবে... আমার কেন জানি না এটাও মনে হচ্ছে এই জায়গায় এরকম সব ঘটনা ঘটে বলেই কোথায় যেন শুনেছিলাম। কে যেন বলছিল সেদিন।'

'তাই নাকি, কীরকম একটু শুনি,' জ্যোতিষদাকে একটু বেশিই উৎসাহিত মনে হল। ‘এই তো! এরকম কিছুই তো শুনতে চাইছিলাম।' সিগারেটটা সম্ভবত ঠিক মতো ধরেনি। উজ্জ্বল লাল রঙের রেলওয়ে ছাপ দেশলাই বাক্স থেকে কাঠি বার করে সিগারেট আবার একবার ধরিয়ে কাঠিটাকে নিখুঁত লক্ষ্যে ছুঁড়ে দিলেন অ্যাশট্রেতে। তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে তার ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তার নিজের যৌবনকালের সুদর্শন দিনগুলি অনেক আগেই পার করে এসেছেন। মুখে এখন বলিরেখার গভীর ছাপ। নাকে দেখা দিচ্ছে শিরা উপশিরার মানচিত্র।
'তুমি নিশ্চিত এত দিনে ধরেই নিয়েছ দিকশূন্যপুর খুব শান্ত একটা জায়গা, তাই না?'

সত্যি বলতে প্রথম পোস্টিং এর জায়গা এত নিস্তেজ হবে ভাবতেই পারিনি। কথাটা মনে এলেও বলতে পারিনি।

'অত ভাবার কিছু নেই,' উনি বললেন, 'আমি জানি তুমি সেটাই মনে করো। তোমার ভাবনায় কোনও ভুল নেই। এই এলাকার মানুষজন বেশিরভাগ সময়েই রাত এগারোটার ভেতরেই ঘুমের জগতে চলে যায়। তবে স্বীকার করতে বাধ্য, এই জায়গায় অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। আমি এখানে যতদিন আছি, তার অর্ধেক সময় যদি তুমি টিকে থাকো, তাহলে তোমার নজরেও আসবে কিছু কিছু। এই রাজ্যের যেকোনো জায়গার তুলনায় এখানকার আপাত শান্ত এই ছয় বা আটটা ব্লকে অনেক অদ্ভুত কিছু ঘটে। এতেই অনেক কিছু বলা হয়ে যায়। আমি জানি। আমি এটা বিশ্বাস করি। এসব আমাকে আতঙ্কিত করে দেয়। অবশ্য আমার সাথে বোতল থাকলে আমি এতটা ভয় পাই না। বাদ দাও, তুমি একবার কনস্টেবল রাজেশের মুখটা মনে করো। সুযোগ পেলে জিজ্ঞাসা করে দেখো, কেন তাঁর চুল এই চল্লিশেই পেকে সব সাদা হয়ে গেছে? অথবা সুজনের কথাটা মনে করে দ্যাখো, মনে পড়ছে কী? সুজন, গ্রীষ্মকালে আত্মহত্যা করেছিল। খটখটে গা জ্বালানো প্রচণ্ড গরমের সময়। সেবারের... ' জ্যোতিষদাকে দেখে মনে হল কিছু একটা ভাবছেন। 'সেবারের গ্রীষ্মকালের আবহাওয়াটাই ছিল বেশ খারাপ। জঘন্য যাকে বলে। আমাদের মধ্যে অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিল যে তারা এটা সহ্যই করতে পারবে না।'

'কারা এরকম মনে করতে শুরু করেছিল?’ আমি জিজ্ঞাসা না করে পারিনি । বুঝতে পারছিলাম আমার মুখে একটা চাপা হাসি ফুটে উঠছে। যা স্বাভাবিক নয় কিন্তু কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। আসলে এই ছোট্ট থানায় সবেধন পাঁচজন মাত্র কর্মচারী। এরকম কথা বলার সময়, জ্যোতিষদা নিজেও ওই মেয়েটার মতো সব কিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। ব্যাপারটা বেশ কৌতুকজনক। সম্ভবত সবই পানীয়ের প্রভাব। আর ঠিক তখনই দেখতে পেলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন।

'আমার মনে হচ্ছে তুমি এটাই ভাবছ যে, আমি একটা মাথা পাগলা বুড়ো।’

'একেবারেই না, একদমই না,' ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে বলতে চেষ্টা করি আমি। যদিও ভেতরে ভেতরে হাসি ঘুলঘুলিয়ে উঠছিল।

'নাহ, বলতেই হবে তুমি ভালো ছেলে। তোমার যখন আমার মতো বয়েস হবে তখন এই স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছেই হবে না তোমার। যদি সত্যিই কিছু জানার ইচ্ছে থাকে, তাহলে সত্যি বলছি তুমি এখানেই থেকে যেতেই চাইবে না। আমার মতোই। কী মনে হয় তুমি থাকবে ততদিন? এরকম কিছু করার ইচ্ছে আছে নাকি? '

'হ্যাঁ,' উত্তর দিয়েছিলাম। মোটেই মিথ্যে বলিনি। রিম্পি অবশ্য চেয়েছিল পুলিশবাহিনী ছাড়া সে অন্য কোথাও, যেন আমি চাকরি করি। কোনও অফিসে হলে সবচেয়ে ভালো, হয়। তবুও আমি এতেই যোগ দিয়েছি। সাধারণ নিয়মিত অ্যাডভেঞ্চারহীন কর্মচারীদের কথা ভাবলেই আমার পেটের ভেতর গুরগুর করে ।

'আমিও এটাই ভেবেছিলাম,' উনি মুখের ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, 'তোমার মুখ দেখেই বোঝা যায় জেদ আছে। তুমি অনেক দূর যাবে, আর তখন এই পুরানো দিকশূন্যপুরকে ততটা বিরক্তিকর মনে হবে না । তবুও বলব, তুমি সব কিছু জানো না। এ এক অদ্ভুত জায়গা। সময় পেলে পুরোনো ফাইলপত্র একটু নেড়েচেড়ে দেখো। যার ভেতর বেশির ভাগই যদিও ওই থোড় বড়ি খাড়া কেস। অল্পবয়সী মেয়ে বা ছেলেরা বম্বের নায়ক বা নায়িকা হওয়ার লোভে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে ... স্বামী নিখোঁজ হয়ে গেছে, কেন তার উত্তর অভিযোগকারিনী স্ত্রীগুলোর দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেই বেশিরভাগ সময় বুঝতে পারবে... অজানা ব্যক্তি দ্বারা ঘরের চালে অগ্নিসংযোগ ... ব্যাগ বা পার্স ছিনতাই... এই সবই বেশি পাবে। কিন্তু এর মধ্যেই, তোমার রক্ত হিম করে দেওয়ার মতো গল্পও যথেষ্ট পাবে। যার ভেতর কিছু তোমার পেটের ভিতর প্রজাপতি উড়িয়ে দেবে।'

শেষ বাক্যটা যে জ্যোতিষদার পড়া ইংরেজি পেপারব্যাকের কোনও লাইনের আক্ষরিক অনুবাদ তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। জানতে চেয়েছিলাম, 'সত্যি নাকি?'
ইতিবাচক ভঙ্গীতে মাথা নাড়েন উনি। 'ওগুলোর ভেতর কিছু ঘটনা একেবারে একটু আগে ওই মিসেস রায় যা বলে গেল ঠিক সেরকম। উনি আর তার স্বামীকে কোনোদিনই দেখতে পাবেন না - আমার কথা মিলিয়ে নিও। বিশ্বাস করো বা না করো। সব সেই এক গল্প, বুঝলে কিনা? ফাইলগুলো ওখানেই আছে। ধুলো জমে গেছে ওগু্লোর ওপর। অন্যান্য আর পাঁচটা ফাইলের মতো বেশি নড়াচড়া করা হয় না। ভাল করে নেড়ে দেখো ওগুলো। মন দিয়ে পড়বে কেমন?'

কিছুই বললাম না, তবে ওগুলো পড়ার আগ্রহ তার ভেতর জমতে শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন রাতের পর আর ওগুলো পড়ার ইচ্ছেই জাগেনি।

“চল এবার আসল ঘটনায় ঢোকা যাক । কিন্তু তার আগে, কী রে বুদ্ধু প্লেট কই?”

খাওয়া দাওয়া সেরে চায়ের কাপ হাতে পুনরায় শুরু হল প্রবাহদার কাহিনী।

“জ্যোতিষদা যেভাবে লিখেছিলেন সেভাবেই বলার চেষ্টা করি বুঝলি। তাতে রসটা জমবে বেশি। অদ্ভুতভাবে নোট করেছিলেন, কখনও নিজের জবানী, আবার কখনও ওদের কথোপকথন। বেশ ইন্টারেস্টিং। ওই লেখা যে আমি কতবার পড়েছি। আমার বাড়িতে নোটবুকটার পুরো ফটোকপি রাখা আছে – যাকগে। একটু মন দিয়ে শুনবি, কারণ এবার আমিগুলো আর আমি নিজে নই সব জ্যোতিষদার বয়ান।

মেয়ে্টা - বা যুবতী মহিলা - মানে সঠিক অর্থে কী লিখব, পলিটিক্যালি কারেক্ট যাকে বলে আর কী [বর্তমানে এ সমস্ত ঠিকঠাক ভাবে না লিখলে আবার শোকজ করা হয়।]- দশটা বাইশ নাগাদ ধূমকেতুর মতো উপস্থিত হয়েছিলেন দরজার কাছে। মুখের চারদিকে ঝুলে ছিল ভেজা ভেজা সুতোর মতো চুলের গুচ্ছ। চোখ বিস্ফারিত। হাতে স্ট্র্যাপ ধরা অবস্থায় ঝুলছিল ছোট একটা ব্যাগ।

'রতন,' উনি প্রথম এই শব্দটাই বলেছিলেন। 'প্লিজ, আপনারা রতনকে খুঁজে বার করুন।'

আমি জানতে চেয়েছিলাম, 'কি হয়েছে ম্যাডাম? আসুন ভেতরে আসুন। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা তো করবই ।
মেয়েটা আমাদের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়েই ছিল। মনে হচ্ছিল ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
‘কী হলো ম্যাডাম? সন্দেহ হচ্ছে নাকি আপনার? বাদ দিন, তার আগে আপনি বলুন তো, রতন কে?'

'সে মারা গেছে,' মেয়েটা বলল। 'আমি জানি সে মরে গেছে।’ বলেই কেঁদে ফেলল এবং তারপরেই হাসতে শুরু করল - একেবারে খিল খিল করে হাসি। [একটুও বাড়িয়ে বলা হচ্ছে না এখানে।] ব্যাগটাকে রেখে দিলেন নিজের সামনে। দেখে অপ্রকৃতিস্থ বলেই মনে হল।

রাতের এই সময়টায় পুলিস স্টেশন মোটামুটি নির্জন থাকে। ঘরের আরেক পাশের টেবিলে বসে সেকেন্ড অফিসার দেবাশীষ গোস্বামী নির্বিকার ভঙ্গীতে বসে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে কিছু একটা শুনছিল। কিছুদিন আগেই কাস্টমসে ধরা পড়েছে ওটা। নিশ্চিত ইংরেজি গান শুনছে। দেখতে পেলাম প্রবাহ অ্যান্টি রুম থেকে বেরিয়ে আসছে।
আমি হাত নেড়ে প্রবাহ এবং দেবাশীষকে ইশারা করলাম। দেবাশীষ অবশ্য ইতিমধ্যেই মেয়েটার আধা-হিস্টিরিক্যাল কন্ঠস্বর শুনে ঘুরে তাকিয়েছিল।

এই দেবাশীষ লোকটা আবার পকেটমার ছিনতাইবাজদের হাতের আঙ্গুলগুলোকে পাটকাঠির মতো ভাঙতে খুব ভালবাসে। এই প্রায় আইনভাঙ্গা কাজ বিষয়ে তাকে কিছু বললেই, দেবাশীষ বলে, “আরে বাদ দাও, এরকম না করলে ও ব্যাটারা জব্দ হবে না।”

না এটা জ্যোতিষদার খাতায় লেখা ছিল না। তোদের জানালাম।

'রতন, তুমি কোথায় চলে গেলে!' মেয়েটা চেঁচিয়ে ওঠে। 'ওহ, প্লিজ, ওরা মনে হয় ওকে ধরে নিয়ে এতক্ষণ অনেকদূর চলে গেছে।'

'মিস -' প্রবাহ বলল।

'বাইরে কী হচ্ছে বলুন তো?' ফিসফিস করে বলল মেয়েটা । শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি অত্যন্ত দ্রুত। প্রায় হাঁফাচ্ছিল। বাম গালে আঁচড়ের মত দাগ। স্বাস্থ্য বেশ ভালোই – সাথেই একঢাল মেঘের মতো মাথা ভরা চুল। মুখশ্রীও যথেষ্ট সুন্দর। পরণের শাড়িটা বেশ দামী। জুতোর একটা হিল খুলে গেছে।

'বাইরে কী ঘটে চলেছে আপনারা কী জানেন?' মহিলা পুনরায় বলে উঠলেন । 'দানবেরা -'

‘প্রবাহ এক গ্লাস জল নিয়ে এসো তো! ’ বললাম। “একটু চা খাবেন নাকি?”

'রতন,' ফিসফিস করে বলল মেয়েটা। 'আমি জানি ও মারা গেছে।'

'বুঝলাম। শুনুন আমি এখানকার অফিসার ইন চার্জ। চিন্তা করবেন না আমরা আপনার সমস্যার সমাধান করে দেব।' কথাটা বলে নিয়ে আসা জলের গ্লাসটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম।

'এই যে ম্যাডাম, এটা খেয়ে নিন, ভাল লাগবে।'

'আমার পক্ষে এখন কিছুই খাওয়া সম্ভব না,' জানাল মেয়েটা। ‘পারব না -' কয়েক সেকেন্ড বাদেই জলের গ্লাসটা চেপেও ধরলেন হাত দিয়ে। ওটার শীতলতা মেয়েটাকে সামান্য স্বস্তি দিল মনে হয়।

প্রবাহ এই সময় কিছু একটা বলার চেষ্টা করে, সম্ভবত জলের গ্লাসটাকে নামিয়ে রাখার জন্য বলবে ভাবছিল। তা না হলে ওটা কাঁপতে থাকা হাত থেকে ছিটকে গিয়ে কেলেঙ্কারি হতে পারে।
'আমি পারব না,' আবার একই কথা বলল মেয়েটা। পরক্ষণেই গ্লাসে মুখে ঠেকিয়ে জল খেল এক ঢোক। বাচ্চাদের মতো দু'হাতে গ্লাসটাকে চেপে ধরে থাকল। তারপর যখন আমার দিকে তাকাল, সে চোখে শিশুর দৃষ্টি - খাদের কিনারায় পৌঁছে যাওয়ার ছাপ সেখানে। শ্রান্ত, ক্লান্ত। কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। মনে হচ্ছিল যা ঘটেছে তা এই তরুনীর মনকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। যেন একটা ইরেজার জাতীয় কিছু আকাশ থেকে নেমে এসে গোটা কয়েক আঁচড়ে জীবন থেকে কুড়ি বছর মুছে দিয়েছে বেচারীর। ফেলে রেখে গেছে একটা বাচ্চা মেয়েকে। বা বলা ভালো বড়দের পোশাকের ভেতর যুবতীর রূপ নেওয়া একটা শিশুকে দিকশূন্যপুরের এই ছোট সাদা রঙের ঘরটাতে এনে ফেলেছে।

'ওহ রতন! দানব! অফিসার আপনি কী আমাকে সাহায্য করবেন? সাহায্য করবেন আমাকে?হয়তো ও মারা যায়নি এখনও। হতে পারে - আমি এখন কী করব !' কথাটা বলেই কেঁদে ফেলল, তারপরেই, যেন কোনও কারণে খুব লজ্জিত হয়ে ফোঁপাতে শুরু করল।

আমি অত্যন্ত মোলায়েম গলায় সহানুভুতির যতটা সম্ভব প্রলেপ লাগিয়ে বললাম, 'শুনুন, অত হতাশ হবেন না। আমার মনে হচ্ছে আমরা আপনার রতনকে খুঁজে বার করতে আপনাকে সাহায্য করতে পারব। সে কী আপনার স্বামী?’

কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি সম্মতির ভঙ্গীতে মাথা ঝোঁকাল। ' জানেন আমরা আমাদের ছেলে মেয়েকে সার্কিট হাঊসে আয়ার কাছে রেখে এসেছি... ওরা তো ঘুমিয়ে পড়বে... আশা করেছিল বাবা ওদের আদর করবে... আমরা ফিরে গেলেই... '

'শুনুন আপনি একটু শান্ত হন সবার আগে, তারপর খুলে বলুন তো কী হয়েছে -'

প্রবাহ বলে, 'তার সঙ্গে এটাও বলুন ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে।’

'আমি শুধু এটাই বলতে পারি এটা ঘটেছে!' কাঁদতে কাঁদতেই মেয়েটি বলল. 'জানি না কোথায় ঘটেছে! আমি এটাও বলতে পারব না ঠিক কী ঘটেছে, তবে এটা বলতে পারি যা ঘটেছে তা অতি ভ-ভয়ানক ব্যাপার। '

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার নাম কী?’

'সুবালা রায়। আমার স্বামী রতন রায়। আমরা একটা বিশেষ সরকারী কাজে এখানে এসেছিলাম। রোহনপুরের সার্কিট হাউসে উঠেছি। ' এই কথাগুলো বলার সময় মেয়েটা একটু ধাতস্থ হয়েছে বলে মনে হয়েছিল। জলের গ্লাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে গ্লাসটাকে নামিয়ে রাখল। দেখতে পেলাম মেয়েটার তার হাতের তালু বেশ লাল হয়ে আছে। মনে মনে বললাম, পড়ে টড়ে গিয়েছিল মনে হচ্ছে।
[এভাবে ব্র্যাকেটের ভিতর নিজের ভাবনাচিন্তাগুলোও সব লিখে রাখছি।]

'আপনারা সরকারী কাজে এসেছেন বললেন তাই না?' জিজ্ঞাসা করলাম।

'হ্যাঁ...দু সপ্তাহ মতো থাকার দরকার আছে... কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন করছেন? এভাবে রতনকে তো খুঁজে পাওয়া যাবে না! কেন এই সব বোকা বোকা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন আমাকে? '

প্রবাহ বলল, 'আপনাদের পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছি মিসেস রায়। আপনি আমাদেরকে বলুন তো ঠিক কী ঘটেছিল। নিজের মতো করে গুছিয়ে বলুন।'

'আচ্ছা আপনাদের এখানে প্রাইভেট গাড়ির চালকেরা কী এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন নাকি সবাই?' হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল মেয়েটা।

প্রবাহর মুখ দেখেই বুঝলাম, বুঝতে পারছিল না কী বলবে। আমি অবশ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে শান্ত গলায় বললাম, 'হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন ম্যাডাম? এখানে, কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?

'হ্যাঁ,' মেয়েটা বলল। 'আমরা তিনটের সময় সার্কিট হাঊস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। যে গাড়িটা বুক করে ছিলাম তার আসার কথা ছিল। আধঘণ্টা অপেক্ষা করেও তার পাত্তা পাওয়া গেল না। সার্কিট হাউস ডেস্ক থেকে ফোন করে লাইন পাওয়াই গেল না গাড়ির অফিসে। ওখান থেকেই অন্য একটা ফোন নম্বর পাওয়া গেল যারা গাড়ি ভাড়া দেয়। এখানে অবশ্য ফোন লাগল। আমরা দিকশূন্যপুর যেতে চাই শুনে এক কথায় না করে দিল।

প্রবাহ বলল, 'সে আবার কী? এই এক ঘণ্টার পথ আসতে চাইল না! কী কারণ কিছু বলল? ইয়ে, আপনার অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত মিসেস রায়।’

'জানেন আমরা তাকে ডাবল ভাড়া দেব বলেছিলাম, তবুও রাজি হয়নি।’ [উচ্চারণে পরিষ্কার একটা বিভ্রান্তির ছাপ।] 'এরপরে গাড়ি পাওয়ার জন্য আমাদের প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। ওই সার্কিট হাউস থেকেই এই গাড়িটা যোগাড় করে দেয়। গাড়িটা কিছুটা পথ আসার পর রতন বুঝতে পারে সে ঠিকানা লেখা কাগজটা হারিয়ে ফেলেছে।'
গ্লাসটাকে আবার দুহাতে আঁকড়ে ধরল মেয়েটি।

'আপনারা কাকে দেখতে যাচ্ছিলেন?' আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
'সেটা তো বলতে পারব না। নামটা আমার জানা নেই। আর একজন আইনজীবী। ও হ্যাঁ আমার স্বামী উকিল। এর আগে ওদের ভেতর কোনোদিন দেখা সাক্ষাত হয়নি। আসলে ওদের সংস্থা দুটো - ' অস্পষ্টভাবে একটা ইঙ্গিত করে।

'পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত?'

'হ্যাঁ, সেটাই মনে হয়। ওই ভদ্রলোকের বিশেষ কোনও একটা মামলায় সাহায্য করতেই রতন এখানে এসেছিল। তার সঙ্গেই একটু হাওয়া বদল বলতে পারেন। ওই ভদ্রলোক নিজে ভাড়া বাড়িতে থাকেন বলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন সার্কিট হাউসে। উনি আমাদেরকে তার বাড়িতে রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওর সাথে রতনের যোগাযোগ হতো অফিসের ঠিকানায়। বাড়ির ঠিকানাটা রতন একটা কাগজের চিরকুটে লিখে রেখেছিল। আমরা ট্যাক্সিতে ওঠার পরে, সে বুঝতে পারে যে ভাবেই হোক সেটা খোয়া গেছে। একটাই শব্দ শুধু তার মনে ছিল, দিকশূন্যপুর । এছাড়া আর তার কিছুই মনে ছিল না। '
আমাদের দুজনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মেয়েটি বলে, 'দিকশূন্যপুর – নামটা মোটেই ভাল নয়।'

জানতে চাইলাম, 'তারপর আপনারা কী করলেন?'

মেয়েটা পুনরায় বলতে শুরু করল। সে কথা যখন শেষ হল তখন চা খাওয়া শেষ। ইতিমধ্যে আমি নোটবুকের বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলেছি সে বিবরণ লেখায়।

আইনজীবি রতন রায় আকারে বেশ দশাসই মানুষ। কালো ট্যাক্সির পিছনের সিটে বসে ড্রাইভারের সাথে কথা বলার জন্য ঝুঁকল। তারপরেই স্ত্রীয়ের দিকে একটু হতভম্বের মতো তাকাল। ঠিক সেইভাবে, যেভাবে একদা পুজোর মন্ডপে ঢাক বাজানোর সময় সুবালার দিকে দিকে প্রথমবার রতন তাকিয়েছিল। সেদিন কাঠের চেয়ারে বসে ভ্যাবলার মতো ওর দিকে চেয়েছিল সুবালা। অষ্টমীর দিন ছিল সেটা। রতনের পরণে ছিল পাঞ্জাবী আর পায়জামা। আর আজ গাড়ির ভেতর সেই মানুষটাই পরে আছে কেতাদুরস্ত স্যুট এবং টাই।
ট্যাক্সির চালক ঠিকানা হারিয়ে ফেলার গল্পটি মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল। বয়স্ক মানুষটার পরণে ছিল ধূসর রঙ্গের একটা সোয়েটার। মাথায় সিনেমায় ট্যাক্সি চালকদের মাথায় যেমন টুপি দেখা যায় সেরকম একটা টুপি। গলায় চেক কাটা উলের মাফলার। মানুষটাকে দেখে বেশ আন্তরিক । বেশ কমনীয়তা পূর্ণ বলে মনে হচ্ছিল। কাছে কোথাও একটা মাইকে যাত্রা পালার ঘোষণা শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। যাত্রা সম্রাট আনন্দ গোপাল এবার হিটলারের ভুমিকায়।
ট্যাক্সি চালক বলল, 'বুঝলাম, আপনাকে একটা কথা বলি স্যার। আমি আপনাদের দিকশূন্যপুর নিয়ে যাব । ওখানে বাজারে কোন একটা দোকানের কাছে দাঁড়াব যাদের ফোন আছে। আপনি আপনার দরকারি ঠিকানাটা ওখান থেকে জেনে নেবেন। আশা করি আপনি যাদের কাছে যাচ্ছেন তাদেরও ফোন আছে। আপনি জেনে নিলেই আমি একেবারে সেই বাড়ির দরজায় আপনাদের পৌছে দেব। ঠিক আছে।’
'বাহ! এটা ভালো ভাবনা,' সুবালা বলেছিল। আসলে, এরকম একটা সমস্যার মুহূর্তে মানুষের কাছ থেকে ভদ্র নম্র ব্যবহার পাওয়াটাই অনেক বড় কথা।
'থ্যাঙ্কস,' রতন বলে এবং ঠিক করে বসে। তারপর সুবালার দিকে তাকিয়ে বলে, 'কি, এবার শান্তি হলো তো? আর কোনও সমস্যা নেই।'
'এর জন্য তোমার ধন্যবাদ পাওয়ার কিছু নেই,' সুবালা ছদ্মরাগ দেখায়।
'স্যার, তাহলে চলুন যাওয়া যাক' ট্যাক্সিচালক বলল। 'দিকশূন্যপুরের পথে।'

সময়টা নভেম্বরের শেষ। অনবরত একটা ঠান্ডা বাতাস রাস্তার উপরে পড়ে থাকা আবর্জনাগুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। ধাক্কা মারছিল পথচলতি মানুষের গায়ে। রোদ ক্রমশ কমে আসছিল। শেষ বিকেলের আলো মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছিল বাড়ির ফাঁক দিয়ে। সুবালা দেখল সেই আলোতে লালচে আভা ধরতে শুরু করেছে।
ট্যাক্সিচালক গুনগুন করে কিছু একটা সুর ভাঁজছিল। রতনের গা ঘেঁষে বসে সুবালা অন্তরঙ্গতা অনুভব করতে করতে ভাবছিল - সারা বছরের খাটাখাটনির মাঝে এরকম বেড়ানোটা বেশ ভালই লাগে। স্বামীর কাজের সূত্রে স্ত্রীয়ের ভ্রমণযোগ, এরকম সুযোগ কজনার ভাগ্যে জোটে।
এইসময় সূর্যটা সহসাই এক সারি বড় গাছের পেছনে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর তার কারণেই ওরা কোন দিকে যাচ্ছে সেই হিসাবটা কেমন যেন গুলিয়ে যায়। অবশ্য অচেনা জায়গায় গেলে গেলে এরকম ঘটে এটা তার ভালোই জানা আছে। আলাদা আলাদা জায়গায় দিকগুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। সূর্য এমন দিকে ওঠে বা অস্ত যায় যাকে ঠিক মেলানো যায় না। মানুষ যে কীভাবে সামলে নেয় কে জানে। এই কথাটাই সে আগেরদিন রতনকে বলতেই, রতন বলেছিল, তোমার মতো এসব নিয়ে কেউ ভাবে না বুঝলে। নতুন জায়গায় বেড়ানোটাই আসল কথা।
এটাই ছিল এই সফরে তাদের সবচেয়ে বেশি সময়ের ট্যাক্সি যাত্রা। ওরা রোহনপুর এসেছিল ট্রেনে। শহর অনেকক্ষণ ছেড়ে চলে এসেছে বলেই মনে হল। কেন জানি না মনে হচ্ছে একই পথে তারা চক্কর মারছে। ওরা এমন একটা এলাকা পার করে এল যেখানে সারি সারি গোডাউনের মত কিছু । কিন্তু জনমানবহীন। জীবনের কোন লক্ষণ সেখানে নেই। একেবারে নির্জন।”

সুবালা পরে অবশ্য নিজের ভুল সংশোধন করেন। একটা ছোট ছেলেকে উনি ওখানে একটা বড় ভাঙা পাইপের ওপর বসে থাকতে দেখেছিলেন। সম্ভবত দেশলাই জ্বালাচ্ছিল। এটা জ্যোতিষদার নোটবুকে পরের দিকে লেখা ছিল। আমি তোদের আগেই বলে দিলাম।

“এরপর ওরা দেখতে পায় একটা ঘিঞ্জি এলাকা। যেখানে বেশ কিছু নানাধরনের দোকান ওদের চোখে পড়ে। আর তারপরেই ওরা মনে হয় আবার কেতাদুরস্ত শহুরে অংশে ঢুকে পড়েছিল।

'ওখানে একটা বড়সড় হোটেল ছিল,' আমাদের দিকে এমন এক বিস্ময়ের স্বরে সুবালা কথাটা বলেছিলেন, যেমনটা মানুষ স্ফিংক্স বা ঝুলন্ত উদ্যানের কথা বলার সময় বলে থাকে।
'সত্যিই ছিল বুঝি?' আমি কিছুটা অবাক এবং সায় দেওয়ার সুরে কথাটা বললাম – মেয়েটি মোটামুটি স্মরণ করতে পারছে। এই স্মৃতি স্রোত কোনোভাবে ধাক্কা খাক এটা আমি চাইনি। বরং ততক্ষণ মেয়েটি কথা বলে যাক যতক্ষন না সে তাদের সব কিছু জানাতে সক্ষম হয়।

শহরের জাঁকজমক পূর্ন অংশটিকে পেছনে ফেলে ওরা এগিয়ে যান। পৌঁছে যান তুলনামূলকভাবে ফাঁকা এলাকায়। সূর্য তখন দিগন্ত রেখায় একটা কমলা রঙের বলে পরিণত হয়েছে। তার থেকে বিচ্ছুরিত এক অদ্ভুত আলোতে হেঁটে যাওয়া মানুষদের দেখে মনে হচ্ছিল এক্ষুনি যেন ওদের গায়ে আগুন ধরে যাবে, “আর ঠিক তখন থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে,' মেয়েটি জানায়। কণ্ঠস্বর নেমে যায় কয়েক ধাপ। হাতগুলো আবার কেঁপে ওঠে।

আমি কৌতূহলের সুরে সামনের দিকে ঝুঁকে জানতে চাই, 'বদলাতে শুরু করে মানে? কীভাবে? কীভাবে বিষয়গুলি বদলে গেল, মিসেস রায়? '

এই সময় ওদের চোখে পড়ে একটা সাইন বোর্ড জাতীয় কিছু। মেয়েটা জানায় সেখানে এক অদ্ভুত কথা লেখা ছিল -
ষাট জন হারিয়ে গেছে ভূগর্ভস্থ আতঙ্কে্র জগতে।

‘রতন, দেখো দেখো!'
'কী?' মিঃ রায় চারদিকে তাকান। কিন্তু ততক্ষণে সেই সাইনবোর্ড অনেক পেছনে চলে গেছে।
'ওখানে লেখা ছিল, ষাট জন হারিয়ে গেছে ভূগর্ভস্থ আতঙ্কের জগতে। এর মানে কী গো? ভূগর্ভস্থ পথ? মাটির তলা দিয়ে পথ বানানো হচ্ছে নাকি বিদেশের মতো?'
'হতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু তো নয়। দুর্ঘটনা হয়েছে নাকি? '
'আমি কী করে জানব' মিসেস রায় সামনের দিকে ঝুঁকে বলে, 'এই যে ড্রাইভার দাদা, আপনি কী এ ব্যাপারে কিছু জানেন? এখানে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে নাকি?”
'অ্যাক্সিডেন্ট ম্যাডাম? আমি তো তেমন কিছু শুনিনি।'
'আপনার কাছে খবরের কাগজ নেই ?'
'ট্যাক্সিতে নেই, ম্যাডাম।'
'রতন?'
'হুমমম?'
তবে সুবালা বুঝতে পারেন রতনের এ ব্যাপারে আগ্রহ নেই। সে আবার তার কোটের পকেটগুলো হাতড়াচ্ছিল । আসলে রতন তার থ্রি-পিস স্যুটটি পরেছিল, ওখানে অনেকগুলো পকেট এখনো দেখা হয়নি। বলা যায় না ঠিকানা লেখা কাগজটা কোনো একটা পকেটে থেকে যেতেও পারে।

মিসেস রায়ের মনে কিন্তু সাইনবোর্ডের কথাগুলো বার বার ভেসে আসছিল।
ষাট জনের মৃত্যু হয়েছে সুড়ঙ্গ ধ্বসে গিয়ে, এরকম লেখা থাকাই উচিত ছিল। কিন্তু... ষাট জন হারিয়ে গেছে ভূগর্ভস্থ আতঙ্কের জগতে। কথাগুলো ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। ওখানে মৃত্যু লেখা ছিল না। হারিয়ে গেছে লেখা ছিল। ও কোথায় যেন পড়েছিল, সমুদ্রে্র এলাকায় মৃত্যু ঘটলে, মৃত্যুর বদলে হারিয়ে যাওয়া শব্দের ব্যবহার করাটাই নাকি রীতি। এখানে সমুদ্র আছে নাকি!
ভূগর্ভস্থ আতঙ্কর জগত!!
সুবালার কথাটা ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। শব্দ দুটো ওকে কবরস্থান, নর্দমা এবং শিহরন জনিত অস্বস্তি- , অদ্ভুত রকম কোলাহলের বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করছিল । মনে হচ্ছিল অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে একটা ট্রাম যাচ্ছে। আর তার ভেতর থেকে কিলবিল করে বেরিয়ে আসছে কিছু হাত! না, হাত না অনেকগুলো চ্যাটচেটে শুঁড় বা কর্ষিকা বলাটাই সঠিক হবে। একের পর এক অসহায় মানুষকে ওরা টেনে নিচ্ছিল অন্ধকার কামরার ভিতরে ...

ট্যাক্সিটা এবার ডানদিকে ঘুরল। চামড়ার জ্যাকেট পরা তিনটে ছেলে এককোনায় তাদের মোটরসাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা ট্যাক্সিটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছু সময়ের জন্য - অস্ত যাওয়ার সূর্যর আলো এই সময় এসে পড়েছিল ওদের মুখের এক দিকে - দেখে মনে হয়েছিল বাইকচালকদের মোটেই মানুষের মতো মাথা নেই। ক্ষণিকের জন্য সুবালার মনে হয়েছিল নিশ্চিতভাবেই কালো চামড়ার জ্যাকেটগুলোর গলার ওপরে একটা করে ইঁদুরের মাথা দেখা যাচ্ছে। কালো চোখের সেই ইঁদুরেরা ওদের ট্যাক্সির দিকে চেয়ে দেখছে। একটু বাদেই আলোর স্থান পরিবর্তন হয় এবং উনি বুঝতে পারেন যে ভুল দেখেছেন। ওখানে একটা ছোট্ট দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনজন যুবক ধূমপান করছে।
'আমরা ঠিক দিকেই যাচ্ছি,' রতন কাগজটা খোঁজা থামিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দিকে ইঙ্গিত করে বলেন। ওরা দেখতে পায় একটা সাইন বোর্ড, লেখা আছে 'দিকশূন্যপুর প্রধান সড়ক'। ইংরেজ আমলের পুরনো লাল ইঁটের বাড়িগুলো ঘুমন্ত বয়স্ক প্রহরীদের মতো সারসার দন্ডায়মান ছিল। শুধু জানলাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল ওগুলো যেন চোখ ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছে ট্যাক্সিটার দিকে। কয়েকটা বাচ্চাকে দেখা গেল এদিক সেদিকে ছুটে যেতে। দু চারজন লোক এক সাথে সম্ভবত কর্মস্থল থেকে ফিরছে। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে এদিকে কোথাও কারখানা আছে। আশ্বাসজনকভাবে সব কিছুই যথেষ্ট স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল ওখানে।
ট্যাক্সিটা থামল একটা জঘন্য দেখতে রেস্তোঁরার সামনে। যার জানালাতে ঝুলছিল বিজ্ঞাপন, এই রেস্তোঁরা লাইসেন্সপ্রাপ্ত। ওর নিচেই মাঝখানে আর একটা বড় মাপের লেখা, চাইলে এখান থেকে খাবার প্যাক করে দেওয়া হয়। জানালার উলটোদিকে নিচে চৌকাঠের ওপর বিশালমাপের একটা ধূসর বিড়াল শুয়ে ছিল। রেস্তোঁরাটির ঠিক পাশেই একটা কাঁচ লাগান কাঠের ঘর। বাইরের দেওয়ালে লেখা – ফোন করতে হলে এই ঘরে আসুন।
ট্যাক্সিচালক বলল, 'ওই দেখুন, ওই যে ফোন বুথ! ওখানে গিয়ে একটা ফোন করে আপনার বন্ধুর বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নিন। তারপর আমি ঠিক পৌঁছে দেব। খুচরো টাকা আছে তো? '
রতন বলল, ‘হ্যাঁ, তা আছে!”

সুবালা কিছুক্ষণ ট্যাক্সির ভেতর বসে থাকার পর পা দুটোকে একটু টান করার কথা ভাবে। ঠান্ডা বাতাস তখনও বয়ে চলেছিল। দরজা খুলতেই তার ধাক্কায় ওর শাড়ির আঁচল চাবুকের মতো ফট ফট করে আছড়ে পড়ে ট্যাক্সির জানলার কাঁচে। একটা নোংরা কিছুর মোড়ক উড়ে এসে ওর পায়ে লেপ্টে যায়। ঘেন্নায় নাক শিঁটকে উনি ওটাকে ঝেড়ে ফেলে দেন। তারপর মুখ তুলে তাকান ধূসর রঙের কাচের জানালার নিচে শুয়ে থাকা বিড়ালটার দিকে। ওটাও তার দিকে এক চোখে ফিরে তাকায় অপাঠযোগ্য অভিব্যক্তি নিয়ে। প্রাণীটার মুখের আধখানা কোনও লড়াইয়ের কারণে নখের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। আপাতত কোঁচকানো গোলাপি নগ্ন চামড়া, একটা সাদা চোখ আর কিছু এবড়োখেবড়ো লোম অবশিষ্ট আছে।
একটা ডাক ছাড়ে বিড়ালটা সুবালাকে লক্ষ্য করে। আওয়াজ অবশ্য শোনা যায় না জানলার কাঁচের উল্টোদিকে থাকার কারণে।

কেমন যেন একটা বিরক্তি মাখানো অস্বস্তি অনুভব করে সুবালা এগিয়ে যায় ফোনবুথের দিকে এবং কাছে গিয়ে নোংরা কাচের ভিতরের জগতে উঁকি মারে। রতন বুড়ো আঙ্গুল এবং তর্জনীর সাহায্যে একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত করে ওকে দেখায় এবং চোখ টেপে । তারপর কথা বলে কারও সঙ্গে। হেসে ওঠে – শব্দ না এলেও সেটা বোঝা যায়।

বিড়ালটাকে আর একবার দেখার জন্য সুবালা জানলাটার দিকে ফিরে তাকায়। জানলা তখন ফাঁকা। ভেতরে ঝাপসা অস্পষ্টতায় দেখা যাচ্ছে টেবিলের উপর চেয়ারগুলো উঠিয়ে রাখা আছে। এক বৃদ্ধ ঝাঁট দিচ্ছে। এবার সুবালা যখন ফিরে তাকাল, দেখল রতন কিছু একটা লিখছে। পেনটা পকেটে রেখে, হাতে তুলে নিল কাগজটা। তারপর আরও দুচারটে কথা বলে ফোন রেখে বাইরে বেরিয়ে এল।

বিজয়ীর ভঙ্গীতে ঘরের বাইরে বসে থাকা ছেলেটাকে টাকা দিতে দিতেই সুবালার দিকে ঠিকানা লেখা কাগজটা তুলে নাচাল। 'ব্যাস হয়ে গেছে -' তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলে, “আরে ট্যাক্সিটা গেল কোথায়?” কথাটা শুনে সুবালা ঘুরে তাকায়। সত্যিই তো ট্যাক্সি উধাও। যেখানে ওটা দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে এখন পড়ে আছে কিছু জঞ্জাল। কয়েক টুকরো কাগজ পাশের নর্দমা থেকে মাথা তুলে আছে। রাস্তায় দুটো বাচ্চা একে অপরের হাত ধরে টানাটানি করছে আর হাসছে। সুবালা লক্ষ্য করল যে, তাদের মধ্যে একটা বাচ্চার হাত কেমন যেন বিকৃত - দেখে থাবার মতো মনে হচ্ছে ওটাকে।
বাচ্চা দুটো রাস্তার ওপাড় থেকে ওর দিকেই তাকাল এবার। বুঝতে পেরেছে সুবালা ওদের দিকেই তাকিয়ে আছেন। পুনরায় একে অপরের হাত ধরে টেনে খিলখিল করে হেসে উঠল ওরা।
'আমি জানি না,' সুবালা বলে কিছুটা হতাশাগ্রস্ত স্বরে। হঠাৎ করেই গরম হাওয়া বইতে শুরু করে। একেবারে গ্রীষ্মকালের মত। কেন জানি না সে হাওয়ায় গাটা শি্রশির করে ওঠে মিসেস রায়ের। অজানা আশঙ্কায়। চারদিকের আলো দেখে মনে হচ্ছিল কোনও শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি -

'তখন কটা বাজছিল?' প্রবাহ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল।
'আমি জানি না,' মিসেস রায় সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। 'ছটা হতে পারে। বা ছটা বেজে কুড়ি।

'হুম বুঝলাম, বলতে থাকু্ন,' প্রবাহ কেন প্রশ্নটা করল বুঝতে পারছি। নভেম্বর মাসে ছটা বাজা মানেই অন্ধকার হয়ে যাওয়া। সেখানে মিসেস রায় আকাশে সূর্যর আলো দেখতে পাচ্ছিলেন।

'আচ্ছা, ওই ড্রাইভার এরকমটা কেন করল? কী করে করল?' রতন কথাটা জিজ্ঞাসা করে এদিক সেদিকে তাকাচ্ছিল। মনে হলো ও আশা করছে ট্যাক্সিটা আবার ফিরে আসবে। 'কিছু না বলে এভাবে চলে যাওয়ার মানেটা কী?’
'আমার মনে হয় তুমি যখন আমাকে বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনী দিয়ে ইঙ্গিত করলে, তখন ও হয়ত ভেবেছে তুমি ওকে চলে যেতে বলছ,” সুবালা বলল।
'তাই আবার হয় নাকি! সেটাও যদি মনে নিই, ভাড়া নেওয়ার কথাটাও কী ভুলে গেল বলতে চাও? এ আবার কেমন ব্যাপার!’ রতন কিছুটা ক্ষুব্ধভাবেই কথাটা বলে রাস্তা পার হয়ে উল্টোদিকে হেঁটে গেল। সেই ছোট বাচ্চাদুটো তখনও হাসাহাসি করছিল। রতন ডাকল। ' এ্যাই, শোন শোন!'
'আপনারা এই এলাকায় নতুন এসেছেন তাই না?' বিকৃত হাতওয়ালা ছেলেটা জানতে চাইল।
'হ্যাঁ,' রতন হেসে বলল। 'তোরা ট্যাক্সিটাকে দেখেছিলি? ওটা কোন দিকে গেল রে? ''
বাচ্চা দুটোকে দেখে মনে হল ওরা প্রশ্ন নিয়ে একটু যেন ভাবছে। ছেলেদুটোর সাথেই একটা পাঁচবছরের দুদিকে বেনী ঝুলানো একটা মেয়েও ছিল। সে চলে গেল উলটোদিকের ফুটপাথে। দু হাত দিয়ে মুখের কাছে চোঙ্গার মতো করে হাসতে হাসতে ওদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল 'অ্যাই হতভাগা ভুটু!'

'কী হলো রে শিলু? ' ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল, বিকৃত হাতটা দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গীতে একটা স্যালুটের মতো করল রতনের দিকে ফিরে। তারপরে ওরা দুজনেই একছুটে ওখান থেকে পালিয়ে গেল। কেবল তাদের হাসির প্রতিধ্বনি থেকে গেল ওখানে।
রতন সুবালার দিকে হতভম্বের মতো তাকাল।
'মনে হচ্ছে এই এলাকার বাচ্চারা অচেনা মানুষ সম্পর্কে খুব বেশি উৎসাহী নয়,' একটু ইতস্তত ভঙ্গীতে বলল।
কিছুটা ঘাবড়ে যাওয়ার চোখে সুবালা চারদিকে একবার তাকালেন। রাস্তাটা এখন নির্জন।
রতন এপারে এসে সুবালাকে বলল, 'আরে ডিয়ার, মনে হচ্ছে না আমরা যেন অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরিয়েছি। '
'আমার কিন্তু সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না রতন। ওই বাচ্চা দুটো সম্ভবত তাদের বড় ভাইদের ডাকতে গেছে।' সুবালা হাসতে চাইল, পরিস্থিতির চাপটা কমানোর জন্য। কিন্তু ঠিকভাবে হাসতেও পারল না। কেমন যেন এক অদ্ভুত মনে হচ্ছে সব কিছু। অপার্থিব মাত্রায় পৌছে গেছে। যা তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এর চেয়ে সার্কিট হাউসে থাকলেই ভালো হত।
'আমরা এখন আর কীই বা করতে পারি,' রতন বলল। 'এই রাস্তায় চটজলদি কোনও যানবাহন যে পাওয়া যাবে না সেটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে।'
'রতন, ট্যাক্সি চালক কেন এখানে আমাদের এভাবে ছেড়ে চলে গেল? লোকটাকে আমার বেশ ভা্লোই মনে হয়েছিল।'
'কে জানে কেন! কিছুই বুঝতে পারছি না। রজতবাবু ফোনে কিন্তু আমাকে ভালো করে পথটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। উনি যে রাস্তায় থাকেন তার নাম একাত্তরের কানা গলি। যা খুবই ছোটো একটা রাস্তা। মানে গলিই। সাথে এটাও বললেন যে, ওটা নাকি স্থানীয় ম্যাপেও খুঁজে পাওয়া যায় না।' কথা বলতে বলতে ওরা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার মত খাবার বিক্রি করা রেস্তোঁরা থেকে দূরে চলে গিয়েছিল। আবার সেই রাস্তা ধরেই হাঁটছিল যেটা দিয়ে ওদের গাড়িটা এসেছিল। 'আমাদের রাজেন হালদার লেনের ডান দিকে যেতে হবে, তারপর নেমে যেতে হবে বাঁ দিকে কিছুটা, তারপর ঘুরতে হবে প্রথম ডানদিকের মোড় ধরে... নাকি বাঁদিকে যেতে হবে? যাইহোক, সব্জী বাজার স্ট্রিট ধরে দ্বিতীয়বার বাঁদিকে ঘুরলেই ওই কানা গলি। '
'তোমার সবটা মনে আছে?'
রতন কিছুটা গর্বের সাথে বলল, 'ডিয়ার সুবালা রায়, আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন আমি একজন নামকরা আইনজীবি। মনে রাখাটাই আমাদের কাজ।’ কথাটা শুনে সুবালা ফিক করে হেসে ফেলল । রতন সব কিছুকেই বেশ সহজে নিতে পারে। টেনশন করে না।
এভাবেই বেশ খানিকটা পথ হেঁটে যাওয়ার পর রতন বলল, 'জলদিই আমরা পৌছে যাব, রজতবাবুর কথা মতো এখান থেকে সব শুদ্ধ আধঘন্টা লাগতে পারে।’
'সেটা হলে -' সুবালা সবে কথা শুরু করেছে। ঠিক তখনই চাপা গোঙ্গানির শব্দটা শোনা গেল।
ওরা দুজনেই থমকে দাঁড়াল। গোঙ্গানির শব্দটা তাদের ডান দিক থেকে শোনা যাচ্ছে, যেখানে উঁচু ঝোপে ঘেরা একটা এলাকা। উলটো দিকে পার্ক জাতীয় কিছু আছে মনে হয়। রতন শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই সুবালা ওর হাতটা আঁকড়ে ধরল।
'রতন, না!'
'না মানেটা কি? মনে হচ্ছে কেউ যেন বিপদে পড়েছে ।'
অগত্যা কিছু্টা নার্ভাসভাবেই সুবালাও রতনের পিছু পিছু এগিয়ে গেল। ঝোপের উচ্চতা বেশ ভালই কিন্তু ঘন নয়। দুহাত দিয়ে গাছপালা ঠেলে সরাতেই ফুলগাছে ঘেরা একটা ছোট্ট লনের মতো বর্গাকার স্থান দেখা গেল। লনের ঘাস খুবই সবুজ। তার ঠিক মাঝখানে একটা কালো ধোঁয়ার মতো দাগ – মানে প্রথম দেখায় এরকমটাই মনে হয়েছিল। সুবালা ভালো করে দেখার জন্য যখন আবার রতনের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মারল রতন বেশ লম্বা, তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকানো কিন্তু কঠিন, তবে ঝুঁকে ছিল; বলে দেখতে অসুবিধা হল না।
একটা গর্ত, অদ্ভুত আকারের গর্ত। অস্পষ্টভাবে হলেও ওটা দেখতে একেবারে একটা হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা মানুষের মতো। ওটার ভেতর থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলী বেরিয়ে আসছিল।
ষাট জন হারিয়ে গেছে ভূগর্ভস্থ আতঙ্কের জগতে, সহসাই কথাগুলো সুবালার মনে ভেসে এসেছিল।

গর্তর ভেতর থেকেই গোঙ্গানিটা উঠে আসছিল। রতন এক ঝটকায় ঝোপের দেওয়াল পার হয়ে ছুটতে শুরু করল ওটার দিকে।
'রতন,' সুবালা চেঁচিয়ে উঠেছিল, 'কী করছোটা কী, যেও না।'
'কেউ নিশ্চিতভাবে সমস্যায় পড়েছে,' রতনের দিক থেকে উত্তর এল। সুবালা দেখল রতনকে এগিয়ে যেতে। ঝোপের দেওয়ালের ফাঁকটা রতন ঢুকে যেতেই সুবালার চোখের সামনে বন্ধ হয়ে গেল। আবছা দেখা যাচ্ছিল রতনকে।
ঝোপ ঠেলে সরিয়ে এবার সুবালাও ভেতর ঢোকার চেষ্টা করল। কিন্তু হঠাৎ করেই ঝোপটা যেন দুর্ভেদ্য দেওয়ালে পরিণত হয়। অনেক ঠেলেও ফাঁক বানাতে পারেননি মিসেস রায়।
'রতন!' আতঙ্ক জড়ানো স্বরে দেকে উঠেছিলেন, “চলে এস! আমার ভয় করছে!'
'একটু দাঁড়াও, আসছি, ডিয়ার!'
কাছে পাশাপাশি দুটো লাইট পোস্ট ঝোপের উপর থেকে ঝুঁকে সুবালার দিকেই যেন চেয়েছিল।
হাহাকারের মত সেই গোঙ্গানি এখনো শোনা যাচ্ছিল তবে তত জোরে নয় – চাপা ঘরঘরে, একটু যেন খ্যালখেলে হাসির মতো।
রতন কী এটা শুনতে পাচ্ছে না? মনে হয়েছিল সুবালার।
'এই যে, কেউ কী নিচে আছেন?' শুনতে পায় রতনের কন্ঠস্বর । 'আরে কেউ - ওহ! আরে! হা ভগবান! ' তারপরই হঠাৎ রতন আর্তচিৎকার করে ওঠে্ন। সুবালা এর আগে তার স্বামীকে এভাবে কখনও তাকে আর্তনাদ করতে শোনেনি। পা দুটো যেন জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল।
অনেক চেষ্টা করেও লম্বা ঝোপের ভেতর দিয়ে ওর কাছে পৌছানোর কোন পথ খুঁজে বার করতে পারেননি মিসেস রায়। এই সময় এক এক করে - সেই বাইকচালকরা যাদের মুখ ইঁদুরের মতো ছিল, গোলাপী চামড়া বের হওয়া মুখের বিড়াল, বিকৃত হাতের বাচ্চা ছেলে -ছবিগুলো ওর মাথায় ভেসে এসেছিল। কে জানে কেন!
রতন! সুবালা চিৎকার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোনও শব্দ বের হয়নি ওর মুখ থেকে।
ঝোপের উলটো দিক থেকে ঝটাপটির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মাটির নিচ থেকে উঠে আসা হাহাকার থেমে গিয়েছিল। তার বদলে কেমন যেন একটা ভিজে কিছুর ঘষ্টানোর শব্দ ভেসে আসছিল। তারপরেই হঠাৎ করে রতন প্রায় উড়েই যেন এসে পড়ল ঝোপের গায়ে। মনে হল কেউ যেন ওকে সজোরে ধাক্কা মারল। ওর কোটের বাম হাতটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। গোটা গায়ে কালো কিছু জিনিস মাখামাখি হয়েছিল । যেটাকে দেখতে লাগছিল একটু আগে দেখা গর্তের কাছের ধোঁয়ার মতো।

'সুবালা, পালাও!'
'কী -'
'পালাও!' রতনের মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছিল।
সুবালা চারদিক তাকিয়ে পুলিস খুঁজছিল। বা যে কোনো একজন মানুষকে। কিন্তু ওই মুহূর্তে ওই জায়গাটা ছিল, কোনো এক পরিত্যক্ত নির্জন শহরের মতো। ঝোপের দেওয়াল বার নরম হয়ে গিয়েছিল। পুনরায় সুবালা হাত দিয়ে ওটা সরিয়ে নিছক কৌতূহলেই ভেতরের দিকে তাকিয়েছিল। মনে হয়েছিল ওখানে কিছু যেন একটা নড়ে বেড়াচ্ছে। এমন কিছু একটা, যা কালোর চেয়েও বেশি কালো। অনেকটা আবলুস কাঠের মতো বা বলা ভালো আলোর বিপরীত বলতে যা বোঝায় ঠিক সে রকম।
ওটার গা থেকেই একতাল কাদা মাখলে যেমন থ্যালথেলে শব্দ হয় সেরকম একটা শব্দ আসছিল।
একটু বাদেই ঝোপের ছোট শক্ত শাখাগুলো কাঁপতে শুরু করে। সুবালা সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকে।
মিস্টার রায় যদি তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে চিলচিৎকার না করতেন, তাহলে হয়ত মিসেস রায় চিরকাল ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতেন।
( এরকমটাই উনি আমাদেরকে বললেন)
‘হ্যাঁ অফিসার হ্যাঁ, রতন চিৎকার করে উঠেছিল, যে আদালতে জেরা করার সময় কোনোদিন চিৎকার করে না, সেই রতন - তা না হলে আমি সম্ভবত ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকে যেতাম। ওখানেই দাঁড়িয়ে...’

এরপর ওরা দৌড়াতে শুরু করেন।
‘কোন দিকে?’ প্রবাহ জিজ্ঞাসা করেছিল, কিন্তু মিসেস রায় বলতে পারেননি। এক অদ্ভুত রকম আতঙ্ক আর হতভম্বিত অবস্থায় ওর স্বামী পুরো ঘাবড়ে গিয়েছিল - সুবালার শুধু এটুকুই মনে আছে। রতন ওর কব্জিটাকে আঙ্গুল দিয়ে চেপে হাতকড়ার মতো ধরে ছিলেন। ওরা ছুটে পালিয়ে এসেছিলেন; ঝোপের ওপর দিয়ে ঝুঁকে থাকা ল্যাম্প পোস্ট দুটোর কাছ থেকে। সরে এসেছিলেন সেই ধোঁয়া বের হতে থাক গর্তটার কাছ থেকে। মিসেস রায়ের এসব কথা ভালো করেই মনে আছে। এরপর বাকি যা মনে ছিল সে সব অস্পষ্ট ছিল এক স্মৃতি শৃঙ্খলা মাত্র।

প্রথমে দৌড়ানো খুব খুব কঠিন ছিল এবং তারপরে সহজ হয়ে যায়। কারণ ওরা উতরাই ধরে নামছিলেন। পর পর দুবার বাঁক নেন। টানা সবুজ শেড যুক্ত উঁচু ছাদওয়ালা ধূসর বাড়িগুলো অন্ধ পেনশন প্রাপকদের মতো ওদের দিকে তাকিয়েছিল। তার মনে আছে রতন তার কোটটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অবশেষে ওরা একটা চওড়া রাস্তায় এসে পৌছায়।

'একটু থামো,' সুবালা হাঁফাতে হাঁফাতে বলেন। 'একটু থামো, আমি আর ছুটতে পারছি না!' হাত দিয়ে উনি পেটের কাছটা চেপে ধরেছিলেন। মনে হচ্ছিল ওখানে যেন কেউ গরম লাল শিক গেঁথে দিয়েছে।
রতন দৌড়ানো থামান। ওরা একটা মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বর্তমান রাস্তাটাকে ভেদ করে চলে গেছে একটা বেশ চওড়া পিচ বাঁধানো রাস্তা। বেশ কিছুটা দূরে একটা সাইনবোর্ড জানান দিচ্ছিল, ওরা মহাচন্ডী টোয়েন, দিকশূন্যপূর এক মাইল দূরে অবস্থিত।
‘মহাচন্ডী টোয়েন! মানে টাউন? মানে শহর?’ আমি জানতে চেয়েছিলাম।
‘না,’ মিসেস রায় জবাব দেন, ‘মহাচন্ডী টোয়েন, টী ও ডাব্লু ই এন।’

'এ আবার কেমন শব্দ, আগে তো কোনোদিন শুনিনি! এর মানে কী? এবার নিশ্চিত পাগল হয়ে যাব, "রতন কথাটা বলে কেমন ভাবে যেন হাসল।
মিসেস রায় তার ঘড়ির দিকে একটু আগেই তাকিয়েছিলেন, সোয়া আটটা বাজছিল তখন। এরকম সময়ে আকাশের এরকম রং উনি আগে কোনোদিন দেখেননি। সূর্যাস্তের ঝকঝকে কমলা থেকে এখন ঘন কালচে লালে পরিণত হয়েছে। যার আশেপাশের দোকানগুলোর বন্ধ জানালার দরজায় পড়ে ঝকমক করছে। সব মিলিয়ে মিশিয়ে কেমন যেন একটা গা গুলানো ব্যাপার । আচ্ছা আকাশে ওটা কী, সূর্য? নাকি চাঁদ? দিগন্ত রেখায় ঝুলে থাকা একটা আবছা লালচে গোলকটা কী?
'ওখানে ঠিক কী হল বলো তো?' সুবালা জিজ্ঞাসা করেন। 'ওটা কী ছিল, রতন?'
'আমার কোটটা হারিয়ে গেল, ধ্যাত তেরে কী! '
'ওটা মোটেই হারিয়ে যায়নি, তুমি খুলে ফেলে দিয়েছ। ওটাতে কীসব লেগে - '
'বোকার মতো কথা বোলো না!' রতন ঝঁঝিয়ে ওঠে। যদিও তার চোখে রাগ ছিল না একটূও, বরং একটা হতভম্ব শিশুর মতো অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছিল। 'আমি ওটা হারিয়ে ফেলেছি, ব্যাস। '
'তুমি যখন ঝোপের ওদিকে মাঠের ভেতরে গিয়েছিলে, তখন কী হয়েছিল?'
'কিছুই না। এ নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমরা এখন কোথায়? '
'রতন -'
'আমার কিছুই মনে নেই,' রতন মৃদুস্বরে বলে। 'সব ভুলে গিয়েছি, সব ফাঁকা। আমরা সেখানে ছিলাম ... আমরা একটা শব্দ শুনতে পাই... তারপর আমি দৌড়াচ্ছি । এটুকুই শুধু মনে করতে পারছি।’ কয়েক মুহূর্ত বাদে বাচ্চাদের মতো ভীতিজনক আধো আধো স্বরে বলল, 'শুধু শুধু কেন আমি আমার কোটটা ফেলে দেব? ওটা আমার প্রিয় কোট। সব প্যান্টের সাথে মানিয়ে যায়।' বলেই মাথাটা পেছনের দিকে কাত করে আতঙ্ক জাগানো স্বরে হেসে ওঠে।

মিসেস রায় বুঝতে পারেন ঝোপের ওপারে যা কিছু তার স্বামী দেখেছে তা ওকে কিছু পরিমাণে মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। হয়তো উনি নিজেও এরকম অবস্থায় পৌছে যেতেন যদি নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখতেন। আপাতত এসব ভেবে লাভ নেই। ওদের এখান থেকে পালাতেই হবে। সার্কিট হাউসে ফিরে যেতে হবে। যেখানে ওদের বাচ্চারা আছে।
'চলো একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসি। আমি ঘরে যেতে চাই।'
'কিন্তু রজতবাবু -' রতন বলে।
'তার কথা ভেবে লাভ নেই! সুবালা চেঁচিয়ে ওঠে। “এখানে সব কিছু গোলমেলে। সব কেমন যেন ভুল, এখানে সবকিছুই ভুলভাল ঘটছে। এই মুহূর্তে আমি একটা কিছু চাই, যেটা আমাকে ঘরে নিয়ে যাবে। !'
'হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। ঠিক আছে.' রতন তার কপালটা মোছে কাঁপা কাঁপা হাতে। 'আমি তোমার সাথে সহমত, কিন্তু একটাই সমস্যা, এখানে কিছুই নেই। ''
সত্যিই তাই, প্রশস্ত এবং বাঁধানো রাস্তাটায় সত্যিই কিচ্ছু ছিল না একেবারে শুনশান। রাস্তার একেবারে মাঝখান ধরে চলে গিয়েছে পুরানো ট্রাম লাইনের মতো দাগ।
‘ট্রাম লাইন? দিকশূন্যপুরে!’ প্রবাহ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল।
‘হ্যাঁ, সেরকমই তো মনে হল। বলছিই তো সব কিছুই কেমন যেন বদলে গিয়েছিল। উলটোদিকে, একটা ফুলের দোকানের সামনে, আদ্যিকালের এক তিন চাকার টেম্পো দাঁড় করানো ছিল। আরও দূরে রাস্তার পাশে একটি ইয়ামাহা মোটরবাইক রাখা ছিল কিকস্ট্যান্ডের উপর। ব্যাস এইটুকুই। ওদের কানে গাড়ি চলার শব্দ ভেসে আসছিল। তবে সেটা অনেক দূর থেকে, আবছা।

'সম্ভবত রাস্তাটা মেরামত করার জন্য বন্ধ করা আছে,' রতন বিড়বিড় করে এবং তারপরেই এ্রকটা অদ্ভুত কাজ করে... অদ্ভুত, তো বটেই, অন্তত তার পক্ষে যে, সাধারণ জীবনে সহজ সরল এবং আত্মবিশ্বাসী। পিছনে ফিরে এমনভাবে তাকায় যেন কেউ আমাদের অনুসরণ করছে। 'চলো আমরা হেঁটেই যাই,' মিসেস রায় বলেছিলেন।
'কোথায়?'
'যেকোনো জায়গায় । এই জায়গাটা থেকে দূরে। এখান থেকে কিছুটা হেঁটে গেলেই আমরা ট্যাক্সি পেয়ে যাব মনে হয়। জোর করে ইতিবাচক মানসিকতা দেখানোর চেষ্টা করে। আসলে ভিতরে ভিতরে একটা আতঙ্ক ওকে ঘিরে ধরছিল।
‘ঠিক আছে,’ রতনের গলা শুনে মনে হয় এই মুহূর্ত থেকে সে তার দায়দায়িত্বের ভার সুবালার উপর ছেড়ে দিতে রাজি।

ওরা রাস্তাটা ধরে আকাসের বুকে ঝুলে থাকা অদ্ভুত আলো বিচ্ছুরণকারি গোলকটাকে সামনের দিকে রেখে হাঁটতে শুরু করে। দূর থেকে একটানা ঝড় বয়ে যাওয়ার মতো করে, ট্র্যাফিকের কোলাহল ভেসে আসছিল। কমাবাড়ার কোনও লক্ষণ ছিল না সেখানে। চারদিকের এই নিস্তব্ধতা, নির্জনতা সুবালার স্নায়ুকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছিল। তার কেন জানি না মনে হচ্ছিল কেউ তাদের দিকে লক্ষ্য রাখছে। এই মনে হওয়াটাকে চেষ্টা করছিল সে ঝেড়ে ফেলার, কিন্তু পারছিল না। তাদের পদচারনার শব্দর সাথেই ‘ষাট জন হারিয়ে গেছে ভূগর্ভস্থ আতঙ্কে্র জগতে’ কথাগুলো বারবার তার মাথায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ঝোপের পেছনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ছবিটাও ভেসে উঠছিল তার সঙ্গে। একসময় আর থাকতে না পেরে সুবালা আবার জিজ্ঞাসা করল।
'রতন, ওখানে কী ছিল?'
সোজাসাপ্টা উত্তর এল: 'আমার মনে নেই। আর আমি মনে করতেও চাই না। '

ওরা একটা বাজারের মতো কোন এলাকার ভেতর হেঁটে গেল, যার দোকানপাট সব বন্ধ ছিল। ন্যাড়া মাথার মতো এক গাদা নারকেল রাখা আছে দেখা গেল একটা জানালার পেছনে। ওরা একটা লন্ড্রি পার হল, যার দেওয়াল ভেদ করে পচা গলা মাড়ি থেকে বেরিয়ে থাকা দাঁতের মতো একটা সাদা কিসের মেশিন বের হয়ে ছিল। বিজ্ঞাপনী পোস্টার লাগানো একটা এমন দোকানও ওরা দেখতে পেল, যার সামনে অনেক পুরোনো দিনের রং জ্বলে যাওয়া একটা বিজ্ঞাপন ঝুলছে, ‘দোকান ঘর ভাড়া দেওয়া হবে’ । এই সময় সুবালা দেখতে পেলেন, মুখের গোলাপী ছাল বাখড়া উঠে যাওয়া সেই একইরকম দেখতে একটা ধূসর রঙের বিড়াল তার দিকে তাকিয়ে আছে।

নিজের অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থা ও নাচানাচি করতে থাকা সন্দেহগুলো বিশ্লেষণ করে মিসেস রায় বুঝতে পারলেন, যে তার মনের ভেতর একটা সন্ত্রাস এবার সত্যি সত্যিই রূপ ধারণ করছে। মনে হচ্ছে তার নাড়িভুড়িগুলো যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে পেটের ভিতরেই। মুখে তীব্র তেতো বিশ্রী স্বাদ ছড়িয়ে পড়ছে। রাস্তার রঙটাও কেমন যেন তাজা রক্তের মত লাল দেখাচ্ছিল অদ্ভুত গোলকের আলোয়।
এবার ওরা যেটা দেখতে পেল সেটা বিদেশী সিনেমা ছাড়া সত্যিই আর কোথাও দেখেনি। বড় একটা গুহার মুখ বলে মনে হচ্ছিল ওটাকে। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তাটা সোজা গিয়ে ঢুকে গেছে ওটার ভেতর। কী ওটা? কোনও একটা ভূগর্ভস্থ পথ? আমি পারব না, সুবালার মন জানিয়ে দেয়। আমি ওখানে যেতে পারব না, অনেক কিছুই ওখানে থাকতে পারে।

এখানে কাকুতি কিনতি করার সুরে মিসেস রায় বলে ওঠেন, ‘দোহাই অফিসার কী থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়েছিল, দয়া করে আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না, কারণ আমি বলতে পারব না!’

মিসেস রায়ের মনের আর একটা অংশ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, ফেলে আসা রাস্তা ধরে সে আবার ফিরে যেতে পারবে কিনা ? সেই ফাঁকা দোকানটা যেখানে একটা বিড়াল ছিল। কে জানে ওটা রেস্তোঁরা থেকে এখানে কীভাবে এল? না এ বিষয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করা বা খুব গভীরভাবে চিন্তাও করা উচিত নয় বলেই সুবালার মনে হয়েছিল। কিংবা সেই লন্ড্রির দাঁত বার করা চেহারা, বা সেই অদ্ভুত মাথাওয়ালা মানুষদের বাজার। মিসেস রায়ের মনে হয়নি ওই দিকে ফিরে যাওয়াটা ঠিক হবে।

ওরা সেই গুহা মুখের অনেকটাই কাছাকাছি এসে গিয়েছিল। আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ওরা দেখতে পায় ভিতরে চলে গিয়েছে ট্রেন লাইন। প্রায় তখুনি ওদের ডান দিক থেকে একটা অদ্ভুতরকম ভাবে রঙ করা ছয় কামরার ট্রেন – একেবারে হাড়ের মতো সাদা – ওদের চমকে দিয়ে ছুটে যায়। মনে হয়েছিল একটা বড় সড় আকারের কোনো অদ্ভুত জন্তু যেন ছুটে গেল তার শিকার লক্ষ্য করে।

চাকাগুলো থেকে ছিটকাচ্ছিল আগুনের স্ফুলিঙ্গ। ওরা দুজনেই অনিচ্ছাকৃতভাবে লাফিয়ে পিছিয়ে আসে। রতনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আর্ত চিৎকার। সুবালা তাকিয়েছিলেন রতনের দিকে। এ কোন রতন? শেষ একঘন্টায় মানুষটা এমন কোনও একজনে পরিণত হয়েছে যাকে উনি এর আগে কখনো দেখেননি। এরকম কিছু যে হতে পারে কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি। মিস্টার রায়ের চুলগুলো সব সাদা রঙের হয়ে গিয়েছিল। যদিও নিজের মনকে প্রবোধ দেওয়ার উদ্দেশ্যে, নিজেই নিজেকে সুবালা বলেন, আসলে এটা আলোছায়ার ধোঁকাবাজি। রতনের চুলের অবস্থাই তাকে বুঝিয়ে দিল যে পথ দিয়ে এসেছেন সেদিকে ফিরে যাওয়া অর্থহীন। অতএব, ওই গুহার ভেতর প্রবেশ করা ছাড়া গতি নেই।

“চলে এসো,' স্বামীর হাত ধরে টানেন মিসেস রায়। এত জোরে চেপে ধরেন যাতে নিজের কাঁপুনিটাও থামানো যায়। 'যত তাড়াতাড়ি যেতে পারব ততই ভালো।’ প্রায় টানতে টানতেই রতনকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন।
গুহার মতো মনে হলেও ওটা গুহা ছিল না মোটেই। একটু এগোতেই উলটোদিকের আলো দেখা গেল। সেই একই রকম অদ্ভুত আলো। ওরা প্রায় বাইরে চলেই এসেছিলেন। মনে হয়েছিল যাক বাঁচা গেল - এমন সময় একটা থাবা সুবালার বাম বাহুর উপরের দিকটা চেপে ধরে। আর্তনাদ বের হয়নি মুখ থেকে। কেমন যেন মনে হচ্ছিল ওর ফুসফুসটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাচ্ছে। আত্মা জাতীয় বস্তুটা শরীর ছেড়ে বাইরে বে্রিয়ে আসার জন্য হাঁসফাঁস করছে, আর ঠিক তখনই... রতনের হাত তার নিজের হাতের বাঁধন থেকে আলাদা হয়ে যায়। সম্ভবত মিঃ রায় সেটা বুঝতেও পারেননি।
আকাশেরও উগ্র রঙের বিপরীতে একটা লম্বা এবং রোগা সিলুয়েটের মতো রতনকে শেষবারের মতো হেঁটে যেতে দেখেন সুবালা। এক মুহুর্তের জন্য - তারপরেই মানুষটা মিলিয়ে যায়।

যে থাবা বা হাতটা সুবালাকে আঁকড়ে ধরছিল, সেটা কেমন যেন চ্যাটচেটে অথচ বানরদের হাতের মতো লোমশ। জান্তব উদ্যমে ওটা তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় গুহার একটা দেওয়ালের কাছে। সেখানেই ঝুলে ছিল ওটার দেহটা! কেমন দেখতে ছিল ওটা, সেটা মিসেস রায়ের স্পষ্ট মনে আছে!
শুধু দুটো জ্বলজ্বলে আলোকিত সবুজ চোখ।
'এসো এসো আমাদের উৎসবে যোগ দাও!' একটা খ্যাসখেসে গাঁইয়া ধরণের কন্ঠস্বর বলে ওঠে। সুবালার নাকে ভেসে আসে কাঁচা মাংস আর রক্তের গন্ধ। তার সাথে আরো জঘন্য কিছু যাতে গা গুলিয়ে ওঠে। অনেকটা আবর্জনার ড্রামের নিচের দুর্গন্ধের মতো।
সেই সবুজ চোখদুটো ছিল একেবারে বিড়ালের চোখের মতো। হঠাৎ করেই তার কেমন যেন মনে হয়, এই ছায়া জগতে যারা বাস করে তাদের চোখগুলোও নিশ্চিতভাবেই ওই ঘোলাটে চোখের গোলাপী রঙের চামড়া বের হওয়া ধূসর লোমওয়ালা বেড়ালটার মতো দেখতে।

এক ঝটকায় ওই হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটতে শুরু করে সুবালা। অনুভব করে তার কাছাকাছি বাতাসের মধ্যে দিয়ে কিছু একটা যেন পিছলে পিছলে এগিয়ে আসছে। একটা হাত? থাবা? একটা থুতু ছিটানোর মতো শব্দ হয়। হিসহিসে শব্দ -
আরও একটা ট্রেন বিকট শব্দ করে পাশ দিয়ে ছুটে চলে যায়। সে শব্দের মাত্রা ছিল অপরিমেয়। মাথা ঝনঝন করে উঠেছিল। কালো রঙের ঝুলকালি ঝরে ঝরে পড়ছিল তুষারের মতো। এরকম কিছুই যেন লেগেছিল তখন রতনের কোটের উপর। আতঙ্কের তাড়নায় অন্ধর মতো ছুটতে থাকে সুবালা। কোন দিকে বা কোথায় যাচ্ছিল না জেনেই ছুটে চলেছিল সে।
কতক্ষণ তাও জানে না।
একটাই চিন্তা তাকে নিজের ভেতর ফিরিয়ে এনেছিল, রতন নেই! হারিয়ে গেছে। দমবন্ধ হয়ে এসেছিল তার ব্যাপারটা অনুভব করে। অনেকক্ষণ ছোটার পর আর পারেননি। হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা নোংরা ইটের দেওয়ালের গায়ে। কান্নার দমকে নিঃশ্বাস নিতেই পারছিলেন না। উনি তখনও সেই একই রাস্তাতেই ছিলেন । অন্ততপক্ষে উনি নিজে এটাই বিশ্বাস করেন, সেটাই উনি বলেনও। প্রশস্ত বাঁধানো রাস্তার মাঝে ট্রামের লাইনটা আবার দেখতে পেয়েছিলেন সুবালা!

আশেপাশের নির্জন, দোকানগুলো আবার কেমন যেন বদলে গিয়েছিল । সারি সারি গম্বুজের মতো দেখতে লাগছিল ওগুলোকে। সব ভাঙ্গাচোরা । মিস্কাটোনিক ইউনিভার্সিটি, অ্যাডমিশন চলছে, রংচটা একটা পোস্টার লাগানো ছিল ওখানে। আর্খ্যাম অ্যান্ড সন্স, কালিঝুলি মাখা একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়েছিল সুবালার। একটা নাম দেখতে পেলেন আলহাজ্রেদ । বেগুনী রঙের বিবর্ণ ইটের ওপর উজ্জ্বল সবুজ রঙ দিয়ে টানাটানা প্রাচীন সময়ের অক্ষরের ধাঁচে লেখা ছিল শব্দটা। সেই নামের নীচে ছিল পর পর কিছু আঁকাবাঁকা অজানা অক্ষর এবং ড্যাসের সারি।

'রতন!' চিৎকার করে উঠেছিলেন সুবালা। চরম নীরবতা থাকা সত্ত্বেও এ শব্দের কোনও প্রতিধ্বনি ভেসে আসেনি । না, সম্পূর্ণ নীরবতা বোধহয় ছিল না ওখানে। দূর থেকে তখনও ট্র্যাফিকের শব্দ ভেসে আসছিল। এবার অনেকটা কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে। স্বামীর নামটা মিসেস রায়ের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়ে থপাক করে যেন পড়ে গেল রাস্তার ওপর। আকাশের রক্ত লাল আভা বদলে গিয়েছিল শীতল ধূসর ছাই রংয়েতে। এই সময় সুবালা অনুভব করেন এবার এই এলাকায় রাত ঘনিয়ে আসবে - সে রাতের রূপ কেমন হবে তাঅখানেও কূলকিনারা করাই যাচ্ছিল না - আর এই চিন্তাভাবনাই তার মনে নতুন করে সন্ত্রাস বয়ে নিয়ে এসেছিল।

মিসেস রায় হাঁটতে শুরু করলেন, মাঝে মাঝেই স্বামীর নাম ধরে ডাকছিলেন সাড়া পাওয়ার আশায়। অদ্ভুতভাবে তার কণ্ঠস্বরেরও কোনও প্রতিধ্বনি না হলেও তার পা ফেলার আওয়াজের কিন্তু হচ্ছিল। একটু একটু করে ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছিল রাস্তাটা। মাথার উপর আকাশ আবার বদলে গিয়েছিল, ধুসরতায় মিশেছিল লালচে বেগুনি রঙ ।

ওই আলো বা তার নিজের ক্লান্তির কিছু বিকৃত প্রভাব হতে পারে, কিন্তু ওই মুহূর্তে আশেপাশের সব কিছুকেই দেখে মনে হচ্ছিল সব যেন ক্ষুধার্তের মতো যেন অপেক্ষা করছে। সব কিছুর গায়ে জমে আছে কয়েক যুগের ধুলো – কয়েক শতাব্দীরও হতে পারে - ওগুলো যেন ডাবড্যাব করে তার দিকেই যেন তাকিয়েছিল। ওদের গায়ে লেখা নামগুলোকে যেন অদ্ভুত পাগলামিতে পেয়েছিল– ঠিক করে উচ্চারণ করাই যাচ্ছিল না শব্দগুলোকে। স্বরবর্ণগুলো কেমন যেন ভুল জায়গায় বসানো ছিল। আর বাকি অক্ষরগুলো এমন উলটো পালটা ভাবে পাশাপাশি অবস্থান করছিল যে কোনও মানুষের জিহ্বার পক্ষে তাদের উচ্চারণ করা অসম্ভব। থুলহু ফ’তাগন লেখা ছিল একটাতে। যার নীচে আরও অনেক আঁকা বাঁকা অক্ষরের সারি। আর একটায় দেখতে পাওয়া গেল ইয়োগ সোথোথ। আর’লিয়েহ লেখা ছিল অন্য আর একটার গায়ে। আরও একটার কথা ওর বিশেষভাবে মনে আছে: ন রট সেটন নায়ার লা হোটেপ।

'আপনি কীভাবে এমন সব অদ্ভুত শব্দগুলো মনে করতে পারছেন?' প্রবাহ জিজ্ঞাসা করে।

সুবালা রায় ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, 'জানি না। আমি সত্যিই জানি না। এ যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো যা আপনি জেগে ওঠার পর তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে চাইবেন। কিন্তু বেশিরভাগ স্বপ্নই তো আমরা ভুলে যাই। এটা কিছুতেই মন থেকে বিদায় নিচ্ছে না। এ যেন মনের ভেতর ঘুরপাক খেয়েই চলেছে, খেয়েই চলেছে, খেয়েই চলেছে।'

নুড়ি পাথরে বাঁধানো ট্রাম লাইনের দ্বারা বিভক্ত রাস্তাটাকে অনন্তের দিকে প্রসারিত বলে মনে হয়েছিল। তবুও সুবালা হাঁটতেই থাকে - ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন যে, ও দৌড়াতেও পারে, যদিও পরে আবার বলে, ও দৌড়ে ছিল। - ও আর রতনকে ডাকেনি। ভয়াবহ হাড় কাঁপানো আতঙ্কের স্রোতে এমনভাবে ডুবে গিয়েছিল যে তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না ব্যাপারটা। পাগল না হয়ে বা না মরে গিয়ে এমতাবস্থায় মানুষ এত কিছু সহ্য করতে পারে! যে ভয় তাকে চাদরের মতো আবৃত করে রেখেছিল সেই ভয়কে সোজাসুজি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

এরপরে মিসেস রায় তার নিজের মতো করে একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার যেন চেষ্টা করেন, বলেন - তার মনে হয়েছে উনি যেন আর এই পৃথিবীতেই ছিলেন না। পৌঁছে গিয়েছিলেন একটা অন্য গ্রহে। সেটা এমন একটা জায়গা যেটাকে মানুষের মন দিয়ে অনুভব করাই কঠিন। সেখানকার কোণগুলো একেবারেই অন্যরকম বলে মনে হয়েছিল। ওই স্থানের রংগুলোও সব আলাদা। যাকে ...যাকে একটা কথা দিয়েই বোঝানো যায়, সব কিছুই হতাশা মাখানো।

‘অদ্ভুতুড়ে জাম রঙা আকাশের নিচে অবস্থিত একটানা কিছু প্রাচীন আঁকা বাঁকা সারিবদ্ধ বাড়ির মাঝখানের অংশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি। একটাই আশা নিয়ে যে, এ পথ একসময় শেষ হবে।’
আর সেটা হয়েও ছিল।
সহসাই মিসেস রায় বুঝতে পারেন তার সামনে পাশের দিকে দেওয়ালের কাছে দুটো অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে - সেই শিশুদুটো যাদের উনি আর রতন আগে দেখেছিলেন। ছেলেটা তার সেই অদ্ভুত হাতটা দিয়ে ছোটো মেয়েটার চুল টানার চেষ্টা করছিল।
ছেলেটা বলল, 'আরে এ তো সেই বউটা।’
'দেখে মনে হচ্ছে পথ হারিয়ে ফেলেছে,' মেয়েটা বলল।
'স্বামীকেও হারিয়েছে।'
'পথও হারিয়েছে।'
'হবেই তো, অন্ধকারের পথ খুঁজে পেয়েছিল যে।'
'হ্যাঁ সেই পথ যা অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। '
'আশা ভরসাও হারিয়েছে মনে হচ্ছে।'
‘হ্যাঁ। ও যে তমসাচ্ছন্ন তারাদের জগতের বাঁশিওয়ালার ছোঁয়া পেয়েছিল -'
'- যারা সব মাত্রাকে গ্রাস করে -'
'-সেই সবুজ চোখের বাঁশিওয়ালা -'
ওদের কথাগুলো ক্রমশ দ্রুত থেকে আরো দ্রুত ভেসে এসেছিল, এক দম বন্ধ করা কবিতা আউরানোর মতো, যেন কিছু ঝলক। এ সব শুনে সুবালার মাথা ঘুরছিল। আশেপাশের বাড়িঘরগুলো ওর দিকে যেন ঝুঁকে আসছিল। আকাশের তারাগুলো সব মিলিয়ে গিয়েছিল। তার বদলে ফুটে উঠেছিল অন্য কিছু তারা। কিন্তু সেগুলো তার চেনা তারা নয়।যে তারাদের সে ছোটবেলায় অবাক চোখে চেয়ে দেখেছে বা যুবতী হিসাবে যার তলায় দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখেছে। এরা সেরকম তারা নয়। এদের আলো আছে কিন্তু কেমন যেন দ্যুতিবিহীন, অন্ধকারের প্রলেপ মাখা। এরা সব অদ্ভুত উন্মাদ তারার দল যাদের অবস্থান অজ্ঞাত নক্ষত্রমণ্ডলীতে। অন্ধকার জগতের নক্ষত্র এরা!

শিশু দুটোর কথা শুনবে না বলে সুবালা কানে হাত চাপা দিয়েছিল, কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। ওদের কথাগুলো ওর মাথায় এসে যেন ধাক্কা মারছিল।
অবশেষে মিসেস রায় চিৎকার করে ওঠেন, 'আমার স্বামী কোথায়? রতন কোথায়? তোমরা ওকে নিয়ে কী করেছ? '
কিছু সময়ের জন্য সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সে এক গা শিউরানো নীরবতা।
তারপর মেয়েটা বলল: 'সে নীচে চলে গেছে।'
ছেলেটা বলল: 'আর অনেকের সাথে সে চলে গেছে! তার কাছে, যার পায়ে ছাগলের মতো খুর! ।'
মেয়েটা হাসে – এক বিষাক্ত দূষিত অশুভ হাসি। 'সে হয়ত ঠিকঠাক যেতেও পারবে না, পারবে কী? ওকে তো বেছে নেওয়া হয়েছিল! কালো তুষার দ্বারা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। শোনো গো বউ, তুমিও যাও। যাবে?'
'রতন! তোমরা কী করেছ ওকে - '
ছেলেটি হাত তুলল এবং উচ্চকিত সুরেলা ভাষায় এমন কিছু শব্দ উচ্চারণ করল যা মিসেস রায় বুঝতে পারলেন না - তবে শব্দগুলির উচ্চারণ তাকে কেমন যেন দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল শিরা উপশিরায় এক পাগলামি নেচে বেড়াচ্ছে।

'জানেন রাস্তাটা তখন নড়তে শুরু করে দিয়েছিল! হ্যাঁ,' সুবালা হঠাৎ বলে ওঠেন এবার। ‘পাথরের টুকরোগুলো গালিচার মতো নরম হয়ে গিয়েছিল। ওগুলো উঠছিল আর নামছিল, জলের ঢেউয়ের মতো, নামছিল আর উঠছিল। ট্রামের লাইনদুটো আলগা হয়ে বাতাসে ভেসে কোথায় যেন উড়ে চলে গেল - আমার স্পষ্ট মনে আছে, লাইন দুটোর গায়ে ওই ম্রিয়মাণ তারাদের আলো জ্বলজ্বল করছিল - এরপর পাথরগুলোও একটা একটা করে রাস্তা থেকে উঠে যেতে থাকে উপরের দিকে। তারপর একসাথে অনেকগুলো। ঝপ ঝপ করে সব ওপরে উঠে যাচ্ছিল! মিলিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারের ভেতরে। কিছু ছিঁড়ে ফেললে যেমন শব্দ হয় ঠিক সেরকম শব্দ হচ্ছিল ওই সময়। একটা গুড় গুড় হুড় হুড় ধরণের শব্দ... সম্ভবত ভুমিকম্পে এরকম শব্দ হয়। আর – তারপরেই কিছু একটা আসতে শুরু করে - '

'কী?' আমি জিজ্ঞাসা করলাম। ঝুঁকে গেলাম সামনের দিকে। পারলে যেন তার মনের ভিতর ঢুকে পড়ব। 'কী দেখেছিলেন আপনি? ওটা কী আসছিল?'

'শুঁড়, কর্ষিকা' মিসেস রায় বললেন, ধীরে ধীরে থেমে থেমে l ‘আমার মনে হয়েছিল ওগুলো কর্ষিকা। অক্টোপাসের মতো শুড়! কিন্তু বটগাছের গুঁড়ির মতো মোটা। মনে হচ্ছিল ওগুলোর ভেতর হাজার হাজার ছোট ছোট কর্ষিকা আছে ... আর তার সাথেই আছে গোলাপী চোষক... যদিও সেগুলো দেখতে মুখের মতো...যার ভেতর একটা দেখতে একেবারে রতনের মুখের মতো ... প্রত্যেকটা মুখে ফুটে ছিল যন্ত্রণার ছাপ । ওদের নীচে, ওই কর্ষিকাগুলোর নীচে পাথর উঠে যাওয়া রাস্তার অন্ধকারে – অন্য কিছু ছিল। সবুজ চোখের মতো কিছু...'

এই সময় মিসেস রায়ের কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। যখন এই অবস্থা কাটল তখন আর বলার মতো কিছু ছিলই না। এর পরের যে অবস্থা তার স্পষ্টভাবে মনে পড়েছিল, সেটা হলো উনি একটা দোকানের দরজার সামনে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসেছিলেন । এই সময়েই দেখতে পান তার সামনের রাস্তা দিয়ে একটা আধটা গাড়ি চলাচল করছে। সাথেই ল্যাম্পপোস্টের আলো তাকে কিছুটা ধাতস্থ করে। দুজন মানুষের ছায়া অবয়ব দেখে সুবালা ভয়ে কুঁকড়ে সরে যান ছায়ার ভেতর। ওর মনে পড়ে যায় সেই, দুটো অদ্ভুত শিশুর অবশ্য এই ছায়া অবয়বেরা বাচ্চা ছিল না, দুটো কিশোর কিশোরী। হাতে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। ছেলেটা সত্যজিৎ রায়ের নতুন সিনেমা সম্পর্কে কিছু বলছিল।

ভয়ে ভয়ে ফুটপাথে নেমে আসেন উনি। সতর্ক সজাগ হয়ে, যাতে সেরকম কিছু ঘটলে যাতে আবার ওই দরজার কাছের ছায়ায় ফিরে যেতে পারেন। তবে তার কোনও প্রয়োজন হয়নি। পঞ্চাশ গজ দূরেই একটা মোটামুটি ব্যস্ত চৌরাস্তা দেখা যাচ্ছিল। গাড়ি এবং লরিগুলো প্রয়োজন মতো থেমে আলোক সংকেত অনুসারে এগিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার ওপারে বড় একটা আলোকিত ঘড়ি দেখা যাচ্ছিল এক জুয়েলারী দোকানের শোকেস উইন্ডোতে। তার সামনে অবশ্য ইস্পাতের গ্রিল দেওয়া ছিল, তবুও সুবালার বুঝতে অসুবিধা হয়নি কটা বাজে। দশটা বেজে পাঁচ মিনিট।
চৌরাস্তা পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন সুবালা। স্ট্রিট লাইটের চমক এবং চারপাশে ট্র্যাফিকের গোলমাল থাকা সত্বেও উনি বারবার চমকে উঠে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে পেছনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। সারা শরীর ফেটে পড়ছিল যন্ত্রণায়। সামান্য খোঁড়াচ্ছিলেন জুতোর একটা হিল খুলে যাওয়ার কারণে। মাঝে মাঝেই টান ধরছিল পেট আর পায়ের পেশীতে - ডান পায়ের অবস্থা তো শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল। যেন ওই পায়ের উপরেতে কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

মোড়ের মাথায় এসে দেখতে পান একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে সাদা চুলওয়ালা এক মহিলা প্রায় সমবয়সী এক পুরূষের সাথে কথা বলছিল। ওরা দুজনেই ওর দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন সে ভয় জাগানো একটা কিছু।
'পুলিশ,' মিসেস ককিয়ে ওঠেন, ' পুলিস স্টেশনটা কোথায়? আমার স্বামী হারিয়ে গেছে... পুলিসের সাথে কথা বলা দরকার।'
'কি হয়েছে গো, তোমার?' মহিলা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গীতেই জিজ্ঞাসা করলেন। 'তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি যেন ঝড়ের ভেতর চলে গিয়েছিলে।”

'গাড়ীর দুর্ঘটনা নাকি?' তার সঙ্গী জিজ্ঞাসা করেন।
'না। না ... না ... দয়া করে বলুন, এখানে কি কোনও পুলিস স্টেশন আছে? '
' হ্যাঁ এই রাস্তাটা ধরে কিছুটা হেঁটে গেলেই দিকশূন্যপুর পুলিস থানা,' লোকটি বলল।

বয়স্ক পুরুষ মহিলার দিকে তাকিয়ে বলেন, 'অনিতা আমি তাহলে ওকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি । যাতে ঠিকঠাক জায়গায় পৌছাতে পারে।'
'আমিও যাই তোমাদের সাথে, যাবো? ' অনিতা বলেন এবং সুবালার কাঁধের ওপর একটা হাত রাখেন।
‘এবার বলো তো মেয়ে ব্যাপারটা কী? কেউ কি তোমাকে ফাঁকায় পেয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেছে? '
'না, না, সে সব কিছু নয়' সুবালা বলেন। 'এটা...আমি... আমি... সেই রাস্তা... সেখানে একটা বিড়াল ছিল, যেটার কেবলমাত্র একটাই চোখ... রাস্তা হঠাৎ ফাঁক হয়ে গিয়েছিল ...আমি নিজে সেটা দেখেছি ... ওরা একজন সবুজ চোখের বাঁশিওয়ালা সম্পর্কে কিছু বলল... রতনকে খুঁজে বার করতে হবে!'
মিসেস রায় বুঝতে পারছিলেন যে, তিনি অসংলগ্ন কথা বলছেন, কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। কেমন যেন অসহায় বোধ হচ্ছিল তার। পরিষ্কার করে সাজিয়ে বলার ক্ষমতাই ওই মুহূর্তে ছিল না তার।
কিন্তু যেভাবেই হোক, বেশিক্ষণ এই সমস্যা পোয়াতে হয়নি। সেই বয়স্ক মানুষ দুটো একটু বাদেই ওকে ছেড়ে দুরে সরে যায়, যখন সে বলে তার এই অসংলগ্ন ভাবে কথা বলার কারণ মনের চাপ।
বয়স্ক ভদ্রলোক লোকটা তখন অনিতা নামের মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন - 'আবার হয়েছে, সেই রকম!’
মহিলা চোখ টিপলেন বলেই মনে হল সুবালার।
'ওই যে ওখানে পুলিস স্টেশন। ওই যে ওই লাইট পোস্টটার পরেই । এগিয়ে গেলেই বোর্ড দেখতে পাবে।' তারপর খুব তাড়াতাড়ি, ওরা দু'জন ওর কাছ থেকে সরে গেলেন। মহিলা একবার মাথা ঘু্রিয়ে তাকালেন ওর দিকে। ওদের ধন্যবাদ জানানো দরকার এটা মনে হতেই সুবালা ওদের দিকে কয়েক পা এগিয়েও যান।
'আমাদের কাছে এসো না!' অনিতা তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে বলেন এবং অদ্ভুত শয়তানি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। 'তুমি মহাচন্ডী টোয়েনে গিয়েছিলে বলেই মনে হচ্ছে। একদম আমাদের কাছে আসবে না! '
বলেই দুজন রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

এখানেই শেষ হয়েছিল জ্যোতিষদার নোটবুকের লেখা। প্রবাহদা থামলেন।
সুজয় জানতে চাইল, “এর সাথে আপনার চাকরি ছাড়ার সম্পর্ক কী তা তো বুঝলাম না দাদা?”
প্রবাহদা অদ্ভুতভাবে হাসলেন। “আরে সেটা তো এখনও বলিইনি। সেদিন অতক্ষণ একটানা ওই বিবরণ পড়ার পর কিছুটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলছিলাম। পুরোটাই কেমন যেন পাগলের প্রলাপ বলেই মনে হল এবার।
দেবাশিষদার গলা পেলাম, “আমি একটা রাউন্ড মেরে আসছি।”
'দেবাশিষদা, আপনি আর্খাম অ্যান্ড সন্স নামের দোকানের নাম শুনেছেন এর আগে?'
'তুমি এখনো ওই মেয়েটার কথাগুলো নিয়েই ভাবছ বুঝি? '
'হ্যাঁ, ইয়ে মানে...’
'কখনো শুনিনি.'
'রাজেন হালদার লেন?'
'রেজিনগর নতুন বাজারের আশেপাশেই হবে -'
'না এখানে কোথাও।'
'না - এখানে ও নামে কোনও রাস্তা নেই।'
'মহাচন্ডী টোয়েন নামের কিছু?'
‘ওটাও পাগলের প্রলাপ!'

এই সময় প্রবাহদার কথার মাঝে আমি, এই অধম গল্প লেখক বলে উঠলাম, “এরকম কিছু একটা কোথায় যেন পড়েছিলাম মনে হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এরকম কিছু একটা প্রথা একসময়।”

“হ্যাঁ প্রতিম, আমিও পরে খোঁজ খবর করে জেনেছিলাম। ইংল্যান্ডে প্রাচীন ড্রুইড প্রথা অনুসারে, একটি টোয়েন বা তোয়েন হল সেই স্থান সেখানে আচার অনুষ্ঠানে দেবতার উদ্দেশ্যে ভেট চড়ানো হত। সোজা কথায় বলি দেওয়া হত। তাও আবার মানুষ বলি। আসলে এ দেবতা তো আমাদের চেনাজানা দেবতা ছিলেন না।’

সুজয় আবার বলল, ‘সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু মহাচন্ডী কথাটা বাংলা তার সাথে টোয়েন না কী বলছেন সেটা তো যা বুঝছি বিদেশী। এ দুটো একসাথে হয় কী করে? মহাচন্ডীর থান বললেও না হয় বুঝতাম।’

প্রবাহদা বললেন, ‘কথাটা খারাপ বলিসনি, কিন্তু মাত্রা যখন তালগোল পাকিয়ে যায় তখন নামগুলো ঠিকঠাক কী করে থাকে বল?
যাই হোক আসল কথায় ফিরি, দেবাশীষদা বেরিয়ে যাওয়ার পর থানার দেওয়ালে দিকশূন্যপুরের একটা মানচিত্র ঝোলানো ছিল। আমি ওটার কাছে এগিয়ে গেলাম। ওখানে তুলনামূলকভাবে সব কিছুই যথেষ্ট বিশদভাবে সব কিছু দেখানো আছে। ভালো করে দেখতে থাকলাম। চারদিক এখন একেবারে নিস্তব্ধ। বড় বেশি শান্ত মনে হচ্ছিল।

ম্যাপের সেই জায়গাটাতে আঙুল রাখলাম, যেখানে সম্ভবত ট্যাক্সিওয়ালা ওদের ছেড়ে চলে যায়
(অবশ্য যদি মিসেস রায়ের গল্পটা সম্পর্কে বিশ্বাস করার মতো কিছু থাকে তবেই)। রজতবাবু যে পথে তার বাড়ি আসার কথা বলেছিলেন সেটাও কিছুটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। একাত্তরের কানা গলি বলে কিছু নেই। তবে রিফিঊজি ক্যাম্প লেন একটা আছে। পর পর ছয় বা আটটি বাড়ি আছে ওই রাস্তায়। খুব বেশি হলে এক মাইল মত সব মিলিয়ে। এইটুকু রাস্তায় কোনও মানুষের পক্ষে হারিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তার ওপর ওই সব ট্রাম লাইন, সাদা ট্রেন- নাহ মহিলার মাথাই খারাপ এটাই মনে হয়েছিল আমার।
প্যাকেটের সর্বশেষ সিগারেটটা ধরালাম। আর এই সময় বুঝতে পারলাম জ্যোতিষদা এখনও ফিরে আসেননি। এত দেরি হচ্ছে কেন?
সুবালা রায়কে একজন কনস্টেবল সার্কিট হাউস অবধি পৌছে দিতে গেছে। সে আর রাতে ফিরবে না বলেই গেছে। ভাবছিলাম, মিসেস রায়ের ছেলে মেয়ে যখন তাদের বাবার কথা জানতে চাইবে, উনি কী বলবেন? আশা করা যায় বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে দেবেন। নাকি ওদেরকে সেটাই বলবেন যা আমাদের বলে গেলেন? দিকশূন্যপুরের দানব ওদের বাবাকে গিলে খেয়ে ফেলেছে?
সব মিলিয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। চাইছিলাম সব ভুলে যেতে। এরকম একটা ঘটনা শোনার জন্য সে এই সময় থানায় না থাকলেই ভালো হত। জ্যোতিষদা এসব ভালোবাসেন, উনি সামলে নিতে পারতেন।

কিন্তু সে মানুষটা গেল কোথায়? অনেকক্ষণ আগেই তো উনি রাতের হাওয়ায় একটু পাইচারী করতে বেরিয়েছিলেন।

বাইরের গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শীতের রাত । কুয়াশা ভেসে আছে এদিকে সেদিকে। আলোগুলো কেমন যেন ম্রিয়মান। কেমন যেন বেগুনী আভা মাখা। সোজা তাকালাম রাস্তা বরাবর। না জ্যোতিষদাকে কোথাও দেখা গেল না। এখন রাত তিনটে । চারদিকে নীরবতা ঝুলে আছে মোটা পর্দার মত।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়ালাম । কেমন যেন এক অস্থিরতা অনুভুত হচ্ছিল। মিসেস রায়ের বলে যাওয়া গল্পটাকে মনের ভেতর বেশ ভালোই প্রভাব ফেলেছে বুঝতে পারছিলাম। অল্পবয়সে প্রথমবার ইভিল ডেড সিনেমা দেখে একা একা বাথরুমে যেতেও ভয় লাগত। অনেকটা সেরকম একটা শিরশিরে আতঙ্ক আমাকে ঘিরে ধরেছিল। কারণটা কী বুঝতে পারিনি তখন। বুঝেছিলাম আর কিছুটা পরে। আসলে দিকশূন্যপুরের মাত্রা তখন সত্যিই বদলে গিয়েছিল।
আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে শুরু করি সামনের মোড়টার দিকে। জানতাম ওইখানে একটা ছোট দোকান রাতে খোলা থাকে। যেখানে জ্যোতিষদা সিগারেট কিনতে যান। আশা করেছিলাম উনি ফিরে আসবেন ওই পথেই দেখা পেয়ে যাব। ওখানে না পেলে আর একটু এগিয়ে দেখব। তবে বেশী দূর যাওয়াটাও সম্ভব নয়। থানা একেবারে ফাঁকা রেখে সবাই চলে গেছে এটা যদি জানা জানি হয়ে যায় তাহলে সরকারী মহলে ধুন্দুমার বেঁধে যাবে।
মোড়ের মাথায় পৌঁছে আশেপাশে তাকালাম। অদ্ভুত মনে হলো চারপাশটা, এখানকার ল্যাম্পপোস্টগুলো কোথায় গেল? ওগুলোকে বাদ দিয়ে পুরো রাস্তাটাকে একেবারে আলাদা রকম দেখাচ্ছে। জাম রঙের আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে চারপাশ। কিন্তু জ্যোতিষদা কোথায়?

আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলাম । দেখাই যাক না কী হয়। তবে বেশি দূর যাব না। স্টেশনটাকে বেশীক্ষণ এ অবস্থায় ফাঁকা রেখে দেওয়াটা ঠিক হবে না মোটেই।

‘প্রবাহ! পালাও!’ আতঙ্ক মাখা ফিসফিসানি শুনেছিস কোনোদিন? হয়তো শুনেছিস। কিন্তু নির্জন নিস্তব্ধ রাতে ফাঁকা রাস্তায় সে যে কী ভয়ানক! মনে হয়েছিল কেউ যেন আমার শিরদাঁড়ায় বরফের আঙ্গুল দিয়ে পিয়ানো বাজাচ্ছে!

‘প্রবাহ! পালাও!’ জ্যোতিষদার গলা।
‘জ্যোতিষদা আপনি কোথায়?’
এবার আর ফিসফিসানি নয় দম আটকানো ঘ্যালঘেলে স্বরে উত্তর এল, ‘আমি কোথায় না জানলেও চলবে। নিজে বাঁচতে চাইলে পালাও । অন্তত ওই মোড়ের সীমানা পার হয়ে যাও সবার আগে। দিকশূন্যপুরে এখানকার মাত্রা বড়ই পাতলা। বলেছিলাম না তোমাকে?’
‘কিন্তু আপনি কোথায়?’ পিছাতে পিছাতে পিছাতেই প্রশ্ন করলাম আবার।
অদ্ভুত আলোয় মাখা সামনের আকাশে এবার আবির্ভাব হলো যার তাকে দেখে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া যে হয়নি সেটা আমার চোদ্দ পুরুষের আশীর্বাদ!’

থামলেন প্রবাহদা। মুখ দেখে বুঝতে পারলাম সেই ঘটনার চাপ কী পরিমাণ এখনো মানুষটাকে ব্যতিব্যস্ত করে। জলের বোতলটা এগিয়ে দিলাম। ঢকঢক করে প্রায় আধবোতল জল খেয়ে । মিনিট খানেক চুপ করে বসে থাকলেন। না আমরা কেউ বলতে পারিনি কিছু। উনিই বলতে শুরু করলেন।
‘কী দেখেছিলাম আন্দাজ করতে পারবি কেউ?’

উত্তরটা কী হতে পারে কিছুটা আন্দাজ আমি করেছিলাম। বাকিরাও হয়ত করেছিল কিন্তু কিছু বলেনি। প্রবাহদাই বললেন, ‘দুটো অতিকায় সবুজ চোখ। যার চারপাশ দিয়ে ঝুলে আছে লোম ওঠা বেড়ালের গোলাপী চামড়ার মতো একাধিক শুঁড়। তারই একটায় আটকে আছেন জ্যোতিষদা। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।
শেষবারের মতো উনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘পালাও! প্রবাহ!’
না আর দাঁড়াইনি, ঘুরে ছুটতে শুরু করেছিলাম। একটু বাদেই আমার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসে।
পরেরদিন আমার জ্ঞান ফেরে সদর হাসপাতালের বেডে।

রতন রায়কে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি অফিসার ইন চার্জ জ্যোতিষ চট্টরাজকেও। সুবালা রায়ের মাথার চুলগুলোও একরাতের ভেতরেই কেমন যেন খ্যাসটা মেরে গিয়েছিল।
যখন সূর্য একটা লাল এবং কমলা রঙের বলের আকারে বদলে যেত – উনি কুঁকড়ে যেতেন আতঙ্কে। চেষ্টা করতেন আলমারি জাতীয় কিছুর ভেতর ঢুকে পড়ার। আর অন্য সময়ে পেন বা পেন্সিল হাতের কাছে যা পেতেন, তাই দিয়ে গোটা কয়েক কথা বার বার লিখতেন।
“ভয় পেতে হবে, ছাগলের মতো খুর! সবুজ বড় বড় চোখ! সাবধান ওরা আছে, আমাদের আশে পাশেই!”
এক মাস পরে উনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এরপর একটা বিশেষ হোমে প্রায় নব্বই দিন তাকে রাখা হয়। যার ফলে তার মানসিক স্বাস্থ্যের অনেকটাই উন্নতি হয়।

আমাকে পাওয়া গিয়েছিল একটা ল্যাম্প পোস্টের নিচে। সম্ভবত ওটার সাথে ধাক্কা খেয়েই আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। আমি শুধু একটাই কথা বলেছিলাম, আমার কিছু মনে নেই। বাস্তবে কী ঘটেছিল, সেটা এই প্রথম বললাম। জ্যোতিষ চট্টরাজ যা ভাবতেন, যা বিশ্বাস করতেন, যা দেখার আশা করেছিলেন সেটাই দেখতে পেয়েছিলেন।
আমাদের চেনাশোনা মাত্রার ওপারে যে দানবেরা বাস করে, তারা মাঝে মাঝেই ঢুকে পড়ে এ জগতে। উঠিয়ে নিয়ে যায় কিছু মানুষকে! কেন? উত্তর জানা নেই? হতে পারে আমরা আসলে তাদের শিকার, তাদের খাদ্য অথবা তাদের উপাস্য দেবতার জন্য বলির পশু। কে জানে এরাই সেই ‘এল্ডার ওয়ান’ নামক অজানা নক্ষত্রের জগত থেকে আসা সুপ্রাচীন সত্ত্বাদের উপাসক কিনা? যাদের কথা লাভক্র্যাফট লিখে রেখে গেছেন।



দিকশূন্যপুর, যা সত্যিই এক অতি শান্ত শহরতলী। সেখানে আজও সময়ে সময়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। বদলে যায় মাত্রা। লোকেরা তাদের পথ মাঝে মাঝেই হারিয়ে ফেলে বলেই শোনা যায়। যাদের ভেতর আবার কেউ কেউ চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়।
আর প্রবাহ চাকলাদারের কানে মাঝে মাঝে ভেসে আসে অফিসার ইনচার্জ জ্যোতিষ চট্টরাজের বলা কথাগুলো, “আসলে এরকম ক্ষীণমাত্রা বিশিষ্ট জায়গা তো এই দিকশূন্যপুর। সেটা জানি বলেই, আমি নিজেকে এটাই বলি, এরকম একটা দিন কী আসবে না, যেদিন আমাদের আর ওই অন্য মাত্রার মাঝের চামড়ার আস্তরণটা ধুয়ে মুছে ঘষে সাফ হয়ে যাবে? এরকম কোন দিন কী আসবে না যেদিন ওই মেয়েটা সত্যি ঘটনা বলে যা শুনিয়ে গেল তার অর্ধেকটা অন্তত বাস্তব হবে? সেই দিনটা দেখার জন্যই তো আমি এই থানা ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না।”


[স্টিফেন কিং এর “ক্রাউচ এন্ড” কাহিনী অবলম্বনে।]

No comments:

Post a Comment