রবার্ট ই হাওয়ার্ড
আগুন পাখির ছাপ
অনুবাদ - প্রতিম
দাস
০০০০০
“হে
রাজপুত্র, জেনে
রাখুন সেই সময়ের অন্তর্বতী সময়ে যখন মহাসাগর
গ্রাস করেছিল আটলান্টিস এবং তার গৌরবময় শহরগু্লোকে, যখন আর্য পুত্রদের উত্থান হয়েছিল, সেই সময়ে স্বপ্নের অতীত এক যুগ তারা ভরা আকাশের নিচে
নীলাভ দ্যুতির মতো এক যুগ সারা বিশ্ব জুড়ে বিরাজমান ছিল। যেখানে ছিল নেমেডিয়া, ওফির, ব্রাইথুনিয়া, হাইপারবোরিয়া, জামোরার
কালো কেশ সজ্জিতা নারী এবং মাকড়সার জালে ঘেরা রহস্যময় মিনার, জিঙ্গারার
শৌর্য, শেমের
দিগন্ত বিস্তৃত বনভুমির সীমান্ত ঘেরা কোথ, স্টিগিয়ার ছায়া-রক্ষিত সমাধি, ইস্পাত, রেশম
এবং সোনার পোশাক পরিহিত হিরকানিয়ার অশ্বারোহীর দল। আর এদের ভেতরেই ছিল বিশ্বের
সবচেয়ে গৌরবময় রাজত্ব, অ্যাকুইলোনিয়া। স্বপ্নমাখা পশ্চিম সীমান্তের সবচেয়ে
বড় রাজ্য। এখানেই এসেছিল এক তস্কর তথা এক
লুণ্ঠনকারী তথা হন্তারক। কালো তার চুল, বড় বড় চোখ, হাতে খোলা তরোয়াল, এক চুড়ান্ত
হতাশার প্রতিচ্ছবি আবার একইসঙ্গে আমুদে এক চরিত্র। সিমারিয়ার কোনান। সে এসেছিল এ পৃথিবীর রত্ন
সিংহাসনকে তাঁর পদানত করতে।”
- নেমেডিয়ান
ক্রনিকলস
১
ছায়াচ্ছন্ন গম্বুজ আর চকচকে মিনারগুলোর উপর ভোরের আলো এসে
পরার আগের ভুতুড়ে অন্ধকার ছড়িয়ে ছিল। এর ভেতরেই এক ম্লান আবছা আলো মাখা গোলকধাঁধা সম গলিপথের একটা দরজা খুলে যায়।
খুলে দেয় এক অজ্ঞাত হাত। তড়িঘড়ি করে নেমে আসে চার মুখোশধারী। একটাও কথা না বলে গা
মাথা আচ্ছাদিত করা মানুষগুলো হাঁটতে শুরু করে।
নিঃশব্দে একেবারে ভুতের মতোই ওরা এক সময় অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওদের পিছনে
সামান্য খোলা দরজার কাছে তখনও দাঁড়িয়েছিল
এক আবছা অবয়ব। দুটো শয়তানি মাখা চোখ জ্বলজ্বল করতে
দেখা গেল ওখানে।
বিদ্রূপমাখা স্বরে এক কন্ঠ শোনা গেল, "নিশাচরের
দল, যা রাতের অন্ধকারত আশ্রয় করেই চলে যা।
ওরে মুর্খের দল, তোরা জানিসই না, দুর্ভাগ্য ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো
তোদের পিছু নিয়েছে। "
দরজা বন্ধ করে হুড়কো লাগিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল অবয়বটা। চলে গেল করিডোরের দিকে। হাতে তার মোমবাতি। এক গম্ভীর দানবিক অবয়ব, যার কালচে গায়ের চামড়া
প্রমাণ দিচ্ছে ওর শরীরে বইছে স্টিগিয়ানদের
রক্ত। প্রবেশ করল এক অভ্যন্তরীণ কক্ষে, যেখানে
রেশমে মোড়ানো পালঙ্কের উপর বিশাল ধুসর বিড়ালের মত শুয়ে ছিল জীর্ণ ভেলভেটের
পোশাক পরা লম্বা রোগা এক মানুষ। হাতে তার বিরাট মাপের সোনালী পানপাত্র।
মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়ে স্টিগিয়ান বলল, "অ্যাসকালান্টে, আপনার
স্যাঙ্গাতেরা তো গর্তের ভিতর থেকে ইঁদুর বের হওয়ার মতো করে চলে গেল। ভালোই সব
যন্তর জুটিয়েছেন দেখছি।"
"যন্তর?" অ্যাসকালান্টে উত্তর দিলেন, “এর তো একটাই
অর্থ হয় যে, আমি ওদের চালক! আরে, ওরা
আমাকে কেন নিজেদের চালক ভাববে? বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল আমি এই নগরে একেবারে শত্রুদের
মাঝখানে বসবাস করছি। সারাদিন আমাকে এই ঘুপচি বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হয়। রাতে অন্ধকার
গলির ভিতর যাহোক একটু চলাফেরার সুযোগ পাই। দক্ষিণ মরুভূমির চার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর
কাছ থেকে ডাক এসেছিল সেই সময়েই। আমি খুব ভালো করেই জানি ওই মহান বিদ্রোহীরা কী
করতে পারে আর না পারে। সেই তখন থেকেই এই নগরীর প্রায় প্রতিটা জায়গায় আমি রাষ্ট্রদ্রোহ
আর অশান্তির বীজ বপন করে দিয়েছি। সোজা কথায়,
ছায়ার আড়ালে থেকে সূর্যের আলোর নিচে বসে থাকা রাজাকে উচ্ছেদের পথ প্রশস্ত
করছি আমি। মিত্রার দিব্যি, এটা ভুলে যেও না দস্যু হওয়ার আগে আমিও একজন
কূটনীতিক ছিলাম।
"তারমানে
এই হতচ্ছাড়াগুলোই এখন আপনার প্রভু?"
“হ্যাঁ, আমি চাই ওরা এটা ভাবতে থাকুক যে, আমি ওদের সেবা
করছি, যতক্ষণ না আমাদের প্রাথমিক কাজ শেষ হচ্ছে। অ্যাস্কালান্টের বুদ্ধির সঙ্গে কে
তাল মেলাবে শুনি? কারাবানের
বামন কাউন্ট ভলমানা? ব্ল্যাক লিজিয়নের দৈত্যকায় কমান্ডার গ্রোমেল? অ্যাট্টালাসের
হোঁদল কুতকুতে ব্যারন ডিওন, নাকি রিনালদো নামের সেই খরগোসের মতো বুদ্ধিধারী
কবি? আমিই সেই শক্তি যে ওদেরকে মাটি থেকে
উঠিয়ে শক্ত ইস্পাতে পরিণত করেছি। সময় এলে আমিই ওদের ধুলোয় মিশিয়ে দেব। তবে সেটা
ভবিষ্যতের গল্প, আপাতত আজ রাতে রাজা খতম হবেন।”
"ইয়ে,
কয়েকদিন আগে দেখলাম যে রাজকীয় বাহিনী শহর থেকে কোথাও যেন গেল," স্টিগিয়ান বলল।
"ওরা
সীমান্তের দিকে গিয়েছে। বিধর্মী পিক্টদের সায়েস্তা করার জন্য–এর পিছনেও আমার হাত
আছে ধরে নিতেই পারো। আমার সরবরাহ করা কড়া মদ খেয়েই পিক্টদের পাগলামি বেড়েছে। ডিওনের
সম্পদ কাজে লেগেছে এ ক্ষেত্রে। আর এদিকে নগরে থাকা বাকি রাজকীয় সেনাদের দায়িত্ব
নিয়ে নিয়েছে ভলমানা। নেমেডিয়ায় ওর রাজপুত্র সুত্রের
সম্পর্ক থাকার কারণে সহজ হয়েছে মহারাজ নুমাকে দিয়ে অ্যাকুইলোনিয়ার ধার্মিক প্রধান
পোইটেনের কাউন্ট ট্রোসেরোকে সম্মানের সঙ্গে উপস্থিতির জন্য অনুরোধ জানানো। সেই সাম্মানিক
আমন্ত্রণ জানাতে রাজকীয় প্রতিনিধি তার
কাছে যাবে নিজস্ব বাহিনী নিয়ে। সঙ্গে থাকবে প্রসপেরো। যে
আবার মহারাজ কোনানের ডান হাত স্বরুপ। এর ফলে মহারাজ নুমার কাছে থাকছে কেবলমাত্র
তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা। বাকি থাকছে ব্ল্যাক লিজিয়ানরা। গ্রোমালের
মাধ্যমে আমি ওই রক্ষীদের একজন নেতাকে উৎকোচ প্রদান করে দলে টেনে নিয়েছি। মাঝরাতে
সে তার লোকেদের যেভাবেই হোক মহারাজের কক্ষের দরজা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে
যাবে।
“এরপরেই
আমরা গোপন সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে আমার বাছাই করা ষোলজন বেপরোয়া গুন্ডাকে নিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করব। আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে
অবশ্য স্বাগত জানানোর মতো কোনও মানুষ থাকবে না। কারণ গ্রোমেলের ব্ল্যাক লিজিয়ন তখন
শহর এবং রাজমুকুট সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে নেবে।"
"তারমানে,
ডিওন কী এটাই মনে করে যে, তাকে রাজমুকুট দেওয়া হবে?"
"হ্যাঁ,
মোটা হাঁদাটা রাজকীয় রক্তের সুত্রে এটার দাবি জানিয়েছে। কোনান এই একটাই ভুল করে
রেখেছে, এখনও সেই পুরাতন রাজবংশর গর্ব করে এমন পুরুষদের বাঁচিয়ে রেখেছে। একদা
যাদের কাছ থেকে ও অ্যাকুইলোনিয়ার মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছিল।
“ভলমানাও
চাইছে পুনরায় পুরানো রাজপরিবারের শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসুক। তাহলে
তার আনুকুল্যে সে তার দারিদ্র্যপীড়িত এস্টেটগুলোকে আগের মতো জাঁকজমক পূর্ণ করে
তুলবে। ফিরিয়ে আনবে পূর্বের আড়ম্বর। ব্ল্যাক ড্রাগনের কমান্ডার প্যালানটাইডেসকে
ঘৃণা করে গ্রোমেল। সে চায় বসসোনিয়ান একগুঁয়েমি সহকারে পুরো সেনাবাহিনীর কমান্ডার
হতে। একমাত্র রিনালদোর কোনও ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। ওর চোখে কোনান হলো এক
লালচে হাত আর রুক্ষ পাওয়ালা অসভ্য বর্বর, যে উত্তরদিক থেকে এসেছে সভ্যদের জগতকে তছনছ করে দিতে। কোনান
রাজা হওয়ার জন্য যাকে হত্যা করেছিল, সেই ছিল রিনালদোর কাছে আদর্শ শাসকের রূপ। তার কারণ সেই রাজা মাঝে মাঝে
তার চারুকলার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। যে কারণে, সে ওই শাসকের খারাপ দিকগুলো দেখতেই
পায় না এবং এটাই চায় যে সাধারণ মানুষও সেগুলো ভুলে যাক। ইতিমধ্যেই অনেকেই খোলাখুলিভাবে সেই গাথা গায়,
যেখানে রিনালদো এক শয়তানকে মহিমান্বিত
করেছে, আর কোনানের করেছে নিন্দা । বলেছে,
কোনান হলো, ‘অতল
করাল গহ্বর থেকে উঠে আসা এক কৃষ্ণকায় বীভৎসতা।’ কোনান অবশ্য
এসব শুনে হাসে। কিন্তু মানুষ ক্ষেপে যায়।
"কিন্তু
সে কেন কোনানকে ঘৃণা করে?"
24.09.2025
“কবিরা
সর্বদাই ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের ঘৃণা করে। তাদের কাছে
পরিপূর্ণতার অর্থ কোণঠাসা হওয়া বা কারোর পিছনে অপেক্ষা করা। অতীত এবং ভবিষ্যতের
স্বপ্নকে ঢাল বানিয়ে এরা বর্তমান থেকে সবসময় দূরে থাকে। রিনালদো
আদর্শবাদের এক জ্বলন্ত মশাল। সে মনে করে
একজন অত্যাচারীকে উৎখাত করে জনগণকে মুক্ত করার জন্য সে কিছু করছে। আর আমার
কথা যদি বলো-কয়েক মাস আগে আমি সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। মনে হচ্ছিল
সারা জীবন কাফেলা পরীক্ষা করেই কেটে যাবে। কিন্তু এখন পুরনো স্বপ্ন আমায় আলোড়িত
করছে। কোনান মারা যাবে; ডিওন
সিংহাসনে বসবে। তারপর সেও মারা যাবে। এক এক করে, যারাই আমার বিরোধিতা করেছে সব মারা যাবে–আগুনে হোক বা
অস্ত্রাঘাতে বা সেই মারাত্মক মদ, তুমি তো জানোই কীভাবে সেটা বানাতে হয়। তারপর, অ্যাসকালান্টে, অ্যাকুইলোনিয়ার
রাজা! কী কেমন শুনতে লাগছে? ”
স্টিগিয়ান তার প্রশস্ত কাঁধ ঝাঁকাল ।
"একটা সময় ছিল," একরাশ তিক্ততার সঙ্গে সে বলল, "যখন আমারও
উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, আপনাদের
পাশে অবশ্য তা নেহাতই বালখিল্য সুলভ। আজ কী অবস্থায় পড়ে আছি! সেই পুরনো সময়ে যারা
আমার সমকক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তারা আজ আমাকে দেখে নিশ্চিত এটাই ভাবে যে, একদা ‘রিং’য়ের সদস্য থথ-অ্যামন আজ এক বিদেশীর দাস
হিসাবে কাজ করছে। পরিণত হয়েছে আইনভাঙা গুন্ডায়।
সাহায্য করছে ক্ষুদ্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার মোহে আচ্ছন্ন ব্যারন আর রাজাদের! ”
"তুমি তোমার যাদু আর মন্ত্রশক্তির উপর ভরসা রেখেছিলে," অ্যাস্ক্যালান্টে
উত্তর দিল মামুলী স্বরে। "আমি বিশ্বাস রেখেছি আমার কূটবুদ্ধি আর আমার
তরোয়ালের উপর। "
"কূটবুদ্ধি আর তরোয়াল, অন্ধকারের প্রজ্ঞার সামনে
খড়কে কাঠির সমান,"
স্টিগিয়ান গর্জে উঠল। ওর কালো চোখগুলো ভয়ানকভাবে জ্বলজ্বল করে “আমি যদি আংটিটা আমার কাছ থেকে খোয়া
না যেত, তাহলে আজ আমাদের অবস্থান উলটো হত।"
কিছুটা অস্বস্তি সহকারে অ্যাস্কাল্যান্টে বলল, "তবুও, তোকে
আমার চাবুকের দাগ পিঠে নিয়েই ঘুরতে হবে এবং সম্ভবত আর অনেক দাগ যুক্ত হবে
ওখানে।"
"অত নিশ্চিত হবেন না!" স্টিগিয়ানের চোখে তাত্ক্ষণিকভাবে ঝলসে উঠল
বিদ্বেষের চমক।
“কোনও
একদিন,
যেভাবেই হোক আবার আমি আংটিটা খুঁজে পাব। আর যেদিন
পাব সেদিন সেটের সর্প জিহ্বার দিব্যি, আপনাকে দাম চোকাতে—”
কথা শেষ করার আগেই
ক্রোধে উন্মত্ত অ্যাস্কালান্টে বক্তার মুখে সজোরে আঘাত করল। থথ
পিছিয়ে গেল, ঠোঁঠ ফেটে বেরিয়ে এল রক্ত।
"কুত্তার বাচ্চা, অত্যধিক সাহস হয়ে গেছে তোর, "চেঁচিয়ে উঠল
যড়যন্ত্রকারী দস্যু। "ভুলে যাস না
আমি এখনও তোর সেই প্রভু, যে তোর গোপন অন্ধকার রহস্য জানে। সাহস
থাকে তো যা দেখি বাড়ির ছাদে উঠে চিৎকার করে বল – অ্যাস্কালান্টে এই নগরের ভেতরে
বসে রাজার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে–আছে সাহস?"
ঠোঁট থেকে রক্ত মুছে
স্টিগিয়ান বিড়বিড় করে, “না
সে সাহস আমি দেখাব না।”
"সে সাহস দেখানোর স্বপ্নও দেখিস না, যদি মাথায় কিছু
থাকে," অ্যাসকাল্যান্টে
নির্লজ্জভাবে মুচকি হেসে বলল, “কারণ তোর কোনোরকম বিশ্বাসঘাতকতার কারণে যদি আমি মরে
যাই, তাহলে
দক্ষিণ মরুভূমির একজন সাধু পুরোহিত সেটা জেনে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে সে তার কাছে রেখে
আসা একটা পাণ্ডুলিপির সিলমোহর ভেঙে ফেলবে। সে ওটা পাঠ
করা মাত্র, স্টিগিয়ায়
একটা শব্দ ফিসফিস করতে শোনা যাবে। সঙ্গেই মাঝরাতে
দক্ষিণ দিক থেকে বয়ে আসবে এক হাওয়া। তখন তোমার মাথাটা কোথায় লুকিয়ে রাখবে, থথ-আমন?"
কাঁপতে থাকা ক্রীতদাসের কালচে মুখে ছড়িয়ে গেল ফ্যাকাশে
রঙ।
"অনেক হয়েছে!" অ্যাসকালান্টে তার সুর বদলে বললেন “তোমার জন্য আমার
কাছে অন্য কাজ আছে। আমি ডিওনকে বিশ্বাস করি না। সেজন্যই
ওকে ওর নিজের দেশের বাড়িতে চলে যেতে
বলেছি। জানিয়েছি আজ রাতের কাজ শেষ না
হওয়া পর্যন্ত সে যেন সেখানেই থাকে। মোটা
হাঁদাটা নিজের বিচলিত ভাব কিছুতেই আজ মহারাজের সামনে গোপন করতে পারত না। ওকে
অনুসরণ করবে, কখনই ওকে পেরিয়ে যাবে না। ওর এস্টেট অবধি যাবে এবং ওখানেই থাকবে।
যতক্ষণ না আমরা কিছু জানাই। একদম চোখের
আড়াল করবে না। হয়ত আতঙ্কে সে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, হতবাক হয়ে যেতে পারে-এমনকি
আতঙ্কের ভার সহ্য করতে না পেরে কোনানের কাছেও যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। বলে
দিতে পারে সব কথা, আমাদের পরিকল্পনা।
নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে এটা করতেই পারে!"
চোখের ঘৃণা লুকিয়ে থথ সম্মতির ভঙ্গীতে মাথা নিচু করে এবং
তাকে যা বলা হল সে কাজ করতে চলে যায়। অ্যাস্কালান্টে আবার তার পানপাত্র হাতে তুলে
নেয়। দূরে রত্নখচিত মিনারের পেছন দিকে এক
রক্ত রাঙা ভোরের উদয় হয় ।
২
যখন আমি একজন যোদ্ধা ছিলাম, তখন ওরা ড্রাম বাজিয়ে আমায় সম্মান
জানাত,
আমার ঘোড়ার পায়ের সামনে ছুঁড়ে দিত সোনার রেনু;
আর যখন আমি একজন মহান রাজা, তখন সবাই প্রতিনিয়ত সুযোগ খুঁজছে
কী করে আমার পানপাত্রে বিষ মেশানো যায় বা করা যায় পৃষ্ঠদেশে
ছুরিকাঘাত।
- দ্যা রোড অফ কিংস
বেশ বড় মাপের ঘরটা দারুনভাবে সাজানো। ঝকঝকে পালিশ করা ‘প্যানেল’ওয়ালা
দেওয়ালে ঝুলছে মহার্ঘ ‘ট্যাপেস্ট্রি’।
হাতির দাঁত নির্মিত মেঝেতে মোটা গালিচা পাতা। উঁচু ছাদের গায়ে সুক্ষ্ম
খোদাইয়ের কাজ সঙ্গেই রুপোর কারুকার্য। হাতির দাঁত আর সোনায় সজ্জিত একটা লিখন বেদীর
পিছনে এমন এক মানুষ বসেছিল, যার বৃষস্কন্ধ
এবং রোদে পোড়া চামড়া এই বিলাসবহুল কক্ষের সঙ্গে কেমন যেন বেমানান। মনে হচ্ছে মানুষটা
দুরবর্তী উঁচু এলাকার কোন খোলামেলা প্রকৃতির আলোবাতাস মেখেই দিন কাটিয়েছে। সামান্যতম
নড়চড়াতে পেশীর আন্দোলন জানান দিচ্ছে জন্মযোদ্ধা মানুষটার মাথায় কিছু একটা ভাবনা
খেলা করছে। তবে ঠিক কী সেটা বোঝার উপায় নেই।
হয় মানুষটা পুরোপুরি বিশ্রাম মগ্ন-একেবারে ব্রোঞ্জের মূর্তির মতো-অথবা অন্য কোনও এক
গতিশক্তি তার ভিতর কাজ করছে। সেটা অত্যধিক উদ্বিগ্ন স্নায়ুর চঞ্চলতা নয় মোটেই,
বরং বিড়ালের সেই গতি যা তার অনুসরণকারীর
দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয়। যে পোশাক তার পরনে তা অতি দামী কাপড়ের হলেও অতি সাধারণভাবে
বানানো। হাতে কোনও আংটি নেই। গায়ে নেই কোন অলঙ্কার। মাথায় ঝুলে থাকা বর্গক্ষেত্র
আকারের কালো ঘনচুল আটকানো আছে রুপোর
ব্যান্ড দিয়ে।
হাতের সোনার কীলকটা
মানুষটা নামিয়ে রাখল পাশে। ওটা দিয়ে মোম আবৃত প্যাপিরাসে দীর্ঘ সময় ধরে কিছু
লিখছিল সে। তারপর হাতের উপর চিবুক রেখে ধোঁয়াটে নীল চোখ দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা
মানুষটার দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকাল। ওই ব্যক্তিটি
এই মুহুর্তে তার নিজের দরকারেই উপস্থিত হয়েছে। গায়ে
চাপিয়েছে সোনার কাজ করা বর্ম, মুখে শিসের ধ্বনি। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত কারণ সে এই
মুহূর্তে একজন রাজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
টেবিলের পিছনে বসে থাকা মানুষটা বলল, "প্রসপেরো, রাজ্য বিষয়ক এই সব ব্যাপার স্যাপার দেখাশোনা
করাটা আমার কাছে যুদ্ধ করার চেয়ে বেশি ক্লান্তিদায়ক।”
25.09.2025
কালচে চোখের অধিকারী পোইটানিয়ান যোদ্ধা উত্তর দিল, “সবই
দায়িত্বের ব্যাপার কোনান। আপনি রাজা– আপনাকে তো নিজের দায়িত্ব
অবশ্যই পালন করতে হবে। "
"আমার ইচ্ছে হচ্ছে আমি তোমার সঙ্গে নেমেডিয়ায় চলে
যাই," কোনানের
স্বরে ঈর্ষার ছোঁয়া। “কয়েক
যুগ কেটে গেল বোধ আমি ঘোড়ায় চাপিনি–কী আর করা যাবে! পাবলিয়াস বলছিল নগরে আমাকে নাকি খুব দরকার। নিকুচি করেছে দরকারের!”
পোইটানিয়ান সহচরের সঙ্গে যে একটা অন্যরকম সহজ সরল সম্পর্ক
বিদ্যমান সেটা বোঝাই যাচ্ছিল কোনানের কথা বলার সুরেই। "পুরোনো সাম্রাজ্য উৎখাত করার কাজ অনেক
বেশি সহজ ছিল। তার তুলনায় এখনকার সময় একেবারে বিশ্রী। যে বন্য বর্বর পথ আমি অনুসরণ করে এসেছি, সেই
সমস্ত পরিশ্রমের দিন, চক্রান্ত, ক্লেশ,
হানাহানির কথা নতুন করে ভাবলে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
“আমি
এত কিছু পাওয়ার স্বপ্ন দেখিনি, প্রসপেরো। আমার পায়ের কাছে মরে পড়ে থাকা রাজা নুমেডাইডিসের
মাথা থেকে যখন মুকুটটা খুলে নিয়ে নিজের মাথায় পরেছিলাম, তখনই আমি
আমার স্বপ্নের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে যাই। আমি মুকুট দখল করতে প্রস্তুত ছিলাম,
কিন্তু সেটা ধারন করে রাখার ইচ্ছে আমার ছিল না। সেইসব স্বাধীন পুরানো দিনগুলোতে
আমার একটাই সোজাসুজি লক্ষ্য ছিল, তরোয়াল হাতে শত্রুদের নিকেশ করা। আর এখন আর
লক্ষ্য কেমন যেন বেঁকে চুরে গেছে। তরোয়ালটা কোন কাজেই লাগছে না।
“যখন
নুমেডাইডিসকে উচ্ছেদ করেছি,
তখন ওদের কাছে আমি ছিলাম মুক্তিদাতা–আর এখন ওরাই আমার ছায়ায় থুতু ফেলে। ওরাই
এখন সেই শুয়োরের বাচ্চার মূর্তি স্থাপন করেছে মিত্রার মন্দিরে। যেখানে গিয়ে লোকেরা দুঃখ প্রকাশ করে। বিলাপ করে। এখন
তাদের কাছে উনি একজন ভালো মানুষ! যাকে এক লাল-হাতওয়ালা বর্বর হত্যা করেছিল। যখন
আমি অ্যাকুইলোনিয়ার সেনাবাহিনীকে বিজয়ের রাস্তা দেখিয়েছিলাম তখন ওরা ভুলে গিয়েছিল
আমি একজন ভাড়াটে সেনা। একজন বিদেশী। আর
এখন তাদের কাছেই আমি ক্ষমার অযোগ্য ব্যক্তি।
"এখন মানুষ মিত্রার মন্দিরে নুমেডাইডিসের স্মৃতিতে ধূপ
জ্বালাতে আসে। এমন একজন মানুষের জন্য যার অধীনস্থ
ভাড়াটে খুনির দল একদা তাদের জীবন ছারখার করে দিয়েছিল। ওদের অনেকের সন্তান শেষ
নিঃশ্বাস ফেলেছিল মাটির নিচের কারাগারে। ওদের মেয়ে বউকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল হারেমে।
কী অদ্ভুত বোকা এরা!”
নিজের তরোয়ালের খাপে একটা আঘাত করে প্রসপেরো বলল, "এর জন্য
রিনালদো বেশি দায়ী। সে এমন গান মানুষকে শোনাচ্ছে যা লোককে ভুল বোঝাতে সাহায্য
করছে। সময় নষ্ট না করে ওই হতচ্ছাড়াকে নগরের সর্বোচ্চ মিনারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিন। শকুনদেরকে
গান শোনাক ব্যাটা।”
কোনান তার সিংহের মতো বিরাট মাথা নেড়ে বলল, “সম্ভব নয়, প্রসপেরো, সে আমার
নাগালের বাইরে। যে কোনও বড় কবি একজন রাজার চেয়েও মহান। তাঁর গানগুলো আমার রাজদণ্ডর
চেয়েও শক্তিশালী; কারণ
সে যখন তার গানের জন্য আমাকে বেছে নেবে তখন সে আসলে আমার বুক থেকে হৃদয়টাকেই উপড়ে নেবে। আমি মরে
যাব, মানুষ আমাকে ভুলে যাব,
কিন্তু রিনালদোর গান বেঁচে থাকবে চিরকাল।
“না, প্রসপেরো,” একটা সন্দেহ
মাখা দৃষ্টিতে কোনান বলল, “কিছু একটা গোপন ব্যাপার আছে, এমন কিছুটা অন্তর্নিহিত গোলমাল যার বিষয়ে আমরা
সচেতন নই। যৌবনে যেমন লম্বা ঘাসের ভিতর লুকিয়ে থাকা বাঘের অস্তিত্ব অনুভব করতে
পারতাম সেরকমভাবেই বুঝতে পারছি। পুরো রাজত্ব জুড়ে এক অজ্ঞাত অশান্তির বাতাস বইছে।
আমার অবস্থা সেই শিকারীর মতো, যে ঘন অন্ধকারের ভিতর তার সঙ্গে থাকা ক্ষুদ্র আগুনের শিখায়
দুর থেকে ধেয়ে আসা থাবার আওয়াজের সঙ্গেই জ্বলন্ত চোখের ঝলকটাও দেখতে পাচ্ছে। ব্যাপারটা
কী তা যদি বুঝতে পারতাম তরোয়াল দিয়েই তার মোকাবিলা করতাম। শুনে রাখো, শুধু শুধু
পিক্টরা সীমান্তে ক্ষেপে ওঠেনি বা কোন কারণ ছাড়া
ওদের সামলানোর জন্য বসসোনিয়ানদের পাঠানো হয়নি। আমাকে সেনাবাহিনী তৈরি রাখতে
হবে।”
"পাবলিয়াস কিন্তু
সীমান্ত পেরিয়ে আপনাকে ফাঁদে ফেলা এবং হত্যা করার জন্য এক চক্রান্তের
আশঙ্কা করছে,"
গায়ের উপর থাকা রেশমের সারকোটের ভাঁজ হাত বুলিয়ে মসৃণ করতে করতে প্রসপেরো জানাল। সঙ্গেই
রুপোর আয়নায় নিজেকে দেখেও নিল গর্বিত ভঙ্গীতে। “এই কারণেই সে আপনাকে শহরে থাকতে
অনুরোধ করেছে। যে সব সন্দেহ আপনার মনে জন্ম নিয়েছে
তা আসলে বর্বর মানসিকতার ফসল। মানুষ যা করে করুক! ভাড়াটে সেনারা সব আমাদের
পক্ষে। ব্ল্যাক ড্রাগনস এবং পোইটেনের সব
গুন্ডা দুর্বৃত্তও আপনাকে গুরু বলে মানে। আপনি যে
গুপ্ত হত্যার ভয় পাচ্ছেন সেটা অসম্ভব। রাজকীয় দেহরক্ষীর
দল দিনরাত সৈন্যরা আপনাকে পাহারা দিচ্ছে। যাকগে, আপনি ওটা কী করছেন? "
"একটা মানচিত্র নিয়ে কাজ করছি," কোনান
গর্বের সুরে উত্তর দিল। “রাজসভার
মানচিত্রটায় দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিমের দেশগুলি ভাল করেই দেখানো আছে। কিন্তু
উত্তরের সব অস্পষ্ট এবং ত্রুটিযুক্ত। উত্তরের এলাকাটা আমি নিজেই ঠিকঠাক করছি। এই হলো
সিমেরিয়া, যেখানে
আমার জন্ম হয়েছিল। এবং -"
"অ্যাসগার্ড এবং ভ্যানাহেইম," প্রসপেরো
মানচিত্রটা ভালো করে দেখে। “মিত্রার
দিব্যি, আমি
তো এই দেশগুলোকে কল্পিত বলে মনে করতাম।"
কোনানের মুখে বর্বর
হাসি ফুটে ওঠে, নিজের অজান্তেই কালো মুখের ওপরের কাটা দাগের চিহ্ন স্পর্শ করে বলে, “তুমি জানবেই
বা কী করে, তুমি কী নিজের যৌবন সিমেরিয়ার উত্তর সীমান্তে কাটিয়েছ! আসগার্ডের
অবস্থান উত্তরে। ভ্যানাহেইম
সিমেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে। যেখানে সীমান্ত
এলাকায় প্রায় যুদ্ধ চলতেই থাকে।"
"এই উত্তরের মানুষেরা ঠিক কী ধরনের হয়?" প্রসপেরো
জিজ্ঞাসা করে।
“লম্বা
এবং ফর্সা এবং নীল চোখের অধিকারী। এদের দেবতা
হলেন তুষার-দৈত্য ইমির এবং এদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর নিজস্ব রাজা আছে। ওরা মারাত্মক রকমের
শক্তিশালী। সারা দিন শুধু লড়াই করে আর স্থানীয়
মদ পান করে। তারপর চলে সারা রাত ধরে চিৎকার করে
গান আর হল্লাবাজি।”
"বুঝলাম, আপনিও ঠিক ওদেরই মতন," প্রসপেরো
হাসল। “আপনিও প্রাণ খুলে হাসেন, প্রচুর মদ
খান এবং সুরে বেসুরে ভালোই গান করেন। যদিও আমি আর কোনো সিমেরিয়ানকে দেখিনি, যে
মদের বদলে জলও খায় বা হাসে বা বিরক্তিকর মন্ত্র জপার বদলে গান করে ।"
কোনান উত্তর দিল, "সম্ভবত এর কারণ সেই দেশ যেখানে তারা
বাস করে। এক অদ্ভুত অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ, যা হয়ত আর কোথাও নেই - আকাশের নীচে
অবস্থানকারী সমস্ত পাহাড়,
ঘন অরন্য সবসময় ধূসরতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। যার উপত্যকাগুলোর উপর দিয়ে বয়ে যায়
বিষাদের বাতাস।"
"আশ্চর্য লাগছে সেখানের মানুষদের মেজাজের হাল হকিকত
ভেবে,"
পোইটেনের হাস্যোজ্জ্বল রোদে ধোয়া সমভূমি আর নীল অলস নদীর কথা ভেবে প্রসপেরো কাঁধ
ঝাঁকাল। অ্যাকুইলোনিয়ার একেবারে দক্ষিনপ্রান্তে অবস্থিত প্রদেশ এই পোইটেন।
"তাদের ইহজীবন বা পরকালের কোন আশা ভরসা নেই," কোনান
জানায়। “তাদের
দেবতা হলেন ক্রোম এবং তাঁর অন্ধকার জাতি, যারা কোনও রোদহীন চিরকালীন
কুয়াশাচ্ছন্ন স্থানে থাকেন। যা আসলে মৃতদের পৃথিবী। ওহ
মিত্রা! উনি সেখান থেকেই শাসন করেন। এর
চেয়ে আসিরদের সমাজ আমার বেশি পছন্দ।”
"বুঝলাম," প্রসপেরো হাসে, "সিমেরিয়ার
অন্ধকার পাহাড়গুলো আপাতত অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। যাই হোক এবার আমি যাই। নুমার
দরবারে গিয়ে আপাতত একপাত্র সাদা নেমেডিয়ান
মদ পান করব আপনার স্বাস্থ্য কামনায়। "
"ভালো, খুব ভালো," কোনান চাপা হেসে বলল, "তবে দেখো
সাম্রাজ্য বিষয়ক ভাবনা ভাবতে গিয়ে নুমার নর্তকীদের চুম্বন করতে ভুলে যেও না যেন।”
কথা শেষ করেই হো হো করে হেসে উঠল কোনান। তার অনুরণন শুনতে শুনতে কক্ষ থেকে বিদায়
নিল প্রসপেরো।
৩
পিরামিডের নিচে গুহায় দুর্দান্ত সেট কুন্ডলী
পাকিয়ে ঘুমায়;
সমাধির ছায়াবৃত এলাকায় তার
অনুচরেরা নড়াচড়া করে।
আমি সেই লুকানো উপসাগরের
কথা বলছি, যে সূর্য কী তা জানে না-
হে নিয়মনিষ্ঠ উজ্জ্বলতার দেবতা আমার ঘৃণার সহায়ক
রূপে কাউকে প্রেরণ করুন!
সূর্য ডুবছে, তার সোনালী আভায় ঢেকে যাচ্ছিল, অরণ্যের সবুজ এবং ঝাপসা নীল রঙ। নানা
ধরনের ফুল ফলে সজ্জিত বাগানের ভিতর বসে থলথলে অথচ পেশীবহুল হাতে ধরা সোনালী
শিকলটাকে ক্রমাগত মোচড় দিচ্ছিল অ্যাট্টালাসের ডিয়ন। অনেক কষ্টে শ্বেতপাথরের বসার জায়গায় নিজের শরীরটাকে একটু নড়িয়ে এদিকে ওদিকে এমনভাবে তাকাল যেন কোনও
শত্রুর সন্ধান
করছে। যে জায়গায় ডিওন বসে আছে তার চারদিকে সরু গাছের বৃত্তাকার
বেষ্টনী। ছড়িয়ে যাওয়া ডালপালাগুলোর ছায়া এসে পড়েছে তার গায়ে। কাছেই একটা ঝর্ণা
থেকে রুপালী জল ধারা কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে। এছাড়াও এই উদ্যানের আরও অনেকগুলো ঝর্নার,
যাদের এখান থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, জলের আওয়াজ একটা চিরস্থায়ী ফিসফিসে
সুরের মতো ভেসে আসছে।
ডিওন ছাড়াও এখানে আর একজন প্রায় দানব সদৃশ চেহারার মানুষও
উপস্থিত আছে। শ্বেতপাথরের আসনটার কাছে দাঁড়িয়ে সে গম্ভীর চোখে ব্যারনকে পর্যবেক্ষণ
করছে। ডিওন অবশ্য থথ-আমনের দিকে সে
ভাবে নজর দিচ্ছে না। সে মোটামুটি ভাবে জানে থথ এমন একজন ক্রীতদাস যাকে
অ্যাসকালান্টে একটু বেশিই বিশ্বাস করে। অবশ্য অনেক ধনী
মানুষের মতোই ডিওন তার নিচের স্তরে
থাকা মানুষদের খুব একটা পাত্তা দেয় না।
"আপনার এতটা বিচলিত
হওয়ার দরকার নেই," থথ বলল। "চক্রান্ত ব্যর্থ হবে না।"
"অ্যাস্কালান্ট
আর পাঁচজনের মতো
ভুলও করতে পারে, ডিওন
ঝাঁঝিয়ে উঠল, ব্যর্থতার চিন্তায় তার কপালে জমছে ঘাম।
"না
উনি করেন না," স্টিগিয়ার
অধিবাসী বর্বরতা মাখানো সুরে কটাক্ষ করে বলল, "সেটা হলে আজ
আমিই প্রভু হতাম, ক্রীতদাস নয়।”
"এ
আবার কী কথা?" কিছুটা হলেও ডিওন এবার
যেন মনোযোগ দিল কথোপকথনে।
থথ-অ্যামনের চোখ কুঁচকে
গেল। তার এতদিনের সমস্ত আত্ম-নিয়ন্ত্রণ
ভেঙেই গেল বলা যায়। লজ্জা, ঘৃণা এবং ক্রোধের
মানসিকতায় সে কিছু একটা মরিয়া সুযোগ নিতে প্রস্তুত হল
এবার। সে যেটা লক্ষ্য করেনি তা হ'ল, ডিওন তাকে একজন মস্তিষ্ক এবং বুদ্ধির
ব্যবহার সক্ষম
মানুষ হিসাবে
দেখেনি মোটেই। সে ওকে আর পাঁচজন ক্রীতদাস ভেবে নিয়েছে। এমন মানুষ যাকে পাত্তা
দেওয়ার দরকার নেই ।
"আমার কথা শুনুন," থথ বলল। “আপনিই রাজা হবেন। কিন্তু আপনি জানেন না
অ্যাসকালান্টের
মনের ভাবনা। কোনানকে যদি হত্যা করা যায়, তাহলে তাকে আপনি আর বিশ্বাস করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে
আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু
কথা দিতে হবে, আপনি ক্ষমতায় এলে আমাকে রক্ষা করবেন, আমিও আপনাকে
যথাসাধ্য সাহায্য
করব।
“শুনুন, হুজুর! আমি ছিলাম দক্ষিণের একজন দুর্দান্ত জাদুকর। লোকেরা থথ আমনের
কথা সেভাবেই বলত যেভাবে তারা রাম্মনের কথা বলে। স্টিগিয়ার রাজা সেস্ফন আমায় খুব সম্মান
করতেন, দেশের সমস্ত জাদুকরদের ওপরে আমাকে স্থান দিয়েছিলেন
ফলে তারা আমাকে ঘৃণা করত, সঙ্গেই করত ভয়, কারণ আমি
অন্যজগতের সত্তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। তারা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে
আমার ইচ্ছানুসারে কাজ করত। সেটের দিব্যি, আমার শত্রুরা
জানতেও পারত না, নামহীন ভয়াবহতার আড়ম্বরপূর্ণ আঙ্গুলের
স্পর্শ নিজেদের গলায় অনুভব করার জন্য মাঝরাতে তাদের জেগে উঠতে হতে পারে! আমি সেটের সর্প অঙ্গুরীর
সাহায্যে অনেক ভয়ানক কালো জাদু সম্পন্ন করেছি। ওই
জিনিষ আমি পেয়েছিলাম
পৃথিবীর ভিতর এক
লীগ নীচে
অবস্থিত এক গোপন সমাধিতে। চটচটে সমুদ্রের ভিতর থেকে উঠে আসা
মানুষেরা যার কথা ভুলে গিয়েছিল অনেক কাল আগে।
“একটা চোর আমার
সেই আংটি চুরি করে, ফলে
আমার শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বাকি
জাদুকরেরা আমাকে হত্যা করার জন্য উঠে পড়ে
লাগে। উটচালকের ছদ্মবেশ ধরে আমি পালাতে বাধ্য হই। কোথে এক কাফেলার সঙ্গে সফর করার
সময় অ্যাসকালেন্টের অনুচরেরা আমাদের আক্রমণ করে। আমি ছাড়া সেই কাফেলার সবাইকে হত্যা করা হয়। নিজের আসল
পরিচয় দিয়ে এবং আজীবন অ্যাস্কালেন্টের সেবা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের প্রান
বাঁচাই। কী যে জঘন্য এই প্রতিশ্রুতির বাঁধন!
“আমাকে ধরে রাখতে, সে আমার সব
কথা একটা পার্চমেন্টে লিখে সিলছাপ মেরে সংরক্ষিত করে এবং কোথের দক্ষিণ সীমান্তে বসবাসকারী এক সাধুর হাতে তুলে
দেয়। ওটার কারণেই আজ অবধি আমি অ্যাসকালান্টের ঘুমানোর
সুযোগ নিয়ে তাকে হত্যা বা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে
তার শত্রুদের
হাতে তুলে দিতে পারিনি। কারণ তাহলেই সেই সাধু ওই পার্চমেন্ট খুলে
পড়বে - এভাবেই অ্যাসকালান্টে তাকে নির্দেশ
দিয়ে রেখেছে। আর সে যদি এ বিষয়ে স্টিগিয়াতে একটা কথাও - "
থরথর করে কেঁপে উঠল থথ। তার কালচে চামড়ার
মুখে ছড়িয়ে গেল ফ্যাকাশে ভাব।
"আমাকে অ্যাকুইলোনিয়াতে
কেউ চেনে না," সে বলতে
থাকল। “কিন্তু
একবার যদি স্টিগিয়ায় আমার শত্রুরা কোনোভাবে আমার অবস্থান
সম্পর্কে জানতে পারে তাহলে এ বিশ্বের আধখানা জায়গার কোথাও গিয়েও আমি রেহাই পাব না।
সে এক এমন অভিশাপ যা ব্রোঞ্জের মূর্তির হৃদয়কেও ফাটিয়ে চুরমার করে দেবে। একমাত্র
কোন প্রাসাদওয়ালা রাজা এবং তরোয়ালবাহী সেনাদল আমাকে রক্ষা করতে পারে। এই কারণেই
আমি আপনাকে আমার গোপন কথা খুলে বললাম।
অনুরোধ জানাচ্ছি
আপনি আমার সঙ্গে একটি চুক্তি করুন। আমি আপনাকে আমার জ্ঞান দিয়ে সাহায্য করব এবং আপনি আমাকে রক্ষা করবেন। আর কোনও দিন যদি আমি আংটিটি খুঁজে পাই-"
“আংটি? আংটি? থথ তার
সামনে থাকা লোকটার অহংকারকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। সত্যি বলতে
স্বভাবগত কারণেই ডিওন এতক্ষন সেভাবে নেহাত এক ক্রীতদাসের কথা ভালো
করে শোনেইনি। সে
তা নিজের চিন্তাভাবনায় মগ্ন ছিল। কিন্তু
আংটি শব্দটা তার আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার জলাশয়ে একটা আলোড়ন তুলল।
"আংটি?" আবার বলল। " হ্যাঁ মনে
পড়েছে-আমার সৌভাগ্যের আংটি। এক
ব্যাটা শিমিটিশ
চোর আমার
কাছে ওটা
নিয়ে এসেছিল এবং সে দিব্যি
কেটে বলেছিল বটে
যে, সে
ওটা চুরি করেছিল
সুদূর দক্ষিণের
এক জাদুকরের কাছ থেকে। ওটা নাকি আমার ভাগ্য ফিরিয়ে দেবে। মিত্রা জানেন, আমি তাকে ভালোই
অর্থ দিয়েছিলাম।
দেবতাদের
দিব্যি, আমার ভাগ্যে যা
কিছু আছে আমি সব চাই। ওটার জন্যই তাহলে ভলমানা আর অ্যাসকালান্টে আমাকে তাদের
এই রক্তাক্ত যড়যন্ত্রে
সামিল করেছে-দেখতে হবে তো আংটিটাকে।"
কথাগুলো শুনেই থথের রক্ত নেচে উঠল,
মুখে পড়ল তার প্রভাব। তার চোখে এমন এক বিস্মিত স্তম্ভিত ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল, যা
দিয়ে সে অনুভব করল এক বোকা মানুষের বোকামির অসীম গভীরতা। ডিওন কখনই তার দিকে মনোযোগ দেয়নি। এই মুহূর্তে
সে তার শ্বেতপাথরের বসার আসনের সঙ্গে যুক্ত এক গোপন ঢাকনা
উত্তোলন করে তার ভেতরে হাতড়াচ্ছিল। ওখানে স্তূপের মত জমে আছে স্থূলকায় মানুষটার
সংগ্রহ করা বিভিন্ন ধরণের
হাবিজাবি জিনিসপত্র-
বর্বরদের
কবচ, হাড়ের টুকরো, টুকরোটাকরা
অদ্ভুত দর্শন গয়না–কুসংস্কারগ্রস্থ
মানুষটা নিজের ভাগ্য বদল করার জন্য যা পেয়েছে তাকেই আঁকড়ে ধরেছে।
"আহা, এই তো পেয়েছি!" বিজয়ীর ভঙ্গীতে উদ্ভট দর্শন একটা আংটি তুলে ধরে
ডিওন। দেখে মনে হচ্ছে তামা জাতীয় ধাতু দিয়ে বানানো। আকারে তিনটে পাক দিয়ে বসে থাকা
আঁশ যুক্ত সাপের মত। মুখের ভিতর ঢুকে আছে লেজের প্রান্ত। চোখের জায়গায় হলুদ পাথর
ঝিলিক মারছে অশুভ দ্যূতিতে। থথ-আমন এমন ভাবে চেঁচিয়ে উঠল যেন কেউ তার
মুখে আঘাত করেছে। যা শুনে ডিওন ঘুরে তাকাল এবং ঢোঁক গিলল। তার মূখের সব রক্ত কেউ
যেন শুষে নিয়েছে। ক্রীতদাসের চোখ জ্বলছিল, মুখ হাঁ হয়ে
গেছে, প্রশস্ত
বিশাল দু হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সামনের দিকে থাবার মতো।
"আংটি! সেটের
দিব্যি!
সেই আংটি!" তীক্ষ্ণ
স্বরে চেঁচিয়ে উঠল থথ। “আমার আংটি-যা চুরি হয়েছিল
আমার কাছ থেকে-"
স্টিগিয়ানের হাতে ইস্পাতের
চকচকে ফলা ঝলসে উঠল। নিমেষের ভিতর সেটা বিদ্ধ হল ব্যারনের চর্বিযুক্ত দেহে। গলে
যাওয়া মাখনের মত থলথলে চেহারার ডিওন দম আটকে যাওয়া একটা গ্যালগেলে শব্দ করে লুটিয়ে
পড়ল জমিতে। বোকা
মানুষটা, এক
অজ্ঞাত সন্ত্রাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল। ঠিকভাবে
জানতেও পারল না আসলে কী হল! অতিমাত্রায় ভারী মৃতদেহটাকে একদিকে ঠেলে ফেলে দিয়ে
থথ দু হাতে
চেপে ধরল আংটিটাকে। ওর কালো চোখে জ্বলজ্বল
করে উঠল এক বিভীষিকাময় দ্যুতি।
"আমার আংটি!" নিদারুন এক উচ্ছ্বাসে
সে ফিসফিস করে উঠল। "আমার ক্ষমতা!"
সে নিজেও জানে না ঠিক
কতক্ষণ ওই চমকপ্রদ ভয়ংকর জিনিসটা দুহাতে আঁকড়ে কাঠের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল। পান
করছিল নিজের তমসাচ্ছন্ন আত্মায় ওটার অশুভ জ্যোতি সুধারস। যখন কোনও এক অতল গহ্বর থেকে সে নিজের
চেতনাকে আবার ফিরে পেল তখন আরও একবার কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। ইতিমধ্যে আকাশে দেখা
দিয়েছে চাঁদ। তার আলোয় মসৃণ শ্বেতপাথরের
আসনে ছায়া পড়েছে তার। ওটার পাদদেশে গা এলিয়ে পড়ে আছে আট্টালাসের প্রভুর মৃতদেহ।
"আর না, অ্যাসকালান্টে। আর না!" ফিসফিস করে
উঠল থথ। স্টিগিয়ানের চোখ এখন রক্তলোলুপ পশুর মতো লাল টকটকে।
নিচু হয়ে নিজের হাতে মৃত মানুষটার দেহ থেকে গড়িয়ে যাওয়া রক্ত আঁজলা ভরে তুলে নিল। মাখাল
আংটির হলুদ পাথরের চোখে। ততক্ষণ যতক্ষণ না চোখ দুটোর উপর একটা লালচে আবরণের সৃষ্টি
হল।
রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দেওয়া স্বরে মন্ত্রোচ্চারণের মতো করে
সে বলল, “হে রহস্যময় সর্প, আপাতত অন্ধ হয়ে যাও!
চাঁদের আলোয়
নির্বাপিত হোক তোমার দৃষ্টি। সেটা খুলে যাক অন্ধকারের জগতে! হে মহান সেটের মহাসর্প
কী দেখতে
পাচ্ছ তুমি? ওই অন্ধকার আচ্ছন্ন রাতের মহাসাগরে কাকে আহ্বান জানাচ্ছ? কার ছায়া ঝুঁকে পড়ছে আলোর
উপর? কে
সে? হে মহাসর্প,
তাকে ডেকে নিয়ে এসো আমার কাছে!"
আঙ্গুলের অদ্ভুতরকমের
অঙ্গভঙ্গি সহযোগে থথ সর্প আংটির গায়ের আঁশগুলোকে টোকা মারছিল।
বারবার টোকা মেরেই ফিরে আসছিল আঙুল তার নিজের অবস্থানে। এই মুহূর্তে ওর গলার স্বর
নেমে গেছে। ফিসফিস করে উচ্চারণ করছে সেই সব অশুভ অন্ধকারাচ্ছন্ন নাম আর
মন্ত্র। যে মন্ত্র ভুলে গেছে স্টিগিয়ার অন্ধকার জগতের অধিবাসিরাও। যার
প্রচলন ছিল সেই ভয়াবহ উপকূলবর্তী অঞ্চলের কবরস্থানে, যেখানে সন্ধ্যা
নামলেই শুরু হয়
ভৌতিক অবয়বদের
আনাগোনা।
জলের ভিতর যখন কোনও প্রাণী নিচ থেকে উপরে উঠে আসে তখন যেমন ঘূর্ণি তৈরি হয়, সহসাই সেখানে ওর চারপাশের বাতাসে এরকম বায়ব একটা আন্দোলন সৃষ্টি
হল। নামহীন, হিমশীতল এক
ঝলক বাতাস বয়ে গেল ওর গায়ের উপর দিয়ে। যেন কোনও দরজা খোলা হলো। থথ
কারও একটা উপস্থিতি তার পিছনে অনুভব করলেও ফিরে তাকাল না। ওর চোখ স্থির হয়ে আছে চাঁদের
আলো পড়া শ্বেতপাথরের এলাকায়। ওর পিছনে
তখন এক অশরীরী
ছায়া নড়াচড়া করছে। ফিসফিস করে মন্ত্র বলা
সে এখনো থামায়নি। ওদিকে সেই ছায়া অবয়বের আকার যেমন বাড়ছিল সঙ্গেই পরিষ্কার হচ্ছিল
তার রূপ। এক সময় সেই ভয়াবহ সেই অবয়ব তার দৃশ্যমান হল সম্পূর্ণ রূপে। দেখতে
অনেকটা বিশালকায়
বেবুনের মতো। কিন্তু
এরকম কোনও বেবুন এই পৃথিবী, এমনকি স্টিগিয়াতেও
দেখা যায়নি। থথ সেদিকে না তাকিয়ে কোমর বন্ধনীর ভিতর থেকে তার বর্তমান মালিকের
একটা চটিজুতো বার করল-সবসময় অস্পষ্ট
একটা আশা নিয়ে সে এটা বয়ে
বেড়িয়েছে, হয়তো কোনদিন এটার ব্যবহার করতে সক্ষম হবে-ছুঁড়ে
দিল পিছনের দিকে।
"ভালো
করে ওটাকে দেখে নাও,
আংটির গোলাম! খুঁজে বার করো কে এটা পরতেন এবং তাকে ধ্বংস করো! তার চোখের দিকে তাকিয়ে আগে তার আত্মাকে ধ্বংস করে
দাও। তারপর ওর গলা কেটে দাও! মেরে ফেল! বুঝতে
পেরেছ?"
ক্রোধান্বিত আবেগের ফেটে পড়ল থথের কন্ঠ
থেকে। "তার সঙ্গেই শেষ করে দাও ওর সব কিছু! ”
চাঁদের আলোয় প্রাচীরের গায়ের ছায়ার থথ দেখল সেই
ভয়ানক অবয়ব মাথা নিচু করে এক বীভৎস কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকছে। তারপরেই নিমেষের ভিতর
মাথা তুলে সে গাছেদের ভিতর দিয়ে বুনো ঝড়ের গতিতে ছূটে চলে গেল। স্টিগিয়ান জাদুকর পাগলের মতো
উচ্ছ্বাসে নিজের দু হাত ঝাড়ল দুপাশে। দাঁত আর চোখ চাঁদের আলোতে চকচক করে উঠল।
প্রাচীর থেকে কিছু দূরে থাকা একপ্রহরী সৈনিক সহসাই
আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল। সে দেখল একটা জ্বলজ্বল চোখের বিশালকায়
কালো ছায়া এক
লাফে প্রাচীর
পার হয়ে চলে গেল। আর ওর গায়ে এসে লাগল ঘুর্নি ঝড়ের দমকা দাপট। তবে এত তাড়াতাড়ি
ওটা চলে গেল যে বিস্মিত প্রহরীর মনে
হলো ওটা কোনও স্বপ্ন বা মনের ভুল।
৪
যখন এ ধরা ছিল তরুণ আর মানুষেরা দুর্বল,
রাতের ভয়ঙ্করেরা বিচরণ করত অবাধে,
আমি আগুন আর ইস্পাত হাতে লড়েছি সেটের বিরুদ্ধে
সঙ্গে ছিল উপাস গাছের রস;
এখন আমি কালো হৃদয় নিয়ে
নিদ্রারত,
যুগযুগান্ত সহ্য করছে যত অত্যাচার।
মানুষের আত্মাকে বাঁচাতে
যে সাপের সঙ্গে লড়াই করেছিল তাকে ভুলে গেলে
সবাই?
উঁচু সোনার গম্বুজের ভিতর
অবস্থিত বিরাট শয়নকক্ষে কোনান ঘুমের ভেতরেই উসখুস করছিল আর স্বপ্ন দেখছিল। ঘূর্ণায়মান
ধূসর কুয়াশার
ভিতর অনেক দূর থেকে ক্ষীণস্বরে কে যেন কিছু বলছে। কিছু বুঝতে না পারলেও সে ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল না বলেই মনে হচ্ছিল।
হাতে তরোয়াল
নিয়ে ও এগিয়ে
গেল ধূসর কুয়াশার
গায়ে মেখে, এ যেন
মেঘের মধ্য দিয়ে হেঁটে
যাওয়া। এগিয়ে
যাওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। এবার
কোনান বুঝতে পারল কন্ঠস্বর কী বলছে-কোনানের নিজের নামটাই
উচ্চারিত হচ্ছে সময় বা কালের এই প্রান্তসীমায়।
কুয়াশা অনেক কমে গেছে এখানে। কোনান দেখতে পেল দারুন রকম কালো এক করিডোরের ভিতর দিয়ে হাঁটছে ও, মনে হচ্ছে এর দেওয়াল কালো পাথর কেটে বানানো হয়েছে। এখানে কোনও
আলো নেই তবু কিছু একটা জাদুমায়াতে সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাওয়া
যাচ্ছে। নিচের মেঝে, ওপরের ছাদ
এবং চারপাশের
দেওয়াল সব চকচকে পালিশ করা। আলো ঠিকরাচ্ছে। ওসবের গায়ে খোদাই করা আছে প্রাচীন বীর এবং অর্ধ-বিস্মৃত দেবতাদের মূর্তি। এই সব নামহীন প্রাচীন
সত্তাদের বিস্তৃত ছায়াময় রূপরেখা দেখে
ওর শরীর কম্পিত হল। একইসঙ্গে বুঝতে পারল কয়েক শতাব্দী ধরে এই করিডোরে
কোন জীবন্ত মানুষের পা পড়েনি।
শক্ত পাথরে খোদাই করা প্রশস্ত সিঁড়ির উপরে এসে দাঁড়াল
সে। দুপাশে নানা রকমের প্রাচীন এবং ভয়াবহ
রহস্যময় চিহ্নগুলো দেখে কোনানের গায়ে কাঁটা দিল। সিঁড়ির প্রতিটা ধাপে খোদাই করা ছিল প্রাচীন
মহাসর্প, সেটের
ঘৃণ্য বিবমিষা
উদ্রেককারি মূর্তি। প্রতিটা পদক্ষেপে তার গোড়ালি গিয়ে লাগছিল
সাপের মাথায় । যেমনটা
সেই প্রাচীন সময় থেকেই হয়ে আসছে। এভাবেই এখান দিয়ে যেতে হয় যেকোনো আগন্তুককে। কিছুতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হচ্ছিল
না কোনানের।
ওদিকে সেই কন্ঠস্বর তাকে ডেকেই চলেছিল। শেষ অবধি অন্ধকারে
তার সয়ে যাওয়া শারীরিক চোখ দিয়ে দেখল এক অদ্ভুত
ভূগর্ভস্থ সমাধি স্থলে এসে উপস্থিত হয়েছে ও। যেখানে একটা সমাধি বেদীর উপরে বসে
আছে এক অস্পষ্ট সাদা-দাড়িওয়ালা
অবয়ব। কোনানের ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেল, হাত চলে গেল তলোয়ারের বাঁটে। ভৌতিক
কন্ঠস্বরে অবয়বের তরফ থেকে ভেসে এল প্রশ্ন।
"ওহে মানব সন্তান, তুমি কী আমাকে চেনো?"
"না, ক্রমের দিব্যি! আমি আপনাকে
চিনি না।" জবাব
দিল কোনান।
বয়স্ক সেই ব্যক্তি জানাল, “শোনো হে
মানব, আমি এপিমিট্রেয়াস।”
"কিন্তু
সাধক এপিমিট্রেয়াস তো পনেরোশো বছর আগে মারা গেছেন!" কোনান হতবাক হয়ে
বলে উঠল।
"নিকুচি
করেছে!" আদেশসুচক
স্বরে বলে উঠল অবয়ব, "অন্ধকার হ্রদে একটি নুড়ি নিক্ষেপ করলে
তার তরঙ্গাঘাত যেমন দূরের উপকূলে পৌঁছে যায়, ঠিক তেমনই আমার জাগরণে এই পৃথিবীর বুকে লেগেছে দোলা। সিমেরিয়ার কোনান তোমাকে
চিনতে আমার ভুল হয়নি। দুর্দান্ত ঘটনা ঘটানোর মহা
দায়িত্ব আছে তোমার উপর। কিন্তু অভিশাপের ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে এই মাটিতে, যাকে রুখতে
সক্ষম নয় তোমার তরোয়াল। "
"আপনি ধাঁধা জড়ানো
কথা বলছেন," কোনান অস্বস্তি
মাখা স্বরে বলে উঠল "আমাকে আমার শত্রুকে
দেখতে দিন। আমি তার খুলি ফাটিয়ে দাঁতের হাসি থামিয়ে দেব।”
"রক্তমাংসের শত্রুদের বিরুদ্ধে তোমার বর্বর ক্রোধের
ব্যবহার কোরো কোনান!” প্রাচীন মানুষটা জানালেন। “আমি আগে থেকেই জানিয়ে দিচ্ছি এ লড়াই
মানুষের বিরুদ্ধে নয়। এমন
এক
অন্ধকার জগত আছে যার অনুমান করা মানুষের দ্বারা
প্রায় অসম্ভব। যেখানে নিরাকার দানবেরা বিচরণ করে রয়েছে–
অজ্ঞাত জগত থেকে আগত নরকের দূতেরা দুষ্ট জাদুকরদের আহবানে সাড়া দিয়ে রূপ
পরিগ্রহ করে এবং সব কিছুকে গিলে খায়। হে রাজন, তোমার বাসস্থানে
সেরকমই এক সর্প আছে-এক বিষাক্ত
সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার রাজ্যে, যে এসেছে স্টিগিয়া থেকে, যার হৃদয়ে অবস্থান করছে
ছায়া জগতের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রজ্ঞা। একজন ঘুমন্ত মানুষ যে
ভাবে স্বপ্ন দেখে একটা
সাপ তার দিকে এগিয়ে আসছে, সেভাবেই আমি অনুভব করেছি সেটের নিওফাইটের
জঘন্যতম উপস্থিতি। ভয়াবহ শক্তির মদে সে মাতাল। শত্রুর দিকে সে যে আঘাত হানতে
চলেছে তাতে এই রাজত্ব ধ্বংস হতে পারে। আমি তোমাকে আমার কাছে ডেকেছি অস্ত্র প্রদান করার জন্য। যাতে
তুমি তার এবং তার নারকীয় বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে পারো।”
"কিন্তু কেন?" হতবাক হয়ে কোনান জিজ্ঞাসা করল। “মানুষেরা বলে আপনি
গোলামিরার কালো হৃদয়ে
নিদ্রারত, যেখান
থেকে আপনি আপনার আত্মাকে
অদৃশ্য ডানায় ভর দিয়ে প্রেরণ করেছেন অ্যাকুইলোনিয়ার
প্রয়োজনের সময়েতে সাহায্য করার জন্য । কিন্তু আমি–আমি তো একজন বহিরাগত
বর্বর। "
"শান্ত
হও!" অবয়বের
ভুতুড়ে স্বর অনুরণিত হল ছায়াময় বিরাটকায় গুহার ভিতর। “তোমার আর অ্যাকুইলোনিয়ায় ভাগ্য একসুত্রে
গাঁথা। বিশাল
এক ঘটনার জাল ভাগ্যের গর্ভে গঠন হচ্ছে। এক রক্ত-পাগল যাদুকর কখনই
মহা সাম্রাজ্যের নিয়তির পথে দাঁড়াতে
পারবে না।
অনেক যুগ আগে সেট এই পৃথিবীকে অজগরের মত পেঁচিয়ে
ধরেছিল। তিনজন সাধারণ মানুষের বয়সের সমান ছিল আমার জীবনকাল। সারাটা জীবন আমি তার
বিরুদ্ধে লড়েছি। তাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলাম রহস্যময় দক্ষিণের ছায়ায়।
আমাদের জন্য যে মহা শয়তান, সেই দানবকেই তমসাচ্ছন্ন স্টিগিয়ার লোকেরা পূজা করে। সেটের
বিরুদ্ধে যেমন লড়াই করেছিলাম, ঠিক
সেভাবেই আমাকে লড়তে হয়েছে তার উপাসকদের সঙ্গেও।
লড়াই করতে
হয়েছে তার অনুগত এবং সহচরদের সঙ্গে। তোমার তরোয়াল বার করো।”
অবাক হয়েও, কোনান অবয়বের কথা মতোই কাজ করল। সেই অসাধারণ তলোয়ারের
রুপোর হাতলের কাছে প্রাচীন যুগের সেই
মানুষটার আত্মা তার হাড় সর্বস্ব আঙুল দিয়ে একটা আশ্চর্যজনক প্রতীকচিহ্ন
আঁকলেন। যা ছায়ায় মাঝে সাদা আগুনের মতো জ্বলজ্বল
করতে থাকল ।
এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভূগর্ভস্থ কক্ষ, সমাধিবেদী এবং প্রাচীন
মানুষটা সহ সব কিছু অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিস্মিত কোনান এক লাফে তার বিশাল সোনার গম্বুজযুক্ত কক্ষের
পালঙ্কে লাফিয়ে উঠে বসল। তারপর উঠে দাঁড়াতেই আর একবার চমকে উঠল এটা দেখে যে সে
স্বপ্নের মতোই হাতে তলোয়ার উঁচিয়ে ধরে আছে। একই সঙ্গে তার ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেল
এটা দেখে যে তরোয়ালের হাতলের প্রশস্ত রৌপ্যফলকের উপর একটি প্রতীক খোদাই করা আছে–আগুন পাখি, ফিনিক্স। ওর
মনে পড়ল স্বপ্নে সে যে সমাধিবেদী দেখেছিল তার পাথরেও এই
একই প্রতীক খোদাই করা ছিল। শিহরণ খেলে গেল কোনানের সারা শরীরে, আদপেই ওটা পাথরের খোদাই চিত্র
ছিল কী?
এভাবে দাঁড়িয়ে
থাকতেই থাকতেই
কোনান সম্বিৎ ফিরে পেল,
করিডোরের
বাইরে একটা
সন্দেহজনক শব্দ শুনে। কিসের শব্দ জানার জন্য সে উদগ্রীব
হয়ে তরোয়াল বাগিয়ে ধরল। এই মুহূর্তে সে আবার আগের সেই সন্দেহপ্রবন, বর্বর ধূসর নেকড়েতে
পরিণত হয়েছে, যে তার নিজের এলাকা বিষয়ে সচেতন।
৫
সুশীল ভাব বা অপরাধ বাছক সাজানো বা মিথ্যা এ সম্পর্কে আমি আর কী জানি?
আমি,
তাদের দলে যাদের জন্ম নগ্ন জমিতে এবং বড় হয়ে
ওঠা খোলা আকাশের
নিচে।
পরিশীলিত কথাবার্তা, সাজানো ছলনা, সব ব্যর্থ হয়, যখন
চওড়া তলোয়ার ঝলসে ওঠে
যা ভাগ কুত্তার দল, মর-আমি রাজা হওয়ার আগে একজন মানুষ ছিলাম, মনে
আছে তো!
- দ্য রোড অফ কিংস
নীরবতায় ছেয়ে থাকা রাজপ্রাসাদের করিডোরে দেখতে পাওয়া
যাচ্ছে কুড়িজন সন্তর্পণে এগিয়ে যেতে থাকা
অবয়বকে। ওদের পা হয় খালি না হয় নরম চামড়ায়
মোড়ানো। মোটা গালিচা হোক বা শ্বেত পাথরের টালির মেঝেতে কোন শব্দের জন্ম দিচ্ছে না ওদের
পদক্ষেপ। হলঘরগুলোর বাইরের দেয়ালগিরির মশালের
লালচে আভা ঠিকরাচ্ছে ওদের হাতের ছোরা, তরোয়াল এবং কুঠারের
ফলায়।
শোনা গেল অ্যাসকালান্টের কন্ঠস্বর, “থামো সবাই।
উত্তেজনায় জোরে জোরে যে শ্বাস নিচ্ছ, তাকে বলছি, নিজেকে শান্ত করো ! রাত পাহারার
দায়িত্বে থাকা মানুষ বেশিরভাগকেই এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাকি যারা আছে তারাও মদে চুর। যদিও আমাদের অবশ্যই সাবধান হওয়া উচিত। পিছিয়ে
যাও, পাহারাদার
আসছে!”
নিমেষের ভিতর দলটা খোদাই করা এক সারি স্তম্ভর পিছনে
লুকিয়ে পড়ে। আর নিমেষের মধ্যে ওই স্থান
দিয়ে কালো বর্ম পরিহিত
দশটা দৈত্যসম
অবয়ব ছন্দবদ্ধ গতিতে হেঁটে
যায়। ওদের চোখে মুখে সন্দেহর ছাপ। বুঝতে পারছে না,
কেন তাদের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে দূরে পাঠানো হচ্ছে। যে
ওদের নিয়ে যাচ্ছে তার মুখ এই মুহূর্তে ফ্যাকাশে মেরে আছে।
প্রহরীর দল চলে গেল গেল ষড়যন্ত্রকারীদের সামনে দিয়ে। প্রহরীদের নেতাকে দেখতে
পাওয়া গেল কাঁপা কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছতে। অপেক্ষাকৃত তরুণ এই প্রহরী
প্রধানের পক্ষে রাজার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার ব্যাপারটা এখন ঠিক হজম হয়নি। সে
নিজেকে গালাগাল দিচ্ছিল অতিরিক্ত ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে থাকার জন্য। যা না হলে ওকে আজ এই রাজনীতির খেলার বোড়ের ভুমিকা পালন
করতে হত না।
প্রহরীরা এক সময় মিলিয়ে গেল করিডোরের অন্য
দিকে।
“বেশ
ভালোই!” হাসল
অ্যাস্ক্যালেন্টে। “কোনান
এখন পাহারাহীন হয়ে ঘুমাচ্ছে। জলদি চলো! যদি
কেউ তাকে হত্যা করার সময় আমাদের ধরে ফেলে, তাহলে সব
ভেস্তে যাবে। অবশ্য একজন মৃত রাজার পক্ষ অবলম্বন করতে খুব কম মানুষই সাহস
দেখাবে।”
“কথা
কম, তাড়াতাড়ি!” রিনালদো ঝাপটে উঠল। তার নীল চোখের দীপ্তির সঙ্গে একইভাবে চকচক
করে উঠল তার মাথার উপর দিকে তুলে ধরে থাকা
তরোয়ালটাও। “আমার তরোয়াল খুব তৃষ্ণার্ত! আমি শুনতে
পাচ্ছি শকুনদের ডানার ঝাপ্টানি! চলো!”
বেপরোয়া গতিতে করিডোর পার
হয়ে ওরা এসে দাঁড়াল এক ভারী দরজার সামনে। যার গায়ে
খোদাই করা আছে আকুইলোনিয়ার রাজকীয় ড্রাগনের প্রতীক চিহ্ন।
“গ্রোমেল!” অ্যাস্কাল্যান্টে
ইশারা করল, “দরজা
ভেঙে ফেল!”
দৈত্যকায় একজন মানুষ গভীর শ্বাস নিয়ে
তার শক্তিশালী শরীরটাকে দরজার প্যানেলের
গায়ে চেপে ধরল। শোনা গেল তীক্ষ্ণ ক্যাঁচকেঁচে শব্দ। চাপ প্রয়োগ করার জন্য বেঁকে
গেল তার শরীর। একটু বাদেই ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এসে পুনরায় ঢাকা দিল দরজার গায়ে। বিকট
শব্দ করে এদিকে সেদিকে ছিটকে গেল দরজার
হুড়কোর টুকরো টাকরা। দরজার পাল্লা খুলে গেল ভেতরের দিকে।
আগুন ঝরানো স্বরে অ্যাস্কালান্টে গর্জন করল, “চলো ভেতরে!”
“ঢুকে
পড়ো সবাই!” চিৎকার
শোনা গেল রিনালদোর। “অত্যাচারীর মৃত্যু চাই!”
বেশি দূর অবশ্য যেতে পারল না। ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
কোনান। না কোনও নগ্ন মানুষ নয়, যে
এই মুহূর্তে গভীর ঘুমের ঘোর ভেঙে নিরস্ত্র
এসে দাঁড়িয়েছে
ভেড়ার মত জবাই হওয়ার
জন্য। বরং এক
অসভ্য বর্বর
দানব এসে দাঁড়িয়েছে আক্রমণকারীদের সামনে, যার পেশীবহুল হাতে লম্বা তরোয়াল।
এক ঝলক বরফ শীতল জল যেন শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়া ঝটিকা বাহিনীর-ভাঙা দরজার
ফ্রেমে চার বিদ্রোহী অভিজাত আর তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা দাড়িগোঁফওয়ালা একদল মানুষ-
মোমবাতি আলোকিত
কক্ষর মাঝখানে
জ্বলজ্বলে চোখে খোলা তলোয়ার হাতে দৈত্যসদৃশ মানুষটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
ওই মুহূর্তে অ্যাস্কাল্যান্টের চোখ পড়ল, রাজকীয় পালঙ্কের কাছে একটা ছোট টেবিলের উপরে রাখারুপোর রাজদণ্ড এবং সরু সোনার গোলাকার
অ্যাকুইলোনিয়ার রাজমুকুটটার দিকে। একটা উন্মাদীয় আকাঙ্ক্ষা তাকে শিহরিত করল।
“আরে, অপেক্ষা
কিসের!” চেঁচিয়ে
উঠল সে, “আমাদের কুড়িজনার বিরুদ্ধে ও একা। তার উপর মাথায় শিরস্ত্রাণ নেই!” সত্যিই তাই
কোনানের হাতে সময় ছিল না ওটা মাথায় পড়ার বা গায়ে ওজনদার বর্ম চাপানোর। সুযোগ পায়নি
দেওয়াল থেকে ভারী ঢালটাকে নামিয়ে নেওয়ারও। ওদিকে ভোলমানা এবং গ্রোমাল,
এরাই শুধু পুরো শরীর ঢেকেছিল বর্ম দিয়ে। তুলনায় কোনান
তার বাকি শত্রুদের চেয়ে বেশী সুরক্ষিত বলাই যায়।
কোনান অবাক চোখে তার আক্রমণকারীদের দেখছিল। অ্যাসকালান্টেকে সে চেনে না।
বর্মে ঢাকা দুজনকে চেনার তো কোন উপায়ই নেই। বাকি থাকে রিনালদো, সে তার কানাতওয়ালা
টুপিটাকে নামিয়ে দিয়েছিল চোখের কাছ অবধি। আপাতত এসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। একসঙ্গে
চিৎকার করে ঘরের ছাদ কাঁপিয়ে, ঘাতকেরা ঘরে ঢুকে পড়ল। সবার আগে ক্ষ্যাপা
ষাঁড়ের মতো ধেয়ে গেল গ্রোমেল। মাথা নিচু, তরোয়ালটাও
নিচু করা আছে আক্রমণ সামাল দেওয়ার জন্য। কোনান বাঘের মতো ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লাফিয়ে উঠে হাতের বিশাল
তরোয়ালটাকে ঘোরাল হাওয়ায়। বাতাস কাটার হুউউস শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গেই ঝলসে ওঠা
ফলাটা সজোরে আঘাত হানল বসসোনিয়ান আক্রমণকারীর শিরস্ত্রানের উপর। শোনা গেল ধাতব
সংঘাতের শব্দ। এক আঘাতেই কাম তামাম! মেঝেতে
পড়ে গেল গ্রোমেলের
প্রাণহীন
শরীর। কোনান এক লাফে
পিছিয়ে গেল পিছনে, হাতে ভেঙে যাওয়া তরোয়ালের হাতল।
“গ্রোমেল!” বিস্ফারিত
চোখে প্রথম মৃত আক্রমণকারীকে দেখে বলে উঠল অ্যাকুইলোনিয়ার রাজা।
শিরস্ত্রাণ খসে গিয়ে দেখা যাছে থেঁতলে যাওয়া মাথাটা।
এবার বাকী দল এগিয়ে এল আক্রমণ করার জন্য। একটা ছোরা ছুঁয়ে গেল কোনানের স্তনবৃন্ত
আর পাঁজরের কাছটাকে। তরোয়ালের প্রান্ত ঝলসিয়ে উঠল চোখের সামনে। বামহাতের
এক ঝটকায় ছোরাধারীকে মুষ্ঠ্যাঘাত করেই তলোয়ারধারীর মাথায় আঘাত হানল কোনান হাতের
ভাঙা তরোয়ালের হাতল দিয়ে। লোকটার মাথা ফেটে গেল দু টুকরো হয়ে, ঘিলুতে মাখামাখি
হয়ে গেল মুখমন্ডল।
“তোমরা
পাঁচজন দরজার দিকে লক্ষ্য রাখো!” চিৎকার করে উঠল অ্যাস্কালান্টে। ঘরের
ভিতর চলতে থাকা অস্ত্রশস্ত্রের ঘূর্ণিপাকের ভিতর সে প্রায় নাচছিল। আশঙ্কা একটাই কোনান ওদের সবাইকে
ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দরজা দিয়ে পালিয়ে না যায়। দুর্বৃত্তরা ক্ষনিকের
জন্য থেমে পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল দরজার মুখ আড়াল করে। আর এই সুযোগে কোনান দ্রুত
দেয়ালের দিকে চলে গেল। ওখানে
ঝোলানো ছিল প্রাচীন যুগের এক যুদ্ধ কুঠার। প্রায়
পঞ্চাশ বছর ধরে ওটাকে কেউ ব্যবহারই করেনি।
ওটাকে হাতে নিয়ে প্রাচীরের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াতেই আক্রমণকারীদের
অস্ত্র ঝলসে উঠল। কোনান ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের উপর। প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ কোনানের
না-পসন্দ। বিন্দুমাত্র সুযোগ দেখা যাচ্ছে এমন মুহূর্তেও সে শত্রুদের দিকে চিরকাল
ধেয়েই গেছে অপ্রতিরোধ্য মানসিকতা নিয়ে। অন্য যে কোনও মানুষ যা
করলে নিশ্চিত মারা যেত, সেখানে কোনান
চিরটাকাল নিজের বেঁচে থাকার আশা না করে, একটাই কথা
ভেবেছে, মরার আগে যতগুলোকে পারব মেরেই
মরব। তার ভিতর তখন জ্বলে উঠেছে বর্বরোচিত আত্মার তেজ আর কানে ভেসে আসতে শুরু করেছে পুরনো দিনের বীর
যোদ্ধাদের গান ।
দেয়ালের কাছ থেকে সরে আসতে আসতেই তার কুঠারের
আঘাতে খসে গেল এক আক্রমণকারীর হাত কাঁধের কাছ থেকে। পিছন দিকে আন্দাজ মতো ভয়ঙ্কর আঘাতে মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ
হয়ে গেল আর একজনের। তরোয়ালের ঝলক তার শরীর প্রায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই দমবন্ধ
করা পরিস্থিতিতে মৃত্যু কিছুতেই তার নাগাল পাচ্ছিল না।
সিমেরিয়ানের চলাফেরার গতি আক্রমণকারীদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছিল। তার লাফ
দেওয়া দেখে মনে হচ্ছিল কোন বাঘের শরীরে যেন বেবুন ঢুকে পড়েছে। একটুও না থেমে
লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গড়িয়ে সে হতভম্ব করে দিচ্ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে। এর সঙ্গেই চাকার
মতো ঘুরছিল তার হাতের চকচকে কুঠার।
তার ঘাতকেরা তাকে ঘিরে ধরে পাগলের মতোই চালিয়ে
যাচ্ছিল তার আক্রমণ। মেঝেতে পড়েছিল দুটো মৃতদেহ, কোনানের
ক্রোধের পরিচায়ক প্রমাণ রূপে। অবশ্য কোনান নিজেও আহত হয়েছিল ভালোই। বাহু, ঘাড় ও পা
থেকে রক্তপাত হচ্ছিল
অঝোরে।
“আরে
এই হতচ্ছাড়ার দল!”
মাথার টুপি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বন্য দৃষ্টিতে চিৎকার করে ওঠে রিনালদো, “তোরা কী যুদ্ধ করা
ভুলে গেলি নাকি রে? কী
চাস ওই স্বৈরাচারী বেঁচে থাকুক?
ওকে শেষ করে দে! বলেই পাগলের মতো ছুটে গেল কোনানের
দিকে। ততক্ষণে কোনান ওকে চিনতে পেরেছে। খালি হাতেই এক জোরালো আঘাত করে প্রথমে রিনালদোর
তলোয়ারটা ফেলে দিয়ে, পরের এক ধাক্কায় ওকে ছিটকে ফেলে দিল মেঝেতে। এই
সময়েই অ্যাসকাল্যান্টের তলোয়ারের ডগা বিদ্ধ করল কোনানের বাম বাহুকে। সে
নিজেও অবশ্য একটুর জন্য বেঁচে গেল কোনানের সজোরে ঘুরানো কুঠারের আঘাতের হাত থেকে।
পুনরায় একসঙ্গে আক্রমণ করল আক্রমণকারীর দল। হুস হাস শব্দ করে এদিকে সেদিকে ঝলসে
উঠতে থাকল কোনানের কুঠার। এক দাড়িওয়ালা ঘাতক নিচু হয়ে চেপে ধরল কোনানের পা।
কিছুক্ষণ টানা হ্যাঁচড়া করে বুঝল একে নড়ানো তার কম্ম নয়। এ লোহার
মিনারের মতো অনড়। তারপরেই দেখতে পেল কালান্তক কুঠার নেমে আসছে তার দিকে। না
এড়াতে পারল না তার আঘাত। এর মাঝেই ওই ঘাতকের আর এক সঙ্গী একটা চওড়া ওজনদার তলোয়ার
দুহাতে ধরে আঘাত হানলো কোনানের বাম কাঁধের উপর।
গল গল করে বেরিয়ে এল রক্তের ধারা।
ভোলমানা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। এবার অধৈর্য হয়ে
আক্রমণকারীদের এদিকে সেদিকে ঠেলে দিয়ে নিজে এগিয়ে গিয়ে
কোনানের শিরস্ত্রাণহীন মাথা লক্ষ্য করে আঘাত হানল। কোনোক্রমে নিজের মাথা বাঁচাল
কোনান। কালো চুলের একটা গোছা কেটে পড়ে গেল মাটিতে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে
কোনান গোড়ালিতে ভর দিয়ে ঘুরে এক পাশ থেকে হাঁকাল তার কুঠার। ইস্পাতের বর্মের উপর
সশব্দে আঘাত হানল ভারী কুঠারের ফলক। বাঁদিকের বর্ম খসে পড়ে গেল ঘাতক দলের
নেতার।
“ভোলমানা!” রুদ্ধশ্বাস
কন্ঠে গরজে উঠল কোনান, “ওরে নরকের কীট, ব্যাটা বামন-”
আর একদিক থেকে ধেয়ে এল রিনালদো। চোখে বন্য দৃষ্টি, হাতে কেবল মাত্র একটা ছোরা । কোনান
পিছিয়ে গিয়ে, কুঠার
ওঠালো।
“রিনালদো!” কন্ঠে মরিয়া আবেদন। “পিছিয়ে যাও! আমি তোমাকে মারতে চাই না -”
“মর, অত্যাচারী!” চিৎকার করে উঠল পাগল কবি,
ধেয়ে গেল রাজার দিকে। কোনান এসব দেখতে গিয়ে আঘাত হানতে একটু দেরি
করে ফেলল। ততক্ষণে তার মস্তিষ্কে ধাক্কা মেরেছে এক তীব্র যন্ত্রনার অনুরণন।
ইস্পাতের ফলা কামড় বসিয়েছে তার অসুরক্ষিত শরীরের অংশে। প্রায়
অন্ধর মতোই আঘাত হানল কোনান। রিনালদোর মাথার খুলি ফেটে
গেল ছিন্নভিন্ন
হয়ে। ধুপ করে পড়ে গেল শরীরটা। কোনান পিছিয়ে গেল দেওয়ালের গায়ে। ক্ষতস্থান
চেপে ধরা আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত ছিটকে বের
হচ্ছিল।
অ্যাস্কালান্টে চিৎকার করে বলে
উঠল, “এবার, ওকে হত্যা করো!”
কোনান দেয়ালে ঠেঁস দিয়ে দাঁড়িয়ে কুঠার
উঁচিয়ে ধরল। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল অনিবার্য আদিমতার এক ভিত্তি চিত্র–পা দুপাশে
ছড়ানো। মাথা
এগিয়ে আছে সামনের দিকে। দেওয়ালের গায়ে এক হাত রেখে ভার সামলাচ্ছে আহত শরীরের।
আর অন্য
হাতে তুলে ধরেছে দুর্দম কুঠার। লোহার মতো
শক্ত পেশিগুলো ফুলে উঠেছে উত্তেজনায়। হিমশীতল ক্রোধ ভয়ানক মৃত্যুর রূপ ধারণ করেছে যেন–রক্ত মাখা
মুখে চোখদুটো আগুনের মত ভয়ঙ্করভাবে জ্বলছে। বিভ্রান্ত
হয়ে পড়েছে আক্রমণকারীরা–তারাও
আচরণে বন্য, স্বভাবে অপরাধী এবং বেপরোয়া, তবুও তারা
অবস্থান করে মূলত সভ্য সমাজের অংশ হিসাবেই, তাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটটাও সভ্য বলেই
বিবেচিত হয় সমাজে। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অসভ্য বর্বর-জন্মজাত ঘাতক। ওরা এক পা
পিছিয়ে গেল–আহত
বাঘ সুস্থ বাঘের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর, সাক্ষাৎ মৃত্যু দূত।
কোনান ওদের মানসিক অনিশ্চয়তা অ্নুভব করে
উল্লাসহীন হিংস্র মুখে হাসল। রক্তমাখা ঠোঁট মুছে বিড়বিড় করে বলল, “কে মরতে চাস
সবার আগে?”
অ্যাসকাল্যান্টে নেকড়ের মতো লাফিয়ে উঠে
এগিয়ে আসতে গিয়েও অবিশ্বাস্য দক্ষতায় নিজেকে সামলে নিল। সমানে হিস হিস করতে থাকা মৃত্যুর রূপ চিনতে তার ভুল হয়নি। তার
ভেতরেই তরোয়ালের যে আঘাত চালিয়ে ছিল সেটা এড়িয়ে গেল কোনান, সঙ্গেই করল প্রত্যাঘাত।
সে আঘাতে অবশ্য কুঠারের ফলাটা অ্যাস্কালান্টের পায়ের খুব কাছেই চকচকে মেঝেতে কয়েক
ইঞ্চি ঢুকে গেল।
আর এক ভাড়াটে সেনা কিছুটা অনিশ্চিতভাবেই এই সুযোগটাকে
বেছে নিল কোনানকে আক্রমণ করার জন্য । সিমেরিয়ান
তার কুঠারটাকে মেঝে থেকে উঠানোর
আগেই সে আঘাত হানার চিন্তা করে। কিন্তু তার ভাবনাতেই ভুল ছিল। চোখের নিমেষে কুঠারটা
উঠল এবং নামল, আর রক্তমাখা একটা মানবদেহ ছিটকে গিয়ে পড়ল আক্রমণকারীদের পায়ের
কাছে।
ঠিক সেই মুহুর্তে দরজার কাছে
দাঁড়িয়ে থাকা ঘাতকদের দিক থেকে ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার ভেসে
এল। তার সঙ্গেই একটা মিশকালো বিশালকায় কিছুর ছায়া পড়ল দেওয়ালের গায়ে। অ্যাসকালান্টে বাদে বাকিরা সেই আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাল এবং প্রায় কুকুরের মতো গুঙিয়ে উঠল। চোখের পলক
ফেলার আগে তাড়া খাওয়া কুকুরের মতোই ওরা ছুটে বেরিয়ে গেল দরজার বাইরে। শোনা গেল
করিডোর দিয়ে ওদের ছুটে পালানোর শব্দ।
অ্যাস্কালান্টে দরজার দিকে তাকায়নি, ওর চোখ ছিল কেবল আহত রাজার দিকে। সে ভেবে নেয়, সম্ভবত এই
লড়াইয়ের আওয়াজ
শেষ প্রাসাদের
এদিকে সেদিকে পৌঁছে গেছে। এবার অনুগত প্রহরীরা চলে আসবে
তাকে ধরার জন্য। কিন্তু এর ভেতরেও তার একটা ব্যাপার অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল। তার দলের পোড়খাওয়া ঘাতকেরা এরকম ভয়ঙ্কর
চিৎকার করতে করতে কেন পালাল! কোনানও দরজার দিকে তাকায়নি। মৃত্যু পথযাত্রী নেকডড়ের মতো জ্বলন্ত চোখ দিয়ে সে
অ্যাসকাল্যান্টেকে দেখছিল। এই চরম
অবস্থাতেও অ্যাসকালেন্টের মনের শয়তানি
ভাবনাটা একই রকম ছিল ।
“বোধহয় সমস্ত কিছুই শেষ
হওয়ার পথে, বিশেষ করে সম্মান,” বিড়বিড় করে উঠল সে। “সে যাইহোক,রাজা নিজের
পায়ে খাড়া হয়ে থাকা অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করছে - এবং - “আর কী কী সব ভাবনা তার মনের খেলা করছিল
জানার উপায় নেই। আপাতত মুখের কথা শেষ না করেই সে হাল্কা চালে এগিয়ে গেল কোনানের
দিকে। সিমেরিয়ান তখন কুঠার ধরা হাত দিয়ে রক্তভেজা প্রায় অন্ধ চোখটা মোছার চেষ্টা
করছিল।
তবে অ্যাসকালান্টে কিছু করার আগেই সেখান
হাওয়ার শনশন শব্দ শোনা গেল এবং তার সঙ্গেই একটা ভারী ওজনের কিছু
প্রবলভাবে তার
কাঁধে আঘাত
করল। ঠেলে ফেলে দিল ওকে মেঝের উপর। বিরাট মাপের নখওয়ালা থাবা
চেপে বসল ওর শরীরের মাংসের উপর। আক্রমণকারীর থাবার নিচে
পিষ্ঠ হতে হতে মরিয়া ভাবে মাথা ঘুরিয়ে
অ্যাসকালান্টে তাকাল যে মুখের দিকে তাকে উন্মাদগ্রস্থ কোন দুঃস্বপ্ন
ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। তার উপর ঝুঁকে আছে যে কালো রঙের বস্তুটা, তার জন্ম যে
কোন সুস্থ বা মানবিক জগতে হয়নি সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না। ওটার কালো
নখ যুক্ত থাবা এগিয়ে আসছিল গলার দিকে। অজ্ঞাত
আতঙ্কর হলুদ
চোখে সেই হত্যাকারী ঝোড়ো বাতাসের ইঙ্গিত যা কচি ভুট্টাগাছেদের দুমড়ে মুচড়ে শেষ
করে দেয়। মুখে যে ঘৃণ্য ভাব সেটা বুনো পশুর
থেকেই জঘন্য। এর তুলনা হতে পারে এক প্রাচীন, আসুরিক মমির মুখের সঙ্গে যে
শয়তানের অনুচর।
এইসব ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা ভাবতে ভাবতেই বিদ্রোহী দলনেতার চোখ যেন দেখতে
পেল আরো কিছু। এক ভয়ানক সাদৃশ্য। তার
ক্রীতদাস থথ-অ্যামনের উন্মাদনার ছায়া যেন
এই দানবকে পরতে পরতে জড়িয়ে রেখেছে।
এই অনুভুতির সঙ্গে সঙ্গেই
অ্যাসকালান্টের যাবতীয় শয়তানি ভাবনা চিন্তা তাকে ছেড়ে বিদায় নিল। শরীরের উপর
ঝুঁকে থাকা হত্যাকারীর নখ গলা স্পর্শ করার আগেই তার আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
কোনান, তার চোখের উপর থেকে রক্ত মূছে স্তম্ভিত
মূর্তির মতো তাকিয়ে ছিল। প্রথমে তার মনে হয়েছিল একটা দানবাকৃতি কালো হাউন্ড
বোধহয় আসকালেন্টের
বিকৃত শরীরের
ওপরে দাঁড়িয়ে
আছে। কিন্তু চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দেখতে পেল, ওটা
কোন হাউন্ড তো নয়ই কোনও বেবুনও নয়। বেশী না ভেবে এক অদ্ভুত রকমের, প্রায়
অ্যাস্কালান্টের শেষ আর্তনাদের মতোই, চিৎকার করে কোনান সরে যেতে থাকল দেওয়ালের গা
থেকে। কোনোরকমে শরীরের সব শক্তি একত্র করে কুঠারের আঘাত হানল ওটার গায়ে। দানবটার
খুলি চুরমার হয়ে যাওয়ার বদলে কুঠারটাই ছিটকে চলে গেল। দানবের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর
আপ্রাণ প্রচেষ্টায় হাঁচড়পাঁচড় করে পার হয়েও গেল ঘরের অর্ধেকটা।
এই মুহূর্তে দানবের দন্তবিকশিত মুখ গহ্বর পৌঁছে গেছে
কোনানের হাতের
উপর। গলা বাঁচাতে হাতটাকেই ঢাল করেছে কোনান। রক্তাক্ত হাতের উপর
দিয়ে এই মুহূর্তে
দানবটা নারকীয় চোখে তাকিয়ে আছে রাজার চোখের দিকে। যেখানে
দেখা যাচ্ছে সেই আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি যা একটু আগে অ্যাসকালান্টের চোখ দেখেছিল। কোনান অনুভব করছিল, তার আত্মা কেমন যেন
শিথিল হয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে
যাওয়ার উপক্রম করছে। মিশে যেতে চাইছে সামনের ওই বীভৎস হলুদ চোখের মহাজাগতিক ভয়াবহতার ভিতর।
যেখানে চলছে ক্রমবর্ধমান নিরাকার বিশৃঙ্খলতার দাপাদাপি। যা গিলে
নিচ্ছে সমস্ত
জীবন এবং বিচক্ষণতাকে।
ধীরে ধীরে বাড়ছে সে চোখের আকার। দানবিক আকার সম্পন্ন সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সিমেরিয়ান নিরাকার
বাহ্যিক অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপ্রীতিকর ভয়াবহ বাস্তবতার ঝলক দেখতে পাচ্ছিল।
চেষ্টা করল রক্তমাখা ঠোঁট ফাঁক করে বুকের ভিতর জমে ওঠা
আতঙ্কটাকে চিৎকার করে জানান দেওয়ার। পারল না!
কিছু শুকনো ঘ্যাসঘেসে আওয়াজ শুধুমাত্র তার গলা থেকে বেরিয়ে
এল।
যে বিভীষিকা অ্যাসকাল্যান্টেকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়ে খতম করে দিয়েছিল সেই অনুভুতি
সিমারিয়ানের মনে এমন এক উন্মত্ত ক্রোধের জন্ম দিল যাকে পাগলামির সঙ্গেই
তুলনা করা যায়
। আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ সম ঝটকায় কোনান পুরো
শরীরটাকে ঠেলে দিল পিছনের দিকে। করাল চোয়ালে আবদ্ধ যন্ত্রনাক্লিষ্ট হাত সহযোগে ওই
দানবকেও সে টেনে নিয়ে গেল নিজের সঙ্গে। এই
সময়েই তার হাতে ঠেকল একটা কিছু, লড়াই
ক্লান্ত মস্তিস্ক জানান দিল ওটা তার ভেঙে যাওয়া তরোয়ালের হাতল। সাতপাঁচ না ভেবে ওটাকে আঁকড়ে ধরল কোনান, গায়ের
সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ওটাকে গেঁথে বসিয়ে দিল দানবটার গায়ে ছুরিকাঘাত করার ভঙ্গীতে। ভাঙা ফলা আমুল বিদ্ধ হতেই যন্ত্রনায়
চেঁচিয়ে উঠল বিকট সেই সত্তা। আর তার সঙ্গেই মুক্ত হল কোনানের হাত। চকিতে
একপাশে সরে গেল সে। দেখতে পেল দানবটার শরীরের ক্ষতস্থান থেকে ভলকে ভলকে ঘন রক্ত ছিটকে
বেরিয়ে আসছে। ছটফট করছে ওটা। একটু বাদেই থেমে গেল সব ছটফটানি, ভয়াবহ মৃত চোখদুটো
উন্মুক্ত অবস্থায় উর্ধ্বমুখী হয়েই থেকে গেল। কোনান পুনরায় নিজের
চোখের উপর থেকে
রক্ত মুছলো,
অবাক হয়ে বার কয়েক চোখ পিটপিট করল। সামনের
বস্তুটা কেমন যেন মনে হচ্ছে গলে গলে যাচ্ছে, পরিণত হচ্ছে থকথকে একটা পদার্থে।
এরপরেই একাধিক মানুষের কণ্ঠস্বর ওর কানে এসে
ধাক্কা মারল। ওর রাজপ্রাসাদে থাকা - নাইট, মন্ত্রী, কিছু নারী,
প্রহরী, কাউন্সিলর–সবাই
একসঙ্গে চিৎকার করে ঠেলেঠুলে
এ ওর সামনে আসার চেষ্টা চালাচ্ছিল। বিদেশী ব্ল্যাক ড্রাগন
প্রহরীদের মূখে পাশব রাগের অভিপ্রকাশ স্পষ্ট,
শরীর ঝাঁকিয়ে শপথ করছে এর কারণ খুঁজে বের করার। যে অল্পবয়সী রক্ষীপ্রধানের উপর
এই দরজা পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাকে আর এরপর খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
“গ্রোমেল! ভোলমানা! রিনালদো! “ হাই কাউন্সিলর, পাবলিয়াস
তার চর্বিযুক্ত হাত মৃতদেহগুলোর
দিকে নির্দেশ করে উত্তেজিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল। “কী সাংঘাতিক বিশ্বাসঘাতকতা!
কাউকে তো এর ফল ভোগ করতেই হবে! প্রহরীদেরকে ডাকো! “
ততোধিক উত্তেজিত কন্ঠে ব্ল্যাক ড্রাগনদের এর কমান্ডার
প্যালান্টাইডিস বলল, “প্রহরীরা
তো এখানেই, হাঁদারাম
দেখতেও পাচ্ছে না!”
এরকম মুহূর্তে ও পাবলিয়াসের উচ্চপদে আসীন থাকার কথাও ভুলে গিয়েছিল। “আপাতত আপনার
দোষারোপ বন্ধ রেখে রাজা কোনানের ক্ষতস্থানের
শুশ্রূষায় সাহায্য করুন। যা রক্ত বের হচ্ছে তাতেই না ওঁর...।”
“ঠিক ঠিক!” পাব্লিয়াস সম্মতি জানালেন, আসলে মানুষটা কাজ করার চেয়ে পরিকল্পনা করাতে বেশি
দড়। “আমাদের অবশ্যই ক্ষতস্থানগুলোকে
বাঁধার ব্যবস্থা করতে হবে। যত জলদি সম্ভব
রাজবৈদ্যকে ডেকে নিয়ে এসো! ওহ, ঈশ্বর, কী লজ্জাজনক ব্যাপার এই নগরের পক্ষে! রাজন, আপনিই
কী সবাইকে খতম করেছেন?”
“মদ
দাও!” পালঙ্কের
উপর নিয়ে গিয়ে শোয়াতেই কোনান চেঁচিয়ে উটল। রক্তাক্ত ঠোঁটের কাছে
মদ ভর্তি পানপাত্র ধরতেই তৃষ্ণায় ঠেলায় প্রায় মরে যাওয়া মানুষের মতো গব গব করে ওটা
গিলে নিল সে।
“ওহ!
কী শান্তি!” বলেই
ধপ করে আবার পড়ে গেল। “হতচ্ছাড়াদের
খতম করতে করতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়ে ছিল।”
পরিচারকেরা ইতিমধ্যে রক্তের প্রবাহ
অনেকটাই থামাতে পেরেছে। বর্বর মানুষটার সহজাত প্রাণ শক্তি
একটু একটু করে ফিরে আসছে আবার।
রাজবৈদ্যর উদ্দেশ্যে কোনান বলল, “সবার আগে আমার দিকে
পাঁজরের কাছের ক্ষতটাকে দেখুন। রিনালদো আমাকে ওখানে তার
ছোরা কলম দিয়ে প্রায় খতম করে দেওয়ার মতোই আঘাত করা গান শুনিয়েছিল।”
“আমাদের অনেক আগেই ওটাকে ফাঁসি দেওয়া উচিত ছিল,” পাবলিয়াস বললেন। “কবিদের কাছ
থেকে ভালো ব্যবহার আশাই করা যায় না – এটা আবার কে? “
একটু ভয়ে ভয়েই চটি পরা পায়ের আঙ্গুল দিয়ে
অ্যাসকালান্টের
দেহটি স্পর্শ করে বললেন।
“মিত্রার
দিব্যি!” কমান্ডারের
কন্ঠ শোনা গেল। “এটা অ্যাসকালান্টে, একদা থুনের
কাউন্ট ছিল!
হায় ঈশ্বর! কোন
শয়তানের অনুচর ওকে তাঁর মরুভূমি এলাকা থেকে এখানে নিয়ে
এসেছিল?”
“কিন্তু
ও এরকম ভাবে তাকিয়ে আছে কেন?” ফিসফিস করে কথাটা বলে সরে গেল মৃতদেহটার কাছ থেকে।
অজ্ঞাত কারণে ওর চোখ বিস্ফারিত এবং চর্বিওয়ালা ঘাড়ের রোম সব খাড়া হয়ে গেছে।
উপস্থিত বাকিরাও মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল।
“আমি
আর ওই মানুষটা যা দেখেছি তা যদি আপনি দেখতেন”, রাজবৈদ্যর
বাধা দেওয়া সত্বেও কোনান উঠে বসে বলল, “আপনি অবাক হতেন না। আপনার চোখ সুযোগই
পেত না ওকে দেখে বিস্ফারিত হওয়া-” একটু থেমে সে আঙুল তুলে
একটা কিছু দেখাতে গিয়ে মুখ হাঁ হয়েই থেকে গেল। কোনান চাইছিল মৃত দানবটাকে দেখাতে।
কিন্তু সেখানে কিছুই পড়ে নেই!
“হায়
ক্রোম!”
বিস্ময়ের স্বর রাজার গলায়, “যে
অন্ধকার পথে সে এসেছিল সেখানেই ফিরে গেছে মনে হচ্ছে !”
“রাজার
বিকার ঘটেছে,
ভুল বকছে” একজন অভিজাত ফিসফিস করে বললেন।
কোনান সেটা শুনে বর্বরোচিত
শপথ করে
ক্রোধান্বিত স্বরে বলল, “ব্যাডব, মরিগান, মাচা এবং নেমেইনের দিব্যি! আমি এখনও
জ্ঞান হারাইনি! ওটা
দেখতে ছিল স্টিগিয়ান মমি আর বেবুনের মিলিত রূপ।
ওই দরজা দিয়ে ওটা এসেছিল। ওকে
দেখেই অ্যাস্কালেন্টের বাকি দলবল পালিয়ে যায়। তারপর অ্যাসকালান্টেকে হত্যা করে ধেয়ে
আসে আমার দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার উপর! আমি ওটাকে খতম করি - জানি না কেন আমার কুঠারটা ওর
গায়ে লেগে ছিটকে গিয়েছিল। যেন কোন পাথরের গায়ে আঘাত করলাম। তবে আমার মনে হয়
এটাতে আমার দেখা সাধু এপিমিট্রিয়াসের কিছু একটা -”
“পাগল
নাকি! কীভাবে উনি এপিমিট্রিয়াসের দেখা পেতে পারেন! তিনি তো পনেরোশো বছর আগেই মারা
গেছেন!”
উপস্থিত মানুষেরা একে অপরকে ফিসফিস করে এরকম
কথাই বলল।
“ইমিরের দিব্যি!” গর্জন করে উঠলেন রাজা কোনান। “আজ রাতেই আমি এপিমিট্রিয়াসের সঙ্গে কথা বলেছি! উনি আমার স্বপ্নে আবির্ভূত
হয়েছিলেন। তার ডাক শুনেই প্রাচীন দেবদেবীর রূপ খোদাই করা কালো পাথরের
করিডোর বেয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম এক পাথরের সিঁড়িতে। যার প্রতিটা ধাপ ছিল সেটের মূর্তির মত। ওটা দিয়ে নেমে যাই এক
ভূগর্ভস্থ কবরখানায়। সেখানেই ছিল একটা সমাধিবেদী। যার উপর ফিনিক্স খোদাই- “
“মিত্রার নামে হুজুর, হে
রাজন, চুপ করুন!” শোনা গেল
মিত্রার মহাযাজকের চিৎকার, তার মুখ ফ্যাকাশে
মেরে গিয়েছে ছাইয়ের মত।
কোনান রাগী সিংহের মত নিজের কালো চুলের গুচ্ছ ঝাঁকিয়ে গর্জন
করে উঠল, “আমি কী তোমার দাস, যে তোমার আদেশে আমাকে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে?”
“না, না, হুজুর!” মহাযাজক কাঁপছিলেন, কিন্তু সেটা
রাজকীয় ক্রোধের ভয়ে নয়। “আমি আপনাকে
অপমান করতে চাইনি।” একটু
এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে
রাজার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে এমন কিছু
কথা বলল যা আর কেউ শুনতে পেল না।
“হুজুর, এটা মানুষের বোধগম্য বিষয়ের উর্ধ্বে। শুধুমাত্র
যাজকতন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত কিছু মানুষ এর কথা জানেন। গোলামিরা পাহাড়ের কালো হৃদয়ের ভিতর
অবস্থিত অজ্ঞাত হাতের খোদাই করা কালো পাথরের করিডোরের
কথা । একমাত্র তারাই জানে ওখানকার সেই
ফিনিক্স-রক্ষিত সমাধিস্থলের
কথা যেখানে এপিমিট্রিয়াসকে পনেরোশ বছর
আগে কবর দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় থেকে কোনও জীবিত মানুষ ওখানে ঢোকেনি। তাঁর নির্বাচিত অনুগামীরা ওঁকে
কবরস্থ করার পর করিডোরের বাইরের প্রবেশপথটাও বন্ধ করে দেয় যাতে কোনও মানুষ ওটাকে খুঁজে না পায়। এমন
কী আজও মহাযাজকরা জানেন না যে ওটা আসলে
ঠিক কোথায়। কেবলমাত্র
মুখের কথায় মহাযাজকদের দ্বারা নির্বাচিত কয়েকজনের হাতে ওই স্থান রক্ষণাবেক্ষনের
দায়িত্ব দেওয়া আছে। মিত্রার মহাচক্রের কিছু অনুচর জানেন গোলামিরার কালো হৃদয়ে এপিমিট্রিয়াসের অন্তিম
বিশ্রামের জায়গাটির
কথা। এ এমন এক রহস্য, যার উপরে মিত্রার সংস্কৃতি অবস্থান করে আছে।”
“আমি
জানি না এপিমিট্রিয়াস আমাকে কী জাদু করে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন,” উত্তর দিল কোনান। “কিন্তু এটা সত্যি
যে, আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি এবং উনি আমার তরোয়ালে হাতলের নিচের দিকে একটি প্রতীক চিহ্ন
স্থাপন করে দেন। সেই চিহ্নর কী অর্থ বা কী কারণে
শয়তানদের জন্য ওটা সাংঘাতিক কিছু বা চিহ্নটির পিছনে কী জাদু আছে, সেটাও আমি জানি না। তবে ওটার ফলা গ্রোমেলের
শিরস্ত্রানের উপর আঘাত করার সময় ভেঙে যায়। তা সত্বেও যেটুকু ছিল সেটাই যথেষ্ট ছিল
ওই অজ্ঞাত দানব খতম করার জন্য।”
“আমাকে তরোয়াল
একবার দেখতে দিন, রাজন” শুকনো ঠোঁটে ফিসফিস করে বললেন মহাযাজক।
কোনান ভাঙা অস্ত্রটা
তুলে ধরল, যা দেখেই মহাযাজক চিত্কার করে উঠে হাঁটু
গেড়ে বসলেন।
“মিত্রা অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের রক্ষা করুন!” ঢোঁক গিলে
বললেন, “রাজা
কোনান সত্যিই আজ রাতে এপিমিট্রিয়াসের সঙ্গে কথা বলেছেন! প্রমান তরোয়ালেই-ওই গোপন প্রতীক
সেই মানুষটা ছাড়া আর কেউই তৈরি করতে পারে না- অমর আগুন
পাখির প্রতীক
যা তাঁর সমাধির ওপরে খোদাই
করা আছে ! একটা মোমবাতি
নিয়ে এসো, জলদি! রাজন
যে জায়গা দেখালেন সেই জায়গাটাকে ভালো করে দেখা হোক। যেখানে দানবটা মারা গিয়েছিল!”
একটা ভাঙা আবরণীর তলায় জায়গাটা চাপা পড়ে
ছিল। ওটাকে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই
মেঝেতে গিয়ে পড়ল মোমবাতির আলো। যারাই তাকাল তাদের শরীর কেঁপে উঠল ঠকঠক করে। চরম
নীরবতা নেমে এল ঘরে। কিছু মানুষ হাঁটু গেড়ে বসে
প্রার্থনা শুরু করে দিল আর কিছু ছুটে পালাল ঘর থেকে।
দানবটা যেখানে মারা গিয়েছিল সেই মেঝেতে আটকে আছে
একটা কালো স্থির
ছায়ার মতো দাগ। যাকে ধুয়েও পরিষ্কার করা যায়নি। সেই অজ্ঞাত সত্তা তার নিজ
রক্ত দিয়ে স্পষ্টভাবে নিজ শরীরের
প্রান্তরেখার ছাপ রেখে গেছে। যা এই সুস্থ স্বাভাবিক পৃথিবীর কোনও কিছুর মতোই দেখতে
নয়। মারাত্মক
এবং ভয়াবহ
উদাসীনতা মাখা সেই দাগ, যা দেখতে অনেকটা স্টিগিয়ার তমসাচ্ছন্ন এলাকার কুয়াশা ঘিরে থাকা মন্দিরের বেদীতে
অবস্থিত, বানর
সদৃশ দেবতাদের মূর্তির মতো।
[প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই লেখা প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ নয়েজ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে 'কোনান অমনিবাস' এতে।]