বিশ্ব ভূত কথা – ঘুমাতে যাওয়ার আগে
দ্বিতীয় অধ্যায়
প্রথম বিখ্যাত ভূতের কথা
আদিকালের কিছু হিব্রু নথির খোঁজ পাওয়া গেছে
যেখানে জীবিত মানুষেরা মৃতদের বা ভূতেদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
এই সিরিজের প্রথম পর্বে আমরা দেখেছিলাম, প্রায় সব সভ্যতাই বিশ্বাস করে যে, মৃত্যুর পর কিছু একটা রূপের অস্তিত্ব আছে। সেখানে অনেকেই বলেছেন, শরীর থেকে বের হয়ে
যাওয়া আত্মারা একটা ‘ইথার’ জগতে
অবস্থান করে। যার সময়ের পার্থিব নিয়ম কানুন মেলে না।
আর সেই জন্যেই যারা মারা যায় তারা অতীত, বর্তমান এবং
ভবিষ্যত দেখতে সক্ষম। অতএব যদি আপনি সত্যিই জানতে চান যে, আগামীকাল কী ঘটতে চলেছে, তাহলে এ ব্যাপারে
যারা সবচেয়ে ভাল জানে, সেই ‘তেনা’দের শরণাপন্ন হওয়াই সঠিক কাজ। কি বলেন?
আর এই কথাকেই বাস্তবে পরিণত করতে সব
সমাজেই সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত, এমন সব বিশেষজ্ঞদের দেখতে পাওয়া গেছে বা যায় এবং যাবেও যারা জীবিত মানুষের সাথে আত্মার যোগাযোগ করতে সাহায্য করতে এক পা বাড়িয়ে বসে আছেন। তাদের পরিচয় আপনারা সবাই
জানেন। এরা মৃতদের
সাথে কথোপকথন করার জন্য এক বিশেষ ধরণের ভবিষ্যদ্বাণী
বা ভাগ্য বিচার করা পদ্ধতি ব্যবহার করে। যা ‘নেক্রোম্যান্সি’ নামে পরিচিত। এই শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দ ‘নেক্রোম্যান্টিয়া’ শব্দ
থেকে। যার ভেতর আছে দুটো শব্দ ‘নেক্রস’ বা মৃত মানুষ এবং ‘ম্যান্টেইয়া’ বা ভবিষ্যত
কথন।
কবরের বা সমাধির ভেতর থেকে উঠে আসা আওয়াজ
আজ যদিও নেক্রোম্যান্সি শব্দটা ‘ম্যাজিক’ এর আর এক রূপ হিসাবে ব্যবহার হয়, কিন্তু মূল শব্দর সাথে কিছু পরিমাণ গুপ্ত এবং অপ্রীতিকর বিষয় মিশে আছে।
একদা নেক্রোম্যান্সি
এই শব্দটা কেবলমাত্র মৃতের আত্মাকে ভবিষ্যতের
পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে সক্ষম বিদ্যার জন্যই ব্যবহার হত বা
এই কলাবিদ্যাকেই নির্দেশ করত।
নেক্রোম্যান্সিকে বাস্তবিক পক্ষেই যে কোনও ভাগ্য গণনাকারী, জাদুকর এবং বিশেষত মায়াবী জাদুকর বা ‘সরসরার’দের জন্য এক অপরিহার্য দক্ষতা হিসাবে
বিবেচনা করা হত। একটা আত্মা আহ্বান প্রক্রিয়ায়
প্রকৃত জাদুকরকে যথেষ্ট কৃচ্ছসাধন করতে হত। যার ভেতর অন্যতম ছিল উপবাস । তা ছাড়াও ছিল গোপন আচারপ্রথা পালন নানা অজ্ঞাত মন্ত্র সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে
শেখা। সাথেই জাদুবৃত্ত অঙ্কণ প্রনালী
অধ্যয়ন। যার সামান্য মাপের গণ্ডগোলে জগত ভারসাম্যর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
গত লেখার শেষ প্যারাগ্রাফের
সূত্রে একটা প্রশ্ন মনে জাগছে। আচ্ছা বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে এত অশান্তির
কারণ অশিক্ষিত জাদুকরদের ভুলভাল কাজকর্ম নয় তো? ভাল একটা গল্পের প্লট কিন্তু। শুধু তাই নয় যে
কোনও সমস্যা এই একটা যুক্তিতেই সমাধান করে দেওয়া যায়। - অধম লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত মত
প্রাচীন যুগের উইচক্র্যাফটের
প্রামান্য নথি
নেক্রোম্যান্সির ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত নথিভুক্ত ঘটনা হল, উইচ অফ এন্ডোরের কাছ থেকে
সাউলের পরামর্শ নেওয়া। যা পবিত্র বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে পাওয়া যায়। প্রথম স্যামুয়েলের পুস্তক: ২৮-৭১৬।
মোজেসের প্রচলিত আইন অনুসারে নেক্রোম্যান্সি এবং জাদুবিদ্যা ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
"তোমার বেঁচে থাকার জন্য কোনও ‘উইচ’কে কষ্ট পেতে
দেওয়া চলবে না।" (এক্সোডাস ২২:১৮)
"যে পুরুষ বা মহিলার পরিচিত বা অধীনস্থ আত্মা বা যে একজন জাদুকর
থাকবে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে।" (লেভিটিকাস ২০:২৭ )
"তোমাদের মধ্যে যেন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া না যায়, যে ভবিষ্যদ্বাণী করে [সুথসেয়ার] বা একজন জাদুকর বা একজন ‘আউগার’[এরা কোন একটা ছোট
জন্তু কেটে তার আঁতড়ি বা নাড়িভুড়ির অবস্থান দেখে ভাগ্য বিচার করতেন] বা একজন মায়াবী জাদুকর[সরসরার] বা একজন ‘চার্মার’ বা একজন ‘মিডিয়াম’ বা ‘উইজার্ড’ বা
নেক্রোম্যান্সারের জীবন ধারন করে বেঁচে আছে। যে কেউ এই কাজগুলো করে সে মহান প্রভুর কাছে একজন ঘৃণ্য সত্তা রুপে বিবেচিত।"(ডিউটেরোনমি ১৮:১০১৩)
সাউল নিজেই ইস্রায়েলীয়দের
মধ্যে জাদুবিদ্যাকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন, " পরিচিত বা অধীনস্থ আত্মা বা যে একজন জাদুকর
থাকবে যাদের তাদের" তাড়িয়ে দেওয়া হবে। তবুও, অবস্থার বিপাকে পড়ে
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত
রাজা একজন নেক্রোম্যান্সারের
সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন।
কেন? সে গল্প শুনুন তাহলে।
মহান প্রভু তথা ঈশ্বর ডেভিডকে সাউলের উত্তরসূরি হিসাবে
অভিষিক্ত করেছিলেন। যার প্রস্তুতি হিসাবে ডেভিড শাসকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন শুরু করেন। এমতাবস্থায় সাউলের পরামর্শ প্রয়োজন ছিল এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় ততই ভালো। ফলে নিজেই অবৈধ ঘোষনা করা নেক্রোম্যান্সীর সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কী করবেন এটা জানার জন্য তিনি স্যামুয়েলের আত্মাকে ডেকে আনার কথা ভাবেন।
খোঁজ খবর নেওয়ার সময় সাউল জানতে পারেন এন্ডোর শহরে এরকম একজন আছেন যিনি এই নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম।
যাতে তাকে চেনা না যায় তার জন্য সাউল ছদ্মবেশ ধারণ করেন এবং তথাকথিত ‘উইচ অফ এন্ডোর’ এর কাছে যান। ওই নেক্রোম্যান্সার স্যামুয়েলের আত্মাকে জাগ্রত করেছিলেন, কিন্তু মৃত রাজা এই ঘটনায় এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন
যে তিনি সাউলকে সাহায্য বা পরামর্শ দিতে অস্বীকার
করেছিলেন। যার ফলস্বরুপ উনি যুদ্ধে ডেভিডের কাছে পরাজিত
হয়েছিলেন।
বর্তমান সময়ের গবেষকদের মতে উইচ অফ এন্ডোর সম্ভবত সেই অর্থে ডাইনী বা জাদুকর ছিলেন না। বরং বলা যেতে
পারে প্রাচীন
গ্রীসের অর্যাকল জাতীয় কিছু একটা ছিলেন। প্রসঙ্গত জানাই, প্রাচীন গ্রীসের
এই অর্যাকলেরা ভবিষ্যতের খবর সংগ্রহ করতেন
দেবতাদের কাছ থেকে। কখনও সে কাজে তারা মৃতদেহের সাহায্য নিতেন।
ডেলফিতে এ্যাপোলোর অর্যাকল ছিলেন সেই সময়ের অসংখ্য অর্যাকলদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত । এই অর্যাকলেরা প্রায় সবাই মহিলা ছিলেন। যারা প্রাচীন গ্রীসে মন্দিরেই বসবাস করতেন। অর্যাকলের সাথে পরামর্শ করার জন্য, প্রার্থনাকারীকে পর্যাপ্ত ‘নৈবেদ্য’ পেশ করতে হত। তবেই সুযোগ পাওয়া যেত ভবিষ্যতের ঘটনা সম্পর্কে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার। অর্যাকলদের ‘ভর’ বা ‘ট্রান্স’ হত বা উঠত বলাই ভাল, দেবতাদের সাথে পরামর্শ করার আগে। প্রয়োজনে তারা আন্ডারওয়ার্ল্ডে বাস করা আত্মাদের সাথেও কথা বলতেন। অর্যাকল সর্বদা তার উত্তর ধাঁধার মত ছন্দে দিতেন । সেই উত্তরের আসল অর্থ প্রশ্নকারীকে নিজেকেই বুঝে নিতে হত।
আধুনিক বাইবেলের গবেষক পণ্ডিতরা জানিয়েছেন যে, হিব্রু গ্রন্থের
গ্রিক সেপ্টুয়াজিন্ট অনুবাদে নেক্রোম্যান্সার "উইচ" এর পরিবর্তে "বেলি-টকার" হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যার অর্থ হল এই বিদ্যায় শিক্ষিত
মানুষেরা ‘গ্যাস্ট্রোম্যান্সি’ অনুশীলন করে নিজের
কণ্ঠস্বর এবং মাত্রাকে এতটাই নামিয়ে উচ্চারণ করতে সক্ষম ছিলেন যে সেটা শুনে মনে হত মাটির তলা
থেকে শব্দ উঠে আসছে। আর যদি এই তথ্য সত্যি
হয় তাহলে বলতেই হবে, ‘উইচ অফ এন্ডোর’ কোনও মায়াবী জাদুকরছিলেন না।
বরং উনি ছিলেন এই বিশ্বের আদিযুগের একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট!
প্রথম শতাব্দী, লুকান নামের একজনের
বয়ান অনুসারে এক নেক্রোম্যান্সির ঘটনা পাওয়া যায়। ৪৯ বা ৪৮ খ্রিস্ট পূর্ব সময়ে
সিজার আর পম্পেইয়ের যুদ্ধর কি ফলাফল হবে সেটা জানার চেষ্টা করে এক থেসালিয়ান উইচ।
ওই সময় চলতে থাকা এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে সেই নারী এমন এক মৃত দেহ খুঁজে নেয় যার
ফুসফুসের কোনও ক্ষতি হয়নি। তাকে মন্ত্র বলে জীবিত করে সে। তারপর একের পর এক
মন্ত্রের প্রয়োগ করে। জীবন্ত সাপ দিয়ে চাবুকের মত প্রহার করে। ততক্ষণ অবধি যতক্ষন
না সেই পুনরায় জীবিত সৈন্য তার প্রশ্নের উত্তর দেয়। প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের মৃতদেহকে মন্ত্র বলে জীবিত করার এই পদ্ধতিগত
কিংবদন্তী থেকেই সম্ভবত পরবর্তী সময়ে ভ্যাম্পায়ার এবং জোম্বি জাতীয় ‘ভয়ানক’ চরিত্র
নির্মাণ হয়েছে।
সবই খুব অদ্ভুত বা দুর্বোধ্য!
হাজার হাজার বছর পার করে আসার পর এটা বলা খুব মুশকিল যে, ভূত বিষয়ক যে সব নথি সেই সময়ে
লেখা হয়েছিল সেগুলো লেখকদের কল্পনার বিকাশ বা সাহিত্য, নাকি বাস্তবিক পক্ষেই ‘অ্যাপারিশন’ জাতীয় কিছু ঘটেছিল।
নবম শতাব্দীর গ্রিক মহাকাব্য হোমার রচিত ইলিয়াডে জন্য দায়ী, ভূতেদের সভ্যভব্য, নিষ্ক্রিয় আত্মা বলাই যায়। তারা জীবিতদের বিরক্ত করে না এবং জীবিতরাও তাদের সম্পর্কে খুব একটা উদ্বিগ্ন নয়। যথাযথ শেষকৃত্য এবং আচার অনুষ্ঠান পালন করা হলে তাদের আর সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না।
মৃত্যুর পরে, মৃত ব্যক্তির আত্মা হেডিসের উদ্দেশ্যে
রওনা হয়, যা পৃথিবী পৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত এক নেতি জগত। যার শাসক দেবতা হেডিস। পৃথিবী
পৃষ্ঠের কিছু ফাটল, কিছু গুহা এবং বিশেষ গোপন
কিছু স্থান ওই আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রবেশপথ। যা আজ বিজ্ঞানের যূগে এসে হাস্যকর বলেই
প্রতিভাত হয়। যাই হোক এসব স্থানে সব সময় একজন
পুরোহিত, বা একজন অর্যাকল সব সময় উপস্থিত
থাকেন বলেই বিশ্বাস।
ঐতিহ্যগতভাবে হোমারের দ্বারা রচিত বলেই বিখ্যাত আর
একটি মহাকাব্য ওডিসিতে, জাদুকরী সিরসে নায়ক ওডিসিয়াসকে নির্দেশ দিয়েছিল কিভাবে হেডিসে
পৌঁছতে হবে। যাতে সে দীর্ঘকাল আগে মৃত ভাববাদী টাইরেসিয়াসের আত্মার সাথে
পরামর্শ করতে পারে । সিরসে ওডিসিয়াসকে বলেছিল, ওসিয়ানাসের জলরাশি পার হওয়ার পর পর্যাপ্ত
পরিমাণে নৈবেদ্য পেশ করতে হবে এবং বলি দিতে হবে। সাথেই একটা পরিখা খনন করে সেটাকে ভর্তি করতে হবে মধু, দুধ,
মদ, জল, বার্লি এবং ভেড়ার রক্তের মিশ্রণ দিইয়ে। মৃতদের আত্মারা ওই পরিখার কাছে এসে
উপস্থিত হবে ওই মিশ্রণ পান করার আশায়। কিন্তু
যতক্ষণ না টাইরেসিয়াসের আত্মা উপস্থিত হবে ততক্ষণ ওডিসিয়াস যেন তাদের তলোয়ার দিয়ে তাদের ভয় দেখানো থেকে বিরত না হয়।
আচ্ছা, যারা মিশ্রণ খেতে আসবে
তারা তো ভূত। তাহলে তাদের তো দেহ নেই। দেহ নেই তো যেটা খাবে সেটা যাবে কোথায়? আর দেহ
নেই তাহলে তরোয়াল দেখে ভয় পাবে কেন? দুঃখিত ভূতগন, একটু ইয়ার্কি করার সুযোগ পেয়ে ছাড়তে
পারলাম না। ঘাড় মটকে দিও না বাপু!
ওডিসিয়াস নির্দেশাবলী অনুসরণ করেছিলেন। টাইরিসিয়াস সেই মিশ্রণ পান করার পর যা পরামর্শ প্রদান করেন। ওডিসিয়াস তার মা, অ্যাকিলিস, আগামেমনন, ইডিপাসের স্ত্রী/মা এবং লেডার ভূতেদের সাথেও কথা বলেছিলেন। রাজহাঁসের রূপে থাকা এই লেডার সাথেই জিউসের মিলনে জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত ‘হেলেন অফ ট্রয়’ এর।
ইউলিসিস ওই রকম ভূগর্ভস্থ জগতেই হারকিউলিসের দেখা পেয়েছিলেন। তবে মহাকাব্যের নায়ক ওটাকে ‘ফ্যান্টম
ডাবল’ বা ‘এইডোলন’ বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কারণ আসল হারকিউলিস তখন দেবতাদের সাথে মাউন্ট অলিম্পাসে ছিলেন। আরিব্বাস! ভুতেদেরও স্টান্টম্যান!
বর্ণনা অনুসারে হেডিসে যে আত্মাদের দেখা গিয়েছিল তার ছিল অস্থির প্রকৃতির এবং ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছিল; অন্যথায়, তারা নিরীহই ছিল বলা যায়। তাদের অবয়ব বিশেষ কোন পদার্থ দ্বারা গঠিত ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, যখন ইউলিসিস তার মাকে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করেছিল, তার হাত শূন্যের ভেতর দিয়ে চলে
গিয়েছিল।
হোমারের সময়কাল (খ্রিস্টপূর্ব
৮ম শতাব্দী) থেকে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের
সময় কালে (৪৬৯? -৩৯৯) যখন আমরা পৌঁছাই দেখা যায় ভূত
এবং তাদের প্রকৃতি সম্পর্কের বিশ্বাসে একটা বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এ সময় ভূতেদের সহায়ক এবং সান্ত্বনাদায়ক রূপ দেখতে পাওয়া
গিয়েছে। তারমানে অবশ্য এই নয় তারা কোন ক্ষতি করছে না। এই সময়ের বিশ্বাস অনুসারে মনে করা হত যে, ভূতেরা শোরগোল করতে ভালোবাসে,
প্রকৃতি অস্থির এবং যারা
তাদের বিরক্ত করে বা যারা খুব কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের ওরা তাদের আঘাত বা
হত্যা করতে সক্ষম। বিগত শতাব্দীগুলোতে ‘ওঝা’
জাতীয় মানুষেরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে।
এবার দেখা গেল ভূতেরাও মানুষের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার দাবি
জানান শুরু করেছে! এই সময় বলা হচ্ছে, যারা অকালে বা বিশেষ
করে হিংস্রতার কারণে মারা
গেছে তাদের ভূত বিপজ্জনক ।
এই সময়ের মানুষ মনে করত মৃত ব্যক্তির আত্মা তার কবরের আশেপাশেই অবস্থান করে। বিশেষত করে যারা আত্মহত্যা করে বা কারও দ্বারা খুন হয় বা অকালে মারা যায়। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্ব) তার ‘ফ্যাডো’ নামক লেখায় লিখে গেছেন - ''সমাধিস্থল এবং শবাধারের আশেপাশে চৌর্য বৃত্তির আকাঙ্ক্ষায় যারা ঘুরে বেড়ায়, তারা বলেছে, ওই স্থানে ভূতুড়ে চেহারাদের আবির্ভূত হতে দেখা যায়। ওই সব আত্মারা শুদ্ধ না হওয়ার কারণে এ জগত থেকে বিদায় নিতে পারেনি।"
বিশ্বাস অনুসারে, আপনার আত্মা যদি
প্রকৃত পক্ষে শুদ্ধ না হয় তাহলে এ জগতের ওপরে অবস্থিত ‘ইথার’ জগতে যেতে পারে
না। ভূগর্ভস্থ ‘নরক’ জগতে সে বাধ্য থাকে।
যেখানে তাদের শুদ্ধিকরণ হয় নানা কষ্টদায়ক পদ্ধতিতে। আপনি মৃত্যুর পর যদি এই সব
যন্ত্রনা ভোগ না করতে চান, তাহলে জীবন যাপন করুন শুদ্ধাচারী ভাল মানুষ রূপে।
সূচনা লগ্নের একাধিক খ্রিষ্টান লেখক
এই ভাবনায় জারিত হয়েছিলেন। এই ভাবনাকে মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বও
নিয়েছিলেন। এখান থেকেই ‘পার্গেটরি’ বা পরিশুদ্ধ হতে হবে ভাবনার জন্ম হয়। বুঝতে
অসুবিধা সেই সময়ের সমাজবাদীরা এভাবেই মানুষকে ভাল হয়ে থাকার এবং সমাজকে সুস্থ করার
একটা চেষ্টা করেছিলেন। যদিও নিজস্ব মতামত মানুষকে মানতে বাধ্য করতে গিয়ে তারা
নিজেরাই একাধিক নৃশংস পথের আশ্রয় নিতেন। যার কথা আমার “শেষপাতে” সিরিজের অন্তিম
তিন পোস্টে জানিয়েছিলাম।
আমি কোন পথে যাব বা কী বিশ্বাস করব?
মানুষ বিশ্বাস করত বা করে যে
ভূত আছে এবং তারা বস্তুগত জগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। মৃত্যুর পর আত্মার কী হয় তার সাথে এই বিশ্বাসের সরাসরি সম্পর্ক আছে।
এবার মৃত্যুর পর আত্মা বিষয়ে প্রাচীন গ্রীসের কিছু বিশ্বাসের কথা
আপনাদের জানাই।
মৃতদেহ এবং আত্মা সমাধির ভেতর একসাথেই অবস্থান করে। এমন কিছু সমাধিস্থলের খাওঁজ
পাওয়া গেছে যেখানে জমির ওপর থেকে শবাধারের ভেতর অবধি নল লাগানো আছে। যাতে মৃত ব্যক্তির জন্য পুষ্টিকর তরল পাঠানো যায়। প্রার্থনা বা নেক্রোম্যান্সি জাতীয় আচার দ্বারা এইসব
আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করা যেত।
মৃতদেহ ত্যাগ করার পর আত্মাকে চক্রাকার যন্ত্রণাদায়ক পথ পার হয়ে হেডিসে পৌঁছতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সেখানে মনে করা হত মৃত্যুর পরের জীবনে থাকার জন্য দুটো ভিন্ন অঞ্চল আছে। এক সুখ-সমৃদ্ধ, মনোরম এলাকা যেখানে ধার্মিকদের আত্মা অবস্থান করে। এই স্থান কে কোথাও কোথাও ‘এলিসিয়াম’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। দুই, টারটারাস। এই নামটা নিউ টেস্টামেন্টেও পাওয়া যায়। যেখানে স্থান হত দুষ্ট আত্মাদের। যেখানে তারা যন্ত্রণা ভোগ করত। এই বিশ্বাসটাই নানান ধর্মের স্বর্গ ও নরকের ভাবনার মতই।
আত্মা শরীর ত্যাগ করে এক আধ্যাত্মিক জগতে চলে যায়। যা এক ইথারের জগত, অবস্থান পৃথিবীর ওপরে। যেখানে গিয়ে এই আত্মারা স্রষ্টা বা
চূড়ান্ত সত্তার সাথে মিশে যায়।
আত্মাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো যায় এবং শাস্তি হিসেবে
সেখানে তাকে মানবেতর রূপে জীবনযাপন করতে হতেও
পারে।
দেহের মৃত্যুর সাথেই আত্মার মৃত্যু হয়। এপিকিউরিয়ানদের
দ্বারা সমর্থিত, এই ভাবনা নিশ্চিত ভাবেই কম জনপ্রিয় ছিল।
সেই সময়ের ভুতের দল
প্রাচীন গ্রীক এবং রোমান আমলের ভূতের গল্প জগতে এবার
চলুন একটু ঘুরে আসি। এই ধরনের গল্পগুলো রহস্য ভিত্তিক সাহিত্য কল্পনা বলে ধরে নেওয়া
যেতেই পারে। ‘মার্চেন/মার্কেন স্টোরি’ নামে পরিচিত এই গল্পগুলোর
প্রমাণ ভিত্তিক নির্ভরযোগ্যতা ছিল অতি সামান্য। সাধারণভাবে এগুলোকে
কাল্পনিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। অন্যদিকে ‘সেজেন লিজেন্ড’ জাতীয় লেখাগুলোকে সত্যি ঘটনার সাথে আলঙ্কারিক সাহিত্য মিশিয়ে নির্মাণ
করা হত বলেই গবেষকেরা মনে করেন।
ভূতুড়ে বাড়ি সংক্রান্ত
সর্বপ্রথম লেখাটা সম্ভবত লিখেছিলেন রোমান লেখক, রাজনীতিক, এবং বাগ্মী প্লিনি দ্য ইয়াঙ্গার
[৬২? – ১১৩ খ্রীষ্টাব্দ]। একটা চিঠিতে উনি
তার পৃষ্ঠপোষক, লুসিয়াস সুরাকে লিখেছেন এথেন্সের এক ভিলা সম্পর্কে। কেউ ওই ভিলা
ভাড়া নিতে চাইছিল না, কারণ ওখানে ভূত
আছে। অগভীর রাতে ওই ভিলায় ভয়াবহ সব আওয়াজ শোনা যায়। শোনা যায় শিকলের ঝনঝনানি, যার
শব্দমাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে রাত বাড়ার সাথে সাথে। হঠাৎ হঠাৎ একজন নোংরা এবং দরিদ্র বৃদ্ধের ভয়াবহ
অশরীরীর আবির্ভাব হয়। যার লম্বা দাড়িতে জট
পড়ে গেছে । মাথায় অবিন্যস্ত সাদা চুল । পায়ে বাঁধা আছে ভারী লোহার পাত। যা ওই অশরীরী আর্তনাদ সহযোগে অতি কষ্টে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছেন।
বৃদ্ধর দুই হাতের কব্জিতে আটকানো আছে শিকল
সহ হাতকড়া। মাঝে মাঝেই চরম ক্রোধে উনি দুহাত ওপরের দিকে তুলে ওই শিকল বাঁধা হাত ঝাঁকাতে
থাকেন। একবার, কয়েকজন অতি সাহসী সন্দেহবাদী
ওই ভিলায় রাত কাটায়। সকালে সবাইকে অজ্ঞান
অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। যারাই ওই সন্ধ্যার পরে ওই অভিশপ্ত বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে
হয় তারা দারুন ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বা মারা গেছেন।
ভিলার এই কুখ্যাতি থাকা সত্বেও আরেক এথেনীয় দার্শনিক এথেনোডোরাস ওই ভিলা ভাড়া নেওয়া থেকে বিরত হননি।
আসলে
ওই ভুতুড়ে কুখ্যাতির কারণে ভাড়া অত্যন্ত কম থাকায় এবং নিজের খুব বেশি আর্থিক
সামর্থ না থাকায় কিছুটা বাধ্য হয়েই এথেনোডোরাস ওই স্থান ইজারা নিতে বাধ্য হন।
প্লিনির মতে, এথেনোডোরাস ভিলায় প্রথম রাতেই
ভূতের দেখা পেয়েছিলেন। অস্পষ্ট শিকলের শব্দ ভেসে আসে সবার আগে। তার পরেই
আবির্ভূত হন সেই বৃদ্ধ। তাঁর দেখানো পথে যাওয়ার জন্য দার্শনিককে ইশারা করে
সেই ভৌতিক অবয়ব। এথেনোডোরাস সেটা করতে না চাইলে
বৃদ্ধ রাগের চোটে জোরে জোরে শিকল ঝাঁকাতে থাকেন। যতক্ষণ না দার্শনিক ওঁর সাথে যেতে রাজি হলেন ততক্ষণ
উনি এক ভাবে শিকল নাড়িয়ে চ্ললেন। অশরীরী এথেনোডোরাসকে
ভিলা সংলগ্ন বাগানে নিয়ে যান এবং একটা স্থান
ইশারা করে অদৃশ্য হয়ে যান।
পরের দিন, এথেনোডোরাস তার অভিজ্ঞতার গল্প স্থানীয়
কর্তৃপক্ষকে জানান। ওরা বাগানের ওই নির্দিষ্ট
স্থান খনন করেন। পাওয়া যায় শৃঙ্খলে আবদ্ধ একটা মানুষের কঙ্কাল। অবশিষ্ট হাড়গুলোকে
সঠিক নিয়ম মেনে সমাধিস্থ করা হয় । বাড়িটাকেও আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে শুদ্ধ করা হয়। এরপর আর ওই বৃদ্ধের ভূতকে ওখানে কোনও
দিন দেখা যায়নি।
ওরা ফিরে আসে - কিসের
জন্য?
যথাযথ শেষকৃত্য করার দাবি নিয়ে ভূতের আবির্ভাব ক্লাসিক গ্রীক এবং রোমান সাহিত্যের এক অতি পরিচিত বিষয়। তিনটে উদাহরণ পেশ করছি:
ট্রয় যুদ্ধের সময়, প্যাট্রোক্লাসের অশরীরী তার সহযোদ্ধা অ্যাকিলিসের কাছে উপস্থিত
হয়েছিল। । চেয়েছিল সঠিকভাবে তাকে দাহ করা হোক।
ভূতটা অবশ্য এর সাথে একটা দুঃসংবাদও দিয়েছিল- অ্যাকিলিসও এই ট্রয়ের যুদ্ধেই মারা যাবে।
ইউলিসিসের সমুদ্র যাত্রার এক সাথী এলপেনর। যার মৃত্যু হয়েছিল সির্সের দ্বীপে। তার
আত্মাও ফিরে আসে, ইউলিসিসকে ওই দ্বীপে ফিরে
গিয়ে যথাযথভাবে তাকে সমাধিস্থ করার আবেদন জানায়।
রোমান সম্রাট ক্যালিগুলার ভূত
ল্যামিয়ানের উদ্যানে ঘুরে বেড়াত। হত্যা করার পর তার দেহ
দ্রুত পুড়িয়ে দিয়ে ওখানেই পুঁতে দেওয়া হয়েছিল।
একজন সম্রাটের উপযোগী শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান না হওয়া
পর্যন্ত তার ভূতকে অনেকেই ওই স্থানে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর ছাই রাখা হয়েছিল। যে স্থানে ক্যালিগুলাকে
খুন করা হয়েছিল সেই স্থানে তাকে ছাড়াও অন্যান্য অনেক ভূতের
দেখা পাওয়া যেত বলে জানা যায়।
অনেক সময় দেখা গেছে নিজের চেনা
মানুষদের কাছে বা কোনও কোনও সময় অপরিচিত মানুষের কাছেও ভূতের আগমন হচ্ছে, জীবিত জীবনের বা পরবর্তী সময়ে তার জন্য
করা নানান কাজের ধার শোধ করার জন্য।
রোমান রাজনীতিক এবং লেখক সিসেরো (খ্রিস্টপূর্ব ১০৬-৪৩), সিমোনাইডস নামক মানুষের
কথা লিখেছেন। যে এক অজানা আগুন্তুকের মৃতদেহ কবরস্থ করেছিল। সেই আগন্তুকের ভূত সিমোনাইডসের কাছে উপস্থিত
হয়েছিল। তাকে পরামর্শ দিয়েছিল জাহাজে সফর না
করার। সিমোনাইডস অশরীরীর কথা
মেনে নিয়েছিলেন । পরে জানতে পারেন যে, জাহাজটা সমুদ্রের বুকে হারিয়ে গেছে।
এমন অনেক নমুনাও পাওয়া যাচ্ছে যেখানে
ভুত বা আত্মারা বর্তমান ঘটনা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না কিন্তু অতীত সম্পর্কে
সম্পূর্ণ সচেতন । খ্রীষ্ট পূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস
লিখে গেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ৫ ম শতাব্দীর মানুষ পেরিয়ান্ডারের স্ত্রীর কথা। গ্রীস করিন্থের শাসকের স্ত্রীর আত্মা মৃতদের জগত থেকে ফিরে এসেছিলেন স্বামীর হারিয়ে
যাওয়া এক মূল্যবান বস্তু খুঁজে পেতে সাহায্য করার জন্য।
সব ভূতই ভবিষ্যৎ বলতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, এটাকে একটা ক্ল্যাসিক্যাল যুগের সমাপ্তি রূপে আমরা ধরে নিতে পারি।
একের পর এক অর্যাকলদের অবলুপ্তি ঘটার পর
দেখা যায় ভূতেরা ভবিষ্যতের ঘটনার পূর্বাভাস
দেওয়ার ক্ষমতা নিজেদের ভেতর বিকশিত করেছে।
শোকাহতদের সান্ত্বনা দিতেও ভূতেরা ফিরে আসে। এনিয়াসের
স্ত্রীর ভূত [নাকি পেত্নী বলব?], যিনি ট্রয়ের যুদ্ধর সময় আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন,
ফিরে এসেছিলেন স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে ।
এছাড়াও সেই সমস্ত মানুষদের ভূতেরাও ফিরে ফিরে আসে
যাদের মৃত্যু হয়েছে কোনও হিংসাত্মক পরিণতিতে। তাদের আত্মারা ‘ভূত’ এর রূপে
নিয়ে ফিরে আসে জীবিত মানুষদের কাছে তাদের হত্যাকারীকে খুঁজে পেতে সাহায্য করার জন্য।
রোমান কবি ওভিড (৪৩ খ্রিষ্টপূর্ব – ১৮ খ্রীষ্টাব্দ)
রেমাসের অশরীরীর সম্পর্কে লিখে রেখে গেছেন।
যে ফিরে এসেছিল তার আততায়ীর নাম জানানোর জন্য।
‘ডি ডিভিনেশনে’, সিসেরোর লেখায় পাওয়া যায় এক সরাই
খানায় দুজন বন্ধু আশ্রয় নিয়েছিল। এদের ভেতর একজনকে সরাইখানার মালিক হত্যা করে। তার ভূত ফিরে আসে এবং নিজের মৃতদেহ খুঁজে পেতে সাহায্য করে বন্ধুকে। সাথেই যথাযথ
শেষ কৃত্য করার অনুরো জানায়।
ভূতকে বিঘ্নকারী বিরক্তি উদ্রেক কারী সত্তা রুপেই
মানা হয়ে থাকে । এর সূচনাও আদিম কাল থেকেই।
দ্বিতীয় শতাব্দীতে, গ্রিক লেখক পৌসানিয়াসের লেখায় এরকম এক ভুতুড়ে বর্ণনা
পাওয়া যায়। উনি লিখেছেন, ৬০০ বছর আগে ম্যারাথনের যুদ্ধ যেখানে হয়েছিল, সেই স্থানেই
মৃত যোদ্ধাদের কবর দেওয়া হয়েছিল। সেখানে রাতের বেলায় [কেন? যুদ্ধ তো দিনের বেলা হয়েছিল?]
যুদ্ধের সময় সৈন্যদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি
শোনা যায়।
‘লাইফ অফ
সিমন’ -এ, গ্রীক জীবনীকার প্লুটার্ক ( ৪৬?-১২০? খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন, চ্যারোনিয়ায় স্নানাগারগুলো ভুতুড়ে। ওখানে একজন খুন হওয়া মানুষের ‘ডেমন’ [এরা
ঠিক কী ধরণের সত্তা সে বিষয়ে ‘শেষপাতে’ তে লিখেছিলাম] ঘুরে বেড়ায়। যে জীবিত কালে এক
জন গুন্ডা ছিল। মাঝে মাঝে অশরীরী অবয়বের আবির্ভাব, গোঙানি এবং আরও সব ভয় ধরানো শব্দ
শোনা যেত ওই সব স্নানাগারের ভেতর। যার সহ্য করা অনেকের অক্ষেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে
ওখানকার বাসিন্দারা স্নানাগারগুলো বন্ধ করে দেয়।
কিছু কাহিনী অনুসারে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভূত কোনও মধ্যস্থতাকারীর জন্য অপেক্ষা করে না। এরকম অনেক কিংবদন্তী আছে যেখানে
স্বয়ং ভুত নিজেই তার খুনি বা হামলাকারীদের শাস্তি দিয়েছে। যদিও ভূতেদের পক্ষে কোনও জীবিত মানুষকে ছোঁয়া সম্ভব
নয় বলেই মনে করা হয়, তবুও কিছু ক্ষেত্রে তেনারা নিজেরাই তাদের অপরাধীদের শারীরিকভাবে
লাঞ্ছিত করতে সক্ষম বলেও বিবৃত হয়েছে। বেশির
ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সব ভূতেদের ঠিক থাক ভাবে শেষকৃত্য সম্পাদন করা হয়নি।
এইসব থেকে কী এটাই মনে হয় না সুধী পাঠক পাঠিকাগন - আসলে এই সব গল্প কথা সৃষ্টি করার আসল উদ্দেশ্য ছিল, একজন মানুষের দেহটাকে সঠিক পদ্ধতিতে পঞ্চভূতে বিলীন করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা? যা একদিকে পরিবেশ সহায়ক।
তৃতীয় শতাব্দীতে, প্রাচীন গ্রীস এবং রোমে খ্রিস্টধর্ম তাদের ভিত্তি অনেকটাই শক্ত করে ফেলেছিল। এর সাথেই
পৌত্তলিকদের কাছে নিজেদের ধর্মকে আকর্ষণীয় করে তোলার উদ্দেশ্যে সেই সময়ের খ্রিস্টান চার্চ প্রচলিত জনপ্রিয় ধর্মীয় অনেক বিষয়কেই তাদের আচারের
ভেতর সংযুক্ত করে নিয়েছিল। বিশেষ করে ভূত এবং
পরকালের অনেক আচার সেখানে ঢুকে যায়।
সেই সময়ের খ্রিস্টান লেখকদের ভেতর একজন জাস্টিন মার্টিয়ার জানিয়েছেন, নতুন এই ধর্ম ব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হতে থাকে মৃত্যুর পরেও একটা জীবন
আছে। উনি ওল্ড টেস্টামেন্টের সাউলের কাহিনীর,
যার কথা আমি আগেই বলেছি, দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন যেখানে পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে
খ্রিস্টানরা মৃত্যুর পর আত্মা বা ভূতে বিশ্বাস করে।
প্রথমদিকের খ্রিস্টান চিন্তাবিদরা বলতেন, ভূত আছে এবং তারা শুধুমাত্র অশরীরী অবয়ব ছাড়া আর
কিছু নয়। আর এর জন্যই, মৃত্যুর পরে, সমস্ত মানুষ সামাজিক স্তরে একই ধরণের সত্তায় পরিণত
হয়। এই বিশেষ ধারণাটা স্বাভাবিক ভাবেই সমাজের
সেই সমস্ত জনসাধারণের কাছে প্রবল আকর্ষণীয় হয়েছিল যারা তুলনামূলক ভাবে সমাজের নিচের
দিকে অবস্থান করত। মৃত্যু পরবর্তী সময়ে উচ্চস্তরের সমকক্ষ হওয়ার ভাবনা তাদের প্ররোচিত
করেছিল নতুন ধর্ম পালনে। আর এই সূত্রেই একাধিক ভূতের গল্প তথা কিংবদন্তী জন্ম নিতে
থাকে।
এরকম একটা সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকাটা খ্রিস্টান চার্চের
পক্ষে যে একটা বড় ব্যাপার ছিল তাতে কোনও সন্দেহ
নেই। কারন এর সূত্রেই এসেছিল সেই অমোঘ প্রশ্ন - একজন মানুষ
মারা যাওয়ার পর তার আত্মা কোথায় যায়? এখন
আপনি বলতেই পারেন যেখানেই যাক না কেন এ নিয়ে এত ভাবার কী আছে? কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ?
কারণ এর সাথেই আরও একটা প্রশ্ন জুড়ে যাচ্ছে যে, যে আত্মা অন্য জগতে গেল, সে কী তাহলে
ইচ্ছেমত এই জগতে ফিরে আসতেও পারে?
সূচনা লগ্নের খ্রিস্টান তাত্ত্বিক এবং লেখকরা একমত
ছিলেন যে, আত্মা কোনও একটা জায়গায় অবশ্যই যায়। এবং অপেক্ষা শেষ বিচারের। তারা তিনটে সম্ভাব্য স্থানের কথাও বলেছিলেন -
১। এক অদৃশ্য অঞ্চল যা ঈশ্বরের দ্বারা সংরক্ষিত বা নিয়ন্ত্রিত।
২। তথাকথিত ‘আব্রাহামের বক্ষদেশ’। যদিও কেউ ঠিকঠাক
জানত না যে এটা কী বা কোথায় এর অবস্থান।
৩। আন্ডারওয়ার্ল্ড বা ভূগর্ভস্থ এক জগত যেখানে শাস্তি
পেতে হয় নাকি আরামদায়ক সেটা নিশ্চিত হতে পারেননি
তারা। মধ্যবর্তী একটা অঞ্চল বলেই মানা হত।
পারগেটরি বা প্রায়শ্চিত্ত পরিশোধক ব্যবস্থা বা পরিশুদ্ধিকরণ:
স্বর্গও নয় নরকও নয়
মহান খ্রিস্টান তাত্ত্বিক সেন্ট অগাস্টিনও বলেননি,
তার আত্মা আসলে কোথায় গিয়েছিল তার মৃত্যুর পর। দ্বাদশ শতাব্দীর সময় যখন মধ্যযুগ ধীরে ধীরে বিদায়
নিচ্ছে এ জগত থেকে, তখন এই পরিশুদ্ধিকরণের
ধারণা ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বর্গ এবং নরকের মধ্যে এমন এক ‘ইথার জগত’ যেখানে
আত্মাদের থাকতে হয়। পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয়বার পার্থিব
জীবন ধারণের।
১২৫৪ সালে সম্ভবত পোপ চতুর্থ ইনোসেন্টকে লেখা একটি
ধর্মীয় চিঠিতে ‘পারগেটরি’ শব্দটার প্রথম ‘অফিসিয়াল’ ব্যবহার হয়েছিল । ১২৭৪ সালে
কাউন্সিল অফ লিওন্সে এ নিয়ে আলোচনা করা হয়
কাউন্সিল অফ ফ্লোরেন্সে (১৪৩৮-১৪৪৩)
এ এ নিয়ে ব্যাপক চর্চা হয়েছিল।
কাউন্সিলের পক্ষে থেকে ঘোষণা করা হয়, মূল্যের বিনিময়ে মৃতদের সাথে যোগাযোগ, অলৌকিক পদ্ধতিতে বার্তা প্রেরণ করা এবং তাদের কাছ থেকে কোন বিষয়ে সংবাদ প্রাপ্তি বাস্তবে সম্ভব। শুধু তাই নয় চার্চের নিয়ামকেরা মৃত মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধিকরণ কষ্টের পরিমাণ কমানোর জন্য বিশেষ আচার প্রথাও চালু করে। মূল উদ্দেশ্য কী ছিল তা আশাকরি বলে দেওয়ার দরকার নেই। সমঝদারোকে ইশারাই কাফি! আসলে সারা বিশ্বের সমস্ত [ অনুগ্রহ করে কেউ রাগ করবেন না] ধর্মের কিছু সুবিধাবাদী মানুষ বা সংস্থা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, এরকম সব কিংবদন্তী ও আচার প্রথার জন্ম দিয়েছেন এবং বাধ্য করেছেন সবাইকে মেনে নিতে। শান্ত মনে সামাজিক অবস্থান বুঝে ভেবে দেখুন, আমার কথাটা ভুল নয় বলেই মনে হবে।
আত্মার আবির্ভাব বা অ্যাপারিশনের
একাধিক ঘটনা অন্ধকার এবং মধ্যযুগ জুড়ে অব্যাহত ছিল। ভূতের নানবিধ
রূপ এবার হাজির হতে শুরু করে মানুষের স্বপ্নের জগতেও। সেই সময়ের
বেশিরভাগ বর্ণনা অনুসারে, মানুষের আকারে যে ভূতের দেখা যেত তাদের অবয়ব হত ফ্যাকাশে এবং মুখেচোখে
থাকত বিমর্ষ দুঃখের ছাপ। ৯০ শতাংশ অশরীরীর গায়ে হাত পায়ে এবং মুখে দেখা যেত পোড়া দাগ
ও ক্ষত চিহ্ন। যা আসলে ছিল পরিশুদ্ধি করণের চিহ্ন। কখনও কখনও,
এই সব ভূতেরা মানবেতর রূপেও উপস্থিত হত। অনেকেই আলোর বল
বা ঘুঘুপাখি রূপে এদের দেখা পেতেন।
গল্প অনুসারে
খ্রিস্টান অশরীরীর দল ফিরে আসত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বীকারোক্তি দিতে এবং
ক্ষমা
চাইতে। জীবিত থাকার সময় যে পাপ তারা করেছে তার কথা বলত। তার জন্য কী প্রায়শ্চিত্ত
তাদের করতে হচ্ছে সেটাও জানাত। একটা বিষয়ে
ওই যুগের প্রায় সব ভূতের গল্পেই মিল পাওয়া যায়। জীবন যাপনের সময় সমস্ত ধরণের ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং নিয়ম কানুন
মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তারা সতর্ক
করে দিত।
কিছু কী বুঝতে পারছেন পাঠক পাঠিকাবৃন্দ ভুতের গল্পের
আসল উৎস কোথায়?
কিন্তু যুগের বদল মানেই পরিবর্তনের হাওয়া। এ সিরিজে
আগামী কোনও এক সময়ে আমরা দেখব ১৬ শতাব্দীতে,
সংস্কারবাদী প্রোটেস্ট্যান্ট লেখক এবং চিন্তাবিদরা ভূতের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলতে
শুরু করেছিলেন।
যাইহোক তাত্ত্বিক
এবং চিন্তাবিদদের ভাবনা চিন্তা থেকে একটু সরে আসি এবার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ আসলে কী ধরণের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে,
যাতে তাদের বেশিরভাগের মনেই এ ধারণা নিশ্চিত
হয় যে, মৃত্যুর পরেও জীবন আছে?
আপাতত এই সিরিজের ২য় অধ্যায়ের
এখানেই সমাপ্তি। পরবর্তী অধ্যায়ে ভুতেদের প্রকৃতি খোঁজার চেষ্টা চালাব। যদি সত্যিই তাদের অস্তিত্ব থাকে তাহলে তাদের নির্মাণ
কী দিয়ে তৈরি হতে পারে?