প্রতিম দাস
প্রথম পর্ব
দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল বাবলুদের
সজ্জনপুরে আসার পর।
বাবলুর বাবাকে হঠাৎই এখানে
চলে আসতে হয় বদলীর অর্ডার এসে যাওয়ায়।
অনেকদিন আগে এখানে কয়লার খনি ছিল। সাথেই ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কলোনি।
যার চিহ্ন এখনো দেখা যায়। সময়ের সাথে এখানেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। যাবতীয়
আধুনিকতার পশরা সজিয়ে একটা সুপার মলও চালু হয়েছে সজ্জনপুরে ।
বাবলু এখনো পর্যন্ত এখানকার
জীবনটার সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনি। নতুন স্কুলে গোটা কয়েক বন্ধু হয়েছে। যার
মধ্যে একজন এই পাড়াতেই থাকে। ওদের বাড়ী থেকে দুটো বাড়ীর পরেই । সৌমি।
পাঁচদিন হল গরমের ছুটি শুরু
হয়েছে। প্রথম দু দিন পুরোনো গল্পের বই নেড়েচেড়ে বা টিভিতে কার্টুন দেখে কাটালো বাবলু। তারপর
থেকে কি করবে ভেবেই পাচ্ছিলো না । ওর বয়েসি এখানকার ছেলে মেয়েগুলো যেন কেমন টাইপের
– সব সময় বাড়ীর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। শখ আহ্লাদ বলতে মনে হয় তেমন কিছু নেই। পাহাড়ের কোলে ওর বড় মাঠটা ফাঁকাই পড়ে থাকে । কাউকে তেমন
খেলা করতে দেখা যায় না। অথচ বাবলুরা আগে যেখানে থাকতো সেখানকার এক চিলতে পার্কটায়
জায়গা দখল নিয়ে রীতিমতো ঝগড়া লেগে যেতো প্রায় দিন।
আজ সময় কাটাতে বাবলু ওদের নতুন
বাড়ীটা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে । নতুন মানে অবশ্য আনকোরা নতুন কোনো বাড়ী নয়।
অফিসের ব্যবস্থায় দিন পনের আগে যেটায় ওরা এসেছে সেই বাড়ীটা । ইংরেজ আমলের বাড়ী।
দোতলা । বেশ বড় , গোটা বারো ঘর । চারটে বাদে সব তালা বন্ধ। রান্নঘর নিচে । পাশেই
একটা স্টোর রুম । আপাতত সেই স্টোর রুমটাতেই ঢুকেছে বাবলু। মা বাজারে গেছেন। বাবা
অফিসে ।
ভাঙা চেয়ার। কাঠের পিপে। টিনের
ড্রাম। একটা বেশ বড় মাপের পাল্লা ভাঙা কাঠের আলমারি – এরকম অজস্র জিনিষে ভর্তি
ঘরটা । সাথেই আছে প্রচুর পরিমানে মাকড়শার জাল । এক পাশে একটা জানলা । যেটা খুলতে
গিয়ে বাবলু ঘেয়ে নেমে একসা হল । এটা সেটা সরিয়ে এগিয়ে গেল আলমারিটার দিকে। দুপা এগোতেই কিছু একটাতে হোঁচট খেলো ।
তাকিয়ে দেখল একটা আংটা । মেঝেতে পড়ে থাকা কৌটো বাউটা সরাতেই দেখা গেল আংটাটা আসলে
একটা ট্র্যাপডোরের অংশ। কার্টুন দেখার সময় এরকম ট্র্যাপডোর বাবলু দেখেছে।
আংটাটা ধরে জোরে একটা টান মারলো
। কিছুই হলো না। একটুও নড়লো না ওটা । আবার একটা টান দিলো বাবলু । একটু যেন নড়লো । আর
একবার হ্যাঁচকা টান মারতেই ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হলো । শেষ কবে এ দরজা খোলা হয়েছিল কে জানে ! হাল না ছেড়ে
চেষ্টা চালিয়ে গেল বাবলু । আর তার ফল ও মিললো হাতে নাতে। খুলে গেল ট্র্যাপডোরটা। অর্ধেকের চেয়ে আর
একটু বেশী উঠে কাত হয়ে থাকলো । ভেতর থেকে ভেসে এলো অনেক দিনের পুরনো মাটির ভিজে
ভিজে গন্ধ। ভেতরটায় পিচকালো অন্ধকার । খানিকক্ষণ চেয়ে থাকার বাবলু দেখতে পেলো একটা
কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে । নিচু হয়ে দেখতে গিয়ে একটা কেমন যেন শব্দ ওর কানে এসে
ধাক্কা মারলো । চমকে পিছিয়ে এসে তাকিয়ে থাকলো অন্ধকারের দিকে ...বসে রইলো কান পেতে ...না আর কোন শব্দ শোনা গেল। নিস্তব্ধ ।
স্টোররুম থেকে বেরিয়ে দোতলায়
গেল বাবলু। চারজার টর্চ টা নিয়ে ফিরে এলো । এবার ট্র্যাপডোরের গর্তে আলো ফেলতেই
সিঁড়িটা ভালো করে দেখা গেল। বেশ বড় । ফুট দশেক তো হবেই। নামবো নাকি নামবো না এই টানা পোড়েনে কৌতূহলেরই
জয় হল ।
প্রতিবার পা ফেলার সাথে মচ মচ
শব্দ নিয়ে নিচে নামলো বাবলু। চারপাশের দেওয়াল ভিজে স্যাঁতসেঁতে। মেঝেটাও তাই।
দীর্ঘদিন বাদে কোনো জামাকাপড় ভর্তি বাক্স খুললে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় সেরকম
গন্ধে ভরে আছে ঘরের ভেতরেটা ।
চারদিকটা ভালো করে দেখার জন্য
টর্চটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে যেতেই ওটা নিভে গেল। শরীরটা কেঁপে উঠলো বাবলুর। মনে
হল চারপাশ থেকে অনেকগুলো শীতল হাত বুঝি ওর দিকে এগিয়ে আসছে । বার কয়েক ঝাঁকুনি দিতেই টর্চটা
আবার জ্বলে উঠলো ।
দেখার মতো কিছুই নেই ঘরটায় ।
একেবারে ফাঁকা। একটা মিটসেফের মতো কাঠের বাক্স এক পাশে । আলো ফেলে দেখলো সেটাও
ফাঁকা । হতাশ হলো মনে মনে । গুপ্তধন না পাওয়া যাক, পুরোনো আমলের একটা বর্শা কি তরবারি
নিদেনপক্ষে থাকতেও তো পারতো!
শক্ত মেঝের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে
যেতে নরম কিছু একটার ওপর ওর পা পড়লো । ফাঁকা গর্তের ওপর পাতলা বোর্ড রেখে তার ওপর
পা দিলে যেমন অনুভুতি হয় ঠিক তেমনটাই। চট করে পিছিয়ে এসে আলো ফেললো মেঝেতে। একটা পাতলা
কাঠের তক্তামতো কি যেন পড়ে আছে । ভিজে আবহাওয়া আর সময়ের মার খেয়ে ওটা যথেষ্টই নরম
হয়ে গেছে। হাঁটু গেড়ে বসে তক্তাটাকে
সরাতেই আর একটা গর্ত দেখা গেল ওর তলায় । কানে এলো অদ্ভুত ফিসফিসে সেই শব্দ যা কিছু
ক্ষণ আগে ও শুনতে পেয়েছিল। ভালো করে শুনলো বাবলু। না কোনো সন্দেহই নেই । দুটো
মানুষ কথা বলছে । কেউ যাতে শুনতে বুঝতে না পরে সেরকম ফিস ফিস করে ।
প্রশ্নের ঢেউ এসে ধাক্কা মারল
বাবলুর মনে । কারা কথা বলছে? কি আছে ওই গর্তের নিচে? ওই নিচে মানুষ বাস করে নাকি?
না আপাতত এই সব প্রশ্নের সমাধান
করার কোনো ইচ্ছেই নেই বাবলুর। এখন ওপরে ফিরে যেতে পারলে বাঁচে বাবলু। একদিনের
পক্ষে যথেষ্ট অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে । পরে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করে দেখা যাবে ।
তক্তাটা টেনে গর্তটা আবার ঢেকে দিলো বাবলু।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সবে ছয় সাত
ধাপ উঠেছে মাত্র ...
...ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার ঘটে
গেল...ট্র্যাপডোরের ঢাকনাটা সজোরে আছড়ে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল বাইরে যাওয়ার পথটা। মনে হল কেউ
যেন ঠেলে বন্ধ করে দিলো দরজাটাকে ...
দ্বিতীয় পর্ব
সব্বোনাস! তখন তুই কি করলি? সৌমি জানতে
চাইলো বাবলুর কাছে। এতক্ষন বাবলু সৌমিকে বলছিল ট্র্যাপডোর রহস্যের বৃত্তান্ত ।
সব মেয়েরাই একটু সাজগোজ করে ফিটফাট থাকতে
ভালবাসে । অন্তত আগের শহরটায় সেরকমই দেখেছে বাবলু। সৌমি একদমই সেরকম নয়। একটু কাউবয়
টাইপের। বাবলুর চেয়ে হাইটে লম্বা। জিনস আর টি শার্ট পড়ে থাকে বেশীর ভাগ সময়ে।
টেক্সাস অঞ্চলের গল্প কাহিনীর পোকা । ওই সমস্ত এলাকায় ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো আইন
কানুন না মানা আউট-ল দের কথা সব সময় ওর মুখে। ও বাবলুকে বলেছে ইংরেজ আমলে এখানেও
নাকি ওইরকম অনেক ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো আউট-ল বা ডাকাত ছিল।
বাবলু সৌমির প্রশ্নের জবাবে
বললো, প্রথমে খানিকক্ষণ দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম । তারপর টর্চটাকে সব সময় জ্বালিয়ে রাখার সুইচটা টিপে
দিয়ে জামার পকেটে ঢোকালাম । ওপরে উঠে গিয়ে শুরু করলাম ট্র্যাপডোরটাকে ঠেলতে। কি মনে
হচ্ছিল জানিস? কেউ যেন ওটার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ খানিকক্ষণ বাদেই টর্চটা আবার
নিভে গেল । এবার ঝেড়েও জ্বললো না। বুঝলাম চার্জ শেষ।
বাপরে! তোর ভয় করেনি?
বাবলু মুখে বললো, ওসব ভয় টয়
পাওয়া আমার ধাতে নেই। ভয় পাবো কেন? মনে মনে বললো, করেনি আবার! মনে হচ্ছিল হাঁটুর মালাইচাকিগুলো
পর্যন্ত খুলে যাবে কাঁপুনির ঠেলায়। হাত পা ঠান্ডা মেরে গিয়েছিল। কিন্তু তোর মতো
একটা মেয়ের সামনে সেটা বলবো কেন?
কি করলি তারপর?
নিচে একটা ফুট চারেকের কাঠের
ডান্ডা দেখেছিলা মোটা সিঁড়ির নিচে রাখা ছিল । হাতড়ে হাতড়ে নেমে গিয়ে সেটাকে নিয়ে এলাম ।
বার কয়েক ওটা দিয়ে মারলাম গুঁতো । কাজ হয়ে গেল। একটু ফাঁক হতেই জোরে ঠেলা দিলাম
কাঠটা দিয়ে । এক সময় খুলে গেল দরজাটা ।
বুঝতে পেরেছিলি কি করে বন্ধ
হয়েছিল ওটা?
না।
আমার মনে হয় হাওয়ার ধাক্কায় ওটা
পড়ে গিয়েছিল । কাত হয়ে ছিল বললি না নিচে নামার সময়?
হ্যাঁ । বাবলু বললো বটে , তবে
মনের খচখচানিটা গেলো না। তাও তো নিচের ফিসফিসে শব্দ শোনার কথা বলেইনি সৌমিকে।
অবশ্য ওটা ওর শোনার ভুল হতে পারে। গর্তের ভেতরে আবার কেউ থাকে নাকি। ওইরকম একটা
পরিস্থিতিতে ওটা আসলে ওর মনের কল্পনা ।
আমার কি মনে হয় জানিস? এই
বাড়ীটা একসময় আউট-ল দের আস্তানা ছিল। ওই
ট্র্যাপডোরটা আসলে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা ।
ছুটি পড়েছে আর তোর সিনেমা দেখার
মাত্রা বেড়েছে তাই না?
বাজে কথা বলিস নাতো। তুই কি
জানিস এক সময় এখানে শিবে ডাকাতের রাজত্ব ছিল?
সে আবার কে?
একটু ইতিহাস টিতিহাস পড়তে হয়
বাবু সোনা। তাহলে অনেক কিছু জানা যায়।
ইতিহাস খুব বোরিং সাবজেক্ট। সাল
মুখস্ত করো । কে কোথায় কার সাথে যুদ্ধ করে মারা গেলো তা মনে রাখো। ধূস –
আমার কিন্তু দারুন লাগে। বেশ
গল্পের বই এর মতো মনে হয় । যাকগে... জানিস শিবে ডাকাতের একটা বেশ বড়সড় গ্যাং ছিল ।
ওরা ইংরেজদের ঘোড়া চুরি করতো ।
সত্যি?
হ্যাঁ রে। ওর ডান হাত ছিল
জোসেফ। এক আদিবাসী খ্রিস্টান । শিবে ডাকাতের চেয়েও খতরনাক। এখানেই ধরা পড়েছিল।
‘পুরোনো দিনের সজ্জনপুর’ নামের বইয়েতে সব
লেখা আছে । পড়ে নিস লাইব্রেরী থেকে নিয়ে। আমার কি ইচ্ছে হয় জানিস।
কি?
ওইসব দিনগুলোতে ফিরে যেতে ।
বিজ্ঞানীরা কবে যে টাইম মেশিন বানাবে।
বাজে বকা থামাবি।
থামাতে পারি যদি আমাকে ওই
ট্র্যাপ ডোরের নিচের ঘরে নিয়ে যাস । ইচ্ছে না থাকলেও বাবলু মেনে নিলো চাহিদাটা।
নিচের ঘরের ওই ফিসফিসানিটা সৌমিও শুনতে পায় কিনা সেটা জানার ইচ্ছে হচ্ছে ।
00000
ট্র্যাপডোরটা আবার আগের দিনের
মতো শক্ত হয়ে আটকে গিয়েছিল । তবে আজ সাথে সৌমি থাকায় বার কয়েক টানাটানি করতেই ওটা
খুলে গেল । পায়ের চাপ দিয়ে আগের দিনের থেকে আরো খানিকটা বেশী কাত করে দিলো
বাবলু ওটাকে।
টর্চ জ্বালাতেই সেই সিঁড়িটাকে দেখা
গেল। সৌমিকে দেখে মনে হলো না যে আগে নামার ইচ্ছে ওর আছে। অতএব আবার বাবলুই নামলো
আগে। পেছন পেছন নেমে এলো সৌমি ।
সেই গর্তটা কই? সৌমির প্রশ্নের
জবাবে বাবলু টর্চের আলো ফেলে তক্তা ঢাকা জায়গাটা দেখালো। সৌমি ওটাকে সরিয়ে অনেকটা
ঝুঁকে ভেতরটা দেখলো । হাবেভাবে বাবলু বুঝতেই পারলো না কোনো রকম রহস্যময় শব্দ সৌমি শুনতে পেলো কিনা।
আমি নিশ্চিত এটা এ বাড়ী থেকে
পালানোর একটা সুড়ঙ্গ পথ।
আবার গল্প শুরু করলি!
জানিস নাতো টেক্সাসে ডাল্টন
গ্যাং দের এরকম একটা পথ ছিল?
কি গ্যাং?
ডাল্ট...সসসসসস...চুপ...একটা কি
রকম শব্দ হলো না?
ধক করে লাফিয়ে উঠলো বাবলুর
বুকের ভেতরটা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল গর্তটার কাছে । নিচু হতেই শুনতে পেলো সেই ফিসফিসানি।
গলার কাঁপা ভাবটা সামলে নিয়ে বললো, কিসের শব্দ ওটা ।
ফিসফিসানিটাতো হাওয়া চলাচলের।
কিন্তু আমি যেন একটা অন্য শব্দ শুনতে পেলাম।
এবার সেই শব্দটা দুজনেই শুনতে
পেলো। একটা প্রবল চিৎকার। অনেক দূর থেকে ভেসে এলো । পর পর কয়েকবার। প্রত্যেকবার
যেন একটু একটু করে গিয়ে আসছে শব্দটা ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পথ ধরে।
তাড়াতাড়ি তক্তাটা চাপা দিয়ে
সৌমি ছুটে চলে গেল সিঁড়িটার দিকে। বাবলুও পিছু নিলো। পুরনো সিঁড়ির কাঠ মচ মচ করে
উঠলো ওদের হাঁচড় পাঁচর করে উঠে যাওয়ার চাপে। ওপরে গিয়েই ঝপ করে ফেলে দিলো
ট্র্যাপডোরটাকে।
মিনিট পাঁচেক বাদে প্রায় আধ জগ
জল খেয়ে সৌমি একটু ধাতস্থ হয়ে বাবলুর দিকে তাকিয়ে বললো, আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওই
গর্তের ভেতর নেমে দেখে আসার চিৎকারটা কে করছে আর কেনই বা করছে!
আমার ও যে করছে না তা নয়।
কিন্তু...
ভয় পাচ্ছিস? তুই যে বললি তোর
নাকি ভয় টয় করে না ।
আমি তোর কথা ভাবছি। আমি তো যখন
খুশী ওখানে যেতে পারি।
তাই! বেশ তাহলে আমার কথা ভাবতে
হবে না তোকে। আগামীকাল তাহলে একটা ছোট্ট করে অ্যাডভেঞ্চার করলে কেমন হয়? ওর ভেতরে
নামার...যাবি?
গেলেই হলো ।
রাতে বিছানায় শোওয়ার সময় বাবলু
মনে মনে বললো, হে ভগবান আগামীকালটা যেন অনেক অনেক দেরি করে আসে ।
তৃতীয় পর্ব
আমাদেরকে যে কোন রকম পরিস্থিতির
জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে। অভিজ্ঞ মানুষের মতো বললো সৌমি ।
সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু ওই একগাছা দড়ি কাঁধে ঝুলিয়েছিস কেন?
বুদ্ধুরাম এটা সাধারন দড়ি নয় ।
একে বলে ল্যাসো। রেড ইন্ডিয়ানরা বুনো ঘোড়া ধরার কাজে এটা ব্যবহার করে । যাকগে তুই কি কি নিয়েছিস
বল?
বাবলু দেখালো সাথে নিয়ে
আসা একটা পকেট নাইফ, এক প্যাকেট দেশলাই, জলের বোতল, ওয়াকম্যান আর বিস্কুটের প্যাকেট ।
আসল জিনিষটাই তো নিসনি। টর্চটা
কই?
বাবলুর মনে পড়লো ওটা চারজেই
বসানো আছে। সৌমিকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ও চলে গেল। ফিরে এলো একটুবাদেই । পিঠে ব্যাগ । হাতে টর্চ । বললো, চল তাহলে যাওয়া
যাক ।
সৌমি ইতিবাচক ভাবে মাথা নাড়লো ।
০০০০০
ট্র্যাপ ডোরটা খুলতে খুলতে
বাবলু বললো, তুই শিওর তো গর্তে নামার ব্যাপারে?
ভয় পাচ্ছিস মনে হচ্ছে? বলেই
সৌমি আজ আগেই সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছিল। বাবলু ভেবেছিল হয়তো সৌমি কথাটা শুনে পিছিয়ে আসবে। সেটা যখন ঘটলো না অগত্যা সৌমির অনুসরণ করতে বাধ্য হল।
নিচে নামার পর তক্তাটা সরিয়ে
সৌমি আগে নামলো গর্তটার ভেতরে। টর্চের আলোয় বাবলু দেখত পেলো অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে
গেল সৌমি। বাবলু নামার পর বুঝতে পারলো অদৃশ্য হওয়ার কারনটা । গর্তের দেওয়ালের গায়ে
দেখা যাচ্ছে সুড়ঙ্গ পথটাকে ।
নিচু
হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোনোর মত সংকীর্ণ পথটা । বেশ খানিকটা যাওয়ার পর হামাগুড়ি
দেওয়ার মতো জায়গাও রইলো না। কনুই এর ওপর ভর দিয়ে বুকে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকলো ওরা।
অভ্যাসতো নেই কিছুক্ষণ বাদেই কনুইগুলো জ্বালা করতে শুরু করলো বাবলুর। ও মনে মনে ভাবছিল
বাপরে কি বিরাট সুড়ঙ্গ! শেষই হতে চাইছে না। কি হবে, যদি এখন এটা ওদের ওপর ধ্বসে
পড়ে যায়? জীবন্ত সমাধি! কেউ খুঁজেও পাবে না ওদের। আর এগিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র
ইচ্ছে না থাকলেও বাবলু থামতেও পারলো না । কারন সৌমি ওর আগে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
আরো খানিকক্ষণ চলার পর সহসাই ওরা উঠে
দাঁড়ানোর মতো একটা জায়গায় পৌঁছে গেল। ব্যাগ থেকে টর্চটা বার করে জ্বালালো বাবলু।
আশেপাশে কোথাও সৌমি নেই। নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে আলোও বেশি দূর যাচ্ছে না। হঠাৎ ওর
ব্যাগটা ধরে কে যেন টানলো। চমকে ঘুরে তাকালো
বাবলু! শোনা গেল সৌমির ইয়ারকি মাখা
কণ্ঠস্বর । মুখতো দেখছি শুকিয়ে গেছে বাবলু বাবু!
মোটেই না । আমি বুঝতে পেরেছিলাম
ওটা তোর কাজ। রাগ সামলে জবাব দিলো বাবলু।
জানিস এটা কোন জায়গা?
না।
পরিত্যক্ত খনি এলাকা । এটাও
একটা খনি। এটা যে ডাকাতদের বানানো সুড়ঙ্গ এ ব্যাপারে আমি একেবারে শিওর।
কিন্তু এখানে তো কিছুই নেই।
মানে...
বুঝেছি তুই কি বলতে
চাইছিস। এবারতো সেটাই খুঁজে দেখবো আমরা। বলা যায় না শিবে ডাকাতের লুকিয়ে রাখা
চোরাই মালের হদিস পেয়ে যেতেও পারি। ওহ! তাহলে আমি নেক্সট ছুটিতে টেক্সাস বেড়াতে
যাবো।
ওরা শুরু করলো হাঁটতে। কিছুটা
দূরে দূরে কাঠের গুড়ি দিয়ে ছাদটা ঠেকা দেওয়া আছে । কোনও কিছুতে হাত না দিয়ে ওরা
এগোতে থাকলো। একটা সময় এলো যখন ওরা দেখলো
ওদের সামনে রাস্তাটা তিনভাগ হয়ে তিন দিকে চলে গেছে। বাবলু আলো ফেলে দেখলো
পার্থক্য কিছুই নেই । সবগুলোই একই রকম গুহার মতো ভেতর অন্ধকার। এবড়ো খেবড়ো কালো
দেওয়াল ।
সৌমি হাত তুলে বললো, চল ওই পথটা
দিয়ে যাই।
ফিরে আসার কি হবে? কোনদিক দিয়ে
এলাম মনে থাকবেতো?
না মনে থাকার কি আছে। ফিরে এসে
বাঁ দিকে ঘুরলেই হবে। না না, ডান দিকে ঘুরতে হবে।
এখনই গুলিয়ে ফেলছিস! ফিরে এসে
ভুল হলে কি হবে বুঝতে পারছিস? আর বাড়ী ফেরাই হবে না। চিরটাকালের মতো আটকে থেকে যাব এখানে।
মাটির তলাতে। কথাগুলো বলতে বলতে বাবলু এদিক ওদিক থেকে কিছু ভাঙা চোরা কয়লার
টুকরো তুলে এনে জমা করলো । তারপর
একটা তীর চিহ্ন বানালো এখানে আসার সুড়ঙ্গের দিক নির্দেশ করে।
না সত্যিই তোর বুদ্ধি আছে বলতে
হবে। সৌমি বললো হাসি মুখে।
ধন্যবাদ। স্বীকার করার জন্য।
আবার শুরু হল ওদের হাঁটা। মিনিট
সাতেক চলার পর ওদের কানে ভেসে এলো একটা শব্দ। অনেকগুলো বই এর পাতা যেন হাওয়ার ধাক্কায় ফট ফট করে উড়ছে।
সৌমি বাবাগো মাগো চিৎকার করে সামনের দিকে দৌড়ালো । পিছু নিলো বাবলুও। অনেকটা ছোটার পর সৌমি
থামলো। আর দম নেই। হাঁফাচ্ছে দারুন ভাবে।
কিসের শব্দ ছিল ওটা?
বাদুড় । দম নিয়ে বললো সৌমি ।
বাদুড়! তার জন্য এতো ভয়ের কি
আছে?
ভয়ের কি আছে মানে। জানিস ওরা
তোর রক্ত চুষে খেয়ে নেবে। ওদের ভ্যাম্পায়ারের মতো দাঁত থাকে।
মোটেই সব বাদুড় রক্ত খায় না ।
কে বললো তোকে?
বইয়েতে পড়েছি। বাদ দে চল এগোনো
যাক ।
সামনের পথটা এবার ঢালু। নিচের দিকে নেমে গেছে। আরো কিছুটা সময়
কেটে যাওয়ার পর যেখানে ওরা উপস্থিত হল সেখানকার ছাদটা বেশ উঁচু। জায়গাটা বেশ
প্রশস্ত । একটা বড় হল ঘরের মতো। পেছন থেকে সৌমির প্রশ্ন ভেসে এলো, কিছু দেখতে পাচ্ছিস?
পাচ্ছি...কিন্তু বুঝতে পারছি না
কি ওগুলো!
কি রকম দেখতে?
লম্বা বাক্সের মতো।
বাক্সের মতো! সৌমি ছুটে আসার
শব্দ শোনা গেলো। মনে হচ্ছে টেক্সাস আমার কপালে নাচছে রে বাবলু! ওগুলো নিশ্চিত
গুপ্তধনের বাক্স। আমরা পৌছে গেছি । ইইইইহাআআ!!
বাক্সগুলো লম্বাটে এবং সরু ।
খুব বেশি হলে হাত খানেক চওড়া আর ফুট সাতেক লম্বা । ধুলো আর মাকড়শার জালে ঢাকা ।
সৌমি আমার ইন্টিউশন কিন্তু তোর
সাথে মিলছে না ।
কেন তোর আবার কি মনে হচ্ছে?
সিন্দুক কখনো এরকম
দেখতে হয় নাকি!
মানে?
তুই বোধ হয় চিনতে পারবি। বিদেশি
সিনেমায় এরকম অনেক দেখা যায়।
কি বলতে চাইছিস বলতো? কি দেখছিস
বলতো?
এসেই দ্যাখ ভালো করে। তাহলেই
বুঝতে পারবি ।
সৌমি এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
তারপর ভয়ার্ত ফ্যাসফেসে কণ্ঠে বললো, বাবলু! ওগুলো তো ক-কফিন । তার মানে আমরা
এখন...
আমরা এখন মাটির তলার কোনো কবরখানার
ভেতরে। আমাদের চারপাশে রাখা আছে মানুষের মৃতদেহ...কঙ্কাল। বলতে বলতে বাবলু বুঝতে
পারলো ওর গলা কাঁপছে। কাঁপছে সারা শরীর। সাথে সাথেই রোম খাড়া হয়ে উঠেছে ।
ওদেরকে আরো হতবাক করে হঠাৎই
ওপরের ছাদ ভেদ করে নিচে নেমে এলো একটা আলোর চওড়া স্তম্ভ।
দুজনেই চমকে উঠলো ।
চার
কি ব্যাপার বলতো? ফিসফিস করে
বললো বাবলু।
ততোধিক ফিসফিসানির স্বরে সৌমি
বললো, তোর কথাই ঠিক এটা একটা কবরখানা। তোদের বাড়ী থেকে কিছুটা দূরেই । তুই
দেখেছিস বোধহয়।
শরীরের ভেতরটা কেমন কেমন করে
উঠলো বাবলুর । ওর একটুও ভালো লাগছে না আর এই অ্যাডভেঞ্চার। তাই কিছুটা বিরক্তির
সাথে বললো, না দেখিনি। ইচ্ছেও নেই। কিন্তু ওই আলোটা কিসের এটা জানতে ইচ্ছে করছে।
এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল
বাবলু আলোটার দিকে । পেছনে সৌমি ।
আলোর উৎসটা দেখা গেল ।
ওপরে একটা ফাঁকা জায়গা সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশ। সাদা মেঘ । কিছু মানুষকেও দেখা
যাচ্ছে ওপরে । কালো এবং সাদা পোশাক পড়া । একজনের হাতে একটা বই । গলায় খুলছে পবিত্র
ক্রশ । হাতের বইটা দেখে মানুষটা কিছু বলছে । নিচ থেকে পরিস্কার শোনা যাচ্ছেনা ওদের কথা।
ওরা মনে হয় কাউকে কবর দিতে
এসেছে। সৌমি বললো।
তুই কি বলতে চাস এই অঞ্চলে কবর
দেওয়ার মানে একটা গর্তের ভেতর দিয়ে কফিনটাকে মাটির তলার ঘরে নামিয়ে দেওয়া। ধুসসস
এরকম আবার হয় নাকি!
আমি জানি না । কিন্তু আমার একটা
ব্যাপার দেখে অবাক লাগছে।
কি ব্যাপার?
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আজ অবধি এখানকার কাউকে কবরখানায়
কবর দিতে দেখিনি আমি।
মানে! কি বলতে চাইছিস তুই?
যেটা বলতে চাইছি সেটা বোঝানোর
ক্ষমতা আমার যদি থাকতো তাহলে তো সমস্যাই থাকতো না। সৌমির গলায় হতাশা ।
সে যাকগে । তবে একটা সমস্যার সমাধান কিন্তু
আপাতত হয়েছে।
সৌমি ঘুরে তাকিয়ে বললো, কোন
সমস্যা?
ওই আলো আসার ফাঁকটা দিয়ে আমরা
এখান থেকে...
বাবলুর মুখের কথা শেষ হলোনা।
তার আগেই অপরের আলোটা কমে এলো একটা কফিন
নিচে নামতে শুরু করেছে দড়ি বাঁধা অবস্থায় । ওদের স্তম্ভিত করে দিয়ে কফিনটা মেঝেতে
নেমে আসা মাত্র আলোর ফাঁকটা বন্ধ হয়ে গেল।
এটা কি রকম হলো? বাবলুর গলায়
একরাশ উৎকণ্ঠার ছোঁয়া ।
সেটা পরে ভাববি বাবলু। এদিকে
তাকা। কফিনটা দ্যাখ। যদিও নতুন। তবু এরকম কফিন এখনো যে
কেউ ব্যবহার করে এটা দেখেই আশ্চর্য
হচ্ছি!
কেন আশ্চর্যর আবার কি হলো । কি
ব্যাপার বলতো? ওটা কি কফিন নয়?
কফিনইতো...কিন্তু হাতে বানানো।
হাতেই তো বানানো হয়।
উফ! তুই বুঝতেই পারছিস না ।
এরকম কফিন শ’খানেক বছর আগে বানানো ও ব্যবহার হতো। মনে হচ্ছে আমরা যেটা দেখলাম সেটা
একশো বছর আগের ঘটনা।
বাবলু হেসে ফেললো । সিনেমা দেখে
আর আজে বাজে গল্প পড়ে পড়ে তোর মাথাটা একেবারেই গেছে। চল, ফেরা যাক।
ফেরার জন্য পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে
ওরা হতবাক হয়ে গেল। ওদের সামনে এখন অনেকগুলো গুহা মুখ । বোঝার উপায় নেই ঠিক কোনটা
দিয়ে এসে ওর ঢুকেছিল।
কোনটা দিয়ে যাব বলতো? বাবলু
কিছুতা ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলো ।
একটা পথের দিকে আঙুল তুলে সৌমি
বললো , আমার মনে হচ্ছে আমরা ওই দিক দিয়ে এসেছি।
তোর ঠিক মনে আছে তো? আমার
কিন্তু ওই পথটা মনে হচ্ছে।
একটা কথা বলবো?
কি?
এতো ভাবলে মাথা গুলিয়ে যায় ।
আগে একটু বিশ্রাম নিলে ভালো হয় না।
ইচ্ছে না থাকলেও সৌমির কথা মেনে
নিলো বাবলু। ব্যাটারী বাঁচাতে টর্চটা অফ করে শক্ত মেঝের ওপর বসলো ওরা দুজন গায়ে গা
ঠেকিয়ে। পিঠের ব্যাগ থেকে বিস্কুট বার করলো বাবলু । সৌমিকে দিলো । বিস্কুট খাওয়ার
পর জল খাবে বলে ওয়াটার বোতলটা হাতে নিয়েছে এমন সময়...
...ক্যাআআআচট! করে একটা শব্দ হলো।
ঠিক যেন কাঠের গায়ে লাগানো একটা পেরেক উঠালো কেউ!
বাবলু শিগগিরি টর্চটা জ্বালা !
সৌমি আতঙ্কিত স্বরে বললো।
অন্ধকারে থতমত খেয়ে গেল বাবলু।
টর্চটা জ্বালাতেও পারছিল না ঠিকমতো ।
কি হলোরে জ্বালা টর্চটা। সৌমি এবার
ধমকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে একটা জোরালো শব্দ হলো একটু দূরে। বাবলু প্রায় একই
সাথে টর্চটা জ্বালালো। চারপাশে ঘোরালো আলোর ফোকাশটাকে ।
নাহ যেমন ছিল সব তেমনই আছে।
কিন্তু ও কি!! বাবলুর মুখ দিয়ে প্রায় গোঙানির মতো শব্দ বের হচ্ছিলো। অনেক কষ্টে
নিজেকে সামলালো । প্রবল বিষ্ময়ের সাথে তাকিয়ে দেখলো একটু আগে নেমে আসা নতুন কফিনটার ঢাকনা খোলা।
এক পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে ওটা ।
চলতো ওটার ভেতরটা একবার দেখি!
সৌমি উত্তেজনায় কেঁপে উঠে বললো ।
তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?
বাবলু প্রায় ধমকানোর মতো করে বলে উঠলো । চারদিকের নিস্তব্ধতায় বাবলু এই মুহূর্তে
যেন নিজের হৃদপিণ্ডের লাফানোর শব্দটাও শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হলো ।
এতো ভীতু কেনরে তুই? সৌমি উলটে
ধমকে উঠলো। ওটা তো একটা মৃতদেহ। মৃত মানুষ কি আর করবে। বলতে বলতে সৌমি এগিয়ে গেল
ওটার দিকে। বাবলু আর কিছু বলার আগেই ।
কফিনের ভেতর শোয়ানো আছে একটা
পুরোনো দিনের পোশাক পড়া মানুষ। কালো রঙ জ্বলে যাওয়া কোট। বুকের কাছে দুটো বোতাম
খোলা। দুটো গর্ত সেখানে। শুকনো রক্ত লেগে আছে।
বাজি ধরতে পারি একে কেউ গুলি
করে মেরেছে। ডাকাত টাকাত হবে নিশ্চিত। সৌমির গলায় ইয়ার্কির সুর ।
থামবি তুই! যত্তসব আজে বাজে
বকবক। বাবলুর আর কিছুই ভালো লাগছিল না। বললো, চল এবার পালাই এখান থেকে ।
একটা জিনিষ খেয়াল করেছিস?
লোকটাকে বুট পড়িয়েই কবর দিলো। স্ট্রেঞ্জ! সৌমির খটকা লেগেছে এমন একজন বিজ্ঞ মানুষের মতো মাথা নেড়ে বললো।
কথাটা শুনে বাবলুও মৃত মানুষ
টার পায়ের দিকে তাকালো । যা করেছে, করেছে । এবার চ অ অ...
দাঁড়ানারে আমি আর একটু দেখি
ভালো ক...
মুখের কথা মুখেই আটকে গেলো
সৌমির। দারুন বিস্ময়ে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার অবস্থা ওদের । শুয়ে থাকা মৃতদেহটার চোখ নড়ছে
একটু একটু করে। বাবলু সৌমির হাতটা চেপে ধরলো । নিজেদের অজান্তেই ওরা শুরু করলো
পিছাতে । এক পা এক পা করে...
মৃতদেহটা উঠে বসলো কফিনের
ভেতরেই । সেটা দেখে নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে গেল বাবলুদের । সৌমির হাত প্রবল ভয়ে উঠে
এসেছে মুখের ওপর। অস্পষ্ট জড়ানো গলায় ও
বলতে থাকলো, জোম্বি! জোম্বি! অর্থাৎ জ্যান্ত মৃতদেহ ।
কফিনের দুপাশে হাতের চাপ দিয়ে
লম্বা লম্বা পা দুটোকে বাইরে বের করে উঠে দাঁড়ালো মৃতদেহটা। তারপর একটু একটু করে
এগিয়ে আসতে শুরু করলো ওদের দিকে। চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত রকমের । সহসাই মুখ হাঁ করে
একটা বিকট চিৎকার ছাড়লো। বাবলুর মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো ।
সৌমি হাতে টান দিতেই সম্বিৎ
ফিরলো বাবলুর ।পিছন ঘুরে শুরু করলো ছুটতে...কিন্তু কোন পথে যাবে? সামনে
অনেকগুলো গুহামুখের গোলকধাঁধা ।
পথ বেছে নেওয়ার মতো সময় এখন
ওদের হাতে নেই। সামনে যেটা পেলো সেটাতেই ঢুকে পড়লো দুজনে । কিছুদূর যাওয়ার পর বাবলু
একটু থেমে টর্চটা জ্বালিয়ে আলো ফেললো পেছন দিকে। দেখতে পেলো রহস্যমাখা অন্ধকারের
মধ্যেও ভয়ঙ্কর মূর্তিমানের মতো টলতে টলতে এগিয়ে আসছে মৃতদেহটা।
পড়িমড়ি করে আবার শুরু করলো
ছুটতে ।
আপাতত সামনে গুহার পথটা দুভাগে
ভাগ হয়ে গেছে আবার। কোন পথে যাবে এবার? বাবলু সৌমির দিকে তাকালো।
তোর বানানো সেই তীর চিহ্নটা
খুঁজে পাওয়া দরকার । ওটা অনুসারে যেতে হবে আমাদের। এদিকে ওদিকে আলো ফেলেও সেটাকে
দেখতে পাওয়া গেলো না । আর এর অর্থ একটাই ওরা ভুল পথে এসেছে।
পিছন থেকে ভেসে আসছে থপ থপ করে
পা ফেলার শব্দ। সৌমি বাবলুর জামার হাতায় টান মেরে বললো, বাবলু দাঁড়ালে চলবে না।
পালাতে হবে এখান থেকে। ঝটপট! শিগগিরি !!
ওরা প্রথম পথটা ধরেই দারুন
ত্রাসের সাথে শুরু করলো ছুটতে।
কিন্তু বিপদ যখন আসে তখন এভাবেই
আসে। ওদের পরিশ্রম ব্যর্থ । সামনে আর পথ নেই। নিরেট কালো দেওয়াল। অতএব ফিরে যেতে
হবে এখান থেকে । ঢুকতে হবে অন্য গুহা পথে। সেটাই করলো ওরা ।
বেশ কিছুক্ষন অন্ধকারে ছোটার পর
ওরা বুঝতে পারলো ঘুরে ফিরে ওরা সেই কবরখানাটার ভেতরে ফিরে এসেছে আবার। ওদিকে সম্ভবত
ওদের পায়ের আওয়াজ অনুসরণ করেই এগিয়ে আসছে সেই মৃত মূর্তিমান।
বাবলু ইতিমধ্যে নিজেকে অনেকটা
সামলে নিয়েছে। চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে সৌমির হাত ধরে এগিয়ে গেল দ্বিতীয়
গুহাপথের দিকে। প্রথমটায় ঢুকে ছিল আগেরবার । যা হবে হবে...আপাতত ওই বীভৎস
মূর্তিমানের হাত থেকে বাঁচাটাই প্রধান কাজ। মাথার ভেতরে আর কিছু কাজ করছে না এই
মুহূর্তে । কি করে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছানো যায় সেটাই মূল চিন্তা।
কিন্তু না আজ মনে হচ্ছে ভাগ্য
বলে জিনিষটা ওদের দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে । কিছুতে স্পর্শ না করা সত্বেও
একটা ছাদে ঠেসান দেওয়া খুঁটি কাঠ ওদের সামনে ধড়াম করে পড়ে গেল । তার সাথেই ছাদ
থেকে খসে পড়লো একটা বড় সড় পাথরের চাঙর । সামনে এগিয়ে যাওয়ার আর উপায় রইলো না।
এবার কি করবি? সৌমির গলায়
কান্না মাখা ভয়ের সুর।
তুইই কিছু উপায় বের কর। এখানে
আসার ভাবনাটাতো তোর মাথাতেই এসেছিল। বাবলুর গলায় ব্যঙ্গের ছোঁয়া।
ও, সব দোষ আমার না ! সুড়ঙ্গটা
কে খুঁজে বার করেছিল শুনি...আমি?
বাবলুর এই মুহূর্তে ঝগড়া করার
একটুও মুড নেই। আতঙ্কে ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কথা না বলে ও সামনে পড়ে থাকা ধুলো
পাথরের চাঙরটা এবং ভাঙা চোরা জিনিষের
স্তুপের দিকেই এগিয়ে গেল।
ওটা পার হয়ে কি করে যাবি? সৌমির
গলা অসহায় শোনাচ্ছিল।
তোর ইচ্ছে না হলে তুই থাক এখানে । আমি
চেষ্টা করে দেখি।
পিছন থেকে শোনা যাচ্ছে এই থপ থপ
শব্দ। অনেকটাই কাছে এসে গেছে । এবার সৌমিকেই দেখা গেল তড়িঘড়ি এগিয়ে গিয়ে টুকরো টাকরা পাথর ধুলো
সরাতে। কিছুক্ষনের চেষ্টায় একটা ফাঁক তৈরি করে ফেললো ওরা । প্রানপনে চেষ্টা চালাতে থাকলো ফাঁকটাকে
বড় করার
।
আরো খানিকটা বড় হতেই বাবলু
সৌমিকে বললো ওটার ভেতর দিয়ে যাওয়ার জন্য ।
পিছনে আওয়াজটা আর অনেক কাছে এসে
গেছে ।
বাবলু চেঁচিয়ে উঠলো, জলদি, সৌমি
জলদি! ওটা এসে গেছে!
পাঁচ
সৌমি চলে গেছে স্তুপের ওপাশে ।
এবার বাবলু মাথা ঢোকালো। কিন্তু অর্ধেকটা ঢোকার পর আটকে গেলো পিঠের ব্যাগে ।
পিছিয়ে গিয়ে ব্যাগ খোলার মতো সময় যে নেই সেটা বিভীষিকাটার এগিয়ে আসার গতিতেই বাবলু
বুঝতে পেরেছিল। সেই তাড়াহুড়োতেই ব্যাগের কথাটা মাথাতেই ছিল না। চিৎকার করে বাবলু
ডাকলো, সৌমি!!! আমি আটকে গিয়েছি !
অন্ধকারে সৌমি হাত বাড়ালো। আমার
হাতটা ধর বাবলু। হাতড়ে
হাতড়ে কোনো রকমে সৌমির হাতের নাগাল পেলো । আর ঠিক তখনই নিজের গোড়ালির কাছে একটা বরফ শীতল
ছোঁয়া অনুভব করলো বাবলু। গোটা শরীরটা অবর্ণনীয় শিহরনে কেঁপে উঠলো ওর। খসখসে গলায়
বললো, জোরে টান সৌমি... খোক্কসটা আমার পা
ধরে ফেলেছে ।
সৌমি গায়ের সব শক্তি একজোট করে
দু হাতে বাবলুর হাত ধরে টানতে থাকলো । প্রানপনে চিৎকার করে চলেছে বাবলু। একসময় এই
টানা হ্যাঁচড়ায় জমে ওঠা স্তুপটা একটু নড়ে উঠলো। আর সেই অবসরে বাবলু এক ঝটকায় চলে
গেল পাথরটার ওপাশে । হুড়মুড় করে আর কিছুটা ধুলো পাথর কুচি নেমে এসে বন্ধ করে দিলো
ওদের বানানো ফাঁকটাকেও ।
আপাতত ওরা নিরাপদ। দেহধারী
অশরীরী ওপাশে আটকে গেছে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এসেছিল দুজনেরই । জলের বোতলটা বার করে
জল খেলো ওরা। কয়েক মুহূর্ত বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করলো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। দুজনের
মনেই এখন একটা চিন্তা কি করে এই পাতাল থেকে বের হওয়া যায় ।
টর্চটা আবার নিভিয়ে দিয়ে বাবলু।
চারপাশ এতোটাই নিস্তব্ধ দুজনের নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ দুজনেই শুনতে পাচ্ছে। হঠৎ মিশকালো
অন্ধকারের ভেতরেই এক বিন্দু আলোর কনা দেখতে পেলো সৌমি । বাবলুকে দেখালো । বাবলু
একটু এগিয়ে গিয়ে বুঝতে পারলো কিছুটা দূরের দেওয়ালের গায়ের দুটো পাথরের ফাঁক দিয়ে
আলোটা আসছে। খনি জগতের বাইরে যে এলাকা তার প্রতিনিধি ওই আলো ।
সমস্ত গায়ের জোর এক করে বাবলু পাথরটাকে
টানলো । হাত লাগাল সৌমিও । খুব সামান্য একটু নড়লো পাথরটা । আলোটাও একটু বাড়লো । একটা ওপর দিকে উঠে যাওয়া সুড়ঙ্গ পথ ধরে আলোটা অনেকটা দূর
থেকে আসছে । এবার টর্চ জ্বেলে ভালো করে
দেওয়ালটা দেখলো । বুঝতে পারলো কোনো কারনে একটা পথকে দুটো মাঝারি মাপের পাথর আর কাদা মাটি দিয়ে
আটকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ এই মাটি খুঁড়ে সরাতে পারলে ওই সুড়ঙ্গতে পৌছানো
যাবে।
যে করেই হোক আমাদের পাথরের পাশের মাটি
সরাতে হবে। বললো বাবলু। যা বুঝছি মাটিটা খুব একটা শক্ত নয় ।
হয়তো শক্ত নয় মাটিটা কিন্তু
খালি হাতে খোঁড়া মোটেই সহজ কাজ নয়। সৌমি বাবলুর কাছে টর্চটা চাইলো ।
টর্চ কি করবি?
দরকার আছে দে না। টর্চ নিয়ে
সৌমি একটু পিছিয়ে গেল সেই দিকে যেদিক থেকে এসেছিল ওরা। তারপর ফিরে এলো একটা কাঠের
টুকরো নিয়ে । ছাদটা ভেঙে পড়ার জায়গাটা থেকে ।
এটা দিয়ে খুঁড়তে সুবিধা হবে বোধ
হয়।
হলোও তাই।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই একটা হামাগুড়ি
দিয়ে যাওয়ার মতো গর্ত ওরা বানিয়ে ফেললো পাথর দুটোর মাঝে জমে থাকা মাটির ভেতর দিয়ে।
শুরু হল নতুন উদ্যমে এগোনো । সুড়ঙ্গপথে যত
এগোতে থাকলো আলোটা ক্রমশ বড় আর উজ্জ্বল হতে থাকলো । শেষমেষ বাবলুরা পৌছালো একটা বড়
গর্তের ভেতরে । একটু ওপরেই
একটা মানুষ বেরিয়ে যেতে পারে এমন ফাঁক । ওখান দিয়েই ঢুকছে আলো । বার কয়েক লাফ ঝাঁপ
দিয়ে ওটার কানাত ধরে ওপরের জমিতে উঠে গেল
বাবলু । তারপর ঝুঁকে সৌমিকে উঠিয়ে নিলো । চোখ ধাঁধানো ঝকঝকে সূর্যের আলো ছড়িয়ে আছে
চারপাশে ।
চার দিকটা দেখতে দেখতে সৌমি
বললো, সুড়ঙ্গ পথে কতদূর চলে এসেছি কে জানে। এদিকটায় আমি আগে কোনো দিন আসিনি। ঠিক চিনতে পারছিনা।
চেনার দরকার নেই । ওই জঘন্য
জায়গা থেকে যে বেরিয়ে আসতে পেরেছি এই যথেষ্ট। আর খনিগুহায় ঢুকবো না জীবনে,
প্রতিজ্ঞা করলাম ।
কি অবস্থা হয়েছেরে আমাদের হাত
পায়ের। একেবারে কালো ভুত। জামা কাপড়ের যা হাল তাতে আজ কপালে মার নাচছে । তোর মাথায়
মাকড়সার জাল আটকে আছে ।
তোর চুলেও ।
কি করবি এবার?
চল হাত
মুখ ধুয়ে কিছু খাবার পাওয়া যায় কিনা দেখি
। খুব ক্ষিধে পেয়েছে ।
টাকা
আছে তোর কাছে ।
হ্যাঁ
ব্যাগে আছে । কিন্তু যাবো কোন দিকে?
সেটাই
তো ভাবছি আমিও!
সেকিরে?
কিছু দিন আগে যে বলছিলি সজ্জনপুরের সব জায়গা নাকি তোর হাতের তালুর মতো চেনা ।
তাহলে?
চেনাই
তো। কিন্তু...! সৌমি থমকে গেল ।
তোমরা
কি করছো এখানে? প্রশ্নটা শুনে। এসেছে ওদের পেছন দিক থেকে ।
দুজনেই
ঘুরে তাকালো। ওদেরই বয়েসী একটা ছেলে। গায়ের রঙ ময়লা। অদ্ভুত একটা পোশাক পরনে।
একটাই কাপড় দুপাশে সেলাই করা। হাঁটু পর্যন্ত ঝুল। গলার কাছটা গোল করে কাটা ।
কাঁধের পর হাতা বলে কিছু নেই সে পোশাকের। পায়ে নেই জুতো । হাতে একটা লাঠি। লাঠিটার
মাথায় একটা ধাতব হুক লাগানো । সব মিলিয়ে কেমন একটা খাপছাড়া ভাব। যেটা বাবলুদের
চোখে বিসদৃশ ঠেকছিল।
উত্তরটা
সৌমিই দিলো । কিছু করছি না তো? আচ্ছা তুমি কি বলতে পারবে এটা কোন জায়গা?
না
পারার কি আছে! এটা তো সজ্জনপুর ।
সে তো
আমরাও জানি । মানে জানতে চাইছি শহরটা কোন দিকে?
ওই যে
পাহাড়টা ওটা পার হয়ে যেতে হবে।
সৌমি
বললো, দূর তা কি করে হয়। আর যদি হয়ও তাহলেতো এখানে সুপারমলটা থাকার কথা ।
কি টা?
ছেলেটা জানতে চাইলো ।
সুপারমল
। বাবলু বললো ।
সেটা
কি? ওটা ইংরেজী শব্দ তাই না? ওই শব্দটা আমি এখনো শিখিনি ।
বাবলু
সৌমির দিকে তাকালো ।
তোমার
নাম কি? প্রশ্নটা করলো সৌমি ।
জুগন ।
উইলিয়াম জুগন হাঁসদা। তোমাদের?
বাবলুরা
নিজেদের নাম বললো। সৌমি বললো, আমার একজন বন্ধু আছে স্বপ্না হাঁসদা । তোমার কেউ হয়
নাকি?
আমাদের
আত্মীয়রা সব পাশের শহরে থাকে। আমার জন্ম এই এলাকাতে ।
অদ্ভুত
ব্যাপার! আগেতো কখনো তোমাকে দেখিনি ।
আমিও
না, জুগন জানালো । তোমাদের পোশাক কেমন যেন অদ্ভুত রকমের । ওই বিদেশীদের মতো ।
বাবলু
বললো, সেটা তো আমিও ভাবছি তোমার পোশাকের বাহার দেখে ।
সৌমি
হঠাৎ জানতে চাইলো, জুগন বলতে পারবে এটা কোন বছর? মানে কোন সাল?
না
বলতে পারার কি আছে এটা ১৮৯৬ সাল।
জুগনের
কথা শুনে দমটা যেন বাবলুদের গলার কাছে এসে আটকে গেলো । বাবলু বললো, ও নিশ্চয় ভুল বলছে নাহয় ইয়ার্কি মারছে আমাদের
সাথে।
নারে,
আমার কিন্তু সেটা মনে হচ্ছে না। ওর জামাকাপড়ই তার প্রমান দিচ্ছে। আর এই জন্যই এ
জায়গাটা এতো ফাঁকা। আমাদের সময় হলে বাড়ী ঘরে ভর্তি থাকতো ।
মানে
?কি যে সব বলছিস কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
সৌমি
বাবলুর কথার জবাব না দিয়ে জুগনকে এবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ওই দিকটায় একটা বড় জলাশয় আছে
না।
জুগন
ইতিবাচক ভাবে মাথা নাড়লো ।
ও যা
বলছে তাতে বিশ্বাস করতেই হচ্ছে যে এটা ১৮৯৬ সাল । সৌমি বাবলুর দিকে তাকিয়ে বললো।
বাবলু
অবাক হয়ে বললো, মানে!
সৌমিও
কেমন যেন ঘোরের মধ্যে মাথা নাড়লো। তারপর বিড় বিড় করে নিজের মনেই বলতে থাকলো, আমরা
বোধহয় সময় চক্রের পাকে পড়ে একশ বছরেরও বেশী সময় পিছিয়ে গিয়েছি ।
বাবলুর কোনো কথাই বিশ্বাস হচ্ছিল না । ওর সব কিছু কেমন যেন অদ্ভুত মনে
হচ্ছিল । চারপাশের পরিবেশটা কেমন যেন বদলে গেছে । কিছু আগেই তার প্রমান হাতে নাতে
পেয়েছে। মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে ওদের তাড়া করেছিল। এখন শুনছে ওরা ১০০ বছর আগের সময়ে চলে এসেছে। মাথাটা আবার
ঝিম ঝিম করে উঠলো ওর।
জুগন
আজ কাউকে কবর দেওয়া হয়েছে কিনা জানো? সৌমি জানতে চাইলো ।
জুগন
মাথা নেড়ে বললো, হ্যাঁ। দেওয়া হয়েছে তো । মিঃ জোন্সকে। জোসেফ ডাকাতের হাতে গুলি খেয়ে উনি
গতকাল মারা গেছেন।
বাবলু
কথাটা শুনে চমকে গেল দারুন ভাবে । সত্যিই তাহলে ওরা পিছিয়ে চলে এসেছে বহু বহু বছর
আগের একটা সময়ে। কি আশ্চর্য ব্যাপার! এও কি সম্ভব? বাবলু জুগনকে অদ্ভুত একটা
প্রশ্ন করে বসলো, জুগন তুমি কি জানো পিজ্জা কাকে বলে?
না ।
কি সেটা? জুগনের মুখে বিস্ময় । কোনো খেলনা? আগে তো শুনিনি কথাটা!
বাবলু
সৌমির দিকে তাকালো, বললো, ও যদি পাগল না হয়...তোর অনুমান যদি সত্যি হয়
...তাহলে আমরা এবার ঘোর বিপদে পড়ে গেলাম বলেই মনে হচ্ছে!
ছয়
আমাদের
আবার খনিগুহায় ফিরে যেতে হবে। এছাড়া আর কোনো পথ আমার মাথায় আসছে না । যেভাবেই হোক
ফেরার পথটা আমাদের খুঁজে পেতে হবে। বাবলু সৌমির দিকে তাকিয়ে হতাশা মেশানো গলায় বললো
।
সৌমি
ভয় ভয় মুখে গর্তটার দিকে তাকালো । ওর মনের পর্দায় ভেসে উঠলো সেই ভয়ঙ্কর জ্যান্ত
মরাটার এগিয়ে আসার ছবি । ধরা ধরা গলায় সৌমি বললো, একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর কিছু
করলে হয়না?
বাবলু
সম্মতি দিলো প্রস্তাবটায়।
তোমরা
কি ওই খনিতে ঢুকেছিলে ? জুগন জানতে চাইলো
।
বাবলুরা
নেড়ে হ্যাঁ বললো একসাথে ।
আবার
যেতে চাও নাকি ওর ভেতরে? ওটা কিন্তু খুব বিপদজনক জায়গা ।
বিপদ
জনক সেটা রা বলে দেওয়ার দরকার নেই । সৌমি অসহায়
ভাবে বললো, কি আর করবো বলো । তাছাড়া যে আর কোনো
পথ জানা নেই আমাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার।
কেন?
তোমরা পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলে যাও।
হবে না
জুগন। আসলে আমরা... বাবলু থেমে গেল । কিভাবে জুগনকে বোঝাবে ব্যাপারটা ওর মাথায় আসছিল না ।
তোমরা
...তোমরা কি? জুগনের চোখে কৌতূহলের ঝিলিক ।
আমরা
...আমরা তোমার মতো এই সময়ের মানুষ নই। ভবিষ্যত থেকে আমরা এখানে এসে পড়েছি ওই
গর্তটার ভেতর দিয়ে। সৌমি বললো ।
জুগন
হি হি করে হেসে উঠলো । আরে বাস, তোমরা তো বেশ ভালো গল্প ফাঁদতে পারো ।
গল্প
না জুগন , আমরা তোমাকে সত্যি কথাই বললাম। আচ্ছা দাঁড়াও – বাবলু ব্যাগ থেকে
ওয়াকম্যানটা বার করলো ।
সৌমি
অবাক হয়ে জানতে চাইলো ওটা দিয়ে কি করবি ? সৌমি জানতে চাইলো ।
আমি
নিশ্চিত ওয়াকম্যান এমন একটা জিনিষ যা এর আগে ও কোনোদিন দেখেনি। এটার কাজ দেখলে হয়তো ও কিছুটা হলেও
বুঝতে পারবে আমরা ভবিষ্যতের মানুষ ।
বাবলু
ওয়াকম্যানটা চালু করে হেডফোনটা গুঁজে দিলো জুগনের কানে ।
বিস্ফারিত
চোখে এক হাতে কান চেপে ধরলো জুগন । ওয়াকম্যানে বাজছিল বাবলুর
একটা প্রিয় গান। অবাক হয়ে জুগন এদিকে ওদিকে তাকিয়ে, বাবলুদের মুখের দিকে তাকিয়ে কি
যেন খুঁজতে চাইছিল। সম্ভবত গায়কবাদকরা কোথায় এটা বোঝার চেষ্টা করছিল ।
বাবলু
স্টপ বাটনটা টিপে গান থামিয়ে দিলো। জুগনের মুখে বিস্ময়ের ছাপ সুস্পষ্ট বর্তমান ।
কিছু
বুঝলে জুগন? সৌমি জানে চাইলো ।
অদ্ভুত!
শুধু এই শব্দটাই উচ্চারিত হলো জুগনের মুখ থেকে।
তুমি
গান শোনোনি কোনোদিন এর আগে?
শুনেছি
তো। কিন্তু এরকম কিছু শুনিনি আগে। জুগনের
কথা শেষ হতে না হতেই একটা জোরালো শিসের মতো হিসহিসে শব্দ কানে এলো ওদের । আতঙ্কিত
ফ্যাকাশে মুখে সৌমি চিৎকার করে উঠলো, বাবলু! সাপ! সাপ!
সাপকে
বাবলুও ভয় করে । কথাটা শুনেই ভয়ে ওর মুখ বিবর্ণ হয়ে গে লো ।
এই
এলাকায় অনেক সাপ আছে । জুগনের গলায় বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই । পাহাড়ি এলাকা । সাপ
থাকবেই।
কি করবো
এখন? ঢোঁক গিলে বাবলু খসখসে গলায় জানতে চাইলো ।
একদম
নড়বি না । নড়লেই ওরা ছোবল মারে আমি বইয়েতে পড়েছি । সৌমি বললো ।
এসময়
জুগন একটা অদ্ভুত কাজ করলো। ওর হাতের হুক লাগানো
লাঠিটা আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দিলো সাপটার দিকে । তার পর এক ঝটকায় সাপটাকে হুকে উঠিয়ে
নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে ।
বাবলু
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো । সৌমি তাকিয়ে ছিলো লাঠিটার দিকে। জুগন সেটা দেখে বললো,
এরকম লাঠি এখানে আমরা প্রায় সকলেই সাথে নিয়েই যাতায়াত করি।
তোমার
ভয় করে না? সৌমি জানতে চাইলো ।
করে
একটু একটু। তবে জানো বোধ হয় ওরাও আমাদের একই রকম ভয় পায় । কিছু না করলে সাধারণত
ওরা কিছু করেই না বলা যায়। আর একটা কথা ওরা কিন্তু আগুনকে খুব ভয় পায় । কথাগুলো
বলেই জুগন জানতে চাইলো, তোমাদের কি ক্ষিধে পেয়েছে?
বাবলুরা
প্রশ্নটা শুনে আবার একসাথে দুজনে হ্যাঁ বলে উঠলো । সেটা শুনে জুগন বললো, তাহলে চলো আমাদের বাড়ীতে
।
ওরা
কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো জুগনের সাথে ।
যেতে
যেতে ওরা জুগনের কাছ থেকে জানতে পারলো ওর বাবা মা এই মুহূর্তে বাড়ীতে নেই । পাশের
শহরে গেছে অসুস্থ পিসিকে দেখতে । মিস্টার জোন্সের মৃত্যুর কারনে আজ স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে।
জুগনদের
বাড়িটা ছোটো । এরকম বাড়ির গঠন বাবলু আগে দেখেনি। তিনটে ঘর । একটা ছোট্ট রান্না
করার জায়গা। মাথায় কাঠের ছাদ । আগে ভালো করে গা হাত পা ধুলো দুজনে । জুগন ওদের
খেতে দিলো ডিম সিদ্ধ আর বাসি রুটি । ক্ষিধের মুখে ওটাই অমৃত মনে হলো ওদের ।
তোমাদের
এখানে মোটরগাড়ি চলে না ? বাবলু জানতে চাইলো ।
মোটরগাড়ী
সেটা আবার কি?
যন্ত্রচালিত
গাড়ী । সৌমি বললো ।
ও, ঘোড়াবিহীন
গাড়ী। দেখেছি শহরের এলাকায় । খুব আওয়াজ হয় চলার সময় । ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে যায়। না
এদিকে নেই ।
তুমি
তার মানে টিভি কাকে বলে তাও জান না!
সেটা
আবার কি?
বাবলু বুঝিয়ে
বললো টিভির ব্যাপারটা। ওতে ভিডিও গেম খেলা যায় সেটাও জানালো । জুগনের খুব একটা আগ্রহ
দেখা গেলনা বিষয়টায় । মনে হয় ঠিকমতো বুঝতে পারেনি।
খাওয়ার
পর একটু বিশ্রাম নিয়ে সৌমি বাইরে গিয়ে দেখালো ওর ল্যাসোর নানান কেরামতি। বাবলু মনে
মনে স্বীকার করে নিলো সৌমি ওটা ভালোই নিয়ন্ত্রন করতে পারে। জুগনের হাতালির আধিক্যে
বোঝা যাচ্ছিলো ওর বেশ ভালোই লেগেছে ।
তোমাদের
গরু ছাগল নেই ? চড়াতে নিয়ে যাও না? সৌমি জানতে চাইলো । জানো আমার না খুব ইচ্ছে করে
মাঠে মাঠে ছাগল চড়িয়ে বেড়াতে।
না
আমাদের ওসব নেই। বাবা চান আমি যেন ডাক্তার হতে পারি । এদিকে তেমন কেউ নেই যে
আমাদের তো মানুষদের জ্বরটর হলে দেখবে ।
আমার
খুব ডাকাত হতেও ইচ্ছে করে জানো । সৌমিই বললো। বেশ অ্যাডভেঞ্চার করা যায়।
সৌমির
এই কথা শুনে জুগন বেশ অবাক হলো । বললো, সেকি । না না ডাকাত হওয়া আবার ভালো নাকি!
ভালো মানুষ কখনো ডাকাত হয় না। লোকের জিনিষপত্র লুঠ করা । মানুষ খুন করা এসব কি ভালো কাজ।
এই যে মিস্টার জোন্সকে মারল ওরা এটা কি ভালো কাজ?
কি
হয়েছিল ব্যাপারটা? বাবলু জানতে চাইলো।
মিস্টার
জোন্স ব্যাঙ্কে কাজ করতেন। টাকাকড়ির দায়িত্বে ছিলেন। জোসেফ এসেছিল ডাকাতি করতে।
মিস্টার জোন্স সিন্দুকের চাবি দিতে রাজি না হওয়ায় শুরু হয়েছিল তর্কাতর্কি । আর তারপরেই...
তুমি
ঠিকই বলেছ জুগন । ডাকাত হওয়া মোটেই ভালো কাজ নয় । আসলে ওরা ঠিক কি করে এভাবে তো
ভেবে দেখিনি কোনো দিন। সিনেমায়তো খারাপদেরকেও হিরো করে দেখায় ।
ওদের
কথার মাঝে বাবলু বলে উঠলো, সৌমি ফিরে যাওয়ার আগে চারপাশটা একবার ঘুরে দেখে গেলে
কেমন হয়?
দেখলেই
হলো ।
জুগন
তুমি কি আমাদের সাথে যেতে পারবে?
না
যাওয়ার কি আছে । আজতো আমার কোনও কাজই নেই।
ওরা
গ্রামের দিকে গেল । পাহাড়ের খাঁজে একটা মুদিখানার মতো দোকান। জুগন ওখান থেকে এক
পয়সার বিস্কুট কিনলো । এক
পয়সায় কিছু কেনা যায়! সৌমিদের কাছে ব্যাপারটা যথেষ্টই হতভম্ব হয়ে যাওয়ার মতো। গ্রামীন বেকারীতে
বানানো বিস্কুট । অদ্ভুত এক স্বাদ । যা ওরা আগে কখনো খায়নি ।
এরপর
হাঁটতে হাঁটতে ওরা এক সময় পৌছালো এমন এক জায়গায় যেটার চারপাশটা খুব চেনা চেনা। পর
পর সাজানো বড় বড় পাঁচটা পাথর দেখে ওদের আর সংশয় রইলো না । এখানে ওরা লুকোচুরি খেলেছে। এই সেই জায়গা
যেখানে বাবলুরা যে বাড়ীতে থাকে সেটা
সবে তৈরী হতে শুরু
হয়েছে । এর নিচেই বাবলু খুঁজে পেয়েছিল সুড়ঙ্গের পথ ।
ওরা
এগিয়ে গেল পাথরগুলোর দিকে। দেখতে পেলো বেশ স্বাস্থ্যবান একটা লোক পেছন ঘুরে বসে । মাথায় ছেঁড়া ফাটা একটা ঘাসে বোনা টুপি । পরনের পোশাক কত দিন
কাচা হয়নি কে জানে। বাবলুদের পায়ের শব্দ পেয়ে লোকটা মাথা ঘোরালো । টুপিতে ঢেকে আছে
অর্ধেক কপাল। দাড়ি গোঁফের জঙ্গল বলা যায় মুখটাকে । ভোঁতা আঙুল দিয়ে টুপিটা একটু তুলে কুতকুতে চোখে ওদের দিকে তাকাল
লোকটা ।
পাশেই
রাখা একটা বন্দুক ।
অ্যাই
কে রে তোরা? এখানে কি চাই? কর্কশ বাজখাঁই গলায় হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো লোকটা ।
জুগন
ফিস ফিস করে বলে উঠলো, সর্বনাশ! জোসেফ! ডাকাত!
সাত
তারপরেই
চেঁচিয়ে বলে উঠলো, পালাও! দৌড়াও!
শুরু
হলো দৌড় । এমন দৌড়ানো বাবলুরা খনি গুহাতেও দৌড়ায়নি। ছুটতে ছুটতে ওরা পৌঁছে
গেল একটা শুকনো মরা নদীর খাতের মতো জায়গায় । এদিকে ওদিকে পড়ে আছে ছোটো বড় নানান
মাপের পাথর । দম ফুরিয়ে এসেছিল ওদের। বাবলু হাঁফাতে হাঁফাতে বললো, কাছে পিঠে কোথাও লুকানোর জায়গা নেই জুগন?
কোনো উত্তর পেলো
না ।
আরো
একটু ছোটার পর একটা বাঁকের মতো জায়গা পার হল বাবলু । একপাশে সামান্য উঁচুতে ঘাসের
জঙ্গল। বাবলু দাঁড়িয়ে পড়লো। লাফিয়ে উঠে গেল ওপরে একটু দম নিয়ে ঘুরে তাকিয়ে সৌমিদের
ডাকতে গিয়ে আতঙ্কে থমকে গেল। দেখতে পেলো
জুগন আর সৌমিকে ধরে ফেলেছে জোসেফ । দু হাতে ওদের দুজনকে অবলীলায় ঝুলিয়ে রেখেছে
দৈত্যাকার মানুষটা ।
বাবলু
শুনতে পেলো জোসেফের কর্কশ কণ্ঠ, অ্যাই হতচ্ছাড়ার দল, তোদের আর একটা ছুঁচো কোথায়
লুকালো বল?
বাবলু
প্রানপণে চেষ্টা করছিল শরীরের কাঁপুনি থামাবার। ঘাস নড়তে দেখে যদি সন্দেহ করে
ডাকাতটা । ওদিকে ক্লান্ত অবসন্ন ভয়ার্ত মুখে ডাকাতটার দিকে তাকিয়ে ছিল সৌমি। ছট
ফট করার শক্তিটাও যেন কে কেড়ে নিয়েছে ওর। জুগনের অবস্থাও তথৈবচ।
হাল্কা
একটা হাওয়ার দমকা বয়ে গেল ঘাস জঙ্গলে। আর তাতেই কিছু একটা ঢুকে গেল বাবলুর নাকে।
হাঁচির বেগটা কোনোমতে নাক মুখ চেপে ধরে সামলালো বাবলু। হুঁক করে একটা অদ্ভুত শব্দ
বের হল ওর মুখ দিয়ে। এই রে শুনতে পেলো নাকি ডাকাতটা? নাহ, বরং ভেসে এলো সেই
বাজখাঁই চিৎকার, কি রে লোকজন ডাকতে গেলি নাকি রে? তাহলে কিন্তু এ দুটোকেই খতম করে
দেব । বলেই পেছন ঘুরে শুরু করলো হাঁটা ।
আর ঠিক
তখন ই আবার একটা হাঁচির বেগ এলো...এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলনা বাবলু ...হ্যাচ্চোওও!!!
সজোরে হেঁচেই ফেললো । থেমে গেল বিশালদেহী। ফিরে তাকাল । বোঝার চেষ্টা করলো শব্দটা
কিসের এবং কোথা থেকে হ লো । বুঝতে পারলো না যদিও । আবার শুরু করলো হাঁটতে ।
ঢিব
ঢিব করতে থাকা বুকে নিয়ে বাবলু বুঝতে পারলো ঝামেলাটা এবার ভালোই ঘোঁট পাকালো । একশো বছরের বেশি আগের এই জগত থেকে ফিরে
যাওয়ার সাথে এবার যুক্ত হলো সৌমির ডাকাতের খপ্পরে পড়া।
কিছুক্ষণ
চুপচাপ বসে থাকলো। কি করবে সেটা মাথাতেই আসছে না। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে নিয়ে আস্তে
আস্তে নেমে এলো উঁচু ঢিবিটা থেকে। তার পর হাঁটা শুরু করলো সেদিকেই যেদিকে ডাকাতটা
গেল। বেশি দূর যেতে হল না অবশ্য । একটা বড় পাথরের কাছেই দেখা পাওয়া গেল জোসেফের ।
সৌমির হাত পা বাঁধা। জুগনকে বাঁধছে এই মুহূর্তে।
বোকা
বিচ্ছুর দল। আমায় খুঁজতে এসেছিলি তাই না? পুরস্কার নিবি? রাত হলেই আমি এ এলাকা
ছেড়ে কেটে পড়বো । তোদের ছিঁড়ে খাবে রক্তখেকোর দল !
জুগন
মাথা নেড়ে কিছু একটা বলার আগেই সৌমি বললো, ইস্মাইল জোসেফ মাঝি । জোসেফ ডাকাত ।
তোমার কথা পড়েছি আমি বইয়েতে ।
কিসে?
বইতে।
পুরোনো দিনের সজ্জনপুর বইয়েতে ।
আরে
পাগল হয়ে গেলি নাকিরে মেয়ে । কি সব উলটোপালটা বকছিস!
ঠিকই
বলছি আমি। ওই বইটাতে তোমার কথা লেখা আছে। তোমার ফাঁসি হয়েছিল এখানেই।
দ্যাখো
কান্ড। অ্যাই পাগল টাগল হলি নাকি র্যা? আমিটা তাহলে কে? ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল মানে
তো মরে গেছি। আমিতো তাহলে ভুত! আমায় দেখে তোর মরা বলে মনে হচ্ছে নাকি? হ্যা হ্যা
হ্যা করে চারদিক কাঁপিয়ে হেসে উঠলো জোসেফ ডাকাত।
জুগন বললো,
না না তুমি ভুত কেন হবে জোসেফ দাদা।
কে র্যা
তুই? ও হো তোকে তো ভালো করে দেখিইনি । তুই হাঁসদার বেটা না?
জুগন
মাথা নাড়লো।
বড়
দাঁও মেরেছি এবার। পালাবো এলাকা ছেড়ে আজ রাতেই । বলতে বলতে জুগনকে বাঁধা শেষ
করে জোসেফ টুপিটা খুলে হেলান দিয়ে বসলো
পাথরটায় । পিঠের পেছনে রাখল পেটফোলা ব্যাগটাকে । ওটাতেই আছে লুটের মাল । টুপিটা
মাথা থেকে খুলে চাপা দিলো মুখের ওপর। পাশে রাখল বন্দুকটা ।
বাবলু
আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো আরেকটা পাথরের আড়ালে বসে। সৌমিদের কাছে যেতে হলে ওকে শুকনো নদীর খাতটা
পার হতে হবে। সেটা করতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি । তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে
পড়লো বাবলু । শুকনো নুড়ি পাথরের ওপর
শব্দটা বেশ জোরেই হলো। ছিটকে গেল দু একটা পাথর । সেই শব্দেই ঝট করে উঠে বসলো জোসেফ।
চকিতে হাতে নিলো বন্দুকটা । তারপর চিৎকার করে উঠলো, কে...কে ...কে? কিসের শব্দ হলো?
জুগন
দেখতে পেয়েছিলো বাবলুকে । তড়িঘড়ি পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাথরগুলোকে লাথি মারতে শুরু
করলো ।
সেটা
দেখে জোসেফ চ্যাঁচালো, অ্যাই ছোঁড়া আওয়াজ করছিস কেন রে? মেরে ঠ্যাং খোঁড়া করে
দেবো। দেখতে পাচ্ছিস না নাকি আমি ঘুমাচ্ছি ।
জুগনের
চোখে ঘৃণার ঝলক দেখে হ্যা হ্যা করে হেসে টুপিটা আবার মুখের ওপর চাপা দিয়ে হেলান
দিলো জোসেফ ডাকাত।
সৌমিদের
কাছে পৌছাতেই হবে বাবলুকে । আর তার জন্য যেতে হবে জোসেফের সামনে দিয়ে । আর কোনো পথ নেই । যদি
ঘুম ভেঙে যায় কি হবে ভগবান জানে।
যা হয়
হবে ভেবে পাথরের ওপর থেকে ঊঠতে গিয়েই
বাবলু থমকে গেল জোরালো হিস হিসে শব্দ পুনরায় শুনতে পেয়ে। উফ! সব বিপদ যেন লাইন
দিয়ে ওদের পেছনেই ধাওয়া করেছে । আড় চোখে তাকাতেই দেখতে পেলো কালছে লাল রঙের সরীসৃপটাকে
। ফনা তোলার উদ্যোগ করছে । মনে পড়ে গেল জুগনের বলা কথা । ওদের ক্ষতি না করলে ওরাও
কিছু করে না। দম বন্ধ করে পাথরের মতো আধ বসা অবস্থায় থেকে গেল বাবলু । সত্যিই কিছু
করলো না সাপটা। কয়েক সেকেন্ড বাদে বার দুই ফনা নাচিয়ে চলে গেল সড় সড় করে পাশের একটা শুকনো ঘাস ঝোপের
ভেতরে।
ধরে
রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে বার কয়েক শ্বাস নিলো বাবলু। তার পর পা টিপে টিপে এগোতে
থাকলো । হাতে খুলে নিলো পকেট নাইফটা । পৌছে গেল সৌমিদের কাছে । ইশারা করে জানালো
শব্দ বা নড়াচড়া না করার জন্য।
নিচু
হয়ে বসে কাটার চেষ্টা করলো জুগনের পায়ের বাঁধন । ধার তেমন নেই চাকুটায়। তবে
চেষ্টায় কি না হয় । এবার হাতে বাঁধন। সেটা যেন তাড়াতাড়িই কেটে গেল ।
সৌমির
পায়ের বাঁধনটাও কেটে ফেলতে পেরে আত্মবিস্বাস অনেকটাই বেড়ে গেল বাবলুর। সিনেমায়
যেমন দেখায় – ঠিক তেমন যেন ঘটে চলেছে সব ঘটনা । একবারে ডাকাতের ডেরায় ঢুকে তার ই
মুখের সামনে দাঁড়িয়ে... বুকের ভেতরটা ফুটবলের মতো লাফাচ্ছিল ওর ।
হঠাৎ
জুগনের আর্তচিৎকারে পিছন ঘুরে তাকানোর আগেই একটা ভারি হাতের থাবা এসে পড়লো বাবলুর
কাঁধে । মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে বাবলু ভয়ে জমে গেল। জোসেফ ডাকাত! রাগে লাল দুটো চোখ গনগন করছে
। জান্তব মুখে বীভৎস হাসি । হাত বাড়িয়ে সৌমিকেও ধরে ফেললো বদমাইশটা । জুগন পালালো।
বিদ্যুৎ বেগে পাথরের ফাঁক ফোকর দিয়ে।
আট
কি রে
পুঁচকে ছুঁচো আমাকে ফাঁকি দিবি ভেবে ছিলি তাই না ? এবার আর ঘুমোচ্ছি না । যতক্ষন
না এখান থেকে কেটে পড়ছি জেগেই থাকবো । ওদের কে সাথে রাখবো ঢাল হিসাবে। আমাকে কেউ
ধরতে বা মারতে এলে আগে তোদের শেষ করে দেবো !
সম্ভবত
আর আস্ত গোটা দড়ি নেই জোসেফের কাছে যে কারনে বাবলুকে বাঁধতে পারলো না । সৌমির পাটাও
খোলা থাকলো । দৌড়ে যে পালাবে সে সুযোগটাও নিতে পারছে না বাবলুরা । জোসেফ বন্দুক
হাতে নিয়ে বসে আছে। হঠাৎ জোসেফ কিছুক্ষণ
মন দিয়ে দেখল বাবলু দের, তারপর বললো, অ্যাই তোদেরকে তো এই এলাকায় আগে দেখিনি কোনো
দিন! তোদের জামা কাপড় ও যেন কেমন কেমন! পায়ে ওটা কি পড়েছিস রে?
এর নাম
স্নিকারস।
কোথায়
পাওয়া যায়?
আমারা
যেখান থেকে এসেছি সেখানে।
সেটা
কোথায় শুনি?
ভবিষ্যতে।
কথাটা
শুনে কুতকুতে চোখে দাড়ি গোঁগের জঙ্গল নাচিয়ে জোসেফ হেসে উঠলো খ্যাঁক খেকিয়ে। আরে
বাহ রে! ভালো রসিকতা করতে পারিস দেখছি তোরা । ভবিষ্যৎ মানে ফিঊচার । একেবারে গোমুখ্যু
নই। পেটে
আমার বিদ্যেও আছে বুঝলি। হাঃ হাঃ হাঃ!!!
বাবলু
ওকে চারজার টর্চটা দেখা । সৌমি বললো ।
কেন?
দেখাই
না ।
বাবলু
মনে মনে বললো, এ ব্যাটা ডাকাত যদি ওটা নিয়ে নেয় তাহলেই হয়েছে । বাবলু ব্যাগে হাত
দিতে যেতেই জোসেফ হুঙ্কার মেরে উঠলো, অ্যাই একদম চালাকি করার চেষ্টা করবি না বলে
দিলাম! একদম না !
বাবলু
ইতিমধ্যে লাল রঙের টর্চটা বার করে জোসেফের দিকে এগিয়ে ধরলো ।
জোসেফ
নিলো ওটা।
পাশে
সাদা পুঁতির মতো যেটা আছে ওটা চিপে দেখো কি হয় । সৌমি বললো ।
কিছুটা
ইতস্তত করে বার দুয়েক বাবলুদের দিকে তাকিয়ে সাদা সুইচটায় চাপ দিলো । টর্চের মুখটা
জোসেফের দিকে ছিল। ভেতরে বাল্বটা জ্বলে উঠতেই জোসেফ অবাক হয়ে গেল। মজাটা পেয়েই বার কয়েক নেভা জ্বলা করলো। তারপর
হ্যা হ্যা করে হেসে বললো, আরে এ তো জাদু খেলা । তুই জাদুকর নাকিরে।
ঠিক
ধরেছো , হ্যাঁ, ও একজন জাদুকর। সৌমি বললো ।
ওর
কাছে এমন একটা জিনিষ আছে যার ভেতরে মানুষকে বন্দি করে রাখা যায় । তারা গান শোনায়
আমাদের ওখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
জোসেফের
চোখ দুটো বড় বর হয়ে গেল এ কথা শুনে। বললো, কি দ্যাখা দেখি সেই জিনিষটা !
বাবলু
মনে মনে সৌমির মুন্ডপাত করতে করতে ভাবলো, এবার ওয়াক ম্যানটাও গেল। কতদিন ধরে টিফিনের পয়সা জমিয়ে ও ওটা কিনেছে।
পকেট থেকে ওয়াকম্যানটা বার করলো । হেডফোনের
পিনটা গোঁজাই ছিল। কি ভাবে ব্যবহার করতে হবে সেটা দেখিয়ে ওটাও জোসেফের হাতে দিলো
বাবলু । বন্দুকটা পাশে রেখে ওটা হাতে নিলো জোসেফ।
গান
শুরু হওয়া মাত্র জোসেফের মুখের ভাবেই বোঝা গেল কি পরিমাণ অবাক হয়েছে ও । এ আবার কি
হচ্ছে। হেডফোনের মাথাটা এক কান থেকে খুলে ভালো করে দেখলো । তার পর আবার কানে
গুঁজলো । শব্দ বাড়ানোর নবটা ঘোরাতেই ওটা বেড়ে গেল অনেকটা । এসব করায় এতোটাই মগ্ন
হয়ে গিয়েছিল জোসেফ যে খেয়াল করেনি ইতিমধ্যে দুজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে উলটো
দিকের পাথরের আড়ালে।
বাবলুর
মনে হলো সৌমি এদের আগেই দেখতে পেয়েছিল ।
সম্ভবত জোসেফের হাতে থাকা বন্দুকটার কারনে ওরা এগিয়ে আসতে পারছিল না। আর সেজন্যই সৌমি এই ফন্দিটা খাটিয়েছে । বেশ
স্বাস্থ্যবান লোক দুজনের পরনে খাকি রঙের হাফপ্যান্ট আর ওই একই রঙের জামা । অর্থাৎ
এরা স্থানীয় পুলিস । দুজনের চেহারাও বেশ ভালোই।
কয়েক
সেকেন্ড অপেক্ষা করেই দুজন প্রায় একসাথেই একলাফে সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতে পিস্তল ।
চমকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল জোসেফ । আর সেই ফাঁকে জুগন আর একটা পাথরের আড়াল থেকে
ছুটে এসে জোসেফের বন্দুকটা তুলে নিয়ে একপাশে সরে গেল । এদেরকে জুগনই ডেকে
এনেছে বোঝা গেল ।
এবার
আরো একজন মানুষ একইরকম পোষাক এবং মাথায় সোলার হ্যাট পড়া বেরিয়ে এলেন পাথরের আড়াল থেকে
। হাতে হ্যান্ড কাফ নিয়ে। বললেন, তোর খেলা শেষ জোসেফ। পালানোর চেষ্টা করিস না।
দুদিকে
দুটো আগ্নেয়াস্ত্রর সামনে হতচকিত হয়ে থাকা জোসেফ ধরা দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে
পেলো না ।
আপনিতো
ইন্সপেক্টর বিজয় বর্মণ, তাই না? সৌমি বললো ।
ইয়েস
আমিই বিজয় বর্মণ । তুমি আমায় চেনো?
আমি
বইয়েতে পড়েছি আপনার নাম ।
হোয়াট?
কিসে!
বাবলু
তাড়াতাড়ি বললো, কিছু না স্যার। বাদ দিন ওর কথা। ইশারায় বললো, ওর মাথায় একটু গণ্ডগোল
আছে। সেটা দেখে সৌমি মুখ ভ্যাংচালো ।
জুগনের
কাছ থেকে বন্দুকটা নিলেন মিঃ বর্মণ তারপর বললেন, একা একা বাড়ী যেতে পারবে তোমরা না
দিয়ে আসবো?
বাবলু
টর্চ আর ওয়াকম্যানটা পকেটস্থ করে বললো, না না স্যার আমরা চলে যেতে পারবো। আপনি
চিন্তা করবেন না।
ওকে ।
এই চলো । কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর ঘুরে
দাঁড়ালেন। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা। দিন দশেক পর বাবা মাকে নিয়ে একবার পুলিস চৌকিতে
এসো তোমরা । যে সরকারী পুরস্কার ঘোষণা করা আছে সেটা তোমাদের দেওয়ার ব্যবস্থা করে রাখবো।
ইন্সপেক্টররা
চলে যাওয়ার পর বাবলু বললো, জুগন মনে করে গিয়ে ওটা নিয়ে নিও ।
জুগন
অবাক হয়ে বললো, তোমাদের ভাগ নেবে না?
আমাদের
দরকার নেই ভাই। বাড়ী ফিরে যাওয়ার পথটা খুঁজে পেলেই বাঁচি । অনেক অ্যাডভেঞ্চার হলো
। আমার সব শখ মিটে গেছে ।
ঠিকই বলেছিস । সৌমির কথায় সায় দিলো বাবলু।
জুগন
বললো, আচ্ছা তোমারা এখানে আমাদের সাথে থেকে যেতে পারো না? একসাথে পড়াশোনা খেলাধুলা
করা যাবে।
বাবলু
বললো, হয়তো সেটা করা যায় । কিন্তু বাবা মা , বন্ধু বান্ধব...এদের ছেড়ে ... বুঝতে
পারছো আশা করি...
কিন্তু
ফিরে যাবে কিভাবে তোমরা?
সেটাই
তো এখন লাখ টাকার প্রশ্ন বাবলুদের সামনে। পথ বলতেতো সেই একটাই । আবার সেই সুড়ঙ্গে
ঢোকা। ওটার ভেতর দিয়ে গিয়েই খুঁজে নিতে
হবে একশো বছরের বেশি সময় আগের সেই জগতে ফেরার রাস্তাটাকে।
ওরা
ফিরে এলো জুগনদের বাড়ীতে । সৌমি তুলে নিলো ল্যাসোটা । বাবলু বোতলে ভরে নিলো জল ।
জুগন কয়েকটা রুটি, ডিম সেদ্ধ আর বাকি বিস্কুটগুলো দিয়ে দিলো ওদের।
তারপর বললো , ওই ছোট
গর্ত দিয়ে তোমাদের খনিতে আর ঢোকার দরকার নেই। চলো একটা সোজা পথ দেখিয়ে দিই তোমাদের
ওর ভেতরে যাওয়ার ।
তাহলে
তো ভালোই হয়, বাবলু বললো।
জুগন
পাহাড়ের পাশ দিয়ে ওদের নিয়ে এলো খনিতে ঢোকার একটা গুহা মুখে । তারপর ধরা গলায় বললো, এসো তাহলে ।
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তোমরা যেন বাড়ী ফেরার রাস্তা খুঁজে পাও ।
গুডবাই
জুগন । সৌমি আর বাবলু বিদায় জানালো একই সাথে ।
এবার
খোঁজ সেই পথের। যে পথে গেলে ওরা ফিরে যেতে পারবে ওদের নিজস্ব জগতটায় । ওরা যত
এগোতে লাগলো কমতে থাকলো আলো । বার কয়েক পেছন ফিরে তাকিয়ে দুজনেই দেখেছে জুগন ঠায় দাঁড়িয়ে
আছে । এবার সামনে একটা বাঁক। শেষ বারের মতো হাত নাড়লো ওরা । হাত নাড়ালো জুগনও ।
বাঁকটা
ঘুরতেই নিকষ কালো অন্ধকার ওদের স্বাগত জানালো । বাবলু টর্চটা জ্বালালো । চরম
নিস্তব্ধতা ভেদ করে শোনা যাচ্ছে একটা শব্দ। কোথাও যেন জল পড়ছে টপ টপ করে ফোঁটায়
ফোঁটায় ।
সেই
সুড়ঙ্গটা খুঁজে পাবো কি করে সেটাই
বুঝতে পারছি না, বাব লু বলে উঠতেই
সৌমি উত্তরে বললো,
তবুও এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। একশো বছর আগের এই পৃথিবীতে থাকার
কোন ইচ্ছেই আমার নেই ।
তাহলে
ভেবে কোন লাভ নেই বলছিস?
হ্যাঁ
মা বলেন, বেশি ভাবলে দুশ্চিন্তার জন্ম হয়।
রাস্তাটা
চ্যাটচেটে ধরনের । যেন জল দিয়ে ভেজানো। একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল এবার। সৌমি বললো,
আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবি না বলে দিলাম ।
আমি
আবার তোকে কখন ভয় দেখানোর চেষ্টা করলাম? অবাক হয়ে বললো বাব লু।
তাহলে
শব্দটা কে করলো?
বাবলু
আলোর ফোকাসটা ঘোরালো । ডান পাশের দেওয়ালে একটা গর্ত । দুটো লাল বিন্দু চকচক করে
উঠলো । শরীরটা কালো । মুখের দুপাশে দুটো সাদা কি যেন। আওয়াজটা এবার আরো জোরে স্পষ্ট শোনা গেল। বাবলুর হাত চেপে ধরে সৌমি শুকনো কণ্ঠে বললো, ওটা কি?
যাই
হোক এখানে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। চল শিগগিরি এখান থেকে।
ওরা পা
টিপে টিপে এগোতে থাকলো । এক মুহূর্ত
বাদে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন আর দুপদাপ শব্দ শুরু হল ওদের পেছনে। আড় চোখে তাকালো বাবলু
। টর্চের আলোয় ওর চিনতে অসুবিধা হল না জন্তুটাকে।
জুগন বলেছিল এদের কথা । খনির ভেতরে থাকে ওরা । বুনো শুয়োর ।
সৌমি
দৌড়া ।
বাবলুর
চিৎকারটা শুনে সৌমি দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে শুরু করলো ছুটতে । পিছনে ধেয়ে আসছে
জন্তুটা । পায়ের কাছে পুরোনো টিনের ক্যানেস্তারার
মতো কিছু একটা ঠেকলো বাব লুর। চকিতে থেমে ঝুঁকে ওটা তুলে নিয়ে পেছন দিকে ছুঁড়ে
দিলো শুয়োরটার দিকে। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল জন্তুটা ।
সোজা দৌড়ালে হবে না।
প্রথম যে বাঁকটা পাবো সেদিকেই ঢুকে যেতে হবে। বাবলু বললো ছুটতে ছুটতে ।
পাওয়া
গেল বাঁক। কিন্তু সেই আগের বারের মতো ভাগ্য খারাপ। দেড়শো দুশো পা দৌড়েই থামতে বাধ্য
হল ওরা । সমানে পাথুরে কয়লার দেওয়াল। খননকাজ আর এগোয় নি এরপর ।
ভেসে
এলো ক্রুদ্ধ জন্তুটার ছুটে আসার শব্দ। আচ্ছা নাছোড়বান্দা গোঁয়ার তো জন্তুটা। সৌমির
বলার সুরে রাগ আর হতাশা একসাথে মিশে ছিল । এবার কি ওটার হাতেই আমাদের মরতে হবে ?
নয়
অত
সহজে না! জুগন কি বলেছিল মনে আছে?
কি
বলেছিল?
এরাও
সাপের মতোই একটা জিনিষকে ভয় পায়।
মনে
পড়েছে ,আগুন । কিন্তু জ্বালাবি কি করে ।
দ্রুত
ব্যাগ হাতড়ে দেশলাই বাক্সটা বার করে আনলো বাবলু। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে ওর। প্রথম কাঠিটা হাত থেকে ছিটকে
গেল। সৌমি ভয়ার্ত স্বরে বললো, বাবলু জলদি!
জ্বলে
উঠলো পরের কাঠিটা। ছোট্ট একটা শিখা, তবু জুগনের কথা
মিলে গেল। জোরে জোরে দুবার ঘোঁত ঘোঁত করে নিঃশ্বাস নিয়ে জন্তুটা ছোটা থামাল।
কিন্তু একটা কাঠির আয়ু আর কতক্ষণ ! বাবলু আর একটা কাঠি বার করে ওই আগুনে ঠেকিয়েই
জ্বলালো। শুয়োরটা গর্জন করে উঠলো ।
বুঝতে
অসুবিধা হল না বাবলুর এভাবে ওই বুনোটাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখা
যাবে না। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল ওর। এক সাথে গোটা দশেক কাঠি জ্বালিয়ে ছুঁড়ে
দিলো ওটার দিকে । কয়েক পা পিছিয়ে গেল জন্তুটা চারপাশে আগুন ছিটকে আসতেই। কিন্তু
পালালো না ।
যা হবে
হবে! এরকম একটা মনোভাব নিয়ে বাবলু এবার সবকটা কাঠি একসাথে ধরে আগুন লাগিয়ে হাতটা
সামনের দিকে এগিয়ে হেই হেই করে চিৎকার করে ছূটে গেল সামনের দিকে। কাজ হল এবার ।
মুখ ঘুরিয়ে দৌড় লাগাল শুয়োরটা । পিছু পিছু খানিকটা দৌড়ে গেল বাবলু ঝোঁকের মাথায় ।
হাতে আগুনের তাত লাগতে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ফেলে দিলো কাঠিগুলো । পিছিয়ে এলো সৌমির
কাছে ।
আশা
করছি ও ব্যাটা আর আসবে না।
ফিরে যদি আসে তাহলে আর এক প্যাকেট দেশলাই
জ্বালাতে হবে।
সরি
সৌমি, আর কোনও প্যাকেট নেই।
ওরা
এগিয়ে চললো ফিরতি পথে । আর একটা গুহামুখ দেখা
পাওয়ার আশায় ওরা হাঁটতেই থাকলো । আরো তিন তিনবার ওদের অনেকটা করে হেঁটেও ফিরে
আসতে হয়েছে পাথুরে কয়লার দেওয়ালে গিয়ে পথ
শেষ হয়ে যাওয়ায় । শেষ গুহা মুখটা দিয়ে ঢুকে ওরা অনেকটা সময় হাঁটলো । কিন্তু সেই পথটা
কোথায় যেটা দিয়ে ফিরে যাওয়া যাবে ট্র্যাপডোরটার কাছে ? কোথায় সেই তীর চিহ্ন যা সাজিয়ে রেখেছে বাবলু?
বাবলু
আমরা ফিরে যেতে পারবো তো? নাকি না খেয়েই মরতে হবে ?
শুয়োরেও
মেরে ফেলতে পারে বা খোক্কসে।
ইয়ার্কি
মারছিস?
তা আর
কি করবো বল!
চল
ফিরে যাই?
কোথায়?
জুগনের কাছে।
হুম
তাঈ যেতে হবে মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত। আর তো কোনও উপায় দেখছি না। ওদের সাথেই থাকবো
। ওদের স্কুলে পড়বো । গরু ছাগল চড়াবো । একটু বড় হলে একটা দোকান করবো । পিজজা,
মোমো, চাউমিনের । এখানকার লোক এসব খায়নি । বিক্রি মনে হয় ভালোই হবে।
বুঝলাম
। কিন্তু শুয়োরটার তাড়া খাওয়ার পর এতোক্ষন কোন কোন পথে এলাম সেটা মনে আছে কি?
নাতো...কেন
রে?
মনে
হচ্ছে এবার তোর মাথাটা একেবারেই গেছে । যাকগে ওসব ভুলে যা। এতদুর এসে ফিরে যাওয়ার
চেষ্টা করে লাভ নেই । চল এগোই ।
ওদের
হাঁটা চলতেই থাকলো । এর মধ্যে দুবার ওরা জুগনের দেওয়া খাবার খেয়েছে । বিস্কুটগুলো
খেতে অসুবিধা হয়নি । কিন্তু রুটি চিবাতে চিবাতে ওদের কষে ব্যাথা হয়ে গেছে। তবু না ফেলে ওটাই
গিলে নিলো। যতটা পেটে যায় ততই ভালো । কে জানে আবার কোথায় কখন খাবার জুটবে।
এই
মুহূর্তে ওদের সামনে চার দিকে চারটে গুহার পথ চলে গিয়েছে। বেশ উঁচু জায়গাটা ।
কিছুটা দূরে হাল্কা আলোর আভায় দেখা যাচ্ছে কিছু লম্বাটে ধরনের বাক্স ।
সৌমি
বললো, মনে হচ্ছে আমরা আবার সেই কবরখানাটায় ফিরে এসেছি রে বাবলু!
এবার
আর ভয় নয় কিছুটা আশার আলো জ্বলে উঠলো বাবলুর মনে কথাটা শুনে। মনে হচ্ছে সেই
সুড়ঙ্গটা খুঁজে পেলেও পেতে পারে ওরা। মোটেই একশ বছর আগের সময়টায় ফিরে যেতে চায় না
ও । সৌমি একটু আগে যা বলছিল সেটা যে ওর ও মনের কথা নয় সেটাও বাবলু ভালোই বুঝতে
পারছে।
ওরা
এগিয়ে গেল আলোকিত জায়গাটার দিকে। সৌমির অনুমান ঠিক। এটা সেই কবরখানাটাই । ওই তো খোলা
কফিনটা পড়ে আছে।
বাবলু
ওই আলোর কিন্তু একটাই মানে ?
কি?
আবার
একটা কবর দেওয়া হতে চলেছে।
পুরোনো
অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়তেই বাবলু বললো,
তাহলে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। বলা যায় না ... কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপর থেকে একটা
কফিনবিহীন দেহ নিচে এসে পড়লো ওদের সামনে। টর্চের আলোয় ওটার মুখ দেখে ওরা সত্যি
সত্যিই হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো। জোসেফ ডাকাতের মৃতদেহ । জিভটা সামান্য বেরিয়ে আছে ।
নাকের কাছে গোঁফের ওপর কয়েক ফোঁটা রক্ত লেগে আছে। গলা থেকে ফাঁস দড়িটা খোলা হয়নি
।
বাবলু
বুঝতে পারছিল না এতো তাড়াতাড়ি জোসেফের ফাঁসি হয়ে গেল কি করে? তবে কি সময় এবার সামনের দিকে
এগোচ্ছে?
সৌমি
বললো, বাবলু এও কি মিস্টার জোন্সের মতো ... বলতে না বলতেই নড়ে উঠল দেহটা । খুলে
গেল চোখ। সটান উঠে দাঁড়াল দেহটা। ঘুরলো ওদের দিকে। বাবলু মনে মনে বললো, সর্বনাশ
! আমাদের চিনতে পেরে গেল নাকি? ও কি বুঝতে
পারছে আজ আমাদের জন্যই ওর এই দশা!
রক্তজল
করা হাড় কাঁপানো চিৎকার বের হলো জোসেফের মুখ দিয়ে। যেটা বাবলু আর সৌমিকে বুঝিয়ে দিলো, যঃ পলায়তি
সঃ জীবতি । অর্থাৎ বাঁচতে হলে পালাতে হবে। এছাড়া আর কোন পথ নেই ।
দশ
ওরা
দৌড়ালো বুকে শেষ বিন্দু দম থাকা অবধি। মাঝে মাঝে থামলেই শুনতে পাচ্ছিলো
জোসেফ ডাকাতের অনুসরণের পদধ্বনির শব্দ। জ্যান্ত মরারা কি ক্লান্ত হয় না? এটা ভাবতে
ভাবতে বাবলু বললো, সৌমি আমি আর পারছি না দৌড়াতে!
সৌমিরও একই হাল। তবু
সে জানালো কিচ্ছু করার নেই। পারতে আমাদের হবেই।
আর
পারছি না রে...যা হয় হোক!
যা হয়
হোক মানে! তুই জানিস ওই জোম্বিরা যখন মানুষ কে ধরে তখন কি করে?
না,
বাবলু সত্যিই জানে না। তাই মাথা নাড়লো নেতিবাচক ভাবে।
ওরা
তোর রক্ত চুষে ছিবড়ে বানিয়ে দেবে। তুই তখন ওটার মতোই জোম্বি হয়ে যাবি।
তুই কি
করে জানলি?
সিনেমায়
দেখেছি ।
এবার
পায়ের শব্দ আর হাড় হিম করা চিৎকারটা শোনা গেল খুব কাছেই। আলোটা ঘুরিয়ে ফেলতেই ওরা
দেখতে পেলো জোসেফকে । সাদা ফ্যাকাশে মুখ। অন্ধদের মতো তাকানোর ভঙ্গী। জিভটা বেরিয়ে
আছে । বাবলুর ক্লান্তির ভাবটা হঠাৎ কোথায় যেন এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। সৌমির হাতটা চেপে ধরে
আবার শুরু করলো ছোটা। সৌমিও তাল মেলাতে শুরু করলো ।
কতক্ষণ
ওরা ছুটলো তার হিসাব নেই । এবার সৌমিই বসে পড়লো ধপ করে বাবলুর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ।
নিস্তব্ধ নিথর চারদিক। শুধু ওদের জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
বাবলু
বললো, মনে হচ্ছে ওটার নাগাল পেরিয়ে এসেছি। আর পায়ের আওয়াজ কিন্ত শোনা যাচ্ছে না।
সেটা
হলেই বাঁচি। হাঁফাতে হাঁফাতে কোন মতে সৌমি বললো । শ্বাস নিতে বেচারার খুব কষ্ট
হচ্ছে । কিন্তু না। ভাগ্য মোটেই ভালো নয় ওদের। ভয় ধরানো শব্দটা আবার শোনা যেতে লাগলো একটু দূর
থেকে।
সৌমি
জলের বোতলটা নিয়ে এক ঢোঁক জল খেলো । তারপর বললো, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
কি
বুদ্ধি?
কাঠের
খুঁটিগুলো দিয়েই তো এই ছাদ ঠেকা দেওয়া আছে তাই না?
হ্যাঁ,
তাতে কি হয়েছে?
সৌমি
বাবলুর কথায় উত্তর না দিয়ে উঠে গিয়ে একটা খুঁটি ধরে নাড়াতে শুরু করলো।
আরে! কি করতে চাইছিস তুই? বাবলু জানতে চাইলো ।
মনে
হচ্ছে না খুব একটা শক্ত পোক্ত ভাবে এগুলো আটকানো আছে। আমরা যদি এর একটাকে ফেলে দিতে
পারি তাহলে ছাদটা ধ্বসে গিয়ে জোম্বিটা আটকে যাবে ।
অসাধারন!
কি আমার বুদ্ধি রে ! ছাদটা ধ্বসে গিয়ে জোম্বিটা আটকে যাবে বাবলু ভেংচে উঠলো । ওরে
বুদ্ধিমতী, তার সাথে সাথে আমাদের মাথাটা যে গুঁড়িয়ে যাবে সে খেয়াল আছে?
আছে আছে।
তার জন্যইতো আমার ল্যাসোটা ব্যবহার করবো।
বাবলুর
এবার বুঝতে অসুবিধা হল না সৌমি ঠিক কি করতে চাইছে। যে খুঁটিটা সৌমি নড়াচ্ছিল সেটা ল্যাসোটা
বেঁধে দুজন মিলে শুরু করলো দূর থেকে টানতে । যতটা সহজ ভেবেছিল ওরা কাজটা তা মোটেই
নয়। খানিকক্ষণ বাদে ছাদ থেকে কিছুটা ধুলোবালি খসে পড়তেই ওদের উৎসাহ বেড়ে গেল । আর
কিছুক্ষন টানাটানি করে বাবলু বললো এমন তো হতে পারে ছাদটা ধ্বসে পড়লো কিন্তু ততটা
উঁচু হলোনা যতটা ওকে আটকাতে পারে। তাহলে?
তোর
বাজে ভাবাটা এবার থামা দেখি। সৌমি ঝাঁঝিয়ে উঠলো । সময় নষ্ট না করে কাজটা কর।
খুঁটিটা
একটু একটু নড়ছে দেখে ওরা আর একটু পিছিয়ে গেল। অবশ্য দড়িটা তেমন কিছু বড় ও নয়।
কিছুটা সময় যেতে খুঁটিটা ভালোভাবেই নড়তে শুরু করলো। এবার অপেক্ষা জোসেফের আগমনের ।
ক্রমাগত শব্দটা এগিয়ে আসছে। বাবলু টর্চের
মুখটা রাখলো গুহার সেই দিকে যেদিক থেকে হাড় কাঁপানো শব্দটা আসছে ।
খুব
বেশি অপেক্ষা করতে হলোনা। দেখা গেল মূর্তিমান বিভীষিকাকে । ওরাও তৈরী । খুঁটি থেকে ফুট তিনেক
দূরে এবার জোসেফের জোম্বি । সৌমি চেঁচিয়ে উঠলো, বাবলু! মার টান!
কিছুই
হল না। খুঁটি সরলোনা তার জায়গা থেকে । ছাদটাও ধ্বসে পড়লো না। বাবলুর মনে হলো
খুঁটিটা ছাদে কিছুতে আটকানো আছে।
হাল না
ছেড়ে ওরা আবার টান দিলো গায়ের সব জোর কাজে লাগিয়ে। দুবার... তিনবার ...। আর
তারপরেই ওরা দুজনেই টাল সামলাতে না পেরে পেছনের দিকে পড়ে গেল ...
... একটা
বড় সড় বোমা ফাটার মতো আওয়াজ হলো। ছাদটা ধ্বসে পড়লো ওদের সামনে। গায়ে এসে লাগলো
একটা জোরালো হাওয়ার ধাক্কা । কালো ধুলোর চাদরে ঢেকে গেল টর্চের আলো । ধুলো ঢুকে
গেল ওদের চোখে মুখে।
একসময়
সব শান্ত হলো। বার কতক হেঁচে কেশে ওরাও একটু ধাতস্থ হলো। ঢিব ঢিব করছিল দুজনেরই
বুকের ভেতরটা । মুখের ধুলো ঝেড়ে বাবলু টর্চের কাঁচ মুছে আলো ফেললো সামনের দিকে । দেখা গেল একটা
কালো স্তুপ ওদের সামনে । নিশ্চিত ভাবেই ওটার নিচে চাপা পড়েছে জোসেফের জ্যান্ত
মৃতদেহটা।
সৌমি
বার কতক শূন্যে ঘুষি মেরে লাফিয়ে চেঁচিয়ে বল লো, আমরা পেরেছি । বাবলু বললো, পর পর
দুটো বিপদ থেকে বাঁচলাম আমরা। এবার বাড়ী ফেরার পথটাও নিশ্চয় খুঁজে পাব আমরা, কি
বলিস?
ওটাও
পেয়ে যাব পার্টনার । ডোন্ট ও... বলতে বলতেই উত্তেজনায় কেশে ফেললো সৌমি । বাবলু ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা
বার করে এগিয়ে ধরলো সৌমির দিকে । ওর খাওয়া হলে নিজেও দু ঢোক খেলো বাব লু ...এবং
আবার শুরু হল ওদের চলা ।
এদিকে
খাবার প্রায় শেষ। কয়েকটা বিস্কুট আর অবশিষ্ট আছে। জলও আছে মাত্র কয়েক ঢোঁক । ক্ষিধে আর পরিশ্রমে শরীর আর
চলছে না ওদের ।
বাড়ী
ফিরেই মাকে বলবো, দুটো নুডলসের প্যাকেট রেডি করে দাও । বাবলু বললো ।
একাই
খাবি?
আরে না
রে বাবা । দু প্যাকেট একা খেতে পারি নাকি আমি !
ওরা
ক্লান্ত অবসন্ন পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল। টর্চের আলোর জোর ক্রমশ কমে আসছে ।
একটু পরে হয়তো এক ফুট দূরের জিনিষও আর দেখা যাবে না।
এটার
আয়ূ বোধ হয় শেষ হয়ে এলোরে সৌমি !
সৌমি
বললো, ওটার আর দোষ কি...আমাদের আয়ু আর কতক্ষণ কে জানে...
এগারো
টর্চ
নিভিয়ে ওরা অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো । সৌমি একবার বললো, আমার খুব ভয়
করছে রে বাবলু। ভয় যে বাবলুরও করছে না তা নয় । কিন্তু মুখে প্রকাশ করছিল না। ও
শুধু সৌমিকে সাহস যোগাচ্ছিল।
যে
ভাবেই হোক আমাদের সেই পথটা খুঁজে বার করতে হবেইরে সৌমি । তাড়াহুড়ো না করে
সাবধানে আস্তে আস্তে হাঁট। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে ঝামেলা বাড়বে।
মাঝে
মাঝে একবার করে টর্চটা জ্বালাচ্ছিল । একসময় ওটা আর জ্বললো না। তার মানে চার্জ শেষ
। বাবলুর সব রাগ গিয়ে পড়লো শুয়োরটার ওপর । ওই ব্যাটা তেড়ে না এলে দেশলাই কাঠিগুলো
এখন কত কাজে লাগতো ।
সত্যিই
খনি গুহার অন্ধকার এখন ভীষন তীব্র । অনেক
অনেক বেশী জমাট এবং ঘন । এ অন্ধকার নিজের চোখে না দেখলে কেউ এর ভয়াবহতা বুঝতেই
পারবে না।
বাবলু
তোর ওয়াকম্যানের ব্যাটারী দিয়ে টর্চটা জ্বলানো যাবে না?
না...মাপ
আলাদা । ওসব না ভেবে সাবধানে হাঁট । দেখিস কোন খুঁটিতে আবার ধাক্কা খাস না যেন।
অন্ধকারের
মধ্যে হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে ওরা হাঁটতে শুরু করলো । এভাবে ওরা আগেও হেঁটেছে
কানামাছি খেলার সময়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্য । অজানা জায়গা। কোথায় কি আছে ওরা
কিছুই জানে না। এখন যদি কোনোভাবে ওদের ছবি তোলা যেত তাহলে ওদেরকেই জোম্বি বলে মনে হতো
নির্ঘাত ।
মাঝে
মাঝেই মাকড়শার পুরু জাল ওদের হাতে মুখে জড়িয়ে যাচ্ছিলো ।
সৌমি
বললো, বাবলু, এই ভাবে হাঁটলে সেই সুড়ঙ্গটা কিভাবে খুঁজে পাবো ? এমন তো হতে পারে আমরা ওটাকে পার
হয়েই চলে গেলাম।
ঠিক
... তাই তো এটা তো আমার মাথায় আসেনি । তুই কি করতে চাইছিস?
আমাদের
দুজনের মনে হয় দুপাশের দেওয়াল ধরে হাঁটা উচিত ।
ঠিক
আছে , তাই হোক । তুই বাঁ দিকে যা আমি ডান দিকে যাচ্ছি।
দুজনে
দুপাশের দেওয়াল ছূঁয়ে ছুঁয়ে এগোতে শুরু করলো এবার। কথা বলা থামায়নি । একের থেকে অন্য
জন দূরে চলে যাওয়ার ভয়ে।
বাবলুর
কানে একটা শব্দ ভেসে এলো । আবার কোন খোক্কস নাকিরে বাবা? সৌমি কোনও শব্দ শুনতে
পেলি?
কই নাতো । ওপাশ
থেকে উত্তর দিলো সৌমি ।
বাবলু
বুঝতে পারলো এটা ওর মনের কল্পনা । কিন্তু একটু পরেই কল্পনা বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেল ।
শুধুই শব্দ নয় শব্দকারীদের উপস্থিতিও টের পাওয়া গেল।
বাদুড় ।
সৌমি তোর ভয় করছে না?
না ।
যা যা ঘটে চলেছে তার তুলনায় এটা খুব সাধারন ব্যাপার।
একটু
বসবি নাকি? সৌমি রাজি হলো । বাবলু একটু বাদে জিজ্ঞাসা করলো, কেউ কি আমাদের খোঁজ টোজ নিচ্ছে
বলে তোর মনে হয় ?
নিতেও
পারে । কিন্তু লাভ কি । কেউ তো জানেও না আমরা কি করেছি...কোথায় এসেছি।
হুম
...ঠিকই বলেছিস।
মিনিট
কয়েক বিশ্রাম নিয়ে সৌমি বললো, চল এগোনো যাক।
ওঠার
সময় পকেট থেকে টর্চটা পড়ে গেল বাবলুর। হাতড়ে হাতড়ে সেটা খুঁজতে গিয়ে ওর হাতে ঠেকলো
একটা কয়লার টুকরো । তারপর আরো একটা
...তারপর আর অনেকগুলো । পেয়ে গেল
টর্চটাকেও ।
কাঁপা
কাঁপা গলায় বাবলু চেঁচিয়ে উঠলো, সৌমি পেয়ে গিয়েছি !
কি?
টর্চটা?
খুঁজে
পেয়েছি!
ধুর! কি
খুঁজে পেয়েছিস সেটা বল ।
তীর
চিহ্নটা । কয়লার টুকরো দিয়ে যেটা বানিয়ে ছিলাম।
শুনেই
সৌমি বাবলুর গলার স্বর লক্ষ্য করে একটু একটু করে চলে এলো বাবলুর কাছে। বেশী নড়াচড়া
না করে বাবলুর বুঝতে অসুবিধা হলো না তীরের মুখটা কোন দিকে । কারন মাথাতে একটা বড়
মাপের কয়লা রেখেছিল ও ।
যা
বুঝছি তাতে কিছূটা এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকেই আছে সেই সুড়ঙ্গের মুখটা ।
আন্দাজে
ভুল হয়নি বাবলুর। পাওয়াও গেল পথটাকে।
তাহলে...
সৌমি, আমরা বাড়ী ফিরছি?
কে
জানে?
মানে?
বলা তো
যায় না । সুড়ঙ্গ পথে ওই ঘরটায় পৌঁছানোর পর দেখা গেল আমরা সময় চক্রে পার হতেই পারিনি।
একশো বছর আগেই পড়ে আছি!
উফফফফ!!
তোর মাথায় কি ভালো কথা আসে না। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে যাবে। চল চল এগোই
।
এবার
বাব লু ঢুকল আগে । সেই হামাগুড়ি পদ্ধতিতে পথচলা । কনুই আর হাঁটুর সাহায্যে শরীরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া টেনে
টেনে। পেছনে সৌমি ।
কিছুটা
সময় এভাবে চলার পর ওরা পৌছে গেল সেই মাটির নিচের ঘরটায় । যেখানে মই বেয়ে নেমেছিল
ওরা । ওই তো ওপরের আলোয় দেখা যাচ্ছে মইটাকে । তড়িঘড়ি মচ মচ শব্দ করে বাবলু উঠে গেল
ওপরে। তারপর চেঁচিয়ে উঠলো ...
...ইয়াআআআহ!!
ওয়াশিং মেশিনটা দেখে এতো আনন্দ এর আগে ওর
কোনোদিন হয়নি ।ওটা দেখতে পাওয়ার একটাই অর্থ ওরা ওদের সময়টাতেই ফিরে আসতে
পেরেছে।
সৌমি,
আমার ঠিকঠাক ফিরে এসেছি!
ঘর
থেকে ওরা যখন বাইরে বেরিয়ে এলো ঠিক তখনই অফিস থেকে ফিরে এলেন বাব লুর বাবা। ওদের
দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, এ কি রে! তোদের জামা কাপড়ের এরকম দশা কি করে হলো?
ও কিছু
না বাবা । আসল কথা চেপে রেখে বাবলু বললো, আমরা একটা অভিযান অভিযান খেলা খেলছিলাম।
সৌমি ও সায় দিলো, বললো,
হ্যাঁ কাকু ।
সে
আবার কেমন খেলা রে?
বলে
বোঝানো যাবে না । মাটির ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে ...
বাবলুকে
থামিয়ে সৌমি বললো, সে এক দারুন মজার ব্যাপার স্যাপার!
বাবলুর
বাবা এবার স্বাভাবিক গলায় বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে বুঝলাম। যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নে ।
আমি পিজ্জা নিয়ে এসেছি । সৌমি খেয়ে যেও ।
চলে যেও না ।
বারো
বাবলুরা
কাউকে বলতে পারেনি ওদের সুড়ঙ্গ অভিযানের কথা। চায়ওনি। ওই ভয়ানক জায়গাটার ছোঁয়া ওরা
কাউকে পেতে দিতে চায় নি । তবে জুগনের কথা ওদের খুবই মনে পড়তো ।
ওদের
অভিযানের দিন চারেক পরে সৌমি এলো বাবলুদের বাড়ী।
কিরে
কি খবর, কাকিমা বকেননি তো? বাবলুর গলায় কৌতুক।
আরে না
না ! বলছিলাম একটু যাবি আমার সাথে?
আবার
কোন অভিযান টভিযান নাকি?
তা
বলতে পারিস। একটা জিনিষ খুঁজে দেখবো ।
কতদূর
যেতে হবে?
বেশি
না। তোদের বাড়ী থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হবে খুব বেশি হলে ।
ওরা
যেখানে এলো, সেই জায়গাটা একটা মাঠের মতো । বুক সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা । এটা
সেই পরিত্যক্ত কবরখানা। মাটির তলার জগতটার সাথে যার বিন্দুমাত্র মিল নেই । অনেকগুলো
সমাধি বেদী দেখা যাচ্ছে এদিকে সেদিকে। সবই সময়ের আর আবহাওয়ার মার খেয়ে ক্ষত
বিক্ষত। বড় বড় ঘাস চারদিকে । নিচু পাঁচিল টপকে সৌমি কবরখানার ভেতরে নামলো । অগত্যা
বাবলুকেও সেটাই করতে হল।
এদিক ওদিকের ঘাস
সরিয়ে সৌমি সমাধি ফলকগুলো দেখছিল। বাবলু ভালো বুঝতে পারছে সৌমি কি খুঁজছে ।
কাঙ্খিত ফলক সহ সমাধিটা পাওয়াও গেল। যার ওপরে লেখা ছিল – “ভবিষ্যতের কথা বলতো যে
মানুষটা ...ডাঃ উইলিয়াম জুগন হাঁসদা” । জন্ম সালটা ক্ষয়ে গেলেও মৃত্যুর দিন ও সালটা
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো । ১৫ই
ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৪ ।
সৌমি
বললো দীর্ঘজীবী হয়েছিল জুগন।
হয়েছিল
কিরে বল হয়েছিলেন ! বয়সে বড় না আমাদের চেয়ে।
সেটা ঠিকই বলেছিস কিন্তু সেতো আমাদের বন্ধু তাই
না ?
হ্যাঁ,
এমন এক বন্ধু যে আমাদের কাছ থেকে শোনা অনেক জিনিষই নিজের জীবনকালে বাস্তবায়িত হতে দেখে
গিয়েছিলেন।
সমাপ্ত