Search This Blog

Tuesday, January 30, 2018

স্প্রিং - প্রতিম দাস [সম্পূর্ণ] "হিমায়ন" গল্পের প্রিক্যুয়েল

  
স্প্রিং  
প্রতিম দাস
ইউনাইটেড ক্লাবে বিদ্যাদেবীর আরাধনা হয়, জানি। কারন ওটা আমার ছোট বেলার ক্লাব। এবার হঠাৎই বাবন এসে বললো, “প্রতিমদা মণ্ডপের দায়িত্বটা নাও। একটা নতুন ধরনের কিছু করো তো।”
২০০৭ সালে নরেন ক্ষ্যাপা স্মৃতি মন্দিরে আয়নার দুর্গা প্রতিমা এবং ২০০৮ সালে আইসক্রিম খাওয়ার কাঠের চামচ দিয়ে প্রতিমা বানানোর পর পরিচিতি এসেছে। বললাম,“আমি তো মণ্ডপের কাজ করি না।”
ও বললো, “ওসব জানিনা তুমি ক্লাবের পুরনো মেম্বার। এটা আমাদের আব্দার। দুদিন বাদে সন্ধে বেলায় মিটিং আছে। তো মায় আসতে হবে। সাথেই তোমার পরিকল্পনা কি সেটা নিয়ে আসবে।”
গেলাম দুদিন বাদে। মধ্যে ১৬টা বছর পেরিয়ে গেলেও ক্লাবের কিছুই বদলায়নি প্রায় সবাই একই আছে শুধু নতুন একটা ঘর হয়েছে। ঘরটায় কিছু চেয়ার পাতা। একটা সোফা। বাবন ছিল ঘরে। দেখতে পেয়েই, ভেতরে আসার জন্য ডাকলো। এঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম ভাবনাটা। কিছুক্ষনের মধ্যে আরো ১৪-১৫ জন এসে গেল। দু তিন জন ছাড়া সব নতুন। বুঝিয়ে বললাম ব্যাপারটা কি হবে – পছন্দ হল ওদের। কথা ফাইনাল করে চলে আসছি, দরজায় মুখোমুখী হলাম একজন শীর্ণকায় মানুষের। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগলো। কোথায় যেন দেখেছি?
পেছন থেকে বাবনের গলা শোণা গেল, ‘আরিব্বাস আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে! জিডি এসেছে রে! বসতে দে। প্রতিমদা একটু দাঁড়িয়ো কথা আছে।’
দাঁড়ালাম ঘরের বাইরে ...মাঠে ।
‘বসুন দাদা, ঐ সোফাটাতে বসুন’, ভেতরে কে একজন বললো।
জিডি নামের লোকটির গলার আওয়াজ পেলাম এবার, ‘নতুন আমদানি মনে হচ্ছে। ভেতরে স্প্রিং আছে তো? নারে ওতে বসবো না। ১৯৭৪ সালের পর থেকে স্প্রিং এর কোনো চেয়ারে আর বসি না।’
‘কেন দাদা! স্প্রিং এর চেয়ারে আবার কি হলো?’
‘সে এক কাহিনী। বললে তদের আবার বিশ্বাস হবে না। বলবি গুল মারছি।’
‘না, না আপনি বলুন। তাছাড়া আমাদের বলায় আপনার কি আসে যায়। আপনি তো সত্যি ঘটনাই বলবেন।’
‘তা শুধু মুখে শুনবি? একটু অনুপান না হলে কি আর এসব জমে ভায়া।’
‘আগে এটা তো ধরান, আপনার স্পেশাল ব্র্যান্ড। শ্যামল, ঝালমুড়ি আর চা বলে দে তো মানিকদাকে।’
তোটা শুনেই আবার ভেতরে ঢুকলাম। আসলে একটু লেখালিখির নেশা আছে। যদি কোনো মাল মশলা জুটে যায়
বাবন আমায় দেখতে পেয়ে বললো, ‘আরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়ো।’
বসেই পড়লাম।
জোরে একটা সুখটান মেরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে শুরু করলেন জিডি।
‘সময়টা ১৯৭৪ এর শেষের দিকে। কোম্পানির খরচায় গিয়েছি আয়ারল্যান্ডে। জানিসই তো আমি বিদেশি কোম্পানি ছাড়া চাকরি করিনি কক্ষনো। আমি ছিলাম এক নম্বর সেলসম্যান। তাই বস যখন বললো
– ডস আয়ারল্যান্ডে যাবে নাকি আমার সাথে। জেনারেল মিটিং এ যাচ্ছি। একজন হেল্পিং হ্যান্ড দরকার
সময়টা শীতকাল। আর ওখানে মাইনাসের নিচে ঠাণ্ডা। তবুও নতুন দেশ দেখার সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না।
‘তোমার আয়ারল্যান্ড যাওয়ার সাথে চেয়ারে না বসার কি সম্পর্ক তা তো বুঝতে পারছি না?’ প্রশ্নটা করলো কৌশিক।
‘ধীরে হে অর্বাচীন বালক। সব বলবো। চা মুড়িটা আসতে দাও।’
‘গল্পটা বানাতে একটু সময় দিবিতো জিডিকে নাকি...’, আলটপকা মন্তব্য ছুঁড়ে দিল  আবার একজন। জিডির মধ্যে অবশ্য কোন হেলদোল দেখলাম না। বুঝলাম এ ধরনের মন্তব্যে উনি অভ্যস্ত।
চা মুড়ি পর্ব শেষ করে আরও একটা স্পেশাল ব্র্যান্ড ধরিয়ে জিডি পুনরায় শুরু করলেন –
‘জেনারেল মিটিং এ কি হলো বা কি খেলাম, কোথায় থাকলাম এসব না শুনলেও তোদের চলবে কি বলিস?
কে কোনও উত্তর দিল না।
‘মিটিং শেষের দিন রাতে বস বল লো – ডস চলো কাল আমার জন্মস্থান থেকে ঘুরে আসি।
পরেরদিন সকাল আটটার ট্রেনে চললাম সেই স্থান অভিমুখে। জায়গাটার নাম বলছি না। সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে।
এবার ক্লাব ঘরে বয়ে গেল একটা হাসির রেশ। “একেবারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা!” ব্যঙ্গের সুরে কথাটা  ভেসে গেল জিডির দিকে।
উঠে দাঁড়ালেন জিডি, “আমি চললাম।“
বাবন বললো, “ কল্পনার দিক থেকে সুজয় আসছে। মোড়ের মাথা থেকে কিং সাইজ বেগনি আনতে বলে দিয়েছি
জোঁকের মুখে নুন দেওয়া হল যেন। জিডি ধপ করে বসে পড়লেন।
‘হ্যাঁ কি যেন বলছিলাম। আমার বসের জন্মস্থানটা একটা গ্রাম। অবশ্য সে গ্রাম আমাদের এদোঁ গ্রাম নয়। তখনকার দিনে সেটা প্রায় একটা আমদের মফস্বল শহরের সমান। ওরা বলে কান্ট্রি সাইড। বসের পৈত্রিক সম্পত্তি আর বাস গৃহের দেখাশোণা করেন মিঃ উইল্কিনন্সন নামক এক ৬০এর চেয়ে কিছু বেশি বয়সের মানুষ। নম্র, ভদ্র, শান্ত স্বভাবের এবং গাছপালা ভালবাসেন। বসই বলেছিলেন। কিন্তু ওখানে পৌঁছে যা দেখলাম তাতে সংশয় সৃষ্টি হল মনে। আমাদের দেখে উনি এগিয়ে এলেন বাগানের ফুলগাছ গুলো পায়ে দলে মাড়িয়ে। চোখের মনি দুটো কেমন যেন স্থির। রোবটের মতো আচরনে আমদের স্বাগত জানালেন।
দুপুরের খাওয়া সেরে আমি চারপাশটা ঘুরে দেখার জন্য বের হলাম। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর চোখে পড়লো এক অদ্ভুত ঘটনা। একজন লোককে দুজন চেপে ধরে নিয়ে আসছে, আর লোকটা একভাবে বলে চলেছে- কোনো ভয় নেইরে বাবা। আমি ডুবে যাবো না। আমি জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারি।
এগিয়ে গেলাম কি ব্যাপার জানার জন্য। পাগল নাকি?
 লোক দুজনার সাথে কথা বলে  জানা গেল গত কয়েকদিন ধরে এই গ্রামে বেশ কয়েকজন মানুষ এরকম অদ্ভুত আচরণ করছে । সেই কাজটাই ঐসব মানুষ গুলো করতে চাইছে যা তারা করতে অভ্যস্ত নয় বা করতে চায়ই না। যেমন এই মানুষটা জলাশয়ের কাছে যেতে ভয় পায় অথচ এখন জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে চাইছে।
ফিরে এসে দেখি বস মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করায় বললেন – মিঃ উইলকিনন্সন ওনার সাথে অভব্য আচরণ করেছেন কিছুক্ষণ আগে। যা একদমই আশাতীত।
আমি বললাম – এ গ্রামে সপ্তাহখানেক ধরে এরকম সব ঘটনা ঘটছে। কিছু মানুষ কল্পনায় আনা সম্ভব নয় এমন সব আচরণ করছে। আপনিতো জানেন আমি সাইকোলজির ছাত্র ছিলাম[এখানেও দু চারজন খুক খুক করে কেসে বা হেসে উঠলো] যদি অনুমতি দেন তাহলে ব্যাপারটা একটু...
-      দ্যাখো কি করতে পারো। হাতে তো সময় সাকুল্যে মাত্র তিনটে।
-      সে ক্ষেত্রে আপনার সাহায্য দরকার সবার আগে।
-      কেন?
-      কারন একটাই এখানে কে আমাকে চেনে না।
-      বলো কি করতে হবে?
-      শেরিফ বা গ্রাম প্রধানের সাথে পরিচয় করতে চাই।
-      সে আর এমন কি ব্যাপার। বর্তমান শেরিফ যতদূর জানি আমার চেনা মানুষ।
জোসুয়া রেনল্ড। শেরিফ। বসের শুধু চেনাই নয়, ক্লাস মেট। কথা বলে বুঝলাম উনিও খুব চিন্তিত ঘটনাগুলো নিয়ে। আমি যেচে এ রহস্যের সমাধান করতে চাওয়ায় উনি খুবই খুশি। সাথেই বসের সুপারিশ থাকায় যে কোনো রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন।
প্রথমেই ঐ সব মানুষগুলোর নাম, তাদের বাসস্থান জানতে চাইলাম। বেশি সময় লাগলো না ওগুলো জোগাড় করতে। মোট ৯ জন। ৩ জন মহিলা। ৬ জন পুরুষ। বয়স ২৭ থেকে ৮৪ বছর।
গোটা দিনটা কেটে গেল ঘুরে ঘুরে এদের সাথে এবং এদের বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলে।
ছোট গ্রাম ফলে একে অপরকে চিনলেও কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বা সম্পর্ক ওদের মধ্যে গত ১০-১২ দিনে হয়নি। তার অর্থ এর মধ্যে কোন সংক্রমণ জাতীয় ব্যাপার নেই। তাহলে সূত্রটা কি?
শেরিফের সহযোগিতায় ঐ ৯টা মানুষের চেনা পরিচিত আরও অনেক মানুষের সাথে কথা বললাম। কিন্তু এমন কোনো তথ্য হাতে এলো না যা রহস্যটার সমাধান করতে পারে।
পরের দিনটা ছিল রবিবার। গ্রামের ছোট্ট প্রাচীন চার্চটায় প্রায় সকলেই জমায়েত হয়েছিলেন। আমিও গেছিলাম বসের সাথে। ফাদার জন সারমন পাঠ এবং উপাসনা করালেন। অনুষ্ঠান শেষে  যে যার বাড়ির পথে ফিরে গেলেন। আমিও বেরিয়ে এলাম।  একটি গাড়ি এসে  থামলো। বেশ ঝকঝকে গাড়ি। ভেতরে একজন সুবেশা মহিলা বসে। ফাদার জন বেরিয়ে এলেন চার্চ থেকে। দেখেই  সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একটি ছেলে। খুলে দিল পেছনের দরজামহিলা বেরিয়ে এগিয়ে গেলেন ফাদারের দিকে। ফাদার মাথা নাড়লেন এবং হাঁটা শুরু করলেন চার্চ সংলগ্ন একটি বাড়ির দিকে। মহিলা অনুসরন করলেন ওকে। পরে জানতে পেরেছিলাম ওটা ফাদারের বাসভবন। আমি আর দাঁড়ালাম না।
হাতে আর মাত্র একটা দিন। সমস্যাটার সমাধান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি। সহসাই একটা গাড়ি এসে থামল । সেটা থেকে যিনি নামলেন তার গলাখাঁকাড়ির শব্দেই ঘর থেকে বুঝতে পারলাম শেরিফ মিঃ রেনল্ড এলেন। ঘড়িতে রাত তখন যথেষ্টই।
ডোরবেল বাজার আগেই দরজা খুলে স্বাগত জানালাম।
উনি তার প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললেন- মিঃ ডস, আরো এক জন আক্রান্ত। তবে উনি এই গ্রামের কে নন।  শহর থেকে আগত অতিথি। মিসেস ম্যাকফারসন। আমি চাই আপনি একবার চলুন, এখনি।
দেখেই চিনলাম। সকালে চার্চের সামনে দেখা সেই গাড়িটা। যে বাড়িতে শেরিফ আমাকে নিয়ে এলেন তার সামনেই রাখা আছে । কিন্তু একি দশা! উইন্ড স্ক্রীন, হেড লাইট ভাঙা। সামনের বনেট বেঁকে তুবড়ে চেপ্টে গেছে। সামনের ঘেরা বারান্দায় সকালে দেখা ছেলেটি বসে আছে ।
মাথায় ব্যান্ডেজ। ওই গাড়ির ড্রাইভার।
ওর কাছ থেকে যা জানা গেছে –
সকালে ফাদারের বাড়ি থেকে চলে আসার মিনিট দশেক বাদে চলন্ত গাড়ির মধ্যে মিসেস ম্যাকফারসন অকথ্য গালাগাল দিতে থাকেন ছেলেটিকে, কোনও কারন ছাড়াই। তারপর সহসাই পেছন থেকে ওর গলা টিপে ধরেন উনি। সময় মত ব্রেক কষেও গাছের সাথে ধাক্কা লাগা ও উল্টে যাওয়া আটকাতে পারেনি  সাইমন । ছেলেটির নাম। এরপর  ও আর ম্যাডাম গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে । কিন্তু মিসেস ম্যাকফারসন এর আচরণ বদলায় না। হাতের কাছে যা পান তাই ছূঁড়ে মারতে থাকেন সাইমনকে। একটা পাথরের আঘাতে মাথা ফাটে ওর। কোনও মতে দূরে পালিয়ে গিয়ে লোকজন ডেকে আনে সাইমন। তাদের সাহায্যেই গাড়ি এবং ম্যাডামকে বাড়ি আনা হয়।
বাড়ির ভেতর ঢুকে সেই ঘর টিতে গেলাম যেখানে মিসেস ম্যাকফারসনকে বেঁধে রাখা হয়েছে বিছানার সাথে। না হলে হাতের কাছে যা পাচ্ছেন তাই ছূঁড়ে ছূঁড়ে মারছেন। চোখের মনি দেখলাম এই উপসর্গে আক্রান্তদের মতই স্থির।
গ্রামের একমাত্র ডাক্তারটি উপস্থিত। কি করবেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলে ফিরে এলাম বসের পৈত্রিক বাসভবনে।
মিঃ রেনল্ড বিদায় নেওয়ার পর পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আবার ভাবা শুরু করলাম। ফাদারের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ঘটনাটি ঘটেছে। তাহলে কি ফাদারই কিছু করছেন। সেক্ষেত্রে আগে আমাকে জানতে হবে বাকি আক্রান্তরা সবাই ফাদারের বাড়ি ইতিমধ্যে গিয়েছিলেন কিনা? সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বসকে জানালাম আমার অনুমানটা।
সকালে প্রাতঃরাশ সেরেই ছুটলাম শেরিফের বাড়ি। দেখা হতেই জানালাম - যত দ্রুত পারেন একটা খবর আনার ব্যবস্থা করুন আর ফাদার জনকে ডেকে পাঠান।
-      কি খবর?
-      ফাদারের বাসভবনে আক্রান্তরা সপ্তাহ খানেকের মধ্যে গিয়েছিল কিনা?
-      আপনি কি মাননীয় ফাদারকে এ ব্যাপারে ...
থামিয়ে দিয়ে বললাম – সে উত্তর পরে দেব। আমার হাতে সময় খুব কম। যতটা পারেন জলদি করুন।

এক ঘণ্টার মধ্যেই করিৎকর্মা শেরিফ মিঃ রেনল্ড দুটো কাজই সুসম্পন্ন করলেন। হ্যাঁ আমার অনুমান সঠিক আক্রান্তরা সকলেই ফাদারের বাড়ি গিয়েছিলেন। মানসিক শান্তির আশায়। বিশেষ ধর্ম উপদেশ শুনতে। মনে হচ্ছে জাল গুটিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সমস্যা জটিল হল যখন স্বয়ং ফাদার জনও অকপটে একজন সুখ্রিস্টান নাগরিকের মতো সত্যি কথাই স্বীকার করলেন।
-      হ্যাঁ ওরা সকলেই আমার কাছে এসেছিলেন মানসিক শান্তি লাভের আশায়। আমিও খুবই দুশ্চিন্তায় আছি মাই সন ওদের মানসিক বিকলন বিষয়ে। কবে থেকে এই কাজ করে আসছি এরকমতো কোন দিন হয়নি।
তাহলে কি হচ্ছে এটা??? ভৌতিক কান্ড!! নাহ , এর শেষ দেখে তবে ছাড়বো। প্রয়োজনে এদেশে থাকার মেয়াদ আরও কিছুদিন বাড়ানোর জন্য বসকে বলতে হবে।
-      ফাদার আপনার ব্যক্তিগত উপদেশ দেওয়ার জায়গাটা একবার দেখা যাবে?
-      অবশ্যই মাই সন। ইউ আর অলয়েজ ওয়েল কাম।
-      থ্যাঙ্ক ইউ ফাদার।
মিঃ রেনল্ডকে নিয়ে গেলাম ফাদারের বাসভবনে। ভেতরে দুটি ঘর। তারই একটাতে কাঠের পার্টিশন দিয়ে তৈরি হয়েছে একটা অ্যান্টি চেম্বার। সেখানে একটি ছোট টেবিল পাতা। যার দু দিকে দুটি চেয়ার। একটি কাঠের হাতলবিহীন। আর একটি গদিসহ লোহার। কাঠের চেয়ারের পেছন দিকে একটি ক্রুশ বিদ্ধ যীশুর মাঝারি মাপের মূর্তি। টেবিলের ওপর একটি বাইবেল। পার্টিশনের ওপাশে দরজার ডানদিকে একটা ফায়ারপ্লেস, বেশ বড়ই। যার জ্বলন্ত আগুনের তাপে ঘরটা বেশ আরামদায়ক । আয়ারল্যান্ডের শীত থেকে বাঁচতে এটা খুব দরকার।
না, তেমন কিছু তো নেই এঘরে। তবু কি মনে হতে ফাদারকে  বললাম – ফাদার জন, কিছু অসুবিধা না হলে আপনি একবার আপনার আসনে বসবেন প্লিজ। ঠিক যেভাবে বসে আপনি উপদেশ দেন।
বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে উনি কাঠের চেয়ারটায় বসলেন। এবার মিঃ রেনল্ডকে বললাম – আপনিও যদি অনুগ্রহ করে বিপরীত চেয়ারটায় বসেন।
উনিও অনুরোধ রাখলেন। ফাদারকে বললাম কিছু ধর্ম উপদেশ পাঠ করতে।
প্রায় মিনিট সাতেক ধরে উচ্চনিচ স্বরক্ষেপনে  চললো ফাদারের উপদেশ দান পর্ব। বিভিন্ন দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করেও কিছু হদিশ করতে পারলাম না।
অযথা বিরক্ত ও সময় নষ্ট করার জন্য ফাদারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, আমি আর মিঃ রেনল্ড। ফিরে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইতে গিয়েই চোখে পড়লো পরিবর্তনটা। চোখের মনি স্থির মিঃ রেনল্ডের। এমন ভাবে তাকচ্ছেন যেন আমাকে চেনেনই না। সহসাই রিভলবারটা বার করলেন হোলস্টার থেকে। তাক করলেন আমার দিকে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ। ওহঃ মাই গড!!! “ক্লিক” করেএকটা শব্দ হল। ভাগ্যিস পরিবর্তিত মানুষটা আসল কাজটা , মানে সেফটি ক্যাচ এর লকটা খোলেননি। বেঁচে গেলাম এযাত্রা। শরীরের সব শক্তি দিয়ে ওকে ধাক্কা মেরে ছুটলাম ফাদারের ঘরের দিকে। আমাকে সম্ভবত দেখতে পেয়েছিলেন ফাদার জন। দরজাটা খুলে গেল। ঢুকেই ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে একটা ছবি ভেসে উঠলো মনের পর্দায়—মন দিয়ে উপদেশ শুনছেন মিঃ রেনল্ড। তবেতো আমার অনুমান মনে হচ্ছে এক্ষেত্রেও ভুল নয়।
চেপে ধরলাম ফাদারকে – বলুন কি করছেন আপনি? হিপ্নোটিজম? ধর্ম উপদেশ দেওয়ার ছলে নিরীহ মানুষদের পরিনত করছেন শয়তানে!!
-      প্লিজ বিলিভ মি মাই সন। বাই দ্য সেক অফ দি হোলি স্পিরিট, আমি নির্দোষ। কি করে কি হচ্ছে আমি সত্যিই কিছু জানি না।
তাহলে কেন হচ্ছে এটা? আবারো একটা ছবি ভেসে উঠলো মনে। একটা বিসদৃশতার। দুটো চেয়ার। একটা কাঠের আর একটা লোহার। কেন? দুটোই এক নয় কেন? তবে কি?
-ফাদার দুটো চেয়ার দু রকম জিনিষে তৈরি কেন?
- সপ্তাহখানেক আগেও এক রকমই ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে লোহার চেয়ারটি স্কটল্যান্ড থেকে আমার কাছে এসেছে দিন কুড়ি আগে। ফার্নিচারের দোকান থেকে নতুন করে সাজিয়ে নিয়ে শান্তি কামনায় আসা মানুষদের স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য ওটাকে ওখানে রেখেছি।
- উত্তরাধিকার সূত্রে মানে? কতদিনের পুরনো ওটা?
- সঠিক বয়স কত তা ঠিকঠাক বলতে পারবো না। তবে অন্ততঃ দেড়শ পৌনে দুশো বছরতো হবেই। আমার বাবার তৃতীয় পূর্ব পুরুষ মিঃ লনবার্ন বার্নস্টাইন ছিলেন ওটার মালিক।
- উনি কি করতেন টরতেন আপনার জানা আছে?
- হ্যাঁ। উনি ছিলেন প্যারাসাইকলজিস্ট এবং অ্যালকেমিস্ট। যত দূর জানি এই চেয়ারটা নার চেম্বারে থাকতো রোগীদের চিকিৎসা করার জন্য। আসল তামা দিয়ে তৈরি ওটার স্প্রিংগুলো। ছোটবেলায় যখন গেছিলাম , দেখেছিলাম চেয়ারটার সাথে বেশ কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম যুক্ত ছিল।
লোহার চেয়ার, তামার স্প্রিং, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম!!! প্যারানরম্যাল স্টাডিজ পড়ার সময় পড়ে ছিলাম এরকম চেয়ারের কথা। ইউরোপের মধ্যযুগের আবিষ্কার। চেয়ারে বসিয়ে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো উন্মাদগ্রস্থদের । বেশিক্ষণ এরকম চেয়ারে বসিয়ে রাখলে অবচেতন মনে একটা পরিবর্তন ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা নেতিবাচক হত। আর সেজন্যই এর ব্যবহার করা হত অপরাধীদের ওপর। নেতি নেতি কাটাকূটি হয়ে সদ্গুনের আগমন হবে এটা ভেবে।
সজোরে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। মিঃ রেনল্ড । আগেকার দিনের মজবুত দরজা। আপাতত চিন্তার কিছু নেই  ওদিক থেকে। দ্রুত ভাবতে থাকলাম। কি করা যায়? যা পড়েছিলাম তাতে এর প্রভাব ছাড়াতে সেই যুগে আক্রান্তকে আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়া হত। তাতে অনেকেরই মৃত্যু ও ঘটতো। এটা করা এখানে সম্ভব নয়। তাহলে...
অন্য পথে হাঁটতে হবে। বাঁশ যদি না থাকে বাঁশী তৈরি হবে কি করে ... আইডিয়া... মনে হচ্ছে কাজ হবে ...
-      ফাদার , আপনি কি চান এ সমস্ত আক্রান্তরা পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক?
-      অবশ্যই মাই সন।
-      তাহলে এ চেয়ারটাকে ঐ ফায়ারপ্লেসে ফেলে দিন।
যাকে আমি সন্দেহ করেছিলাম তিনি যে কত সাচ্চা মানুষ তার প্রমান পেলাম। কোনো প্রশ্ন না করে আমার কথা শেষ হতেই এগিয়ে গেলেন চেয়ারটার দিকে। তারপর ইশারা করলেন আমাকে ওটা ধরার জন্য। বেশ ভারী চেয়ারটা। দুজনে মিলে ওটাকে নিয়ে গেলাম ফায়ার প্লেসটার কাছে। তারপর ঠেলে ঢুকিয়ে দিলাম ভেতরে। আগুনের পরিমাণ বড়াতে কয়েক টুকরো কাঠ ও উনি দিলেন ভেতরে। চামড়া পোড়া গন্ধে ভরে গেল ঘর। আগুনের স্পর্শ পাওয়া মাত্র ওদিকে থেমে গেল দরজা ধাক্কানো।
মিনিট দশেক বাদে চামড়া পুড়ে বেড়িয়ে এলো লোহার চেয়ারটার কঙ্কাল। আগুনে লাল টকটকে। আগুন খোঁচানোর শিকটা দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করে চেয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলাম তামার স্প্রিংগুলোকে।
শুনতে পেলাম মিঃ রেনল্ডের গলা।
-      ফাদার! ফাদার! আপনি ঠিক আছেনতো। কিছু একটা পুড়ছে মনে হচ্ছে?

ঐ দিন বিকেলবেলা।
হঠাৎ করেই আক্রান্তরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসায় গ্রামটির সকলেই বেশ স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন।
মিঃ রেনল্ড আর বস ছাড়া কাওকেই বলা হয়নি আসলে কি ঘটেছিলপুরো কৃতিত্বটা ফাদারের প্রার্থনার কারনে ঘটেছে বলেই প্রচার করা হয়েছে।
মিঃ রেনল্ড কি ভাবে যে আমার কাছে ক্ষমা চাইছিলেন সেটা বলে বোঝানো মুশকিলঅনেক কষ্টে বোঝাতে পেরেছি ওর ঐ আচরণের দায় ওনার নয়। আর ফাদার জনতো মনে হচ্ছিল ক্ষমতা থাকলে আমাকে সশরীরে স্বর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।’
কোনও এক দুর্মুখ ক্লাব সদস্য ফোড়ন কাটলো – ভালোই হত উনি ওটা করলে। একরাশ গুলগল্প শুনতে হত না।
জিডি উঠে দাঁড়ালেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন –  ওরে বাবা! সাড়ে দশটা বেজে গেছে!! ভাই বাবন তোমার কিং সাইজ বেগনির লোভে মনে হচ্ছে আজ আমার কপালে মেসের ভাতটা আর জুটল না । চলি।
কাওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উনি হনহনিয়ে হেঁটে গেলেন দরজার দিকে। আমিও পিছু নিলাম এবং পিছু ডাকলাম
-      দাদা একটা কথা ছিল।
হাঁটতে হাঁটতেই মাথা না ঘুরিয়ে উনি বললেন – কি কথা?
-কিছু মনে না করলে আপনার নামটা জানতে পারি?
- নয়া চিড়িয়া মনে হচ্ছে। হুম ... আমার নাম জিডি... ঘনশ্যাম দাস।
শুনেই আমি থমকে গেলাম।
ঘনশ্যাম দাস! ঘনশ্যাম!! মানে ঘনা......দা!!!
এজন্যই এতো চেনা চেনা লাগছিল... আবারো একটা কথা জানার জন্য চিন্তার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে সামনে তাকিয়ে দেখলাম... কে নেই ...

সমাপ্ত।









No comments:

Post a Comment