Search This Blog

Sunday, March 22, 2020

গিলগামেশ কাব্য [গদ্যরুপ] - প্রস্তাবনা ও প্রথম অধ্যায়

গিলগামেশ কাব্য
[গদ্যরুপ]
প্রতিম দাস

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষদিকে আক্কাডিয়ান ভাষায় রচিত হয়েছিল একটি মহাকাব্য । এই প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান পুরাণের অন্যতম প্রধান নায়ক এবং মহাকাব্যের নায়ক গিলগামেশ ।যিনি ছিলেন  সুমেরিয়ান নগর-রাজ্য উরুকের তিহাসিক রাজা। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ থেকে ২৫০০ এর মধ্যে কোনো এক সময়ে রাজত্ব করেছিলেন এই মানুষটি। মারা যাওয়ার পর দেবতার স্তরে উন্নীত হন।  উর তৃতীয় রাজবংশের সময় [২১১২-২০০৪ খ্রিস্টপূর্ব]  কিংবদন্তীর একটি প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন । পাঁচটি প্রাচীন সুমেরীয় কবিতায় গিলগামেশের কিংবদন্তি কীর্তির বিবরণ পাওয়া যায়।
পরবর্তী ব্যাবিলনীয় যুগে, এই কবিতার কাহিনীগুলো  একটি সংযুক্ত আখ্যা্নে পরিণত হয় ।   যে কাব্যের গদ্যরুপ পোস্ট করছি সেই  “এপিক অফ গিলগামেশ”, মধ্য ব্যাবিলনীয় যুগে প্রাচীন তথ্যের ভিত্তিতে লিখেছিলেন সিন-লেকি-উন্নিনি নামের এক চারন কবি  ।    
১৮৪৯ সালে আসুরবানিপাল গ্রন্থাগারে এই মহাকাব্য খুঁজে পাওয়া যায় । ১৮৭০ সালে এর অনুবাদ হয়। হিব্রু বাইবেলের কিছু অংশের সাথে এর মিল খুঁজে পাওয়ার কারণে  ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টিও  হয়েছিল সেই সময়ে। বিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে নতুন করে গবেষক পাঠকদের ভেতর এই বিষয়ে আগ্রহ জন্মায়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এই মহাকাব্য খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রীক ভাষায় রচিত দুই মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসি র উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল।
০০০০০০০০০০০
প্রস্তাবনা
 উরুকের রাজা গিলগামেশ

আসুন আপনাদের গিলগামেশের কথা বলা যাক। উনি কি করেছিলেন না করেছিলেন সেইসব কথা ।  এমন একজন মানুষ যিনি সব কিছু জানতেন ।  গিলগামেশ ছিলেন সেই মহান রাজা যিনি বিশ্বের সমস্ত দেশগুলির কথা জানতেন।  বুদ্ধিমান মানুষটা অনেক রহস্যময় বস্তু ঘটনা দেখেছিলেন এবং অনেক গোপন বিষয় জানতেন। মহাবন্যার আগে  উনি  উপস্থাপিত করেছিলেন এক দীর্ঘ সময়ের গাথা । যে সময়টায় উনি দীর্ঘ ভ্রমণে গিয়েছিলেন সেই সফরের পরিশ্রম তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছিল। ফিরে আসার পর বেশ কিছুদিন  বিশ্রাম নিয়ে  একটি প্রস্তর ফলকে খোদাই করেছিলেন   পুরো কাহিনীটি।
দেবতারা যখন গিলগামেশকে নির্মাণ করেছিলেন তখন তারা তাঁকে একটি নিখুঁত দেহ উপহার দিয়েছিলেনশামাশ, মহিমান্বিত সূর্যদেব তাকে প্রদান করেছিলেন সৌন্দর্যঝড়ের দেবতা আদাদ তাকে দিয়েছিলেন সাহস মহান দেবতারা তাঁর সৌন্দর্যকে নিখুঁত করে তুলেছিলেন, যা অন্য সকলকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলএকইসাথে দুর্দান্ত বন্য ষাঁড়ের মত ভয়ঙ্কর ছিল তার প্রকৃতি ।   
গিলগামেশ  দুই তৃতীয়াংশ ছিলেন দেবতা এবং এক তৃতীয়াংশ মানুষ
উরুকে উনি নির্মাণ করেছিলেন সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা  মহাকাশের দেবতা আনু এবং প্রেমের দেবী ইসথারের জন্য  পবিত্র ইয়ান্না মন্দির বানিয়েছিলেন প্রশস্ত রাজপথ।   আজও সেই মন্দির দেখতে পাওয়া যায়।  সেই প্রাচীরের বাইরের দিকে ছিল টানা কার্নিশ ।  তামা দিয়ে মোড়ানো ছিল সেটাযার উজ্জ্বলতায় চোখ ধাঁধিয়ে যেত। সেই দেওয়ালের ভিতরের সমান আর কোন কিছু ছিলনা এ জগতে। ওটার সুপ্রাচীন চৌকাঠ সাজানো দ্বারটি স্পর্শ করে দেখুন।  ইয়ান্না আমাদের প্রেম ও যুদ্ধের দেবী  ইশথারের বাসস্থান।  এরকম কিছু আর  কোনও পরবর্তী রাজা বা  জীবিত মানুষ নির্মাণ করতে পারেনি।  উরুকের ওই  প্রাচীরের ওপরে উঠুনওর ওপর দিয়ে হেঁটে যান।  পরীক্ষা করে দেখুন ওর ভিত্তি যাচাই করে দেখুন ওর নির্মাণ সৌকর্য। পোড়া ইট দিয়ে কি সুন্দর ভাবেই না বানানো হয়েছিল ।  সাতজন সাধক ঋষি এই ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন
০০০০০০০০০

প্রথম অধ্যায়  
এনকিডুর আগমন

গিলগামেশ বিশ্বের নানা স্থানে গিয়েছিলেন, কিন্তু এমন কারো দেখা পাননি যে তার সাথে টক্কর  দিতে পারে । ঊরুকে আসার পর এরকম কারোর দেখা তিনি পেয়েছিলেন।   
উরুকের মানুষেরা তার আগমনে  বিচলিত হয়ে পড়েছিল। লুকিয়ে পড়েছিল বাড়ির ভেতর।  'গিলগামেশ এসব দেখে বিজয় ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন মহানন্দে। দিন হোক বা রাত কখনোই তার আক্রনাত্বক মনোভাবের বিন্দুমাত্র খামতি দেখা যেত না। তার বীরত্বের দাপটে কোনও ছেলে তার  বাবার আশ্রয়ে লুকিয়ে থাকতে পারেনি । সবাইকে  গিলগামেশ ধরে নিয়ে যান।  এমনকি ছোট বাচ্চারাও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি।  যদিও একজন রাজার আচরণ তার প্রজাদের জন্য   মেষপালকের মতই হওয়া উচিত ছিল। তবু তার লালসা্র হাত থেকে রক্ষা পায়নি কোনও কুমারী । প্রেমিকদের কাছে উনি ছিলেন দুঃখের কারন।  যোদ্ধার কন্যা বা ভালো মানুষের স্ত্রী  কেউ রক্ষা পায়নি তার হাত থেকে। তবুও গিলগামেশকেই  শহরের  সবচেয়ে  জ্ঞানী, সুসমাচার প্রদানকারী, পথ প্রদর্শক এবং দৃঢ় প্রত্যয়ী মানুষ রুপে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।  
দেবতারা শুনতে পেলেন ঊরুকের জনগণের  বিলাপ ।  স্বর্গের দেবতারা ডাক দিলেন  উরুকের প্রধান, উরুকের দেবতা আনুকে । বললেন, “ এসব কি শুনছি। একজন বর্বর ষাঁড়ের মতো শক্তিশালী মানুষ নাকি নির্মাণ করা হয়েছে? কেউই নাকি তার বাহুবলের সামনে দাঁড়াতেই পারেনা।  সে সবাইকেই নিজের বন্দী বানায় । এই কারনে আজ কোনো বাবার কাছে তাদের ছেলে নেই।  এরকম কখন রাজার আচরণ হয়? তার লালসায় কোন প্রেমিক আর তার প্রেমিকাকে কুমারী রূপে পায় না।   যোদ্ধার কন্যা হোক বা অভিজাতর  স্ত্রী সবাইকে সে নাকি ভোগ করে।”
 আনু এইসব কথা শুনে ডেকে পাঠালেন সৃষ্টির দেবীকে, “ হে আরু, তুমিই তাকে নির্মাণ করেছ । অতএব হে দেবী, এবার নির্মাণ কর তার সমকক্ষ কাউকে । এমন কাউকে বানাও যে হবে ঠিক ওর নিজের প্রতিচ্ছবি । ওর দ্বিতীয় সত্তা। এক ঝোড়ো  হাওয়ার বিরুদ্ধে আর এক ঝোড়ো হাওয়া ।  লেগে যাক লড়াই ওদের ভেতর । উরুকের পরিবেশ শান্ত সুখদায়ক হোক । ”
অগত্যা দেবী আরু মনে মনে একটি আকার নির্মাণ করলেন। ব্যবহার করলেন মহাকাশওর দেবতা আনুর উপাদানগুলি।   নিজের হাত জলে ডুবিয়ে কাদামাটি মাখলেন এবং তাই দিয়ে বানালেন মনে মনে দেখা আকারের বাস্তব অবয়ব । তাকে ছেড়ে দিলেন জগতে । এভাবেই জন্ম নিলেন মহান এনকিডু।  তার মধ্যে যুদ্ধ দেবতা নিনুর্তার সব গুন সমাহিত হয়েছিল। দেহত্বক রুক্ষ ।   মহিলাদের মতো লম্বা চুল ।  যা ভুট্টার দেবী নিসাবার চুলের মতো দোলা খেত হাওয়ায়। সম্পূর্ণ দেহ আবৃত ছিল  ঘন রোমে, গবাদি পশুর দেবতা সামুকানের মত। এনকিডূ মানবজাতির বিষয়ে কিছুই জানতেন না। জানতেন না কাকে বলে চাষযোগ্য জমি।   
গ্যাজেল হরিণের সাথে  পাহাড়ের ঘাস আর  বুনো জন্তুদের মতো গর্তে জমা জল খেয়ে ক্ষুধা নিবারন করেছিলেন এনকিডু । বন্যপশুদের মতই জলের ভেতর খেলা করেছেন ওদের সাথেই। সেই জলাশয়ের কাছেই তার সাথে এক ফাঁদ পেতে শিকার ধরত একজন মানুষ। সে এনকিডুকে দেখতে পেল ওখানে শিকার করতে এসে । পর পর তিন দিন তার মুখোমুখি হয় সে। এনকিডুর ওই বিশাল চেহারা দেখে মানুষটা রক্ত ভয়ে জমে গিয়েছিল। সামান্য যা শিকার ধরা পড়েছিল তাই নিয়েই সে তার বাড়িতে ফিরে যায়। আতঙ্কে তার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারন সে দেখেছিল ওই বিশালকায় অবয়বের মুখটায়  দীর্ঘ পথ পার করে আসার ছাপ সুস্পষ্ট । শিকারী মনে মনে আশ্চর্য হয়ে তার পিতাকে বলল, 'বাবা, একজন লোককে দেখতে পেলাম । সম্ভবত  পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী। হয়ত  ওই মানুষ স্বর্গ থেকে নেমে আসা অমরত্বের অধিকারী ।  পাহাড়ের ওপরে বুনো জন্তুদের সাথে মিলে মিশে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে । ধীরে ধীরে সে এগিয়ে আসছে আমাদের জলাশয়ের দিকে। আমাদের এলাকায়।   আমার খুব ভয় করছে।  সাহস হচ্ছে না ওদিকে যাওয়ার।   আমি যে ফাঁদ বানানোর জন্য যে গর্তগুলিতে খনন করি, সেগুলো ওই মানুষটা বুজিয়ে দিচ্ছে। সাহায্য করছে জীব জন্তুদের পালিয়ে যেতে। আমিতো আর শিকার ধরতেই পারছি না। ''
সব কথা শুনে শিকারীর পিতা বললেন, “ হে পুত্র, ভয়ের কিছু নেই। উরুকে আছেন গিলগামেশ । তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করে কেউ কখনও বিজয়ী হয় নি।  তিনি স্বর্গের নক্ষত্রসম শক্তিশালী ।
উরুকে যাও, গিলগামেশের সন্ধান করো । তাকে জানাও,  এই বন্য লোকটির শক্তির গৌরব।  তার কাছে থেকে চেয়ে নাও একজন বহুগামীনী গণিকাকে, যারা থাকে ভালোবাসার মন্দি্রে।   তাকে সাথে ফিরে এসো। সেই নারীকে দায়িত্ব দাও ওই পুরুষকে বশ করার। নারীটিকে জানিয়ে দাও যখন সেই প্রবল শক্তিশালী বন্য পুরুষ তোমার ফাঁদের নিক্টে আসবে সে যেন ওখানে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে অপেক্ষা করে। প্রলোভিত করে তাকে। সুযোগ বুঝে যেন  আলিঙ্গনও করে। এই কাজ সমাধা হলেই বুনো জন্তুরা ওই পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করবে। ”
শিকারি উরুকে্র পথে যাত্রা শুরু করল। সেখানে উপস্থিত হয়ে সে গিলগামেশের সাথে দেখা করে জানাল,  “ আর পাঁচজনের তেকে একেবারে আলাদা রকমের   একজন মানুষ এখন চারণভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে । দেখে মনে হচ্ছে মানুষটা স্বর্গীয় শক্তিতে বলীয়ান।  আমি তাকে নিজের চোখে দেখেছি । তার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছি। সে বন্য পশুদের আমার ফাঁদ থেকে বেঁচে পালিয়ে যেতে সহায়তা করছে।   আমি   গর্ত খুঁড়ে রাখলে সে ভরাট করে দিচ্ছে।   আমার জাল টেনে ছিঁড়ে দিচ্ছে।” তারপর সে জানাল আর পিতা কি বলেছেন।
 গিলগামেশ বললেন, “ ওহে শিকারি তোমার পিতা ঠিকই বলেছেন। নিয়ে যাও একজন ছলনাময়ী নারীকে । ওরা হল আদিম আনন্দের সন্তান । যে মুহূর্ত থেকে সেই পুরুষ নারীকে আলিঙ্গন করবে সেই মুহূর্ত থেকেই বন্য পশুরা আর ওর কাছে ঘেঁষবেনা। ”
শিকারি তার সাথে গিলগামেশে প্রদান করা গণিকাকে নিয়ে ফিরে এল। তিনদিন লেগেছিল ওদের এই যাত্রা পথ পার হতে।  শিকারের   গর্তের কাছে এসে ওরা সেখানে বসল । নির্দেশ মত গণিকা নারীটি সেখানে অপেক্ষা শুরু করল এনকিডুকে প্রলোভিত করার জন্য।  প্রথম দিন একটাও পশু ওই এলাকায় এল না। দ্বিতীয় দিনেও ঘটল একই ঘটনা।  কিন্তু তৃতীয় দিনে পশুর দল এল জল খেতে। তাদের সাথেই এল এনকিডু ।  সমভূমির ছোট ছোট বন্য প্রাণী খুশী মনে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কারন তারা জানতো এনকিডু তাদের সাথে আছে। যে তাদের সাথেই   ঘাস খায়।   
উরুক থেকে আসা নারী দেখতে পেল বর্বর মানুষটাকে । যে  দূরের পাহাড়   থেকে এসেছিল। শিকারি মেয়েটিকে বলল, “ওই সেই পুরুষ। যাও তোমার কাজ শুরু কর। উন্মুক্ত কর তোমার বক্ষদেশ । উন্মুক্ত কর তোমার লোভনীয় শরীর। লজ্জা কিসের। এটাই তো তোমার কাজ। ওকে দেখতে দাও তোমার নগ্নতা । ওকে প্রলোভিত কর। শিখিয়ে দাও আদিম  ভালবাসার শিল্প কলা।  ওকে ধারন কর তোমার শরীরে । ওকে নিয়ে শুয়ে থাক । যখন বুনো পশুরা এটা দেখবে ওরা আর ওর কাছে ঘেঁষবে না।”
 নারী  লজ্জা পায়নি মোটেই। সে নিজেকে করেছিল উন্মুক্ত ।  স্বাগত জানিয়েছিল বিশালকায় পুরুষকে। বাহু বন্ধনে জড়িয়ে তাকে শিখিয়েছিল কাম কলা । ছয় দিন এবং সাত রাত তারা একসাথে শুয়েছিল । এনকিডু বিস্মৃত হয়েছিলেন তার  পাহাড়ের বাসস্থানের কথা।এরপর
যখন তার শরীরের সব চাহিদা মিটে গেল উনি আবার ফিরে গেলেন  বুনো জন্তুদের কাছে । এনকিডূকে দেখেই বন্য প্রাণীরা ভয়ে পালিয়ে গেল ওর কাছ থেকে।    এনকিডু চেষ্টা করলেন ওদের কাছে যাওয়ার কিন্তু পারলেন না। তার শরীর যেন কেউ অদৃশ্য দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল।  তার হাঁটুর সব শক্তি কে যেন কেড়ে নিয়েছিল। অতি দ্রুত চলাফেরা করার শক্তিটাও চলে গিয়েছিল। বন্যপ্রাণীরা সব চলে যেতেই এনকিডু দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন ।  
এনকিডুর মধ্যে ছিল প্রজ্ঞা এবং  মানবসুলভ ​​চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা। তারই সহায়তায় উনি সেই নারীর কাছে ফিরে এলেন। তার পায়ের কাছে বসে মন দিয়ে শুনলেন তার কথা ।
 “ এনকিডু, আপনি জ্ঞানী । আপনি এখন প্রায় দেবতার মতো হয়ে গেছেন। কেন আপনি পাহাড়ের পশুর সাথে বন্য জীবন পালন করছেন? আমার সাথে আসুন । আমি আপনাকে নিয়ে যাব দুর্দান্ত প্রাচীর ঘেরা  হবে উরুক নগরীতে । যেখানে আছে স্বর্গের দেবতা আনু আর প্রেম ও ভালবাসার দেবী ইশতারের  মন্দির ।  সেখানেই আছেন গিলগামেশ । তিনি খুব শক্তিশালী এবং বুনো ষাঁড়ের মতো তিনি মানুষদের নিয়ন্ত্রন করেন। ”
এসব কথা শুনে এনকিডু খুব খুশী হল । সে একজন সাথী চাইছিল । যে তার মনের কথা বুঝতে পারবে। এনকিডু বলল, “হে নারী, আমাকে  সেই পবিত্র মন্দিরে নিয়ে চলুন। যা  আনু এবং ইশতারের বাসস্থান । সেই স্থানে নিয়ে চলুন যেখানে গিলগামেশ মানুষদের উপরে অত্যাচার করে।  আমি তাকে দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান জানাব।   আমি উরুকে উপস্থিত হয়ে নিজের সাহসের পরিচয় দিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করে জানিয়ে দেব, ‘আমিই এখন সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষ । আমি এসেছি  পুরানো সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার জন্য। আমিই সেই যে পাহাড়ে জন্মগ্রহণ করেছে।’ "
নারী বলল, 'চলুন, আপনার সাথে তার সাক্ষাৎ করিয়ে দিই।  গিলগামেশ উরুকের কোথায় থাকে,  আমি খুব ভাল করেই জানি । হে এনকিডু, সেখানে সবাই  তাদের সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে্রথাকে, সেখানে প্রতিদিনই ছুটির দিন । সেখানকার যুবক যুবতীরা  দেখতে অতি সুন্দর। তাদের গা থেকে পাওয়া যায়  মিষ্টি গন্ধ! সেখানকার সমস্ত অভিজাতরা   বিছানায় শয়ন করেন  । হে এনকিডু, আপনি সেই মানুষ যে জীবনকে ভালবা্সে । আমি  আপনাকে গিলগামেশের সামনে হাজির করবো । সে এক অদ্ভুত মেজাজের মানুষ ।  আপনি তার দিকে ভালভাবে তাকালে দেখতে পাবে তার উজ্জ্বল পুরুষত্ব। তার শরীর শক্তি এবং পরিপক্কতায় নিখুঁত ।  সে কখনই  দিনে বা রাতে বিশ্রাম নেয় না । সে আপনার চেয়েও শক্তিশালী । সুতরাং  আপনি আপনার অহংকার ত্যাগ করুন। গৌরবময় সূর্য শামাশ গিলগামেশকে পছন্দ করেন।   আকাশের দেবতা আনু, এনলিল এবং জ্ঞানী এয়া অনুগ্রহ করে তাকে প্রদান করেছেন   গভীরতম বোঝাপড়ার শক্তি।   আমি আপনাকে বলছি, জেনে রাখুন এই বন্যপ্রান্তর ছেড়ে আপনি চলে যাওয়ার আগেই গিলগামেশ স্বপ্নেই জেনে যাবেন  যে আপনি আসছেন।”
অন্যদিকে তখন গিলগামেশ তার মা জ্ঞানী নিন্সানকে তাঁর স্বপ্নের কথা বলার জন্য উঠে বসলেন। 'মা, গত রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।   তরুণ বীর যোদ্ধারা আমাকে ঘিরে আনন্দে মেতে ঊঠেছে। আমিও ওদের সাথে আনন্দ করছি।  এরপর রাতের বেলায় আমি  সারা বিশ্ব জুড়ে অবস্থান করা মহাকাশের তারাদের নীচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম । সহসা আকাশ থেকে আনুর একটি সামগ্রী  উল্কার মতো স্বর্গ থেকে নিচে এসে পড়ল। আমি ওটাকে উত্তোলনের চেষ্টা করেছি্লাম। কিন্তু ওটা খুব ভারী ছিল।  উরুকের সমস্ত মানুষ জমায়েত হয়েছিল ওটা দেখার জন্য। সাধারণ মানুষ এতে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিল এবং অভিজাতরা ওটার গায়ে চুম্বন করছিল।  আমার কাছে ওটার আকর্ষণ ছিল নারীদের ভালবাসার মতো। ওখানে উপস্থিত মানুষেরাই আমাকে সহায়তা করল ওটাকে বয়ে আনার জন্য।  ওটাকে আমি উঠিয়ে নিয়ে এলাম তোমার কাছে। যা দেখে তুমি বললে, ওটা আমার ভাই। ''
তখন নিন্সান,  যিনি সবার খুব প্রিয় এবং জ্ঞানী, গিলগামেশকে বললেন, 'ওই স্বর্গীয় তারকা্র টুকরো যা আকাশ থেকে উল্কার মতো নেমে এসেছিল; যাকে তুমি  উত্তোলনের চেষ্টা করেছিলে, কিন্তু খুব ভারী বলে সেটা একা পারোনি ।  তারপর ওটাকে আমার কাছে  নিয়ে এসেছ । আসলে আমিই ওটাকে চালক দন্ডের মত নির্মাণ করেছি। যা তোমাকে নারীর মতো আকর্ষণ করেছে । এই সেই শক্তিশালী বন্ধু, যে প্রয়োজনে তার বন্ধুকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সমস্ত বন্য প্রাণীদের মধ্যে ও সবচেয়ে শক্তিশালী। ও আনুর উপাদান। বনভূমিতে ওর  জন্ম । তৃণভূমি ওর বিচরণ ক্ষেত্র। পাহাড় তাকে লালন-পালন করে । তুমি যখন ওর দেখা পাবে তোমার মনে আনন্দ জাগ্রত হবে । একজন  নারীর মতোই তাকে  ভালবাসবে তুমি । সে  তোমাকে কখনই ত্যাগ করবে না। এটাই স্বপ্নের অর্থ। ”
গিলগামেশ বললেন, “মা, আমি  আরো একটা স্বপ্ন দেখেছি।  
শক্তিশালী প্রাচীরযুক্ত উরুকের রাজপথে  একটি কুড়ুল রাখা আছে । আকৃতি অদ্ভুত এবং মানুষ তার চারপাশে জমাইয়েত হয়েছে। ওটাকে দেখে আমার মনে আনন্দ সঞ্চারিত হল।  নিচু হতেই, ওটার দিক থেকে গভীরভাবে একটা টান অনুভব করলাম।  আমি ওটার প্রতিও নারীর মত ভালবাসা অনুভব করলাম এবং কোমরে ঝুলিয়ে নিলাম।”
নিন্সান  জবাব দিলেন, সেই কুড়ুল, যা তুমি দেখেছ, যা তোমাকে ওইভাবে একজন নারীর     ভালবাসার মতো আকর্ষণ করেছিল তা আমারই পাঠানো সাথী ।  সে স্বর্গের আর এক সাথীর মত শক্তি সহযোগেই  আসবে। সেই সাহসী বন্ধু প্রয়োজনে তার বন্ধুকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। “
 গিলগামেশ তার মাকে বললেন, 'একজন বন্ধু ও পরামর্শদাতা, এনলিল  আমার কাছে এসেছেন।  আমি তাহলে উনার সাথে বন্ধুত্ব করব এবং তার পরামর্শ গ্রহণ করব।”  
গিলগামেশ ঠিক যেভাবে তার স্বপ্নর কথা বলেছিলেন, সেভাবেই সেই গণিকা নারী এনকিডুকে সেই স্বপ্নের বিবরণ শোনাল ।
এবার  সে এনকিডুকে বলল, 'আমি যখন আপনাকে দেখি আপনাকে দেখে  দেবতা বলেই মনে হয়েছে আমার।  কেন আপনি পাহাড়ের বুনোপশুদের এলাকায়  আবার ফিরে যেতে চাইছেন ? মাটিতে শুচ্ছেন কেন,  ওখান থেকে উঠে পড়ুন। এতো রাখালের শয্যা ।”
এন কিডু মন দিয়ে  নারীর কথা শুনেছিল। তার এই পরামর্শ ভাল  বলে মনে হয়েছিল।  গণিকা নারী নিজের পোশাক ছিঁড়ে দু'ভাগে ভাগ করে। তারপর একটা অংশ পড়িয়ে দেয় এনকিডুকে । বাকিটা জড়িয়ে নেন নিজের শরীরে। তারপর  তার হাত ধরে একটি শিশুর মতো নারীটি তাকে মেষপালকদের তাঁবুর নিয়ে গেল । সমস্ত মেষপালকরা তাকে দেখতে চারদিকে ভিড় করেছিল । ওরা এন কিডুকে রুটি খেতে দিল।   কিন্তু এনকিডু কেবল বন্য প্রাণীর দুধ চুষে খেতে জানতেন।   কী করতে হবে বা কীভাবে তার রুটি খাওয়া উচিত এন কিডু বুঝতে পারছিল না। কড়া মদ ক্কী বস্তু সেটাও তার জানা ছিলনা।  তখন নারীটি তাকে বুঝিয়ে বলল, “এনকিডু,  আপনি রুটিটা এই ভাবে খেয়ে নিন । আর এই মদটাও চুমুক দিয়ে পান করুন। এটাই এই দেশের রীতি।”
নারীর কথা মেনে এনকিডু পেট ভরে রুটি সাত পাত্র মদ পান করলেন। যার প্রভাবে  তার মনে আনন্দের সঞ্চার হল।  হৃদয় ভরে উঠল খুশীতে।  মুখে দেখা গেল তার প্রকাশ। তার গোটা শরীরের রুক্ষ রোমরাজিতে এবার তৈল সিঞ্চন করা হল। এনকিডুকে এবার একজন মানূষের মতই দেখাচ্ছিল।  এরপর যখন তাকে ভাল পোশাক পড়ানো হল তখন দেখে মনে হচ্ছিল রাজপুত্র । উনি চেয়ে নিলেন অস্ত্র, সিংহ শিকার করার জন্য । যাতে রাখালরা রাতে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারে। এক এক করে উনি অনেক  নেকড়ে এবং সিংহ শিকার করলেন। মেষপালকরা শান্তিতে শুয়ে রইল; কারণ এনকিডু ছিলেন তাদের পাহারার দায়িত্বে। এমন এক শক্তিশালী মানুষ যার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।
  মেষপালকদের সাথে তার দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিল ।  একদিন সহসাই এনকিডু দেখতে পেলেন একটি মানুষ দূর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। উনি গণিকা নারীটিকে বললেন, “ হে নারী, আপনি দেখুন তো ওই লোকটি কোথায় চলেছে? আমি ওর পরিচয় জানতে ইচ্ছুক।
তার কথা মত নারী জানতে চাইল, “ ওহে আগন্তুক, এরকম উদভ্রান্তের মত আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?
  লোকটি এনকিডুর দিকে তাকিয়ে বলল, “গিলগামেশ  বিবাহ উৎসব এর আয়োজন দেখলেই   নগরবাসীর রাস্তায় বেড়ানো নিষিদ্ধ করে দিচ্ছেন।  অসাধারন রাজপথের  নগর উরুকে উনি  অদ্ভুত সব কাজ করছেন।  রাজা গিলগামেশ নিজের রানির সাথে বিবাহ উৎসব উদযাপন করতে চলেছেন । তাতে অসুবিধা নেই । কিন্তু উনি চাইছেন নগরের সমস্ত সদ্য বিবাহিত কন্যাকে আগে রাজার শয্যাশায়ী হতে হবে । তার পর তার স্বামী অধিকার পাবেন। কারণ তার জন্ম হয়েছে দেবতাদের দ্বারা। এটা তার অধিকার। তার ইচ্ছাতেই সব কিছু সম্পন্ন হবে। এসবের ঘোষণা শুনে  গোটা নগরের মানুষ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে, আর্তনাদ করছে।”
এই সব  কথা শুনে এনকিডুর মুখ ফ্যাকাশে  হয়ে গেল। “আমি যেখানে যাব সেখানে
গিলগামেশ   জনগণকে এভাবে অত্যাচার করে।  আমি তাকে আহ্বান জানাব লড়াইয়ের জন্য।    চিৎকার করে বলব, হে উরুক অধিবাসী গন, আমি পুরানো রীতিনীতি পরিবর্তন করতে এসেছি ।  কারণ আমার চেয়ে বেশি  শক্তিশালী আর কেউ নেই।  "
বলেই এনকিডু হাঁটতে শুরু করল। সেই গণিকা নারী তার পিছু পিছু চলল।  এন কিডু প্রবেশ করলেন উরুকে । বিশাল  বাজার দেখতে পেলেন আগন্তুক। চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে । উনি উপস্থিত হলেন শক্তিপোক্ত প্রাচীরযুক্ত উরুকের রাজপথে। এন কিডুকে দেখে  লোকেরা হাসাহাসি করল ।   কয়েকজন  বলল, “এতো  গিলগামেশের হাতে খেলনা। আকারে খাটো।” “আকারে গিলগামেশ অনেক অনেক বিশাল কায়। "
একজন বলল, “এতো সেই মানুষ যে বন্য জন্তুদের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে।” তাকে সায় দিয়ে আরেক জন বলল, “তাদের কারনেই ইনি সর্বশক্তিমান। ”
কিছু মানুষ  আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, “এবার  গিলগামেশ তার সমকক্ষ যোদ্ধার মুখোমুখি হবেন।    এই মহান নায়কের   সৌন্দর্য দেবতার মতো। হ্যাঁ, ইনিই  গিলগামেশের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। '
উরুকে সাজানো হয়েছিল বিবাহবাসর। নির্মিত হয়েছিল প্রেমের দেবীর জন্য উপযুক্ত শয্যা।    । কনে অপেক্ষা করছিল তার দয়িতের জন্য । অনেক রাতে গিলগামেশ সেখানে যাওয়ার জন্য রওনা দিলেন। এই পথেই তার মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এনকিডু।  চওড়া রাজপথ ধরে এগিয়ে তিনি  দাঁড়িয়ে থাকলেন ভবনে প্রবেশের প্রধান দ্বারের সামনে ।  শক্তিশালী গিলগামেশ দেখা পেলেন এনকিডুর। গিলগামেশ ভবনে প্রবেশ করার জন্য পা বাড়াতেই তাকে বাধা দিলেন এনকিডু। শুরু হল দ্বন্দ্বযুদ্ধ।   একে অপরকে মদমত্ত ষাঁড়ের মতো চেপে ধরলেন তারা। তাদের ধাক্কায় ভেঙে গেল দরজার চৌকাঠ। কেঁপে উঠল দেওয়াল।  অসংখ্য লড়াই জয়ী অভিজ্ঞ গিলগামেশ তার  হাঁটু ভাঁজ করে বসে নিপুন দক্ষতায় এনকিডুকে চেপে ধরে এক ঝটকায় শূন্যে উঠিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন দূরে। সাথে সাথেই তার ক্রোধ অবদমিত হল। 
নিক্ষিপ্ত এনকিডু  গিলগামেশকে বললেন, “ বিশ্বাস করলাম যে, আপনার মত এ বিশ্বে দ্বিতীয় আর কেউ নেই। আপনার মা নিন্সান, সত্যিই এক বুনো ষাঁড়ের মতো শক্তিশালী সন্তানের জন্ম দিয়েছেন । আপনি সত্যিই বাকি সমস্ত লোকেদের থেকে অনেক বেশী ক্ষমতার অধিকারী । আপনার বাহুবল মানুষের শক্তির সীমানা পার করে অবস্থান করে । আর এই জন্যই  এনলিল আপনাকে দিয়েছেন রাজত্বর অধিকার। আপনাকে অভিবাদন।  ”
এই কথা শুনে গিলগামেশ নিজে এগিয়ে গিয়ে এনকিডুকে আলিঙ্গন করলেন । তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব  স্থাপিত হল।   
০০০০০০০
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত

২য় অধ্যায় লিঙ্ক
https://amarkolponarjogot.blogspot.com/2020/04/blog-post.html

Friday, March 13, 2020

ড্রাকুলা আনঅফিশিয়াল নন-কমার্শিয়াল বাংলা অনুবাদ প্রতিম দাস

স্যাডল ব্যাক ইলাস্ট্রেটেড ক্ল্যাসিক্স
ড্রাকুলা
আনঅফিশিয়াল নন-কমার্শিয়াল বাংলা অনুবাদ
প্রতিম দাস