Search This Blog

Thursday, June 29, 2017

নেই...... তবু ছিল - প্রতিম দাস[অশরীরী কাহিনী]

নেই...... তবু ছিল
প্রতিম দাস
[ধন্যবাদ অ্যালিবাই পত্রিকা সম্পাদক ও টিম... ছবি-অ্যালিবাই পত্রিকা]


নেই...... তবু ছিল
প্রতিম দাস

চাপা আওয়াজটার কারনেই ক্যাম্বারটন বুঝতে পারলো ওকে কোন টেলিফোনের রিসিভারটা ওঠাতে হবে। তবুও   মনে দোনোমোনো ভাব। এরকম সময়ে এই গোপন লাইনটায় কে ফোন করতে পারে ?
আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মাত্র ছজন মক্কেল জানে এই নাম্বারটা। যার মধ্যে দুজন একটু আগেই এখান থেকে বিদায় নিয়েছে । দুজন এখন ইউরোপে আর একজন জেলে। ষষ্ঠ জন, বারকে হটিন । কিন্তু সে তো মারা গেছে ।
চাপা আওয়াজে আবার বেজে উঠলো টেলিফোনটা। মাংসল হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা উঠালো ক্যাম্বারটন। কোনও সাড়া নেই ও প্রান্ত থেকে । ক্যাম্বারটন নিজে কখনো এই নাম্বারে আগে কথা বলে না। যারা এই নাম্বার জানে তারা একটা সঙ্কেত শব্দও জানে । যেটা শুনতে পেলে তবেই ক্যাম্বারটন কথা বলে।
শোনা গেল শব্দটা – ‘রেফারেন্স রুমকন্ঠস্বর অচেনা, একটু কাঁপাকাঁপা ধরনের।
গোল ময়দার তালের মতো ভাবলেশহীন মুখোসের মত মুখ আর সন্দেহের চাপে পুঁতির মতো ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখে ক্যাম্বারটন কর্কশ স্বরে বললো, ‘কে আপনি?’
‘হটিনের একজন বন্ধু,’ অচেনাস্বর ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ওই আমাকে নাম্বারটা দিয়েছে। বলেছে ফোন করতে যদি... যদি আমি কোন সমস্যায় পড়ি তাহলে ।’
‘আপনার নাম?’
‘স্মিথ। জন স্মি –‘
‘খুবই অচেনা নাম,’ ক্যাম্বারটন অবজ্ঞার স্বরে বললো , ‘আমি আগে কোন দিন শুনিনি । আপনাকে চিনি বলেওতো মনে হচ্ছে না ।’
‘অত চিন্তার কিছু নেই। আপনি আমাকে দেখলেই চিনতে পারবেন।’
‘আপনার সাথে দেখা করবোই বা কেন?’
‘কারন আপনার কাছ থেকে আইনানুগ সাহায্য নেওয়ার জন্য আমি প্রচুর অর্থ দিতে রাজি আছি । আপনি এখন একা আছেন তো?’
‘হ্যাঁ তা আছি,’ ক্যাম্বারটনের উত্তর দেওয়ার ভঙ্গীতে পাত্তা না দেওয়ার ছোঁয়া থাকলেও কুতকুতে চোখ দুটোতে লোভের আগুন জ্বলজ্বল করে উঠলো ।
‘আপনি জানে আমার এখানে কিভাবে আসতে হবে?’
‘আমি আপনার বিষয়ে সব কিছুই জানি যা হটিন জানতো। আমি পিছনের দরজা দিয়েই আসবো – যেমন – ঠিক যেমন ও যেতো আপনার কাছে প্রত্যেকবার। আমি দশ মিনিটের মধ্যেই আসছি আপনার কাছে।’

হোরেস এল ক্যাম্বারটন, অন্য মানুষরা যে চোখেই ওকে দেখুক না কেন একজন ক্রিমিন্যাল লইয়ার, রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো । চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আবার তাকালো খবরের কাগজের সেই লেখাটার দিকে যেটা ও পড়ছিল ফোনটা আসার আগে। খবর অনুযায়ী, আজ সকালে চিকাগোর দক্ষিন পশ্চিম শহরতলী উইলো রিজের ফার্স্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাঙ্কে ডাকাতি করতে গিয়ে বারকে হটিন আর তার দুই সহযোগী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। হটিনের মৃতদেহ পুলিস শনাক্ত করেছে । বাকি দুজন নেহাত ছুটকো অপরাধী। নাম এখনো জানা যায় নি।
ক্যাম্বারটনের দুঃখ হচ্ছিল খবরটা পড়ে, কারন ওর রোজগার একটু কমে গেল। হটিন পয়সাকড়ির ব্যাপারে একেবারে মুক্ত হস্ত মক্কেল ছিল । অবশ্য গত বছরে একদিনের জন্যেও ওর কাছে কোন পরামর্শ নিতে আসেনিতবে আসতেই হতো দুদিন আগে বা পরে যদি গুলিতে খতম না হয়ে যেত।
ক্রিমিন্যাল লইয়ার ভাবছিলো যে লোকটা  ফোন করেছিল সে হয়তো হটিনের ফাঁকা স্থানটা পূর্ণ করতে পারবে। অবশ্য এতোটা নিশ্চিত হওয়াও ঠিক না। তার চেয়ে যে আসছে তারজন্য সব রকম ভাবে তৈরী থাকাই ভালো।
লাইব্রেরীর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা গুলি ভর্তি রিভলবার ঢুকিয়ে নিলো কোটের ডানদিকের পকেটে। এবার গেল শোবার ঘরে এবং গুপ্ত আলমারীর টপ ড্রয়ারটা খুলে একটা গুলিভরা পিস্তল নিয়ে রেখে দিল বাঁ পকেটে।
তারপর ধীরে সুস্থে ফিরে এলো ক্লার্ক স্ট্রীটের পূর্ব দিকে ডাইভারসী পার্কওয়ের বহুতল বিশিষ্ট মালিকানা ভিত্তিক অ্যাভন আর্মস হোটেলের ঘরে। এই জায়গাটা যত গুন্ডা, ঠকবাজ, জালিয়াত এবং আড়ম্বরওয়ালা বদমাইসদের বাসা । যেখানে প্রায় সব সময়েই চলছে একে অপরকে ঠকানোর পালা  তবু এই পরিবেশেই নিজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ক্যাম্বারটন। এই মুহূর্তে ওর মনে একটা উৎকণ্ঠার ঝড়।  নিশাকালে আগত কোন এক অচেনা আগন্তুকের অপেক্ষায় এবং আগামী সমস্যার আশঙ্কায় এতটা উতলা ও আগে কখনো বোধ করেনি।
ডাক শুনে অতিথির একেবারে কাছে গিয়ে দরজা খুলবে না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যাম্বারটন দরজার ছিটকিনি খুলে ভেজিয়ে রেখে দিল। ফিরে এসে দরজার দিকে মুখ করে বসলো একটা এমন চেয়ারে যেটার পেছনটায় হেলান দিলে কাত হয়ে যায় না। দু হাত দুপকেটে আগ্নেয়াস্ত্রর ওপর।
“এবারে,” ক্যাম্বারটন ভাবলো, “যদি তোমার হালচাল আমার ভালো না লাগে মিঃ স্মিথ, অথবা তুমি যেই হও না কেন আর যাই হও না কেন, ওইখান থেকেই ফিরে যেতে বাধ্য করবো । আমার ওপর আঘাতের কোন সুযোগই তোমায় দেবো না।”

প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো একটা টোকা পড়লো দরজায়। যার জবাবে বোমা ফাটার মতো চেঁচিয়ে উঠলো ক্যাম্বারটন।
‘কাম ইন!’
নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা। পেশিবহুল চেহারা চওড়া কাঁধ, গায়ে জ্যাকেট একটি মানুষ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। ডান হাতটা পকেটে ঢোকানো। যা মনে হচ্ছে তাতে লোকটিও একটা আগ্নেয়াস্ত্র ধরে আছে ওখানে। অন্য হাতে কপালের ওপর থেকে টুপির কানাতটা  ওঠালো।
ক্যাম্বারটন বলে উঠলো, ‘ডারন্যাক!’ এই মানুষের নাম ভুল হওয়ার কোনো কারনই নেই। প্রায় প্রত্যেক দিনের কাগজে এর ছবি প্রকাশিত হয়। অ্যান্টন( টনি) ডারন্যাক। আমেরিকার এক নাম্বারের গনশত্রু।
‘ও! আপনি তাহলে আমায় চেনেন দেখছি,’ ঘোঁতঘোঁতে স্বরে বললো আগ ন্তুক। কথা বলার সময় চোয়াল নড়লো বেশ ভালো ভাবেই। ‘তাহলে তো এটাও জানেন আমার ধরতে পারলে ২৫ হাজার ডলার পুরষ্কার পাওয়া যাবে । কিন্তু –’ পকেটে স্থিত হাতটা নড়ে উঠলো। ‘ সেটা পাওয়ার ভাবনা মাথাতেও আনবেন না। বদলে আমি আপনাকে ওর দ্বিগুন – অবশ্য যদি আমার হয়ে কাজ করেন।’
থলথলে লোভী মুখটা চকচক করে ঊঠলো ক্যাম্বারটনের, যেটা আসলে ওর মানসিকতা অনুসারে আন্তরিক হাসির প্রকাশ। ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আসুন তাহলে, আমরা বন্ধুত্বে পথে হাঁটা শুরু করি।’
ডারন্যাক ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা এনে আইনজীবীর হাতটাকে নিজের থাবার মতো হাতে চেপে ধরলো। ‘ওকে। বেশ তাই হোক। আজ থেকে তুমিই আমার মুখপত্র । আর আমি মনে করি এবং চাই যে সে কাজটা তুমি ভালো মানুষের মতোই করবে।’
‘আমার মনে হয় আপাতত একপাত্র দরকার তোমার ।’
মুখোমুখী বসলো দুজনে। শুরু হলো কথোপকথন বা এটাই বলা ভালো যে একটানা কথা বলে চললো ডারন্যাক আর শ্রোতার ভূমিকায় ক্যাম্বারটন। সাথেই একের পর এক পাত্র পূর্ণ করে এগিয়ে দিতে থাকলো অতিথিকে। ক্যাম্বারটন এই পদ্ধতিটায় অভ্যস্ত। এ এক এমন পদ্ধতি যার সাহায্যে নিজের গোপন টেলিফোনের মক্কেলদের অনেক গোপন কথা ও সহজেই জানতে পারে।
পালিয়ে বেড়ানো ডারন্যাক ঊকিলের কাছে নিজের সব সমস্যার কথা এক এক করে খুলে বললো। যাকে আর পাঁচজন জানে এক নিষ্ঠুর মানুষ রুপে সে নিজেই এখন যথেষ্ট আতঙ্কিত। মনের শান্তি নষ্ট করার মতো কাজ করে করে সে কুখ্যাতি অর্জন করেছে । যে বন্দুকের জোরে সে দিন যাপন করে এখন সেরকমই কোনো বন্দুকের গুলিতে নিজের মৃত্যু হবে এই ভয়ে সে ভীত। সব মানুষের হাত এখন ওর দিকে উঠে আছে।
আরো এক পাত্র এক চুমুকে গলাধঃকরন করে বললো, ‘মিনেয়াপোলিসে হটিনের সাথে ছয় মাস আগে আমার দেখা হয়। ও আমার গ্যাং এ যোগ দেয় । আমরা একসাথে অনেক গুলো কাজ করি। শেষ কাজ সেন্ট লুইসে মাইনের টাকা ছিনতাই । কাজটা ঠিকঠাক করতে পারিনি আমরা। আমার তিনটে লোক খতম হয় ওটা করতে গিয়ে।‘
‘আমার মনে পড়েছে, আমি পড়েছিলাম ওটার ব্যপারে,’ ক্যাম্বারটন জানায়। ‘কিন্তু জানতাম না ওটার সাথে হটিন জড়িত ছিল – বা তুমি।’
‘কেউই জানতো না। হটিন এবং আর দুজন আজ সকালেই খতম হয়েছে।’ ঠোঁট চেটে ডাকাত সর্দার বল লো । ‘আমিও লটকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ভাগ্য সাথে ছিল। এটা একটা দারুন সু্যোগ আমার কাছে । যা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। এক লক্ষ ডলার সটকাতে পেরেছিলামযার কিছুটা অবশ্য হটিনের প্রাপ্য ছিল। কিন্তু সেতো এখন মৃত। বাকিদের মধ্যে যারা মরেনি সব জেলে ঢুকে গেছেফলে কারোর সাথেই ভাগাভাগি করার দরকার নেই। এটা শুধু তুমি জানলে। এখন বলো, কত নেবে এদেশ থেকে আমাকে পালানোর ব্যবস্থা করে দিতে?’
ক্যাম্বারটন শুকরের মতো কুতকুতে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো আগন্তুকের দিকে । অপহৃত অর্থের ওই বিশাল পরিমাণ কি সত্যিই ওই গরিলাসদৃশ বর্বরটার কাছে আছে? ওকি আমাকে তার থেকে অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ দেবে নিজের চামড়া বাঁচাতে? ওর উকিলি বুদ্ধি বলছে এ দুটো প্রশ্নের উত্তরই ইতিবাচক হবে।
‘হুম, খুবই কঠিন কাজ,’ বললো ক্যাম্বারটন। ‘যে মহিলাকে তুমি ঠকিয়েছিলে সেই মহিলা তোমার ছবি পুলিসকে দিয়ে দিয়েছে।  আর সেটা ছাপিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে তুমি এখন বেব রুথের মতোই জনপ্রিয়। তোমার হাল হকিকত সব পুলিস দপ্তরে, সব গোয়েন্দা দপ্তরে এমন কি পোস্ট অফিসগুলোতেও পাঠানো হয়েছে।’
‘একেবারে ঠিক বলেছো তুমিএখন অবস্থা এরকম যে  কেউ মোটামুটি আমার মতো দেখতে হলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে । পালানোর চেষ্টা করলেই গুলি ।’ ডারন্যাক চেঁচিয়ে উঠলো , ‘এরকম অবস্থায় আমি কি করবো বলতে পারো?’
ক্যাম্বারটন মক্কেলকে ভালো করে দেখে নিয়ে বললো, ‘সে পথ একটা আছে , দারুন রকমের। কিন্তু করা বেশ কঠিন এবং ব্যয়বহুল। শুরুতেই বেশ ভালো খরচা আছে । সবার আগে আমাকে একজন ভালো প্লাস্টিক সার্জারি করতে পারে এমন একজনকে ভাড়া করতে হবে। যে তোমার জনপ্রিয় মুখটাকে বদলে দেবে । তারপর সব পথ পরিষ্কার করার জন্য খুঁজতে হবে কিছু সাহায্যকারী, তারপর আরো আছে –’
‘থামো দেখি, অনেক বকবক করেছ,’ ডারন্যাক কথার মাঝে বলে উঠলো, ‘তুমি যদি আমার খরচা করার ক্ষমতা কতটা এই নিয়ে ভেবে থাকো তাহলে এটা ধরো। এতে পঁচিশ হাজার আছে।’ কোটের বুক পকেট থেকে একটা সবুজ প্যাকেট বার করে ছুঁড়ে দিলো ক্যাম্বারটনের দিকে। ‘আর এটাও জেনে রাখো এটা যেখান থেকে এনেছি সেখানে আর লক্ষাধিক ডলার রাখা আছে। এখান থেকে কয়েকটা ব্লক পরেই আইডিয়াল শ্যু রিপেয়ার শপ । তারই মেঝের তলায় সযত্নে রাখা আছে ওগুলো।’  একটা হেঁচকি তুলে আর একপাত্র হুইস্কি গলায় ঢেলে বললো, ‘ঠিকই ধরেছো, আমিই আইডিয়াল শ্যু রিপেয়ার শপের মালিক। ওই বুড়ো মুচি আসলে মালিক নয়। কোনো লোক  এটা জানে না যে ও আসলে আমার হয়ে কাজ করে। একসময় সংশোধনাগারে ছিল, ওখানেই জুতো সারানো শিখেছিল।’
‘ও জানে ওখানে টাকাটা আছে?’
‘হাঃ হাঃ হাঃ! মোটেই না। বুড়ো ফ্রেড মিলার এতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানার অধিকারী নয়। ও শুধু জানে আমি এই দোকানটা আমার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে গোপন আলোচনার জন্য ব্যবহার করি। আর সে সময় ওর হাতে আমি কিছু আলগা ডলার গুঁজে দিই পানশালায় যাওয়ার জন্য। বাকি সময়টা ও ওখানে শুয়ে বসে কাটায়। আজ রাতের জন্যেও ওকে কিছু দিয়ে দিয়েছিভেবেছিলাম তোমার আমার মধ্যে আলোচনাটা ওখানে বসেই করবো ।’
ক্রিমিন্যাল লইয়ারের লোভী চোখ দুটো ক্ষনিকের জন্য ঝলসে উঠলো ডারন্যাকের ডলার গুলোর কথা ভেবে। ওর মনে ভাবনার গতি বাড়লো। এই কাজটা করার ঝুঁকি নিতে কত ডলার খরচ হবে? যদি ধরা পড়ে জেলে যেতে হয় এ মক্কেলকে আমেরিকার বাইরে পাচার করতে গিয়ে ? চিন্তার ভারে ময়দার তাল সদৃশ মুখে বেশ কিছু ভাঁজ পড়লো।
সহসাই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা সমাধান সূত্র পেয়ে গেল ক্যাম্বারটন। শয়তানের দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ডারন্যাকের দিকে। সে দৃষ্টি বুঝতে পেরে হতভম্বের মতো চাইলো পালিয়ে বেড়ানো অপরাধী। চেষ্টা করলো আগ্নেয়াস্ত্রটা বার করারকিন্তু ওকে চমকে দিয়ে মোটা থলথলে চেহারার আইনজীবী তড়িৎ গতিতে পিস্তল বার করে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে গুলি করলো। চেয়ার থেকে ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল জনপ্রিয় কুখ্যাত অপরাধী । একেবারে কপালে ঢুকে গেছে গুলিটা।
নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বারুদ পোড়া গন্ধ নাকে টেনে ক্যাম্বারটন তাকালো শিকারের প্রানহীন দেহটার দিকে, যে হাতে ধরে আছে একটা রিভলবার । ওইটাই ওর আত্মরক্ষার গল্পটাকে সাজাতে সাহায্য করবে। এবার উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে । তারপর সবার আগে দেওয়াল আলমারীর লকারে ঢুকিয়ে রাখলো সবুজ প্যাকেটটা । খুলে রেখে দিলো দরজাটা । হুইস্কির বোতল আর গ্লাস দুটো সরিয়ে ফেললো ওখান থেকে। এবার হোটেলের অফিসের সাথে যুক্ত টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিলো হাতে।
শান্ত ভাবে জানালো, ‘দয়া করে পুলিসকে খবর পাঠান এখানে আসার জন্য। আমি এই মাত্র এক সিঁধেল চোরকে গুলি করে মেরে ফেলেছি । যাকে দেখতে টনি ডারন্যাকের মতো।’

কিছুক্ষন বাদে পুলিস, সংবাদপত্রের রিপোর্টার আর হোটেলের কর্মচারীরা ভিড় জমালো ক্যাম্বারটনের ঘরে। আর ও শোনালো এক শিহরনউদ্রেককারী ঘটনার কথা । যেটায় ও জানালো সান্ধ্যকালীন ভ্রমণ সেরে ঘরে ফিরে ও দেখতে পায় ওই লোকটা ওর দেওয়াল আলমারীটা খুলে ভেতরটা হাতড়াচ্ছে ।
‘ও আমার দিকে ধেয়ে এলো রিভলবারটা আমার দিকে তাক করে । নিজেকে বাঁচাতে আমি গুলি চালালাম।’
 পুলিস সার্জেন্ট জানতে চাইলো, ‘আগে কখনো দেখেছেন ওকে?’
‘মোটেই না। খবরের কাগজে ওর ছবি দেখেছিলাম তাই চিনতে পারি ।’
এক রিপোর্টার বললো, ‘মিঃ ক্যাম্বারটন, আপনি তো কেল্লাফতে করে দিয়েছেন। ওর মাথার দাম এখন পঁচিশ হাজার ডলার।’
‘তাই বুঝি! আমি অতশত ভেবে কিছু করিনি। শুধু নিজের প্রাণটা বাঁচাতে চেয়েছিলাম। তবে হ্যাঁ এখন আমি দাবি করতেই পারি যে সমাজের বুক থেকে আমি একটা দাগী অপরাধীকে হঠিয়ে দিয়েছি । আর তার জন্য কিছু পুরষ্কার আমার পাওয়া উচিত।’
নিজের ওপর নিজে দারুনভাবে সন্তুষ্ট আইনজীবী এবার বিভিন্ন সংবাদপত্রের জন্য বিভিন্ন ভঙ্গীতে নিজের ছবি তুলতে দিলেন। কখনো পিস্তল হাতেকোনোটায় দেওয়াল আলমারীটা দেখাচ্ছেন। সার্জেন্ট এর সাথে করমর্দনের ছবিও উঠলো। হোটেল ম্যানেজার, বেলবয়, পরিচারিকাদের কাউকেই মনে দুঃখ পেতে দিলেন না, সবার সাথে ছবি তুললেন। শুধু নিজের শিকারের সাথে একটাও ছবি তুললেন না।  উপস্থিত ফটোগ্রাফারদের সবরকম চাহিদা মিটালেন – শুধু একজনের বাদে। উনি চেয়েছিলেন ক্যাম্বারটন মৃতদেহটার ওপর পা দিয়ে দাঁড়ান শিকারীর ভঙ্গীতে। উকিল মহাশয় বিনয়ের সাথে বললেন সেটা ওনার সম্মানের পক্ষে খুব খারাপ একটা ব্যাপার হবে।

রাত পেরিয়ে ভোর হওয়ার একটু ক্যাম্বারটন বেরিয়ে এলো রাস্তায়টেলিফোন ডিরেক্টরী ঘেঁটে আইডিয়াল শ্যু রিপেয়ার শপের ঠিকানাটা যোগাড় করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। ৬৯২ এলওয়েল কোর্ট। চারটে ব্লক পরেই। পকেটে রিভলবার, ছোটো একটা টর্চ আর মাথায় টুপি পড়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঝোলানো সিঁড়ির সাহায্যে পেছনের সরু গলিপথটা দিয়ে শুরু করলো হাঁটা।
ক্লার্ক অ্যান্ড ব্রডওয়ের আলোকোজ্জ্বল অংশটা থেকে কিছু দূরেই এলওয়েল কোর্ট। গলি পথ সংলগ্ন একটা ভাঙ্গা চোরা বস্তির মতো এলাকাটা। ৬৯২ নাম্বারের ঠিকানাওলা বাড়ীটার
 সামনের দরজার কাঁচে লেখা আছে   “শ্যু রিপেয়ারিং” । কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবে না এখানে লুকানো আছে লক্ষাধিক ডলার। ক্যাম্বারটন কিন্তু আত্মবিশ্বাসী যে ওই টাকাটা সে আত্মসাৎ করতে পারবে। ডারন্যাক যে খুব একটা বুদ্ধিমান নয় এটা    সহজেই বুঝে গিয়েছিলোতার প্রমান এখানেও, একটা সাধারন তালা লাগিয়ে রেখেছে দরজাটায়। স্কেলিটন কি ব্যবহার করে সহজেই ওটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো ক্যাম্বারটন।

ভেতরে আবছা গা ছমছমে পরিবেশ। দূরে লাইট পোস্ট থেকে ঝাপসা আলো জানালার নোংরা কাঁচ ভেদ করে ঢুকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে বাধা পেয়ে অদ্ভুত দর্শন ভ্রান্তিকর সব ছায়া অবয়বের জন্ম দিয়েছে। আন্দাজ করে করে ও সামনের দিকে এগোলো । নরম কিছু একটায় ওর পা পড়তেই “ফ্যাঁ অ্যা অ্যা স” শব্দ ওকে চমকে দিলো। দুটো হলুদ চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। টর্চটা জ্বালাতেই বিড়ালটা লাফিয়ে পালিয়ে গেল। বিড়বিড় করে কিছু গালাগাল ছুঁড়ে দিলো ক্যাম্বারটন ওটার উদ্দেশ্যে । ঘরের চারদিকে আলো ফেলে নিজের অবস্থানটা এবার বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলো ।
দোকানের পেছন দিকেও একটা দরজা আছে। ওটা দেখতে পেয়েই দ্রুত টর্চটা নিভিয়ে দিলো । ডারন্যাকের কথা মতো বুড়ো মিলার হয়তো ওই ঘরেই শুয়ে আছে পানশালা থেকে ফিরে এসে। ডলার খোঁজার আগে একবার ওই ঘরটা দেখে নিতে হবে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দরজাটার দিকে। হাত রাখল ডোরনবে। অতি ধীরে ধীরে শব্দ না করে ঘোরালো ওটাকেএক অজানা আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেল ওর শরীরে । যেটা অস্বাভাবিক নয় মোটেই । ক্যাম্বারটন নিজেকে এ পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি বলে মোটেই মনে করে না। ও মোটেই সে ধরনের মানুষ নয় যারা অন্ধকার ও রাগী বিড়ালের চোখকে ভয় পায় না । কিন্তু এই মুহূর্তে যে ভয়ের ছোঁয়াচ ওকে ঘিরে ধরছে সেটা ঠিক কি রকমের সেটা ও বুঝতে পারছিলনা । কেন জানিনা একটা রাগ জন্ম নিচ্ছিল।
সাবধান হওয়ার কথা ভুলে গিয়ে এক ধাক্কায় দরজাটা খুললো ক্যাম্বারটনএক দমক হিমেল হাওয়া এসে আছড়ে পড়ল ওর ওপর। কনকনে ঠান্ডার সেই অনুভুতিতে ওর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। কিছু একটা গণ্ডগোল আছে বলে মনে হল ওর। জুলাই মাসে এতো ঠান্ডা! মনের জোর দরকার এই মুহূর্তে নিজের এই থলথলে শরীরটাকে চাঙ্গা রাখতে । এ ঘরটা আগের ঘরটার চেয়ে বেশী আলোকিত। পাশের বাড়ীর দেওয়ালের একটা আলো জানলা দিয়ে সরাসরি ঢুকছে এ ঘরে।
মনের মধ্যে একটা উদ্বেগ নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ক্যাম্বারটন থমকে গেল অন্ধকার কোনে একটা কিছু দেখে। দেখে মনে হচ্ছে একটা বিছানা, আর তাতে কেউ একজন শুয়ে আছে। বুড়ো মুচিটাই হবে, মদ্যপান সেরে এসে ঘুমাচ্ছেকিন্তু ক্যাম্বারটনের নাকে এমন একটা গন্ধ ভেসে এলো যা মোটেই অ্যালকোহলের নয়। খুব চেনা একটা গন্ধ। যা মোটেই মানানসই নয় এ জায়গার সাথে। রিভলবারটাকে চেপে ধরে জোরে জোরে কয়েকবার নাক টেনে গন্ধটা শুঁকলো ক্যাম্বারটন তারপর পা টিপে টিপে এগোতে থাকলো শুয়ে থাকা অবয়বটার দিকে এবং থেমেও গেলো দু পা এগিয়েই। একেবারে পাথরের মূর্তির মতো। বিস্ফারিত চোখে ত্রাসের ছায়া।

বিছানায় অবয়বটা উঠে বসেছে – এবং ওটা কোনো বুড়ো মানুষের দেহ নয় । পেশী বহুল, চওড়া কাঁধ ওয়ালা টনি ড্যারন্যাকের অবয়ব। আমেরিকার এক নম্বর অপরাধী। টনি ডারন্যাক! যার মৃতদেহ এই মুহূর্তে মর্গের খুপরিতে থাকা দরকার সে এখানে উঠে বসেছে ! এক অপার্থিব সবজেটে আলোর ছটায় আলোকিত হয়ে আছে তার মুখ । ভয়ানক । তাকিয়ে আছে ক্রুর চোখে এক দৃষ্টে আতঙ্কিত আইনজীবীর দিকে। কপালে একটা বুলেটের ফুটো। আর যে গন্ধটা ক্যাম্বারটনের মস্তিষ্কে গুটি গুটি করে পা  চালিয়ে ঢুকে পড়ছে তীব্রভাবে সেটা পোড়া বারুদের।
ক্যাম্বারটনের গোলাকৃতি মুখ ফ্যাকাশে থেকে আরো ফ্যাকাশে হতে থাকল। মাংসল কোটর থেকে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার যোগাড়থরথর করে কাঁপতে থাকা মুখে কিছু বলার আকুতি কিন্তু শব্দহীন।
‘তুমি!’ অবশেষে কঁকিয়ে উঠলো, ‘তুমি !– কেন ?- কিভাবে ? তুমি ! ডারন্যাক! নিকুচি করেছি তোমার! একবার তোমায় হত্যা করেছি। জানিনা কি ভাবে বেঁচে গেছো। আবার করবো !’
লক্ষ্যস্থির করে রিভলবার উঁচিয়ে ধরলো। ঘরটা কেঁপে কেঁপে ঊঠলো একের পর এক গুলি চা্লানোর শব্দে। গুলি গুলোর কোনোটাই অবয়বটার শরীরে বিদ্ধ হচ্ছিল না। ভেদ করে চলে যাচ্ছিলো । সাথে সাথেই ওটা এগিয়ে আসছিলো ক্যাম্বারটনকে লক্ষ্য করে এক পা এক পা করে। ক্যাম্বারটন পিছাচ্ছিল । গুলি চালানো থামায় নি । চেষ্টা করেছিল কিন্তু ঘুরে দৌড়ে পালাতে পারেনি। সুযোগই হয়নি । সম্মোহনের অমোঘ মায়ায় ওর সামনের অবয়বের চোখ দুটো ওকে আটকে রেখেছিলো। যেন ওরা এক সুতোয় বাঁধা । একজন কেবল এগোবে – আর অন্য জন পিছাবে --- আর কিছুই সম্ভব নয় এর বাইরে।
অসম্ভব ঘামতে ঘামতে পকেটে রাখা দ্বিতীয় আগ্নেয়াস্ত্রটা বার করে সব গুলি চালিয়ে গেল ক্যাম্বারটন। একসময় ট্রিগারেই শুধু চাপ পড়ছিল কিন্তু আর গুলি বের হচ্ছিল না।

আর এই ভঙ্গীতেই পুলিসের টহলদারী গাড়ীর লোকেরা ওকে দেখতে পায়। পাগলের মতো দুহাতে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র ধরে ট্রিগার টিপেই চলেছে। প্রথম গুলিটা চলার কিছু বাদেই টহলদারী গাড়ী এসে যায়। গুলির শব্দ পেয়েই পাশের বাড়ির বাসিন্দারা জেগে উঠে পুলিসে ফোন করে, ‘৬৯২ এ কিছু একটা ঘটছে...’

বিছানার ওপরেই পড়ে ছিল   গুলিতে ছিন্ন ভিন্ন হওয়া বুড়ো ফ্রেড মিলারের প্রানহীন দেহ। পুলিস দেখতে পায় ওই অদ্ভুত পাগলটা যাকে মানুষ হোরেস এল ক্যাম্বারটন , ক্রিমিন্যাল লইয়ার,‌ নামে চেনে সে রিভলবার দুটোর ট্রিগার টিপেই চলেছিল যন্ত্রের মতো।

বুড়ো মুচিকে খুনের দায়ে মামলা বেশী দিন চলেইনি । কারন ক্যাম্বারটনের কিছু বোঝার মতো ক্ষমতাই লোপ পেয়েছিল সে কি করেছে ওই দিন ভোরে। আপাতত উন্মাদাগারে পাগল অপরাধীদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটার এক কোনে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে । তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে । মনে হতো ডারন্যাকের সেই চাহনি আজও ওকে বেঁধে রেখেছে এক সুতোয় ।

কিছু মানুষের অনুমতি ছিল ওর সাথে দেখা করার। খুব কম লোকই আসতো অবশ্য । উন্মাদাগার আধিকারিকের কথানুসারে মাঝে মাঝেই ক্যাম্বারটনের মুখটা এক অভূতপূর্ব আতঙ্কের চাপে এমন বিকৃত হয়ে যেত যে অতি শক্ত মানসিকতার মানুষেরও বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যেত। যে আতঙ্কের অনুভুতি মাঝে মধ্যে ওর মুখকে বিকৃত করতো একসময় সেটা প্রায় সব সময় হতে থাকলো । এর ফলে যে শাস্তি ক্যাম্বারটন ভোগ করছিল প্রতিনিয়ত সেটার তুলনায় আর কোনও বড় শাস্তি এ জগতের আদালতের দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

সমাপ্ত
Attorney for the Damned

Reniyers Wyers

Wednesday, June 28, 2017

দ্যা_লাস্ট_ম্যান *মেরি শেলী *বাংলা অনুবাদ – “শেষের সেইজন” *মূল পর্ব - প্রথম অধ্যায়- ২য় পরিচ্ছেদ [সম্পূর্ণ]

দ্যা_লাস্ট_ম্যান
মেরি শেলী
বাংলা অনুবাদ – “শেষের সেইজন”
প্রতিম দাস
মূল পর্ব - প্রথম অধ্যায়- ২য় পরিচ্ছেদ
...
সাধারন মানুষের ব্যস্ত জীবন থেকে অনেক দূরে, এক পাহাড়ী এলাকায় আমি বাস করতাম যেখানে যুদ্ধের গুজব বা রাজনৈতিক পরিবর্তন নিছকএকটি শব্দ মাত্র। আমার বাল্যকালের সময়টায় ইংল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগ্রা্মের ডামাডোল চলছিল
২০৭৩ সালে,  যিনি ইংল্যান্ডের শেষ রাজা ছিলেন তিনি ছিলেন আমার পিতার পুরনো বন্ধু  রাজনৈতিক চাপের মুখে তিনি সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং প্রজাতন্ত্রের রাজত্ব শুরু  হয় এক বিরাট এস্টেট অবশ্য সিংহাসনচ্যুত রাজকীয় পরিবারের জন্য সুরক্ষিত থাকে।
প্রাক্তন রাজাকে দেওয়া হয় আর্ল অফ উইন্ডসর উপাধিউইন্ডসর ক্যাসল এবং তার সংলগ্ন  প্রশস্ত এলাকা তাঁর জন্য বরাদ্দ সম্পদের একটা অংশ ছিল  কিছুদিন পরেই তিনি মারা যানবেঁচে থাকে তার দুই শিশু সন্তান।একটি পুত্র একটি কন্যা
প্রাক্তন রাণী,  যিনি ছিলেন অস্ট্রিয়ার রাজকুমারী, দীর্ঘকাল তার স্বামীকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করেছিলেন বা বানিয়ে রেখেছিলেন হাতে পুতুল   উদ্ধত এবং
নির্ভীক প্রকৃতির মহিলা ; নিজের সন্তানদের কথা ভেবে তিনি রাজকীয়তা ত্যাগ করে  প্রজাতন্ত্রের সদস্য হতেসম্মত হন ক্ষমতার প্রতি ছিল তার চরম লোভআর রাগ ছিল সেই সমস্ত মানুষদের ওপর যারা তার স্বামীকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল ।
 বিধবা ওয়ার পর ছেলে আদ্রিয়ান, উইন্ডসর অফ আর্ল দ্বিতীয়কে, শিক্ষিত করায় মনোনিবেশ করেনযাতে তার উচ্চাভিলাষী চিন্তাভাবনা একটা পরিণতি লাভ করতে পারে মায়ের দুধের ঋণ শোধ করার জন্য আদ্রিয়ানকে হৃত মুকুট পুনরায় অর্জন করতে হবে এটাই ক্রমাগত শোনাতে থাকেন যখনই সুযোগ পান ।
পনের বছর বয়স হলো আদ্রিয়ানের অধ্যয়নের প্রতি আসক্ত ছিলো সে । সাথেই ছিল শেখার ইচ্ছে এবং প্রতিভা প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়  যে তিনি ইতিমধ্যেই তাঁর মায়ের ভাবনাকে ব্যর্থ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন প্রজাতান্ত্রিকনীতির সমর্থন করে উদ্ধত বিধবা কাউন্টেস কাউকেই বিশ্বাস করতেন না পারিবারিক-শিক্ষাদান বিষয়ে যে কারনে আদ্রিয়ানকে বড় হতে হয় একাকীকোন সঙ্গীই সে পায়নি  কোনো দিন তার বয়স পদ অনুসারে কিছু অজানা পরিস্থিতিকে সামাল দিতে এই সময়ে তার মা বাধ্য হন  বিশেষ শিক্ষা নেওয়ার জন্য  আদ্রিয়ানকে বাইরে পাঠাতে   ।  আমরা শুনেছিলাম যে তাকে কাম্বারল্যান্ড যেতে হত এর জন্য। হাজার হাজার গল্প শোনা যেতো উইন্ডসর এর কাউন্টেস এর এই আচরনের ব্যাখ্যা হিসাবে। যার কোনোটাই সম্ভবত সত্যি ছিল না।
কিন্তু   প্রতিদিনই আমরা একটু একটু করে  নিশ্চিত হচ্ছিলাম যে ইংল্যান্ডের রাজার বাড়ির উন্নতচরিত্র কোন বংশধর আমাদের এলাকায় মাঝে মাঝে আসছেন। 
একটি বড় এস্টেট এবং বেশ বড় এক অট্টালিকা ছিল, এই রাজকীয় পরিবারের, অ্যালসোয়াটারে একটি বড় উদ্যান ছিল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেখানে ভালো ভালো  শিকারের জিনিষে পরিপূর্ণ ছিল। প্রায়ই আমি ঐ অবহেলিত রাজকীয় জায়গায় নিজের বেআইনি অভিযান চালিয়েছিযখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তরুণ আর্ল অফ উইন্ডসর এর কাম্বারল্যান্ড পরিদর্শন করা দরকার তখন এর সংস্কার করার জন্য কাজ শুরু হয় কিছুদিনের মধ্যেই বাসস্থা্নটি আবার ফিরে পায় তার রাজকীয় জাঁকজমক এবং উদ্যানটিকেও দারুন ভাবে সাজানো হয়। সাথে সাথেই দেখাশোনা রার অতি বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়
এই ব্যাপারটায় যে কি পরিমাণে আমি বিরক্ত হয়েছিলাম তা বলার কথা না এর কারনে আমার অতীত দিনের সব আঘাতের অনুভূতি যেন পুনরায়  প্রজ্বলিত হলো ।  নতুন এক প্রতিশোধ ভাবনায় জারিত হলাম আমি যদিও এখন আর সেই পুরনো পেশায় আমি নিযুক্ত ছিলাম না  ;আমার সব পুরানো পরিকল্পনা প্রায় মুছে গিয়েছিল মন থেকে  ;   নতুনভাবে জীবন শুরু করেছিলাম । কিন্তু এখন যেন আবার আমার  জীবনে এক দোটানা স্রোত বইতে শুরু করলো । কেউ একজন এক বিজয়ীর ভঙ্গীতে এবার আসবেন সেই জায়গায় যেখান থেকে একদিন আমার পিতা মাতা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। হয়তো তিনি খুঁজে পাবেন সে দুর্ভাগ্যগ্রস্ত সন্তানসন্ততিদের। দু:স্থ বিত্তহীন আমাদের অস্তিত্বের কথা জানতে পেরে হয়তো তার পিতার মতোই একই রকমের গালিগালাজ করবেন। যে সব একদিন ঘটেছিল সেই সবেরই আবার পুনরাবৃত্তি ঘটবে ।   
সুতরাং আমার দেখা হওয়ার কি দরকার    খেতাবধারী যুবকের সাথে ?   যার বাবা কোন এক সময়ে আমার বাবার বন্ধু ছিল নিশ্চয় ওই মানুষটাকে ঘিরে থাকে তার চাকরবাকর এবং গণ্যমান্য ব্যক্তি ও তাদের গণ্যমান্য সন্তানেরা । নিশ্চিতভাবেই সমগ্র ইংল্যান্ড তাঁর নামে উচ্ছসিত হয়   । এখন তার আগমনবার্তা আমার কাছে আসছে এক বজ্রগর্ভ ঝড়ের মতো । যার সংকেত শোনা যাচ্ছে অনেকদূর থেকেআমি এনিরক্ষর এবং সহবৎহীনভাবে যদি তার সামনে হাজির হই,  তাহলে তার  আশেপাশে থাকা মানুষরা  নিশ্চিত জানিয়ে দেবে আমি কে । সাথে সাথেই এটাও জানাজানি হয়ে যাবে  আমার আজকের এই অবস্থার জন্য কোন মানুষটা দায়ী।
এই রকম সব ধারনা নেচে বেড়াচ্ছে যখন আমার মনে  তখন আমি এটা বলতে বাধ্য  কেন জানিনা মনে হচ্ছিল তরুআর্ল এর সাথে   দেখা হওয়াটা পূর্বনির্দিষ্ট হয়েই আছে এই আগমন উপলক্ষ্যে  কি কি হয়ে চলেছে সেদিকে   লক্ষ্য রেখে যাচ্ছিলাম লন্ডন থেকে ওয়াগন ভর্তি করে বিভিন্ন রকম বিলাস সামগ্রী এসে ঢুকে যাচ্ছিলো অট্টালিকার ভেতর।
এটা ছিল প্রাক্তন রানী পরিকল্পনা, তার ছেলেকে যেন ঘিরে রাখা হয় সব রকমের দামি দামী বিলাস ব্যসনের সামগ্রী দিয়ে।   দেখলাম, এলো দামী কার্পেট রেশমী দোলনা,  সোনার অলঙ্কার , দারুন ভাবে কারু কাজ খোদাই করা বাসনপত্র, ঝাঁ চকচকে আসবাবপত্র এবং সবচেয়ে উচ্চপদে থাকলে যা যা ব্যবস্থা করতে হয় সব কিছু । একজন  রাজকীয় বংশোদ্ভুত মানুষকে এক নজরে চেনার  জন্য যা যা জাঁকজমক দরকার সব কিছুর আয়োজন হলো।  ওই সব দেখার পর  আমার নিজের পোষাকের দিকে তাকালামকোথা থেকে সৃষ্টি হলো এই পার্থক্য?
এসবই  কী  সেই অকৃতজ্ঞতা থেকে - মিথ্যা থেকে - একটি ত্রুটি থেকে , যার সাথে কোন  এক সময় উদার সহানুভূতি সম্পন্ন এই প্রিন্স এর পিতা পরিচিত ছিলেন ।
নিঃসন্দেহে ইনি কিছুটা হলেও সেই রক্তের গর্বিত জোয়ার পেয়েছেন যা বইছে তার মায়ের দেহেইনিতো রাজ্যের সম্পদ এবং আভিজাত্যের স্বীকৃত স্বরুপ । যাকে অবজ্ঞার সাথে আমার বাবার নাম এবং তাকে লক্ষ্য করে হাসাহাসি করতে শেখানো হয়েছিল।    এসব থেকে  আমার শুধু একটু সুরক্ষা চাই আমিতো মনে করি ওদের এইসব বিশালতার পেছনে লুকিয়ে আছে জ্বলজ্বলে কুকীর্তি । আর এখন আমার কলঙ্কিত এবং জীর্ণ জীবনের পাশে তিনি যে সোনার পতাকা প্রোথিত করতে চলেছেন তা মোটেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা নয়, বরং তার নিজের অবমূল্যায়ন এসব ভাবনা সত্ত্বেও আমি তাকে হিংসা করার হাত থেকে নিজেকে আটকাতে পারছিলামনা    অশ্বশালায়   সুন্দর সুন্দর সব ঘোড়া দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছিলতা অস্ত্রের ব্যয়বহুল গঠনপ্রণালী আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিলোসবসময় তার প্রশংসা  করা হচ্ছিল চারপাশে প্রতি ক্ষেত্রে ।  শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছিল প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে । পরিচারকেরা সব সময় উপস্থিত, প্রস্তুত তারা আদেশ পালনে।  উচ্চস্তরীয় সম্মান  - আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছিল এসব জোর করে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আর এজন্যই আমি ঈর্ষা করতে বাধ্য হচ্ছিলাম ।  এক যন্ত্রণাদায়ক তিক্ততার অনুভুতি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল
আর এই মানসিক আত্মিক অশান্তির মধ্যে কাঁটার মুকুটটা পড়াল পারডিটা। দূরদৃষ্টি সম্পন্না পারডিটা ।   আমাকে  নিয়ে এলো বাস্তবের জগতে    জানালো আর্ল অফ উইন্ডসর  কিছু সময়ের ভেতরেই এসে যাবেন।
" এই ব্যাপারটায় তুই খুব খুশি মনে হচ্ছে ?" আমি ভগ্নহৃদয়ে জানতে চাইলাম
"অবশ্যই , লায়োনেল," সে জবাব দিলো। "আমি তাকে দেখার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছি। সে মানুষটা  এই ভুখন্ডের প্রথম মালিক আমাদের রাজার সন্তান । সকলেই তাকে পছন্দ করে ।  সবাই তাকে ভালবাসে এবং বলে যে, সে এখন রাজা নয় এটা কোন ব্যাপারই না। মানুষটা উদার, সাহসী, এবং অমায়িক "
"পারডিটা তুই মানুষের বলা কথায় বিশ্বাস করে নিয়েছিস। এতে ক্ষতি হতে পারে  । আমি পুনরায় বলতে চাই আক্ষরিক অর্থেই, যে ভুলে যাস না আমাদের কাছে প্রমান আছে ওই মানুষটার আচরণ সম্বন্ধে।   উনি কতটা উদার তার প্রমান আমাদের বর্তমান অবস্থাতেই পাওয়া যায়। তার সাহসিকতা প্রমান দেয় আমরা কি পরিমাণ সুরক্ষায় জীবন যাপন করি সেটাতেই। তার সৌজন্যতা কি পরিমাণ আছে সেটা বলার কিছু আর বাকি আছে?  মানুষটা এখন রাজা কিনা তাতে কিছু যায় আসে না, এটাই বললি না তুই? কেন তার সবগুণ কেবলমাত্র তার পরিবার সুত্রে আসে? কারণ তিনি ধনী, তাই তাকে উদার বলা হয়। কারণ তিনি ক্ষমতাবান , তাই সাহসী। যেহেতু না চাইতেই তিনি সব পেয়ে যান তাই  তিনি অমায়িক এসব যে বলে বলুক, আমি জানি তাকে পুরো ইংল্যান্ড তাঁকে এইভাবে বিশ্বাস করে । করুককিন্তু আমরা তাকে চিনি তিনি আমাদের শত্রুএকজন অনুদার, কাপুরুষোচিত, অহংকারীশত্রু। যেভাবে তুই বলছিস তার এক কনা গুনও যদি তার মধ্যে থাকতো তিনি আমাদের জন্য যথাযথরূপে কিছু করতেন ।
ওই মানুষটার পিতা আমার পিতাকে শেষ করে দিয়েছিল – সেই রাজা   যিনি সিংহাসনে বসে ক্ষমতার শীর্ষে জীবন যাপন করতেন।  কেবলমাত্র যারা তার চাটুকারিতা করতো তাদের মাথায় হাত রাখতেন।  আর আমরা এবং এই আর্ল সেই  দুটো মানুষের বংশধর – আমরা একে অপরের শত্রু।  আর আমি ওকে দেখাবো প্রতিশোধ কি ভাবে নিতে হয় এবং শেখাবো   আমার প্রতিশোধের আগুনকে ভয় পেতে! "
আর্ল এসে যাওয়ার কয়েকদিন পর।
এলাকার প্রতিটি বাসিন্দা এমন কি সবচেয়ে দু: স্থ কুটিরের মানুষটাও ঘর ছেড়ে জনসংখ্যার মান স্ফীত করে দেখতে গিয়েছিল তাকে।
 পারডিটাও ছিল তাদের মধ্যে । আমার কুত্সাপূর্ণ বক্তৃতা সত্ত্বেও প্রধান সড়কের কাছে ছুটে গিয়েছিল সবার হৃদয়ের অধীশ্বরকে দেখার জন্য।  আমার নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল মনে হচ্ছিল । যখন দেখছিলাম  চারদিক থেকে দল বেঁধে মানুষ  তাদের ছুটির দিন পালনের মতো করে , পাহাড় পর্বত পার হয়ে  , দরকারি কাজ ফেলে সব ভুলে ওই মানুষটাকে দেখার জন্য ছুটে যাচ্ছে ।
অবাক হয়ে শুনলাম তাদের  শ্লোগান  - "আর কান্নাকাটি করতে হবেনা। কষ্টের দিন এবার শেষ। আর্ল দীর্ঘজীবি হন ।" এরপর যখন রাত ঘনিয়ে এলো , সাথেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো বাড়লো ঠান্ডার মাত্রা  , আমি বাড়িতে ফিরে এলাম ।
 বুঝতে পারছিলাম আজ প্রতিটি কুটির আদ্রিয়ানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আছে। অনুভব করছিলাম আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠান্ডায় অসাড় হয়ে পড়ছেআর সেই যন্ত্রনা আমার পাগলামোকে আরো বাড়িয়ে দিতে থাকলো । এক সময় এই অবস্থা থেকে আমি মুক্তি পেলাম কারণ এটাই আমাকে অজুহাত খুঁজে নিতে সাহায্য করলো   আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘৃণা করার জন্য সবকিছুর জন্যই সে দায়ী এই ধারনার বশবর্তী হয়ে   কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে পিতা এবং পুত্রর পারস্পরিক শত্রুতার যে যুক্তি আমি সাজিয়ে নিয়েছিলাম  এবং তাতে এতটাই  মেতে গিয়েছিলাম যে আমি ভুলেই বসেছিলাম আর একটা দিক। এমনটাও তো হতে পারে যে আমাদের প্রতি তার বাবা-মার অবহেলার ব্যাপারটা সে জানেই না।  
কিন্তু আমার মাথায় তখন আর কোনও অন্য ভাবনার স্থানই ছিল না।   চিৎকার করে বললাম :শুনতে পাচ্ছেন কি আমি কি বলছি! প্রতিশোধ নেব আমি! আমি পদলেহনকারী কুকু্রের মতো কষ্ট  পেতে রাজি নই! বুঝতে পারবে,  একজন বন্ধুহীন ভিক্ষুক হিসাবে আমি অত সহজে সব কিছু মেনে নেবো না ! "প্রত্যেকদিন প্রতি ঘন্টায় আমার ভাবনার এই অতিরঞ্জিত ভুলগুলো বেড়েই যাচ্ছিলো যত তার বিষয়ে প্রশংসা আমার কানে আসছিল, ততই শত শত কাঁটা ফোটার যন্ত্রনা আমার ভেতরের পাশব দিকটাকে ক্ষেপিয়ে দিচ্ছিলো। দূর থেকে  তাকে সুন্দর ঘোড়ার পিঠে চড়ে যেতে দেখলেই আমার রক্তের ভেতরে বয়ে যাচ্ছিলো ক্রোধের বন্যা ।  তাঁর উপস্থিতিতে যেন বাতাস বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছিলো । আর আমার মুখের ভাষাও দিন দিন বদলে যাচ্ছিলো  ।
যখনই আমি তার নাম সম্মানের সাথে মিলিত কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম আমার মুখ দিয়ে নির্গত হচ্ছিল গালাগাল।  আমি চাইছিলাম কিছু একটা অপকর্ম করে এই জ্বলন্ত হৃদয়ের বেদনা উপশম করতে । যার দ্বারা   সে আমার ঘৃণা বিষয়ে একটা ধারনা করতে পারে। তার প্রতি আমার বিদ্বেষ এমন একটা উচ্চতায় পৌছে গিয়েছিল যে  মনে হচ্ছিল এ এক ধরনের অসহ্য নারকীয় অনুভুতি । যেখানে আমি কিছুই করতে পারছি না আর সেও বুঝতে পারছে না আমি ওর উদ্দেশ্যে কি পরিমান বিক্ষোভ জমিয়ে রেখেছি ।
খুব শীঘ্রই জেনে গেলাম যে আদ্রিয়ান তার উদ্যান এবং অন্যান্য যা আছে সব কিছু বেশ পছন্দ করে ফেলেছে।  সে যদিও ওখানে শিকার টিকার করতো না কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দিতো উপজাতিদের দ্বারা পালিত জীব জন্তুদের পর্যবেক্ষন করে। সাথেই আদেশ জারি করেছিল আগের চেয়ে যেন এদের বেশি করে যত্ন নেওয়া হয় এই সুত্রেই আমি  একটি অপরাধমূলক  পরিকল্পনা ছকে ফেললাম এবং আমার নরপশুসুলভ মানসিকতার পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার   একটা ইচ্ছে জাগলো। 
ওই উদ্যানে চোরাশিকার করার উদ্দেশ্য নিয়ে  আমার অবশিষ্ট কয়েকজন সঙ্গীকে, যারা ছিল সবচেয়ে বেপরোয়া,   কি করতে চাই সেটা জানালাম।  কিন্তু তারা বাই এই বিপদজনক কাজ থেকে দূরে থাকাটাই উচিত বলে মনে করলো। ফলে আমি একা হয়ে গেলাম আমার প্রতিশোধ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য। প্রথম প্রথম আমার কীর্তিকলাপ চালালাম লুকিয়ে চুরিয়ে।  তারপর সাহস বাড়লো। উদ্যানের মোলায়েম ঘাসজমিকে পদদলিত করে দিলাম। ভাঙতে শুরু করলাম নানা গাছের ডালপালা। সাথেই পশু হত্যা করে রেখে এলাম তার চিহ্ন। তারপর যা চেয়েছিলাম সেটাই   হলো বাড়ানো হলো রক্ষীদের নজরদারি এবং আমি ধরা পড়লাম আমায় পাঠিয়ে দেওয়া হল কারাগারে।  আমি এটাকে নিজের জয়  মনে করে পরমানন্দ সহকারে কারাগারে প্রবেশ  করলাম।  আমার মনে হলো , এইবার সে  আমাকে বুঝতে পারবে, পাত্তা দেবে । আমি চিৎকার করে বলতে থাকলাম , "এইবার... এইবার বুঝবে কে আমি। আমি কি করতে চাই।”
 মাত্র একদিন কারাবাস করেই সেইদিন সন্ধ্যায় আমি মুক্তি পেলাম। জানতে পারলাম এটা  আর্ল এর   আদেশ ক্রমে হয়েছে। আর এই সংবাদ আমাকে আমার স্ব-উত্থাপিত সম্মানের চূড়ায় বসিয়ে দিলো। মনে হলো নি   আমাকে তুচ্ছ জ্ঞান  করছেনকিন্তু  আমি বুঝিয়ে দেবো আসলে আমিই তাকে হেয় জ্ঞান করি। তার শাস্তি দেওয়া বা ক্ষমা করা দুটোই আমার কাছে একই ব্যাপার।  মুক্তির পর দ্বিতীয়রাতে, আমিআবার রক্ষীদের হাতে ধরা পড়লাম আবার কারাবাসের শাস্তি এবং আবার মুক্তি পেলাম। আমি থামলাম না। এ আমার বেপরোয়া জেদ। চতুর্থ রাতে আমি আবার ধরা পড়লাম। রক্ষীরা তাদের পালনকর্তার চেয়েবেশি রেগে ছিল আমার ওপর। ওদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল যে যদি আমি আবার ধরা পড়ি আমায় যেন আর্ল এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। রক্ষীরা তার সদয় মানসিকতা বিষয়ে  জানতো তাই  আমার অপরাধ বার বার ক্ষমা করে দেওয়াটা তাদের পছন্দ হচ্ছিল না।  ওদের মধ্যে যে নেতা  ছিল সে নিজেই এর একটা সমাধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মালিকের কাছে আমাকে পৌছে দেওয়ার আগে।
আমার পরেঅভিযান করার সময় চরম সাবধানতার সাথে বেছে নিয়েছিলাম  চাঁদ ডুবে যাচ্ছে এমন একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন  সময় । এর ফলে আমার নিজেরই ভয় হচ্ছিল  যে রাত পেরিয়ে ভোর না হয়ে যায়। আশে পাশের বনজঙ্গল এর  ছায়ায় নিজেকে লুকিয়ে   হামাগুড়ি দিয়ে ফার্ন লতা গুল্ম  পদ দলিত করে  আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আগত  সকালের টাটকা তাজা বাতাস পেয়ে পাখিরা অনভিপ্রেত ভাবে মাঝে মাঝেই ডেকে উঠছিল । আর আমি চমকে চমকে উঠছিলাম প্রতিটি মোড় ঘোরার সময়, এই বোধহয় কারো পদশব্দ ভেসে এলো।
আমার হৃদপিন্ডের গতি ক্রমশ বাড়ছিল যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের প্রাচীরটার দিকে । ওটার ওপর হাতের চাপ দিয়ে অন্যপ্রান্তে  নামতেই , দুজন রক্ষী আমার উপর অতর্কিতে হামলা করলোএকজন আমাকে ছিটকে   ফেলে দিলো মাটির ওপরকানে ভেসে এলোঘোড়া চালানোর চাবুকের আওয়াজ আমি চকিতে নিজের ছুরিটা  বার করে রক্ষীটার উত্থাপিত ডানহাতে আঘাত করলাম । একট গভীর  ক্ষত সৃষ্টি হলো সাথে সাথেই।  আহত লোকটা রাগে চিৎকার করে বাকি সঙ্গীদের ডাক পাড়লোআর সাথে সাথে আমিও সেই আর্তনাদকে ভেঙ্গিয়ে একটা চিৎকার ছাড়লাম, যার শব্দ চারদিকে প্রতিধ্বনিত হলো।
 ওদিকে সকালের আলো ফুটে উঠছিল। তার ফলে আশে পাশের স্বর্গীয় সৌন্দর্য ক্রমশ বাড়ছিল
আমাদের নরপশুসুলভ সশব্দ চিৎকার এর সাথে পাল্লা দিয়ে রক্ষীটার সাথে ঝটাপটি চলছিল তার মধ্যে
আহত মানুষটা বলে উঠলেন, "আর্ল!"হাঁফাতে হাঁফাতে আমি মানুষটার সবল হাতের বন্ধন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম  ।
যারা আমাকে তাড়া করেছে তাদের দিকে আগুনে চোখে তাকিয়ে একটি গাছের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য তৈরি হলাম আমার পোষাক ছিঁড়ে গিয়েছিল । সেইসাথে আমার হাতে লেগেছিল আহত মানুষটার  রক্ত
একহাতে ধরে ছিলাম আমার কষ্টার্জিত শিকার মৃত পাখিটাকেআর অন্য হাতে ছুরি চুল জট পাকানো;  মুখে অপরাধের ছাপের স্বাক্ষর ফুটে উঠছিল আমার হাতে ধরা ছুরি থেকে খসে পড়া রক্তের ফোঁটার মতোই।
আমার চেহারায় দারিদ্র্য পীড়িত জীর্ণতার ছাপ চিনতে কারো অসুবিধা হওয়ার নয় লম্বা এবং পেশীবহুল চেহারা আমার, যা আমি পেয়েছি প্রকৃতির দান হিসাবে। কিন্তু  যে আমিকে এখন  ওরা দেখতে পাচ্ছিলো সে প্রকৃত পক্ষে ছিল এক নিকৃষ্ট অত্যাচারী যে  এই পৃথিবীতে  দাপিয়ে বেড়ায়।   আর্ল নামটা আমাকেচমকে দিলো এবং আমার শরীরের সমস্ত রুষ্টরক্ত যা আমার হৃদয়কে উষ্ণ রাখে তা পৌছে গেল আমার দুই গালে। ​​আমি তাকে আগে কোন দিন দেখি নি।  আমি মনে মনে কল্পনা করে রেখেছিলাম সে হবে এক উদ্ধত অভিমানী যুবক, যার সাথে আমার বোঝাপড়া হবেআমার সাথে শ্রেষ্ঠত্বের সব অহংকার সাথে নিয়ে সে কথা বলতে চাইবে আমি ঠিক করেই রেখেছিলাম কিভাবে তার উত্তর দেবো। চরম ভর্ত্সনার ভঙ্গীতে কথা বলে তাকে একেবারে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেবো কিন্তু সে যখন এলো মনে হ লো পশ্চিমের এক মৃদু বাতাস যেন বয়ে গেলসাথে করে নিয়ে চলে গেল আমার পুঞ্জীভূত হৃদয় স্থিত রাগকে ।
লম্বা, রোগা, ফরসা একটি ছেলেচেতনার ও শুদ্ধতার ভাবে পূর্ণ একটি চেহারা যা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। সকাল সূর্যের আলো পড়ে তার রেশমী চুল সোনালী দ্যুতিতে চকচক করছিল। তার মুখাবয়ব, তার মহিমাকে তার গৌরবকে আলোকিত করে তুলেছিল তিনি উচ্চস্বরে জানতে চাইলেন "কিভাবে এসব হলো?" রক্ষীরা নিজেদের সাফাই দিতে শুরু করে দিলো। তিনি ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন, “এতো একটা সাধারন ছেলে । তোমরা দুজন মিলে ওকে মারছো, লজ্জার কথা!”
উনি আমার কাছে এলেন :" ভারনে, "  তারপর প্রায় চিৎকার করে বললেন," লায়োনেল ভারনে !
এইভাবে প্রথমবার আমাদের দেখা হোক এটাই কি চেয়েছিলে তুমি ? আমাদের জন্ম হয়েছিল একে অপরের বন্ধু হওয়ার জন্য। ভাগ্যের খারাপ চলন  আমাদের আলাদা করে দেয়তুমি কি সেই চিরন্তন বংশগত বন্ধুত্বের বন্ধনকে মনে করতে পারো না  যাতে আমি বিশ্বাস রাখি ; যা   শেষ অবধি আমাদের ঐক্যবদ্ধনে বেঁধে রাখবে ? "
এসব কথা তিনি যখন বলছিলেন, তাঁর আন্তরিক চোখ, আমার উপর একান্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। মনে হচ্ছিল তা যেন আমার আত্মাকেও পড়ে নিচ্ছে। আমার হৃদয়, আমার অসভ্য প্রতিশোধ পরায়ণ হৃদয়,  সেই মিষ্ট সদয়তার প্রভাব অনুভব করতে পেরে তার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলো।   তাঁর রোমাঞ্চকর কণ্ঠস্বর, মধুর সুরের মতো, এক নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি ঘটাচ্ছিল আমার ভেতরে। আমার শরীরের প্রতি রক্ত কনিকায় অনুভব করছিলাম তার অনুরণন। 

তার বন্ধুত্ব স্বীকার করে তার এই মহানতার উত্তর দেওয়ার জন্য আমার ভেতরটা ছটফট করে উঠলো।  কিন্তু বলার মতো কোনও শব্দ ছি না আমার মতো পাহাড় পর্বতে ঘুরে বেড়ানো বুনো মানুষটার কাছে ।   আমি আমার হাতদুটো বাড়িয়ে দিতে গিয়েও থমকে গেলাম।ও দুটোতে যে আমার দোষের চিহ্ন বর্তমান।  আদ্রিয়ান আমার অসহায়তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বললেন, "আমার সাথে চলো।  আমার অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। চলো, আমার বাড়িতে চলো তুমি জানো নিশ্চয়, আমি কে?
"হ্যাঁ," আমি স্তম্ভিত হয়ে বললাম।  "  আমার মনে হচ্ছে যে আমি এখন বুঝতে পারছি আপানাকে ।  আপনি আমার সব ভুল  - আমার সব অপরাধ হয়তো ক্ষমা করে দেবেন । "
আদ্রিয়ান আলতো করে হাসলেন এবং রক্ষীদের প্রয়োজনীয় আদেশ দেওয়ার পর আমার আরো কাছে এগিয়ে এলেন । আমার কাঁধে হাত রাখলেন এবং আমরা হাঁতে শুরু করলাম অট্টালিকার পথে।
এটা মোটেই তাঁর মর্যাদার অনুসারী কাজ নয়যতই হোক আমি বলতে বাধ্য সন্দেহই নেই  যে আদ্রিয়ান এসব  মর্যাদা নিয়ে মোটেই ভাবতেন না।   আর সেটাই ছিল প্রথমবার যখন আমার হৃদয় হেরে গেল এক মহান হৃদয়ের কাছে । ইচ্ছে হল নিজের সবটুকুকে ওর পায়ে নিবেদন করি। আমি একাই নই  নিশ্চয় যে একাকী  তার এই মহানুভবতা অনুভব করলাম। 
 তার সংবেদনশীলতা  এবং সৌজন্য সবাইকে মুগ্ধ করে তার চপলতা, বুদ্ধিমত্তা, এবং সক্রিয় দয়াশীল মনোভাব তাকে সবক্ষেত্রে বিজয় এনে দেয়। এই অল্প বয়সে উনি গভীর পড়াশোনা এবং উচ্চ দর্শনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এই মনোভাবের কারনেই অন্যদের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা এক অনিবার্য প্রত্যয়ের জন্ম দেয়।   এর ফলে উনি পরিণত হন সেই অনুপ্রেরনা দায়ী সুরকারে, যিনি নির্ভুল দক্ষতার সঙ্গে "মনের সুরবাহার" বাজিয়ে এক ঐশ্বরিক সুরলহরী সৃষ্টি করেন।  ব্যক্তি রুপে  তার মতো মানুষ এই বিশ্বে কমই আসে ; তার আত্মা  এমন  এক পবিত্র বন্ধনীর ভেতর অবস্থান করে যা তার কাছে কোনও অসম্মানকে পৌছাতেই দেয় না। উনি আসলে এক সামগ্রিক মানসিক সত্তা।
 এমন মানুষ যিনি তাড়াহুড়ো করে কিছু করার বিরুদ্ধে মানসিকতা পোষন করেন বুকের ভেতর।  আর এই ভাবনাই তার শক্তির উৎস। তার হাসি একটি ক্ষুধার্ত সিংহকেও পোষ মানাতে সক্ষম।  তার হাসি মুখ দেখে যে কোন সশস্ত্র সৈন্যবাহিনী নিশ্চিত তাদের অস্ত্র বিনা বাক্যব্যয়ে তার পায়ের কাছে অর্পণ করে দেবে
উনি বিভিন্ন সাধারণ বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন  যে সব বিষয়ে আমার কোনও ধারনাই  আগে কখনো ছিলো না। আমরা লাইব্রেরিতে বসে কথা বলছিলাম। পুরাতন গ্রিক ঋষিদের কথা আমায় বললেন উনিসাথে বললেন তাদের প্রেম প্রজ্ঞার এমন শক্তির কথা  যার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় মন জয়করা যায় । কক্ষটি এরকম অনেক অনেক মানুষের মূর্তি দিয়ে সাজানো ছিল। উনি আমাকে তারা কেমন মানুষ ছিলেন সে বিষয়ে এক এক করে বর্ণনা দিলেন। নীল নেত্রবিশিষ্ট ছেলেটির মধুময় কথা শুনতে শুনতে  আমার সমস্ত উদ্ধতগর্ব এবং শক্তি একটু একটু করে  কোথায় যেন মিলিয়ে  যাচ্ছিলো।  আমার মতো জংলি পাহাড়ী মানুষের কাছে যা ছিল  চাঁছাছোলা সভ্যতার খাসজমি ; যেখানে আমি কোন দিন প্রবেশ করতে পারবো না ভাবতাম সেটার দরজা যেন একটু একটু করে উনি খুলে দিচ্ছিলেন আমার সামনে। আমি একটু একটু করে সেই জগতটায় ঢুকে পড়ছিলাম আর আমার মনে হচ্ছিলো আরে এতো আমার চেনা স্থানীয় জমির মতোই। 
সন্ধ্যা নেমে আসার পর উনি অতীতের আলোচনায় মনোনিবেশ করলেন।  "আমার কিছু কথা বলার আছে , " উনি বললেন, " একটা অতীতের গল্প নতুন করে সাজানো দরকার। দরকার অনেক কিছুর ব্যাখ্যাও। যাতে হয়তো তুমি সাহায্য করতে পারবে। তোমার নিজের বাবার কথা মনে আছে? সেই মানুষটাকে দেখার আনন্দ আমি খুব বেশি না পেলে না নামটাই আমার কাছে সবচেয়ে পুরাতন জিনিষ যা আমি স্মরণ করতে পারি। আমার মনের মানসপটে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সাহসী এবং প্রিয় মানুষ। তাঁর বুদ্ধি পরিমাণে কম ছিল তাঁর হৃদয়ের উপচে পড়া ভালোমানুষীর তুলনায় ।  আর সেই ভালমানুষী তিনি নিজের বন্ধুদের প্রতি বেশী করে ঢেলে দিতেন।    সেজন্য বলতেই হচ্ছে হায়রে! নিজের জন্যও যে কিছু রাখতে হয় এটা তিনি কোনো দিন ভাবেননি ।”
 পিতার বিষয়ে তার এই অতি উচ্চপ্রশংসার কথাগুলো শুনে উৎসাহিত হয়ে আমি   জানালাম সেই সব কথা  যা আমার পিতা ও মাতার বিষয়ে আমি স্মরণ করতে পারি।   তিনি গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন আমার বাবার সেই ক্ষমা চেয়ে পাঠানো  চিঠিটার কথাও। পরিস্থিতির কারনে যা অবহেলিত হয়েছে। জানালেন , সেই সময়টার কথা যখন আদ্রিয়ানের পিতা তখনো ইংল্যান্ডের রাজা হয়েই ছিলেন।  চারিপাশে তাঁর অবস্থা তখন আরো বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে।  তার কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গেছে অনেকটাই ।  রাণীর অস্থির আচরণ ও প্রভুত রাগের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য;  তার ও  পার্লামেন্টের মধ্যে একটি মধ্যস্থতা করার জন্য তিনি চাইতেন তার পুরনো বন্ধুকে পাশে পেতে। এক অভিশপ্ত রাতে  জূয়োর টেবিলে নিজের পরাজয় সুচিত হওয়ার পর যিনি লন্ডন ত্যাগ করেছিলেনএর কয়েক বছর পর আবার তোমাদের খোঁজার চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু কোন ভাবেই কিছুর হদিশ করতে পারা যায় নি । এই খেদ সঙ্গে নিয়ে পিতা ছেড়ে গেলেন আমাদের  রেখে গেলেন তাঁর স্মৃতি । সাথে সাথেই তাঁর পুত্রের প্রতি এক  দায়িত্ব দিয়ে গেলেন বা আদেশ;  যদি কখনো সেই মূল্যবান বন্ধুর খোঁজ পাওয়া যায়  তাহলে তাদের যেন সবরকম সাহায্য করা হয়।  
কাম্বারল্যান্ডে আদ্রিয়ানের আসার কিছুদিন আগে সেই  অভিজাত ব্যক্তির, যার কাছে আমার পিতা মৃত্যুর আগে চিঠি পাঠিয়েছিলেন রাজাকে দেওয়ার জন্য,  এক উত্তরাধিকারী সিল বন্ধ সেই চিঠি  তরুণ আর্ল এর হাতে তুলে দেয়টাকে পাওয়া যায় পুরাতন সময়ের গাদাখানেক কাগজপত্রের এক বান্ডিলের ভেতর। একটি দুর্ঘটনা এই চিঠিকে পুনরায় মানুষের সামনে নিয়ে আসে। আদ্রিয়ান গভীর আগ্রহের সঙ্গে সেই চিঠি পাঠ করেন জানতে পারেন সেই প্রতিভা এবং বুদ্ধির জীবন্ত আত্মা বলে পরিচিত মানুষটার বিষয়ে এরপর তরুণ আর্ল খুঁজে পান সেই জায়গার নাম যেখানে আমার পিতা জীবনের শেদিনগুলি অতিবাহিত করেন ও মারা যান। জানতে পারেন তাদের অনাথ শিশু সন্তানদের বিষয়ে।
 এরপর আলসয়াটারে তার  আগমন এবং তার পরবর্তী সময়ের মাঝে  অনেক খোঁজ খবর নেন তিনি আমাদের বিষয়ে।   জানালেন  আমাদের উপকারের জন্য তিনি বিভিন্ন পরিকল্পনাও করে ফেলেছেন। তাঁর নিজের পরিচয় দেবার একটা প্রাথমিক উদ্যোগ তিনি করছিলেন । ইতিমধ্যে আমি তার উদ্যানে কিছু উৎপাত করি। আর এখন  আমাদের দেখাও হয়ে গেল।
যে ভব্যতার সাথে উনি আমার পিতার সম্বন্ধে  কথা বলেন তা আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশেসীমার বাইরে। স্বর্গীয় রাজার সর্বশেষ ইচ্ছার সিদ্ধি করার জন্য অতি নিপুনতার সাথে  দয়াশীলতার কর্তব্যপরায়ণতার এক চাদরে নিজেকে জড়িয়ে যে আচরণ তিনি করেন তা আমার উদ্ধত গর্বকে শীতল করে দেয় আমার আর অনেক রকম অনুভূতি হয় সেদিন তারঅভিব্যক্তির যে উদার উষ্ণতা, সম্মান উনি দেখিয়েছেন তা খুব কমই আগে পেয়েছি আমি । তার অদ্ভুত রকমের শ্রদ্ধা এবং স্নেহের প্রবাহ দিয়ে তিনি আমার পাথুরে হৃদয়কে স্পর্শ করে এক  জাদুক্ষমতায় উদ্ভাসিত করলেন এবং বের করে আনলেন এক  অক্ষয় বেগের  পবিত্র স্রোতরাত হয়ে এলো আমরা একে অপরের কাছে বিদায় নিলাম। উনি আমার হাত নিজের হাতে ধরে বললেন : "আমাদের আবার দেখা হবে; আমি চাই আগামীকাল তুমি আবার এখানে এসো । আমি সমস্ত আবেগ দিয়ে তার হাত চেপে ধরে বলার চেষ্টা করলাম , "ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন!"  আমার সমস্ত অজ্ঞতা এই একটা কথাতেই প্রকাশ পেলো ।  এই নতুন মানসিক উচ্ছলতাকে সামলানোর জন্য ওখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেলাম।
সেদিন আমি শান্ত হতে পারছিলাম না। একটা পাহাড় খুঁজতে লাগলাম যার ওপর দিয়ে  বয়ে যায় স্নিগ্ধ পশ্চিমের বাতাস আর তার মাথার ওপর  নক্ষত্রেরা তাদের দ্যূতি বিচ্ছুরন করে।
চারপাশে কি আছে সেদিকে নজর না দিয়ে  আমি ছুটেই চলেছিলাম । চেষ্টা করছিলাম শারীরিক ক্লান্তির জন্ম দিয়ে আমার ভেতরে যে আত্মা আমায় নতুন করে ঝাঁকুনি দিচ্ছে তাকে জয় করার।   বুতে পারছিলাম  "একেই বলে আসল শক্তি।  না, কঠোর হৃদয়ের এবং পেশিগত ক্ষমতার শক্তি নয়। হিংস্র এবং দুঃসাহসী শক্তি নয়! বরং কোমল সহানুভূতিশীলতার শক্তি। "
 একটু থেমে আমি এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাতের আঙুলদের জড়িয়ে ধরে একটি নতুন ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার উচ্ছ্বাসের উত্সাহ দিয়ে চিৎকার করে বল লাম, "আমার কোনও সন্দেহ আর নেইআদ্রিয়ান আমিও জ্ঞানী এবং ভালো মানুষ হতে পারবো। আর তারপরেই কোথা থেকে যেন একরাশ কান্নার দমক আমাকে ঘিরে ধর লো।
সহসা ধেয়ে আসা এই আবেগের ঝাপটা সামলে আমি অনেকটা ধাতস্থ  হলাম।  শুয়ে পড়লাম জমির ওপর এবং আমার ভাবনার লাগামকে মুক্তি দিলাম। মনের মধ্যে বয়ে যেতে থাকলো আমার অতীত জীবন; ভাঁজের পর ভাঁজ খুলে খুলে হৃদয় থেকে অনুভব করলাম  একের পর এক করে আসা ভুলগুলোকে । নিজেকে আবিষ্কার করলাম কি পাশবিক, অসভ্য এবং অপদার্থ আমি এযাবৎ নিজেকে প্রতিপন্ন করেছি। তবে এসময়ে অনুতাপ করতে ইচ্ছে হল না কারন  আমি এখন নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার আত্মা এখন  বিগত দিনগুলির পাপের বোঝা ছুড়ে ফেলে দিয়ে এক নতুন নিষ্পাপ প্রেমময় কর্মজীবন আরম্ভ করতে চাইছে ।কঠোর বা রুক্ষ কিছুই আমি চাইছিলাম না সেই ভাবনার মাঝে থাকুক। আমি যেন শিশুর মতো মায়ের আশ্রয় খুঁজছিলাম । আমার আত্মার বিনির্মাণ হচ্ছিল এক মহা শিল্পীর হাতে ।  যা আমি কখনো চাইনি আবার একে আটকানোর ক্ষমতাও আমার নেই।
এটা ছিল আদ্রিয়ানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের প্রথমদিন এবং আমি অবশ্যই এটাকে আমার জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যের দিন রুপে মনে রাখতে চাই এখন থেকে আমার পথচলা শুরু, মানুষ হওয়ার।
আমি এখন সেই গণ্ডিটাকে চিনতে পেরেছি , যার পবিত্র সীমানা ভাগ করে  মানুষের আর পশুর বুদ্ধিবৃত্তিক নৈতিক প্রকৃতি ও চরিত্রকে আমার সবচেয়ে ভালো অনুভূতিগুলোকে কে যেন  ডাক দিয়েছে আমার নতুন বন্ধুর উদারতা, প্রজ্ঞা এবং সুযোগ-সুবিধা দান নামক  জীবনের খেলায় মানানসই প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য সেই বন্ধু নিজে এক উন্নত চরিত্র ধার্মিক সত্তা । যে, শৈশব থেকে শুনে আসা তাঁর পিতার দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত এক প্রতিভাধর ও গুনী বন্ধুর ছেলের সাথে তার মানসিক ও জাগতিক ধন-ভান্ডার আনন্দের সঙ্গে ভাগ করে নিতে প্রস্তুত।
পদত্যাগ করার পর প্রয়াত রাজা রাজনীতি্র জগত থেকে সরে গিয়েছিলেন। যদিও তার পারিবারিক স্তরে   তার প্রভাব বর্তমান ছিল কিছু পরিমাণ। প্রাক্তন রাণী্র মধ্যে গার্হস্থ্য জীব পালনের কোনও গুণই ছিল না । তার সাহস দুঃসাহস যা ছিল কোনটিই তার স্বামীকে আবিষ্ট করতে পারেনি। এর জন্য তিনি
স্বামিকে ঘৃণা করতেন এবং সেই অনুভূতি কোন দিন গোপন রেন নি রাজার আশপাশ থেকে  তাঁর সমস্ত পুরানো বন্ধুদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । কোন নতুন বন্ধু তার জোটেনি যার সাথে সামান্য আলাপ আলোচনা করবেন।  সহানুভূতির এই অভাব তিনি মেটানোর চেষ্টা করেন তার নাবালক শিশু সন্তানকে আশ্রয় করে।   এটাই ছিল আদ্রিয়ানের প্রাথমিকভাবে  সংবেদনশীল মানসিকতা জন্মানোর প্রথম ধাপ। এরপরে যে কথাগুলো আদ্রিয়ান বলতেন তা বার বার শুনতে আমার ক্লান্তি বোধ হতো না। সেই সময়ে আমার বাবা একজন বিশিষ্ট ভুমিকা নিয়ে ছিলেন  আদ্রিয়ানের মানসিকতা গঠনে। তাঁর করা প্রখর মন্তব্যগুলি সেই ছোট্ট ছেলেটি পুনরাবৃত্তি করতোতাকে স্মরণ করতো তাঁর বুদ্ধি, তাঁর ভাবনা চিন্তার কারনে । তাঁর দোষগুলোকে গুনের নিরিখে ছোটো করে দেখতো। তাঁর যে ক্ষতি হতো তাকে আন্তরিকভাবে নিন্দা করতো এমনকি রানী অপছন্দ করেন জেনেও আমার পিতার প্রতি তার ছেলের শ্রদ্ধা একটুও কমেনি ।
এক তিক্ত ব্যঙ্গাত্মক ঘৃণাপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিল রানীর পক্ষে । তিনি নিষেধাজ্ঞা জারির ওপর বেশী ভরসা করতেন আর সেটাই ছিল তার ত্রুটি । রাজার একদিকে অনুগত বন্ধুত্ব এবং অন্যদিকে দুর্ভাগ্যজনক ভালোবাসার মানুষ। তার নিরীহ আচরনের প্রতি রানির অপছন্দভাব  ছিল কিন্তু সাথে সাথেই  তাঁর উপর বিশেষ অধিকার আছে এই অজুহাতে     অনুগ্রহ এবং সুবিধা নিতেও পেছপা হতেন না। অথচ বিন্দু পরিমাণ নতিস্বীকার না করার এই দ্বিমুখী আচরণ একটু বেশি মাত্রায় রাজাকে কষ্ট দিতো। মায়ের রীতিমতো রাগ দেখানো বিরোধিতাও আমার পিতার কাছে যাওয়া থেকে  আদ্রিয়ানকে আটকাতে পারেনি। কারন আমার পিতার মধ্যে সেই সব ছিল যা এক প্রকৃত মানুষের মধ্যে থাকা দরকার।   ফলে এটা মোটেই অদ্ভুত ছিলনা যখন  আদ্রিয়ান সেই প্রিয় মানুষটার বংশধরদের অস্তিত্বের কথা  জানতে পারে এবং নিজের ক্ষমতা অনুসারে  তাদের সব রকম সাহায্য দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
আমাকে খুঁজে পেয়ে যখন জানতে পারলেন আমি পরিণত হয়েছি এক পাহাড়ী ভবঘুরে মেষপালক,  চোরা শিকারী, নিরক্ষর অসভ্য মানুষে,  তবুও তিনি  নিজের  উদারতা বিসর্জন দেননি   দুঃখের সাথে স্বীকার করেন তার পিতার আমাদের প্রতি নিন্দনীয় অবহেলাই আজ আমাদের এ অবস্থার কারন।  এরজন্য তিনি যতটা সম্ভব ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করবেন।  এটাও বলেন আমার সমস্ত পাশবিক রুক্ষতার তলায় আসলে সেই আত্মার উদ্ভাস লুকিয়ে আছে যা আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আমার পিতার কাছ থেকে পেয়েছি। আর এটাই প্রমান আসলে আমার পিতা আজও বেঁচে আছেন তাঁর সমস্ত গুণ এবং প্রতিভা সঙ্গে নিয়ে, আমারই ভেতরে।
সে যাই থাকুক না কেন আমার ভেতরে, আমার উন্নতচরিত্র নতুন তরুণ বন্ধুর এই আবিষ্কার নষ্ট হয়ে যাক এটা আমি চাইতে পারবো না।
আমার এই ব্যক্তিগত ভাবনার ভিত্তিতে আমাদের পরবর্তী গতিবিধি এগিয়ে চললো।  তিনি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন তার নিজের বুদ্ধিবৃত্তির পথ চলায়। আমার সক্রিয় মানসিকতাতে নতুন ধারণাটি আমার মধ্যে জারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও  ঐকান্তিক আগ্রহে শুরু করলাম নতুন পথে দৌড়ানো প্রথম প্রথম এটা আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে এক মহা প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো হয়ে দাঁড়ালো । আমার ভেতরের একটা শক্তি চাইছিলো আমি আমার পিতার গুনাবলীকে অতিক্রম করে নিজেকে আদ্রিয়ানের বন্ধুত্বের যোগ্য করে তুলি কিন্তু জ্ঞান লাভের প্রতিএকটি আন্তরিক ভালবাসা এবং কৌতূহল আমার ভেতর নিজে থেকেই জেগে উঠলো।    সেই সূত্র ধরে  পড়াশোনা এবং গবেষণায় আমার দিন রাত কিভাবে চলে যাচ্ছিলো বুঝতেই পারছিলাম না।  ইতিমধ্যে আমি ভালোভাবে পরিচিত হয়ে গেলাম প্রকৃতির পরিদৃশ্য, ঋতু পরিবর্তন এবং আকাশ পৃথিবীবিভিন্ন চেহারাগুলোর বিষয়ে আমি সত্যি সত্যিইএকবারে চমকে গেলাম  এটা বুঝে যে কি নিদারুন বীভৎস অজ্ঞানতার পর্দা  এতদিন আমার দৃষ্টির সামনে টাঙানো ছিল । আমার জ্ঞানের পরিধি সহসা বিস্তৃত হতেই পুলকিত হলাম ।
আমি দেখলাম এই মহাবিশ্ব, শুধুমাত্র যেন আমার নিজের বাহ্যিক জ্ঞানের স্তরকেই নাড়া দিয়েছে তাই নয়  সাথে সাথেই নিজেকে অন্যদের মধ্যে বিজ্ঞতম রুপে হাজির করার একটা সুযোগ ও দিচ্ছে কবিতা এবং তার ছন্দ, দর্শন এবং তার গবেষণা   শ্রেণীবিভাগ আমার মনের ভেতরে ঘুমিয়ে  থাকা ধারনাকে জাগিয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করছে।
আমার মনে হলো আমি যেন সেই নাবিক, যে জাহাজের মাস্তল থেকে   প্রথম আমেরিকার তটভূমি দেখতে পেয়েছে। আর তার মতই আমি আমার আবিষ্কারের কথা আমার সঙ্গীদের বলার জন্য ছ করছি।  কিন্তু আমি সেরকম কোনো মনের মানুষ কে খুঁজে পেলাম না যাকে এসব বলতে পারি, যে বুঝতে পারবে আমি কি বলতে চাইছি। এমন কি পারডিটাও পারেনি আমাকে বুঝতে আমি এক এমন জগতে বসবাস করছিলাম যাকে সাধারনত বলা হয় বাস্তবতাএ যেন এক নতুন দেশে গিয়ে ঘুম ভাঙার পরের অবস্থা। সামনে যা দেখছি  সব এক্কেবারে নতুন এবং গভীর মনন যুক্ত। আমার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বোনের কাছে অবশ্য এসব ছিল পুরানো পড়ার মতো বিষয় । সে নিজেই যা জানতো তাই যথেষ্ট ছিল ওর মানসিকতায়।
সে আমার কথা শুনেছিল এমন ভাবে যেন আমি এক অভি্যানের বর্ণনা দিচ্ছি । আসলে  যে তা নয় সেটা ভালোই বুঝতে পারছিলাম। তবুও  মেনে নিয়েছিলাম ওর মানসিকতার কথা ভেবেই। আসলে এসবের ভেতরে যে একটা নতুন সার্বজনীনতার স্পর্শ আছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
আমরা উভয়েই আদ্রিয়ানকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম। অবশ্য পারডিটা তখনো কৈশোরের গন্ডী পার হয়নি ফলে  আদ্রিয়ান কেতার গুন ও আচার আচরণ অনুসারে ওর  পক্ষে যথায ভাবে পরিমাপ করতে পারাটা সহজ ছিল না যতটা আমি পারছিলাম আমি সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকছিলাম
এক মধুর প্রকৃতির স্বভাব সংবেদনশীলতা ছিল তার আচরণের ভেতর। যা আমাদের বাক্যালাপকে  দান করতো এক কোমল এবং অপার্থিব মহিমা তিনি ছিলেন  আমুদে দুষ্টু ধরনের  এক গায়ক পাখির মতো যে  অনেক উঁচু মিনারের ওপর থেকে ঈগলের মতো উড়ে আসতে পছন্দ করতো । সাথেই ভাবনায় থাকতো ঘুঘু পাখির মতো নিষ্পাপ চলন। তিনি চাইলেই পারডিটার সব সময়ের গম্ভীরতা দূর করতে পারেন ঠিক যেমন আমার নির্মম নির্যাতন কার্যকলাপ করার প্রকৃতিটাকে নির্মূল করেছিলেন।  যখন আমি ফিরে তাকাই আমার অতীত জীবনের দিকে  মনে হয় সেটা ছিল অস্থির কামনা আর বেদনাদায়ক সংগ্রামের এক দুঃস্বপ্ন । আর এখন আমি বদলে গেছি , মনে হয় যেন পরিবর্তিত হয়েছি এক নতুন রুপে।  যার তাজা চেতনা এবং স্নায়ু্র প্রক্রিয়া মনের আয়নায় মহাবিশ্বের আপাত প্রতিফলনকে বদলে দিয়েছে । কিন্তু সবটাই তা নয় ; আমার শারিরীক শক্তির বিন্দু মাত্র  পরিবর্তন হয়নি।  সক্রিয় পরিশ্রম করার জন্যআমার আকুল আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা মোটেই দমে যায় নি।  আমার পুরুষালী গুণ আমাকে ত্যাগ করে যায়নি ।
জাদুকরী ইউরানিয়া স্যাম্পসনের চুল কেটে ফেলার সুযোগ পেয়েছিল কারন স্যাম্পসন  নিজেকে তার পায়ে অর্পিত করেছিল; কিন্তু এখানে আমার সাথে যা করা হচ্ছে সব মানবিকতার সাথে কোমলতা মিশিয়ে।
আদ্রিয়ান যে আমাকে শুধুমাত্র ইতিহাস দর্শনের শীতল সত্যগুলো চিনিয়েছিলেন তা নয়। একই সময়ে তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন আমার নিজের উদ্দাম এবং অসভ্য আত্মাকে কি করে নিয়ন্ত্রন করতে হয়। তার নিজের জীবনযাত্রার পাতা মেলে ধরে ছিলেন আমার সামনে যাতে আমি বুঝতে সক্ষম হই কি বিস্ময়কর চরিত্র এই হৃদয়ের ।        
ইংল্যান্ডের প্রাক্তন রাণী অর্থাৎ আদ্রিয়ানের মা   শৈশবকাল থেকেই তার ছেলের মনে পুঁতে দিতে চেয়েছিলেন সাহসী উচ্চাভিলাষী ভাবনার ছক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রতিভা এবং প্রতিভাধরদের টপকানোর ক্ষমতা আদ্রিয়ানের আছে;  আর সেই মানস জমিতেই তিনি চাষ করতে চেয়েছিলেন নিজের মতামত এর ফসল। তিনি উৎসাহ জুগিয়েছিলেন আদ্রিয়ানের জ্ঞান আর সাহস অন্বেষনের ক্ষেত্রে।  এমনকি ছেলের দুর্দমনীয় স্বাধীনতার পক্ষেই ছিল তাঁর প্রশ্রয়। এই আশায় যে এটাই একদিন বাকিদের ওপর শাসন করার প্রধান মানসিক হাতিয়ার হয়ে দাড়াঁবে।  তিনি মনে মনে আশা পালন করতেন একদিন এই ছেলেকেই তাদের সামনে খাড়া করবেন যারা একদিন ওর পিতার পদত্যাগ করার ক্ষেত্রে প্রধান সহায়ক  হয়েছিল। যদিও তিনি সফল হননি এসব আদ্রিয়ানকে আর সমৃদ্ধ করেছে। অবশ্য কিছুটা বিকৃতির সাথেই একটি মহান এবং জ্ঞানবান দেশের শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নেওয়ার ঘোষণা  আদ্রিয়ানের ভেতরেও জেগেছিল । শুরুর দিনগুলোতে তিনি  রিপাবলিকান হয়ে ওঠেন নীতি্র দিক থেকে তাতেও তার মা হতাশ হননি শাসন করার আকাঙ্খার  উদ্ধত অহংকার  কে সামলে রেখে  ধৈর্য এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সাহায্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে পড়িয়েছেন লাগাম। মন দিয়েছেন নিজের ছেলের স্বভাব বিষয়ে গবেষণার দিকে প্রশংসা, নিন্দা, উত্সাহ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি চেষ্টা করেছেন সঠিক পথটা বেছে নেওয়ার । কিন্তু তাসত্বেও তার মনে হয়েছে সব ঠিকঠাক সুরে বাজছে না। তবু ছেলের প্রতিভায় ভরসা রেখেছেন  এবং আশায় দিন গুনেছেন এই ভেবে যে শেষের হাসিটা তিনিই হাসবেন।  ওদিকে  আদ্রিয়ান এক অন্য ধরনের নির্বাসনের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেলেন এই সময়।

প্রাক্তন রাণীর একটি মেয়েও ছিল , বয়স বারো বছর; আদ্রিয়ানের  বোনযার সাথে আদ্রিয়ান খুব একটা কথা বলতো না। সুন্দরী, প্রাণবন্ত, ছোটখাটো চেহারা , ছটফটে । নিজের সন্তানদের উন্নতচরিত্র বজায় রাখার জন্য বিধবা রানী প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার নিজের ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষজন,  ছাড়া কারো সাথে  দেখা করতেন না। আদি বাসস্থান জার্মানি থেকে আগত কিছু মানুষ এবং কয়েক জন বিদেশমন্ত্রী ছিল তার মধ্যে।
এদের মধ্যেই ছিলেন এক বিশিষ্ট মানুষ,  রাজকুমারী জাইমি , রানীর পছন্দের তালিকায়। ইংল্যান্ডে গ্রীসের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির  পক্ষের এ্যাম্বাসাডর ।  তার সাথে এসেছিলেন তার মেয়ে রাজকুমারী ইভাদনে । যে আদ্রিয়ানের বোনের সাথে উইন্ডসরক্যাসলে অনেকটা সময় অতিবাহিত করতো
এই হাসিখুশি এবং চতুর গ্রিক মেয়েটির সাথে  মেলা মেশার সময় কাউন্টেস অনেকটাই সাধারন জীবনের ছন্দে ফিরতেন তার নিজস্ব মতামত যা তিনি সব সময় নিজের ছেলে মেয়েদের ওপর চাপাতে চাইতেন    সে সবের একটা চাপ থেকে একটা ছুটি ওরা এই সময়ে অনুভব করতো। 
কিন্তু ইভাদনে এসবকে পাত্তাও দিতো না বা ভয় পেতো না তার প্রতিভা এবং চপলতা কাউন্টেসের জীবনের গতানুগতিকতায় বিন্দু মাত্র ছাপ ফেলতে পারত না ।
ইভাদনে আঠার বছর বয়সে পা দিলো উইন্ডসর ক্যাসলে একসাথে অনেকটা সময় অতিবাহিত করলেও আদ্রিয়ানের দিক থেকে কোনো দিন তেমন কোন উৎসাহ প্রকাশ দেখা যায়নি মেয়েটির গতিবিধি বিষয়ে। মানুষের সাধারণ প্রকৃতির তুলনায় তার হৃদয় এর উচ্ছ্বাস প্রকাশ ছিল চাপা ধরনের  । ইতিমধ্যেই প্রেমের একটা ছোঁয়া তার মনে লেগেছে । মাঝে মাঝেই গ্রিক সুন্দরী ওর দিকে তাকিয়ে অনুরাগ সুলভ হাসে । সব শুনতে আমার  বেশ অদ্ভুত লাগছিল , আমি আদ্রিয়ানের চেয়ে বয়সে বড়  , কোনোদিন কাউকে ভালোবাসিনি , অথচ বন্ধুর সমগ্র হৃদয় সমর্পণ এর সাক্ষী হচ্ছিলাম    কোনরকম  ঈর্ষা, উৎকণ্ঠা অথবা অবিশ্বাস ছিল না তার অনুভূতির মধ্যে; ছিল শুধু   খাঁটি ভক্তি এবং বিশ্বাস ভালবাসার প্রতি তার জীবন ডুবে যাচ্ছিলো তার প্রেমিকার অস্তিত্বর ভেতর ; তার হৃদয় পরিষ্কার ভাবে একসাথে আন্দোলিত হচ্ছিল প্রেমিকার ছন্দে । এটাই ছিল তার জীবনের একমাত্র গোপন ছন্দ - সে কাউকে ভালবাসে এবং ভালোবাসা পায় এই মহাবিশ্ব ছিল তার কাছে  একটি বসবাস যোগ্য স্থান তার প্রিয় মানুষের সাথে। সমাজের কোন নিয়ম বা বন্ধন  সুখ বা দুঃখে তাদের আলাদা করে দিতে পারবে না। যদিও ব্যক্তিগত জীবন আর সামাজিক মিলনের ব্যবস্থাকে সব সময়েই তুলনা করা যেতে পারে  এক বন্য হিংস্র জঙ্গলের সাথে ! তবুও শত ত্রুটি থাকা সত্বেও, এর বন্য মানসিকতার গভীরতায় একটি নিরুপদ্রব ফুল বিছানো পথও থাকে । যেখান দিয়ে নিরাপত্তা আনন্দে যাত্রা করা যায়।  সে রাস্তা লোহিতসাগরের দুভাগ হয়ে সৃষ্ট পথের মতো যেখান দিয়ে হাঁটলে পা ভেজে না।  কিন্তু দুপাশে যখন তখন ভেঙ্গে পড়তে পারে এমন রুক্ষ পাথরের দেওয়াল সব সময় থাকে ।
হায়! কেন আমি এই তুলনাহীন বিভ্রান্তিকর অসহায় মানবতাবোধের নমুনা্ লিপি বদ্ধ করছি ? কি আছে আমাদের মানব প্রকৃতিতে যা আমাদের সব সময় সনির্বন্ধ অনুরোধ জানায়  কষ্ট এবং দুর্বিপাকগ্রস্থ দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য?
  আমরা কেবলমাত্র আনন্দ  করার জন্য  বড় হয়ে উঠিনা;  যদিও আমরা সব সময়ে  সুখানুভবের আবেগকে অভ্যর্থনা করার জন্য উৎকীর্ণ হয়ে থাকি । হতাশা আমাদের   হার না মানা জীবনপথের চালক যে নির্মমভাবে আমাদের নিয়ে যায় অজানা বিপদের দোরগোড়ায়।   এই রকম পরিস্থিতিতে ফেঁসে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত প্রতিভাধর এই যুবকটি ছাড়া আর ভালো কাকেই বা  পাওয়া যাবে, যে ভালবাসবে আর ভালোবাসা ফেরত পাবে আর দুহাত ভরে তুলে নেবে  অবিচ্ছিন্ন আনন্দ এক প্রশ্নচিহ্নহীন আবেগের জগত থেকে?  
তার হৃদয় যদি আর কয়েকটা বছর চুপ চাপ থাকতো , ঘুমিয়ে থাকতো আবেগহীন ভাবে, হয়তো তাহলে কিছুই হতো না । কিন্তু ঘুমটা ভেঙে গেল শৈশবকালেই । সেহৃদয়ের শক্তি ছিল, কিন্তু কোন জ্ঞান ছিল না ; এ ছিল এমন এক কোমল কুঁড়ি যার ক্ষমতা নেই কঠোর তুষারপাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার।

আমি ভণ্ডামি বা তার প্রেমিককে প্রতারিত করার অভিযোগ ইভাদনের বিরুদ্ধে করছি না। কিন্তু তার লেখা প্রথম যে চিঠি দেখেছি তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে  যে সে আদ্রিয়ানকে ভালবাসতোনা চিঠিটা লেখা হয়েছিল অতি সুন্দর ভাবে কমনীয়তার সাথে । সাথেই ছিল আশ্চর্য বিদেশী ভাষার বাঁধন। হাতের লেখা অত্যন্ত সুন্দর ছিল; কাগজটা এবং তার ভাঁজে এমন কিছু ছিল ,  যা আমার মতো ভালবাসায় অনভিজ্ঞ মানুষও  বুঝতে পারছিল এটা দারুন ব্যাপার।   
অনেক পরিমাণে উদারতা, কৃতজ্ঞতা, এবং মাধুর্যতার লেখনীতে ছিল, কিন্তু কোভালোবাসা ছিল না ইভাদনে আদ্রিয়ানের চেয়ে দুবছরের বড়ো ছিলেনআচ্ছা যার বয়স আঠারো হয়ে গেছে সে খনো তার চেয়ে বয়সে ছোটোকে এতো ভালবাসতে পারে ? আমি তার পত্রের প্রশান্ত মানসিকতার ভাষার সাথে তুলনা করে দেখলাম আদ্রিয়ানের ফুটতে থাকা হৃদয়ের অভিব্যক্তিকে।   আদ্রিয়ানের লেখার ছত্রে ছত্রে তার আত্মা যেন টুকরো টুকরো হয়ে মিশে আছে । আর সেই সেই সব ভালোবাসা মাখা অক্ষরগুলো শ্বাস ফেলছে প্রতি লাইনে । যারা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তারঅংশ, ভালোবাসার জীবনের অংশকে ।  এই সব লেখা তাকে বিধস্ত করেছে।  হয়তো এসব লিখতে লিখতে তিনি হৃদয় মথিত হয়ে উঠে আসা আবেগ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কেঁদেওছেন ।

আদ্রিয়ানের আত্মার প্রতিচ্ছবি ওর মুখেই দেখতে পাওয়া যেত এবং কোনরকম রাখঢাক বা শঠতা তার সরল প্রকৃতির বিপরীত পৃষ্ঠের বাসিন্দা ছিল এভাদনে  আন্তরিক অনুরোধ জানিয়ে রেখেছিল  যে তাদের ভালবাসার কথা যেন তার মায়ের কাছে প্রকাশ না হয় অনেক ভেবে চিনতে   আদ্রিয়ান এতে রাজি হয়।    অনেক চেষ্টা করেও অবশ্য আদ্রিয়ান পারেনি  প্রাক্তন রাণীর চোখকে ধোঁকা দিতে। উনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন কিছু একটা ঘটছে নিজস্ব চারিত্রিক সতর্ক দূরদর্শিতার সাথে তিনি বিষয়টাকে নিজের মনের ভেতরেই রেখে দেন  এবং ওই আকর্ষণীয় গ্রিক কন্যার নাগাল থেকে ছেলেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করে ফেলেন।  আদ্রিয়ানকে পাঠিয়ে দেন কাম্বারল্যান্ডে। কিন্তু ইভাদনে যে নিজেদের ভেতর চিঠিপত্র বিনিময়ের ব্যবস্থা করেছিল সেটা তিনি ধরতে পারেন নি। আদ্রিয়ানের  এই অনুপস্থিতি, যা  ওদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য রানী করেছিলেন সেটা আগের চেয়েও শক্তবন্ধনে আবদ্ধ হলো যা বুঝেছিলাম তাতে আমার নতুন বন্ধু তার প্রেমিকার জন্য রাত দিন  সব ভুলতে বসেছিলেন। তার দেশ, তার প্রাচীন সংস্কৃতি , প্রাচীন স্মরণীয় সংগ্রাম ইত্যাদি সব কিছুর মহিমা তিনি এভাদনের ভাবনায় ভুলতে বসেছিলেন। হুকুম জারি হলো ইভাদনের থেকে দূরে থাকার  কিন্তু আদ্রিয়ান এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে  দৃঢ়তার সাথে মায়ের বিরোধীতার পথে হাঁটলেন ইভাদনে মেয়েলি দূরদর্শিতা দিয়ে অনুভব করেছিলেন আদ্রিয়ানের দৃঢ় মত পোষন কতটা কি করতে পারে বা পারেনা । আর এর সাথেই যুক্ত হয়েছিল সময়ের সাথে সাথে পাওয়া নানান ক্ষমতা।  কিন্তু একই সাথে এভাদনে মনে মনে দ্বিধাগ্রস্থও হচ্ছিলেন এই কথা বুঝে, যাকে আদপেই তিনি ভালবাসেন না তাকে নিয়ে আগামী দিনের স্বপ্ন দেখাটাও বোধ হয় ঠিক নয়। কারন তার উচ্ছল হৃদয় ভবিষ্যতে যে কোনো দিন অন্য কারোর দিকে ধাবিত হতেই পারে । আদ্রিয়ানকে এরপর   একবছরের জন্য   নির্বাসিতের জীবন কাটাতে হয় কাম্বারল্যান্ডে

সমাপ্ত  মূল পর্ব প্রথম অধ্যায় ২য় পরিচ্ছেদ