Search This Blog

Sunday, August 27, 2017

#প্রাচীন_সপ্তাশ্চর্যের_খোঁজ (৪৪-৬০) ৫ম অধ্যায়- “দ্বিতীয় অভিযান - লাইট হাউস” [প্রথম ভাগ] প্রতিম দাস

#প্রাচীন_সপ্তাশ্চর্যের_খোঁজ (৪৪)
শুরু হলো পঞ্চম অধ্যায় 
“দ্বিতীয় অভিযান - লাইট হাউস”
প্রতিম দাস
০০০০০০০০০০০০০০০০০


দ্বিতীয় অভিযান
লাইট হাউস
টিউনিশিয়া
১৫ই  মার্চ ২০০৬
টারটারাসের আগমনের ৫ দিন আগে
০০০০০০০
**দ্যা ফ্যারোজ - বাতিঘর**
বিশ্বের আশ্চর্যজনক বস্তুগুলোর ভেতরে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইট হাউস চিরকাল , অতি আশ্চর্যজনক ভাবে সবসময়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে এসেছে।
গ্রেট গিজার পিরামিডের চেয়ে উচ্চতায় ২৯ মিটার ছোট এবং উচ্চতার দিক থেকেও সব কিছুর ভেতরে এর দ্বিতীয় স্থান।
১৬০০ বছর ধরে এটা খাড়া দাঁড়িয়েছিল এবং নিজের কাজ করে গেছে। ১৩০০ সালে দুটো সাঙ্ঘাতিক রকমের ভূমিকম্প একে ধরাশায়ী করে দেয়। শুধু গ্রেট পিরামিড একা টিকে থাকে।
তবে এটা বলতেই হবে এই লাইট হাউস একটা ব্যাপারে পিরামিডের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । আর সেটা হলো এটা ছিল কাজের জিনিষ ।
যেহেতু এটা দীর্ঘদিন ধরে এই পৃথিবীতে থেকেছে তাই এর বিষয়ে অনেক বর্ণনা নানা জায়গায় পাওয়া যায় – গ্রীক, রোমান বা ইসলাম সাহিত্যে।
আজকের দিনের ভাবনায় কল্পনা করলে একে বলতে হবে স্কাইস্ক্র্যাপার।
বানানো হয়েছিল তিনটে বিশাল ভাগে ভাগে – উচ্চতা ১১৭ মিটার , যার অর্থ ৪০ তলা একটি বাড়ী।
প্রথম ভাগটি বর্গক্ষেত্র আকারের – যথেষ্টই চওড়া, একেবারে সলিড এবং দারুন শক্তপোক্ত। ভিত্তি প্রস্তর বলা যায়।
দ্বিতীয় ভাগটি অক্টাগনাল বা আট কোনা এবং ফাঁপা।
তৃতীয় বা শীর্ষ ভাগ সিলিন্ড্রিক্যাল বা চোঙ্গার মতো এবং এটিও ফাঁপা – যার ভেতর দিয়ে জ্বালানী নিয়ে উঠে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
কেবারে ওপরে ছিল এক অসাধারন জিনিষ । এর প্রধান আকর্ষণ। স্ট্রাটাসের মাস্টারপিস – একটা আয়না।
দশফুট উঁচু এবং দেখতে আধুনিক যুগের স্যাটেলাইট ডিসের মতো। আয়নাটাকে আটকানো ছিল  একটি বিশেষ ভাবে বানানো ভিত্তির অপর যাতে ওটা ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরতে পারে। এর ব্রোঞ্জের  উত্তল পৃষ্ঠদেশ সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে জাহাজগুলোকে সতর্ক করে দিতো এই পথের ভয়াবহতাকে । আলেকজান্দ্রিয়ার সামুদ্রিক এলাকার অসংখ্য ডুবোপাহাড়ের বিষয়ে ।
রাতের বেলায় এ বিশাল অগ্নিকুন্ড প্রজ্জ্বলিত থাকতো আয়নাটার সামনে। অন্ধকার সমুদ্রে যার আলো কুড়ি কিলোমিটার দূর থেকে দেখা যেত।  
কৌতূহলের ব্যাপার এটার ক্ষেত্রে এই যে রোডসের কলোসাসের মতোই এটাও বানানো হয়েছিল ইজিপ্টের প্রথম টলেমীর অনুরোধে । যিনি ছিলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর প্রিয় সহচর এবং জেনেরাল।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
আফ্রিকার আকাশ
১৫ই মার্চ, ২০০৬, দুপুর দুটো
টারটারাসের আগমনের ৫ দিন আগে
০০০০০
হ্যালিকারনাসসাস উড়ে চলেছে কেনিয়ার উদ্দেশ্যে।
কালো বিশাল ৭৪৭ বিমান, সারা দেহে সাজানো নানান মিসাইল ও বন্দুকের  সম্ভার। আকাশের বুকে ওটাকে দেখতে লাগছে  একটা বিরাট শিকারী পাখির মতো – যে ডানায় করে বয়ে নিয়ে চলেছে মৃত্যু।
ভেতরে ওয়েস্টের মাল্টি ন্যাশনাল টীম এখনো সুদানের অসফল মিশনের ধাক্কার জের কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
প্রধান কেবিনে – ওয়েস্ট, উইজার্ড, লিলি আর পুহ বিয়ার চুপ করে বসে ছিল। কেবিনটায় কিছু সোফার মতো বসার জায়গা, কয়েকটা টেবিল আর দেওয়ালের গায়ে রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থার সরঞ্জাম সেট করা আছে।
উইজার্ড উটে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘স্প্যানিশ সেনাদলের অ্যাটাশেকে আমি বরং একটা ক করি।  জানিয়ে দিই নডির...’
এগিয়ে গেলেন কাছের দেওয়ালে লাগানো একটা যন্ত্রের দিকে। চারকোনা স্যাট-ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করতেশুরু করলেন।
ওয়েস্ট তাকিয়ে ছিল বাইরের আকাশের দিকে। সুদানে কি কি গন্ডগোল হলো সেগুলো ভেবে যাচ্ছিলো এক মনে।
লিলি বসেছিল পুহ বিয়ারের পাশে। দেখছিল আসল ক্যালিম্যাচুসের পাণ্ডুলিপিটাকে ।
ফাজি আর বিগ ইয়ার ওই সময়ে প্লেনের পেছন দিকের খাবার ঘরে ছিল জো এর সাথে । ককপিটে স্কাই মনস্টারকে প্লেন চালনায় সঙ্গ দিচ্ছে স্ট্রেচ।
প্রধান কেবিনে লিলির নজর এখন ক্যালিম্যাচুসের দ্বিতীয় লেখাটার অপর। যেসমস্ত চিহ্নাদি ওখানে লেখা আছে সব প্রাচীন, অজানা।
সহসাই চেঁচিয়ে উঠলো লিলি, ‘জানো!’
ওয়েস্ট চমকে তাকালো। উইজার্ডও ।

‘এখানে যা লেখা আছে , সেটা আমি আগে পড়তে পারিনি। কেন তা বলতে পারবো না। কিন্তু যেভাবেই হোক এখন এটাকে বুঝতে পারছি। আগেরটা থেকেও এটা লেখনী জটিল। নতুন সব চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। অবশ্য তাতে আমার পড়তে অসুবিধা হচ্ছে না।’
ওয়েস্ট ওর কাছে এসে ঝুঁকে বললো, ‘কি লেখা আছে ওতে?’
লিলি জোরে জোরে পড়তে শুরু করলো –
‘ “বাতিঘর ।
সেই ভিত্তি প্রস্তরটাকে দেখো যেটা একসময় এক বিরাট টাওয়ারের শীর্ষ ভাগ ছিল
ইস্কেন্দারের সব চেয়ে উঁচু মন্দিরের গভীরতম ভূগর্ভস্থ কক্ষে,
সোতেরের চিত্রবিচিত্র  নৃত্য কলাভবনে,
সব কিছুর মাপ রাখত যে এরাতোস্থেনেস, তার করা কাজের ভেতরে, আকাশের তারার পর্যবেক্ষক হিপার্কাস , আর্কিমিডিস আর যন্ত্র নির্মাতা হেরন, সেখানেই তুমি খুঁজে পাবে একে “ইউক্লিডের নির্দেশ নামা”
যাকে ঘিরে আছে  মৃত্যু।” ’
লিলি ভ্রু কুঁচকালো। ‘খুঁজে পাবে একে এর একে কথাটা কাটা আছে। যার বদলে ইউক্লিডের নির্দেশনামা কথাটাকে বসানো হয়েছে । আমি জানিনা এটা কি বলতে চাইছে।’
উইজার্ড বললেন , ‘আমি বুঝেছি।’ এগিয়ে গেলেন পেছনে রাখা একটা  হাইটেক স্টেইনলেস ষ্টীল এর ট্রাঙ্কের দিকে । খুললেন ওটাকে। একটা ভ্যাকুয়াম টাইট কিছু খোলার মতো হিসসস শব্দ শোনা গেল। ট্রাঙ্কটার ভেতরে অসংখ্য গোল গোল নলের মতো গর্ত। প্রত্যেক গর্তে রাখা আছে একটা করে প্রাচীন গোল করে গুটানো পুঁথি । এ উইজার্ডের এক বিরাট মাপের অমূল্য সংগ্রহ – অন্তত ২০০ টা পুঁথি আছে ওখানে।
‘সূচিপত্রটা কোথায় গেল/ হ্যাঁ পেয়েছি , এই যে।’ ট্রাঙ্কের ঢাকনার একপাস থেকে টেনে বার করলেন একটা কম্পিউটার প্রিন্ট আউট। বেশ লম্বা একটা তালিকা। ‘ইউক্লিডের নির্দেশ নামা ... ইউক্লিডের নির্দেশ নামা। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে আমি এই শিরোনামটা আগে দেখেছি। হ্যাঁ যা বললাম তাই, এই তো। একটু অপেক্ষা করো।’
উইজার্ড এবার তাকালেন পুঁথির গর্ত গুলোর দিকে। এর ই মধ্যে লিলির বলা কথা গুলোর একটা টাইপ প্রিন্ট করে ফেললো।
স্ট্রেচ প্রবেশ করলো ঘরে । কিছু একটা যে হচ্ছে এটা বুঝে নিয়ে জানতে চাইলো, ‘ কি হচ্ছে জানতে পারি কি?’
‘আমরা নতুন একটা পথের সন্ধানে এগোচ্ছি,’ওয়েস্ট উত্তর দিলো। লিলির বলা কথা গুলোর ভেতর থেকে একটা লাইন পড়লো। ‘ “সোতেরের   চিত্রবিচিত্র  নৃত্য কলাভবনে” ।   নৃত্যকলা ভবনে , অর্থাৎ হাউস টু দ্য মিউজ । যার অর্থ মিউজিয়ন বা মিউজিয়াম। সোতের হলেন প্রথম টলেমী । সোতেরের মিউজিয়ন অর্থাৎ আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী বা গ্রন্থাগার। যেটাকে সে সময় মিউজিয়নও বলা হতো।’
‘তার মানে,’ পুহ বিয়ার বললো, ‘আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর গভীরতম কবরখানায়, ওই কাজগুলোর বিষয়ে উল্লেখ করা আছে । আমাদের খুঁজে বের করতে হবে  একটা ভিত্তি প্রস্তর যা কোন সময় লাইট হাউসের ওপরে থাকতো। সেটা যাই হোক না কেন। কিন্তু আমারতো মনে হয় সেই লাইব্রেরি কোন অতল অতীতে হারিয়ে গেছে।’
‘একদম ঠিক,’ জো বললো, প্রধান কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে। ’৪৮ খ্রীষ্ট পূর্বে রোমানরা সেই কাজটা করে। প্রাচীন পৃথিবীতে বিবলিওটেকা আলেকজান্দ্রিনা ছিল সকলরকম শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু  ৭০০০০০ এর বেশী পুঁথি ছিল ওখানে। সাথেই ছিল   ইতিহাসের কিছু অসাধান মনীষীদের লেখনী। রোমানরা ওটাকে মাটিতে মিশিয়ে দেয় ।’
ওয়েস্ট এর টাইপ করা কাগজটাকে দেখলো জো। ‘বাপরে, নামগুলো দেখো একবার। মনে হচ্ছে ইতিহাসের সেরা চিন্তাবিদদের তালিকা বানানো হয়েছে। এরাতোস্থেনেস, সেই মানুষ যিনি এই পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করে ছিলেন। হিপ্পারকাস বানিয়েছিলেন মানচিত্র, সমস্ত নক্ষত্র মণ্ডলীর। আর্কিমিডিস আয়তন নির্ণয়ের পথের সাথে সাথে কতোরকমের সুত্র আবিস্কার করেছিলেন ইয়ত্তা নেই। আর হেরন। অসাধারন মানুষটা আবিষ্কার করেছিলেন কগ হুইল  বা দাঁত ওয়ালা বিয়ারিং এবং একটা আদিম ষ্টীম ইঞ্জিন। জেমস ওয়াটের জন্মের ও ২০০০ হাজার বছর আগে।’
পুহ বিয়ার জানতে চাইলো, ‘এখন এর কি খবর?’
জো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ‘লাইব্রেরিতো কবেই ধ্বংস হয়ে গেছে। কত শত বছর আগে, আজকের আধুনিক আলেকজান্দ্রিয়ার তলায়। ওদের জানা ছিলো কোথায় ওটার অবস্থান ছিল- ইজিপশিয়ান সরকার আধুনিক কালে একটা নতুন লাইব্রেরী বানিয়েছে পুরোনো লাইব্রেরীর জায়গাটা থেকে কিছুটা দূরে। তবে রোমানরা তাদের কাজটা ভালোভাবেই করেছিল। ঠিক যেমনটা করেছিল কার্থেজে ওর শখানেক বছর আগে। লাইব্রেরির অস্তিত্বকেই শেষ করে দিয়েছিল একেবারে । একটা ইট , একটাও লেখনী বা ভূগর্ভস্থ কক্ষের  অস্তিত্ব আজ আর নেই।’
‘তার মানে সব পুঁথিই নষ্ট হয়ে গেছে, তাহলে?’
‘হ্যাঁ অনেক নষ্ট হয়ে গেছে এটা যেমন সত্যি তেমনই অনেক পুঁথি লাইব্রেরী থেকে সরিয়েও ফেলা হয়েছিল রোমান আক্রমণের খবর পেয়ে। কোন এক গোপনস্থানে সেগুলোকে নিয়ে চলে যাওয়া হয়। অ্যাটলাস পর্বতের অভ্যন্তরে – আজ অবধি অফিশিয়ালি সে সবের কোন খোঁজ মেলেনি।‘
এই কথা বলার সময় জো তেরছা একটা চাহনিতে উইজার্ড আর ওয়েস্টের দিকে তাকালো।
‘এরকম ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে পেলে যে সবাইকে তার কথা জানাবে সেটা নাও হতে পারে,’ ওয়েস্ট উত্তর দিলো।
‘মানে --?’ পুহ বিয়ার  , উইজার্ড যে পুঁথি গুলো নাড়াচাড়া করছেন সেগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমরা কি এটাই বলতে চাইছো যে ওই পুঁথিগুলো –’
‘এই যে! পেয়ে গেছি!’ উইজার্ড বলে উঠলেন।
  গর্তগুলোর ভেতর থেকে একটা প্রাচীন পুঁথি বা করলেন। দারুন সুন্দর সেটার গঠন । গুটিয়ে রাখার দন্ডটার দুপাশে রত্ন খচিত। পুঁথিটার রং ঘন ক্রীমের মতো।
উইজার্ড ওটাকে খুলে, পড়তে শুরু করলেন।
‘হুম ম ম, গ্রীক অক্ষর। অন্যান্য ইউক্লিডিয়ান লেখনীর সাথে মিল আছে ভালোই। ইতিহাসের অন্যতম সেরা অঙ্কবিদ, ইউক্লিড। সমতল জ্যামিতির আবিষ্কারক। এক্স আর ওয়াই অ্যাক্সিস ব্যবহার করে যা উনি বুঝিয়েছেন সহজভাবে, আসা করছি তোমরা জানো। এই পুঁথি যে ওর লেখা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। । এটার শিরোনাম “নির্দেশনামা” । যার অর্থ এটাই সেই ইউক্লিডের নির্দেশনামা, অন্তত আমার মতে।‘
‘ওটায় কি বলা আছে?’

পুহ বিয়ার জানতে চাইলো।
০০০০০০০০০০০০০০০০০

উইজার্ড কিছুক্ষন ধরে পুঁথিটা পড়লেন । ‘ যা বুঝছি তাতে এর ভেতরে ইউক্লিড তার আর কিছু অসাধারন আবিষ্কার লিপিবদ্ধ করে গেছেন। প্রাচীন আশ্চর্য বা গোল্ডেন ক্যাপস্টোনের কোনো খবর এতে নেই।’
ওয়েস্ট বললো, ‘ধ্যাত তেরে কি।’
‘নিকুচি করেছে জ্যামিতির,’ জো বললো।
‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও ...’ উইজার্ড হাত তুললেন। ‘এটা দেখো।’
পুরো পুঁথিটা গুটিয়ে নিয়ে একেবারে নিচের অংশটা দেখালেন, যেখানটায় ওটা গিয়ে নিচের দন্ডটায় ঠেকেছে। খুদি খুদি অক্ষরে ওখানে হাতে লেখা কিছু নোটের মতো আছে  বলে মনে হচ্ছে। 
পুঁথির নিচের সেই অংশে কিছু লাইন লেখা আছে। ধ্রুপদী গ্রীক ভাষা নয় সেটা। রং অন্য কোন একটা ভাষা। কিউনিফরমের স্টাইলে লেখা থথের শব্দাবলী । এই রকম দেখতে –
‘লিলি ?’ উইজার্ড ডাকলে  লিলি কিছুক্ষন  মন দিয়ে লেখাটাকে দেখলো, তারপর পড়তে শুরু করলো –

‘ “রোমান আক্রমণের আগে ভিত্তিপ্রস্তর সরিয়ে নেওয়া হয়,
নিয়ে যাওয়া হয় হ্যামিলকারের ভুলে যাওয়া বাসস্থানে   ।
ফিনিশিয়ানদের ভয়ানক খাঁড়ি পথ অনুসরণ করো
দুই ত্রিফলার অবস্থানে
দেখতে পাবে সহজ প্রবেশ পথ,
ষষ্ঠ মহান স্থপতির অসাধারন কাজ।
সপ্তমটা ওখানেই আছে তখন থেকে।”’

আবার সেই শব্দটা,’ পুহ বিয়ার বললো, ‘ভিত্তি প্রস্তর। ওরা ওটাকে ভিত্তিপ্রস্তর বলছে কেন?’
ওয়েস্ট কথাটায় কান দিলো না। উইজার্ডের দিকে ঘুরে তাকালো, মুখে উত্তেজনার ছাপ। ‘ক্যালিম্যাচুসের পাণ্ডুলিপি ফ্যারোজের টুকরোটা কোথায় আছে সেটা জানায়নি ...’
‘না,’ উইজার্ড বললেন। ‘সেটা লেখা এই পুঁথিতে। আএ এই পুঁথির আর কোনো কপি নেই। যার অর্থ –’
‘ – ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব নয় ওই টুকরোটা কোথায় রাখা আছে। এর একটাই অর্থ ম্যাক্স, এইটা খুঁজে আনার জন্য আমাদের কারোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে না।’
ওরা দুজনে একে ওপরের দিকে এক স্বস্তির উত্তেজনা ও আনন্দের চোখে তাকালো।
‘দারুন ব্যাপার বলতেই পারি,’ ওয়েস্ট হেসে বললো। ‘এটাই আমাদের কাছে একটা বিরাট সুযোগ এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার।’
০০০০০

হ্যালিকারনাসসাস ভোরের বেলায় , নামলো লিবিয়ার উত্তর সমুদ্রতটে।   সাদা একটা দীর্ঘ রেখার মতো ভুমধ্যসাগরের জল আছড়ে পড়ছে উত্তর আফ্রিকার মরুভূমির সাথে লেগে থাকা সাগর পাড়ে।
বিমানের ভেতরে ওয়েস্ট, উইজার্ড আর জো ইউক্লিডের নির্দেশনামা নিয়ে দ্রুত একটা সমাধান বার করায় মগ্ন।
‘ ফিনিসিয়ান এটা ছিল কার্থেজের অধিবাসীদের আর এক নাম – যে বানিজ্যিক শহরটাকে তছনছ করে দিয়েছিল রোমানরা তৃতীয় থা শেষ পিউনিক যুদ্ধে। সেই কার্থেজ হল আজকের আধুনিক দিনের টিউনিশিয়া। ইতালীর একেবারে দক্ষিনে, ভুমধ্যসাগর পা হয়ে,’ উইজার্ড জানালেন।
‘আর হ্যামিলকার হলো হ্যামিলকার বারকা,’ ওয়েস্ট বললো, ‘ হ্যানিবলের বাবা, প্রথম পিঊনিক যুদ্ধে যিনি ছিলেন কারথেজ সেনাদলের অধিনায়ক। আমি অবশ্য জানি না যে তিনি একজন উদ্বাস্তু ছিলেন কিনা। তবে মানুষটাকে খুব কমজনই মনে রেখেছে।’
জো বললো, ‘হ্যামিলকার মারা যায় স্পেনে ২২৮ খ্রিষ্ট পূর্বে, দ্বিতীয় আর তৃতীয়  পিনিক যুদ্ধের মাঝা মাঝি সময়ে। মনে হয় উনি একটা দূরবর্তী কোন স্থানে দুর্গ বানানোর আদেশ দিয়েছিলেন , যেখানে আর ওর যাওয়া হয় নি।’
উইজার্ড কম্পিউটার নিয়ে বসে পড়েছিলেন। ‘আমি খুঁজে দেখছি আমার ডাটাবেসে হ্যামিলকারের ভুলে যাওয়া বাসস্থান বিষয়ে কোন তথ্য আছে কিনা। আর একটা তথ্য অবশ্য ইতিমধ্যেই পেয়েছি । “ভয়ানক খাঁড়ি পথ” নামটা ব্যবহার করতো আলেকজান্দ্রিয়ার নাবিকেরা আজকের টিউনিসিয়ার সমুদ্রতটকে বোঝাতে। একশো মাইলের এ সামুদ্রিক এলাকায় শুধু পাথুরে খাঁড়ি – যার উচ্চতা ৪০০ ফুট, খাড়া দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের অপর। বিংশ শতকেও এটা জাহাজ দুর্ঘটনার অন্যতম বিপদজনক এলাকা বলে চিহ্নিত। বাপরে! ওই সমুদ্রতটের কাছে কোনোভাবে যদি জাহাজ ডুবি হয় জল ছাড়া আর কোথাও নামার পথ নেই ওই পাথুরে দেওয়ালের জন্য। এক হাত শুকনো স্থলভুমির খোঁজ আসেপাশে কোথাও মিলবে না। যেকারনেই  টাকে যে ওই নামে ডাকা হতো তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।’
ওয়েস্ট জানালো, ‘ষষ্ঠ মহান স্থপতি হলেন ষষ্ঠ ইমহোটেপ । উনি অন্তত ১০০ বছর বেঁচে ছিলেন পঞ্চম ইমহোটেপ সেই বিখ্যাত ফাঁদ বিশেষজ্ঞ নির্মাতা মারা যাওয়ার পরেও। আসোয়ানের কাছের ফিলেই তে দ্বীপ-মন্দির এর সুরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। ওনার পরিচিত ছিল জলের তলা দিয়ে প্রবেশপথ বানানোর বিষয়ে। শধু মাত্র ফিলেই এর মন্দিরেই ওই ধরনের ছ’টা প্রবেশ পথ আছে।’
স্ট্রেচ বলে উঠলো, ‘ একটা কথা, আমি তো জানতাম ইজিপশিয়ান সভ্যতা শেষ হয়ে যায় পিউনিক যুদ্ধের সময়েই।’
‘এ একটা সাধারন ভ্রান্ত ধারনা, ‘ উইজার্ড উত্তর দিলেন। ‘মানুষ ভাবতে ভালবাসে প্রাচীন গ্রীক, রোমান এবং ইজিপশিয়ান সভ্যতা আলাদা আলাদা ভাবে বর্তমান ছিল। একের পর এক। কিন্তু এটা সত্যি নয়। একদমই না । ওরা ছিল একে ওপরের সাথে মিলেমিশে । যখন রোম কার্থেজের সাথে পিউনিক লড়াই লড়ছে , ঠিক সে সময়ে টলেমিদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠছে ইজিপ্ট। সত্যি কথা বলতে হলে বলতে হয় স্বাধীন ইজিপ্টের অস্তিত্ব ছিল সপ্তম ক্লিওপেট্রা পর্যন্ত। সেই বিখ্যাত মহিলা যিনি রোমানদের কাছে ৩০ খ্রিষ্ট পূর্বে পরাজিত হন।
পুহ বিয়ার এবার জানতে চায়, ‘ওই ত্রিফলার ব্যাপারটা কি?’
‘আমার ধারনা ওটা বিশেষ কিছু সামুদ্রিক পাহাড়ের একত্রীকরণ এর ফলে সৃষ্ট আকৃতি,’ উইজার্ড বলেন। ‘ একটা চিহ্ন । তিনটে পাশা পাশা পাশি তীক্ষ্ণ শীর্ষ পাথরকে একসাথে ত্রিফলার মতোই দেখতে লাগে। যেটা নির্দেশ করছে সেই ভুলে যাওয়া বাসস্থানকে।’
‘একশো মাইল বিস্তৃত পাথুরে সাগরতট,’ পুব বিয়ার আর্তকণ্ঠে বললো। ‘কয়েকদিন লেগে যাবে জায়গাটা ভালো করে দেখার জন্য যদি নৌকা নিয়েও যাই। আমাদের হাতেতো অত সময়ই নেই।’
‘না,’ ওয়েস্ট বললো। ‘সত্যিই সময় নেই। কিন্তু আমি নৌকায় করে জায়গাটা দেখার ভাবনা তো ভাবছি না।’
এক ঘণ্টা বাদে হ্যালিকারনাসসাসকে উড়তে দেখা গেল টিউনিশিয়ার সমুদ্রতটের অপর দিয়ে। সমান্তরাল ভাবে, পশ্চিমদিক অভিমুখে। এর মাঝেই ওটার পেছনদিকের সেই ঢালু র‍্যাম্পটা খুলে যেতে  দেখা গেল। ভেতর থেকে ছোট্ট এক অবয়ব আকাশের বুকে লাফ মেরে নিচে নামতে শুরু করলো।
একটা মানুষ।
ওয়েস্ট।
মাথা নিচের দিকে করে নেমে চলেছে নিচে। পুরো মুখটা ঢাকা এক অদ্ভুত রকমের এরোডাইনামিক অক্সিজেন সরবরাহকারী হেলমেটের ভেতরে।
আসল জিনিষটা যেটা দেখার, সেটা ওর পিঠে লাগানো আছে।
এক জোড়া অতি হাল্কা কার্বন নির্মিত পাখনা।
২.৬ মিটার বিস্তৃত পাখনা বা ডানা দুটোর দুপ্রান্ত বাঁকানো এবং  ঠিক মধ্যের অংশটা ফোলা [যেখানে রাখা আছে একটা প্যারাস্যূট]। সাথেই লাগানো আছে ছ’টা কমপ্রেসড-এয়ার থ্রাস্টার। যেগুলোর সাহায্যে ইচ্ছে মতো উড়ে যাওয়া যাবে যদি কোন কারনে ওটার নিজের ওড়ার পদ্ধতিতে সমস্যা হয়।
ওয়েস্টের বুলেট আকৃতির ডানাওয়ালা শরীর শনশন শব্দে হাওয়া কেটে ওপর থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে রকেটের গতিতে নেমে আসছিলো।
ভয়ানক পাথুরে সমুদ্র পাড় ওর নজরে এলো।
হলদে রঙের সুউচ্চ পাথরের দৈত্যাকার অনড় খাড়া দেওয়াল নীল সমতল সমুদ্রের পাশে অবস্থান করছে।  একের পর এক ঢেঊ এসে আছড়ে পড়ছে ওটার গায়ে। বিন্দু বিন্দু জল কনার বিশাল বিশাল মাপের স্প্রে অতি জোরালো ভুসভুসে শব্দ তুলে ছিটিয়ে যাচ্ছে চারদিকে।  
ওয়েস্ট নামছে ১৮০ কিমি প্রতি ঘণ্টার গতিতে, ৮০০ ফুট মতো বাকি আর ...
...সহসাই ভেসে গেল গতি বদলে ওপরের দিকে এবং একটা নিয়ন্ত্রিত উড়ান শুরু করলো।
আপাতত ওয়েস্ট ভাসছে ভুমধ্য সাগরের ঢেউয়ের ৩০০ফুট ওপরে একেবারে পাথুরে দেওয়ালের সমান্তরালে ।
ভেসে যাচ্ছে টিউনিশিয়ান-লিবিয়া সীমান্তের কাছ দিয়ে , একটা বিসদৃশ অংশ এটা উত্তর আমেরিকান সমুদ্র তটরেখার। চওড়া বালির তট পাথুরে খাড়া দেওয়ালের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে। কিছুটা  দূরেই দেশের অভ্যন্তরীণ এলাকা। ওই সমতল ভুমির সাথে জুড়ে আছে একটা পাহাড়ের সারি। যাদের উৎপত্তি হয়েছিল কিছু আগ্নেওগিরির কারনে। ওই পাহাড়ের সারিও এই সমুদ্রতটের  সাথে পাশাপাশি চলেছে ।
এ এক এমন এলাকা যেখানে জীবনের চিহ্নমাত্র নেই। রুক্ষ । উর্বরতার লেশ মাত্র নেই। এখানে কিছুই জন্মায় না।
উড়তে উড়তেই ওয়েস্ট দেখে যাচ্ছিলো পাথুরে দেওয়ালের মাথাগুলোকে।  এমন কোন একটা জায়গা যেখানটা দেখে মনে হবে দুটো ত্রিফলা একসাথে অবস্থান করছে।
অন্তত দশ মিনিট ওড়ার পর ওর স্বাভাবিক উড়ানের গতি ব্যাহত হলো। চালু করে দিলো একটা কমপ্রেসড-এয়ার থ্রাস্টার  । একটা তীক্ষ্ণ হিসস-অয়াপ ধরনের শব্দ করেই ওয়েস্টের শরীরটা বেশ কিছুটা ওপরের দিকে উঠেগেল। ফলে ওর কাছে আর অনেকটাই সুযোগ বেড়ে গেল ভেসে থাকার।
আরো চল্লিশ মিনিট কেটে যাওয়ার পর   – আরো তিনটে এয়ার থ্রাস্টার চালু করতে হয়েছে এর মধ্যে – ওর  নজরে এলো ও যা খুঁজছিল।
দুটো পাথুরে দ্বীপ সামুদ্রিক পাথরের খাড়া দেওয়াল থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।  তিন আঙুলওয়ালা দুটো মানুষের হাত যেন আকাশের দিকে আঙুল তুলে আছে। বা একটা ত্রিফলা ।
দুটো পাশা পাশি ত্রিফলা।
ওই দুটোর পেছন দিকে যে পাথুরে দেওয়াল নজর আসছে তা ভয় পাওয়ার মতোই – একেবারে খাড়া এবং রুক্ষ এবড়ো খেবড়ো। ওর ওপরের অংশটা দেখে মনে হচ্ছে ভিত্তির ওপর যেন ঝুলে আছে। ওটায় চড়া অতি কঠিন বোঝাই যাচ্ছে।
ওয়েস্ট রেডিও মাইক্রোফোনে জানালো, ‘ উইজার্ড! কাম ইন! আমি খুঁজে পেয়েছি!’
আরো এক ঘণ্টা পর। হ্যালিকারনাসসাস নেমেছে এই বালুতটে। ওটার পেটের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো  একটা চারচাকা ওয়ালা ল্যান্ড রোভারআর সাথেই দক্ষিন দিকে একশো মাল দূরের এক জায়গার উদ্দেশ্যে উড়ে চলে গেল ওটা।
ল্যান্ডরোভারের ঝাঁকুনি খেতে খেতে এসে ওয়েস্টের সাথে যোগ দিলো দলটা – হাওয়া বিধ্বস্ত পাথুরে  দেওয়ালের ওপরে দাঁড়িয়ে ওয়েস্ট তাকিয়ে ছিল জোড়া ত্রিফলার দিকেদলে এখন সাত জন । আহত ফাজি বিমানের ভেতরেই থেকে গেছে স্কাই মনস্টারের সাথেহোরাসও আছে ওখানে। বিগ ইয়ার্স আহত হয়েছিল তবে ও চলে ফিরে বেড়াতে পারছে অনেকগুলো নানান রকম পেইন কিলারের কল্যাণে।
হিসাব মতো ওরা এখন টিউনিশিয়াতে। আশে পাশে চারদিক ফাঁকা এবং শুকনো। কোনো দিকেই পঞ্চাশ মাইলের ভেতরে কোন গ্রাম বা মানুষের বসতি নেই।
সোজা কথায় একে চাঁদের জমির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সমতল বালুতট, মাঝে মাঝে উল্কাপাতের ফলে সৃষ্ট খাদের মতো গর্ত এবং অবশ্যই সার সার পাহাড় মূল অন্তর্বর্তী ভুখন্ড  আর এই জায়গার মাঝে  অন্তত এক কিলোমিটার   জুড়ে দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
বিগ ইয়ার্স বললো, ‘জানো বোধ হয়। স্টার ওয়ার্স সিনেমার শ্যূটিং এই টিউনিশিয়াতে হয়েছিল। তাতুইনের দৃশ্যগুলো।’
সমুদ্রের দিক থেকে নজর না সরিয়ে ওয়েস্ট বললো, ‘ভালোই বুঝতে পারছি কেন ওরা জায়গাটা বেছে নিয়েছিল। এ একেবারে ভিনগ্রহের এলাকার মতোই দেখতে।’
উইজার্ড ওয়েস্টের কাছে এসে বসলো। হাতে একটা প্রিন্ট আউট দিলো । ‘ আমার ডাটাবেসে হ্যামিলকারের ভুলে যাওয়া বাসস্থান বিষয়ে এই তথ্যটুকুই শুধু আছে। এটা প্যাপিরাসের ওপর একটা হাতে আঁকা স্কেচ । পাওয়া গিয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার এক শ্রমিকের কুটিরে । ইজিপশিয়ান শ্রমিক । যত দূর মনে হচ্ছে ওই শ্রমিক ষষ্ঠ ইমহোটেপের সেই শ্রমিকদের দলে ছিল যারা হ্যামিলকারের ভুলে যাওয়া বাসস্থানের পুনঃ নির্মাণ করেছিল।’
প্যাপিরাসের ওপরের আঁকাটা বেশ যত্ন নিয়ে করা হয়েছিল এটা বোঝা যাচ্ছে –
কিন্তু বলা খুব মুস্কিল ঠিক কিসের ছবি এখানে আঁকা হয়েছে। ওপর এবং নিচের দিকে কাটা থাকায় সম্ভবত এটা পুরো জিনিষটাকে দেখাতে পারছে না।
‘জল বয়ে যাওয়ার সুড়ঙ্গ বা নালি এবং রক্ষীদের টাওয়ার,’ ওয়েস্ট বললো, ‘ আর একটা খনন করা হয়েছিল এমন সুড়ঙ্গ যা আবার বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাপরে বাপ , যা দেখছি তাতে তো মনে হচ্ছে এটা একটা বিরাট ব্যপার।’ চারদিকটা ভালো করে দেখলো। নির্জন মরুভূমি আর রুক্ষ সমুদ্রতট ছাড়া কিছুই নেই আশে পাশে।  ‘কিন্তু এতো বিশাল মাপের একটা জিনিষ। কোথায় তার চিহ্ন?’
ইউক্লিডের নির্দেশ নামার প্রিন্ট আউটটা বার করলো।
“ফিনিশিয়ানদের ভয়ানক খাঁড়ি পথ অনুসরণ করো
দুই ত্রিফলার অবস্থানে
দেখতে পাবে সহজ প্রবেশ পথ,
ষষ্ঠ মহান স্থপতির অসাধারন কাজ।
সপ্তমটা ওখানেই আছে তখন থেকে।”
‘ “দুই ত্রিফলার অবস্থানে” ওয়েস্ট উচ্চারন করলো লাইনটা । ‘আমরা দুই ত্রিফলা খুঁজে পেয়েছি, অতএব ওর ধারে কাছেই কোথাও প্রবেশপথটাও থাকবে। কিন্তু কিছুইতো নজরে আসছে না। এখানে শুধু অনন্ত বিস্তৃত সমুদ্রতট ছাড়া আর কিছুই নেই।’
সত্যিই তাই।
কোনোরকম খাঁড়ি বা প্রবেশ পথ কাছে পিঠে এই সমুদ্রতটের কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
‘দাঁড়াও দাঁড়াও ... অত হতাশ হচ্ছো কেন ...’ এপ্পার বললেন।
নিজের র‍্যুক স্যাক হাতড়ে বার করলেন একটা ট্রাইপড লাগানো যন্ত্র।
‘সনিক –রিজনেন্স ইমেজার,’ বালির ওপর ট্রাইপডটাকে বসাতে বসাতে বললেন। তারপর ওটাকে নিচের দিকে তাক করে একটা স্যুইচ টিপলেন। ‘এটা আমাদের পায়ের নিচের জমির ঘনত্বর পরিমাপ করে দেখাতে সক্ষম।’
সনিক –রিজনেন্স ইমেজার তার সংকেত দিতে শুরু করলো।
পিইইইং-পিইইইইইইং-পিইইইইইং ।
‘একেবারে সলিড বেলেপাথর । যত দূর পর্যন্ত এই যন্ত্র  ভূগর্ভস্থ ইমেজ ধরতে পারছে তাতে এটাই জানা যাচ্ছে ।’ উইজার্ড বললেন। ‘ঠিক যেমন তুমি ভাবছো।’
এবার উনি ট্রাইপডের ওপরে রাখা ইমেজারটাকে ঘুরিয়ে কিছু গজ দূরে পশ্চিম কোনে একটা স্থানে তাক করলেন। এমন একটা স্থান ওটা যেখানে দুই ত্রিফলার সাথে সমুদ্রতটের রেখা মিশেছে-
পিং-পিং-পিং-পিং-পিং-পিং ...
ইমেজারের স্ক্রিনে লেখা ফুটে ওঠে ।
ওয়েস্ট উইজার্ডের দিকে ঘুরে বলে, ‘এর কি মানে?’
বৃদ্ধ মানুষটা তাকালেন ডিসপ্লে স্ক্রিনের দিকে । ওখানে লেখা
TOTAL DEPTH : 8.0 M.
SUBSTANCE ANALYSIS : SILICON OVERLAY 5.5 M;
GRANITE UNDERLAY 2.5 M.
ঊঈজাড়দ বললেন, ‘এখানে গভীরতা আট মিটার। বালি আর গ্র্যানাইটের টুকরো এক সাথে মিশে আছে শক্ত হয়ে।‘
‘আট মিটার?’ পুহ বিয়ার বলে উঠলো, ‘সেটা কি করে হতে পারে? আমরা এই মুহূর্তে আছি সমুদ্রতল থেকে ১৩০ মিটার ওপরে। যার অর্থ ওই এলাকাটার নিচে ৯২ মিটারের একটা ফাঁকা জায়গা আছে জমির নিচে –’
‘ধুসস, সেটা হতেই পারে না ...’ ওয়েস্ট বললো কথাটা বুঝতে পেরে।
উইজার্ড বললেন, ‘হতেই পারে ...’ ওদিকে তাকিয়ে।
ওয়েস্ট ঘুরে তাকালো মূল ভূখন্ডের দিকে । যেদিকে বালিময় সমুদ্রতট গিয়ে মিশেছে কাছের পাহাড়ে। অন্তত এক কিলোমিটার দূরে । বালুতট দেখে মনে হছে অনন্ত তার বিস্তার। বললো, ‘১০০০০ মানুষ যদি কাজ করার জন্য থাকে তাহলে অনেক আশ্চর্যই করে ফেলা যায়।’
‘মানে? কি বলতে চাইছো?’ পুহ অবাক হয়ে জানতে চাইলো। ‘ তোমরা দুজন বুদ্ধিমান মানুষ আসলে কি ভাবছো সেটা আমাদের মতো সাধারন মানুষদের দয়া করে যদি  খুলে বলো তো ভালো হয়।’
ওয়েস্ট হাসলো। ‘পুহ, একসময় এখানে একটা প্রবেশপথ ছিল। যা মনে হচ্ছে সেটা একটা সংকীর্ণ ফাটল হিসাবে ছিল ওই খাড়া পাথুরে দেওয়ালের গায়ে। যা মূল ভুখন্ড থেকে একে আলাদা করে রেখেছে।।’
‘কিন্তু সেটা এখন আর এখানে নেই,’ পুহ বললো। ‘একটা গোটা প্রবেশ পথ অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে , কিভাবে?’

‘খুব সোজা,’ ওয়েস্ট বললো। ‘অদৃশ্য করা হয়নি তো। ওটা এখানেই আছে। লুকানো আছে। ১০০০০ মানুষের শ্রম সেটা করেছে এক সময়ে। ক্যাপ স্টোনের রক্ষক একটা ছাদ বানিয়ে দিয়েছে সেই প্রবেশ পথের ওপর। পাথর গেঁথে বন্ধ করে দিয়েছে প্রবেশ দ্বার। তারপর সেটাকে পুরো ঢেকে দিয়েছে বালি দিয়ে।’
পাঁচ মিনিট বাদে , জ্যাক ওয়েস্ট জুনিয়র ল্যান্ড রোভারের গায়ের সাথে লাগানো উইঞ্চ কেবল এ নিজেকে আটকে নিয়ে খাড়া পাথুরে দেওয়ালের গায়ে পনেরো মিটার নিচে ঝুলছে। ওর নিচে উত্তাল ভূমধ্যসাগরের ঢেঊ।
ওর ইচ্ছে হয়েছিল ওই আট মিটার বালি আর গ্র্যানাইট পাথরের মিশ্রন বিস্ফোরক দিয়ে ফাটিয়ে দিয়ে নিচে নামার। কিন্তু যেখানে জানা নেই নিচে আসলে কি আছে সেখানে বিস্ফোরক ব্যবহার করাটা বোকামো। হয়তো সেটা করলে ভেতরে ঢোকার কোন সুড়ঙ্গ পথ বা গহ্বর একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আরো খারাপ যেটা হতে পারে হলো পুরো স্থাপত্যটা ধ্বসে নেমে যেতে পারে নিচে।   আর সে রকম কিছু ঘটলে ওয়েস্টের তেমন লোকবল নেই যে সেই ধ্বন্সাবশেষ সরিয়ে দ্রুত রাস্তা খুঁজে বার করবে।
ওয়েস্ট এবার উইজার্ড এর সনিক –রিজনেন্স ইমেজারটা নিজের সামনের খাড়া পাথুরে দেওয়ালের দিকে তাক করলো।
পিং-পিং-পিং-পিং-পিং-পিং ...
আবার পাগলের মতো বাজতে শুরু করলো যন্ত্রটির সংকেত ঘণ্টা।
ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে –
TOTAL THICKNESS : 4.1 M.
SUBSTANCE ANALYSIS : SANDSTONE OVERLAY 1.6 M;
GRANITE UNDERLAY 2.5 M.
ওয়েস্ট বিস্মিত ভাবে পাথুরে দেওয়ালটার দিকে তাকালো। পুরো যে পাথুরে সমুদ্রতট এটাও একেবারে সেরকম দেখতে – একই রঙ, একই পাথুরে গা, রুক্ষ এবং আবহাওয়ার মার খেয়ে খেয়ে ক্ষত বিক্ষত।
কিন্তু এটা গোটাটাই একটা ধোঁকা, একটা ফাঁকিবাজি, একটা নকল ভাবে বানানো পাথরের সমুদ্রতট ।
একটা নকল দেওয়াল।
ওয়েস্ট আবার হাসলো, চিৎকার করে জানালো। ‘এটা একটা নকল দেওয়াল! মাত্র চার মিটার ঘনত্ব । গ্রানাইটের ওপর বেলেপাথরের চাদর লাগানো।’
জো রেডিও মাইক্রোফোনে জানতে চাইলো, ‘প্রবেশপথটা তাহলে কোথায়?’
ওয়েস্ট সোজা নিচের দিকে তাকালো খাড়া উলম্ব পাথরের দেওয়ালের – যেখানে বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ে ভেঙে যাচ্ছে বাষ্পের মতো।
‘ষষ্ঠ ইমহোটেপ এটাকে পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। মনে করে দেখো আমি আগে কি বলেছিলাম – ওই মানুষটা বিখ্যাত ছিলেন জলের তলা দিয়ে প্রবেশ পথ বানানোর ব্যাপারে । আমাকে উঠানোর ব্যবস্থা করো এবং রেডি করো স্কুবার সরঞ্জাম ।’
 কয়েক মিনিট বাদে। ওয়েস্টকে আবার ঝুলতে দেখা গেল সেই উইঞ্চ কেবলের সাহায্যে, পার্থক্য শুধু এটাই এবার একেবারে নিচে নেমে গেছে। কয়েক মিটার নিচেই  সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ সগর্জনে আছড়ে পড়ছে নকল দেওয়ালের গায়ে।
পরনে একটা সাঁতারের পোশাক, মুখ ঢাকা বিশেষ মুখোসে। সাথে পিঠে বাঁধা হাল্কা ওজনের একটা স্কুবা ট্যাঙ্ক। কোমরে বেল্ট থেকে ঝুলছে – ফায়ারম্যান হেলমেট, এক্স-বার, আলোক দন্ড, রক স্ক্রু ড্রিল এবং আগ্নেয়াস্ত্র।
গলার কাছে লাগানো মাইকে বললো, ‘ওকে!   এবার আমাকে নিচে নামিয়ে দাও! জলদি!’
আদেশ মেনে দলের সদস্যরা ঢিল দিলো কেবলের স্পুলারে। ওয়েস্টকে নামিয়ে দিলো উচ্ছল সমুদ্রের জলের ভেতরে পাথুরে দেওয়ালের ভিত্তি কাছে।
 ওয়েস্ট ডুবে গেল জলের ভেতর –
বেশি সময় লাগলো না জিনিষটা খুঁজে পেতে।
উলম্ব খাড়া পাথরের দেওয়াল নিচে নেমে গেছে সমুদ্রের তলায়। কিন্তু ছয় মিটার জলস্তরের পরেই ওটা থেমে গেছে। সেখানে অবস্থান করছে মানুষের হাতে বানানো এক বিরাট দরজা । বিরাট আক্ষরিক অর্থেই। পাথুরে ইটের ফ্রেম । দেখে মনে হচ্ছে একটা বিরাট এরোপ্লেন থাকার জায়গার প্রবেশপথ বানানো হয়েছে জলের তলার পাথর খোদাই করে।
আর এই দরজার ওপরের ফ্রেমে সেই সুপরিচিত চিহ্নটা খোদাই করা –

 ওয়েস্ট মুখোসের ভেতরের রেডিওতে বললো, ‘বন্ধুরা জেনে খুশি হবেন, আমি ঢোকার পথ ঝুঁজে পেয়ে গেছি। আমি ঢুকছি ওটার ভেতরে। অপর প্রান্তে কি আছে সেটা দেখার জন্য।
প্রিন্সটন-টেক আন্ডার ওয়াটার ফ্ল্যাশলাইট এর আলো জ্বালিয়ে, ওয়েস্ট সাঁতার কেটে ঢুকে পড়লো দরজাটার ভেতরে। একটা জলের নিচের পথ যার চারপাশের দেওয়াল বানানো হয়েছে গ্র্যানাইট পাথরের ইট দিয়ে।
খুব অল্পই  সাঁতার কাটতে হলো।
দশ মিটার মতো  সাঁতার কাটার পর ওয়েস্ট পৌছালো চওড়া একটা স্থানে – এবং সাথে সাথেই অনুভব করলো একটা জলের স্রোতের টান।
ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশে।
ফ্ল্যাশ লাইটের আলো যত দূর পৌছাচ্ছে তার পরে আর কিছু দেখাই যাচ্ছে না । এটা যে একটা বিরাট মাপের কোন এক জায়গা এটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হচ্ছে না ওয়েস্টের।
স্রোতের টান ঠেলে  সাঁতার কেটে এগিয়ে গেল বামদিকে। একটা ছোট্ট পাথরের কার্নিশ দেখা যাচ্ছে ওখানে। জল ছেড়ে ওটার ওপর উঠে বসলো এবং একটা বাদামী আলোর আতশবাজী ছুঁড়ে দিলো   ওপরের দিকে ।
চোখ ধাঁধানো আলোটা উঠে গেল , ওপরে ...ওপরে অনেক ওপরে ... ২৫০ ফুট তো হবেই। চারপাশটা মোটামুটি ভালোই দেখা যাচ্ছিলো।’
‘সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! ... এ কি জায়গা?!’

ওদিকে ঠিক একই মুহূর্তে দলীয় সদস্যরা জলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা ওয়েস্টের কাছ থেকে কি খবর আসে তার।
বার্তা ভেসেও এলো, ভাঙা ভাঙা খর খরে শব্দের আকারে – ‘গাইজ, আমি ঢুকে পড়েছি ভেতরে। অবাক হওয়ারপ্রস্তুতি নিয়ে নিচে নেমে এসো সবাই।’
জো উত্তর দিলো, ‘কপি দ্যাট, হান্টস ম্যান। আমরা যাচ্ছি।’
লিলি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দূরে পাহাড়ের ওপাশের সমতল ভুমির দিকে তাকিয়ে ছিল।
সবাই যখন নিজের নিজের স্কুবার সরঞ্জাম পড়ায় ব্যস্ত, লিলি বলে উঠলো, ‘ওটা কি?’
সবাই ঘুরে তাকালো –
-ওদের ওপরে আকাশে একটা সি-১৩০ হারকিউলিস কার্গো বিমান ভেসে আছে । ওটার 
ভেতর থেকে নেমে আসছে ছোটো ছোটো ডজন খানেক অবয়ব।
হাওয়ায় একটা নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে পাক খেতে খেতে নেমে আসছে ওগুলো।
প্যারাস্যুট । আর সেই প্যারাসুটে আছে সৈন্য।
সোজা এগিয়ে আসছে পাহাড়ি দেওয়ালের যে খানে দলের সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছে।
হারকিউলিস বিমানটাও নামলো, কিছুটা দূরে একটা উল্কাপাতে সৃষ্ট খাদের কিনারায়। 
উইজার্ড দ্রুত দূরবীন বার করে দেখলেন – বিমানটার দিকে।
‘আমেরিকার ছাপ লাগানো আছে। ওহ মাই গড! জুডা !’
দুরবীনের মুখ ঘুরালেন ধেয়ে আসা সৈন্যদের দিকে ।
কোল্ট কম্যান্ডো ঝুলছে বুকের কাছে ... মাথার ব্ল্যাক হকি হেলমেট।
‘কালিস আর ওর  সিয়েফ টিম! কি করে সম্ভব  হলো এটা? আমেরিকা রা আমাদের হদিশ পেলো কি ভাবে?! জলদি!! ওই কেবল ধরে নামতে শুরু করে দাও ! আমাদের জলের তলার গুহায় যেতে হবে ! এক্ষুনি!’

ঠিক ছয় মিনিট বাদে , এক জোড়া মিলিটারী বুটের মালিক এসে দাঁড়ালো ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে উইজার্ড দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ক্যাল কালিস।
ওর ঠিক সামনেই ল্যান্ড রোভারটা যেটা থেকে উইঞ্চ কেবল ঝুলে নেমে গেছে সমুদ্রে। ৪০০ ফুট নিচে ঢেঊ এর ভেতরে।
কালিস ঝুঁকে তাকিয়ে দেখতে পেলো ওয়েস্টের দলের শেষ দুজন সদস্য অদৃশ্য হয়ে গেলো জলের ভেতরে। পিঠে স্কুবার সরঞ্জাম বাঁধা।
মাইকের ততক্ষনাৎ জানালো। ‘কর্নেল জুডা, কালিস বলছি। একটুর জন্য আমরা ওদের ধরতে পারলাম না। ওরা জলের নিচের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে। আপাতত আপনার আদেশের অপেক্ষায় আছি। ঠিক কি করতে হবে আমাদের জানান?’’
শীতল কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘ওদের পিছু নাও। আর আগে নির্দেশ আগের মতোই। তুমি বাকিদের মেরে ফেললে আমার কিছুই বলার থাকবে নাকিন্তু ওয়েস্ট আর মেয়েটার গায়ে যেন একটুও দাগ না লাগে। আমরা দ্বিতীয় প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকবো ।’

নকল পাথুরে দেওয়ালের পেছনের জলমগ্ন অতিকায় অন্ধকার গুহার ভেতর এসে পৌছালো বাকি ছয় সদস্য।
ওয়েস্টের নির্দেশ মতো দিকে এগিয়ে যেতেই জল ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর জায়গা পেলেন উইজার্ড । সাথে সাথেই জানিয়ে দিলেন, ‘ জ্যাক! আবার সমস্যা! আমেরিকানরা আবার আমাদের পেছনে এসে গেছে।  
‘সেকি!! কি ভাবে!!’
‘আমি জানি না জ্যাক । আমি সত্যিই জানিনা ।’
ওয়েস্ট বিরক্তির স্বরে বললো  , ‘আপাতত সেসব নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে। আমার অজানা ফাঁদের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করে কাজ করা একদম পছন্দ হয় না। আর সেটাই এখন করতে হবে। চারদিকটা একবার দেখুন উইজার্ড।’

উইজার্ড ভালো ভাবে গুহার চারপাশটা দেখে নিয়ে একটা বড় মাপের ঢোঁক গিলে বললেন, ‘ওহ মাই ...’
উইজার্ডের চোখে যে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল এখন সেটা সব দলীয় সদস্যদের চোখ মুখে ।
কি পরিমাণ মানসিক শক্তি এবং চিন্তা করার ক্ষমতা ছিলো ষষ্ঠ ইমহোটেপের এটা তার প্রমান। স্বাভাবিক প্রবেশ পথের ওপর ছাদ বানিয়ে এক অভূতপূর্ব গুহাতে বদলে দিয়েছিলেন জায়গাটাকে।
এটা চওড়ায় তেমন বড় নয়। গড়ে ২০ মিটার, কোন কোন জায়গায় ৫০ মিটার। কিন্তু লম্বায় অনেক লম্বা, অনেক অনেক বড় । আপাতত অনেকগুলো আলো জ্বালিয়ে নেওয়ায় সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটা সঙ্কীর্ণ আঁকা বাঁকা ফাটলের পথ কয়েকশো মিটার দূর পর্যন্ত চলে গিয়ে মিশেছে ।
পাশের দেওয়ালগুলো একই রকম মসৃণ খাড়া । ডুবে আছে জলের ভেতরে। একেবারে  ওপরে সেই দেওয়ালের ওপর দৈত্যাকার গ্র্যানাইট পাথরের বড় বড় তীর ধরে আছে ছাদটাকে। এক একটা ক্যালি ফোরনিয়ার রেড উড গাছের গুঁড়ির মতো মোটা ।
সেই অতীতে গ্র্যানাইট পাথরে নির্মিত ঐ ছাদ  বালি দিয়ে এমন ভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল যাতে এই প্রবেশপথ একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায় লোকচক্ষুর সামনে থেকে।
ওয়েস্টরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার   পেছনের দেওয়ালটা চারশো ফুট উঁচু। এটার পাথরকে বাইরের দেওয়ালের মতো ছদ্ম আবরনে ঢেকে ফেলা হয়নি।
এই মুহূর্তে ওয়েস্টদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই দেওয়ালের পর   কি আছে সেটা জানা।
সামনে আপাতত এই ছাদওয়ালা ফাটল ।
সামনা সামনি দুদিকেই দেওয়ালের গা দিয়ে একই রকম অ্যাঁকা ব্যাঁকা  রাস্তা চলে গেছে  । নিচে জলের ভেতরেও যেমন নেমে গেছে তেমনি  দুদিকের পাথরের সিঁড়ির পাশ দিয়েই উঠে গেছে ওপরে।  ওখানে যাওয়ার পথ কোথাও কোথাও ঢুকে গেছে দেওয়ালের ভেতরে, আবার কিছু বাদেই বেরিয়েও এসেছে উঠে গেছে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া উচ্চতায়সময়ের প্রভাব ওই পথ ও সিঁড়ি কিছু কিছু জায়গায় ভেঙে ও গেছে । লাফিয়ে পার হতে হবে।
*সিঙ্ক হোল গুহা*

সম্ভবত এটাই প্রথমবার যখন কেউ অন্তত বলবে অ্যাডলফ হিটলারের নাজি জমানায় করা কিছু একটা কাজ সত্যিই কাজে লেগেছে। ৬০ বছর আগে নাজিরা যে ব্রিজটা বানিয়েছিল আজ সেটাই ওয়েস্টদের কালিসের বাহিনীথেকে অনেকটা দূরে নিয়ে যেতে সাহায্য করলো।
দেওয়ালের গা বেয়ে চলতে থাকা পথটার অর্ধেক পার করার পর গিরি গুহার সামনের  বাঁকটা ঘুরতেই দেখা গেল পথটা একটা গর্তের ভেতরে ঢুকে গেছে ।
ছোট্ট সুড়ঙ্গ পথটা পার হয়ে ওরা পৌছালো একটা বর্গাকার ডিওরাইট দেওয়ালের সিঙ্ক হোল গুহার ভেতর। ২০ ফুট চওড়া এবং ৩০ ফুট গভীর। আগ্নেওগিরির কাদা সেখানে টগবগ করে ফুছে – যার তাপের উৎস ভূগর্ভস্থ কোন এক স্থান – পুরো মেঝেটা গরম কাদায় ভরা। একে পার হয়েই গুহার পর প্রান্তে পৌছানো যাবে।
কিন্তু এখানেও নাজিদের বানানো আর একটা ব্রিজ কাজটা সহজ করে দিলো ওয়েস্টদের জন্য – দল বল নিয়ে ওপাড়ে পৌঁছেই ওটাকে ফেলে দিলো গরম কাদার ভেতরে।

*দ্বিতীয় সিঁড়ি [ নিম্নমুখী]

ওরা পৌঁছে গেল বাঁকটার অন্য প্রান্তে – জ্বালিয়ে নিলো নতুন কিছু আলোর লাঠি – এবং শুরু করলো খাড়া নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়ির ধাপ ধরে নামা। দেখে মনে হচ্ছে শেষ ধাপ গিয়ে মিশেছে জলে 
সত্যিই তাই সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে জলের ভেতর --- একটা ঘূর্ণিপাকের মুখে।
কিন্তু এখানেও নাজি প্রযুক্তির সহায়তা পেয়ে গেল ওয়েস্টরা । ঘূর্ণিপাকটাকে নিষ্ক্রিয় করে ওটা পেরিয়ে যাওয়ার কারিগরি ওখানে বর্তমান।
ওয়েস্ট চলে গেল ভেতরে সিঁড়ির ধাপ ধরে –যেখানে পৌছালো তার ঠিক ওপরেই একটা বিরাট মাপের গর্ত কাটা আছে।
‘জ্যাক!’ উইজার্ড হেঁকে বললেন, ‘ট্রিগার স্টোন আছে! খুঁজে দেখো , চিহ্নিত করে দাও আমাদের জন্য যদি সম্ভব হয়!’
ওয়েস্ট সেটাই করলো, সন্দেহজনক কোন পদক্ষেপ সে ফেললো না। খুঁজে খুঁজে পরবর্তী সদস্যদের আসার পথ বানাতে শুরু করলো।
সিঁড়িতে ওদের চলার পথে দু জায়গায় গতি অনেকটাই কমে গিয়েছিল – যেখানে   সিঁড়ির ধাপ ক্ষয়ে নষ্ট হয়ে গেছে । ওদেরকে দুঃসাহসী লাফ দিতে হয়েছে 
লাইনের একেবারে শেষ সদস্য – পুহ বিয়ার – দ্বিতীয় ফাঁকা জায়গাটায় লাফ দেবে ...এক সিয়েফ সেনা হাজির।
পুহ বিয়ার লাফালো।
সিয়েফ সেনা আক্রমণ করলো।
আর এই তাড়াহুড়োতে পুহ বিয়ারের লাফটা ঠিক মতো হলো না ... পা পিছলে গেল... পড়লো সজোরে। বিশাল পশ্চাৎদ্দেশের ওপর পড়লো শরীরের ভার সাথেই চাপ পড়লো একটা ট্রিগার স্টোনে ।
‘ধ্যাত তেরে কি!’ পুহ আর্ত ভাবে বললো।
সবাই থমকে দাঁড়িয়ে গেছে, তাকিয়েছে ঘুরে।
‘ষ্টুপিড আরব , একেবারে যাচ্ছেতাই...’ স্ট্রেচ বিড়বিড় করলো ।
‘স্ট্রেচ ... এসব ভাষা ... প্লিজ ,’ ওয়েস্ট ধমকের সুরে বললো।
একটা গম্ভীর জোরালো ঘর ঘর আওয়াজ শোনা গেল ভেসে আসছে সেই পাথরের গর্তটার ভেতর থেকে ।
স্ট্রেচ বললো, ‘লেট মি গেস... একটা বিরাট পাথরের বোল্ডার ওই গর্তটার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসতে চলেছে । সব নিয়ে থুয়ে আমাদের সিঁড়ি সহ ফেলে দেবে । এক্কেবারে রেইডারস অফ দ্য লস্ট আর্ক এর মতো।’
মোটেই তা নয় যদিও।
পর পর তিনটে কাঠের বিশাল টুকরো বেরিয়ে এলো গর্ত থেকে। এক মিটার চওড়া। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ভারী । প্রত্যেকটার গায়ে শতাধিক তীক্ষ্ণ ব্রোঞ্জের শলাকা লাগানো ।
১০০ কেজি করে ওজন তো বটেই এক একটার। সোজা নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। ওয়েস্টের টিমের দিকে ।
ওয়েস্ট লিলিকে তুলে নিলো কাঁধে, বললো, ‘চলো! চলো! চলো! দাঁড়িয়ে থেকোনা ।’
পুরো দলটা ঘটনা দেখে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সিঁড়ির ধাপে। এবার শুরু করলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নামতে।
একা সিয়েফ সেনাটাও সেটাই শুরু করলো।
ওয়েস্ট ফিরে গেল সিঁড়ির জল মগ্ন ধাপে। যেখানে নাজি প্রযুক্তিতে জলের ঘূর্ণিপাকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে।
এক লাফে ওটাকে পার হয়ে যায়। লিলিকে টেনে নেয় হাত ধরে। তারপর জো আর বিগ ইয়ার্স টপকে ঢুকে যায়। ওদের পরেই উইজার্ড আর স্ট্রেচ।
ওদিকে সিয়েফ সেনাটার পায়ের গতি বেশ ভালোই । ওর পেছনে ধেয়ে আসছে তীক্ষ কাঁটা লাগানো কাঠের টুকরো। সিঁড়ির ফাঁক দুটো অতি সহজেই লাফিয়ে পার হয়ে গেল । আর একটু দূরে পুহ বিয়ার। দলে সবার শেষে দৌড়াচ্ছে । মুখ লাল হয়ে গেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে পুহ গায়ের সব শক্তি কাজে লাগিয়ে মারলো লাফ। পুরো শরীরটাকে টানটান করে দিয়ে পার হয়ে গেল ঘূর্ণি পাকের জায়গাটা। সিয়েফ সেনাও সেটাই করলো , কিন্তু সহসাই ওর শরীরটা উঠে গেল শূন্যে। প্রথম কাঁটা ওয়ালা কাঠের টুকরো ধরে ফেলেছে ওকে। অন্তত গোটা কুড়ি শলাকা শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। সাথেই আছড়ে পড়লো নাজিদের বানানো পাতটার ওপর। পেছন পেছন এসে ধাক্কা মারলো আর দুটো এবং একসাথে তিনটেই ছিটকে গিয়ে পড়লো নিচের জলে ।

‘ওরেপ বাপরে ...’ পুহ বিয়ার বললো, নাজিদের লাগানো ধাতব পাতটার ওপর শুয়ে।
‘কাম অন পুহ!’ ওয়েস্ট বললো, ‘বিশ্রাম নেওয়ার মতো সময় এখন আমাদের হাতে নেই।’
‘বিশ্রাম ? বিশ্রাম ! আমাদের কি কষ্ট বলোতো ক্যাপ্টেন ওয়েস্ট, যাদের তোমার মতো শারিরীক সক্ষমতা আরফুর্তি নেই ।’ একটা আর্তনাদ ছেড়ে পুহ উঠে দাঁড়ালো এবং শুরু করলো দলের অনুসরণ ।

*দ্য ড্রাঊনিং কেজ*

নাজিদের বানানো পাটাতনটা পার হয়ে, ওরা পৌছালো একটা পাথরের প্ল্যাটফর্মের ওপর । তারপরেই দেখা যাচ্ছে পাঁচ ফুট বিস্তৃত একটা জল ময় স্থান । যা আলাদা করে রেখেছে   পরবর্তী স্টেপিং স্টোনটাকে ।   স্টেপিং স্টোন থেকে আর ফুট পাঁচেক দূরে দেখা যাচ্ছে আর একটা সিঁড়ি, উঠে গেছে ওপরের দিকে। ওই সিঁড়িতে পৌঁছানো যথেষ্টই কঠিন । প্রথম ধাপটা ঘূর্ণায়মান জল থেকে সাত ফুট দূরে । প্রায় অসম্ভব একটা দুরত্ব।
তবে তার থেকেও বড় সমস্যা আপাততঃ সামনের স্টেপিং স্টোনটা।
একটা বিরাট মাপের ঘনক আকৃতির খাঁচা ঝুলছে ওটার ওপর । বোঝাই যাচ্ছে কেউ পাথরটায় নামলেই ওটা নেমে আসবে তার ওপর।
‘একে বলে ড্রাঊনিং কেজ,’ উইজার্ড জানালো । স্টেপিং স্টোনের ওপর আমরা লাফিয়ে নামলেই ওটা আমাদের বন্দী করবে । তখন পুরো প্ল্যাটফর্মটাই নেমে যাবে নিচে জলের ভেতরে। খাঁচা সহ সবাইকে ডুবে মরতে হবে।’
জো বললো, ‘ কিন্তু এটা ছাড়া তো আর কোন পথও নেই একে পার হওয়ার ...’
স্ট্রেচ দলের পেছনের দিকটা সামলাচ্ছিল । ‘যা করবার তাড়াতাড়ি করো । কালিস প্রায় পৌঁছে গেছে!’
ওয়েস্ট ঘুরে তাকালো –
- দেখলো সিঙ্ক হোল কেভ থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির একেবারে ওপরে দাঁড়িয়ে আছে কালিস, ওদের পেছনেই।
‘জ্যাক কি ভাবনা তোমার এটার ব্যাপারে?’ উইজার্ড জানতে চাইলেন।
ওয়েস্ট নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো । ‘হুমম। জলের ঘূর্ণিপাকের কারনে সাঁতার কেটে যাওয়াও সম্ভব নয়। পাশের দেওয়াল গুলো যা মসৃণ এবং চকচকে আমরা ওগুলোর সাহায্য নিয়েও এ জায়গা পার হতে পারবো না। তারমানে কোনোভাবেই একে এড়ানোর কোনো উপায় নেই...’
ওয়েস্ট দূরের ওপরে উঠে যাওয়া সিঁড়ির দিকে তাকালো।
ওটার ওপর তিনটে নাজি সেনার কঙ্কাল পড়ে আছে। কোনোটার ই মাথা নেই। কিন্তু ওসবের পেছনে  ওয়েস্ট কিছু একটা দেখতে পেলো –
দেওয়ালের গায়ে মিশে আছে একটা দরজা, মাকড়শার জালে ঢাকা ।
‘এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই,’ চিৎকার করে বললো, ‘সে কারনেই একে আমরা এড়িয়েও যাবো না, উইজার্ড । মাল্টার টেম্পলার পিটের কথা মনে আছে। যেখানে আমরা সঙ্গীতালয়ের পুঁথিগুলো পেয়েছিলাম। এটাও একেবারে সেইরকম। তোমাকে এই ফাঁদে পা দিতে হবে একে পার হয়ে যাওয়ার জন্য।’
স্ট্রেচ পুনরায় বললো, ‘কথা অনেক হলো এবার কাজ হোক । কালিস সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেকের বেশী পথ নেমে চলে এসেছে ...’
জো প্রশ্ন করলো ওয়েস্টকে, ‘এই ফাঁদে পা দিতে হবে একে পার হয়ে যাওয়ার জন্য ? এর মানে কি বলতে চাইছো তুমি?’
‘জলদি করো, জলদি ...’ স্ট্রেচ বললো । ‘পয়েন্ট ব্ল্যাক রেঞ্জ থেকে ওয়ারবলার কোন কাজ করে না ।’
ওয়েস্ট আবার তাকিয়ে দেখলো কালিসের এগিয়ে আসা, সাথে এখনো ন’জন সিয়েফ সেনা। মাত্র গজ তিরিশেক দুরত্ব বাকি।
‘ওকে, এভরিওয়ান... এই একটা ব্যাপারে আমার ওপর তোমাদেরকে পুরো ভরসা করতে হবে । বিশ্বাস করতে হবে। ভাগ ভাগ হয়ে যাওয়ার উপায় নেই , এই কাজটা আমাদের একসাথে করতে হবে
‘যদি লাগে তো তুক না লাগে তো তাক , তাই তো জ্যাক?’ জো বললো ।
‘আর কোন পথ নেই । চলো নিজের নিজের পনি বোতল বার করে হাতে নাও। আমরা একসাথে স্টেপিং স্টোনটার ওপর লাফ দেবো । রেডি ... চলো !’
সবাই একসাথে লাফ দিলো।
সাত জন একসাথে পা দিলো চওড়া স্টেপিং স্টোনের ওপর –
- ততক্ষনাৎ , সেই বিরাট খাঁচা নেমে এলো নিচে । একটা বিশাল ইঁদুর ধরা খাঁচার মতো । ওদের ওপর স্থিত হলো অতিরিক্ত মাত্রার ওজন সহ –
- সাথে সাথেই দশ ফুট চওড়া স্টেপিং স্টোনটা শুরু করলো ডুবতে জলের ঘূর্ণি পাকে!
‘আশা করছি তোমার ভাবনা সঠিক হবে জ্যাক!’ জো চেঁচিয়ে বললো । কোমরের বেল্ট থেকে বার করে নিলো পনি বোতল । ওটার সামনের অংশটা ঢুকিয়ে নিলো মুখের ভেতর। যেমনভাবে পিঠে লাগানো বড় স্কুবা ট্যাঙ্ক থেকে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে এটাও সেই সুবিধাটাই দেয়। তবে মাত্র তিন মিনিটের জন্য।
খাঁচার চাপে জল এখন ওদের হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে।
ওয়েস্ট কোনও উত্তর দিলো না। এই মুহূর্তে ও মন দিয়ে খাঁচাটার ব্রোঞ্জের তৈরী বার গুলোকে দেখছিলো ।
যা খুঁজছিলো সেটা পেয়েও গেলো – একটা ছোট্ট আর্চওয়ে আকৃতির কাটা অংশ খাঁচার একদিকের দেওয়ালের গায়ে। নিচ থেকে খুব বেশী হলে ফুট তিনেক ওপরে, তবে হামাগুড়ি দিয়ে একটা মানুষের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ।
কিন্তু খাঁচার যেদিকে ওই কাটা জায়গাটা আছে সেদিকে তো পাথরের দেওয়াল । ওই পথ দিয়ে বার হয়ে যাবেটা কোথায় ...
খাঁচা আর খানিকটা নেমে গেল জলের ভেতরে । সেই ফাঁকটাও চলে গেল জলের তলায়।
জল এখন বুক ছুঁয়েছে ।
বিগ ইয়ার্স তুলে ধরে আছে লিলিকে নিজের হাতে, ঘূর্ণায়মান জলের ওপরে ।


পেছন দিকে সিঁড়িতে ক্যাল কালিস ব্যাপারটা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে । মুখে মিটিমিটি হাসি ওদের দুরাবস্থা দেখে।
‘জ্যাক...’ জো ডাকলো, উৎকণ্ঠার ছাপ উচ্চারনে ।
‘জ্যাক ...’ উইজার্ড ডাকলো, চিন্তাগ্রস্থ কন্ঠে।
‘সুযোগটা আসবেই, ‘ ওয়েস্ট ফিসফিস করে নিজেকে বললো। ‘সুযোগটা আসতেই হ –’
খাঁচাটার দুই তৃতীয়াংশ নেমে গেছে জলের ভেতরে, নেমেই চলেছে আরো । ওয়েস্ট একটা গ্লোস্টিক জ্বালালো । পনি বোতলটাকে লাগাল মুখে, এবং ডুব দিলো নিচে ।
জলের তলায়।
গ্লো স্টিকের আলোয় ওয়েস্ট দেখতে পেলো খাঁচার দেওয়াল পাথরের দেওয়ালের গা ঘেঁষে নেমে যাচ্ছে ...
দুর্ভেদ্য পাথর ।
দুর্ভেদ্য পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই খাঁচার ওই দিকে ।
এটা হতেই পারে না, ওর মনের ভেতর থেকে কথাগুলো গুমড়ে উঠলো। কিছু একটা থাকতে হবেই এখানে !
কিন্তু কিছুই ছিল না ওখানে।
ওই নিচে ওদের জন্য কিছুই ছিল না ।
ওয়েস্টের হৃদপিন্ড ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছিল। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা তাহলে  করেই ফেললো। ওর কারনেই আজ ওর টিমের সকলে প্রান হারাবে ।
০০০০০

জ্যাক পুনরায় ভালো করে জলের ভেতরে ঘুরতে থাকা খাঁচাটাকে পরীক্ষা করতে শুরু করলো।
জল এখন প্রায় গলার কাছে । খাঁচা ডুবে গেছে চার ভাগের তিন ভাগ।
জো জানতে চাইলো, ‘নিচে কিছু পাওয়া গেলো?’
ওয়েস্ট ভ্রু কুঁচকে , হতভম্বের মতো বললো, ‘না ... কিন্তু থাকা উচিত ।’
স্ট্রেচ চিৎকার করে বললো, ‘তুমি আমাদের সবাইকে মেরে ফেললে দেখছি!’
গলা ছুঁয়েছে জল।
‘নিজের নিজের পনি বোতল মুখে নাও,’ ওয়েস্ট শান্ত ভাবে বললো। তাকালো লিলির দিকে , বিগ ইয়ার্স ওকে যতটা পেরেছে উঁচু করে ধরে রেখেছে। ‘হেই কিড্ডো, তুই আমার সাথে আছিস তো?’
যন্ত্রের মতো মাথা নাড়ালো লিলি – ভয়ে কথা বলার ক্ষমতাও নেই যেন। ‘অ্যাঁ – হ্যাঁ হ্যাঁ।’
‘আস্তে আস্তে পনি বোতল থেকে শ্বাস নাও যে ভাবে আমরা অভ্যাস করেছিলাম,’ একই রকম শান্ত স্বরে বললো ওয়েস্ট । ‘চিন্তার কোন কারন নেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
লিলি ফিসফিস করে বললো, ‘আপনি কি কিছু গণ্ডগোল করে ফেলেছেন?’
‘হতেও পারে ,’ ওয়েস্ট উত্তর দিলো ।
কথাটা বলার সাথে সাথেই চোখ গেল উইজার্ডের দিকে। বয়স্ক মানুষটি সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, ‘নিজের মনকে শক্ত করো জ্যাক । আমি তোমায় বিশ্বাস করি।’
‘খুব ভালো, কারন আমি এই মুহূর্তে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না,’ ওয়েস্ট উত্তর দিলো ।
কথাটা বলার সাথে সাথেই বিশাল ব্রোঞ্জের খাঁচাটা , সাতজন বন্দীকে নিয়ে , পুরোপুরি ডুবে গেল জলে ।
একটা ঝকাং ধরনের শব্দ করে থেমে গেল খাঁচাটা । ওটার ছাদটা এখন জলের ঠিক তিন ফুট নিচে ।
নিচে জলের স্রোতের টান খুবই মারাত্মক । খাঁচাটার বাইরের দিকে জলের ঘূর্ণিটা দেখা যাচ্ছে সিল্যুয়েটের মতো । একটা বিরাট মাপের জল কোনাকৃতি হয়ে নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে ।
পনি বোতলটা মুখে ধরে ওয়েস্ট পুনরায় সেই ছোট্ট আর্চওয়েটাকে শেষ বারের মতো পরীক্ষা করে ...
... এবার দেখতে পেলো কিছু একটা যেন নড়ছে ।
ছোট্ট আর্চ ওয়েটা পাথরের দেওয়ালের গায়ের একটা নির্দিষ্ট কালো গর্তের মুখের কাছে গিয়ে স্থিত হয়েছে ।
যেমন এর আকার ঠিক তেমনি আকার ওটারও। আর্চ ওয়েটার মতোই দেওয়ালের কাটা অংশটা। তার মানে ওই আর্চ ওয়ের ভেতর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে পারলেই এই জলের তলায় ডুবে যাওয়া থেকে পরিত্রান মিলবে ।
ওয়েস্টের চোখে আবার আগের মতো উজ্জ্বলতা ফিরে এলো ।
বাকিদের দিকে ঘুরে তাকালো । সকলেই জলবন্দী অবস্থায় পনি বোতল মুখে নিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। লিলিও ।
ওয়েস্ট হাতের ইশারায় আর্চওয়েটা দেখালো –
উইজার্ড যাবেন সবার আগে।
এর পর বিগ ইয়ার্স আর লিলি। জো, স্ট্রেচ, পুহ বিয়ার ... আর সবার শেষে ওয়েস্ট নিজে ।
উইজার্ড একটা গ্লো স্টিক জ্বালিয়ে নিয়ে সাঁতার কেটে ঢুকে গেলেন আর্চ ওয়েটার ভেতর দিয়ে অন্ধকার গর্তটায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ওয়েস্ট বিগ ইয়ার্স কে অপেক্ষা করতে বললো – অপেক্ষা উইজার্ডের সংকেতের জন্য, সব ঠিকঠাক আছে সেই সংকেত।
একটু বাদেই আবার উইজার্ডকে দেখা গেল । হাত তুলে জানালেন সব “ওকে” ।
এক এক করে সবাই দেওয়ালের গর্ত পথ ধরে বেরিয়ে গেলো খাঁচার ভেতর থেকে । আপাতত ভেতরে কেবল মাত্র জ্যাক ওয়েস্ট জুনিয়র ।
কেউ দেখতেই পেলো কি পরিমাণ স্বস্তির ছাপ এই মুহূর্তে ওর মুখে চোখে । ওর ডাকে সবাই একবাক্যে সাড়া দিয়ে ছিল। আর প্রায় সবাই মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে পৌঁছেও গিয়েছিল । কিন্তু জ্যাকের ভাবনায় কোনো ভুল ছিল না ।


পায়ের একটা জোরালো ধাক্কা মেরে জ্যাক বেরিয়ে গেল খাঁচার ভেতর থেকে । ছোট্ট গর্তটার ভেতরে অদৃশ্য হল ওর বুটের শেষ অংশ ।
দেওয়ালের গায়ের ওই গর্ত কিছুটা যাওয়ার পরই ওপর দিকে উঠতে শুরু করলো । প্রায় উলম্ব সুড়ঙ্গের মতো দেওয়ালের গায়ে অবশ্য মই এর ধাপের মতো হাতল লাগানো ছিলো ।
জলের ঝামেলা শেষ করে সুড়ঙ্গ পথ উঁচুতে উঠে পৌছেছে একটা আনুভূমিক গলিপথে । যা ধরে এগিয়ে আবার সেই দেওয়ালের গায়ের আগের মতোই পথে পৌছানো গেল। এবার অবশ্য সামনে  সেই মাকড়শার জালে ঢাকা দরজার মুখ । উঠতে থাকা সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ পরেই । সেই দরজার মুখ যা ওয়েস্ট দেখেছিলো জলে ডোবার আগে।
ওরা গলিপথটা বেরিয়ে আসার পরপরই ওয়েস্ট দেখতে পেলো কালিস আর ওর দলবল আগের সিঁড়ির নিচের ধাপে এসে গেছে । দাঁড়িয়ে দেখছে খাঁচাটা পুনরায় নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে ।
ওয়েস্টদের সামনের  সিঁড়িতে পড়ে আছে তিনটে মুন্ডুহীন নাজি সেনার কঙ্কাল ।
উইজার্ড বললো, ‘মুন্ডু হীন শরীর সিঁড়ির নিচের ধাপে পড়ে থাকার একটাই অর্থ – ধারালো কিছু হঠাৎ করে চলে আসতে পারে ওপর থেকে । খুব সাবধান ।’
আবার দলের সামনে ওয়েস্ট । ভালো করে তাকালো নতুন সিঁড়ির ধাপের দিকে । ‘ আরে বাহ! ওটা দেখুন ...’
সিঁড়ির ধাপের একেবারে ওপরে সত্যিই একটা দেখার মতো স্থাপত্য কর্ম অবস্থান করছে । একটা অতিকায় গার্ড টাওয়ার, ঝুঁকে আছে খাড়া পাথরের দেওয়ালের গা থেকে ২০০ ফুট ওপরে নিচের জলস্তর থেকে।
প্রাচীন গার্ড টাওয়ারকে সেই সময়ে  এই গিরিখাতের মূল বাঁকের মোড়ে এসে স্থাপন করা হয়েছিল । ঠিক ওর উলটো দিকের পাথরের দেওয়ালের গায়েও বানানো আছে একেবারে যমজ একটি গার্ড টাওয়ার। ওটাও বেরিয়ে ঝুঁকে আছে দেওয়ালের গা থেকে। ওখানেও জলের ভেতর থেকে এভাবেই জলে ডোবানো খাঁচার ফাঁদ বর্তমান।
ওয়েস্ট সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দেওয়া মাত্র –
 আরে! জ্যাক বলেই তো মনে হচ্ছে! একটা কন্ঠস্বর শোনা গেল ।
ওয়েস্ট এদিক ওদিক তাকালো ।
না এ স্বর কালিসের নয় ।
এ অনেক দূর থেকে আসছে ।
জল পেরিয়ে ওই দিকের পাথুরে দেওয়ালের কাছ থেকে ।
ওয়েস্ট তাকালো সেই দিকে ।
দেখতে পেলো আর একটা আমারিকান স্পেশ্যাল ফোরস দল অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ঠিক পরেই সেই ডুবে যাওয়া খাঁচার ফাঁদের জায়গাটা ।
ওরা আবির্ভূত হয়েছে পাথরের দেওয়ালের গায়ের একটা দরজার মুখ দিয়ে। সব শুদ্ধ ২৪ জনের দল ।
ওদের মাথার কাছে বছর পঞ্চাশের একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন । ইস্পাত কালো চোখের চাহনি । অদ্ভুত রকম ভাবে মুখটাতে কোন নাকের অস্তিত্ব নেই । অতীতে এক বিশেষ ঘটনায় ওটা কাটা পড়েছিল । তার ফলেই এই বিচ্ছিরী রকমের একটা ছাপ থেকে গেছে মুখের ওপর ।
মুখের এই বিকৃত অবস্থা সত্বেও , মানুষটা যে পোশাক পরে আছে সেটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ।
ওয়েস্টের মতোই ষ্টীল সোলের জুতো পায়ে।
ওয়েস্টের মতোই ক্যানভাসের জ্যাকেট গায়ে ।
একেবারে ওয়েস্টের মতনই কোমরের বেলেটে পনি বোতল, পিটন এবং এক্স বার ঝুলানো ।
একমাত্র আলাদা জিনিষ হেলমেট – ওই মানুষটা পড়ে আছে একটা হাল্কা ওজনের কেভার’স হেলমেট । ওয়েস্টের মাথায় ফায়ারম্যান  হেলমেট ।
ওয়েস্টের থেকে বয়স বেশী মানুষটার। অনেক শান্ত এবং আত্মবিশ্বাসী । ছোট ছোট কালো চোখ দুটোতে অভিজ্ঞতার ছাপ ।
এই লোকটা সেই মানুষ যাকে এ পৃথিবীতে অন্য যে কোন মানুষের চেয়ে ওয়েস্ট ভয় পায় । এই মানুষটাই ছিল মিলিটারী জীবনে ওয়েস্টের লাস্ট ফিল্ড কম্যান্ডার । এই মানুষটাই বাসরা ইরাকে ওয়েস্ট মৃত্যুর মুখে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিল ।
ডেল্টা টিম সিক্স এর প্রাক্তন কম্যান্ডার। ডেল্টার সব চেয়ে সেরা সেনা । যদিও এখন সিয়েফ এর কম্যান্ডিং অফিসার । সিয়েফ , এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো স্পেশ্যাল ফোরস ।

মানুষটার নাম, কর্নেল মার্শাল জুডা ।
০০০০০০০০০০০০০০০০০
 .



বর্তমান অবস্থান অনুসারে ওয়েস্ট আর তার টিম জুডার থেকে সামান্যই এগিয়ে আছে।
জল মগ্ন গিরিখাতের উভয় দিকের পথ একেবারে একই রকম । ওয়েস্টের দল এই মুহূর্তে এক ফাঁদ বেশী অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। জুডাকে ডুবে যাওয়া খাঁচার ফাঁদ পার হতে হবে। ওরা সেটা করার পথেই এগিয়ে যাচ্ছে নামতে থাকা সিঁড়ি পথ বেয়ে, আর সেই পথেই –
- তিনটে তীক্ষ্ণ শলাকা লাগানো কাঠের বিরাট টুকরো ।
জুডা আর ওর দলবলের দিকে ধেয়ে আসতে থাকলো ওই সাঙ্ঘাতিক জিনিষগুলো ।
জুডার মনে হচ্ছে সব ব্যবস্থাই করা আছে ।
দলের তিনজনের দিকে ইশারা করলো । অতি দ্রুততার সাথে ওরা তিনটে স্ট্যান্ড যুক্ত একটা ব্যারিকেড স্থাপন করে ফেললো ওই শলাকা যুক্ত কাঠের টুকরো আর দলের মাঝখানে ।
টাটানিয়াম-অ্যালয় ধাতু দিয়ে বানানো ব্যারিকেডটা সিঁড়ির সমান চওড়া । কাঠের টুকরোগুলো এক এক করে ওটাতে এসে ধাক্কা খেয়ে সোজা নিচে জলে গিয়ে পড়লো ।
জুডা ওয়েস্টকে এক ভাবে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলো ।
‘জ্যাক এখনো সেই স্বপ্নগুলো দেখো নাকি? আগ্নেওগিরির ভেতর আটকে যাওয়ার স্বপ্ন ?’ জানতে চাইলো জুডা । ‘এখনো স্বপ্নে তাড়া করে মন্ত্রোচ্চারণ আর ড্রামের শব্দ?’
গিরিখাতের এধারে কথাগুলো শুনে ওয়েস্ট অবাক হয়ে গেল । স্তম্ভিত হয়ে গেল । জুডা ওই ব্যাপারটা জানলো কি ...?
আর ঠিক এই স্তম্ভিত হয়ে যাওয়াটাই দেখতে চাইছিলো জুডা । একটা শীতল হাসির রেশ ছড়িয়ে গেল জুডার মুখে । ‘আমি আরো অনেক কিছু জানি, জ্যাক । এমন অনেক কিছু যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না ।’
ওয়েস্ট ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলো – কিন্তু চেষ্টা করলো সেটা বাইরে প্রকাশ না করার।
যদিও তাতে কোনো কাজ হলো না 
জুডা এবার ওয়েস্টের ফায়ার ম্যান হেলমেটটার দিকে ইঙ্গিত করলো । ‘এখনো ওই ফায়ারম্যানের টুপিই পড়ে চলেছো জ্যাক? তুমি ভালো করেই জানো আমার কখনোই ওইটা পছন্দের তালিকায় ছিল না। জায়গা বিশেষে ওটা খুবই অস্বস্তিকর । একজন শিক্ষকের কাছে এটা খুব কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে যখন দেখতে পাওয়া যায় তার একজন বুদ্ধিমান ছাত্র যত সব বোকা বোকা কাজ করে চলেছে।’
ওয়েস্ট নিজেকে সামলাতে পারলো না – নিজের হেলমেটটার দিকে একবার তাকালো ।
জুডা এগোতে থাকলেন, পৌঁছালেন নির্দিষ্ট স্থানে । ‘ দেখে যা মনে হচ্ছে জ্যাক একটা ভালো প্রতিযোগিতা করার সুযোগ আছে আমাদের হাতে । কি মনে করো তুমি আমাকে হারাতে পারবে ? সত্যি সত্যিই কি মনে করো যে তুমি আমাকে হারাতে পারবে?’
জুডার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে দলের সবার উদ্দেশ্যে চাপা গলায় ওয়েস্ট বললো, ‘আমাদের এবার দৌড়াতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব । চলো , শুরু করা যাক!’
ওয়েস্টের দল সিঁড়ির ধাপ বেয়ে দুপদাপ করে উঠতে শুরু করলো । লক্ষ্য একেবারে ওপরে স্থিত গার্ড টাওয়ার ।
জুডা শান্তভাবে  আবার তার দলের লোকেদের ইঙ্গিত করলো । ওর দলের লোকেরা একটা লম্বা ব্রিজের মতো বানাতে শুরু করে দিলো ওখান থেকে সরাসরি পাসের সিঁড়ির ধাপে পৌছানোর জন্য। ডুবন্ত খাঁচার ফাঁদ হয়ে ওরা যাবে না ।
প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল পুরো দমে ।

*গার্ড টাওয়ার এবং গিরিখাত*

ওয়েস্ট আর তার টিম দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো ওপরে ।
গার্ড টাওয়ারের ঠিক আগে ওদের পথের সামনে একটা সরু গিরিখাত । খুব বেশি হলে পনেরো ফুট । একেবারে খাড়া উঠে এসেছে নিচ থেকে । এই ছোট্ট গিরিখাতটা প্রধান গিরিখাতটাকে চিরে দিয়ে চলে গেছে । একই রকম জিনিষ করা আছে ওই পাড়েও ।
আরো একবার নাজিদের করে যাওয়া কাজ ওয়েস্টদের সাহায্য করলো । যা মনে হচ্ছে প্রাচীন যুগের কার্থেজ অধিবাসীরা একটা জটিল চেন দিয়ে ঝোলানো ড্র-ব্রিজের ব্যবস্থা করেছিল এই গিরিখাত পার হওয়ার জন্য – আর সেই ড্র-ব্রিজটাকেই নাজিরা এখানে নিচে স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিল । ফাঁকা স্থানটাকে ঢেকে দেওয়ার জন্য ।
ভাগ্যের সহায়তা যখন পাওয়াই গেলো তা আর কে ছাড়ে । ওয়েস্টের টিম এক ছুটে পার হয়ে গেল প্রাচীন ড্র-ব্রিজ । পৌছালো গার্ড টাওয়ারের কাছে । সাথে সাথেই পৌছে গেল মূল গিরিখাতের আরো একটা বাঁকের মাথায় ।
বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকা  গার্ড টাওয়ারের গা থেকে একটা মই ঘিরে আছে স্থাপত্যটাকে । যার অর্থ ওদেরকে এবার ২০০ ফুট মই এর পথ ধরে উঠতে হবে । কোথাও কোনো আলাদা কিছু নেই ধরার জন্য । একেবারে নিচে উদ্দাম জলের স্রোত ।
মই এর একেবারে শুরুতেই দুটো ধারালো ফলা নড়ছিল মাথা কেটে দেওয়ার জন্য । ওয়েস্ট ওদের নিষ্ক্রিয় করলো দ্রুত ঘন হয়ে জমে যাওয়া ফোম দিয়ে । তারপর একে অপরের সাথে দড়ি দিয়ে নিজেদের বেঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে বোকা বানিয়ে ওরা উঠতে থাকলো গার্ড টাওয়ারের  গা বেয়ে ।
গিরিখাতের ওপর পাড়ে , জুডার টীমের বানানো লম্বা ব্রিজ সেট হয়ে গেছে । ওর দলের লোকেরা এক এক করে পার হয়ে যাচ্ছে জায়গাটা । ডুবন্ত খাঁচার ফাঁদকে কাঁচকলা দেখিয়ে ওরা পৌঁছে গেল ওপরে উঠতে থাকা সিঁড়ির নিচে।

০০০০০
“দ্বিতীয় অভিযান - লাইট হাউস”
প্রতিম দাস
০০০০০০০০০০০০০০০০০


গার্ড টাওয়ারের গায়ের দেওয়াল মইয়ের পথ ধরে ওয়েস্টরা উপস্থিত হলো ওটার ব্যালকনিতে।   একটা সরু টানেল দেখা যাচ্ছে ব্যালকনির শেষে। যা ভেদ করে গেছে গিরিখাতের দেওয়াল । ওটা দিয়ে গেলে পৌছানো যাবে বাঁকের অন্য দিকে । ওয়েস্ট তিনটে আলোর রোশনাই পর পর ছুঁড়ে দিলো ওটার ভেতরে ...
... আর তাতেই দেখা গেল পথের শেষ অংশ এবং ওদের অভীষ্ট লক্ষ্যটাকে।
বিগ ইয়ার্স ঢোঁক গিলে বললো, ‘হোলি শিট ...’
লিলি বলে উঠলো, ‘অবাক করে দেওয়ার মতো জিনিষ ।’
নিজের সমস্ত গরিমা নিয়ে ওখানে অবস্থান করছে , জলের ওপরে এক অতিকায় মিনারের মতো, নিজের অস্তিত্বের প্রমান দিচ্ছে । কম করে পনেরো তলা বাড়ীর সমান , দূরের পাথুরে দেওয়ালের সামনে , একটা দৈত্যাকার প্রাচীন দুর্গ ।
দেওয়ালের গা থেকে নির্গত হতে থাকা বাষ্পের কনার ভেতরে দুর্গটাকে বেশ ভুতুড়ে ধরনের মনে হচ্ছিল।
স্থাপত্যটার একেবারে নিচের অংশটা বিশাল মাপের  একটা ঘনক আকৃতি । আর তার ঠিক মাঝখানে অবস্থান করছে একটা মানানসই মহাকায় আর্চওয়ে । মধ্যের অংশটায় অবস্থান করছে আরো দুটো সুচাগ্র টাওয়ার । যাদের চুড়া ওপরে অন্ধকারে মিশে গেছে । এই টাওয়ার দুটোর গঠন শৈলীর সাথে ওয়েস্টরা যে গার্ড টাওয়ার পার হয়ে এলো তার ভালোই মিল । শুধু এই দুটো টাওয়ার অনেক বেশী লম্বা । জলের ভেতর থেকে সোজা ওপরে উঠে চলে গেছে ।
বিরাট মাপের আর্চ ওয়েটার মধ্যে খানে একটা ঢালু পথ নেমে গেছে জলের ভেতরে, শেষ হয়েছে একটা চ্যাটালো পাথরের জেটিতে । যেটা লম্বায় চল্লিশ মিটার লম্বাতো হবেই। একবারে মাঝখানে দেখা যাচ্ছে সিঁড়ির ধাপ । এই ঢালু পথটার সাথে ভ্যালি অফ কিংস এ খুঁজে পাওয়া রানী হাতসেপসুতের সমাধি মন্দিরের সিঁড়ি পথের অদ্ভুত মিল
সম্পূর্ণ বানানোও হয়নি ... কখনো ব্যাবহার করাও হয়নি যে উদ্দেশ্য নিয়ে একে বানানো হচ্ছিলো তার প্রেক্ষিতে – সাথেই দীর্ঘ সময় ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে দেন এক প্রতিভাবান ইজিপশিয়ান স্থপতিবিদ – এটাই হামিলকারের ভুলে যাওয়া বাসস্থান ।


ওয়েস্ট থলের ভেতর থেকে প্রিন্ট আউটটা বার করে , ভালো করে দেখে নিলো –
একেবারে সেই প্রাচীনকালের আঁকা ছবিটার মতো । গিরিখাতটা এখন ওর সামনে এসে একটা ওয়াই আকৃতি নিয়ে সমাপ্ত হয়েছে । বিভক্ত হয়ে গেছে দু দিকে দুটো আলাদা চ্যানেলে । ভুলে যাওয়া বাসস্থানটা অবস্থান করছে ওয়াই এর ভি আকৃতির একেবারে মাথায় । যেন তাকিয়ে আছে মূল জলপ্রবাহটার দিকে । 
মুল জলপ্রবাহ যেখানে দ্বিধা বিভক্ত হয়েছে  তার দুপাশে দুটো সেন্ট্রি টাওয়ার দেখা যাচ্ছে । যাদের মুখ ভুলে যাওয়া বাসস্থানের দিকে ।
এই সবগুলো মিশিয়ে গোটা ব্যাপারটা যদি অতিকায় বলে না মনে হয় তা হলে জানিয়ে রাখা যাক, ভুলে যাওয়া বাসস্থানের সাথে যুক্ত হয়ে আছে দুটো জল বিভাজিকা ব্রিজ । যেমন একটা ভাঙা আগে দেখা গিয়েছিল মূল গিরিখাতের জলের ওপর ভাঙ্গা অবস্থায় । ২০০ ফুট করে উঁচু এবং তৈরী হয়েছে অনেক পাথরের ইঁট দিয়ে বানানো ধনুক আকৃতির খিলান দিয়ে ।
এই ব্রিজ দুটোর একটাও একটুও ভাঙ্গেনি । ওয়াই এর দুই বাহুর ওপর ওদের অবস্থান ।
ভুলে যাওয়া বাসস্থানের পেছনের পাথরের দেওয়াল টার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো জো ।
‘ওটা পেছন দিকে হেলে আছে,’ বললো। ‘ঠিক যেন একটা শঙ্কুর –‘
ওয়েস্ট বললো, ‘চলো চলো, আমাদের হাতে সময় খুব কম ।’
গিরিখাতের শেষ অংশ টুকুতে একটা নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়ি পথ এবং তারপরেই একটা ওপর দিকে উঠে যাওয়া ঢালু পথ। গিরিখাতের বাম দিকের দেওয়ালের গা ঘেঁষে ঢালু পথটা উঠে গেছে এঁকে বেঁকে । কৌতূহলজনক ব্যাপার হলো, ওটার বাইরের দিকটায় নিচু উপরের দিকে মুখ ওয়ালা একটা  ড্রেনের মতো অংশ কাটা আছে । কি কারনে সেটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে ।
বলাই বাহুল্য , এই সিঁড়ি পথ – ঢালুপথ এর একেবারে নিখুঁত প্রতিরুপ গিরিখাতের ওপাড়েও দেখা যাচ্ছে ।
ওয়েস্ট আর তার টিম এগিয়ে চললো নিচের দিকে নামতে থাকা সিঁড়ি পথ ধরে। দেওয়ালের গায়ের ফুটো দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ তীব্র জলের ধারা বেরিয়ে আসছে এরকম পর পর দুটো ফাঁদকে এড়াতে হলো ওদের ।
ওদিকে জুডার দল ছোট্ট গিরিখাতটা পার করে ওদের দিকের গার্ড টাওয়ারের কাছে পৌছালো ।
শুরু করলো ওটার দেওয়ালের গায়ের মই বেয়ে ওঠা ।

*ওপরের দিকে উঠতে থাকা ঢালুপথ*

একটা অদ্ভুত রকমের উঁচু স্টেপিং স্টোন দেখতে পাওয়া গেল নিচের দিকে নামতে থাকা সিঁড়ি আর ওপর দিকে উঠতে থাকা ঢালু পথের ফাঁকে । দেখে যা মনে হচ্ছে তাতে ওটা জলস্তর থেকে অন্তত ৩০ ফুট ওপরে  একটা দেওয়ালের মতো  বার হয়ে এসেছে। 
ঢালুপথটা উঠে গেছে বেশ উঁচুতে । বিস্তার ওপরের দিকে ১০০ মিটার তো হবেই । শেষ হয়েছে বাম দিকের সেন্ট্রি টাওয়ারের কাছে গিয়ে। পথটা ফুট চারেক লম্বা । একজনের পক্ষে যথেষ্ট জায়গা । কোনো ভাবে যদি পড়ে যাও সোজা পিছলে গড়িয়ে চলে যাবে নিচের জলে। 
ঢালুপথটাতে দুটো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথম, রাস্তাটার দুই তৃতীয়াংশকে দেখে মনে হচ্ছে ওটা যেন একটা দরজা । দ্বিতীয়, তার পর থেকে বাকি অংশটাকে দেখতে লাগছে একটা নলের মতো ।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মাঝে মাঝেই জলের প্রবল স্রোত বেরিয়ে আসছে ওই নলের মুখ দিয়ে। ছিটকে গিয়ে পড়ছে জল মগ্ন গিরিখাতে ।
উইজার্ডকে বেশ উত্তেজিত দেখালো । ‘এটা একটা সিংগল-একজিট কনভারজেন্স ট্র্যাপ ...’
‘সেটা আবার কি বস্তু?’ পুহ বিয়ার জানতে চাইলো ।
ওয়েস্ট বললো, ‘এর অর্থ এক প্রতিযোগিতা । আমাদের আর ওই নলের ভেতর থেকে কি তরল পদার্থ বেরিয়ে আসবে তার মধ্যে। আমাদেরকে দরজার কাছে পৌছাতে হবে তরল কিছু করার আগেই । আমার মনে হচ্ছে ওই উঁচু হয়ে থাকা স্টেপিং স্টোনটায় চাপ পড়লেই প্রতিযোগিতার শুরু হয়ে যাবে।’
বিগ ইয়ার্স জানতে চাইলো , ‘ কি ধরনের তরল ?’
উইজার্ড বললো, ‘ আমি দেখেছি এসব থেকে কাঁচা খনিজ তেল, গরম বালির স্রোত , আলকাতরা ...’
যাচ্ছে ।


ওয়েস্ট আর তার টিম এগিয়ে চললো নিচের দিকে নামতে থাকা সিঁড়ি পথ ধরে। দেওয়ালের গায়ের ফুটো দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ তীব্র জলের ধারা বেরিয়ে আসছে এরকম পর পর দুটো ফাঁদকে এড়াতে হলো ওদের ।
ওদিকে জুডার দল ছোট্ট গিরিখাতটা পার করে ওদের দিকের গার্ড টাওয়ারের কাছে পৌছালো ।

শুরু করলো ওটার দেওয়ালের গায়ের মই বেয়ে ওঠা ।
উইজার্ড কথা বলতে থাকার ফাঁকে ওয়েস্ট তাকালো জুডার দলের দিকে।
ওরা উঠছে ওদের গার্ড টাওয়ারের গা বেয়ে, জলের অনেক অনেক ওপরে । এগিয়ে যাচ্ছে সুশৃঙ্খল ভাবে – ওয়েস্টদের টিমের তুলনায় অনেক দ্রুত গতিতে।
প্রথম সিয়েফ সেনা ব্যালকনিতে পৌছে টাওয়ারের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘আপাতত কি হবে না হবে এসব ভেবে কোন লাভ নেই,’ ওয়েস্ট বললো, ‘লেটস টেক দ্য চ্যালেঞ্জ।’
বলার সাথে সাথে সাথেই স্টেপিং স্টোনটার ওপর লাফ মারলো এবং বাউন্স খাওয়ার মতো করে পৌছে গেল ঢালু পথে ।
স্টেপিং স্টোনে পায়ের চাপ পড়া মাত্র একেবারে ওপর থেকে নলের মুখ দিয়ে হড়হড় করে বেরিয়ে এলো ‘  গরম আগ্নেওগিরির কাদা । কালো এবং ঘন। এতটাই গরম যে ভালো করে তাকালে ওটার মধ্যে লালছে সোনালী লাভার সরু লাইনও দেখা যাছিলো ।
ঢালু পথের  সাথে যুক্ত ড্রেনের মতো অংশটাও শুরু করে দিলো তার কাজ।
ওয়েস্টদের টিমের দিকে সেই গরম কাদা অতি দ্রুত বইয়ে দেওয়ায় সহায়তা করে!
“এটার জন্যই আমরা প্রতিদিন প্র্যাকটিস করেছি ,’ ওয়েস্ট বললো । ‘ ছোটা শুরু করো !!’
ঢালুপথের ওপরের প্রান্ত লক্ষ্য করে শুরু হল সাতজনের দৌড় ।
ওপর থেকে নেমে আসছে নলের ভেতর দিয়ে গরম কাদা।
খুব বেশী সময় লাগবে না দুই তৃতীয়াংশ এলাকায় আসতে – ঢালু পথটাকে বানানোই হয়েছে কাদা গড়ানোর উপযোগী করে ।
তবে ওয়েস্ট এর দল এর জন্য প্রস্তুত ছিল । পায়ে ছিল জোর । নলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে ঢালুপথে গড়ানো শুরু হওয়ার আগেই হাঁচড় পাঁচড় করে উঠে ওরা দেওয়ালের গায়ের দরজার কাছে পৌছে গেল । তার কিছুক্ষনের মধ্যেই অঝোর ধারায় শুরু হয়ে গেল গরম কাদার ধারা স্রোত । ওয়েস্ট ছিল সবার পেছনে । আগ্নেওগিরির কাদা ওকে আর একটু হলেই ছুঁয়ে ফেলতো । ওয়েস্ট এক লাফ দিয়ে পার হলো জায়গাটা । প্রায় মসৃণ ঢালুপথের ওপর দিয়ে দ্রুত বয়ে গিয়ে সেই কাদা জোরালো “ফসসসসস” শব্দ করে পড়লো নিচের জলে ।

জুডার টিম ওয়েস্টদের কাছাকাছি এসে গেছে । ওরা ঢালু পথটাকে সামলালো অন্য ভাবে।
ওরা মাত্র একজনকে পাঠালো স্টেপিং স্টোনটাতে পা দিয়ে ঢালু পথের ওপর। যে গেল তার পিঠে বাঁধা ছিল একটা বেশ বড় রুপালী রঙের ক্যানিস্টার । হাতে ধরে ছিল এমন একটা জিনিষ যেটাকে দেখে মনে হচ্ছিল বড় ব্যারেল যুক্ত লিফ ব্লোয়ার ।
নিজের কাজে দক্ষ মানুষটা দ্রুত দৌড়ে কাদা বার হয়ে আসার আগেই পৌঁছে গেল ওপরের দরজার কাছে , কিন্তু ভেতরে ঢুকল না । উলটে লিফ ব্লোয়ারটা তাক করলো ঢালু পথের ওপর ।
ওটা থেকে গরম বাতাসের পরিবর্তে বেরিয়ে এলো প্রচুর পরিমাণে সুপারকুল লিক্যুইড নাইট্রোজেন । যা গরম কাদাকে বেরিয়ে আসা মাত্রই জমিয়ে শক্ত করে দিলো । নলের মুখের কাছটা এবং ড্রেনের মুখগুলো আটকে গেল এরফলে । কাদা আর বেরিয়ে আসতেই পারলো না। আটকে গেল ওখানেই!
এরফলে জুডা আর তার দলবলের সামনে কোন বিপদের আশঙ্কাই রইলো না ঢালু পথ ধরে এগিয়ে যেতে । এগিয়ে চললো সেন্ট্রি টাওয়ারের দিকে – আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে।

আর উলটো দিকে জানের বাজি খেলে ওয়েস্ট আর ওর টিম পৌছালো নিজেদের দিকের সেন্ট্রি টাওয়ারে।
স্ট্রেচ জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমার যদি ক্যাপ স্টোনের টুকরোটা পেয়েও যাই, সেটাকে নিয়ে ওখান থেকে বের হবো কিভাবে? ওই আমেরিকানদের হাত থেকে নিজেদের কি করে বাঁচাবো? আর এটা যদি সবচেয়ে বড় টুকরোটা হয় তাহলে তার মাপ হবে নয় বর্গ ফুটের কাছাকাছি – সলিড সোনার-’
পুহ বিয়ার গলা খাঁকারী দিয়ে বললো, ‘ সবসময় এতো নেতিবাচক ভাবনা কেন? এটাই তোমার চরিত্র তাই না ইজ্রায়েলী? মাঝে মাঝে তো আমি অবাক হয়ে ভাবি কি এমন ঠেলায় পড়েছিলে যে এই মিশনে যোগ দিয়েছ আমাদের সাথে ।’
স্ট্রেচ মুখ বেঁকিয়ে জবাব দিলো, ‘কেবলমাত্র তোমার দিকে নজর রাখার জন্য আমার এখানে আগমন ।’
উইজার্ড বললেন, ‘যদি আমরা টুকরোটা দখল করতে না পারি তাহলে অন্ততপক্ষে ওটা দেখা দরকার। লিলিকে দেখতে হবে ওটার গায়ে লেখা ইতিবাচক মন্ত্রগুলোকে যা খোদাই করা ছে ওটার ওপর দিকে।’  

ওয়েস্টের এসব ফালতু কথা বার্তায় মন ছিল না।
ও সেন্ট্রি টাওয়ারের ব্যালকনি থেকে উঁকি মেরে নিচের ভুলে যাওয়া বাস স্থানের বিশাল আর্চ খিলানটাকে দেখছিল ।
জেটিটার দিকে তাকাতে দেখতে পেলো বিশাল আর্চ টার কাছ পর্যন্ত ঢালু পথের শেষ প্রান্ত বিস্তারিত হয়েছে। জেটিটা অবস্থান করছে দুটো সেন্ট্রি টাওয়ারের ঠিক মাঝখানে । আর ওটাকে ঘিরে চারটে ছোট মারবেল পাথরের স্তম্ভের ওপর স্থিত একটি আচ্ছাদন। ওয়েস্টের ব্যালকনি থেকে  ওই ছোট্ট বাড়ীর মতো জিনিষটার দুরত্ব খুব বেশি হলে ৫০ মিটার।
‘বিগ ইয়ার্স, আমাদেরকে একটা ফ্লাইং ফক্স সেট করতে হবে জেটির ওপরের ছোট্ট ঘরটা পর্যন্ত ।’
‘বুঝতে পেরেছি।’
বিগ ইয়ার্স টেনে বার করলো এম-১৬ । একটা গ্র্যাপ্লিং হুক লাগালো ওটার গ্রেনেড লাগানর জায়গাটায় । তারপর লক্ষ্য স্থির করে টিপে দিলো ট্রিগার।
হুকটা ধেয়ে গেল গিরিখাতের ওপর দিয়ে , হাওয়া কেটে যাওয়ার শন শন শব্দ শোনা গেল, ওটার সাথে যুক্ত থাকা দড়িটাও অনুসরণ করলো ওটাকে । তারপর নামতে থাকলো নিচের দিকে । একেবারে জেটিকে ঘিরে থাকা মারবেল পাথরের ঘরটাকে লক্ষ্য করে... তারপর শোনা গেল একটা শব্দ “ঠোয়াআআআআক!” হুকটা একটা পিলারকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরলো শক্ত করে ।


পেছন থেকে জো এর উচ্ছসিত কণ্ঠ শোনা গেল, ‘নাইস শট, ব্রাদার!’
বিগ ইয়ার্স এবার তার দিকে থাকে দড়ির প্রান্তটা শক্ত করে জড়িয়ে বেঁধে দিলো সেন্ট্রি টাওয়ারের  জানলার কাছের একটা পিলারের গায়ে। দড়িটা টান টান হয়ে গেল – ওটাকে এখন দেখতে লাগছে একটা টানা দাগের মতো যা জুড়ে আছে সেন্ট্রি টাওয়ারের ওপর থেকে একেবারে নিচের জেটিতে ।
‘ লিলি, ‘ ওয়েস্ট বললো, ‘ এখান থেকে আবার তোমার আর আমার যাত্রা শুরু । আমাকে চেপে ধরো । আমরা সবার আগে যাবো ।’
লিলি ওয়েস্টের পিঠে উঠে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওয়েস্টকে । ওয়েস্ট একটা বাদুড়ের মতো দেখতে দুদিকে হাতলওয়ালা জিনিষ বার করে লাগালো দড়িটায় । তারপর জানলা দিয়ে ঝুঁকে ভাসিয়ে দিলো নিজেকে –
-              সড়সরিয়ে দুটি শরীর এগিয়ে চললো বিরাট গিরিখাতের ওপর দিয়ে , হ্যামিলকারের প্রাচীন ভুলে যাওয়া বাসস্থানের মহাকায় স্থাপত্যের সামনে দিয়ে একটা বিন্দুর মতো –
-  ছোট্ট জেটিটার ওপর সাবলীল দক্ষতায় নিজেকে দাঁড় করালো ওয়েস্ট । ওদের ঠিক পেছনেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝাপসা স্থাপত্য ।
‘জো ! নিচে নেমে এসো,’ ওয়েস্ট রেডিও বার্তা পাঠালো ।
নিজের ফ্লাইং ফক্স সেট করে নিয়ে জো দক্ষতার সাথে নিচে নেমে এসে দাঁড়ালো ওয়েস্ট আর লিলির পাশে।
‘উইজার্ড এবার তোমা –’ ওয়েস্ট বললো ।
ব্যাম!
বন্দুকের নির্ঘোষ।
গিরিখাতের ভেতরে শব্দটা একার পর এক প্রতিধ্বনি তুললো।
ওয়েস্ট মুখ ঘুরিয়ে দেখলো জুডার একজন স্নাইপার ও প্রান্তের সেন্ট্রি টাওয়ারের ব্যালকনি থেকে লং ব্যারেল্ড ব্যারেট রাইফেল তাক করে আছে ওদের দিকে ... আর সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল এখানে ওয়ারবলার এর সুরক্ষা বেষ্টনী এখানে নেই ।
কিন্তু অবাক ব্যাপার যে কোন বুলেটই ওর বা জো বা লিলির কাছাকাছি এসে পড়ছে না ।
ব্যাপারটা বুঝতে ওয়েস্টের বেশি সময় লাগলো না ।
স্নাইপার মোটেই ওদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে না ।
ওর আসল লক্ষ্য –
‘ সর্বনাশ , এটা খুব বাজে ...’
ব্যাম!
আবার একটা বজ্র নির্ঘোষ।
পিং ! স্যায়াআআক!
বুলেট গিয়ে লাগলো দড়িটায় একেবারে মধ্যে এবং সাথে সাথেই ওটা দুটুকরো হয়ে গেল । নিচের অংশটা আছড়ে পড়লো জলে ।
এর অর্থ আপাতত শুধু ওয়েস্ট, জো আর লিলি ... যা কিছু করার ওদেরকেই করতে হবে । দলের সাথে আর কোন ভাবেই যুক্ত হওয়ার উপায় নেই ।
‘আর কোন পথ নেই আমাদের সামনে,’ ওয়েস্ট গম্ভীর ভাবে বললো। তারপর রেডিওতে বললো –বিগ ইয়ার্স, পুহ বিয়ার, স্ট্রেচ । আমাদের কভার ফায়ার দরকার মাত্র চার সেকেন্ডের মধ্যে!’
একদম তাই ঠিক চার সেকেন্ড বাদে , ওয়েস্টের মুখের কথা অনুযায়ী , এক ঝাঁক বুলেট ধেয়ে এলো জুডার সেন্ট্রি টাওয়ার থেকে ।
বুলেটের ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো শ্বেত পাথরের ছোট্ট ছাদটার ওপর যার তলায় দাঁড়িয়ে আছে ওয়েস্ট, জো আর লিলি ।
চারদিকে শুধুই বুলেট ঠিকরে যাওয়ার শব্দ।
অবশ্য তার সাথে সাথেই ওয়েস্টের টিমের জবাব ওদের দিকের টাওয়ার থেকে ধ্বনিত হল – বুলেট ধেয়ে গেল জুডাদের সেন্ট্রি টাওয়ারের উদ্দেশ্যে ।
গিরিখাতের ওপর দিয়ে দুই টাওয়ারের মধ্যে শুরু হল তুমুল গুলি বর্ষণ।
পালটা জবাবের কার্যকারিতা হাতেনাতে বোঝা গেল – জুডার পক্ষ থেকে বন্ধ হলো গুলো চালনা সামান্য সময়ের জন্য আর সেটাই ওয়েস্টকে সুযোগ করে দিলো যা সে করতে চাইছিল সেটা করার জন্য।
‘ এবার এগোতে হবে!’ চিৎকার করে জো আর লিলির উদ্দেশ্যে বললো ।
চার স্তম্ভের ছাদের তলা থেকে বেরিয়ে ওরা শুরু করলো ছুটতে । উঠতে থাকলো চওড়া ড্রেনের মতো ঢালু পথটা ধরে যার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে দুর্গটা । তিনটে অতি ক্ষুদ্র অবয়ব এগিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন যুগের এক মহাকায় স্থাপত্যের দিকে।
ওরা সিঁড়ির ধাপে উঠে পড়তেই বাইরের গুলি বন্দুকের শব্দ যেন সহসাই মিলিয়ে গেল । ওদের সামনে অন্ধকার পড়ে আছে হ্যামিলকার বারকার কবেকার পরিত্যক্ত ভুলে যাওয়া বাসস্থান।
ওরা প্রবেশ করলো একটা উঁচু ছাদওয়ালা প্রচুর স্তম্ভ যুক্ত হল ঘরে । স্তম্ভগুলো দুপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । হল ঘরটা চওড়ায় যতটা বড় লম্বায় ততটা নয়।
অসাধারন সুন্দর বলতে যা বোঝায় এ হলো তাই – প্রত্যেকটা স্তম্ভ কারুকার্য খচিত । ভূতুড়ে সব স্ট্যাচুগুলোর খোদাই কাজ একেবারে নিখুঁত । রোমান স্থাপত্য ভাবনার ছাপ দেখে বেশ অবাকই হতে হয় – ব্যবসায় দক্ষ কার্থেজের অধিবাসীরাতো মনে হচ্ছে এসব ব্যাপারে চরম শত্রু রোমানদের মতোই । সম্ভবত এটাই অন্যতম কারন ছিল তিনটে রক্তক্ষয়ী পিউনিক যুদ্ধের ।
হলঘরটা একেবারে শুনশান ফাঁকা । উন্মুক্ত মেঝেতে একটা স্তরের মতো ছড়িয়ে আছে ধুসর ছাই।
এসব কিছুই নতুন করে বানিয়েছিল টলেমীর ইজিপশিয়ান ইঞ্জিনীয়াররা ।
দুর্গের পেছনে একটা একটা চওড়া ওপর দিকে উঠতে থাকা সুড়ঙ্গ খনন করা আছে । যা একেবারে সোজা সুজি বাইরের বিরাট আর্চওয়ের সাথে এক লাইনে অবস্থিত । ওই সুড়ঙ্গ এবং ঢালুপথ সংযুক্ত হয়ে আছে একটা সমতল রাস্তা দ্বারা যা চলে গেছে স্তম্ভ যুক্ত হল ঘরের ভেতর দিয়ে । আর সেই রাস্তার পাশেও মুখ তুলে আছে ড্রেন ।
জো বললো, ‘ দেখে মনে হচ্ছে ওই সব ড্রেনের মুখগুলোকে বানানোই হয়েছে কোনও রকমের তরল পদার্থ ছিটানোর জন্য । যা উঠে আসছে সুড়ঙ্গের অন্তঃস্থল থেকে , যা এই হলের ভেতর দিয়েই চলে গিয়েছে এবং নেমে গেছে সামনের ঢালু পথে ।’


‘ওসব নিয়ে ভাবা বা দেখার মতো সময় আমাদের হাতে নেই ,’ ওয়েস্ট বললো, ‘এগোতে থাকো ।’