Search This Blog

Monday, November 5, 2018

শৃঙ্খলাবদ্ধ অরণ্যদেব [ The Phantom in Chains] বাংলা ভাবানুবাদ - প্রতিম দাস

শৃঙ্খলাবদ্ধ অরণ্যদেব
[মূল কাহিনী The Phantom in Chains]

*এই প্রথম অরণ্যদেবের কোনো গল্প বাংলায় অনুবাদ করা হলো*
 প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে ৫১ বছর আগে । কিং সিন্ডিকেটের অ্যানুয়াল এডিশনে ।
পোস্টে ব্যবহৃত ছবি মুল বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
#Un_official_বাংলা_রুপান্তর - প্রতিম দাস
ঘন গহীন রহস্যময় যে সীমাহীন অরণ্য এলাকাটাকে  জঙ্গলরক্ষী বাহিনী দেখাশোনা করে তার বেশ খানিকটা ওপর দিয়েই ঊড়ে যাচ্ছিলো হেলিকপ্টারটা । চকচকে টাকমাথার একটা লোক ওখানে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল একভাবে। মানুষটার শীতল নীল চোখ মাঝে মাঝে চক চক করে ঊঠছিল উত্তেজনায় ।
পাইলট প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ‘ কিভাবছো বল্ডপ্যাট?’
প্রশ্নটা এমন এক মানুষের উদ্দেশ্যে করা হলো যার আসল নাম  বা সে কোন দেশের লোক কেউ জানেনা । উত্তেজনা চাপা স্বরে সে জানালো , ‘অট্টো, আমার মনে হচ্ছে এই এলাকা একেবারে তৈরি হয়ে আছে দখল হওয়ার জন্য ।’
অট্টো দাঁত বার করে হাসলো। ‘ল্যাম্পুরির বিদ্রোহী সেনার দল এই এলাকা আক্রমণ করে সবাইকে ক্রীতদাস বানাবে তাইনা, হি হি!’
বল্ডপ্যাট নামের মানুষটা নিজের চকচকে টাকে হাত বুলিয়ে বললো, ‘সেরকম ভাবনাই আছে অট্টো । ওই ক্ষুদে পিগমিগুলো ভালো চাকর হয় !
এলাকার উত্তরদিকে অবস্থানকারী বিদ্রোহীদের স্বঘোষিত নিষ্ঠুর নেতা ল্যাম্পুরি এই হেলিকপ্টার সফরের জন্য বল্ডপ্যাটকে ভালোই অর্থ প্রদান করেছে। সমগ্র এলাকাটাকে ভালো করে দেখে আক্রমণের জন্য একটা সহজ এবং দ্রুতগামী পথ খুঁজে বার করাই  এ সফরের প্রধান উদ্দেশ্য । একবার এই এলাকা ল্যাম্পুরি যদি দখল করতে পারে তাহলে বল্ডপ্যাটের জন্য যে একটা ভালো পদ এবং আর্থিক পুরষ্কার অপেক্ষা করে থাকবে সেটাও জানানো হয়েছে ওকে।
কিন্তু সবকিছুর মাঝে একটা প্রশ্নচিহ্ন আছে ...
আর সেটাই বল্ডপ্যাটের মনে মাঝে মাঝেই উঁকিঝুঁকি মারছে । পেছন দিকে   ঘুরে তাকিয়ে সেই ভাবনাটাকেই ভাষায় প্রকাশ করলো অট্টো ।
‘সমস্যাটা নিয়ে ভাবছো নিশ্চয় । মানে ওই অরণ্যদেব ... তাই না?’
প্রায় নিখুঁত গোলাকৃতি টাকের অধিকারীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা বিকট ঘোঁত শব্দ । ‘ঠিকই বলেছিস । বোঝাপড়াটা ওর সাথেই আগে করতে হবে।’
‘ঠিক কিভাবে কি করবে ভাবছো সেটা সোজাসুজি একটু বলো দেখি?’
বেশ খানিকটা সময় বল্ডপ্যাটের দিক থেকে কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না । নিশ্চিতভাবেই কোনো দুষ্ট ভাবনা ওর মনে খেলা করছে। দাঁত চিপে চিপে বললো, ‘ওই অরণ্যদেবের জোরের জায়গাটা আগে নষ্ট করতে হবে... চিরকালের মতো ! এই এলাকায় ল্যাম্পুরির বাহিনী কিছু করার আগে আমাকে সে কাজটা সম্পন্ন করতে হবে !’
‘বুঝলাম । কিন্তু কিভাবে?’
আবার চুপ করে গেলো বল্ডপ্যাট । শোনা যাচ্ছিলো একঘেয়ে হেলিকপ্টারের ব্লেড ঘোরার শব্দ। সহসাই বল্ডপ্যাট খলখলিয়ে হেসে উঠলো । ‘ কিছু করার ইচ্ছে থাকলে একটা উপায় হয়ে যায় বন্ধু । মনে হচ্ছে সে উপায় আমি খুঁজে পেয়েছি ।’
আরো কিছুটা নিচের দিকে ঝুঁকে কিছু একটা দেখতে দেখতে গড়গড় করে একটানা অনেক কিছু বলে গেল বল্ডপ্যাট ।
সব শুনে একটা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে অট্টো ঢোঁক গিলে বললো, ‘ হুম, নিঃসন্দেহে ছকটা ভালোই কষেছো
‘শুধু ভালো নয় বন্ধু... এটা একেবারে নিখুঁত ছক!’ গর্বিত স্বরে বললো বল্ডপ্যাট ।
পরের একটা ঘণ্টা বল্ডের মুখ দিয়ে আর একটাও কথা শোনা গেল না । আগামী আক্রমণের পরিকল্পনা বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক কিছু লিখে রাখলো ।
একসময় সে কাজ শেষ হতেই  অট্টোকে নির্দেশ দিলো উত্তরদিকে ল্যাম্পুরির গোপন আস্তানায় ফিরে যাওয়ার ।
এই মুহূর্তে বল্ডপ্যাটের কাছে সব তথ্য মজুত  এই জঙ্গলের প্রতিটা অংশ সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে ফলে সে আপাতত যা জানে তার দাম এখন ল্যাম্পুরির কাছে অতি মাত্রায় মূল্যবান ।
আরো একটা কুটিল হাসির শব্দ বেরিয়ে এলো বল্ডের মুখ দিয়ে । কারন এই মুহূর্তে তার আর কিছুই অজানা নেই ...

যদিও একটা বিষয় এই অতি উত্তেজনার মুহূর্তে বল্ডের ভাবনাতে একবারও এলোই না !
বাস্তব এটাই যে,  সব অপরাধীই কিছু না কিছু ভুল করে । যেমন এই মুহূর্তে করছে বল্ডপ্যাট । তার এই হেলিকপ্টার সফরটা যে কেউ নজর করতে পারে সেটা ওর মাথা থেকে উবে গেছে ।
আর এই কেউ চরিত্রটা হলো চলমান অশরীরী – ষোড়শ অরণ্যদেব
ঘন জঙ্গলের ওপর জোরালো হাওয়ার ধাক্কা মেরে অতি দ্রুত উড়ে যাচ্ছিলো হেলিকপ্টারটা ।
খুলিগুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন অরণ্যদেব । হেলিকপ্টারের শব্দ অনেকক্ষন থেকেই শুনতে পাচ্ছিলেন উনিএবার সেটা এসে গেছে মাথার ওপরে । তাকালেন নীল আকাশের দিকে । চোখের সামনে তুলে ধরেছেন এক অত্যন্ত শক্তিশালী দূরবীন   ওটার ভেতর দিয়ে দেখা গেল উদ্দিষ্ট বস্তুটাকে।
দেখতে পেলেন কুটিল শয়তানী মুখের বল্ডপ্যাটকেও ।  অরণ্যদেবের মুখের রেখাগুলো একবার কঠিন হয়েই মিলিয়ে গেলো ।
ওই মুহূর্তেই তার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো বাঘা । সব সময়ের অনুগত হাউন্ড ।
চোখ থেকে দূরবীনটা নামিয়ে বলে উঠলেন, ‘বুঝলি  বাঘা! মনে হচ্ছে আবার কাজে নামার সময় এসে গেছে ।’ ওই টাকমাথা লোকটাকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি ।   এই ধরণের শয়তান প্রকৃতির লোকেরা কেবলমাত্র তাদের জন্যই  কাজ করে, যাদের সামর্থ্য আছে বিশাল পরিমাণে পারিশ্রমিক দেওয়ার। একইসাথে এরা যে বেশী দেবে তার দলেই ভিড়ে যায় । কোনো বাছবিচার নেই ।
নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকলেন অরণ্যদেব, ‘বল্ডপ্যাটেরা কারোর প্রতিই অনুগত থাকেনা। ওদের ভেতরে স্বাদেশিকতা বলে কিচ্ছু নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে ওরা নিজেদের ক্ষমতা বিক্রি করে বেড়ায় –   দেখেনা ওদের মালিক আদপেই ভালো না খারাপ । যে মূল্য দিতে রাজি হয় ওরা তাদের হয়েই কাজ করে দেয় । আর  সে মূল্য অত্যন্ত চড়া !’
ধীরে ধীরে অরণ্যদেব পদচারনা করতে করতে ঢুকে গেলেন গুহার ভেতরে।  থাকলেন। মাথার ভেতর উঠেছে প্রশ্নের ঝড় এটা ঠিক যে ওই হেলিকপ্টার জঙ্গলের ওপর দিয়ে কিছু না করেই উড়ে চলে গেল অন্যদিকে । কিন্তু এ উড়ান কি শুধু শুধু ? নাকি কিছু বিশেষ কারনে?
এরকম নানা ভাবনা চিন্তা থেকে একটা বিষয় দানা বাঁধতে থাকলো অরণ্যদেবের মাথায় । সে ভাবনা সঠিক কিনা জানা খুব জরুরী ।
গুহা থেকে পুনরায় বেরিয়ে এসে শুরু করলেন পাহাড়ে উঠতে । অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে ছুটে কিছু সময়ের ভেতরেই পৌছে গেলেন পাহাড় চুড়ায় । এই মুহূর্তে ঘন গহীন রহস্যময় জঙ্গল উনার থেকে অনেক অনেক নিচে । মাথার ওপরে এখন দিগন্ত বিস্তৃত নীলাকাশ ।
যদি ওই হেলিকপ্টার কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই এখান দিয়ে উড়ে গিয়ে থাকে তাহলে ওটাকে আর দেখতে পাওয়ার উপায় নেই কিন্তু অরণ্যদেবের অনুমান মিলে গেল । ওটা এখনো এই এলাকা ছেড়ে যায়নি । প্রথমে চারদিকে তাকিয়ে কিছু দেখা না গেলেও কয়েক সেকেন্ড বাদেই আবার শোনা গেল ইঞ্জিনের শব্দ । কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করতেই আবার আকাশের বুকে দেখা গেল হেলিকপ্টারটাকে ।
বল্ডপ্যাট যে কোনো কারনেই হোক এই জঙ্গল এলাকা সরেজমিনে দেখছে- ভাবনাটা এসে গেলো অরণ্যদেবের মনে। একটুও না নড়ে উনি দেখতে থাকলেন যান্ত্রিক পাখির গতিবিধি । একটু বাদেই আবার ওটা মিলিয়ে গেল দূরে।
ওটার চলার পথ দেখে অরণ্যদেবের বুঝতে অসুবিধা হলোনা, ওটার আপাতত গন্তব্য উত্তরের এলাকা । আবার একবার মুখের রেখায় কাঠিন্য ফটে উঠলো । - উত্তরের ওই দূরপ্রান্ত মানেই ল্যাম্পুরি ! বলে উঠলেন, ‘বাঘা... যে কোনো রকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে।’
গম্ভীর মুখে পাহাড় থেকে নেমে এলেন জঙ্গলের সাম্রাজ্যে ।
ঠিক ওই মুহূর্তে ল্যাম্পুরির বিদ্রোহী ঘাঁটিতে উপস্থিতদের মুখে এক সম্ভাব্য বিজয়ের উল্লাস ছড়িয়ে পড়েছে ।
‘তুমি তো দেখছি দারুন কাজ করেছো হে, বল্ডপ্যাট!’ বলে উঠলো বিদ্রোহীদের নেতা । ‘ আকাশপথে ঘুরে তুমি যে ছক বানিয়েছো তাতে এলাকাটাকে বুঝে নিতে কোনোই অসুবিধা হচ্ছেনা। শুধু একটা সমস্যা ...’
‘ওই অরণ্যদেব নামক অজানা শক্তিটাকে নিকেশ করা,’ কথার মাঝেই বলে উঠলো বল্ডপ্যাট ।
ল্যাম্পুরির তামাটে মুখে ফুটে উঠলো একরাশ ঘৃণা ।  ‘হ্যাঁ! ওই একটা সমস্যাই শুধু ...’
বল্ডপ্যাট মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বললো, ‘আপনার ভাবনায় সামান্য ভুল আছে, মহামান্য ল্যাম্পুরি । ওই সমস্যার সমাধান আমি ইতিমধ্যেই ভেবে নিয়েছি ।’
ঝলসে উঠলো ল্যাম্পুরির কালো চোখের মনি। ‘তাই নাকি! তাড়াতাড়ি বলো দেখি কি সেই উপায় । যাতে আমরা সবাই কাজটা শুরু করে দিতে পারি ।’
‘উহুঁ, মহান ল্যাম্পুরি,  আমরা সবাই একসাথে নয় । দরকার বাছাই কিছু মায়াদয়াহীন যোদ্ধা। ওদের কাজ হবে চটজলদি কিছু পিগমিকে ধরা । তারপর শিকলে বেঁধে ওই ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ওদের সার বেঁধে নিয়ে আসতে হবে!’
সোনা দিয়ে বাঁধানো সিংহাসন থেকে ঝুঁকে সামনের দিকে এগিয়ে এসে ল্যাম্পুরি জানতে চাইলেন, ‘এতে আমাদের সমস্যার সমাধান কি করে হবে বল্ডপ্যাট?’
খ্যালখেলিয়ে হেসে উঠলো ধূর্ত ভাড়াটে যোদ্ধা । ‘প্রান প্রিয় পিগমিদের ওইভাবে শিকলে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এটা দেখতে পেলেই অরণ্যদেব তার গোপন আস্তানা ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে আসবে।’
‘তারপর?’
‘ ঠিক তখনই আপনার লুকিয়ে থাকা বাহিনী বেরিয়ে আসবে আড়াল থেকে । অরণ্যদেবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে একসাথে । ব্যাস কেল্লাফতে ... বন্দী হবে চলমান অশরীরী !’
ল্যাম্পুরির মুখে ফুটে উঠলো শয়তানী হাসির ছাপ ।‘ হুম। পরিকল্পনাটা বেশ ভালোই । কিন্তু...মানে...আর কিছু?’
‘আর কিছু অবশ্যই আছে সম্রাট ল্যাম্পুরি । আমার ম্যাপে একটা পাহাড়ের চুড়া চিহ্নিত করা আছে । ওটা এখানকার সবচেয়ে উঁচু জায়গা । ওখানেই আপনার যোদ্ধারা অরণ্যদেবকে নিয়ে যাবে ওর ওপরে একটা খাড়া পাথরে শিকল দিয়ে বাঁধা হবে জঙ্গল পরিত্রাতাকে । নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে সবাই দেখতে পাবে কি রকম হেনস্থা করা হচ্ছে তাদের দেবতাকে । আমি একটা শক্তিশালী টাইম বোম বেঁধে দেবো অরণ্যদেবের পায়ে। সূর্য অস্ত গেলেই ওই বোমা ফাটবে... ব্যাস চিরতরে খতম হয়ে যাবে অরণ্যদেবের গল্প!’
দারুন একটা  তৃপ্তির ভাব মুখে নিয়ে সিংহাসনে গা এলিয়ে দিলো বিদ্রোহী নেতা ল্যাম্পুরি । চোখে যে বিজয় এখন আসেনি তার সুখস্বপ্নের ছায়া সুস্পষ্ট । ‘ বল্ডপ্যাট, আমি দারুন দারুন খুশি তোমার কাজে । যা দেবো বলেছিলাম তার দ্বিগুন দেবো কাজ শেষ হলে ।’

খুলিগুহার ভেতরে বসেই  অরণ্যদেব শুনতে পেলেন   দূর থেকে ভেসে আসা একটানা মন্ত্র পাঠের মতো শব্দ।
সময় নষ্ট না করে সেই শব্দ অনুসরণ করে সবুজ বনানী ভেদ করে এগিয়ে চললেন অরণ্যদেব মন্ত্রপাঠের শব্দের জোর ক্রমশ বাড়ছে । কথাগুলো শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার ...
‘...একদল সশস্ত্র মানুষ বান্ডারদের ঘিরে ধরেছে ... ওদের বন্দী করে বেঁধে ফেলেছে শিকলে... হে অরন্যদেব আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান!’
এগোনোর গতি আরো বাড়িয়ে দিলেন চলমান অশরীরী । কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌছে গেলেন একটা ফাঁকা মাঠের মতো স্থানে । দেখতে পেলেন একদল মানুষ এগিয়ে আসছে । ষোড়শ অরণ্যদেবের সুন্দর মুখশ্রী এই মুহূর্তে গ্র্যানাইট পাথরে খোদাই করা বলে মনে হচ্ছিল ।
ফাঁকা স্থানে এই মুহূর্তে প্রায় একশো বান্ডার উপজাতির মানুষকে দেখা যাচ্ছে। ওদের হাত পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ষ্টীলের শিকল দিয়ে।  চাবুক মারতে মারতে ওদেরকে জঙ্গলের পথ ধরে টেনে হিঁচড়ে  নিয়ে চলেছে একদল নানা রঙে চিত্রবিচিত্র করা মানুষ । ওরা ল্যাম্পুরির বাছাই করা নৃশংস যোদ্ধার দল ।
একাধিক চাবুকের ঘা খেয়েও কিন্তু একজনও বান্ডার পিগমির মুখ দিয়ে একটুও কষ্টের আর্তনাদ বের হচ্ছেনা। অরন্যদেব একইসাথে ওদের জন্য গর্ব এবং ওই চিত্রবিচিত্র অত্যাচারী লোকগুলোর প্রতি সাংঘাতিক রকমের রাগ অনুভব করছিলেন মনের ভেতরে ।
একটা বজ্রগম্ভীর চিৎকার ছেড়ে উনি লাফিয়ে গেলেন জঙ্গলের আড়াল ত্যাগ করে সামনের খোলা প্রান্তরে ...প্রায় একই সাথে  জোরালো “ছ্যাড়ড়-ড়াং-ছপাং” এর মতো একটা শব্দ শোনা গেল । বিরাট মাপের একটা জাল শূন্য থেকে ভেসে এসে পড়লো অরণ্যদেবের ওপর। অসহায়ের মতো আটকে গেলেন তার ভেতর চলমান অশরীরী ।
আরো একটা একইরকম বড় জাল এসে পড়লো আগের জালের ওপর ... এই মুহূর্তে অরণ্যদেব বন্দী ... !!
কিংবদন্তী প্রতিপক্ষর দিক থেকে বিপদের কোনো সম্ভাবনা নেই বুঝে এবার সামনে এলো কুটিল বিদ্রোহী নেতা ল্যাম্পুরি আর তার ভাড়াটে সেনাপতি বল্ডপ্যাট । দুজনের মুখেই শয়তানি হাসির জোয়ার ।
সহসাই অরণ্যদেবের গালে এক বেমক্কা চড় কষালো ল্যাম্পুরি !
‘ভালোই সাহসের পরিচয় দিচ্ছো ল্যাম্পুরি! হাতপা বেঁধে শত্রুকে মারছো। বাঃ!’
বাজখাঁই চিৎকার ছাড়লো ল্যাম্পুরি, ‘চোওওপ!’ তারপরেই ফিক করে হেসে বললো, ‘ওইসব উল্টোপাল্টা কথা বলে আর কি হবে অরণ্যদেব! নাহ, আটকাবো না তোমাকে, যা ইচ্ছে হয় বলে নাও। হাজার হোক এগুলোই তো তোমার শেষ কথা এ জীবনে’ মুখ ফিরিয়ে অনুচরদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ অ্যাই যা,  এটাকে নিয়ে গিয়ে বেঁধে ফ্যাল যেমন বলা হয়েছে !’
অবাক হয়ে সবাই দেখলো অরণ্যদেব নিজেকে ছাড়ানোর কোনো চেষ্টাই করছেন না । চিত্র বিচিত্রিত যোদ্ধার দল খাড়া পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে টেনে হিঁচড়ে ওপরে উঠাতে শুরু করলো অরণ্যদেবকে ।
বল্ডপ্যাটের মনের ভেতর কিন্তু একটা অস্বস্তির ঢেঊ উঠছিল ।
‘ অরন্যদেব কোনোরকম প্রতিবাদ করছেনা কেন ? তেড়েফুঁড়ে উঠছে না কেন!... কি কারন?’
ল্যম্পুরি উত্তরে বললো, ‘ আরে বল্ডপ্যাট, এই জন্যইতো মানুষ ওই অরণ্যদেবকে কিংবদন্তী মনে করে। ওর সব কিছু সৃষ্টি ছাড়া! তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ‘আমি মহান ল্যাম্পুরি কখনোই ওর বিষয়ে ছড়িয়ে থাকা গল্পগুলো বিশ্বাস করিনি । জানতাম ওসব ওর নিজের বানানো গল্প ... এবার সেটা বুঝতে পারবে এই জঙ্গলের অধিবাসীরা । যখন দেখবে তাদের পরিত্রাতার কি হাল করছি আমি!’
‘হয়তো আপনার কথা ঠিক, কিন্তু আমার ব্যাপারটা ভালো ঠেকছেনা । এতো সহজে ওই ...’
ল্যম্পুরি ঘোঁত করে একটা শব্দ করলো বিরক্তিসূচক । ‘তাতে হয়েছেটা কি শুনি? তুমি একটু বেশীই চিন্তা করছো বন্ধু! আরে আমাদের শক্তির কাছে ওই অরণ্যদেব হেরে গেছে, এটা বুঝতে পারছোনা নাকি?’
‘হ্যাঁ...মানে... ইয়ে, হয়তো আমারই বোঝার ভুল মহামান্য ল্যাম্পুরি।।’
অরন্যদেবকে নিয়ে ল্যাম্পুরির অনুচরেরা পৌছে গেছে পাহাড়ের ওপরেপেছন পেছন পৌছে গেছে ল্যাম্পুরি আর বল্ডপ্যাটও।  চুড়ার ওপরে থাকা একটা বড়সড় সুচালো পাথরের সাথে শিকল দিয়ে বেঁধেও ফেলা হয়েছে অরণ্যদেবকে। শেষ বিকেলের সূর্যালোকে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের প্রেক্ষাপটে চলমান অশরীরী সহ পাথরটা দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল প্রহরীর মতো । অরণ্যদেবের দিক থেকে আশ্চর্যজনকভাবে এখনো কোনও হেলদোল নেই ।  আর কিছুক্ষনের ভেতরেই সূর্য অস্ত যাবে।
ল্যাম্পুরি আবার একটা বিরাশী সিক্কা চড় কষালো অরণ্যদেবের গালে। বীভৎস একটা হাসি হেসে বললো, ‘ তাহলে এবার হতে চলেছে অরণ্যদেবের সমাপ্তি!’
অরণ্যদেব এবারেও রা কাড়লেন না। চোখের দৃষ্টি অত্যধিক শান্ত শীতল । পলক পড়ছেই না । একভাবে তাকিয়ে আছেন অত্যাচারী ল্যাম্পুরির দিকে।
বল্ডপ্যাট টাইম বোমটাকে রাখলো অরণ্যদেবের দু পায়ের মাঝখানের পাথরের ওপর । চালু করে দিলো যান্ত্রিক প্রকৌশল । তারপর তাকিয়ে দেখলো নিজের ঘড়ির দিকে।
‘আর পনেরো মিনিটের ভেতরেই সূর্য ডুবে যাবে। চলমান অশরীরী... অরণ্যদেবকে শেষবারের মতো দেখে নাও সবাই । দ্যাখো আমরা কিভাবে ওকে শিকলে বেঁধে রেখেছি ! আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত...ব্যাস ...তারপরেই কুচি কুচি  হয়ে যাবে তোমাদের পরিত্রাতার দেহ ... হাঃ হাঃ হাঃ!!!’
 ‘বিদায়, অরণ্যদেব!’ ফিচলেমির সুরে বলে উঠলো ল্যাম্পুরি । তারপরেই  হেসে উঠলো  বল্ডপ্যাটের সাথে তাল মিলিয়ে । জান্তব সেই হাসির দমক প্রতিধ্বনিত হলো ঘন রহস্যময় জঙ্গল এলাকায়।  ‘ ওহে চলমান অশরীরী! ভালো করে দেখে নাও মহান ল্যাম্পুরিকে । ভালো করে দ্যাখো ! একসময় যে এলাকায় তুমি রাজত্ব করেছো সেখানকার আগামীদিনের সম্রাটকে!’
কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে দলবল নিয়ে ওরা নামতে  শুরু করলো নিচের দিকেএকসময় সবুজ গাছের অন্ধকারাচ্ছন্নতায় মিশে গেল ওদের শরীর ।  খুব বেশী হলে আর মিনিট দশ বারো সময় বাকি আছে সবকিছু সমাপ্ত হতে ।  ওই স্ময়টুকুই শেষবারের মতো দেখা যাবে অরণ্যদেবকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় ওই খাড়া পাথরের গায়ে। এই সময়ের ভেতরেই ল্যাম্পুরি আর তার দলবলকে ফিরে যেতে হবে নিচের খোলা প্রান্তরে।
যদিও নিজের পরিকল্পনার প্রথম পর্ব সমাপন করার জন্য অরন্যদেবের মাত্র কয়েকটা সেকেন্ডই যথেষ্ট ভাড়াটে যোদ্ধা বল্ডপ্যাট বা কুটিল ল্যাম্পুরি কারোরই কোনো ধারনা নেই শৃঙ্খলে আবদ্ধ কিংবদন্তী স্বরুপ মানুষটার পেশীগুলোতে কি অসীম শক্তি লুকিয়ে আছে ।
একটা বড় করে শ্বাস নিলেন অরণ্যদেব -- ফুলে উঠলো শরীরের সবগুলো পেশী । একটু বাদেই শোনা গেল ধাতব ঘর্ষণের কর্কশ শব্দ -- আরো কয়েকটা সেকেন্ড যেতে না যেতে তীব্র ক্যাড়াং ক্যাড়াং কট কট কিছু শব্দ হলো -- চলমান অশরীরী এখন সম্পূর্ণ মুক্ত ।
চাপা নিচুমাত্রায়  একটা বিশেষ রকমের শিসের শব্দ  নির্গত হলো অরন্যদেবের দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। ততক্ষনাৎ চারদিকের জঙ্গলের ভেতর থেকে নড়ে উঠলো কিছু অবয়ব । একদল পিগমি যোদ্ধার আবির্ভাব হলো রঙ্গ মঞ্চে ।
না নড়ে দ্রুত নিজের নির্দেশ জানিয়ে দিলেন অরণ্যদেব। কয়েক মিনিটের ভেতরে তৈরি হয়ে গেল অরণ্যদেবের মতো দেখতে একটা অবয়ব পুতুল –বিদ্যুৎ গতিতে হয়ে গেল আসলের সাথে পুতুল অবয়বের স্থান পরিবর্তন -- দূর থেকে দেখে মনে হবে  অরণ্যদেব যেন এখনো শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে আছেন পাথরটার সাথে!
কাজটা শেষ হতেই অরণ্যদেব জানিয়ে দিলেন তার পরবর্তী নির্দেশ। তারপর অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে নামতে শুরু করলেন পাহাড়ের ঢাল । তার সে গতির সাথে পাল্লা দিতে পারলোনা তার অতি অনুগত পিগমি যোদ্ধার দল।
একেবারে নিচে প্রথম ফাঁকা জায়গাটায় এখন কেউ নেই। অরণ্যদেব একবার ফিরে তাকালেন নিজের নকল অবয়বটার দিকে। অস্তগামী সূর্যের আলোয় পাহাড়চূড়ায় ওটাকে স্যিলুয়েটের মতো দেখাচ্ছে । নিশ্চিত ভাবেই হাজার হাজার অরণ্যদেবপ্রেমী মানুষ ইতিমধ্যেই ওটাকে দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন । তাদের রহস্যময় পরিত্রাতা শাসকের এ হেন পরিণতি তাদের কল্পনাতেও ছিলনা । তবে এ অবস্থা  আর খুব বেশীক্ষন স্থায়ী হবেনা!
কিছুটা দুরেই দ্বিতীয় একটা ফাঁকা প্রান্তর। অরণ্যদেব দ্রুত এগোতে থাকলেন । কানে ভেসে এলো উল্লসিত একাধিক মানুষদের কন্ঠস্বরতার ভেতর থেকেই শুনতে পেলেন বল্ডপ্যাটের গলা । ‘আর পাঁচ মিনিট! মাত্র পাঁচ মিনিট ! ব্যাস তার পরেই অরণ্যদেবের কিস্যা খতম ! হাঃ হাঃ হাঃ !!!’
কথাগুলো শেষ হতে না হতেই চরাচর কেঁপে উঠলো এক বিকট বিস্ফোরণের শব্দে । সাথেই চোখ ধাঁধানো একটা আগুনের গোলা লাফিয়ে উঠলো আকাশে!
যা দেখে ও শুনে আনন্দে এক পাক নেচে নিলো ল্যাম্পুরি । চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘অরণ্যদেব খতম... অরন্যদেব আর নেই ... হাঃ হাঃ হাঃ...’
কিন্তু পরমুহূর্তে তিনটে মাত্র শব্দ বল্ডপ্যাট আর ল্যাম্পুরিকে আতঙ্কে জমিয়ে পাথর করে দিলো ।
 ‘ আছি, বেঁচে আছি!’
শিহরনের বরফ শীতল স্রোত বয়ে গেল দুজনে শিরা উপশিরায়বিদ্যূতগতিতে একের পর এক ঘুষি চালালেন     অরণ্যদেব ওদের লক্ষ্য করে । লৌহ মুষ্ঠির সে আঘাত সহ্য করতে না পেরে কাটা কলাগাছের মতো ধপ ধপ করে দুজনেই পড়ে গেল মাটিতে।
ওদের সাথে যে সমস্ত যোদ্ধারা এসেছিল এবার শোনা গেল তাদের আর্ত চিৎকার । জলস্রোতের মতো চারদিক থেকে ধেয়ে আসা বান্ডার পিগমি যোদ্ধাদের সামনে ওরা মাটিতে মিশে গেল খড়কুটোর মতো !
অরণ্যদেব এবার ঘুরে তাকালেন বান্ডারদের রাজা এবং বাকি নেতাদের দিকে। ‘আশা করি তোমাদের বুঝিয়ে বলার দরকার নেই কেন আমি প্রথম থেকে কিছু করিনি । আমি শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করেছি – তারপর কি হলো সেটাতো তোমরা নিজের চোখেই দেখলে ।’
‘হে চলমান অশরীরী! আপনি সবার চেয়ে বেশী সাহসী  । আমরা আপনাকে ভালোবাসি শ্রদ্ধা করি ।’ বললেন বান্ডারদের রাজা । তার সাথে গলা মিলিয়ে বাকি নেতারা   বললেন, ‘আপনি শক্তি ও বুদ্ধিতে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী ক্ষমতার অধিকারী । আমরা কেন জানতে চাইবো আপনি কি ভাবছেন ।’
এবার শুধু রাজাই জানতে চাইলেন, ‘এইসব বদমাইশগুলোকে নিয়ে কি করবো যদি বলে দেন তাহলে ...?
অরণ্যদেবের মুখে ফুটে উঠলো স্মিত হাসি । বুদ্ধি দৃপ্ত উচ্চারনে বললেন,  ‘ ওরা সাথে করে অনেক শিকল নিয়ে এসেছিল বলেই মনে হচ্ছে... এবার ওগুলো দিয়ে ওদেরকেই বেঁধে নিয়ে চলো তোমাদের গণতান্ত্রিক বিচারসভায় । ’
সমাপ্ত