Search This Blog

Monday, August 17, 2020

ওরা সাতজন - প্রতিম দাস


[Lord Dunsany এর লেখা নাটক The Gods of the Mountain এর ছায়ায়]

ওরা সাতজন

প্রতিম দাস

আজ থেকে এক হাজারের কিছু বেশি বছর আগের এক সকাল।  এক  প্রাচীন নগরীর সীমানা প্রাচীরের বাইরে তিনটে মানুষ বসেছিল। ওরা ভিখারিকিছুটা দূরেই নগরে প্রবেশের প্রধান ফটক।  একদা যার পরিচিতি সাত কীলকের দরজা নামে ।   এই দরজার নিচ দিয়েই কয়েক হাজার বছর আগে  গিলগামেশ আর এনকিডু গিয়েছিল হুমবাবা নামক রাক্ষস নিধনেসে অনেক কাল আগের কথা। নগরে আজও প্রেমের দেবী ইস্থারের মন্দিরটা আছে। কিন্তু সেখানে আজ আর তার উপাসনা হয় না। সময় বদলেছে। বদলে গেছে দেবতা । বদলে গেছে মানুষের মন । সামাজিক অবস্থায় ঘটেছে এক বিরাট পরিবর্তন। গরীব আরো গরীব হয়েছে আর ধনীদের কোষাগারে জমছে অর্থের রাশি। যাকগে আন কথা থাক চলুন ভিখারিরা কী বলছে একটু শোনা যাক। ওরাই তো এ কাহিনীর মূল কুশীলব।

ওদের ভেতর যার নাম জাবন সে বলল, “ভিক্ষা তো আর পাওয়াই যাচ্ছে না। অবস্থা খুব  খারাপ

দ্বিতীয় ভিখারি রাগ্ন বলল, “নগরের ভেতরে যারা থাকে তারা আর  ভালো মানুষ নেই ।” 

লোবান নামের,  বয়স্ক  তবে চুল পাকেনি, ভিখারিটা বলল,  “সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা  এই শহরের ধনীমানুষ গুলোর মাথা বিগড়ে দিয়েছে আগেকার মানুষদের মত, ওরা দান ধ্যান  করে মনে সুখ পায়না।  আগের মতো পরোপকারী মানুষই আর নেই। সব ব্যাটা হাড় কেপ্পন  হয়ে গেছে। আগেকার কথা মনে হলে খুব দু;খ হয়গো ।”   

জাবন একথা শুনে বলল, “আমার তো ওদের জন্যই দুঃখ হয় খুড়ো। যারা মানুষের দুঃখ বোঝে না তাদের হৃদয়ের রংটাই মনে হয় বদলে গেছে।”   

রাগ্ন সম্মতির সুরে বলল,  “ঠিকই বলেছো ভায়া। আমাদের সময় বড়ই খারাপ

চিন্তান্বিতভাবে জাবন  বিড় বিড় করে বলল, “অনেকদিন হয়ে গেল কিন্তু । ঠিক কি যে হয়েছে কে জানে?”

 মাথা চুলকে, একটা উকুন বের করে নখ দিয়ে টিপে মেরে রাগ্ন উত্তর দিল, “কী আর হবে   শয়তান ভর করেছে নিশ্চিত।” 

লোবান বিজ্ঞের মত গম্ভীর স্বরে বলল, “আমার মনে হয় পৃথিবীর কাছাকাছি কোনো ধূমকেতু এসেছিলতারই প্রভাবে  পৃথিবীর সব বদলে গেছে ।  এমনকি দেবতাদের মাথাতেও গণ্ডগোল হয়েছে । ফলে মানুষের ভেতর দেবত্ব বলতে যা বোঝায়,  ওই যাকে বলে, পরোপকার, মাতাল হওয়া, বাড়াবাড়ি রকমের দানশীলতা, গান বাজনা শোনা সব সব হারিয়ে যাচ্ছে । দেবতারাও সামলে উঠতে পারছেন না।”   

জাবন কথাগুলো শুনে বলল,  “তাহলে তো সত্যিই খুব হতাশাজনক ব্যাপার।”  

রাগ্ন হাত তুলে জানাল,  “আমি কিন্তু সত্যিই রাতে ধূমকেতু দেখেছি

লোবান খুড়ো চোখ বড় বড় করে বলে, “বলছোটা কি হে? দেবতারাই ভেবলে গেলেন!”   

জাবন দেওয়ালের গায়ে ঠেঁস দিয়ে বসে বলল, দ্যাখো খুড়ো, যদি দেবতারা সুস্থ না হয়ে ওঠেন তাহলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার।  আমি তো ভিক্ষা করাই ছেড়ে দেব ভাবছি । রাস্তার মোড়ে একটা দোকান কিনবজমিয়ে বিক্রিবাট্টা চালাব  লাভ ভালোই হবে।”   

রাগ্ন গুটি গুটি পায়ে জাবনের কাছে হেঁটে গিয়ে মুখটা ভাল করে দেখে ফিক করে হেসে বলল,  “তুমি  একটা দোকান কিনবে ?

বয়স্ক ভিখারিটা এই সময় বলল, “অ্যাই চুপ চুপ দুজন নতুন আদমি আসছে। ভিক্ষা চাওয়া যাক।”

যে দুজনের কথা লোবান বলল তাদের একজন বেশ লম্বা। আচরনে গর্বিত উদ্ধত্যের ছাপ স্পষ্ট । হাতে একটা লম্বা লাঠি।  নাম তোস্কার।  ওর পেছন পেছন বেঁটে মত একটা মানুষ । ওর চাকর বলা যায় । নাম ছুকন্দ।

তোস্কার বলল, “ছুকন্দ, আমি কী ঠিক শুনলাম? কথাটা যে বলল সে তো মনে হচ্ছে একজন ভিখারি? ”

ছুকন্দ সম্মতির ভঙ্গীতে মাথা ঝোঁকাল । সেটা দেখে তোস্কার এগিয়ে গেল ভিখারিগুলোর দিকে।

“অ্যাই যে! তোমরা ভিখারি?” জানতে চাইল তোস্কার।

জাবন উত্তর দিল, “হ্যাঁ, হুজুর, আমরা সব দরিদ্র ভিখারি

 “কতদিন ধরে ভিক্ষুকগিরি করছো?”

জাবন জানালো,  “সেই যবে থেকে এই  নগর নির্মান হয়েছে হুজুর।”

কথাটা শুনে লোবান বলল, “ধুর হতভাগা কী বলছিস পাগলের মত। আজ্ঞে হুজুর আমরা জাত ভিখারি।” 

তোস্কার বলল,  “বটে। তা কবে থেকে ভিখারিরা ব্যবসা করার কথা ভাবছে শুনি?  কখন কোনও ভিখারিকে  লোক ডেকে জিনিস বিক্রি করতে বা  ব্যবসা করতে দেখেছে কেউ ?  

জাবন আমতা আমতা করে বলল, “ ইয়ে, মানে না,  কখনোই করেনি

“তাহলে তুমিই প্রথম যে এই কাজ ছাড়তে চলেছো?”   

“ভিক্ষা করার পক্ষে সময়টা খুব খারাপ চলছে হুজুর ।”

রাগ্ন সায় দিল, “খুবই খারাপ হুজুর

“আর তার জন্য তোমরা ভিক্ষা করাই ছেড়ে দেবে?”

   জাবন ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল,  “এই শহর আর ভিখারিদের জন্য নেই প্রভু । দেবতারাও হতাশ হয়ে পড়েছেন । মানুষের  যা কিছু শুভ বুদ্ধি সব মরে ভুত হয়ে গেছে । কী খুড়ো আমি ঠিক বলছি কিনা?  দেবতারা  ঘুমিয়েই পড়েছেন মনে হয় ?

রাগ্ন আবার একটা উকুন মেরে বলল,  “একদম, তারা হুমবাবা পাহাড়ে   ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন সাতটি সবুজ মূর্তিই পাথর হয়ে গেছে। সে না হয় হল, কিন্তু এ লোকটা কে ? আমাদের জ্ঞান দিচ্ছে যে বড়!” তারপর একটু তেড়ে ফুঁড়েই এবার বলে উঠল,  এই আপনি কে বলুন তো?  আপনি কী বড়সড় কোনো ব্যবসায়ী ? আপনি আমাদের মতো ক্ষুধার্তদের খাবার দিতে পারবেন?”   

তোস্কারের পেছনে দঁড়িয়ে থাকা ছুকন্দ চোখ বড় বড় করে বলল, “আমার প্রভু ব্যবসায়ী! আরে না না আমার প্রভু  ব্যবসায়ী নন। মোটেই নাএকদমই না।”   

জাবন কিছুটা ঘোর লাগা স্বরে বলে উঠল,  “আমি বুঝতে পেরেছি উনি ছদ্মবেশে এসেছেন । খুব ধনী কেউ হবেন। এবার মনে হচ্ছে দেবতারা জেগে উঠেছেন।  আমাদের বাঁচাতে এনাকে   পাঠিয়েছেন

ছুকন্দ বলে উঠল, “আরে নারে বাবা না   আমার প্রভুকে তোমরা চেনো না। উনাকে বোঝার ক্ষমতা তোমাদের নেই।“

রাগ্ন জানতে চাইল, “তাহলে উনি কি সুলতান টুলতান জাতীয় কিছু ? আমাদের ব্যাপারে কথা বলছেন কেন?” 

 অত্যন্ত গর্বের সাথে তোস্কার বলল,  “আমিও একজন ভিক্ষুক, শুধু তাই নয় অনেক বয়সও হয়েছে আমার।” 

ছুকন্দ জানাল,   “আমার প্রভুর মতো এ জগতে  আর কেউ নেই আজ অবধি উনার মতো চতুর এবং ধূর্ত  মানুষ একটাও দেখতে পাইনি । এমন কি সূদুর সিন্ধের এলাকা আগত ভ্রমণকারীদের ভেতরেও এরকম বুদ্ধিমান কাউকে দেখিনি।” 

 লোবান খুড়ো ঝুঁকে অভিবাদন করে বলল, “আমাদের শয়তান আক্রান্ত নগরে  আপনাকে   স্বাগত হে মহা ভিক্ষুক । দুঃখ এটাই যে, এমন সময়ে এলেন যখন কেউ ভিক্ষাই দিচ্ছে না।”   

অর্ধেক নিমীলিত চোখে মাথা আকাশের দিকে তুলে তোস্কার বলল,   “রাস্তাদের রহস্য কেই বা বোঝে আর কেই বা জানে  সকালের তাজা বাতাস কি বার্তা বয়ে আনে তাও কি বোঝা যায়?  কোন মানুষের আত্মা  দানশীলতার পরিচয় দেবে কেউ কি বলতে পারে? ব্যাবসায়ীরা কী কখনো তাদের লাভের গোপন সূত্রের কথা ফাঁস করে?”  

 জাবন এসব কথা শুনে বলল, “শুনুন হুজুর, কিসব জিজ্ঞাসা করলে্‌ তার  মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। তবে বাপু আমি কিন্তু আগে ভাগে জানিয়ে রাখছি,  সময় খুব খারাপ

তোস্কার একটা হাত তুলে অভয়দানের ভঙ্গিতে বলল,  “আমি সব ঠিক করে দেব

“এমন কিছুই নেই যা আমার প্রভু করতে পারেন না,” ফুট কাটল ছুকন্দ।

তোস্কার ছুকন্দের দিকে তাকিয়ে বলল,  “ এই যে, বক বক করাটা থামিয়ে আমার কথাগু্লো মন দিয়ে শোন” তারপর ভিখারিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “দ্যাখো, এই নগরের আমি কিছুই চিনি না, জানিনা। অনেক দূর থেকে এসেছি। ইল্বান শহরের নাম শুনেছ নিশ্চয় তোমরা?”    

ছুকন্দ বলল,  “প্রভু সেখানে তিনবার শকট থেকে  ছিটকে পড়ে গিয়েছিলেন ।  আহতও হনএকবারতো প্রায় মরেই গিয়েছিলেন। সাতবার উত্তম মধ্যম খেয়েছেন । হতচ্ছাড়ারা সব কিছু কেড়েও নিয়েছে কত শত বার।  তবে প্রত্যেকবার উনি ক্ষতিপূরন পেয়ে গেছেন । মানে হাত... ইয়ে,  মানে আদায় করে নিয়েছেনউনার শরীরে নয় রকমের ব্যাধি বাসা বেঁধেছে , যার একটা হলেই ...  

 “আহ!  চুপ করো ছুকন্দ  আচ্ছা তোমাদের এই ভিখারিদের ভেতর কোনও চোর আছে?” 

জাবন জানাল,  “আজ্ঞে হুজুর, সেতো আছে গোটা কয়েক । কিন্তু আপনার তাদেরকে চোর বলে  মনে হবে কিনা কে জানে। খুব একটা ভাল চোর নয় তারা।”   

“উঁহু না না তাহলে হবে না। আমার দক্ষ চোর দরকার। তার আগে দরকার কিছু খাবারআছে নাকি কিছু তোমাদের কাছে?”

তিনজনেই একসাথে মাথা নাড়ল নেতিবাচক ভাবে“সময় খুব খারাপ হুজুর।”  

এই সময় নগরের প্রবেশদ্বার পার করে  দুজন জাঁকজমক যুক্ত পোশাক পরিহিত মানুষকে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। এরা নগর প্রশাশনের সাথে যুক্ত অভিজাত মানুষ ।

 “তাহলে জোরাব,  আমরা ভূমধ্য সাগরে জাহাজ  পাঠাচ্ছি ।” 

 “হ্যাঁ মাননীয়, ইবোলা,  রৌপ্য ফটক পার হয়ে ওরা পৌঁছে যাবে সঠিক স্থানে ।”   

তোস্কার সহসা তার  লম্বা লাঠির মোটা দিকটাকে বাম বগলের তলায় ঢুকিয়ে শরীর ঝুঁকিয়ে দাঁড়ালো । দেখে মনেই হচ্ছিল না এই সেই একটু আগের গর্বিত মানুষটা । ডানহাতটা ল্যাতপ্যাত করে ঝুলে আছে আর কাঁপছে। মাথা কোনো রকমে তুলে সে শুরু করলো ভিক্ষা চাওয়া।  

জোরাব নাক সিঁটকে মুখ বিক্রিত করে বললেন, “মাফ করো হে, আমি কিছু দিতে পারবোনা ।  এখানে প্রচুর ভিখিরি রয়েছেশহরকে সুস্থ রাখতে এদের হাত থেকে আগে আমাদের বাঁচতে হবে।”   

তোস্কার প্রায় কেঁদে ফেলার মত করে বলল, “মাই বাপ আমি অনেক দূর থেকে এসেছি সাতদিন কিছু খাইনি।” প্রায় সত্যি কথাই বলল সে।   

কথাটা শুনে ইবোলা কী ভেবে ফিরে দাঁড়ালেনতোস্কারকে  একটি বড় মাপের মুদ্রা দিয়ে হনহন করে  ওখান থেকে চলে গেলেন তোস্কার একটু অপেক্ষা করে  খাড়া হয়ে দাঁড়াল এবং বাকি ভিখারিদের কাছে ফিরে গেল

 

 

 

 

ওইদিন অপরাহ্ণে। সকালের পাওয়া মুদ্রাতে পাঁচজনের উদরপুর্তি হয়েছে ভালোমতোই।  আপাতত তোস্কার তার পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছে ওদের।

“আমাদের বেশ কিছু ভালো পোশাকের দরকারচোরের সাহায্য এই জন্যই প্রয়োজন শুধু তাই নয় সবুজ রেশমের কাপড়ের পোশাক হতে হবে ।”   

নতুন এক ভিখারি যোগ দিয়েছে ওদের সাথে। সে বলল, “আমি যাচ্ছি চোর খুঁজে আনতে ।”    

লোবান পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “আমরা বড়লোকদের  মতো পোশাক পড়ে  নগরে প্রবেশ করব বুঝি ?” 

জাবন উৎসাহের সুরে বলল,  “হ্যাঁগো খুড়ো, সবাইকে জানাব আমরা দূরের কোনও দেশ থেকে আসা রাষ্ট্রদূত

লোবান চোখ বুঁজে জিভটা একবার চেটে নিয়ে বলল, “উফ! উফ! উফ! তাহলে তো বেশ ভাল খাওয়াদাওয়াও হবে, কী বলিস!”

ছুকন্দ লোবানের কানের কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “ আরে তুমি তো আমার প্রভুকে চেনোই না। তুমি যেখানে ভাবছ, আমরা ধনীদের মতো সেজে যাব। সেখানে উনি নিশ্চিত অন্য কিছু ভাবছেন। আবার হয়তো এটাও হতে পারে যে,  আমরা রাজা সেজে যাব  

লোবান অবিশ্বাসের সুরে বলে ঊঠল,  “ভিখারিরা রাজা সেজে যাবে!”

 “হতেও পারেজানোনা তো আমার প্রভুর ভাবনাচিন্তার বিস্তার কতখানি !”

এবার লোবান, তোস্কারের দিকে তাকিয়ে বলল,  “ হুজুর আপনি আমাদের কী করতে আদেশ দিচ্ছেন?”

“তোমাদেরকে সবার আগে ভালো পোশাক পড়তে হবে ।”  

  “বেশ। তারপর কী করব হুজুর?”

  “তাহলেই আমরা  দেবতায় পরিণত হব!”  

তিন ভিখারি চোখ বড় বড় করে একসাথে বলে উঠল,  “দেবতা!!!”

 “হ্যাঁ দেবতা । আমি যে পথটা দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এলাম সেটার ব্যাপারে কিছু জানো তোমরা?  হুমবাবা পাহাড়ের নাম শুনেছ নিশ্চয়।  সেখানে পাহাড়ের ওপর সবুজ পাথর  খোদাই করে দেবতার মূর্তি বানানো আছে।  সাতজন দেবতা । বসে আছেন পাহাড়ের গায়ে নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। ভ্রমণকারীরা ওদের পূজা করেন

বয়স্ক লোবান বলল,  “হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানব না কেন । জানি তো । এখানকার মানুষেরাও ওদের  খুব শ্রদ্ধা করে। আমরাও করতাম ।  কিন্তু ইদানিং উনারা ঘুমিয়ে পড়েছেন আর আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।” 

তোস্কার বলল, “আমি পরীক্ষা করে দেখেছি মূর্তিগুলো  সবুজ মরকত মনি দিয়ে বানানো ডান কনুইটাকে বাম হাতের উপর রেখে বাবু হয়ে বসে আছেন বিশ্রামের ভঙ্গীতে।  ডানহাতের তর্জনী উঠিয়ে রেখেছেন আকাশের দিকে। আমরা ওই হুমবাবা পাহাড়ের দিক থেকে ছদ্মবেশে শহরে প্রবেশ করব সবাইকে জানাব, আমরাই সেই দেবতা।  সাত  দেবতাদের  মতোই আমাদের দলে  সাতজন থাকবে।”   

রাগ্ন বলল, “এ লোকটা পাগল নাকি খুড়ো? মানু্য? কখনো দেবতা হয়?”

তোস্কার গম্ভীর স্বরে বলল, “প্রয়োজন আর স্বার্থ এই দুটো যখন এক হয় যখন তখন মানুষ দেবতার রুপ নেয়। যাকগে বাজে কথা রেখে,  ভালো করে শুনে নাওযখনই আমরা বসবো ,   অবশ্যই ওই দেবতাদের মতো ভঙ্গীতে বসবো। অর্থাৎ বাবু হয়ে বাম হাতের উপর ডান কনুই এবং ডানহাতের আঙ্গুল আকাশের দিকে ভাল করে অভ্যাস করে নাও।”

লোবান ঘ্যাস ঘ্যাস করে মাথা চুলকে বলল, “হুজুর এই  শহরের হালচাল কিন্তু ভাল নয় । কোনো ক্রমে ধরা পড়ে গেলে  পিটিয়েই মেরে ফেলবে । মানুষজনের স্নেহশীলতা কিন্তু একেবারেই হেজেমজে গেছে।  দেবতারা শহরে ভাল কিছু করছে না বলে ব্যবসায়ীরাও খাপ্পা হয়ে আছে।”  

ছুকন্দ বলল, “বড্ড বাজে বকো তোমরা। অ্যাই শোনো কালকে সবার আগে সবাই মাথা ধোবে পাহাড়ি ঝরনার জলে । আমি বন থেকে রিম্বন ফল এনে দেব । চুল সাফ হয়ে যাবে।”   

 তোস্কার মাটির পাত্র থেকে এক চুমুক জল খেল তারপর বলল,  “বছরের পর বছর ধরে তোমরা এই প্রাচীন পদ্ধতিতে মানুষের কাছে গালাগাল খেয়েও ভিক্ষা চেয়ে চলেছকিছুই তো পাচ্ছো না বললে। শোনো, এবার আমাদের সময় এসেছে। কিছু করে দেখানোর। অনাহারে মরার চেয়ে চেষ্টা করাটাই কি ভাল নয়     

লোবান বলল,  “ইয়ে হুজুর বলছিলাম কী,  দেবতারা আবার রেগে যাবেন না তো?”   

 দ্যাখো লোবান খুড়ো, তোস্কার বলল,  “ভালো করে ভেবে দেখলে সারা জীবনটাই তো আসলে দেবতাদের কাছে ভিক্ষা চাওয়া, তাই নয় কী? চিন্তা করে দ্যাখো, কী করে সবাই?  ধূপ, দীপ জ্বালিয়ে  ঘন্টা বাজিয়ে ভোগ নিবেদন করে আসলে ভিক্ষাই তো চায় ।”   

জাবন সম্মতির সুরে বলল,  “হ্যাঁ, তা যা বলেছেন।  সমস্ত মানুষ সত্যিই দেবতার সামনে ভিখারি ছাড়া আর কিছুই না

তোস্কার বলল, “আমরা যেমন কোনও রাস্তার কোণে বসে ভিক্ষা চাই, ঠিক তেমনই  মহামান্য শাসক তাঁর উপাসনা গৃহের বেদীর  সামনে হাতজোড় করেন তো নাকি?”

লোবান ভুরু কুঁচকে বলল,  “তা কথা খান মন্দ বলেননি হুজুর ।”

 পুনরায় গর্বিত ভঙ্গীতে তোস্কার বলল,  “দেখতে পাবে, পুরোহিতদের অর্চনায় দেবতারা যেমন আনন্দিত  হনওরাও আমাদের দেখে ঠিক সেরকমই আনন্দিত হবে। 

লোবান বলল, “তবুও আমার ভয় হচ্ছে

ছুকন্দ বলল, “তাহলে ওই ভয়টাকেই জলে চুবিয়ে আর নয় আগুনে শেঁকে খাও। দ্যাখো পেট ভরে কিনা।”

তোস্কার, ছুকন্দকে আঙুলের ইশারায় কাছে ডাকলেন ।  “শোন তুই  কাল সকালেই নগরে চলে যাবিএদিকে সেদিকে কথা চালাচালি শুরু করবি ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো করে যেন তেন ভাবে এটা প্রচার করে দিতে হবে পাহাড়ের গায়ের  সবুজ পাথরের খোদাই দেবতারা খুব জলদি কিছু সাধারন মানুষের  ছদ্মবেশে এখানে আসবে

“ঠিক আছে প্রভু ।  ইয়ে বলছিলাম কী,  আমি নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করব ? নাকি এটি কোনও পুরানো পুঁথিতে পেয়েছি সেটা দেখাব?

তোস্কার একটু ভাবল। “পুরোনো পুঁথি এখন কোথায় পাবতুই বলবি হুমবাবা পাহাড়ের পাকদন্ডী দিয়ে এই নগরে আসার সময়, এক সন্ন্যাসীর কাছে  কিছু দুর্লভ দস্তাবেজের ভেতর তুই ওটাকে দেখেছিস বাছ বিচার করবি না বুঝলে।  যাকে পাবি তাকেই বলবিপারলে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাগলের মতো চিৎকার করে বলবি” 

 “যেমনটি বললেন তেমনই করব প্রভু ।”

ওই দিন মধ্যরাত।  ভিখারি আর তোস্কার নিদ্রামগ্ন। একজন মানুষ পা টিপে টিপে  ওখানে এসে দাঁড়ায়এক এক করে সবাইকে দেখে তারপর জাবনের গায়ে একটা খোঁচা মারে । জাবন  ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। “কে? কে?” তারপর ক্ষয়া চাঁদের আলোয় লোকটাকে দেখে বলে ওঠে, ও তুমি! কাজ সাড়া।

ইতিবাচক ভাবে মাথা নাড়ে মানুষটা ।

 জাবন উঠে যায় তোস্কারের কাছে । বলে, “হুজুর! হুজুর,  আমাদের  চোর বাবাজীবন এসে গেছেন

তোস্কার সম্ভবত জেগেই ছিলপ করে উঠে বসে চোরের দিকে তাকিয়ে  উৎসাহের স্বরে বলল,   “আরে বাঃ! তুমি তো  বেশ জলদি কাজ করতে পার দেখছি

চোর একটু ইতস্তত করে জানাল,  “যতটা দরকার সবটা পারিনি হুজুর। কেবলমাত্র তিনটে সবুজ পোশাক যোগাড় করে আনতে পেরেছি নগরে এই ধরনের পোশাক খুব একটা পাওয়া যায় না। তার ওপর আবার সবুজ রঙ। পরিস্থিতি খুব খারাপ  হঠাৎ করে একই ধরনের  জিনিস এতগুলো একসাথে না পাওয়া গেলে সন্দেহ দানা বাঁধবে ।”  

তোস্কারের কপালে ভাঁজ পড়ল। “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে না তুমি খানদানি চোর!”    

চোর কথাটা শুনে দুহাত জড়ো করে ওপরের দিকে তুলে বলল,  “দেবতারা আমাকে ক্ষমা করুন আমি সারা জীবনে সেভাবে কোনোদিনই চুরি করিনি নেহাত পেটের জ্বালায়...”

 তোস্কার মোলায়েম স্বরে বলল,  “আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে । তুমি যা নিয়ে এসেছ তাতেই আমাদের উদ্দেশ্যটি কার্যকর হতে অসুবিধা হবে না।  তা তুমি কবে প্রথম  চুরি করেছিলে কিছু মনে আছে?

চোর বলল, “আজ্ঞে  যখন দশ বছর  তখন আমি প্রথম চুরিটা করেছিলাম

ছুকন্দ বলে উঠল, “যখন  দশ বছর!

“বুঝলাম,” তোস্কার বলল“ওই বয়সে সবাই চুরি করে। বাদ দাওএই যে লোবান,  শোনো এই পোশাকগুলোকে কাটতে হবে । বেশ কিছু টুকরো করা দরকার।  রাগ্নের দিকে তাকিয়ে বলল,  “আরো একজন ভিখারি চাই আমাদের।”

ছুকন্দ বলল, “তোমরা কী জানো,  যখন আমার প্রভুর দশ বছর বয়স, তখন উনাকে একরাতের ভেতর দুটো নগর পার করে পাল... ইয়ে চলে যেতে হয়েছিল।” 

জাবন অবাক হয়ে বলল, “দু দু'টো নগর ! এক রাতে!”

 “হ্যাঁ,”  বুক ফুলিয়ে ছুকন্দ বলল,  “হুঁ হুঁ বাবা। উনি কী আর যে সে মানুষ। প্রভুর নিজের  নগরের লোকেরা আজও জানে না যে চন্দ্র মন্দিরের মাথায় যে সোনার বড় পদ্মটা ছিল, সেটা কোথায় গেল।”    

তোস্কার বলল, “আহ! ছুকন্দ, গল্প বলতে গিয়ে ভুল হয় না যেন। ঠিকঠাক মাপে  টুকরোগুলো কর কাল কীভাবে নগরে প্রচারের কাজটা করবি সেটাও ভাল করে ভেবেচিন্তে রাখ

লোবান জানতে চাইল,  “এই টুকরোগুলো  আমরা নিজেদের এই পোশাকের ওপর আটকে নেব তাইতো হুজুর?” 

জাবন বলল, “তা ছাড়া আবার কী। আহা আমাদের যা দেখাবে না।”   

তোস্কার চাপা আদেশের সুরে বলল, “বোকার দল! মোটেই না । আমরা মোটেই ওভাবে ছদ্মবেশ  ধারণ করব না

“আমাদের এই ছেঁড়া ফাটা পোশাক ঢাকব না বলছেন?”  জাবন জানতে চাইল।

“একদমই  না সাতটা পোশাক পেলে সেগুলো পড়ে তার ওপর  এই ছেঁড়া ফাটা পোশাক পড়তাম। আমি চাই, আমাদের দিকে যারা তাকাবে, তারা যেন বলে এরা রাস্তার ভিখারি যারা ভাল করে দেখবে তারা বলবে, নিজেদের লুকিয়ে রাখতে এরা ছদ্মবেশ ধারণ করেছে

 লোবান একটু অবাক হয়ে বলল,  “তাহলে আমরা কী করব? আপনি পোশাকগুলো কাটতেই বা বললেন কেন?”

“আমরা সাতজনই নিজেদের ছেঁড়া পোশাকের নীচে কয়েকটা করে সবুজ কাপড়ের টুকরো   বেঁধে নেব এমন ভাবে বাঁধতে হবে যাতে ছেঁড়া পোশাকের ফাটা  জায়গাগুলো দিয়ে ওগুলো যেন দেখা যায় ।  সেটা দেখা গেলেই লোকেরা বলবে, 'এই সাতজন মানুষ ভিক্ষুকের মতো ছদ্মবেশ ধারণ করেছে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না এরা আসলে কারা !’

ছুকন্দ গর্বের সুরে বলল,  “দেখেছ আমার জ্ঞানী প্রভুর বুদ্ধিখানা । মন দিয়ে শোনো সবাই, উনি কী বলছেন।   

প্রশংসায় গদ গদ হয়ে জাবন বলল,  উনি অসাধারন এক ভিখারি

লোবান সায় দিয়ে বলল, “দেখতে নবীন কিন্তু বুদ্ধিতে উনি আমার চেয়েও অতিবৃদ্ধ একজন ভিখারি

.৪

তিন দিন পর । সময়, সন্ধেবেলা। স্থা্ন, নগরের প্রধান আলোচনা তথা সমাবেশ গৃহ

এখানেই কয়েকশো বছর ধরে প্রতি মাসে হু্মবাবা পাহাড়ের সাত দেবতার উদ্দেশ্যে পূজার্চনা পালিত হয় । গৃহের বাইরে প্রশস্ত চত্বর। কিছু কিছু নাগরিককে দেখা যাচ্ছে মশাল হাতে এদিকে সেদিকে যাতায়াত করতে । পোশাকের তলায় চুরি করে আনা সবুজ রেশমের পোশাকের টুকরো বেঁধে  পরিকল্পনা মাফিক সাত ভিখারির আগমন হয় ঐ চত্বরে সমাবেশ গৃহের সামনে পাতা আসনে বসে ছিলেন জোরাব । যাকে আমরা দেখেছিলাম ইবোলার সাথে। ভিখারিদের দলটাকে ঢুকতে দেখে উনি আসন ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলেন।

“কে তোমরা?    কোথা থেকে আসছ?

গম্ভীর মন্দ্র স্বরে তোস্কার উত্তর দিলেন,  “কে বলতে পারে আমরা কী বা কোথা থেকে এসেছি?

জোরাব এদিকে সেদিকে তাকিয়ে বলল,  “আরে কী মুস্কিল! এই ভিখারিরা এখানে কী করে এল? কেনই বা এল?”   

তোস্কার পুনরায় তার জাদু মাখানো স্বরে বলল,   “বৎস তোকে কে বলেছে যে আমরা ভিখারি ?

জোরাব এবার বললেন, “আরে এ তো মহা ঝামেলা!  এই লোকগুলো এখানে কী করছে?” 

”তোকে কে বলেছে আমরা লোক?”

সম্ভবত বাইরে তোস্কারদের কথা শুনতে পেয়েই সমাবেশ গৃহ থেকে বেড়িয়ে এলেন ইবোলা, “কী ব্যাপার জোবান,  এখন, চাঁদের আলোয় আম...  !

তোস্কার চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,  “আমার বোন কী তার রুপ!”

ইবোলা অবাক হয়ে বললেন, “কী?

তোস্কার পুনরায় বলল, “আমার ছোট বোন

সায় দেওয়ার সুরে ছুকন্দ বলল,  “আমাদের ছোট বোন, ওই যে চাঁদ  হুমবাবা পাহাড়ে রোজ সন্ধ্যায় সে আমাদের কাছে আসে আকাশের গা বেয়ে সে নাচতে নাচতে চলে যায়। আবার আসে । আবার যায় । তারপর ওর বয়স বাড়ে, একদিনের জন্য বিশ্রাম নেয় পাহাড়ের অন্য দিকে ।”

 ছুকন্দের কথার রেশ ধরে তোস্কার বলেন“তারপর আবার সে বড় হয় । আমাদের নাচ দেখায় । যুগের পর যুগ এই তো চলছে । এক পক্ষে ধীরে ধীরে বড় হয়,  অন্য পক্ষে ক্ষয়ে যায় । সময় বয়ে যায় সে চিরতরুণীই থাকে যেমন থাকি আমরা । চির যুবক ।”

 জোরাব চেঁচিয়ে ওঠেন,  “এই যে, কে রে তুই? বাজে বকা থামা!”    

ইবোলা কিছুটা অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন,  “যা  বললে তাই আবার হয় নাকি । এসব আমাদের শাস্ত্রে নেই ।” 

মাকাসা নামের  এক নিচু স্তরের অমাত্য বলে,  “হয়ত আমাদের শাস্ত্রকারেরা এরকম কিছু ভাবতেই পারেনি ।”  

ছুকন্দ বলে, “জান বৎস, আমাদের বোন এভাবেই আমাদের কাছে ফিরে ফিরে আসে। তার ভালবাসা প্রকাশ করতে।”  

জোরাব, ইবোলার উদ্দেশ্যে বলেন,  “মাননীয় ইবোলা আপনি কী শুনেছেন, কে আবার নাকি বলে বেড়াচ্ছিল দেবতারা নাকি  শহরে এসে আমাদের সাথে কথা বলবেন নগরে পাগলের সংখ্যা বেড়েছে মনে হচ্ছে।”

ইবোলা তোস্কারের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,  “হ্যাঁ শুনেছি । আমার পরিচারিকা এসে বলেছিল ।  এরকম কিছু এর আগে কিন্তু আমাদের নগরে  ঘটেনি । যদি তারা আসতে চান,  বেশ তো তারা আসুনই না একবার। দেখেই যান কী অবস্থায় আছি আমরা।  এ নগরের ভবিষ্যতের বিষয়ে আমার জানার খুব  ইচ্ছে   

কথাগুলো শোনার পর তোস্কার একটা ইশারা করতেই বাকি ছয় ভিক্ষুক এগিয়ে গিয়ে সমাবেশ গৃহর সামনে হুমবাবা পাহাড়ের দেবতাদের ভঙ্গীমার অনুকরন করে  মেঝেতে বসে পড়ল।  ইতিমধ্যে  চত্বরে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে কী হচ্ছে দেখার জন্য। তাদের ভেতর থেকেই একজন বলল, “আমিও বাজারে শুনেছি,  দেবতাদের নাকি আগমন হবে।  খুব  পুরানো কোন এক ভবিষ্যদ্বাণীতে এরকম কথাই নাকি লেখা আছে।”  

আর একজন বলল, “ঠিক ঠিক!  ওরা এরকমটাই বলছিল যে, পাহাড়ের সাত দেবতা মানুষের ছদ্মবেশে এই শহরে আসবে

সব শুনে মিটিমিটি হাসল তোস্কার।

ইবোলা, জোরাবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,  “এরকম কোন ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি আছে নাকি?

 জোরাব জানালেন,  “আমাদের হেফাজতে তো শত সহস্র  ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে আপনি তো জানেন, ভবিষ্যদ্বাণী বিহীন মানুষ রাতের বেলা অজানা সমুদ্রে পথ হারানো  একজন নাবিকের মতোযে জানে না কোথায় পাথর রয়েছে এবং কোথায় নেই । কোন দিকে গেলেই বা জমি দেখা যাবে। ভবিষ্যদ্বাণী হাতে না থাকলে, একজন লোকের সামনে সব অন্ধকার। ভবিষ্যদ্বাণী তারাদের মতো, আমাদের পথ দেখায় । নিজেকে চিনতে সাহায্য করে।”   

ইবোলা সন্দেহের সুরে বললেন,  “আচ্ছা ওই যে  ভবিষ্যদ্বাণীর কথা শোনা যাচ্ছে, সেটা যাচাই করা উচিত নয় কী?

“কী হবে যাচাই করে বলুন দেখি? জোরাব কিছুটা ক্ষোভের সাথেই বললেন মনে হল। নগরের যা হাল তাতে এখন এরকম কিছুই দরকার আমাদের। মানুষের মন ঘোরানোর জন্য।  মেনে নিয়েই দেখা যাক কী হয়

তোস্কার বলল, “ঠিক বলেছ বৎস, অন্ধকারে একটা লণ্ঠনের ছোট  আলো যে বয়ে নিয়ে আসছে সে মাতাল নাকি সুস্থ মানুষ তাতে তোমাদের কী দরকার । আসল তো পথের দিশা পাওয়া তাই না ?”   

মাকাসা দু হাত বুকের কাছে জড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভক্তি সহকারে বলে,  “ হতেও পারে যে তারা সত্যিই দয়ালু  দেবতা

তোস্কার আবার সেই মন্দ্র স্বরে বলে ওঠে, “আমাদের দানশীলতার চেয়ে বড় কোন দান নেই

ইবোলা, জোরাবকে জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে আমাদের কিছু করার দরকার নেই বলছো? আচ্ছা   আমাদের কী কী ক্ষতি দেবতারা করতে পারেন।”    

তোস্কারের কন্ঠ শোনা যায়, “আমাদের ক্রোধের চেয়ে বড় ক্রোধ নেই

জোরাব কথাটা শুনে যেন একটু থতমত খেয়ে যায়। “ইয়ে, মাননীয় ইবোলা, বলছিলাম কী, এরাই যদি সত্যি সত্যিই আমাদের দেবতা হন, তাহলে তো ওদের উপাসনার ব্যবস্থা করা দরকার অ্যাই কে আছিস, উপাচার যোগাড় কর

 মাকাশা বলল, “চিন্তা করবেন না।  আমরা যথা সাধ্য ভক্তি সহকারে  উনাদের  উপাসনা করব হয়ত সত্যিই উনারা আমাদের দেবতা

ইবোলা কিছুটা সময় আশেপাশের মানুষজনের ভাব ভঙ্গী দেখলেন তারপর সহসাই হাঁটু গেড়ে  বসে উদাত্ত স্বরে বলতে শুরু করলেন,  “আপনারা সকল পুরুষের চেয়েও শক্তিশালীসকল    দেবতাদের মধ্যে উচ্চমানের আপনারাই এ শহরের আরাধ্য ঈশ্বর ।  আপনাদের প্রেরণ করা বজ্র বিদ্যুৎ ঝড় ঝঞ্ঝা চন্দ্র সূর্যের গ্রহণ সব কিছুর কাছে আমরা নেহাতই ছেলেমানুষ ।  হে দেবতাগন আপনারাই মানব জাতির ভাগ্যের নির্মাতা ।” 

তোস্কার একটা চোখ সামান্য খুলে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে বলল, “শোনরে নগরবাসী,  পরিকল্পনা অনুযায়ী  এই স্থানে মহামারী ঘটাতে চলেছিলাম আমরা আমি ঘোষণা করছি  সেটা আর হবে না।  ভূমিকম্পতে সব তছনছ করে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, তাও ঘটবে না । মুহুর্মুহু বজ্রপাতে সব শেষ হয়ে যেত সেটাও থামিয়ে দিলাম ।”  জোরাবের দিকে মাথা ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “যে বিদ্রোহী সেনারা যড়যন্ত্র পাকাচ্ছিলে তারাও সাবধান ! কারন আমরা সব দেখতে পাই! কারন,  আমরা দেবতা !” 

উপস্থিত জনতা সচকিত আতঙ্কে বিষ্ময়ে বলে উঠল,  “ কী বলল শুনতে পেলে? আমরা দেবতা! এরাই সেই দেবতা!”

জোরাব বললেন,  “সবাই আসুন আমরা অর্চনা শুরু  করি

ইবোলা আদেশ দিলেন, এ্যাই কে আছিস! জলদি  সুলক্ষন যূক্ত মেষশাবক নিয়ে আয়বলি দিতে হবে!”  

মাকাসা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সৈন্যর দিকে হাত নেড়ে বলল,  “জলদি যাও! জলদি যাও!”

সৈন্যদের পিছু পিছু কয়েকজন মানুষও চলে যায়।

গম্ভীর স্বরে এবার ছুকন্দ, তোস্কারের দিকে হাত দেখিয়ে বলে, “এই দেবতা খুবই শক্তিশালী ।”   

রাগ্ন বলে,  “ইনি কোনও সাধারণ দেবতা নন

বইলোম নামের দেবতা সেজে থাকা আর এক ভিখারি বলে, “ইনিই সেই মহান দেবতা, যিনি  নিজের হাতে আমাদের  তৈরি করেছেন

জনতার ভেতর থেকে  এক মহিলা জানতে চাইল, “ প্রভু উনি আমাদের শাস্তি দেবেন না তো? সাত দেবতার আপনারা কেউ  আমাদের সত্যিই শাস্তি দেবেন না?  তাহলে তো আমরা দারুন ভাবে সব আয়োজন করব।”

অন্য একজন মহিলা তার কথায় সায় দিয়ে বলল, “চল চল, আমরা সবচেয়ে সেরা ভোগের ব্যবস্থা করি সেই ভোগ যা শাস্ত্রে সেরা দেবতার উদ্দেশ্যে দিতে বলা হয় ।”

 আর এক মহিলা কম্পিত স্বরে প্রশ্ন করে, “প্রভু আমাদের রাজপুরুষদের আচরণে আপনারা সত্যিই রেগে যাননি?

ছুকন্দ উত্তরে বলে, “কে বলতে পারে কোন কুয়াশাচ্ছন্ন জল্পনা দেবতাদের মনের  মধ্যে খেলা করছে। ওই উনি আমাদের মতো সাধারন দেবতা নন । একবার একজন  রাখাল পাহাড়ে  উনার কাছে গিয়ে দেবতার অস্তিত্ব বিষয়ে  সন্দেহ প্রকাশ করেছিল  ব্যাস, পরের দিনই ... বুঝতে পারছ আশা করি ?” 

দুজন মহিলা প্রায় একই সাথে বলে ওঠে,  “ আমরা একদমই সন্দেহ করিনি তাদের কী হয়েছিল প্রভু?”

 “পরের দিনই ... সন্ধেবেলায় সে হারিয়ে গেল পাহাড়ের এলাকায় ।”

একথা শুনে তারা সমস্বরে শুরু করল দেবতাদের উদ্দেশ্যে তাদের ভক্তি নিবেদনের স্তব গান।

প্রায়  বিশ যামল [আধ ঘণ্টা] অতিক্রান্ত হওয়ার পর সৈন্য দুজন ফিরে আসে । একজনের হাতে একটা মৃত মেষশাবক এবং অন্য জনের হাতে এক ঝুড়ি ফলজোরাব এগিয়ে যা্ন ওদের দিকে। কী নিয়ে এসেছে ভালো করে দেখেন, তারপর ভিখারিদের সামনে এসে বলেন,     “এই দেখুন প্রভুগন, ভালো প্রসাদের ব্যবস্থা করেছি  সমাবেশ গৃহের সামনের এক বেদীতে রাখা হয় ওগুলো। ওটার পেছনেই বসেছে ছয় ভিখারি।       

রাগ্ন মেষশাবকটার পাটা টিপে দেখে বলে,  “আরে  এতো ভালো করে শূল পক্ক করাই হয়নি  

ইবোলা কথাটা শুনে বিস্মিত হলেন।  “ আশ্চর্যের বিষয় একজন দেবতা মাংস সঠিকভাবে রন্ধন করা হয়েছে কিনা  সে বিষয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করছেন।”   

জোরাব সায় দিয়ে বললেন, “সত্যিই এটি  অদ্ভুত ব্যাপার

ইবোলা বললেন,  “এরকম ভাবে তো আমাদের মত সাধারন মানুষেরাই তাদের আশা নিরাশার কথা বলে।”   

জোরাব নিজের দাড়ির গোছায় হাত বোলাতে বোলাতে রাগ্নর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে  বিড় বিড় করলেন, “অদ্ভুত! সত্যিই অদ্ভুত কান্ড!”   

পরিস্থিতি সামাল দিতে তোস্কার বলল,  “দেবতারা উত্তম রুপে শূল পক্ক মাংস পছন্দ করেন এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? বজ্রপাত ঘটলে যখন মানুষের চামড়া মাংস পুড়ে গন্ধ ছাড়ে সেটা হুমবাবার দেবতাদের খুব প্রিয় সুগন্ধ জানা আছে কী? যখন তারা শান্ত থাকেন তখন ভেড়ার মাংস পূড়িয়েই তারা প্রশান্তি লাভ করেন এটাও বোধহয় জানা নেই।  তাদের কাছে দুটো কাজেরই কোনো পার্থক্য নেই । যাকগে কিছুই করতে হবে না। আমাদের দরকার নেই !”

এ কথা শুনে জোরাব একটু ভ্যাবাচাকা  খেয়ে বললেন,  “আহা রুষ্ট হচ্ছেন কেন প্রভু !

উপস্থিত জনতা সমস্বরে বলল, “এমনিতেই আমাদের নগরের হাল খারাপ। তার ওপর রাজপুরুষেরা এতো সন্দেহ করলে কী করে হবে বলুন তো?  দয়া করে আমাদের ওপর রাগ করবেন না, হে দেবতাগন!”  

জোরাব জনগনের কথায় যেন সম্বিত ফিরে পেলেন, চেঁচিয়ে উঠলেন, “অ্যাই কে আছিস! জলদি পাটাকে ভাল করে সুসিদ্ধ করে নিয়ে আয় ।”

একজন এগিয়ে গিয়ে টুকরোটা বেদীর ওপর থেকে নিয়ে বেরিয়ে যায় এবং কিছুটা সময় বাদেই ফিরে আসে। জোরাব পুনরায় বলে ওঠেন, “আসুন আমরা সবাই মিলে, দেবতাদের উদ্দেশে এই খাদ্য উৎসর্গ করি ।  ওনারা সবাই এগুলো খেলে আমরা মনে শান্তি পাবো ।”

বেদীর ওপরে সব কিছু সাজিয়ে রাখা হয় তোস্কার বাদে বাকি ছয় ভিখারি গপগপ করে খেতে শুরু করে। তোস্কার  কোনো খাদ্য ছুঁয়েও হাত দেখে না।   

ইবোলা বলেন,   "যারা অজ্ঞ, যারা কিছুই জানে না বা বোঝে না এবং যারা অতি ক্ষুধার্ত তারাই একমাত্র এভাবে খাবার খায় ।” 

কয়েকজন মানুষ এ কথায় সম্মতিসূচক শব্দ করে ।

মাকাসা বলে ওঠে,  “আমার তো এদের খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে এরা যেন দীর্ঘ সময় ধরে এই জাতীয় খাবার খায়নি

জোবান সায় দিয়ে বলেন,  “ঠিকই বলেছ। এদের মুখে চোখে চেহারায় ক্ষুধার্ত ভাব স্পষ্ট ।”   

আবার পরিস্থিতি সামাল দেয় তোস্কার। “একদম ঠিক বলেছিস তোরা এরা সত্যিই অনেকদিন খায়নি । তোরা নিজেরাই ভেবে দ্যখো তো, মানুষরূপী যে অসহায় দেবতারা তোদের বিশাল প্রাচীরের ওইদিকে  ঘুরে বেড়ায় তাদের তোরা কতদিন খেতে দিসনি ?  সন্তান খেতে না পেলে পিতারা কী খেতে পারেন ।  আমিও তো এই নগরের সময় পরিবর্তনের সূচনা থেকে এখনো কিছু খাইনি ।  এরা তো আমার চেয়ে অনেক অনেক নবীন। ওরা আর কতদিন অপেক্ষা করবে বল? 

কথাগুলো শুনে জোরাব বলল,  “ক্ষমা করুন ! ক্ষমা করুন, হে দেবতা ! আমার ভুল হয়ে গেছে।  হে প্রাচীনতম দেবতা! খাদ্য গ্রহণ করুন ।” 

যেন অভিমান করেছেন এমন ভাবে তোস্কার বলল, “নাহ, যা পরিস্থিতি তাতে আমার খাওয়াই উচিত নয় । পশু, মানুষ আর তরুন দেবতারা ছাড়া আর কারোর খাওয়া উচিত নয় । সূর্য, চাঁদ আঘাতের অপেক্ষায় থাকা বিদ্যুৎ এবং আমি, আমরা হত্যা করতে পারি এবং আমরা ক্রোধান্বিত হতে পারি, কিন্তু আমরা খাব না

মাকাসার মুখ সাদা হয়ে গেল। সে বলল,  “সর্বনাশ! উনি খাদ্য গ্রহণ না করার অর্থ আমাদের জন্য চরম শাস্তি অপেক্ষা করছে।”  

সবাই এক সাথে বলে উঠল, “হে  প্রাচীন দেবতা, ,আমরা আপনার সন্তান তুল্য। আপনি খাদ্য গ্রহণ করুন

তোস্কার তবুও রেগে থাকার ভান করে বলল,  “অনেক হয়েছে। অনেক সহ্য করেছি । মানুষের এই পশুসুলভ আচরণ আর সহ্য হচ্ছে না।” 

ইবোলা, মাকাসার কাছে গিয়ে বললেন,  “আচ্ছা একে সেই ভিখারিটার মতো লাগছে না। আরে সেই যে, যাকে অনেক দিন ধরে আর দেখা যাচ্ছিল না ।” 

জোরাব বললেন,  “ভিখারিরা কিন্তু খাওয়ার সূযোগ হাতছাড়া করে না।”   

ইবোলা মাথা নেড়ে বললেন,  “সেটা ঠিক বলেছেন আমি আজ অবধি এমন কোনও ভিখারিকে দেখিনি যে মদ প্রত্যাখান করেছে।” 

মাকাসা সতর্ক করার সুরে বলল, “ভুলে যাবেন না  ইনি কিন্তু কোনো ভিখারি নন।”

“দেখাই যাক ভিখারি না অন্য কিছু!  মদের গন্ধ পেলে উনি কী করেন সেটাই আমি দেখতে চাই।তাও আবার যে সে মদ নয় রাজকীয় মদ। যা আমাদেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।” ইবোলার চোখে ফুটে উঠল কুটিল ছায়া।  

মাকাসা আবার বলল, “ আপনি কিন্তু খুব ভুল করছেন উনাকে এভাবে সন্দেহ করে। এর ফলে গভীর সঙ্কট ঘনিয়ে আসতে পারে আমাদের ওপর।

“হ্যাঁ  আমি সন্দেহ করছি। আমি ওদের দেবত্বের প্রমান চাই । তাতে যা হয় হবে।  আমি  মদ নিয়ে আসতে যাচ্ছি!” বলে ইবোলা ওখান থেকে চলে গেলেন।     

মাকাসা মনে মনে বলল,  “আমি জানি মহান দেবতা পান করবেন না তবুও যদি উনি সেটা  করেন, তবে সেটা আমাদের পক্ষে ভালোই হবে দেখাই যাক কী হয়

একটু বাদেই ইবোলার পরিচারককে দেখা গেল বড় মাপের একটা মদের পাত্র নিয়ে আসতে। ইবোলাও আছেন সাথে।  পরিচারক পাত্রটাকে  বেদীর ওপর রাখল   

জাবন জোরে নাক টেনে বলে, “মদ এসেছে। মদ!”  

রাগ্ন বলে, “যে সে মদ নয় ভায়া, রাজকীয় মদ।”   

বয়স্ক লোবান জিভ চেটে বলে,  “অত বড় পাত্র ভর্তি রাজকীয় মদ! আইব্বাস!”  

পঞ্চম ভিখারি বিড় বিড় করে,  “আহা আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম!”   

বইলোম জাবনের মতোই মদের গন্ধ নাকে টেনে নিয়ে বলে,  “বড়ই  সুখের সময় হে আজ! আপনার জয় হোক প্রভু!”

ছুকন্দ বলে,  “হে  মহাজ্ঞানী দেবতা বৃন্দ ! আসুন পানীয় গ্রহণ করুন ।”    

ছয় ভিখারি একসাথে এগিয়ে গেল বেদীর দিকে ।  লম্বা পদক্ষেপে ওদের আগেই  ওখানে পৌঁছে গেল তোস্কার । হাতে তুলে নিল পাত্রটিকেতারপর ঘুরে জনগণের দিকে তাকিয়ে  উল্টো করে ধরল পাত্রটাকে। সব মদ গুব গুব শব্দ করে  পড়ে গেল সমাবেশ গৃহের চত্বরে বিষ্ময় সূচক একাধিক শব্দে ভরে গেল বাতাস।

জাবন অবাক হয়ে চাপা স্বরে বলল,  “কী কান্ড!  পাগল হয়ে গেল নাকি ! সব মদটা তো ফেলে দিচ্ছে!”   

রাগ্ন সায় দিয়ে হতাশ ভাবে বলল, “সেটাই তো দেখছি গো!”

তোস্কার দু চারবার জোরে জোরে শ্বাস নিল। “ আহ! এই কাজটা করে রাগ কিছুটা কমল  

লোবান খুড়ো মিন মিন করে বলল,” হুজুর ওটা কিন্তু রাজকীয় মদ ছিল    

তোস্কার এবার বেদীর ওপর উঠে দাঁড়াল। জনগনের গুঞ্জন থেমে গেল। অন্ধকার আকাশে ফুটে উঠেছে তারাদের রোশনাই। চাঁদ আর মশালের আলোয় আলোকিত তোস্কারকে এক অদ্ভুত ছায়া মানবের মত দেখাচ্ছিল। অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে সে বলল, “ অনেক হয়েছে । আপাতত আমাদের আর বিরক্ত করিস না এটা এমন সময়, যখন দেবতারা তাদের নিজেদের ভাষায় অন্য দেবতাদের  সাথে জগতের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন।  কোনো মানুষের কানে যদি আমাদের কথা  পৌছায় তবে তার জীবনে নেমে আসে  বড় বিপর্যয়যা আটকাতে পারবে না কেউতোদের সেটা হোক আমি চাই না।তাই এখন চলে যা। চলে যা সবাই এখান থেকে।”   

 সবাই ধীরে ধীরে চলে গেলেও একজন তবুও দাঁড়িয়ে থাকে ।  

 তোস্কারের উদ্দেশে  নতজানু হয়ে সে বলে,  প্রভু, আমি নিঃসন্তান এবং আমি

ছুকন্দ বলে, “মহান দেবতা তোমাদের চলে যেতে বললেন না?”

নাছোড়বান্দা মানুষটা আবার বলে, প্রভু ...

তোস্কার এবার চিৎকার করে, “আহ! চলে যেতে বললাম না! যাও!”    

অগত্যা লোকটি চলে যায় ।

চত্বর পুরো ফাঁকা হয়ে গেলে তোস্কার ভাল করে সব দিক দেখে নিয়ে সবাইকে  ইশারা করে সমাবেশ গৃহের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। ভিখারিরা ফল মুল আর  মাংস নিয়ে ঢুকে যায় ভেতরে।  সভাগৃহের দরজার পাল্লা ভেজিয়ে দেয় তোস্কার। তারপর একটা বড় মাংসের টুকরো হাতে তুলে নিয়ে খেতে শুরু করে বাকি ভিখারিরা হাত পা ঝাড়ে । উঠবোস করে, শরীরের জড়তা কাটায়। হাসে। তোস্কার গপ গপ করে খেতে থাকে।

জাবন বলে,  “বাপরে ! কী কঠিন কাজ । ওইভাবে বসে থাকা ।” 

রাগ্ন বলে, “তাতে কী, এভাবে  বসে যদি এরকম ভালো ভিক্ষা জোটে তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।  সে তোমরা  যাই বলো ।”  

ছুকন্দ খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলে,  “সব আমার প্রভুর বুদ্ধিতে আমার প্রভুর বুদ্ধি... বলেছিলাম না !”  

লোবান খুড়ো মাথা চুলকে বলে,  “খুবই ভালো সময় সেটা মানতেই হবে । খুবই ভালো । কিন্তু এখনও আমার একটা ভয় আছে

পাঁচ ভিখারি আর ছুকন্দ তাকায় খুড়োর দিকে।  “আবার  কিসের ভয় পাচ্ছ খুড়ো ? ছুকন্দ জানতে চায়। তারপর আশ্বাস দেওয়ার সুরে বলে,  ভয়ের কিছু নেই আমার প্রভুর মত বুদ্ধিমান আর কেউ নেই

লোবান ফিস ফিস করে বলে,  আমি মানুষকে নয়  দেবতাদের ভয় পাচ্ছি ।  যাদের রুপ নেওয়ার ভান আমরা করছি।”   

ছুকন্দ চোখ বড় বড়  করে বলে, “কাকে ভয় পাচ্ছ? দেবতাকে? হাসালে খুড়ো। পাথরের দেবতাকে আবার ভয়!”

তোস্কার  মাংসর টুকরোতে বড় মাপের কামড় দিয়ে ইশারা করে ছুকন্দকে ডাকে।    

 “হ্যাঁ, বলুন প্রভু

“খাওয়া হয়েছে?” ইতিবাচকভাবে মাথা নাড়ে ছুকন্দ। “তাহলে, ওই দরজার বাইরে গিয়ে বোস ।”   ছুকন্দ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।  “এই হতভাগা দাঁড়িয়ে নয়, দেবতার ভঙ্গীতে বস। বাইরে যা।  কাউকে আসতে দেখলেই  আমাকে সতর্ক করে দিবি আমি খাচ্ছি সেটা কেউ দেখুক আমি চাই না।”

 ছুকন্দ বেড়িয়ে যায়।

জাবন, তোস্কারের দিকে তাকিয়ে বলে,  “ইয়ে, হুজুর রাজকীয় মদটা না ফেললেই কী চলছিল না?

হাসল তোস্কার। “আরে অপেক্ষা করো ! ওরকম মদ এতো পাবে যে তাতে সাঁতার কাটতে পারবে। আমার বুদ্ধিতে চললে তোমাদের ঠকতে হবে না এটা বলে দিচ্ছি।”   

রাগ্ন বলল, “ হুজুর, আমাদের কেউ কেউ  সন্দেহ করছে কিন্তু?

“ তাহলে  আমাদের খুব সাবধানে কাজ করতে হবে।”   

 “যদি ভুল ভাল কিছু হয় তাহলে কী হবে হুজুর?”

 “মৃত্যু  ...

রাগ্ন আঁতকে চিৎকার করে উঠল,  “সর্বনাশ !”

আস্তে! আস্তে! অত চেঁচিও না ।”   

জাবন জানতে চাইল,  “হুজুর, ওরা আমাদেরকে কী আমাদের বিশ্বাস করে ?

 বাইরে থেকে ছুকন্দের গলা শোনা গেল, “কেউ একজন আসছে ।”

তোস্কার মাংসটা  একটা স্তম্ভের পেছনে লুকিয়ে রাখে “বিশ্বাস করে কিনা সেটা খুব তাড়াতাড়ি  জানতে পারব   ইতিমধ্যে সকলে দেবতার ভঙ্গীতে বসে পড়েছে । ছুকন্দও ফিরে এসেছে ভেতরে।  একজন মানুষ এসে দাঁড়ায় দরজার কাছে।

তোস্কার বলে, “এসো বৎস , ভেতরে এসো!”

মানুষটা ভেতরে এসে সবাইকে দেখে নিয়ে বলে, “আমি সেই দেবতার সাথে দেখা করতে চাই যিনি খাবার খান না।”   

তোস্কার অভয়দানের ভঙ্গীতে হাত তুলে বলে, “আমিই সেই  

  “প্রভু আজ দুপুরে আমার ছেলেকে সাপে কেটেছে তাকে বাঁচিয়ে দিন প্রভু । এখনো সে শ্বাস নিচ্ছেতবে অতি ধীরে ধীরে

  “সে তোমার নিজের ছেলে তো?”   

কী অদ্ভুত প্রশ্ন করছেন আপনি? অবশ্যই সে আমার সন্তান, প্রভু

  “সাপ নিশ্চয় তোমার বাড়িতে ঢোকেনি ?”

“না, প্রভু।”

“তাহলে সে বাইরে গিয়েছিল খেলতে। তাকে আটকাতে পারোনি কেন?” 

   “ওকে আমরা কখনোই কিছু করা থেকে আটকাই না প্রভু।”   

  হঠাৎ করে তোস্কার প্রশ্ন করে, “মৃত্যু কার সন্তান বলতে পারো ?

  “মৃত্যু দেবতাদের সন্তান

 তোস্কার কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলেন,  “ভালো করে ভেবে বলো তো দেখি, আজ অবধি একবারও কী ছেলের দুষ্টুমিতে রেগে গিয়ে বলে ওঠোনি , তোর মরে যাওয়াই উচিত!” 

মানুষটা তোস্কারের কথার অর্থ বুঝতে পেরে কেঁপে ওঠে “প্রভু! সে তো সব বাবা মাই বলে ! সব কথা কী ধরতে হয়?”

তোস্কার গম্ভীর স্বরে বলেন,  “ধরতে নেই তোজানি তো। কিন্তু কিছু কথা যে আমাদের কানেও এসে যায় বৎস।  আর তোরাও আমাদের ভুলে গিয়েছিলি । উঁহু কেঁদে লাভ নেই  তুই তো ভবন নির্মাতাশহরে যেখানে যা জায়গা পেয়েছিস  সব কেড়ে নিয়েছিস মানুষ রুপী দরিদ্র ভগবানদের কাছ থেকে। তাদের কত সন্তানের মৃত্যু হয়েছে তোর কারণে।  ভেবে দেখেছিস তাদের মনের অবস্থাটা কখনো? আমার কিছু করার নেই। তুই চলে যা এখান থেকে।”

 মানুষটা কাঁদতে কাঁদতে  চলে যায়

জাবন হাত বাড়িয়ে রাগ্নের কব্জি চেপে ধরে তোস্কারকে দেখিয়ে বলে, “আচ্ছা  উনি সত্যিই     মানুষ তো নাকি...?

কথাটা শুনে তোস্কার হেসে বলে, “হ্যাঁ রে বাবা,  অবশ্যই আমি একজন মানুষ শুধুই একজন মানুষআর  এই মুহূর্তে একজন ক্ষুধার্ত মানুষ”  কয়েক কামড় মাংস চিবিয়ে এক ঢোক জল খেয়ে তোস্কার বলল, “নিশ্চিন্ত হলাম। সাধারন মানুষের বেশীরভাগই আমাদের বিশ্বাস করছে। এটা ছিল তার প্রমান।”

 সেই সমাবেশ গৃহ। কয়েক দিন পর । রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে ভালো মতই।   পর্বতের চুড়ার মতো  আকারের সাতটি সিংহাসন দেখা যাচ্ছে  যার ওপর ভিখারিরা হেলান দিয়ে বসে আছে।  

বইলোম বলে ওঠে,  “ভিখারিদের জীবনে এরকম সময় কোনোদিন আসেনি।” 

জাবন সায় দিয়ে বলে,  “আহা! আহা! কি সব খাদ্য খাচ্ছি! নানা রকম ফল ! নরম কচি ভেড়ার মাংস!” 

রাগ্ন জড়ানো স্বরে বলে, “আর তার সাথে রাজকীয় মদ।”

“এই সব  ফল এবং ভেড়ার মাংস, রাজকীয় মদ, সবই তো আমার প্রভুর বুদ্ধিতে পেলে। সেটা ভুলোনা যেন!” ছুকন্দ বলে।    

  “সত্যি কী বুদ্ধি উনার। গুপ্তচরদের সামনে নিজের ক্ষিধে লোভ সামলে কেমন থেকে গেলেন। আমি বাপু পারতামই না। অকপটে স্বীকার করে  বইলোম।

  কি বুদ্ধিমানের মত উত্তর দিলেন বলো?  যখন ওরা দেবতা আর মানুষের  সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাইলো, উনি এমন যুক্তিজাল বিস্তার করলেন যে ওরা সম্ভবত ঠিকঠাক কিছুই বুঝতেই পারলো না,” বলল জাবন।

“ওরা তো এটাও জানতে চাইল কর্কট রোগের মতো ব্যাধি কেন দেবতারা সৃষ্টি করলেন !” 

 “তার উত্তরটাও উনি কেমন জবরদস্ত দিলেন বলো?” ছুকন্দ গর্বের সাথে বলল,  “আমার বুদ্ধিমান প্রভু সব জানেন। তার জবাব নেই।”   

বইলোম জানতে চাইল,  “উনার পরিকল্পনা দারুন ভাবেই সফল হয়েছে, কী বলো?”   

জাবন হাত উঁচিয়ে বলল, “হয়েছেই তো আমাদের খাবার যোগাড় করার চিন্তাটাই তো আর নেই।” 

  “আমার কাছে তো এটা গত বছর দেখা একটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে,”   রাগ্ন জানাল।  

 মুচকি হেসে বইলোম বলল,  “ওরা আমাদের উদ্দেশ্যে যখন প্রার্থনা করে আমার যে কী হাসি পায়। অতি কষ্টে চেপে রাখি।”  

 তোস্কার অতীব গম্ভীর কন্ঠে বলল, “ভুলে যেও না,  আমরা যখন ভিখারি ছিলাম আমরাও  ওদের মতোই ভিক্ষা করতাম।  আমরাও তো ওদের মতোই কান্নাকাটি করতাম সামান্য খাবারের জন্য।   আমাদের আচরণও ওদের মতই ছিল। সব ভুলে গেলে নাকি?”   

লোবান খুড়ো বলল,  “ভুলিনি হুজুর।  আমরা আমাদের ভিক্ষা করার জন্য  গর্ব অনুভব করি এদের মতো ছোট মন আমাদের ছিলনা।”

তোস্কার গর্বিত স্বরে বলল,  “সেইজন্যই তো এখন আমরা দেবতা। দেবতা কখনো তার ভক্তদের    উপাসকদের উপহাস করে না

জাবন বলল,  “আমি কিন্তু মনে করি দেবতারা তাদের উপাসকদের উপহাসই করেন

“না দেবতারা কখনও আমাদের উপহাস করেননি তাহলে আজ আমরা এই জায়গায় পৌছাতে পারতাম না। স্বপ্নেও কোন দিন ভাবতে পেরেছিলে এরকম সম্মান পাবে?” তোস্কার জানতে চাইল

জাবন জানাল,  “সে আপনি যাই বলুন। আমার মনে হয় কোনো মানুষ যতক্ষন না সামাজিক স্তরে খুব উঁচুতে উঠতে পারে ততক্ষণ  বেশিরভাগ দেবতাই সবাইকে উপহাস করে 

কথা শেষ হতে না হতেই দরজায় টোকা পড়ে। সবাই দ্রুত নিজেদের আসনে বসে। চোর প্রবেশ করে।  ওকে দেখে সবাই আবার আরাম করে বসে।

চোর জানায়, “ প্রভু আমি  তাদের সাথে ছিলাম যারা সব কিছু দেখে এবং সমস্ত কিছু জানে

জাবন অবাক হয়ে জানতে চায়, “তারা আবার কারা হে?”

আমি চোরেদের দলের কথা বলছি   তারা জানে যে আমিও চোর, কিন্তু জানে না আমি আপনাদের সাথে আছি ।”

তোস্কার বলল,  “ভালো, ভালো

  “সেখান থেকেই জানতে পারলাম আমাদের জন্য বিপদ ঘনিয়ে আসছে। দারুন বিপদ।” 

  “কি রকম বিপদ? ওরা কী আমাদের স্বরুপ ধরতে পেরে গেছে? বুঝতে পেরে গেছে আমরা সাধারন মানুষ?

 “সে তো প্রথম থেকেই সন্দেহ করে চলেছে প্রভু । এবার আসলটাও জেনে যাবে । মনে হচ্ছে আমাদের খেল খতম।  আমি অবশ্য তার আগেই কেটে পড়ব । কয়েকদিন ভালো ভালো খাবার খেয়ে নিলাম। এটাই লাভ।”

 “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে  এখনো ওরা সব কিছু জানে না। কী তাইতো?”   

  “হ্যাঁ প্রভু সেটা ঠিক । সব তথ্য ওদের হাতে নেই । কিন্তু জলদি এসে যাবে, তারপর ...”

   কপালে একটা ভাঁজ পড়ল তোস্কারের, “তারা কখন জানতে পারবে বলে তোমার ধারনা?

 “তিন দিন আগে থেকেই ওরা খোঁজ খবর শুরু করে দিয়েছে।”   

  সিংহাসন থেকে নেমে চোরের কাছে গিয়ে তোস্কার প্রশ্ন করল, “তোমার কি মনে হয়, এবিষয়ে কেউ ওদের তথ্য সরবরাহ করছে? কে সেই মানুষ ?

 চোর উত্তেজিত স্বরে বলল, “ না প্রভু সে ব্যাপার নয়।”   

  তোস্কার হাসল, “তাহলে তোমার ভয় পাওয়ার কোনও দরকারই নেই

 “প্রভু আমার কথাটা আগে শুনুন।  তিন দিন আগে দু'জন লোক উটের পিঠে চেপে হুমবাবা পাহাড়ের দিকে  রওনা দিয়েছিল

রাগ্ন উঠে আসে এবার, ‘হুমবাবা পাহাড়ে গেল তো কী হয়েছে?”

চোর বলল, “ কেন গিয়েছে জানো?  পাহাড়ে সাত দেবতার মূর্তি আছে কী নেই সেটা জেনে আসার জন্য।”   

 তোস্কার ভুরু কুঁচকে বলল,  “মূর্তিগুলো দেখার  উদ্দেশ্যে দুজন  গিয়েছে বললে, তাই তো ? 

  “হ্যাঁ,  প্রভু । তিনদিন আগে

জাবন হাউমাঊ করে বলে উঠল, “ ব্যাস সব শেষ ! এবার আমাদের পালা শেষ!   

তোস্কার জানতে চাইল, “তিনদিন আগে গেছে, ঠিক জানো?

চোর জানাল,  “হ্যাঁ, তিনদিন আগে ওরা রওনা দিয়েছিল 

“আসতে বা যেতে দেড়দিন করে লাগে।  তাহলে তো ওদের আজকেই  ফিরে আসা উচিত

জাবন ককিয়ে উঠল, “হায় হায় ! আমাদের কী হবে গো?”  

রাগ্ন কেটে কেটে বলল, “সব খেলা শেষ !”

চোর পুনরায় বলল, “ওরা নিশ্চিতভাবেই দেখেছে  সবুজ পাথরের মূর্তিগুলি পাহাড়ের ওপরেই বসে আছে।  ওরা এসে  জানাবে, 'দেবতারা এখনও ওখানেই আছে '   দেবতা সাজার আমার তো মনে হয় একটাই শাস্তি,  পুড়িয়ে মারা হবে সবাইকে

ছুকন্দ মনে মনে ভয় পেলেও সান্তনা দেওয়ার মত করে বলল, আহা,  চিন্তা করছ কেন? আমার প্রভু কিছু একটা পথ ঠিক বার করবেন

তোস্কার চোরের দিকে তাকিয়ে বলল,  “তুমি এক কাজ করো তো। জলদি গিয়ে উঁচু কোথাও উঠে গিয়ে দ্যাখো তো ওদের দেখা পাও কিনা । কতটা দূরে আছে যদি জানা যায়, তাহলে সেভাবে কিছু একটা  পরিকল্পনা ফাঁদা যাবে।”      

চোর কক্ষ ছেড়ে বেড়িয়ে যায়।

 তোস্কারের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে ছুকন্দ  আবার বলল,  “আরে কোনো চিন্তা নেই আমার প্রভু ঠিক কিছু একটা পরিকল্পনা করেই ফেলবেন।”   

জাবন এবার প্রায় কেঁদে ফেলার মত করেই বলল,  “হায় হায়! উনার কথা শুনে আমরা  ফাঁদে পড়ে গেলাম গো

রাগ্ন বলে ওঠে,  “উনার বুদ্ধিতে আগুন লাগে ...” কথা শেষ না করে নিজের মুখ চেপে ধরে।

“উফফ কী হচ্ছেটা  কী! উনি ঠিক একটা কিছু পথ বার করবেন বলছি না!” ছুকন্দ ধমক দেয়।    চোর পুনরায় প্রবেশ করে

বেশ চিন্তার সুরেই বলে, “প্রভু,  অনেক দেরী হয়ে গেল মনে হচ্ছে।”

তোস্কার জানতে চায়, “দেরী হয়ে গেল মানে?”   

 “মানুষ দুটো নগরে এসে গেছে বেশ কিছুক্ষন আগেই  

জাবন বলে, “এবার আমাদের পোড়ানো হবে ।”   

তোস্কার সবার দিকে তাকিয়ে এবার নিজেও ধমক দেয়,   “আহ! তোমরা একটু বকা থামাবে । আমাকে ভাবতে দাও শান্ত মনে ।”

সেদিন রাতে দেবতাদের থুড়ি ভিখারিদের কাছে কেঊ আসেনি নগর থেকেযদিও চিন্তায় সারা রাত ঘুম হল না সাতজনের একজনেরও।  

 

পরের দিন সকাল।

সবাই চুপ করে দেবতার ভঙ্গীতে বসে শহরের নাগরিকেরা প্রবেশ করে সমাবেশ গৃহে।  ওদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেতোস্কারকে দেখা যায় গভীর চিন্তায় ডুবে থাকতে  

 তোস্কারের উদ্দেশে ইবোলা বলেন, “ হে মহান দেবতাগন, আপনাদের অগোচরে তো এ জগতের কিছুই থাকে না। তাই ধরেই নিচ্ছি যে জেনেই গিয়েছেন,  দু'জন তীর্থযাত্রী আপনাদের পবিত্র আসন দেখতে গিয়েছিল। যেখানে আপনারা কিছুদিন আগে অবধি অধিষ্ঠান করে ছিলেন।”  তোস্কার পাথরের মত বসে থাকে।  কিছুই বলে না“তারা ফিরে এসেছে গতকাল বিকেলে

তোস্কার গম্ভীর কন্ঠে বলে, “মুর্খ! আসল দেবতাদের এখানে রেখে মানুষ পাথরের দেবতাদের সন্ধান করতে গিয়েছিল! জানো তো সেই মাছটার কী হয়েছিল – যে  একবার সমুদ্র খুঁজে বের করার জন্য  দূর দেশে যাত্রা করার চেষ্টা করেছিল

ইবোলা হাত জড় করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন,  “হে সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় দেবতা,  ওরা হয়তো এতোটাই  ধর্মভীরু যে আপনাদের বাসস্থান দেখার ও সেখানে উপাসনা করার বরাবরের ইচ্ছেটাকে ত্যাগ করতে পারেনি ।”   

তোস্কার আরো গম্ভীর স্বরে বলে, “আমি এই ধরনের মানুষদের ভাল করেই চিনি যারা অতিরিক্ত  ঈশ্বরভক্তি দেখায় । এরা আমাদের উদ্দেশে যতই  প্রার্থনা করুক এদের  প্রার্থনা গ্রহণযোগ্য নয় এরা দেবতাদের খুব অল্পই ভালবাসেএদের সবটুকু ভালবাসা ধার্মিকতা পালন দেখানোর প্রতি ন্যস্ত আমি এই ভন্ড ধার্মিকদেরকেও  ভাল করেই চিনি জানি ওরা নিশ্চয় বলেছে যে সাত দেবতার মূর্তি এখনও পাহাড়ের ওপরেতেই আছে   তারা দেব মূর্তি দর্শন করে এসেছে অতএব তারা তোদের কাছে  আরও ধার্মিক বলে প্রতিভাত হবে ।  যত  মূর্খর দল, তাদের সব কথায়  বিশ্বাস করবে এবং তারা যার নিন্দা করবে তাতেই সায় দেবে ।”   

জোরাব, ইবোলার কানের কাছে গিয়ে বলেন, “ আরে কী করছেনটা কি ? আপনি তো দেখছি দেবতাদের রাগিয়ে দিচ্ছেন! রনরোন প্রদেশের সাথে দীর্ঘ দিন ধরে আটকে থাকা বাণিজ্য চুক্তি কাল সম্পাদন হয়েছে সংবাদ পেয়েছেন আশা করি। দেবতাদের কৃপা পুনরায় নগরে ফিরছে মনে হচ্ছে।”

 “হ্যাঁ শুনেছি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা আপনি  কী বলছেন ! আমি আবার রাগানোর মত কী বললাম ?” ইবোলা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন।   

 “দেখুন মনে মনে আমাদের অবিশ্বাস হলেও,  এরাই হয়তো আসলে দেবতা।”

ইবোলা জানতে চাইলেন,  “ হুমবাবা পাহাড় থেকে আগত মানুষেরা কোথায়?

জনৈক নাগরিকের কন্ঠ শোনা গেল, “এই যে হুজুর, এই যে এখানে  

ইবোলা হাত জোড় করে তোস্কারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ আপনাদের পবিত্র বাসস্থান দর্শন করে এবার তারা আপনাদের অর্চনা করার জন্য আসছেন।”  

তোস্কার রাগের ভঙ্গীতে ফুঁসতে ফুঁসতে আদেশের সুরে জানাল, “ওই লোক দুজন সন্দেহ করেছে আমাদের বিষয়ে । দেবতারা এই সন্দেহ কথাটাকেই ঘৃণা করে।  সন্দেহ সর্বদা দূষিত বিষয়  ওদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হোক। যাতে ওরা আর কোনোদিন দেবতাদের বিষয়ে সন্দেহ পোষন করতে না পারে। ওদের এখানে প্রবেশ করতেই দেওয়া যাবেনা।”   

হাঁটু গেড়ে বসে ইবোলা বললেন,  “কিন্তু  হে শ্রদ্ধেয় প্রাচীন পর্বত নিবাসী দেবতাগন, মার্জনা করবেন । সন্দেহ তো আমরাও করি   

তোস্কার স্বর কিছুটা মোলায়েম করল,  “তুমিও মায়ায় বাঁধা বৎস! তুমিও ওদের ফাঁদে পড়েছ!  তবুও খুব বেশি দেরি হয়নি অনুতপ্ত হও! ওদের  কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা কর ! তাতেই তোমার প্রায়শ্চিত্ত হবে। তাকিয়ে দেখ ওদের দিকে ।” আঙ্গুল তুলে দেখাল বাকি ছয় ভিখারির দিকে। “দেবতারা কখনও কাঁদে না তাদেরকে সন্দেহ করে তোমরা কাঁদতে বাধ্য করছ।    দেখতে পাচ্ছ । জানো এর ফলে কী হতে পারে? কী অভিশাপ নেমে আসতে পারে তোমাদের ওপর? শেষের সে দিন আসার আগেই তোমাদের হাড় মাংস শুকিয়ে যাবে! জলদি ! সন্দেহ বিসর্জন দাও !  অনুশোচনা কর

ইবোলা দু হাত জড় করে প্রায় মাটিতে শুয়ে পড়লেন,   “হে মহান  দেবতা, কী করব কিছুতেই  এই গুরুতর সন্দেহ ত্যাগ করতে পারছি না

জনতার ভেতর থেকে কেউ একজন বলল,  “ ওই রাজপুরুষের কিছুই হচ্ছে না, দেবতাকে সন্দেহ করেও! দেবতা উনাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছেন না!  এরা কি তবে সত্যিই  দেবতা নয়!

ছুকন্দ উঠে আসে তোস্কারের কাছে।  কানে কানে বলে,  “আপনি নিশ্চয় কিছু একটা ভেবেছেন প্রভু।  কী ভেবেছেন জলদি বলুন? ”  

কিছুটা হতাশ হয়েই যেন তোস্কার জানায়, “ কিছুই ভেবে উঠতে পারিনি হে এখনও

ইত্যবসরে  দুই তীর্থ যাত্রী প্রবেশ করে সমাবেশ গৃহে তাদের পিছু পিছু ঢোকে বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ।

ইবোলা, জোরাবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,  “এই দুজনই বুঝি হুমবাবার  সেই পবিত্র স্থানে গিয়েছিল।”   

ওরান্ডার সম্মতি সূচক ভাবে মাথা নাড়েন। চাপা স্বরে বলে, “আপনার সন্দেহ নিরসনের আর কোন পথ তো খোলা ছিল না।  তারপর গলা খাঁকাড়ি দিয়ে নিয়ে  উচ্চস্বরে, পরিষ্কার কণ্ঠে প্রশ্ন করেন। “ হে তীর্থযাত্রীদ্বয় আপনাদের স্বাগত জানাই। আপনারা আমাদের বলুন পাহাড়ের দেবতারা এখনও সেখানে বসে আছেন নাকি নেই?  নির্ভয়ে উত্তর দিন আপনারা।” 

 উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ভিখারিরা তাদের সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ায়।

দুই তীর্থযাত্রী একসাথে বলে ওঠে, “কেউ নেই সেখানে !”

ইবোলা চিৎকার করে ওঠেন বিষ্ময়ে, “কী বলছ? তারা সেখানে নেই!” 

এক তীর্থযাত্রী দেবতাদের দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলে বলে,  “তাদের আসন শুন্য।”

দ্বিতীয়জন ধপ করে হাঁটু ভেঙে বসে মাটির দিকে মাথা নামিয়ে জানায়, “একটাও মূর্তি নেই । আমাদের যাত্রা বৃথা হয়েছে। আমরা আসল দেবতাদের ভুলে ...”  কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই জোরাব ভক্তি গদ গদ স্বরে চেঁচিয়ে ওঠেন,  “উপস্থিত সকলে মন প্রান ভরে  দেবতাদের দর্শন করুন ! আশীর্বাদ প্রাথনা করুন!”

মাকাসা বিড় বিড় করে, “এরা সত্যিই তাহলে  পাহাড়  থেকে এসেছেন

উপস্থিত জনতার ভেতরে শুরু হয় গুঞ্জন।

জোরাব দু হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলেন।  “আসুন, আমরা আমাদের সন্দেহের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য একটি বলি দেওয়ার ব্যবস্থা করি । এই অযাচিত ভুল করার ফলে দেবতাদের রোষ হয়তো এই দুর্ভাগ্য গ্রস্থ নগরীর ওপর আবার নেমে আসবে। এর হাত থেকে আমাদের বাঁচতে হবে।  দেরী না করে চলুন সবাই।”

সবাই বেড়িয়ে যায়।

ছুকন্দ তিড়িং করে লাফিয়ে নামে সিংহাসন থেকে। ছুতে গিয়ে ভেজিয়ে দেয় দরজার পাল্লা, তারপর একপাক নেচে নিয়ে বলে,  “আমার প্রভু সব আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছেন।“  

 “না, নারে   ছুকন্দ কী ঘটেছে বুঝতে পারছিনা ।  দুই সপ্তাহ আগে আমি যখন পাহাড়ের  ওখান দিয়ে এসেছিলাম  তখন তো সবুজ পাথরের দেবতার মূর্তিগুলো ছিল!”  চিন্তার ছাপ তোস্কারের কন্ঠে স্পষ্ট। কপালে ভাঁজ।

 “যাক বাবা বিপদ তো কেটে গেছে,” বলে উঠল জাবন।  

রাগ্ন স্বস্তির স্বরে বলে,  “হ্যাঁ কেউ আর আমাদের পুড়িয়ে মারবে না। দারুন বাঁচা বেঁচে গেলাম ।“

তোস্কার একই রকম চিন্তার সুরে বলে,  “বেঁচে গেলাম! তা ঠিক। কিন্তু  কীভাবে? আমি জানি না

জাবন ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,   “কোনো ভিখারির জীবনেই এরকম সময় কখনও আসেনি আমি হলফ করে বলতে পারি।”   

চোর  এতক্ষন লুকিয়ে ছিল পেছনে থামের আড়ালে। সে বলে,  “আমি একবার বাইরে গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসি ।”       

বয়স্ক লোবান এবার বলে,  “আমার কিন্তু ভয় যাচ্ছে না!” 

জাবন বলে, “আরে খুড়ো। আবার  কিসের ভয় ? সবচেয়ে বড় বিপদ থেকে  আমরা তো বেঁচেই গেলাম।“   

লোবান জানাল,   “গত রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি

“কী স্বপ্ন?

“তেমন কিছুই না ।  আমি স্বপ্নে দেখছিলাম যে আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে। কেউ একজন আমাকে রাজকীয় মদ খাওয়াচ্ছে । আমি খাচ্ছি কিন্তু, আতংকে কাঁপতে কাঁপতে।”   

রাগ্ন জানয়,  “আমি যখন মদ খাই তখন  আমি কিছুতেই ভয় পাই না

চোর ফিরে আসে।

বলে, “ওরা  দারুন খাবার দাবারের ব্যবস্থা  করছেএকটা মেষশাবককে বলিও দিয়েছে ।    মেয়েরা ঝুড়িতে করে ফল আনার তোড়জোর করছে সাথেই আনছে রাজকীয় মদের পিপে। আসছে নাচ গানের দল। ”   

বইলোম চোখ বড় বড় করে বলে,  “ভিখারিদের কেউ কোনোদিন এমন জীবনের গল্প স্বপ্নেও দেখেনি ।”   

তোস্কার জানতে চায়, “ওরা কী এখনো আমাদের সন্দেহ করে কথা বলছে?

চোর জানায়, “তা বলতে পারব না। তেমন কিছু শুনতে তো পেলাম না।”

“কখন ভোজ হবে?” বইলোম প্রশ্ন করে।

 চোর জানায়,  “রাতের আকাশে যখন তারা ঝিকমিক করবে তখন। দেরী আছে।  সব খেয়ে নিও না আমার জন্য রেখ কিন্তু 

জাবন এগিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে আকাশ দেখে উঁকি মেরে।  তারাও ফুটে উঠছে একটা একটা করে“আর বেশী দেরী নেই  পেট পুরে খাবো।”

রাগ্ন বলে,  “আমি দেখতে পাচ্ছি  মেয়েরা মাথায় ঝুড়ি বয়ে নিয়ে আসার জন্য তৈরি হচ্ছে

জাবন, “সেই  ঝুড়িতে আছে ফল। টাটকা ফল

রাগ্ন উল্লাসে চিৎকার করে, “এই মরসুমের সমস্ত ফল

“ভাবতেই অবাক লাগছে সামান্য খাবারের জন্য আমরা কোথায় কোথায় না হেঁটে গিয়েছি,”  বইলোম বিড়বিড় করে।   

“হ্যাঁ খুব কষ্টের দিন ছিল সেসব,” সায় দেয় জাবন।   

রাগ্ন বলে,  “ধুলো নোংরা মেখে পড়ে থেকেছি দিনের পর দিন।”  

“একটু খানি মদের জন্য আকুলি বিকুলি করেছি । এর তার পায়ে পড়েছি । মার খেয়েছি । কত শত বার চেয়ে কয়েক ফোঁটা জুটেছে ভাগ্যে!”  স্মৃতি রোমন্থন করে জাবন।

তোস্কারের গলাতেও বিজয়ীর সুর,  “যে সবের জন্য সারা জীবন কুকুরের মতো তাড়া খেয়েছি এখন সব আমাদের নাগালের মধ্যে।”   

চোর  বলে, “আমার তো মনে হচ্ছে যেটুকু চুরিবিদ্যা জানি সেটাও এবার ভুলে যাবচুরি না করেই তো সব ভাল জিনিস পেয়ে যাচ্ছি ।  

তোস্কার আশ্বাস দিয়ে বলে,  “ওই মহাবিদ্যার প্রয়োগ তোমাকে আর করতেও হবে না কোনোদিন 

ছুকন্দ সায় দেয়, “হ্যাঁ হে,  আমার প্রভুর বুদ্ধিতেই আমাদের দিন মজাসে কেটে যাবে।”

একজন  মানুষ এসে দাঁড়ায় দরজার সম্মুখে।

“কে ? কে ওখানে?” চেঁচিয়ে ওঠে তোস্কার। সবাই চটপাট সিংহাসনে বসে পড়ে। চোর লুকিয়ে যায় আড়ালে।

  প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে একজন ভয়ে কুঁকড়ে থাকা মানুষ তোস্কারের পায়ের কাছে এসে       নিজের কপাল চাপড়ায় ।

   “হে প্রভু, আমরা আপনাকে  হাত জড় করে অনুরোধ করছি, রজপুরুষদের সন্দেহের শাস্তি আমাদের দেবেন না।  আমাদের ক্ষমা করুন । করুণা  করুন ।”  

দেবতার ভঙ্গিতে আগমার ভিখারিরা চুপ করে বসে থাকে তোস্কার বলে , “কী হয়েছে?” মানুষটা কেঁদে ফেলে, “ প্রভু সবই তো জানেন।  ভয়ানক ব্যাপার!”

 ভিখারিরা নীরবতা বজায় রাখে বসে থাকে পাথরের মত।

“মরুভূমির প্রান্তরে  আপনারা যখন  পাইচারী করছিলেন ।  কয়েকটা শিশু ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য   দেখে আতঙ্কেই  মারা গেছে।”   

 “মরুভূমির প্রান্তরে?  কখন আমাদের দেখতে পেয়েছো ?” তোস্কার পারল না কন্ঠের বিশ্ময় ঢাকতে।

 “গতরাতে, প্রভু   গত রাতে আপনাদের ভয়ঙ্কর রুপ দেখেছে অনেকেই।  আপনাদের গা দিয়ে জ্যোতি বের হচ্ছিল । সে বড়ই সাংঘাতিক আলো । আপনাদের হাত  প্রসারিত হচ্ছিল মাঝে মাঝেই।  কিছু একটা আঁকড়ে ধরার জন্য ।  মনে হচ্ছিল আপানার গোটা শহরটাকেই উপড়ে নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করছিলেন।“

  “গতকাল রাতে দেখেছো তাই তো? ”

 বিস্ফারিত চোখে মানুষটা উত্তর দেয়, “ হ্যাঁ প্রভু , এরকম আলো আমি কোনোদিন দেখিনি ।” 

  “তুমি  নিজেও দেখেছো?” 

   “হ্যাঁ, প্রভু, এ জীবনে কোনোদিন সে দৃশ্য ভুলতে পারবোনা।   ভয়ানক ! আমার দুটো  বাচ্চা আপনাদেরকে দেখেছিল” আবার কেঁদে ফেলে।  “তারা দুজনেই মারা গেছে।”   

 “তুমি এই আমাদেরকেই দেখেছ?”   

চোখের জল মুছে মানুষটা বলে, “হ্যাঁ, প্রভু। ইয়ে মানে না । আপনারা এখন যে রুপে আছেন সেরকম না। প্রভু  আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি, রাতে ওই রুপে ঘুরে বেড়াবেন না  আলো যুক্ত আপনাদের সে রুপ ...”

 তুমি বলছ, আমরা  এখনকার মতো রুপে ওখানে ছিলাম না।  ঠিক কী রকম রুপে ছিলাম সেটা বলো তো দেখি? 

 একরাশ আতঙ্ক ভরা মুখে ঠক ঠক করে কেঁপে মানুষটা বলে,  “অন্য রুপে প্রভু, অন্য রুপে!”   

 তোস্কার ধমকে ওঠেন, “আহ! কী রকম রুপে সেটা বল?”   

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে মানুষটা বলে চলে, “হুমবাবা পাহাড়ে আপনাদের যে রুপ। ঠিক সেই রকম।   আপনাদের সকলের গায়ের রঙ ছিল সবুজ । সেই সবুজ গা থেকে আলো বের হচ্ছিল । আপনাদের দেখে মনে হচ্ছিল আপনারা সবুজ পাথর দিয়ে বানানোহ্যাঁ পাথর। ঠিক যেমন হুমবাবা পাহাড়ের মুর্তি ঠিক তেমন।  এই মানুষের রুপে আপনাদের সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের আছে। কিন্তু পাথরের রুপে...উফ সে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য । সাধারন মানুষ আমরা । সে কী সহ্য করতে পারি। পাথর হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে এ যে কী বিভীষিকা !”

“আমরা  এভাবে তোমাদের সামনে  হাজির হয়েছিলাম ?

 “হ্যাঁ, প্রভু । আমি মিথ্যে যে বলছি না আপনি তো ভালোই জানেন।  পাথরের মূর্তির হাঁটা চলা করা  উচিত নয় বাচ্চারা দেবতা কী তা বোঝে না, যতক্ষন না আমরা বুঝিয়ে দিই । এভাবে ওদের মারবেন না প্রভু ।” 

  তোস্কার গম্ভীর স্বরে বলে, “শুধু রাজপুরুষেরা নয়, তোমাদের ভেতর এখনো অনেকে আমাদের  সন্দেহ করে। খোঁজ নাও আর কী প্রমান চাই তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য?

  “প্রভু, তারাও আতঙ্কিত আমাদের বাঁচান, প্রভু। ক্ষমা করুন ।”   

তোস্কার গম্ভীর স্বরে কাটা কাটা উচ্চারনে  আশ্বাস দেয়,  “দেবতাদের সন্দেহ করা পাপ । যাও এবং আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত হও আর কিছু হবেনা।”

মানুষটা বার কয়েক নতজানু হয় উঠে দাঁড়ানোর পর। তারপর ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায় তোস্কার সহ বাকি দেবতাদের দেখতে দেখতে। বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। চত্বরের ওপর দিয়ে শোনা যায় তার ছুটে যাওয়ার শব্দ।

 “ওরা কী দেখেছে, প্রভু ?” ছুকন্দ জানতে চায়

“ওরা  নিজেদের মনে জমে থাকা দ্বিধাকে ভয়ের রুপ নিয়ে মরুভূমিতে নাচতে দেখেছে।  কোনো কারনে দূরে কোথাও সবুজ আলো জ্বলছিলঅন্ধকারে সেটা দেখেই বাচ্চারা ভয় পেয়েছে। গল্প বানিয়েছে। বলেছে আমরা  পাথরের রুপ নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি । সত্যি বলতে, আমি জানিনা ওরা কি দেখেছে!”  

 লোবান খুড়ো বলে,  “মরুভূমি থেকে কিছু একটা এইদিকেই আসছে, এরকমটাই কি বলে গেল মানুষটা ?”   

ছুকন্দ খেঁকিয়ে ওঠে,  “মরুভূমি থেকে আবার কি আসছে ?” 

তোস্কার বলেন, “বাদ দে ছুকন্দ মদের ঘোরে  ভুল ভাল বকছে।  ও নিয়ে ভেবে লাভ ...”

লোবান তোস্কারের কথার ওপরেই বলে ওঠে,  “ ভুল বকছি না প্রভু।  লোকটার ফ্যাকাশে মার্কা মুখ কিন্তু প্রমান দিচ্ছিল সত্যিই ভয়ানক কিছু একটা ও দেখেছে।” 

ছুকন্দ ঢোঁক গিলে বলে,  “ভয়ানক কিছু মানেটা কী শুনি  ?

“আমি অনেক মানুষের মুখ দেখে দেখে চুল পাকিয়েছি। ওই লোকটার মুখের ভাব ভঙ্গীতে অভিনয় ছিল না একফোঁটা। ও যা দেখেছিল সেটা খুব কাছ থেকেই দেখেছিল।  আর সেটা ভয়ঙ্কর ছিল।”   

তোস্কার বলল, “বাজে বকা থামাও খুড়ো।  আপাতত আমরাই হলাম সেই সব সত্ত্বা যাদের কে ওরা ভয় পাচ্ছে। আর ওদের  ভয়ই ওদেরকে বোকা বানিয়েছে

মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেটে গেছে আর খানিকটা সময়। আকাশে তারারা সাজিয়ে দিয়েছে তাদের ঝলমলে রোশনাই ভরা ঝালর।

একজন মানুষ এসে দাঁড়ায় দরজার কাছে। প্রবেশ করে অনুমতি নিয়ে। কক্ষের পুরোনো মশাল বদলে সাথে নিয়ে আসা নতুন মশালগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে যায় এক এক করে।  

বইলোম খুশীতে ডগমগ হয়ে বলে,  “আহা, আহা!  এইবার, এইবার আমরা শহরের সুন্দরীদের মুখ দেখতে পাবো । ওরা আমাদের জন্য সুস্বাদু খাবার বয়ে নিয়ে আসছে।  সত্যিই এরকম   সময় কখনও আসবে ভাবাই যায়নি ।”   

তোস্কার বলে, “সবাই যে যার জায়গায় বসে যাও । ওরা আসছে. আমি ওদের পদধ্বনি অনুভব করছি ।” 

রাগ্ন বলে, “নর্তকীরা আসছে বোধহয় । আজ ওরা আমাদের নাচ দেখাবে।”   

চোর  সন্দেহের স্বরে বলে,  “কিন্তু  বাঁশির শব্দ পাচ্ছি না তো । ওরা যে বলেছিল নাচের সাথে বাজনাও থাকবে!”   

জাবন ভুরু কুঁচকে বলে,  “ওরা কী পায়ে ভারী বুট পড়ে আছে?  মনে হচ্ছে যেন  পাথরের মুগুর কেউ মাটিতে ঠুকছে” 

রাগ্ন চোখ পিট পিট করে বলে, উঁহু, এই ভারী পায়ের শব্দ আমার ভাল ঠেকছে না । যারা নাচ করে  তাদের পায়ের আওয়াজ তো শোনাই যায় না বলে শুনেছি। নর্তকীদের শরীর তো হাল্কা হয়

তোস্কার ব্যঙ্গের সুরে বলে, “যদি কিছু মোটা ধুমসী আমাদের নাচ দেখাতে আসে আমি একদমই ওদের দিকে তাকাবো না।”   

বইলোম জানায়,  “যারা আসছে তাদের গতি অতি ধীর। নাচের মেয়েরা এতো ধীরে ধীরে আসছে কেন?”   

রাগ্ন কান খাড়া করে শোনে শব্দটা, তারপর বলে,  “নর্তকীদের হাঁটা চলাও তো নাচের ছন্দেই হয় । তালে তালে । এই শব্দ শুনে মনে হচ্ছে যেন কোনো বড় পাথরের কাঁকড়া হেঁটে আসছে।”

বয়স্ক লোবান সহসাই পাগলের মত  চিৎকার করে ওঠে,  “আমার  এই ভয়টাই ছিল ! অতি প্রাচীন এক ভয় ! উল্টোপাল্টা কাজ করার ভয় !  আমরা সাত দেবতার নাম করে মানুষ ঠকাচ্ছি ! ওরা সব দেখছেন!   আমরা ভিখারি ছিলাম, সেটাই থাকা উচিত ছিল ! সেটাই আমাদের ভাগ্য ! সেই পেশা ছেড়ে আমার নিজেদের দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছি!  না আমি আর চুপ করে বসে থাকব না! আমি এখান থেকে পালাব! আমি বুঝতে পারছি দেবতার অভিশাপ শয়তানের রুপ নিয়ে আমাদের ওপর নেমে আসতে চলেছে !” 

শব্দ থেমে যায় দরজার কাছে এসে।

ছুকন্দ বলে,  “প্রভু ! কারা যেন এসেছে!”

সবাই শুনতে পেলেও  কেউ কোনো উত্তর দেয় না। পাথরের মূর্তির মত বিশেষ ভঙ্গীতে বসে থাকে।

তোস্কার উঠে দাঁড়িয়ে অবিচলিত কন্ঠে আহবান জানায়,  “দ্বারপ্রান্তে যারা উপস্থিত। তারা ভেতরে এসো।”    

 পাথুরে বুটের মালিকেরা এক এক করে কক্ষটিতে প্রবেশ করে। এক সারিতে দাঁড়ায় । সাতজন সবুজ রঙের মূর্তি । হাত পা মুখ সব সবুজ। পায়ে সবুজ পাথরের জুতো।  দাঁড়ানোর ভঙ্গী অদ্ভুত।   যুগ যুগ ধরে বাবু হয়ে বসে থাকার কারণে হাঁটুগুলি দুদিকে ছড়ানো । ডান হাতের কনুই বাম হাতের তালুর উপর রাখা এবং ডান তর্জনী  উপরের দিকে নির্দেশ করছে। এসব দেখে তোস্কার বাদে বাদে বাকি ছয় ভিখারি ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। তোস্কার এক দৃষ্টে চেয়ে থাকেন   সবুজ মূর্তিরা ওদেরকে ঘিরে এক পাক দেয়

 খ্যাসখেসে স্বরে জাবন চিত্কার করে, “হুমবাবা পর্বতের পাথরের দেবতাগন!

তোস্কার কর্কশভাবে ধমক দেয়,  “চুপ করে থাকো সবাই ।  যদি ওরা দেবতা হন তা হলে তো আমরা উদ্ধার হয়ে গেলাম। মানুষ স্বচক্ষে দেবতা দর্শন করলে সোজা  স্বর্গে যায়। আর যদি শয়তান হন এনারা, তাহলে... মনে হচ্ছে ওদের চোখ মশালের আলোয় ধাঁধিয়ে গেছে । ওরা  আমাদের দেখতে নাও পেতে পারে

  সবুজ মূর্তিদের প্রথম জন মশালের দিকে আঙ্গুল তোলে । 

 লালছে হলুদ আগুনের শিখার রঙ বদলে সবুজ হয়ে যায় ছয়জন  বসে থাকা ভিখারির দিকে এক এক করে সেই সবুজ মূর্তি আঙ্গুল তুলে নাড়ায় । সবশেষে সেই আঙ্গুল স্থির হয় তোস্কারের দিকে। মন্ত্রমুগ্ধ কাঠের পুতুলের মতো তাকেও গিয়ে বসতে হয় সিংহাসনে।  সাত পাথুরে দেবতার চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে ক্রোধের আগুনে । ছিটকে যায় সবুজ স্ফুলিঙ্গ সাত ভিখারির দিকে ।

চোখ ধাঁধিয়ে যায় চোরের। সে আর কিছু দেখতে পায় না। শুধু শুনতে পায় এক বজ্র গম্ভীর কন্ঠস্বর। যা প্রতিধ্বনিত হয় সমাবেশ গৃহের দেওয়ালে দেওয়ালে।

“ তোরা দেবতা হতে চেয়েছিলি। তোদের সেটাই করে দিলাম । তোদের উদ্দেশ্য ভাল থাকলেও তার পথ ভালো ছিল না। তবে তোদের এই বলিদান  বৃথা যাবে না।”

মশালের আলো স্বাভাবিক হয় ।  সম্বিত ফিরে পায় চোর। আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে  মূর্তিগুলোর কাছে গিয়ে তাদের গায়ে হাত বোলায়। দরজার কাছে উপস্থিত হয় একদল মানুষতারা প্রবেশ করার আগেই চোর আবার লুকিয়ে পড়ে। খাদ্য দ্রব্য এবং অন্যান্য নানা সামগ্রী নিয়ে প্রবেশ করে জনতা।   

আসনে বসে থাকা সবুজ পাথরের মূর্তিগুলোকে দেখে ওরা থমকে যায়।  কাছে গিয়ে এক এক করে ভাল ভাবে দেখে ওদের শুরু হয় গুঞ্জন।

  “দেবতারা আবার পাথরে পরিণত হয়েছেন!”

 “হায়! হায়! একি হল!”  

 ধুপ ধাপ মেঝেতে বসে কপাল চাপড়াতে শুরু করে  অনেকেই।   

  “আমরা ওদের সন্দেহ করেছিলাম

  “আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি ।”  

“ওরা আবার  পাথরেই  পরিণত হলেন ।”

“এ শহরের অবস্থার উন্নতি হওয়ার আর আশা রইল না।”   

 “আমি জানতাম ওরা  সত্যিই দেবতা ছিলেন

 “কিন্তু রাজপুরুষেরা সেটা বিশ্বাস করতে পারেনি। আমরাও অনেকেই পারিনি ।”

“হায়! হায়! কি সুযোগ নষ্ট হল । দেবতাদের কাছে পেয়েও আমরা হারিয়ে ফেললাম।”  

সহসা আবার প্রতিধ্বনিত হল সেই অজানা কন্ঠস্বর।

“পাথরের দেবতা নয়, যারা তোমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, ভিক্ষা করে, দু মুঠো খাদ্যের জন্য চরম খেটেও ঠিক মত পারিশ্রমিক পায় না, তাদের দিকে নজর দাও সবাই। এতে তোমাদের এবং নগরের সুখ সমৃদ্ধি পুনরায় ফিরে আসবে।”

সমাপ্ত