Search This Blog

Tuesday, April 21, 2020

গিলগামেশ কাব্য [গদ্যরুপ] চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অন্তিম অধ্যায়



তৃতীয় অধ্যায় লিঙ্ক
https://amarkolponarjogot.blogspot.com/2020/04/blog-post_6.html

চতুর্থ অধ্যায়  
অনন্ত জীবনের সন্ধান
  গিলগামেশ ভারাক্রান্ত মনে তার বন্ধু এনকিডুর জন্য আরো অনেক অশ্রুপাত করলেন। বনভুমির এলাকায় ঘুরে ঘুরে বেড়ালেন শিকারির মত। ঠিক যেভাবে তার বন্ধু  ঘুরে বেড়াতবিক্ষিপ্ত মানসিকতা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে উঠলেন, “ আমি কী করে বিশ্রাম নিতে পারি, কীভাবে শান্তিতে থাকতে পারি ? হতাশা চেপে বসেছে আমার মনে । আমার ভাইয়ের এখন যা পরিণতি হয়েছে, আমারও তাই হবে, যখন আমি মারা যাব। যেহেতু  আমি মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছি  তাই, যেভাবেই হোক আমি খুঁজে বার করবো উত্নাপিশতিমকে। কারন তিনি সশরীরে গিয়েছিলেন ঈশ্বরদের সমাবেশ ক্ষেত্রে।  যথাসাধ্য চেষ্টা করব সেই পথ খুঁজে বার করার, যাকে সময়ের দ্বার বলা হয় ।”
  গিলগামেশ শুরু করলেন তার যাত্রা। সমতল ভুমি, তৃণভূমি, পাহাড় পর্বত সব কিছু অতিক্রম করে সে এক দীর্ঘ যাত্রা পথ, লক্ষ্য একটাই উত্নাপিশতিমের সন্ধান করা। যাকে দেবতারা প্রলয়ের পরে নিজেদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারাই তাকে সূর্যের বাগান দিলমানের দেশে বাস করার ব্যবস্থাও করে দেন। একমাত্র মানুষ যাকে তারা প্রদান করেন অনন্ত  জীবন
রাতের বেলায় যখন গিলগামেশ পাহাড়ের কাছে এসে পৌছান তখন প্রার্থনা করেন,  “এ্রই পাহাড়ের এলাকায় পৌছানোর বহুদিন আগে  আমি সিংহ দেখেছি আমি ভয় পেয়েছি,   চাঁদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিপ্রার্থনা করেছি এবং কামনা করেছি  আমার প্রার্থনা যেন দেবতাদের কাছে  পৌছায় । অতএব,  হে দেবতা চাঁদ, আমাকে রক্ষা করুন। ”
 প্রার্থনা শেষ করে গিলগামেশ  ঘুমিয়ে পড়লেনসেই ঘুম ভাঙল একটা স্বপ্ন দেখার পর।   
 সেই স্বপ্নে সিংহের দল  তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল। উনি হাতে নিলেন তার  কুড়ুলকোমর বন্ধনী থেকে নিষ্কাশিত করলেন তার তলোয়ার। সিংহদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন জ্যা মুক্ত তীরের মত। একের পর এক আঘাত হেনে ওদের মেরে তাড়িয়ে দিলেন।   
 আবার শুরু হল তার পথ চলা গিলগামেশ উপস্থিত হলেন  যে সুউচ্চ বিশাল পাহাড় মাসুর নিকট। এই পাহাড়ের বিষয়ে উনি  অনেক কিছু শুনেছিলেন। এই সেই পাহাড়, যা উদীয়মান এবং অস্তমিত সূর্যকে রক্ষা করে। এর দু'টি চূড়া স্বর্গের প্রাচীরসম উঁচু। এর শিরা পাতাল পর্যন্ত বিস্তৃত ।  এই পাহাড়ের প্রবেশ দ্বার পাহারা দেয় কাঁকড়া বিছেরা । যারা আসলে  অর্ধ মানুষ এবং অর্ধ ড্রাগন এদের প্রকোপ অতি ভয়ঙ্করএরা কারোর দিকে তাকালে সেই মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হয়। তাদের শরীরের চমকে চকচক করে মাসু  পাহাড়,    যা রক্ষা করে উদীয়মান সূর্যকে।  গিলগামেশ ওদের দিকে তাকানোর পর বেশ কিছুটা সময় নিজের চোখ বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হলেন। তারপর  সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলেন। অকুতোভয় গিলগামেশকে   দেখতে পেয়ে বৃশ্চিক মানব তার সাথিকে ডেকে বলল, “ ওই যে মানুষটা এদিকে এগিয়ে আসছে মনে হচ্ছে সে একজন দেবতা।”
 সঙ্গী বৃশ্চিক মানব  উত্তর দিল,   “দুই তৃতীয়াংশ দেবতা, কিন্তু এক তৃতীয়াংশ মানুষ।”
প্রথম বৃশ্চিক মানব দেবতাদের সন্তান গিলগামেশকে প্রশ্ন করলেন, “কেন তুমি এতপথ  ভ্রমণ করে এখানে এলে? পার হয়ে এলে বিপজ্জনক জল রাশি।  তোমার আসার কারণ বলো?
 গিলগামেশ উত্তর দিলেন, “ এর কারণ বন্ধু এনকিডু। আমি তাকে খুব ভালবাসতাম একসাথে আমরা সব ধরণের কষ্ট সহ্য করেছি তার অবস্থা বিবেচনা করেই আমি এসেছি, কারণ সাধারণ এক মানষের মতই তাকে এ জগত থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।  আমি তার জন্য দিন রাত কেঁদেছিআমি তার মৃত শরীর কবর দিতে চাইনি।  আমি ভেবেছিলাম আমার কান্না শুনে  আমার বন্ধু ফিরে আসবেসে  চলে যাওয়ার পর থেকে, আমার এ জীবনে কিছুই ভালো লাগছে না।    এজন্যই আমি ভ্রমণ করে চলেছি। সন্ধান করছি উত্নাপিসতিম বাবার।  কারণ মানুষেরা বলে, উনিই একমাত্র মানুষ যিনি দেবতাদের কাছে সশরীরে যেতে পেরেছেন।  সন্ধান পেয়েছেন অনন্ত জীবনের। আমি তাকে জীবিত এবং মৃতদের বিষয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক।”

বৃশ্চিক মানব,  গিলগামেশের উদ্দেশ্যে বলল,  “আজ অবধি  স্ত্রীলোকের গর্ভজাত কোনো মানুষ একাজ করেনি, যার কথা তুমি বলছ । কোনও নশ্বর মানুষ এই পাহাড় ভেদ করে যেতে পারেনি । এর দৈর্ঘ্য বারো লীগ। পুরো এলাকা ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আলোর চিহ্নমাত্র নেই।  অন্ধকারের অসীম চাপ সেখানে হৃদয়কে নিপীড়িত করেসূর্যর উদয় থেকে  অস্ত যাওয়া, এই সময়কালে   এক কনা আলোও সেখানে প্রবেশ করতে পারেনা। ''
গিলগামেশ বললেন, “ আমার হৃদয়ের সমস্ত দুঃখ এবং ব্যথা, অগণন দীর্ঘশ্বাস এবং অস্রুপাত নিয়েই আমি সেখানে প্রবেশ করব। আমাকে যেতে হবেইএই পাহাড়ের প্রবেশ পথ খুলে দিন।”  
বৃশ্চিক মানব একথা শুনে  বলল, “বেশ তাহলে তাই হোক। গিলগামেশ, আমি তোমাকে মাশু পাহাড় পার হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। আশা করছি তোমার পদযুগল তোমাকে সহায়তা  নিরাপদে নিজ ভবনে ফিরে যাওয়ার জন্য।  খুলে দিলাম পাহাড়ের প্রবেশদ্বার।”
বৃশ্চিক মানবের এই কথা শুনে গিলগামেশ, সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই প্রবেশ করলেন পাহাড়ের আভ্যন্তরীন এলাকায়।  এক লীগ পথ পার হতেই  তার চারদিকে অন্ধকার ঘন হয়ে গেলকোন আলো ছিল না সেখানে। গিলগামেশ নিজের সামনে বা পেছনে  কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না দুই লিগের পরে অন্ধকার আরো ঘন হয়ে উঠল । এক এক  লীগ পথ এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অন্ধকার আরো জমাট বাঁধছিল। [মূল কাব্যে প্রতি লীগ এগিয়ে যাওয়া আর অন্ধকার বেড়ে যাওয়া, সাথেই আগে পিছে কিছু দেখতে না পাওয়ার একই বাক্য ব্যবহার হয়েছে বারো বার সেই একঘেয়ে অংশ বর্জন করলাম।  – অনুবাদক।]  আট লীগ পথ পার করে  গিলগামেশ চিৎকার করে উঠলেন তখন অন্ধকার আরো আরো বেশী জমাট বেঁধেছে। আশেপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। নয় লীগ পথ যাওয়ার পর গিল গামেশের মুখের উপর উত্তরের বাতাসের ছোঁয়া এসে লাগল । যদিও  অন্ধকার একই রকম ছিল তখনো।   দশ লীগ পথ পার করেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না সামনে বা পেছনে। এগারো লীগ পথের শেষে  অন্ধকার কমে গেল। ভোরের মতো আলো হাজির হল গিল গামেশের সামনে বারো লীগ পথের শেষে পুনরায় সূর্যের আলোয় আলোকিত হল সব কিছু ।

গিলগামেশ উপস্থিত হলেন দেবতাদের বাগানে। তার চারপাশে সমস্ত ঝোপঝাড়  সজ্জিত হয়ে ছিল নানা রকম মনি মানিক্য দ্বারা ।   দ্রাক্ষালতার দেখা পেয়ে গিলগামেশ এগিয়ে গেলেন সেদিকে। সে স্থানের সব কিছুই দেখতে অতীব সুন্দরমরকত মনির পাতা আর ফল ঝুলে আছে গাছে গাছেওই স্থানের  কাঁটাগাছগুলোও হেম্যাটাইট এবং নানান বিরল পাথরের দ্বারা সজ্জিতসাথেই ছিল সমুদ্রের বুক থেকে তুলে আনা দুস্প্রাপ্য মুক্তো । সমুদ্রের কিনারায ধরে বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে থাকলেন গিলগামেশ  তাকে দেখতে পেলেন মহান শামাশলক্ষ্য করলেন যে, গিলগামেশের পরনে   প্রাণীদের চামড়ার পোশাকবুঝতে পারলেন ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পশুদের  মাংসও খেয়েছেন গিলগামেশ। ব্যথিত হয়ে মহান শামাশ নিজের মনে বললেন, “ আজ অবধি কোন নশ্বর মানুষ  এপথে আসেনি, ভবিষ্যতে আসবেও না। যতদিন   সমুদ্রের উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাবে তত দিন এ ঘটনা আর কখনও ঘটবে  না '' তারপর গিলগামেশকে বললেন, “তুমি যে অনন্ত জীবনের   সন্ধান করছ তা কখনও খুঁজে পাবে না।”
 গিলগামেশ মহান শামাশকে বললেন, “ এত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে, এত পরিশ্রম করে আমি ক্লান্ত। আমাকে কি এবার ঘুমাতে হবে,  পৃথিবী কি আমাকে চিরকালের জন্য আচ্ছাদিত করে দেবে?   আমার চোখ যেন সূর্যকে দেখতেই থাকে যতক্ষন সে তার উজ্জ্বলতা প্রদান করবে  যদিও আমি এখন একজন মরা মানুষের মতই, তবুও আমাকে সূর্যের আলো দেখতে দিন। ”
সমুদ্রের পাশেই  বাস করত সিডুরি নামের এক নারী।  দ্রাক্ষালতাদের দেখভালকারিণী। উত্তেজক পানীয় বানাত সে।  দেবতাদের প্রদান করা সোনার বাটি এবং সোনার পাত্র সহ সমুদ্রের কিনারায় বাগানের ভেতর বসে ছিল সে।  ওড়না দিয়ে আবৃত ছিল তার সমগ্র শরীর । বসে থাকতে থাকতেই সে দেখতে পেল  গিলগামেশ তার দিকেই এগিয়ে আসছেন।  এমন এক মানুষ যার শরীরে দেবতাদের অংশ বিরাজমান। পরনে পশুদের চামড়া । হৃদয়ে  হতাশার ভার আর মুখে হলেন দীর্ঘ পথ পাড় করে আসার ছাপ । সিডুরি গিল গামেশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলল, “ এ নিশ্চয় খুব সাংঘাতিক কেউ। এর এখানে আগমনের কি কারন?”   সময় নষ্ট না করে সে তার নিজ আবাসের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিল অর্গল দ্বারা। 
গিলগামেশ দ্বার বন্ধ করার আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকালেন এবং চৌকাঠে  পা রেখে উনি জানতে চাইলেন, “ হে যুবতী, দ্রাক্ষারস নির্মাত্রী, কেন তুমি তোমার ভবনের প্রবেশ দ্বার বন্ধ করে দিচ্ছ?  তুমি কি জানো আমি চাইলেই এই দ্বার ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে পারি।  কারণ আমিই সেই গিলগামেশ যে, স্বর্গের ষাঁড়কে  হত্যা করেছিআমিই সেই যে, সিডার  বনের রক্ষককে হত্যা করেছি আমিই সেই যে, হুমবাবাকে ওই অরণ্য থেকে বিতারিত করেছি।   আমিই সেই যে, পর্বতের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো সিংহদের শিকার করেছি
তখন সিডুরী তাকে বললেন, “আপনিই যদি সেই গিলগামেশ হবেন, যে স্বর্গের  ষাঁড়টিকে হত্যা করেছিল, অরন্যের প্রহরীকে হত্যা করেছিল, হুমবাবাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সিংহ শিকার করেছিল তাহলে আপনার মতো মানুষের মুখে ও শরীরে ক্ষুধা ও ক্লান্তির ছাপ কেন?  হতাশা কেন আপনার হৃদয়ে?  কেনই বা আপনার মুখ এমন একজনের মুখের মতো যে দীর্ঘ পথ যাত্রা করেছে?  কেনই বা আপনার মুখাবয়ব   গরম এবং ঠান্ডার প্রভাবে কুঁচকে গিয়েছে? কেনই বা আপনি একাধিক চারণভূমি পার করে এখানে এসেছেন  বাতাসের সন্ধানে?
গিলগামেশ তাকে উত্তর দিলেন, “হে যুবতী, কেনই বা আমার মুখাবয়বে  অনাহার এবং ক্লান্তির ছাপ পড়বে না বল দেখি?  হতাশাগ্রস্থ   হৃদয়ে আমি যে এক দীর্ঘ পথ পার করে এখানে এসেছি। উত্তাপ আর শীতলতার আক্রমণ সহ্য করেছি।  কেনই বা আমি তার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাতাসের সন্ধান করব না? আমার বন্ধু, আমার ছোট ভাই,  যে বনাঞ্চলে বুনো গাধা এবং সমতলভূমির প্যান্থার শিকার করত সে স্বর্গের ষাঁড়কে চেপে ধরেছিল যাতে ওই পশুকে আমি হত্যা করতে পারি।    সিডার  অরণ্য থেকে হুম বাবাকে বিতাড়িত করতেও সেই আমার পাশে ছিল।  আমার সেই প্রিয় বন্ধু  সব সময় আমার পাশে দাঁড়িয়ে বিপদের মোকাবিলা  করেছিল এনকিডু আমার ভাই, আমি যাকে ভালোবাসি, মৃত্যুর  তাকে কেড়ে নিয়ে গেছে আমার কাছ থেকেআমি তার জন্য সাত দিন এবং সাত রাত  তার মৃতদেহের পাশে বসে কেঁদেছি , যতক্ষন না কীটেরা তার দেহ আক্রমণ করেছে।  আমার ভাইয়ের এই পরিণতির কারণেই আজ আমি ভীত
মৃত্যু সম্পর্কে।  আমার ভাইয়ের কারণে আমি দিকে দিকে বিভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়িয়েছি।   বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবতে পারিনি।   কিন্তু এখন, হে যুবতী, দ্রাক্ষারস নির্মাত্রী, তোমার মুখ দর্শন করার পর থেকে আমার আর মৃত্যুর মুখ দেখার ইচ্ছে নেই।”
সিডুরি জবাব দিল, 'গিলগামেশ, আপনি কিসের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন?   আপনি কখনই সেই জীবন পাবেন না যা আপনি খুঁজছেন যখন দেবতারা মানুষকে সৃষ্টি করে তখন তারা তাকে মৃত্যুও বরাদ্দ করেশুধু সুযোগ দেয় জীবনটাকে নিজের মত করে  রক্ষণাবেক্ষণ করার।    হে গিলগামেশ, আপনি ভাল করে খাওয়া দাওয়া করুন।    দিনের পর   রাত আর রাতের পর  দিন, মেতে থাকুন  নাচ গান এবং আনন্দ উৎসবে। ভালো নতুন পোশাক পরিধান করুন।   শীতল জলে স্নান করুন আপনার হাত ধরে থাকা ছোট্ট সন্তানদের লালন পালন করুনউষ্ণ আলিঙ্গনে আপনার স্ত্রীকে সুখী করুনএকজন  মানুষের পক্ষে এগুলোই অনেক পাওয়া। ”
 এ কথা শুনে গিলগামেশ যুবতী সিডুরিকে বললেন, “আমি কীভাবে চুপ করে বসে থাকতে পারি, কীভাবেই বা বিশ্রাম নিতে পারিএন কিডু যাকে আমি ভাইয়ের মত ভালবাসতাম সে আজ ধুলিকনায় পরিণত হয়েছে। একদিন আমিও মরে যাব এবং এই পৃথিবীর মাটিতে মিশে যাব। হে যুবতী তুমি সমুদ্রের তীরে বাস কর এবং এর অন্তঃস্থলের কথাও তোমার জানা । অনুগ্রহ করে আমাকে বল, উবারা-টুটুর পুত্র উত্নাপিসতিম বাবার কাছে কোন পথে যাওয়া যায়?  দয়া করে  দিকনির্দেশ  কর । প্রয়োজন হলে আমি মহাসাগর অতিক্রম করবতাতেও যদি  কাজ না হয়
আমি দূর দূরান্তের প্রান্তরে বিচরণ করব ।”
দ্রাক্ষারস প্রস্তুতকারীনী গিলগামেশকে  বলল, “ হে গিলগামেশ,  এই মহাসাগর পার করা যায়না ।  সেই প্রাচীন সময় থেকে আজ অবধি যারাই এ জগতে এসেছে তারা কেউই  ওই সমুদ্র অতিক্রম করতে সক্ষম হয়নি  গৌরবময় সূর্য মহাসাগর অতিক্রম করে, কিন্তু মহান শামাশ ছাড়া আর কেই বা এমন কাজ করতে সক্ষম?  ওই স্থান ও পথ বড়ই কঠিনওখানে যে জল বয়ে চলেছে তা মৃত্যুসম  গভীর    গিলগামেশ, আপনি কীভাবে পার হবেন ওই মহাসাগর? মৃত্যু সম জলের বিরুদ্ধে তুমি  কী করবে? তার চেয়ে, হে গিলগামেশ,  আপনি নীচে অরণ্যে চলে যান ।  ওখানে দেখা পাবেন উত্নাপিসতিমের নৌকার চালক উর্শানবীর। তার কাছে আছে পাথরের পবিত্র জিনিস যার নৌকার সম্মুখভাগ সাপের মত। তার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করুন।  যদি  সম্ভব হয় তবেই   আপনি তার সাথে এই জলরাশি পার হতে পারবেন কিন্তু যদি তা   সম্ভব না হয় তবে আপনাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।”
এই কথা শুনে  গিলগামেশের মনে  ক্রোধের সঞ্চার হল।   হাতে তুলে নিলেন কুড়ুল কোমরবন্ধনী থেকে চাকু।   নিচু হয়ে বসে ওগুলো ছূঁড়ে দিলেন বর্শা নিক্ষেপ করার মত করে। তারপর অরন্যে গিয়ে উপবেশন করলেন। উর্শানবী  দেখতে পেলেন চাকু ভেসে যাওয়ার ঝলক এবং শুনতে পেলেন কুড়ুল পতনের শব্দ ।  গিলগামেশের ছোঁড়া অস্ত্রের আঘাত করল উর্শানবীর নৌকায়   ভেঙে গেল তার হাল সহ   কাঠামোর নানা স্থান  উর্শানবী নিজের কপালে আঘাত করে জানতে চাইলেন, “ হে আগন্তুক তোমার নাম কী? আমি উর্শানবী, স্বর্গে সশরীরে যাওয়া উত্নাপিস্টিমের নৌকার চালক।”
'গিলগামেশ আমার নামআমি, আনুর বাসগৃহ উরুক নিবাসী ।”
উর্শানবী এবার জানতে চাইলেন, “ তোমার মুখাবয়ব এমন শুকনো কেন? দেখে মনে হচ্ছে তুমি অনাহারে আছ।  তোমার হৃদয়ে হতাশা   এবং  মুখে  দীর্ঘ পথযাত্রার ছাপ হ্যাঁ,  একদমই তাই। তোমার মুখ শীত ও গ্রীষ্মের আঘাত সহ্য করেছে। মনে হচ্ছে সজীব বাতাসের খোঁজে তুমি বিস্তীর্ণ প্রান্তর পার করে এখানে এসেছ। কেন?” 
গিলগামেশ তাকে বলেছিলেন, কেনই বা আমার মুখাবয়বে অনাহার এবং ক্লান্তির ছাপ পড়বে না  ?  হতাশাগ্রস্থ হৃদয়ে আমি যে এক দীর্ঘ পথ পার করে এখানে এসেছি। শীত আর গ্রীষ্মের আক্রমণ সহ্য করেছি।  কেনই বা আমি তার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাতাসের সন্ধান করব না?   আমার বন্ধু, আমার ছোট ভাই,  যে বনাঞ্চলে বুনো গাধা এবং সমতলভূমির প্যান্থার শিকার করত যে স্বর্গের ষাঁড়কে চেপে ধরেছিল যাতে ওই পশুকে আমি হত্যা করতে পারি।    সিডার  অরণ্য থেকে হুম বাবাকে বিতারীত করতেও সেই আমার পাশে ছিল।  আমার সেই প্রিয় বন্ধু  সব সময় আমার পাশে দাঁড়িয়ে বিপদের মোকাবিলা  করেছিল এনকিডু আমার ভাই, আমি যাকে ভালোবাসি, মৃত্যুর  তাকে কেড়ে নিয়ে গেছে আমার কাছ থেকেআমি তার জন্য সাত দিন এবং সাত রাত  তার মৃতদেহের পাশে বসে কেঁদেছি , যতক্ষন না কীটেরা তার দেহ আক্রমণ করেছে।  আমার ভাইয়ের এই পরিণতির কারণেই আজ আমি ভীত মৃত্যু সম্পর্কে। তার ভাগ্যর বিড়ম্বনা আমার উপর অতিমাত্রায় তার প্রভাব বিস্তার করছে।  আমি কীভাবে চুপ করে থাকতে পারি, কীভাবেই বা আমি   বিশ্রাম নিতে পারি? সে ধূলোয় পরিণত হয়েছে এবং আমিও মরে যাব তারপর   চিরকালের জন্য পৃথিবীর মাটির সাথে মিশে যাব।  আমি মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছি। আর সেজন্যই, হে উর্শানবী, আমাকে বলুন উত্নাপিসতিম বাবার কাছে যাওয়ার রাস্তা কোনটি? যদি সম্ভব হয় আমি মৃত্যুসম জল রাশি অতিক্রম করব যদি তা সম্ভব না হয় তবে আমি আরও অজানা প্রান্তর ভ্রমণ করব ।”
উর্শানবী তাকে বললেন, 'গিলগামেশ, তোমার নিজের হাতই তোমাকে আটকে দিল এই মহাসাগর পার হয়ে যাওয়া থেকে। তুমি যখন নৌকোর হাল ও পাল সহ   কাঠামোটিকে ভেঙে দিলে তখন ওটা আর নি্রাপদ রইল না।”  
এরপর দু'জনে অনেক আলাপ আলোচনা করলেন। একসময়   গিলগামেশ বললেন, “ আপনি আমার ওপর এতো রেগে যাচ্ছেন কেন ? আপনি তো দিনের যে কোনো সময়ে বা রাতে, যে কোন ঋতুতে পারাপার করেন।”
  'গিলগামেশ, তুমি যে জিনিস ধ্বংস করেছ, সেটাই আমাকে সাহায্য করত এই জলের ওপর দিয়ে ভেসে যেতে। ওটার কারনেই এই মৃত্যু সম জল আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।   এই কারণেই আমি ওটাকে সযত্নে রক্ষা করতাম। কিন্তু, এখন তুমি ওটা ভেঙে নষ্ট করে দিয়েছ।   যা নিয়ে গিয়েছে উড়নুর সাপেরা এখন, হে গিলগামেশ  একটাই পথ। অরন্যে  যাওনিজের কুড়ূল দিয়ে একশো কুড়িটা খুঁটি কেটে নিয়ে এসো সবগুলো যেন ষাট হাত লম্বা হয়। ওদের গায়ে মাখাও বিশেষ তৈলাক্ত পদার্থ। ওগুলোর ওপর লোহার পাত লাগাও এবং আমার কাছে নিয়ে এসো।”     
গিলগামেশ এই কথা শুনে অরন্যে গেলেন এবং উর্শানবীর কথা মত   একশো কুড়িটা খুঁটি কাটলেন । তারপর নির্দেশ মেনে সব কিছু করলেন এবং ফিরে এলেন। নতুন করে নির্মাণ হল নৌকা।
গিলগামেশ এবং উর্শানবী  নৌকায় উঠলেনশুরু করলেন তাদের যাত্রা মহাসাগরের তরঙ্গ ঠেলে । তিন দিনে তারা এক মাস পনের দিনের যাত্রাপথ পার করলেন।  
অবশেষে উর্শানবী তার নৌকাকে  উপস্থিত করালেন মৃত্যু সম জলরাশির নিকটে।  তারপর   গিলগামেশকে বললেন, “ একটা খুঁটি উঠিয়ে নাও। ওটাকে ঠেলে দাও জলের ভেতর। সাবধানে   হাতে যেন জলের স্পর্শ না লাগে।”   গিলগামেশ,  এভাবে একটা একটা করে খুঁটি পুঁততে ত্থাকো।   দ্বিতীয়। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম... দ্বাদশ। ”
 এভাবে  গিলগামেশ একশো উনিশটি খুঁটি পুঁতলেন।  একশো বিশতম খুঁটিটা গিলগামেশের হাত থেকে  ছিনিয়ে নিলেন উর্শানবী। ওটা্কেই   নৌকার মাস্তুল করা হল এবং খাটানো হল পাল । ,   এভাবেই নৌকাচালক উর্শানবী মহান গিলগামেশকে  উত্নাপিসতিম বাবার কাছে নিয়ে গেলেন।  সেই স্থান যাকে সবাই  অগম্য  বলে থাকে।   যিনি পাহাড়ের পূর্ব দিকে সূর্যের অবস্থান ভুমি  দিলমানে বাস করেন।   একমাত্র তাকেই দেবতারা অনন্ত জীবন দান করেছেন।
 উত্নাপিসতিম নিশ্চিন্ত মনে সেই স্থানে শুয়ে ছিলেন। সহসাই   তিনি দেখতে পেলেন দূর থেকে একটা নৌকা আসছে।  নিজের মনে বললেন, “ অদ্ভুত ব্যাপার,  নৌকাটি প্রকৃত হাল এবং মাস্তুল ছাড়াই এই পথে কেন  যাত্রা করেছে? পবিত্র পাথরগুলোই বা ধ্বংস করল কে?  কেন নৌকার মালিক ওই নৌকায় নেই? যে ব্যক্তি ওই নৌকায় আসছে সে তো আমার কেউ নয়!   আমি   এমন একজনকে দেখতে পাচ্ছি যার দেহ পশুর চামড়া দিয়ে ঢাকা রয়েছেকে এই অচেনা মানুষ যে উর্শানবীর পিছন পিছন তীরে অবতরন করল?  এ তো আমার চেনা  কোনও মানুষ নয়!
অতএব উত্নাপিসতিম  গিলগামেশের দিকে তাকিয়ে বললেন,  “ পশুর চামড়া পরিহিত হে মানব সন্তান, কে তুমি? কী তোমার নাম?  তোমার মুখাবয়ব এরকম কেন? মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা জানার জন্য অতি ব্যগ্র?    কি কারণে তুমি এই অসম্ভব যাত্রা পথ পার করেছ? সেই উত্তাল উদ্দাম, সমুদ্র পার হয়ে এসেছ যা অতি  কঠিন? আমাকে বলো,  তোমার এখানে আসার কারণ কী? '
  “গিলগামেশ আমার নাম। আমি আনুর আবাস উরুক  থেকে এসেছি।”
এ কথা শুনে উত্নাপিসতিম বললেন, “ তুমি যদি   গিলগামেশই হবে  তাহলে তোমার মুখে ও শরীরে ক্ষুধা ও ক্লান্তির ছাপ কেন?  হতাশা কেন তোমার হৃদয়ে?  কেনই বা তোমার মুখ এমন একজনের মুখের মতো যে দীর্ঘ পথ যাত্রা করেছে?  কেনই বা তোমার মুখাবয়ব   গরম এবং ঠান্ডার প্রভাবে কুঁচকে গিয়েছে? কেনই বা তুমি একাধিক চারণভূমি পার করে এখানে এসেছেন  বাতাসের সন্ধানে?
গিলগামেশ তাকে বললেন, কেনই বা আমার মুখাবয়বে অনাহার এবং ক্লান্তির ছাপ পড়বে না  ?  হতাশাগ্রস্থ হৃদয়ে আমি যে এক দীর্ঘ পথ পার করে এখানে এসেছি। শীত আর গ্রীষ্মের আক্রমণ সহ্য করেছি।  কেনই বা আমি চারন ভুমিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াব না?  আমার বন্ধু, আমার ছোট ভাই  যে স্বর্গের ষাঁড়কে পাকড়াও করেছিলওই পশুকে  হত্যায় সহায়তা করেছিল। সিডার  অরণ্য থেকে হুম বাবাকে বিতাড়িত করেছিল। প্রিয় বন্ধু  যে সব সময় আমার পাশে দাঁড়িয়ে বিপদের মোকাবিলা  করেছিল এনকিডু আমার ভাই, আমি যাকে ভালোবাসতাম, মৃত্যুর গ্রাস  তাকে কেড়ে নিয়ে গেছে আমার কাছ থেকেআমি তার জন্য সাত দিন এবং সাত রাত  তার মৃতদেহের পাশে বসে কেঁদেছি , যতক্ষন না কীটেরা তার দেহ আক্রমণ করেছে।  আমার ভাইয়ের এই পরিণতির কারণেই আজ আমি  মৃত্যু সম্পর্কে ভীত আমার ভাইয়ের জন্যই আমি পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তার ভাগ্যর বিড়ম্বনা আমার উপর পাষানের মতো চেপে বসেছে   আমি কীভাবে চুপ করে থাকতে পারি, কীভাবেই বা আমি   বিশ্রাম নিতে পারি? সে ধূলোয় পরিণত হয়েছে এবং আমিও মরে যাব তারপর   চিরকালের জন্য পৃথিবীর মাটির সাথে মিশে যাব।”
তারপর আবার গিলগামেশ, উত্নাপিসতিমকে বললেন, “সেই উত্নাপিসতিমের সাথে দেখা করা জন্যই আমি এই পথ পার করে এসেছি, যাকে সবাই বলে অগম্য স্থানে যাওয়া একমাত্র মানুষ।   এর জন্য আমি বিশ্ব ভ্রমণ করেছি,  পার করেছি অনেক দুর্গম স্থান,  পার হয়েছি সমুদ্রপথচলায়    ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।  আমার শরীরের গাঁটে গাঁতে  ব্যথা হচ্ছে সব সময়। সেই নিশ্চিন্ত মিষ্টি   ঘুমের সাথে আমার দেখা হয়নি কত কাল।     সিডুরির  ভবনে প্রবেশের আগেই আমার পোশাক আশাক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।   আমি ভাল্লুক এবং হায়েনা, সিংহ এবং প্যান্থার, বাঘ, বলগা হরিণ এবং পাহারি ছাগল  শিকার করেছি । এছাড়াও হত্যা করেছি চারণভূমির সমস্ত রকম ছোটখাট প্রানীদের ।  তাদের মাংস খেয়েছি এবং তাদের চামড়া চাপিয়েছি নিজের শরীরে। এভাবেই আমি সেই  দ্রাক্ষারস নির্মান কারিণী যুবতীর ভবনের দ্বারে    উপস্থিত হয়েছিলাম।  যে তার দ্বার বন্ধ করে দিয়েছিল আমার মুখের ওপর।  তবু তার কাছ থেকেই আমি সংগ্রহ করেছিলাম এই   ভ্রমণের কথা।    উপস্থিত হয়েছিলাম নৌকাচালক উর্শানবীর কাছে ।  তার সাহায্যেই আমি মৃত্যু সম জল রাশি পার করতে পেরেছি। হে উত্নাপিস তিম বাবা   আপনিই সেইজন যিনি সশরীরে   দেবতাদের সমাবেশে প্রবেশ করতে পেরেছেন আমি  জীবিত ও মৃতদের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন    জিজ্ঞাসা করতে চাই। জানতে চাই সেই অনন্ত জীবনের সন্ধান!    
উত্নাপিস তিম বললেন, “ কোনও কিছুর   স্থায়িত্ব বলে কিছু নেই। আমরা কী এমন ভবন নির্মাণ করতে পারি যা  চিরকাল খাড়া থাকবে? এমন কোন চুক্তি করা যায় কী যা ওটাকে খাড়া করে রাখবে?   ভাইদের ভেতর  নিজস্বতা চিরকাল ব্জায় রাখার জন্য  উত্তরাধিকার ভাগ করে নেওয়া হয় কী?   নদীর বন্যার যে নির্দিষ্ট সময় তাকে আটকানো যায় কি?     জল ফড়িংয়ের কন্যারা তাদের লার্ভাই কেবল রেখে পারে যা  সূর্যর গৌরব দেখার সুযোগ পায়।   সেই প্রাচীন কাল থেকেই কোনো কিছুরই  স্থায়িত্ব নেইঘুমন্ত ও মৃত, এদের ভেতর মিল কোথায়? প্রথম টা মৃত্যুর ছবি আঁকার মতো ওস্তাদ এবং শিষ্যর ভেতর পার্থক্য কিসের, যখন তারা দুজনেই একই  নিয়তির দাস?   আনুনাকি, বিচারকরা এবং  নিয়তির মাতা ম্যামমেতুন একসাথে বসে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন।   জীবন ও মৃত্যু তারা বরাদ্দ করেনকিন্তু  মৃত্যু কবে হবে সেটা    প্রকাশ করেন না।”
তখন গিলগামেশ  অগম্য স্থানে বসবাসকারী উত্নাপিসিতিম বাবাকে বল লেন,  “ আমি আপনাকে এই মাত্র ভালো করে অবলোকন করলাম। দেখতে পাচ্ছি   আপনার এবং আমার  চেহারা  আলাদা নয় আপনার মধ্যে অদ্ভুত কোন বৈশিষ্ট্য কিছু নেই আমি ভেবেছিলাম, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নায়কের মতো আপনাকে দেখতে লাগবে। কিনু আপনি তো দেখছি এখানে আরামে শুয়ে আছেন।  আমাকে শুধু বলুন, আপনি কীভাবে দেবতাদের এলাকায় প্রবেশ করতে পেরেছিলেন এবং কিভাবে  চিরজীবনের অধিকারী হয়েছেন?
উত্নাপিসতিম গিলগামেশকে বললেন, “আমি তোমার কাছে একটি রহস্য প্রকাশ করবতোমায় জানাব দেবতাদের একটি গোপন কথা ।”


মহাপ্লাবনের  বৃত্তান্ত

ইউফ্রেতিস নদীর তীরে অবস্থিত শূড়ুপাক নগরের কথা শুনেছ কী ? সেই নগরের অনেক বয়েস সেখানকার দেবতারাও ছিলেন অতি প্রাচীন  সকলের পিতা আগুনের অধিকর্তা  আনু সেখানেই বসবাস করতেন ছিলেন পরামর্শদাতা যোদ্ধা এনলিল  সাহায্যকারী নিনুর্তা এবং  খালবিলের পর্যবেক্ষক এন্নুগিও থাকতেন সেখানে আর ছিলেন ইয়া   এই সেই সময় যখন  পৃথিবী ছড়িয়ে পড়ছিল দিকে দিগন্তে  মানুষের সংখ্যা বাড়ছিল বহুগুণে   বুনো ষাঁড়ের মতো গোটা জগত ছটফট করছিল প্রানোচ্ছাসে    মহান ঈশ্বর সদাপ্রভুর বিশ্রামের মৌতাত ভঙ্গ হল তার শব্দ কলরবে এনলিল এই কোলাহল শুনে  দেবতাদের পরিষদে বললেন, " অত্যন্ত হৈ চৈ হচ্ছে! মানবজাতির এই আচরণ অসহনীয়  এই কলরবের কারণে ঠিক মতো ঘুমই হচ্ছে না "
অতএব মানবজাতিকে নির্মূল করা দরকার । দেবতারা সিদ্ধান্ত নিলেন এনলিল এই কাজ করেছিলেন তবে ইয়া তার বিশেষ শপথের কারণে স্বপ্নের দ্বারা আমাকে এ বিষয়ে  সতর্ক করে দেন আমার নলখাগড়া নির্মিত ঘরের ভেতর   তিনি তাদের গোপন কথাটি আমাকে   ফিসফিস করে জানিয়ে দেন   
" নলখাগড়ার ঘর, নলখাগড়ার ঘরঘরের প্রতিটা দেওয়াল শোনো, এই কথা প্রতিধ্বনিত করো ওহে শূড়ুপাকের উবারা-টুটুর পুত্র, নিজের এই ঘর ভেঙে ফেলে একটা নৌকা তৈরি করো  সব জাগতিক সম্পত্তি ত্যাগ করে এবং জীবন বাঁচানোর পথ সন্ধান করো   পার্থিব জিনিসকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আপন আত্মাকে বাঁচাও আবার বলছি এই ভবন ভেঙে ফেলে একটা নৌকা নির্মান করো শুনে নাও ভালো করে এর পরিমাপ এই ভাবেই তুমি  ওটাকে গড়ে তুলবে  নৌকার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যেন সমান হয় নৌকার পাটাতন এমনভাবে নির্মাণ করবে যেন তা শক্ত পোক্ত সিন্দুকের মত কাজ করে যেন তা সহ্য করতে পারে  অতল জলরাশির আঘাত  তারপর সমস্ত প্রাণীর বীজ সংগ্রহ করে রাখো সেই নৌকায়”   
যখন আমি তাঁর সব আদেশ বুঝতে পেরেছিলাম তখন আমি আমার প্রভুকে বলেছিলাম, ' হে, পূজ্য আপনি যা আদেশ করেলেন আমি তা যথাযথ ভাবে সম্মান সহ যোগে   সম্পাদন করব কিন্তু কেন এই কাজ করছি, তার উত্তর  আমি কীভাবে এই নগরের অন্য মানুষদের এবং প্রবীণদের  দেব? "
ইয়া  আমাকে, তার অনুগত পরিচারককে বললেন,   "তাদের এটাই বলবে,  আমি জানতে পেরেছি এনলিল আমার ওপর খুব রেগে গেছেন আমি  কতাঁর এলাকায়   বা তাঁর শহরে থাকতে সাহস পাচ্ছি না  আমি আমার প্রভু ইয়ার সাথে বসবাস করার জন্য উপসাগরীয় এলাকায় চলে যাব তোমার উপর বর্ষিত হবে হিসাববিহীন বৃষ্টি ফসল ভালো হয় এমন জোয়ার ধেয়ে আসবে সাথেই আসবে বিরল মাছের দল এবং  লুকিয়ে থাকা  বন্য পাখিরা  সন্ধ্যায় ঝড়ের দুত নিয়ে আসবে সাংঘাতিক ঘুর্নি ঝড়’”
 “পরের দিন ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই আমার পরিবারের সবাই আমার চারপাশে জড়ো হয়েছিল  শিশুরা প্রাকৃতিক তৈলাক্ত বস্তু সংগ্রহ করে আনছিল আর বাকি পুরুষেরা সংগ্রহ করে আনছিল নৌকা বানাতে যা যা প্রয়োজন সেই সব কিছু   পঞ্চম দিনে আমি যত দ্রুত সম্ভব নৌকার কাঠামো নির্মাণ শুরু করলাম নৌকার মূল বিচরণ ক্ষেত্রর মাপ রাখলাম  কএক একর  প্রতিটি দিকে পাটাতন রাখা হল  একশো কুড়ি হাত পুরোটাই বর্গ ক্ষেত্র আকারে সাজালাম সব শুদ্ধ সাতটি তল নির্মাণ করলাম প্রতি তলকে আবার  নয়টি করে ভাগে  বিভক্ত করে দিয়েছিলাম শক্ত পোক্ত করার জন্য যতটা কাঠ লাগানো দরকার সেটাই করেছিলাম ঠিক ঠাক ভাবে স্থাপন করেছিলাম একাধিক  খুঁটি এরপর পুরো নৌকার সব জায়গায় প্রাকৃতিক তৈলাক্ত পদার্থ [পিচ, বিটুমেন জাতীয় বস্তু অনুবাদক] গরম করে লাগিয়ে দিয়েছিলাম জল নিরোধক করার জন্য এই কাজ করার জন্য যারা আমাকে সাহায্য করছিল, তাদের জন্য প্রতিদিন আমি নববর্ষের সময় যেমন ভোজসভা হত ঠিক তেমন ভোজের ব্যবস্থা করেছিলাম  প্রত্যহ ষাঁড় জবাই করেছি এবং প্রতিদিন   মেষ হত্যা করেছি নদীর জলের মতই ওদের জন্য সরবরাহ করেছিলাম নানা ধরণের উৎকৃষ্ট মদ     
সপ্তম দিনে নৌকোটি সম্পূর্ণরূপে নির্মাণ হওয়ার পর আমি নিজেই আমার মাথায় অভিষেক বারি সিঞ্চন করলাম” 
এরপরে ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ ওটাকে জলে ভাসানো   দুই তৃতীয়াংশ নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল জলের ভেতরে নানা স্থানে একাধিক রকমের ওজন স্থাপন করে ওটাকে সোজা রাখতে হয়েছিল আমাকে নৌকায় আমার  সমস্ত সোনাদানা  এবং জীবিত  প্রানীদের উঠিয়ে নিলাম   আমার পরিবার, আমার আত্মীয়, বন্য এবং পোষা সবরকম জীবজন্তু স্থান পেল সেখানেসাথেই রইল সেই কারিগরেরাও যারা এই নৌকা নির্মান করেছে এই সব কাজ করতে করতেই এসে গেল সেই সময় যখন মহান শামাশ তার আদেশ ঘোষনা করলেন   
   ‘সন্ধ্যাবেলায়, যখন ঝড়ের নিয়ন্ত্রক তার ধ্বংসাত্বক বৃষ্টি প্রবাহিত করবেন তখন ওই নৌকা যেন প্রস্তুত থাকে ভেসে যাওয়া জন্য
সময়টি এসে গেল সন্ধ্যা হয়ে এল, ঝড়ের সওয়ার বৃষ্টি নিয়ে নেমে এলেন   আমি সেই ভয়ানক আবহাওয়ার দিকে তাকিয়ে তার বীভৎসতা অনুভব করলামসময় নষ্ট না করে  নৌকার সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকলাম ভেসে যাওয়ার সম্পূর্ণ রূপে প্রস্তুত ছিলাম আমি নৌকার নিয়ন্ত্রন দন্ড তুলে দিলাম নৌকা চালক পুজুর-আমুররির হাতে  এবার নৌকাটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া ও রক্ষা করার দায়িত্ব ওর    
পরের দিন ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই   দিগন্ত থেকে একটা কালো মেঘ ভেসে এসেছিল যার ওপর অবস্থান করে ছিলেন ঝড়ের দেবতা আডাড সাথে নিয়ে এসেছিলেন মুহুর্মুহু বজ্রপাত    শুল্লাত এবং হানিশের সামনের পাহাড় এবং সমতলভুমির ওপর দিয়ে বয়ে গেল  ঝড়ের তান্ডব অতঃপর অতল গহ্বরের দেবতারা উত্থিত হলেন নারগাল উঠিয়ে আনলেন পাতালের জল প্রবাহ যুদ্ধের দেবতা নিনার্তা তছনছ করে দিলেন সমস্ত বাঁধ নরকের সাত বিচারক এবং আনুনাকি আগুনে অস্ত্র নিক্ষেপ করে আগুন লাগিয়ে দিলেন  জমিতে লেলিহান অগ্নিশিখা গ্রাস করতে থাকল সমস্ত কিছুকে যখন ঝড়ের দেবতা দিনের আলোকে রাতের অন্ধকারে পরিণত করলেন তখন হাহাকারের স্রোত পৌছে গেল স্বর্গের সীমানায় জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেল  ঠুনকো কাপের মতো একটা গোটা  দিন এই প্রচণ্ড ক্রোধের দাপট বিরাজ করল পৃথিবীর ওপর অভাবনীয়   জোয়ারের স্রোত বয়ে গেল সকলের ওপর দিয়েআশে পাশে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না   স্বর্গ থেকেও দেখা যাচ্ছিল না কোন মানুষকে  এমন কি স্বয়ং দেবতারাও এই বন্যার রুপ এবং আনুর আগুনের বীভৎসতা দেখে আতঙ্কিত হয়ে নিজেরাও  পালিয়ে গেলেন স্বর্গের সর্বোচ্চ স্তরে   দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে তারাও কাঁপছিলেন ঠক ঠক করে 
“এরপরেই শোনা গেল মিষ্টি-কণ্ঠস্বরের অধিকারিনী স্বর্গের রাণী ইস্থারের চিৎকার যা একজন সন্তান প্রসবকারী  মহিলার আর্তনাদের মতোই মনে হয়েছিল উনি বলে উঠলেন, ‘ হায় ! সেই সব পুরোনো দিন আজ স্মৃতির ধুলায় মিশে গেল কারণ আমিই এই অভিশাপকে ডেকে এনেছিলাম কেন যে আমি দেবতাদের পরিষদে এই বিনাশকে আগমনের  আদেশ দিয়েছিলাম ?  আমি মানুষদের ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধের আদেশ দিয়ে ছিলাম, কিন্তু তারা কি আমার সন্তান সম নয়?  কারণ আমিই তো ওদের এ জগতে আসার কারন   এখন তারা মাছের ডিমের মতো সাগরের জলে ভাসমান
স্বর্গ ও নরকের মহান দেবতারা এবার কেঁদে ফেললেন ঢাকলেন নিজেদের মুখ
ছয় দিন এবং ছয় রাতে ধরে চলল সেই ঝড়ের প্রবাহ এবং  বর্ষণ তাল মিলিয়ে সারা বিশ্বকে হতচকিত করে স্থায়ী হল বন্যা  ঝড় ও বন্যার মিলিত তান্ডবে সব ছারখার হয়ে গেল   
সপ্তম দিনের সুচনায় দক্ষিণ দিক থেকে কমে এল ঝড়ের তান্ডব    সমুদ্র শান্ত হল
বন্যার পরিমাণ আর বাড়ল না  আমি চারদিকে নিরীক্ষণ করলাম  থম থমে নীরবতা বিরাজ করছিল সেখানে  সমস্ত মানবজাতি তখন মিশে গেছে মাটিতে  সমুদ্রের উপরিতল কে দেখে মনে হচ্ছে সমতল জমি আমি একটা অলিন্দের ঢাকনা উন্মোচন করলাম আলো এসে পড়ল আমার মুখের উপর     আমি নীচু হয়ে বসে  কেঁদেছিলাম অঝোর ধারায় অশ্রু আমার মুখ বেয়ে নেমে গেল শরীরে
চারদিকে শুধুই জল আর জল  আমি শুকনো জমি খুঁজছিলাম কিন্তু সে অন্বেষন ছিল নিরর্থক এরপর প্রায়   চৌদ্দ লিগ দূরে  একটি পর্বত দেখতে পেলাম নিসির ছিল তার নাম সেখানেই    নৌকা বাঁধলাম   এরপর এক এক করে কেটে গেল ছয় দিন বন্যার জলে ভেসেই রইলাম আমরা  সপ্তম  দিনের আলো ফুটে উঠতেই আমি একটি পায়রা ছেড়ে দিলাম আকাশে সে ফিরে এসেছিল কারন থাকার মত কোনো  জায়গা সে বেচারি খুঁজে পায়নি 
এরপর আমি সোয়ালো পাখিকেও  ছেড়ে দিলাম কিন্তু সেও একসময় ফিরে এল পায়রাটার মতোই  এবার আমি একটা কাক ছেড়ে দিলাম সে লক্ষ্য করেছিল জল কমছে ভেতর থেকে উঠে আসছে খাদ্য সে আর ফিরে আসেনি   
এবার আমি নৌকার চারদিকের আবরণ উন্মোচন করে দিয়েছিলাম   টাটকা বাতাস উপভোগ  করেছিল আমার নৌকার আরোহীরা পর্বত শীর্ষদেশে এবার একটি পশু বলি দিয়ে তার মাংস উত্সর্গ করলাম যজ্ঞের আগুনে   সাতের ওপর সাত এই ভাবে চৌদ্দটি হাঁড়িতে সেই মাংস রান্নার আয়োজন করলাম কিছুক্ষন বাদের তার  সুমিষ্ট  গন্ধ পেয়েই দেবতারা মক্ষিকার মত হাজির হলেন সেখানে  সবার শেষে এলেন ইস্থার  তার কন্ঠে ছিল সেই বিশেষ রত্নহার যা তাকে বানিয়ে দিয়েছিলেন আনু সেই মরকত মনি নির্মিত রত্নহার উঁচু করে তুলে ধরে দেবী ইস্থার বললেন, ‘হে উপস্থিত দেবতা গন আমার এই রত্নহারের দিব্যি আমি চিরকাল সেই সমস্ত দিনগুলোকে মনে রাখব যেমন ভাবে এই আভরণকে মনে রাখি শেষের এই কটা দিন আমি কখনোই ভুলতে পারবো না হে দেবতাগন, আসুন আমরা এই উৎসর্গ করা ভোগ গ্রহণ করি কিন্তু এনলিল এর স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ পাবে না কারন সে ভবিষ্যত চিন্তা না করেই এই  বন্যা আনয়ন করেছিল ওর কারনেই আমার সন্তান সম মানুষেরা আজ  লোকদের ধ্বংস হয়ে গেছে’  
এরপর যখন এনলিল আমাদের নৌকাটি দেখলেন, তখন তিনি রেগে গেলেন এবং গর্জে উঠলেন স্বর্গের   দেবদেবীদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, "বিশ্বের সব প্রাণীতো ধ্বংস হয়নি মনে হচ্ছে! কিছু নশ্বর প্রাণী কি পালাতে সক্ষম হয়েছে ? এই মহা ধ্বংসর হাত থেকে কারোর বাঁচার অধিকার নেই
"তখন   খালবিলের দেবতা নিনার্তা মুখ খুললেন এবং যোদ্ধা এনলিলকে বললেন, "  দেবতাদের মধ্যে এমন  কে আছে যে ইয়াকে বাদ দিয়ে  পরিকল্পনা   করতে পারে ? ইয়াই একমাত্র দেবতা যে  সমস্ত কিছু জানে’  
'তখন ইয়া যোদ্ধা এনলিলকে উদ্দেশ্য করে বল লেন, ‘দেবদেবীদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান, হে নায়ক এনলিল, আপনি কি ভাবে এরকম ভাবনাচিন্তা বিহিন একটা বন্যার সৃষ্টি করলেন?   
পাপীর ওপর তার পাপের চাপ ন্যস্ত কর,
সীমালংঘনকারীকে তার সীমালংঘনের চাপ অনুভব করাও  ,
যখন সে দোষ করে  তাকে সামান্য শাস্তি দাও,
তাকে এমন কোনও শাস্তি দিও না যাতে  সে মারা যায়;
সিংহ পাঠাও   মানব জাতিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য  ! বন্যা নয়
ভয়ানক বন্যার বদলে, নেকড়ে  পাঠাও মানবজাতিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য  
দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি কর যা  বিশ্বকে তছনছ করে দিক,   কিন্তু বিধ্বংসী বন্যা নয় 
 মহামারীও ভালো মানবজাতিকে শাস্তি দিতেকিন্তু বন্যা নয়
আমি দেবতাদের গোপন কথা প্রকাশ করিনি ওই জ্ঞানী মানুষ এর কথা জেনেছিল  স্বপ্ন দেখে এবার নিজেরাই  পরামর্শ  করুন, তার সাথে কি করা হবে’  
 এরপরে এননিল নৌকায় উঠে এলেন   আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে নিয়ে প্রবেশ করলেন নৌকার অভ্যন্তরে    নিজে মাঝে দাঁড়িয়ে  দু'পাশে হাঁটু গেড়ে বসালেন আমাদের 
আমাদের কপাল ছুঁয়ে  র আশীর্বাদ করে বললেন, " যে অতীত বিনষ্ট হল সে সময়ে উত্নাপিসতিম একজন নশ্বর মানুষ ছিল  এখন থেকে সে এবং তার স্ত্রী জীবন নদীর তীরে এক বিশেষ অগম্য স্থানে  বাস করবে "
এভাবেই দেবতারা আমাকে নিয়ে এসেছিলেন এই স্থানে সুযোগ দিয়েছেন বসবাস করার জীবন নদীর মুখের কাছে এই অগম্য স্থানে”   


ষষ্ঠ অধ্যায়
প্রত্যাবর্তন
উতনাপিসতিম বললেন, “ হে গিলগামেশ, তুমি যে অনন্ত জীবনের  সন্ধান করতে এসেছ  তার স্বার্থে কে  তোমার জন্য তিনি দেবতাদের একত্রিত করবে? তবে তুমি যদি চাও, এসো   একটা পরীক্ষা করে দেখো  কেবলমাত্র ছয় দিন এবং সাত রাত না ঘুমিয়ে থেকে দেখাও ”    
গিলগামেশ পরীক্ষা দিতে রাজি হলেন কিন্তু  বসে থাকতে থাকতেই  তার চোখে ও শরীরে  নরম পশমের মতো ঘুমের আবেশ ছেয়ে গেল  গিল গামেশ ঘুমিয়ে পড়লেন এটা দেখে  উতনাপিসতিম তার স্ত্রীকে বললেন, “ওকে দেখো, সেই শক্তিশালী মানুষ, যে অনন্তজীবন লাভের সন্ধান করতে বসেছিল তার ওপর এখন মহা ঘুমের চাদর চেপে বসেছে
 তার স্ত্রী উত্তর দিলেন , “ওকে স্পর্শ করুন, জাগিয়ে তুলুন মানুষটিকে   যাতে সে শান্তিতে ফিরে যেতে পারে তার নিজের দেশে সেই প্রবেশপথ ও প্রবেশদ্বার পার হয়ে যেখান দিয়ে ও এখানে এসেছিল”   
উত না পিস তিম বাবা তার স্ত্রীকে বললেন, “ এই ধরণের   পুরুষেরা প্রতারণা করে  এমনকি সুযোগ পেলে সে তোমাকেও   প্রতারিত করার চেষ্টা করবেওর জন্য রুটি বানাও   প্রতিদিন একটা করে রুটি রেখে দাও ওর মাথার কাছে আর দেওয়ালের গায়ে দাগ দিয়ে দাও যাতে সে বুঝতে পারে কত দিন ঘুমিয়েছে”       
এভাবেই উত না পিস তিম বাবার স্ত্রী  প্রতিদিন একটি করে  রুটি   বানিয়ে গিল গামেশের মাথার কাছে রেখে দিচ্ছিলেন সাথেই প্রতিদিনের হিসাব মত দেওয়ালের গায়ে দাগো দিয়ে রাখতেন এভাবে একসময় প্রথম রুটিটা পাথরের মত শক্ত হল   দ্বিতীয় রুটি হয়ে গেল চামড়ার মতো  তৃতীয়টা থেকে গন্ধ ছাড়তে শুরু করল চতুর্থ রুটির ওপর জমলো ছত্রাক   পঞ্চমটি ফেটে ফেটে গেল   ষষ্ঠটি ভালোই  ছিল এবং সপ্তমটি তখন সবে তৈরি হচ্ছে
 এই সময়  উতনাপিস তিম গিল গামেশের শরীর স্পর্শ করলেন ঘুম ভেঙে গেল মহান গিল গামেশের    গিলগামেশ অগম্য স্থানের বাসিন্দা উত না পিস তিম বাবাকে  বললেন, “ আ্মার চোখটা একটু এঁটে এসেছিল তন্দ্রার ঘোর লেগেছিল মাত্র”    
জবাবে উত নাপিস তিম বললেন, “ তোমার মাথার কাছে থাকা ওই রুটিগুলো গুনে দেখো    কত দিন ঘুমিয়েছিলেন তা বুঝতে পারবে  কারণ দেখো প্রথম রুটিটা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে   দ্বিতীয় রুটি হয়ে গেছে চামড়ার মতো  তৃতীয়টা থেকে গন্ধ ছাড়ছে    চতুর্থ রুটির ওপর জমেছে ছত্রাক   পঞ্চমটি ফেটে গেছে   ষষ্ঠ রুটি  এখনো ভালোই আছে  আর সপ্তমটি যখন জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর সেঁকা হচ্ছে ঠিক তখন আমি তোমাকে স্পর্শ করে তোমার ঘুম ভাঙালাম
সব শুনে গিলগামেশ বললেন, “ হে উতনাপিস তিম বাবা ,  এখন আমি কি করব?
আমি কোথায় যাব? ইতিমধ্যেই রাতের চোরের মত  মৃত্যু আমার শরীর সম কক্ষে প্রবেশ করেছে  আমি যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই শুনতে পাচ্ছি মৃত্যুর পদ ধ্বনি
অতঃপর উতমাপিস তিম  নৌকাচালক   উর্শানবীকে বল লেন, “ এই কাজের সুত্রে দুর্ভোগ তোমার শুরু হল  এখন থেকে  উর্শানবী এই কাজ করে তুমি এই সাগর তটের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছ  এই সমুদ্র অতিক্রম করা তোমার উচিত হয়নি এখন যাও,  এই উপকূল থেকে তোমাকে বহিস্কার করা হল  এই যে মানুষটা যাকে তুমি নিজে পথ দেখিয়ে এখানে  এনেছিলে    যার দেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে যার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পশু চামড়ায়  আবৃত তাকে আগে অঙ্গ পরি স্খালনের স্থানে নিয়ে যাও সেখানে ও নিজের  লম্বা চুল জল দিয়ে ভালো করে  পরিষ্কার করবে তারপর গায়ে পরে থাকা পশু চর্ম ফেলে দেবে  সমুদ্র সেসব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে   দূরে   এর ফলে সক লে তার তার দেহের সৌন্দর্য দেখতে পাবে তার কপালে নতুন করে চক চক করবে নতুন সৌভাগ্য ফলক তাকে দেওয়া হবে কাপড় যাতে সে  তার নগ্নতা ঢাকতে পারে যতক্ষণ না সে তার নিজের শহরে পৌঁছে যায় এবং তার যাত্রা সমাপ্ত হয়, তত দিন ওই কাপড় কোনো ভাবেই মলিন হবে না  সব সময় ওগুলোকে  নতুনের মতো দেখাবে” 
উর্শানবী গিলগামেশকে নিয়ে গেলেন প্রক্ষালন স্থানে  পরিষ্কার জলে গিল গামেশ তার লম্বা চুল ধুয়ে ফেললেন ত্যাগ করলেন গায়ে পরে থাকা পশুচর্ম ভেসে চলে গেল সে সব সমুদ্রর জলে    তার শরীরের সৌন্দর্য প্রকাশিত হল   কপালে বাঁধা সম্মান চিহ্ন বোধক ফিতেটিও বদলালেন।    সাথেই নিজের  নগ্নতা ঢাকলেন সেই  পোশাক দিয়ে যা নিজের শহরে না পৌঁছানো পর্যন্ত নতুন পোশাকের মতোই দৃশ্য মান হয়ে থাকবে  এর দ্বারাই প্রমানিত হবে তার যাত্রা সম্পন্ন হয়েছে
অতঃপর গিলগামেশ এবং উর্শানবী পুনরায় নৌকোটিকে জলে ভাসালেন প্রস্তুত হলেন ফিরে যাওয়ার জন্য    তখন বাবা উতনাপিসতিমের স্ত্রী বললেন, “ গিলগামেশ কিছু একটা প্রাপ্তির উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছিল আজ সে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছে খালি হাতে হে উতনাপিসতিম, আপনি তাকে কিছুই কী দেবেন না, যা সে  নিজের দেশে নিয়ে ফিরে যাবে?”
 এই কথা শুনে গিলগামেশ একটি খুঁটি ধরে নৌকা থামালেন উতনাপিসতিম বললেন, “ হে গিলগামেশ, অনেক পরিশ্রম করে তুমি এখানে এসেছিলে কিছুই তো পেলে না  নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আমিই বা তোমাকে কী দেব? শোনো গিলগামেশ, আমি একটি গোপন বিষয় এবার তোমাকে জানাই    এটি দেবতাদের একটি রহস্য যা আমি তোমাকে বলতে চলেছি জলের নীচে এক বিশেষ ধরনের  উদ্ভিদ রয়েছে যার গায়ে   গোলাপ গাছের মত কাঁটায় ভরা যা ধরলেই তোমার  হাত ক্ষতবিক্ষত হবে কিন্তু তাতে ভয় না পেয়ে  যদি এটি তুমি ওটাকে নিতে সফল হও তাহলে ঘটবে এক আশ্চর্য ঘটনা ওই উদ্ভিদ একজন মানুষকে  হারানো যৌবন  ফিরিয়ে দিতে পারে
গিলগামেশ এই কথা শুনে সমুদ্র তীরে অবস্থিত বাঁধের দরজা খুললেন যাতে   মিষ্টি জলের স্রোত  তাকে গভীরতম জলের এলাকায় টেনে নিয়ে যেতে পারে নিজের পায়ে বাঁধলেন ভারী পাথর   তার টানে উনি পৌছে গেলেন  জলের নিচে অবস্থিত ভুমিতে  দেখতে পেলেন সেই উদ্ভিদটিকে কাঁটায় ভরা বিন্দু মাত্র দ্বিধা না করে চেপে ধরলেন সেই উদ্ভিদের শাখা  
  তারপর পায়ের সাথে বাঁধা পাথরটার দড়ি কেটে ফেললেন এক লহমায় ভেসে উঠলেন হলের ওপর সমুদ্রের ঢেউ তাকে বহন করে এনে তীরে নিক্ষেপ করল গিলগামেশ নৌকাচালক উর্শানবীকে বললেন,
এদিকে দেখুন কী অদ্ভুত এই উদ্ভিদ  এর বিশেষ গুনের কারনে  একজন মানুষ ফিরে পেতে পারে তার আগের সমস্ত শক্তি আমি এটিকে সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা উরুকে নিয়ে যাব  সেখানে বয়স্ক মানুষদের এটা খেতে দেব এর নামকরন করলাম "নবযৌবন প্রদায়িনী"  সবার শেষে আমি নিজেও এটি ভক্ষন করব যাতে আমি ফ্রে পেতে পারি আমার  হারানো যৌবন ”  যে প্রবেশ দ্বার দিয়ে একদা এখানে প্রবেশ করেছিলেন গিলগামেশ সেই দ্বার দিয়েই  উর্শানবীকে সাথে নিয়ে শুর করলেন প্রত্যাবর্তনের যাত্রা একটানা কুড়ি লিগ পথ পার করার পর  তারা তাদের উপবাস ভঙ্গ করলেন আরও তিরিশ লিগ পথ চলার পর  তারা থামলেন রাত্রিকালী বিশ্রাম নেওয়ার জন্য 
গিলগামেশ শীতল জলের একটি কূপ দেখতে পেয়ে সেটার কাছে এগিয়ে গেলেন  স্নান করার জন্য সেই কূপের ভেতর শুয়ে ছিল একটা সাপ যে আকৃষ্ট হল গিল গামেশের হাতে থাকা উদ্ভিদের ফুলের দ্বারা এক ঝটকায় সে বেড়িয়ে এল জল থেকে এবং চকিতে উদ্ভিদটা ছিনিয়ে নিল গিলগামেশের কাছ থেকে গলাধঃকরণ করল ওটাকে সাথে সাথেই সাপটার শরীরের প্রাচীন ত্বক খসে নতুন ত্বকের বিনির্মাণ হল   
এই ঘটনা দেখে গিলগামেশ কেঁদে ফেললেন   অশ্রুধারা তার মুখ বেয়ে গড়িয়ে এল শরীরে উনি  উর্শানবীর হাত চেপে ধরে বললেন,  “ হায়, হে উর্শানবী, এই জন্যই কী আমি এত   কঠোর পরিশ্রম করলাম? আমার হাত, আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ঘটালাম ? নিজের জন্য আমি কী অর্জন করেছি? একটা কিছুও নয় যা নিয়ে এসেছিলাম তার আসল সুখ রস পৃথিবীর ওই প্রানীটা উপভোগ করল যে স্থান থেকে ওই উদ্ভিদ খুঁজে পেয়েছিলাম সেখান থেকে কত শত পথ দুরেই না চলে এসেছি আমরা আশ্চর্য কিছু ঘটানোর একটা সুযোগ আমি   খুঁজে পেয়েছিলাম সেটা   এবার আমি হারিয়ে ফেললাম নৌকা এখানে এই নদী তীরেই থাক চলুন আমরা যাত্রা শুরু করি”    
পুনরায় কুড়ি লিগ পথ চলার পর  তারা তাদের উপবাস ভাঙলেন  ত্রিশ লিগ চলার পরে আবার তারা পথ চলা থামালেন কারন রাত ঘনিয়ে এসেছিল পরের  তিন দিন   তারা এক মাস এবং পনের দিনের যাত্রা পথ পার করলেন   
  সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা নগর শহর উরুকে পৌঁছে তাদের প্রত্যাবর্তনের যাত্রা সমাপ্ত হল 
গিলগামেশ নৌকাচালক উর্শনবীকে বললেন, “ হে উর্শানবী, উরুকের প্রাচীরের উপরে আরোহন করুন এর ভিত্তি যাচাই করুন  ভালভাবে এর  ইটগুলোকে পরীক্ষা করুন দেখুন এগুলো কী  পোড়া ইট নয়? সাত জন জ্ঞানী সাধক   কী এর ভিত্তি স্থাপন করেননি?  দেবী ইস্থারের ইচ্ছানুসারে, এই নগরের অবস্থান এর এক তৃতীয়াংশ স্থান জুড়ে এক তৃতীয়াংশ উদ্যান এবং শেষ এক তৃতীয়াংশ চাষাবাদ ক্ষেত্র  এই সব স্থানই  উরুক নামক নগরের  অন্তর্গত '

এসবই ছিল মহান গিলগামেশের কাজ,  যিনি বিশ্বের সমস্ত  দেশের কথা  জানতেন তিনি জ্ঞানী ছিলেন তিনি  দেখেছিলেন একাধিক রহস্য    জানতেন নানান গোপন বিষয়   তিনিই আমাদের জানিয়েছিলেন এক কথন যেখানে বলা হয়েছিল বন্যার আগের সময়ের কথা   দীর্ঘ যাত্রা করেছিলেন তিনি  পরিশ্রমে শ্রান্ত ক্লান্ত  হয়েছিলেন এবং ফিরে আসার পর সব কিছুই খোদাই করে ছিলেন একটি পাথরের গায়ে


 সপ্তম অধ্যায়
অন্তিম শয়ন
   পর্বতের অধিবাসী দেবতাদের পিতা  এনলিল গিলগামেশের জন্য যে ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেছিলেন, তা এবার পূর্ণ হলনেতিবাচক পাতাল পৃথিবীর অন্ধকার তাকে দেখিয়েছিল আলোর সন্ধান।  আজ অবধি যত মানবজাতির কথা জানা যায়, তাদের কোন প্রজন্মই এই মহান মানুষের  সাথে তুলনা করা যায় এমন কোনও  স্মৃতিস্তম্ভ রেখে যেতে পারেনি।
 সমস্ত বীর এবং জ্ঞানী লোকেদের জীবন চাঁদের পক্ষকালের মত। ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে/ পৌছায় প্রাপ্তি সম্মানের স র্বোচ্চ শিখরে। তারপর তা কমতে কমতে এক সময় বিলীন হয়ে যায়।   
মানুষেরা বলবে, "কেউ কী কখনও তাঁর মতো দুর্দম শক্তি সহযোগে শাসন করেছে?"
এ যেন সেই অন্ধকার মাসের মত, ছায়ার মাস,  তাকে ছাড়া জগতে আর কোনও আলো নেই। হেগিলগামেশ, এটাই ছিল আপনার দেখা স্বপ্নের অর্থ। আপনাকে রাজত্ব দেওয়া হয়েছিল, এটাই ছিল আপানার ললাট লিখন। চিরজীবন প্রাপ্তি আপনার ভাগ্যে ছিল না। এ কারণে দুঃখিত হবেন নাহতাশায় ভেঙে পড়বেন না। নিজেকে  নিপীড়িত মনে করবেন না তিনিই আপনাকে ক্ষমতা দিয়েছেন সব কিছুকে একত্রিত করার। আবার তিনিই ক্ষমতা দিয়েছেন সব কিছুকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার । তিনিই আপনাকে  ক্ষমতা দিয়েছেন, মানবজাতির অন্ধকার এবং আলো রূপে প্রতিভাত হওয়ার । জনগণের উপরে অভূতপূর্ব আধিপত্য করার ক্ষমতাও তিনিই আপনাকে দিয়েছেনএকজন পরাজিত ও যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে থেকে পালাতে না পারে এমন বিজয়ীর সম্মান দিয়েছেন সেই মহান শক্তি।   এই শক্তিকে অপব্যবহার করবেন নাযারা আপনার অনুগত, তাদের  সাথে ন্যায়বিচার করুনমহান সূর্যের  দিকে তাকিয়ে সেই আচরণ করুন যা আনার করা উচিত। ''
রাজা স্বয়ং গ্রহণ করেছেন  অন্তিম শয্যা।  আর উঠবেন না
কুল্লাবের প্রভু আর উঠে দাঁড়াবেন না
যিনি সমস্ত মন্দকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি আর ফিরে আসবেন না;
যদিও তার বাহু আজও শক্তিতে ভরপুর তবুও তিনি আর জাগ্রত হবেন না। 
সেই জ্ঞানী এবং সুন্দর চেহারার অধিকারী আর ফিরে আসবেন না।   
উনি চলে গেছেন সেই পাহাড়ে, আর ফিরে আসবেন না।   
উনি ভাগ্য সজ্জিত অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছেন, আর উঠবেন না।   
নানা রঙে রাঙ্গানো  পালঙ্ক ছেড়ে উনি আর উঠে দাঁড়াবেন না।   
সমস্ত  ছোট ও বড় নগরের মানুষেরা আর চুপ করে থাকতে পারেনি ।  তারা সবাই এখন  বিলাপ করছে। রক্ত মাংসে গড়া সকল মানব প্রজাতি আজ বিলাপ করছে।  ভাগ্য তার শেষ বাক্য উচ্চারণ করেছে। বড়শিতে আটকে যাওয়া মাছের মতো, দড়ির ফাঁদে আটকে যাওয়া হরিণের মতো,  মহান মানুষটি আজ শূয়ে আছেন তার শয্যায় ।  অমানবিক নামতার আজ তার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন।  নামতার সেই সত্তা যার কোন হাত বা পা নেই, সে জল পান করে না এবং বিড়ালদের মতো মাংসও খায় না
নিন্সানের পুত্র, উরুকের হৃদয়েশ্বর গিলগামেশের জন্য  তার প্রিয় স্ত্রী, তার
পুত্র, তার উপপত্নী, তার পরিবারের সমস্ত লোক, তার রাজসভার ভাঁড়, গায়ক বাদকেরা, তার চাকররা,  রাজবাড়ীতে যারা বাস করত তারা সকলেই গিলগামেশের জন্য তাদের নৈবেদ্য উৎসর্গ   করেছিল।   তারা তাদের নৈবেদ্য প্রদান করল মৃত্যুর রানী  ইরেশকিগালের কাছে এবং   মৃতদের দায়িত্বে থাকা সমস্ত দেবতার কাছে  ভাগ্য দেবতা নামতারের জন্য প্রদান করল  নৈবেদ্য প্রবেশদ্বারের রক্ষক নেটির জন্য উৎসর্গ করল রুটিসর্প দেবতা  নিনগিজিডাকেও নৈবেদ্য অর্পণ করল । জীবনের বৃক্ষের অধিকর্তা ,  দুরমুজি, তরুণ পশুপালক,  এনকি  এবং নিনকি, এন্ডুকুগা এবং নিন্দুকুগা,   এনমাল এবং নিনমাল, এনলিলের নাম বহনকারী সমস্ত পূর্বপুরুষ রুপী দেবতা, কেউ বাদ গেল না। সবার উদ্দেশ্যে প্রদান করা হল নৈবেদ্য।  ভোজন দেবতা শাল্পেইয়ের  জন্য আয়োজিত হল ভোজসভাগবাদি দেবতাপশুপালক দেবতা সামুকানের জন্যমাতা নিনহার্সাগগের জন্য এবং সৃষ্টির জায়গায় সৃষ্টির সমস্ত দেবতাদের জন্য, স্বর্গের আমান্ত্রকদের জন্য , যাজক এবং পুরোহিতেরা  মৃতর নামে উত্সর্গটি গ্রহণ করলেন।   
নিন্সানের সন্তান   গিলগামেশ শুয়ে আছেন তার সমাধিতে।   নৈবেদ্যর স্থানে স্তুপের মতো সাজানো আছে  রুটি   উত্সর্গের স্থানটিতে ঢালা হয়েছে  দ্রাক্ষারস  
এটাই ছিল সেই দিন যেদিন  নিন্সানের সন্তান  প্রভু গিলগামেশ এ জগত থেকে চলে গেলেন ।   তিনি সেই জন যিনি যে কোনো কাজে নিরলস পরিশ্রম করতেন, কোনো পুরুষ যার সমান শক্তিধর ছিল না, যিনি কখনও  তার প্রভু মহান এনলিলকে অবহেলা করেননি।
 হে গিলগামেশ, কুল্লাবের সম্রাট, আপনই  মহান। আপনার প্রশংসা করি।
সমাপ্ত