Search This Blog

Monday, April 6, 2020

গিলগামেশ কাব্য - গদ্যরুপ - ২য় অধ্যায়




গিলগামেশ কাব্য

প্রথম অধ্যায় লিঙ্ক


দ্বিতীয় অধ্যায়
অরণ্য সফর
দেবতাদের পিতা পর্বতের অধিবাসী এনলিল গিলগামেশর ভাগ্য নির্ধারণ করছিলেন তারই সুত্রে গিলগামেশ একটি স্বপ্ন দেখলেন এবং এনকিডুকে  তার বিবরণ শোনালেন।  এনকিডু  বললেন, “ হে গিলগামেশ, এই স্বপ্নের অর্থ, দেবতাদের পিতা আপনাকে রাজত্ব প্রদান করেছেনঅধিকার দিয়েছেন শাসন করার । এটাই আপনার নিয়তি চিরস্থায়ী অমর জীবন আপনার ললাটলিখন নয় এই কথা শুনে  মনকে দু: খিত করবেন না, শোক করবেন না বা অবসাদে ভেঙে পড়বেন না। তিনি আপনাকে একইসাথে সবকিছু একত্র করার এবং বিলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন। আপনি একইসাথে মানবজাতির জন্য  অন্ধকার এবং ঐশ্বরিক আলোর সমান । তিনি আপনাকে জনগণের উপর আধিপত্য করার সীমাহীন ক্ষমতা দান করেছেন । যে যুদ্ধ থেকে একজনও পরাজিত পালিয়ে যেতে পারে না, এমন বিজয়গৌরব লাভের সুযোগ প্রদান করেছেনকিন্তু হে গিলগামেশ এই শক্তিকে অপব্যবহার করবেন না আপনার পরিচারক কর্মচারীদের সাথে প্রাসাদে ন্যায়বিচার করুনশামাশের সম্মুখে নিজেকে  ন্যায়দাতা রূপে প্রতিষ্ঠিত  করুন
এই কথাগুলো বলতে বলতে এনকিডুর চোখ ভিজে গিয়েছিল অশ্রুধারায় । মুখে ফুটে উঠেছিল ব্যাথার ছাপ। একটা তীব্র দীর্ঘশ্বাস ফেলেন উনি।   গিলগামেশ সেটা দেখে জানতে চান, ' হে বন্ধু, তুমি এত কাতর  দীর্ঘশ্বাস কেন ফেলছ?
 এনকিডু উত্তরে বললেন, “আমি নিজেকে দুর্বল অনুভব করছি। আমার বাহু শক্তি হারিয়েছেদুঃখ দলা পাকিয়ে আটকে আছে আমার গলার ভেতরে । আমি অলসতার দ্বারা নিপীড়িত বোধ করছি
তখন মহান  গিলগামেশের  ভাবনামুখ নিজ রাজ্য ও দেশবাসির প্রতি আকৃষ্ট হল। সিডার[দেবদারু গাছ] বনভুমির দিকে তাকিয়ে তার নতুন বন্ধু তথা সহায়ক এনকিডুকে বললেন, ' যেহেতু নিয়তির আদেশ অনুসারে আমার ভাগ্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে, তাই আজ অবধি আমি কোথাও  আমার নাম কোনোভাবেই উৎকীর্ণ করার চেষ্টা  করিনিএবার আমি সেই সমস্ত স্থানে যাব যেখানে বনভুমি পরিষ্কার করে নতুন বাসস্থান স্থাপিত হয়েছে।   সেখানে আমার নাম স্থাপন করব যেখানে ইতিহাস বিখ্যাত পুরুষদের নাম খোদিত হয়েছে তোরনে । আর যেখানে কোনও মানুষের নাম লেখা নেই সেখানে স্থাপন  করব দেবতাদের স্মৃতিস্তম্ভতার সাথেই এবার আমরা অরন্যে সফর করব। ধ্বংস করব সেই  দুষ্ট শয়তানকে । যার নাম  হুমবাবা যার নামের অর্থ ’বিশালতা’ সে এক অতি হিংস্র দৈত্য
এই কথা শুনে  এনকিডু পুনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 'আমি যখন বুনো জন্তুদের সাথে অরন্যে বসবাস করতাম তখনই ওই অরণ্য আমি ঘুরে দেখেছি। এই অরন্যের সব দিকে দশ হাজার লিগ  [ তিরিশ হাজার মাইল] বিস্তৃত । মহান এনলিল এই অরণ্য রক্ষার জন্য হুমবাবাকে নিযুক্ত করেছিলেন।  তাকে সাজিয়ে দেন আতঙ্কের নানান সামগ্রী দিয়ে।  এমন আতঙ্ক যা যে কোনো জীবিত প্রানীর রক্ত জল করে দিতে সক্ষম। সে যখন গর্জন করে তখন তা সামুদ্রিক ঝড়ের শব্দের  মতো শোনায়তার শ্বাসপ্রশ্বাস আগুনের সমান।   তার চোয়ালের কাছে যাওয়ার অর্থ নিজে মৃত্যুকে ডেকে আনা তার শ্রবন শক্তি এত ভালো যে কোনো বাছুর যদি ষাট লিগ দূর থেকেও ডাকে সে শুনতে পায় তার আওয়াজ। এসব জেনে কার আর সাহস হবে  ওই অরণ্যর গভীরে পদার্পণ করার?  আমি এটাও শুনেছি, যে ওর কাছে  যায় তাকেই  দুর্বলতা গ্রাস করেএই কারনেই কেউ যখন হুমবাবার সাথে লড়াই করার চেষ্টা করে সেটা সঠিক মাত্রার  সংগ্রাম হয় না মোটেই। সে একজন দুর্দান্ত যোদ্ধা  সবকিছু তছনছকারী এক শক্তি। আরো শুনে রাখুন হে   গিলগামেশ, বনের ওই প্রহরী কখনও ঘুমায় না
গিলগামেশ এসব কথা শুনে বললেন, “স্বর্গে সহজে স্থান লাভ করে এমন কাউকে দেখেছ কি?   কেবলমাত্র দেবতারাই গৌরবময় শামাশের সাথে চিরকাল বেঁচে থাকেনআর আমাদের মত মানূষের জন্য জীবনকাল নির্ধারণ করে রাখাই আছে । আমাদের জীবন যাপন বাতাসের একটা ঝাপটের মত এসব কি তোমার জানা নেই? তাহলে কেন আগে থেকেই ভয় পাচ্ছ ! যদিও আমি তোমার প্রভু তবু চিন্তা নেই, আমিই আগে যাব ওই অরন্যে। তুমি  নিরাপদ অনুভব করলে হাঁক দেবে, ‘সামনে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই!  এরপরে যদি আমি হেরে যাই বা মরে যাই,  তাহলে আমার নাম স্থায়ী হয়ে থেকে যাবে।  মানুষেরা আমার সম্পর্কে বলবে, " গিলগামেশ সেই জন যে হিংস্র হুমবাবার সাথে লড়াই করতে গিয়ে প্রান দিয়েছে অনেক অনেক যুগ পড়া করেও যখন আমার  পরিবারে নতুন প্রজন্ম আসবে, তখনো তারা আমার সাথে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা স্মরণ করবে
এনকিডু  এবার গিলগামেশকে বললেন, 'হে প্রভু, আপনি যদি নিতান্তই ওই এলাকায়  প্রবেশ করবেন মনস্থ করে থাকেন, তাহলে এই সিডার গাছের  এলাকার মালিক যিনি, সেই সূর্য দেবতা মহান শামাশের কাছে সবার আগে  যান
গিলগামেশ একহাতে একটি দাগহীন সাদা এবং একটি বাদামী রঙের ছাগলছানা বুকের কাছে চেপে ধরে সূর্যালোকে গিয়ে দাঁড়ালেন অন্যহাতে রৌপ্য রাজদণ্ডটি চেপে ধরে  গৌরবময় শামাশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে মহান শামাশ, আমি আপনার অধিক্রিত এলাকায় প্রবেশ করতে চলেছি আমি জোড় হাত করে প্রার্থনা করছি আমার আত্মার যেন কোন ক্ষতি না হয়  আমি যেন আবার উরুকের ছায়ায় ফিরে আসতে পারি  আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করুন, আমি আপনার প্রদান করা সুরক্ষা চাই, শুভকামনা চাই
 গৌরবময় মহান শামাশ উত্তর দি্লেন, “গিলগামেশ, তুমিতো শক্তিশালী তাহলে আবার এসব প্রার্থনা করা কি কারন?”
 হে মহান শামাশ, শুনুন,  আমার কথা শুনুন এখানে নগরে মানুষ অবসাদগ্রস্থ হৃদয়ে  মারা যাচ্ছে  মানুষ তার মনে হতাশায় জর্জরিত হচ্ছে   আমি দেখেছি প্রাচীরের ওপাড়ে মানুষের শবদেহ  নদীর উপর ভাসছে  সেখানে আমার নগরের মানুষও আছে   আমি জানি  সবচেয়ে লম্বা মানুষ স্বর্গের নাগাল পায় না  সবচেয়ে বিশালকায় মানুষের ক্ষমতা নেই পৃথিবীকে পরিবেষ্টন করার সেই স্বরগকে নাগালের ভেতর পাওয়ার  জন্যই এবার  আমি ওই এলাকায় প্রবেশ করব কারণ আমি আমার ভাগ্যবলে চিহ্নিত তাই আজ অবধি কোনো স্থানে  আমার নাম খোদাই করিনি এবার আমি সেস্খানেই যাব যেখান থেকে সিডার গাছের কাঠ সংগ্রহ করা হয়  আমি এবার সেই খিলানে নাম খোদাই করাবো যেখানে বিখ্যাত মানুষদের নাম খোদাই করা হয়  আমি সেখানে একটি   স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করব দেবতাদের উদ্দেশ্যেআবেগে গিলগামেশের চোখ দিয়ে  অশ্রু নির্গত হল হায় ভাগ্য, জানিনা কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমাকে  হুমবাবার এলাকায় পৌছাতে  হবে এই উদ্যোগটি যদি সাধিত না হয়, তবে হে মহান শামাশ,  কেন আপনি আমার মনে এই   আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করেছেন?   আমি কিভাবে সফল হতে পারি, যদি আপনি আমাকে সফলতা প্রদান না করেন ? আমি যদি ওই এলাকায় গিয়ে মারা যাই তাহলে তা নিয়ে আফশোস কিছু থাকবে না আর যদি আমি ফিরে আসি তবে মহান শামাশের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরুপ আমি সেরা  উপহার পেশ করব ''
অগত্যা শামাশ গিলগামেশের  কান্না ভেজা আবেদন  স্বীকার করলেন  করুণাময় মানুষের মতই তাকে করুণা প্রদান করলেন গিলগামেশের জন্য তিনি শক্তিশালী বাহিনীকে নিযুক্ত করলেন যারা ছিল জনৈক  মাতার পুত্র তাদের উনি পর্বতের গুহাগুলি পাহারার দায়িত্ব দিলেন বিভিন্ন   দুর্দান্ত শক্তির বাতাসেরাও নিযুক্ত হল তার নির্দেশে    উত্তরের বাতাস, ঘূর্ণিঝড়, সাধারন ঝড় এবং বরফ শীতল বাতাস, পাহাড়ী ঝড় এবং সামুদ্রিক বাতাস সবাই একত্রিত হল যারা সাপের মতো, ড্রাগনের মতো, জ্বলন্ত আগুনের মতো ক্ষমতার অধিকারী  যাদের আক্রমণ হৃদয়কে হিমশীতল করে দিতে পারে গিলগামেশ আনন্দিত হলেন এটা দেখে যে,  তাকে সাহায্য করতে বিধ্বংসী   বন্যা এবং বিদ্যুতের ফলাকেও  নিযুক্ত করলেন মহান শামাশ   
গিলগামেশ এবার কামার শালায় গিয়ে আদেশ দিলেন, “ আমাদের জন্য অস্ত্র নির্মাণ কর অস্ত্র নির্মাতা কারিগরেরা নিজেদের ভেতর আলাপ আলোচনা করে চলে গেল  সমতলভুমির অরন্যে  সেখান থেকে দরকার মত কাঠ কেটে নিল নয় স্কোর বা একশো আশি পাউন্ড ওজনের কুঠার বানানোর জন্যনির্মাণ করল ছয়টি স্কোর পাউন্ডের দুর্দান্ত তরোয়াল যার সাথে  ছিল ত্রিশ পাউন্ড ওজনের হাতল এবং খাপ  তারা গিলগামেশের জন্য বিশেষ ভাবে নির্মাণ করল 'বীর শক্তিকুঠার এবং আনশান ধনুক  এভাবেই সংগ্রামের জন্য তৈরি হলেন গিলগামেশ   এবং এনকিডু   
সাত কীলকের বিশাল দরজার নিকটে বাজার চত্বরে উরুকের সমস্ত মানুষ সমবেত হল, গিল গামেশের যুদ্ধ যাত্রা দেখার জন্য গিলগামেশ তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,  'আমি, গিলগামেশ, সেই ভয়ানক প্রাণীটির সন্ধানে যাচ্ছি   যার সম্পর্কে চারদিকে নানান  গুজব শোনা যাচ্ছে আমি ওই সিডারের অরন্যেই  ওকে ভুপাতিত করব দেখিয়ে দেব উরুকের মানুষের শক্তি    সমস্ত পৃথিবীও সেটা দেখতে পাবে  আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই উদ্যোগ সফল করার জন্য ওই পাহাড়ে আরোহন করে, সিডার গাছ কেটে আমি নিজের নাম চিরস্থায়ী করে রেখে যাব 
 বাজারে উপস্থিত উরুকের পরামর্শদাতারা তাকে বলল, ‘হে, গিলগামেশ, আপনি যুবক, আপনার সাহস আপনাকে বহুদূর নিয়ে যাবে  আপনি জানেন না, যে উদ্যোগ আপনি করছেন, যে   পরিকল্পনা আপনি সাজিয়েছেন, তার ফলাফল কী হতে পারে   আমরা শুনেছি হুমবাবা সাধারন মানূষের মতো নয় তার নাকি মৃত্যু নেই   তার অস্ত্রগুলি এমনই যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না  ওই অরণ্য প্রতিটি দিকে দশ হাজার লিগ করে  প্রসারিত  কে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করার জন্য ওই গভীর অরন্যে অন্বেষণ করার কথা ভাবে? হুমবাবার গর্জন ঝড়ের গর্জনের স্মতুল  তার নিঃশ্বাস আগুনের মতো এবং তার চোয়ালসহ দাঁত সাক্ষাৎ মৃত্যুর প্রবেশদ্বার হে গিলগামেশ  কেন আপনি এই জিনিসটি করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন? ঐ মৃত্যুদূত হুমবাবার সাথে লড়াই যে  অসম লড়াই, আপনি কি জানেন না!”
 পরামর্শদাতাদের এই কথাগুলো শুনে গিলগামেশ তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “আমি এসব কথার কী উত্তর দেব ওদের? আমি কি বলব যে, আমি হুমবাবাকে ভয় করি? জীবনের বাকি দিনগুলো সেই ভয়ে নিজের ঘরে বসেই কাটিয়ে দেব?”
গিলগামেশ এনকিডুর উদ্দেশে বললেন,  'হে বন্ধু, চলুন আমরা আমাদের প্রাসাদ  এগালমাতে যাই ওখানে আছেন নিন্সান রানী নিন্সান গভীর জ্ঞানের অধিকারিনী তার কাছ থেকেই যেনে নিই আমাদের যাত্রাপথের পরামর্শ উনিই জানিয়ে দেবেন কিভাবে কি করতে হবে
 ওরা এক অপরের হাত ধরে একসাথে  এগালমায় গেলেন এবং মহান রানী নিন্সানের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার জন্য  গিলগামেশ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন এবং নিন্সানকে বললেন,  মাতা নিন্সান মন দিয়ে আমার কথা শুনুন  আমরা এক দীর্ঘ সফরে যাচ্ছি হুমবাবার এলাকায়      অজানা পথ পাড় করে সেখানে  এক অদ্ভুত লড়াইয়ের সম্মুখীন হওয়ার জন্য  সফর শুরু করা থেকে ফিরে আসা অবধি, সিডারের অরন্যে প্রবেশ করা থেকে সেই শয়তানকে, যাকে শামাস স্বয়ং ঘৃণার চোখে দেখেন,  হত্যা করা অবধি আপনি আমার জন্য মহান শামাশের কাছে প্রার্থনা করবেন!”    
নিন্সান এসব কথা শুনে তার ঘরে ফিরে গেলেন পড়লেন এক সুন্দর পোশাক স্তনদ্বয়কে সজ্জিত করলেন মূল্যবান  গহনা দ্বারা   মাথায় পড়লেন টায়রা  পোশাকের নিম্নদেশ স্পর্শ করে থাকল জমিকে সজ্জিত হয়ে ইনি উঠে গেলেন প্রাসাদের ছাদে উপস্থিত হলেন সূর্য দেবতার বেদীর নিকটে প্রজ্জ্বলিত করলেন ধূপ  তার ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠতে শুরু করার সাথে সাথে নিন্সান উপরের দিকে   হাত তুলে বললেন,  'হে শামাশ, আপনি কেন আমার পুত্র গিলগামেশকে এইরূপে অস্থির করে তুলেছেন  ? আপনার ইচ্ছাতেই সে এখন মানসিক ভাবে প্রস্তুত দীর্ঘ সফরের জন্য সে যাচ্ছে হুম বাবার এলাকায়  অজানা পথ পাড়ি দিয়ে সে চলেছে   অদ্ভুত এক সংগ্রাম করতে  অতএব তার যাত্রার শুরু থেকে ফিরে আসা অবধি, সেই সিডারের অরন্যে প্রবেশ করা, যাকে আপনি ঘৃণা করেন সেই শয়তানকে খুঁজে বের করা, এবং তাকে হত্যা করা অবধি অনুগ্রহ করে তাকে বিস্মৃত হবেন না আপনার সহধর্মিণী  আয়া যেন প্রতিদিন ভোরে তার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দেয় রাত হলে তাকে রক্ষা করার দায়িও প্রদান করবেন রাতের প্রহরীর হস্তে তার যেন কোন  ক্ষতি না হয়
এরপরে গিলগামেশের মাতা নিন্সান  প্রজ্জ্বলিত ধূপ নির্বাপণ কবাপ এবং এনকিডুকে  ডাকলেন তাকে উপদেশ প্রদান করলেন,  হে, শক্তিশালী এনকিডু, তুমি আমার দেহজাত সন্তান নও, তবুও আমি তোমাকে গ্রহণ করব আমার দত্তক পুত্ররূপে তুমি আমার সেই সন্তানদের মত যাদের  মন্দিরে খুঁজে পাওয়া যায়   মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রূপে যেভাবে  গিলগামেশের সেবা করেন করা  যাজক পুরোহিতেরা, সেভাবেই তুমি তার দেখাশোনা করবে  এই স্থানে উপস্থিত সমস্ত মানুষ, সমস্ত মহিলা, সমস্ত পুরোহিত এবং সমস্ত যাজকদের সম্মুখে আমি প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করলাম '' তারপর এনকিডুর গলায় পড়িয়ে দিলেন একটি তাবিজ এবং   বললেন, “আমি ওর রক্ষার দায়িত্ব তোমার উপর অর্পণ করলাম ওকে নিরাপদে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে
এরপর সমস্ত  অস্ত্রশশ্ত্র   তাদের কাছে নিয়ে আসা হল   সোনার খাপবদ্ধ অসাধারন তরোয়াল তারা উঠিয়ে নিলেন হাতে স্পর্শ করলেন ধনুক এবং তীর গিলগামেশ নিলেন কুঠার কাঁধে ঝোলালেন তূণীর  হাতে তুলে নিলেন আনশান ধনুক    কোমর বন্ধনীতে বেঁধে নিলেন  তরোয়াল  সশস্ত্র যোদ্ধারা প্রস্তুত সফরের জন্য   এবার একের পর এক মানুষ এসে তাদের শুভেচ্ছা জানাল জানতে চাইল,  আপনি আবার কবে এই নগরে   ফিরে আসবেন?”
পরামর্শদাতারা গিলগামেশকে আশীর্বাদ করার সাথেই সতর্ক করে দিলেন, “নিজের শক্তির উপর খুব বেশি বিশ্বাস করবেন না সদা সতর্ক থাকবেন   আঘাত পাওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবেন  যে সামনে এগিয়ে যায় সে তার সঙ্গীকে রক্ষা করে ভাল পথ প্রদর্শক জানে কিভাবে তার সাথীকে বাঁচানো যায় এনকিডুকে সুযোগ দিন নেতৃত্ব করার সে ভালো করে চেনে  অরন্যের পথ ঘাট সে  হুমবাবাকেও দেখেছে তাছাড়া তার  অভিজ্ঞতাও আছে যুদ্ধ করার  ওকেই প্রথমে এগিয়ে যেতে দেবেন  ওকে নিজের জন্য সাবধান হতে দিন তবেই  এনকিডু তার বন্ধুকে রক্ষা করতে পারবে  নিরাপদে আবার এই রাজপথে ফিরে আসতেও পারবেন আপনারা হে এনকিডু, আমরা  উরুকের পরামর্শদাতারা আমাদের রাজাকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছি ; ওকে নিরাপদে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আপনার
গিলগামেশকে পুনরায় তারা বলল, “শামাশ আপনাকে আপনার অন্তরের আকাঙ্ক্ষা পুর্ন করার বরদান করুন তিনি আপনাকে সেই শক্তি দিন,  যাতে  নিজের চোখে আপনি  সেই কাজ সম্পন্ন হতে দেখুন যার কথা আপনার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে    তিনি আপনার জন্য সমস্ত  অবরুদ্ধ   পথ খুলে দিন এই কামনা করি  সমস্ত পথ মসৃণ হোক  পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য    আপনার পারাপারের জন্য যেন কোন পর্বত বাধা হয়ে না দাঁড়ায়  সুখদায়ক হয়ে উঠুক দিন শেষের রাত্রিযাপন  অভিভাবক দেবতা লুগলবান্দা বিজয়ের আশীর্বাদ নিয়ে  আপনার পাশে  দাঁড়ান
আপনি পাশে একজন শিশুকে নিয়ে যুদ্ধ করলেও যেন সেই  যুদ্ধে আপনি জয়লাভ করেন      হুমবাবা নদীর জলে ধূয়ে নেবেন আনার পা সন্ধ্যাকালে কূপ খনন করে তার বিশুদ্ধ জলে ধুয়ে ফেলবেন আপনার দেহ ত্বক  শীতল জল উৎসর্গ করবেন মহান দেবতা শামাশকে ভুলে যাবেন না যেন লুগলবান্দার কথাও
অতঃপর এনকিডু বললেন , “চলুন এগোনো যাক সামনে, ভয়ের কিছু নেই আমাকে অনুসরণ
করুন, কারণ আমি জানি যে হুম বাবা কোথায় থাকে এবং কোন কোন  পথে সে ঘুরে বেড়ায়   
হে পরামর্শদাতাগন এবার আপনারা ফিরে যান এখানে ভয়ের কোন কারণ নেই
 পরামর্শদাতারা যখন এই কথা শুনলেন তখন তারা তাদের নায়ককে ওখানেই বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন,  যান, গিলগামেশ, কামনা করি   অভিভাবক ঈশ্বর আপনাকে রক্ষা করুন সত্বর নিরাপদে আপনি উরুকের উপকূলে পুনরায় ফিরে আসুন  
একটানা কুড়ি   লিগ পথ হেঁটে চলার পর ওরা খাদ্য গ্রহণ করলেন এবং আরো তিরিশ লিগ প্তহ পার করে ওরা  রাতে বিশ্রাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন    পঞ্চাশ লিগ পথ তারা একদিনে হাঁটলেন এভাবে   তিন দিনে তারা  এক মাস এবং দুই সপ্তাহের যাত্রাপথ পাড়ি দিলেন  হিসাবে   সাতটি পাহাড় অতিক্রম করে তারা উপনীত হলেন অরন্যের প্রবেশ দ্বারে
এনকিডু গিলগামেশকে ডেকে বললেন, “এই প্রবেশদ্বার খুলতে গিয়ে যদি   আমি ভুপাতিত হই তাহলে আপনি একা একা বনে প্রবেশ করবেন না
গিলগামেশ একথা শুনে তাকে বললেন, 'প্রিয় বন্ধু, কাপুরুষের মতো কথা বোলো না আমরা যে এত বিপদ স্নকুল পথ চরম কষ্ট সহযোগে পাড়ি দিয়ে এলাম, সেটা কী শেষ মুহূর্তে   ফিরে যাওয়ার জন্য? তুমি আমার পাশে থাকো কোনোরকম ভয় পাবে না  মৃত্যুর ভয় পাবে না আমার পাশে থাকলে তোমার দুর্বলতা কেটে যাবে থেমে যাবে হাতের কম্পন। আমি কী আমার বন্ধুকে পিছনে ফেলে চলে যাব? না, আমরা একসাথেই বনের ভেতর প্রবেশ করব আসন্ন যুদ্ধের জন্য তোমার সাহসকে জাগ্রত কর    মৃত্যুর কথা ভুলে যাও এবং আমাকে অনুসরণ কর বোকার মত ভাবনা নিয়ে কেউ কোনো কাজ করে না   দু'জন এক সাথে গেলে একে অপরকে  রক্ষা করতে পারবো আর যদি আমরা হেরেও যাই আমাদের নাম চিরস্থায়ী হয়ে থেকে যাবে ''
ওরা একসাথে অরন্যে প্রবেশ করলেন উপস্থিত হলেন   সবুজ পাহাড়ে  সেখানে দাঁড়িয়ে ওদের বাক্যস্ফুরণ হচ্ছিল না  চুপচাপ দাঁড়িয়ে তারা বিশাল অরণ্যর রুপ দর্শন করছিল দেখছিল সিডার গাছগুলোর উচ্চতা, অরণ্য অভ্যন্তরে প্রবেশের পথ এবং সেই বিশেষ রাস্তা যেখান দিয়ে হুম বাবা যাতায়াত করে    পথটি বিস্তৃত  এবং চলাচলের পক্ষে বেশ ভাল ওরা দেবদারু পর্বতে, দেবতাদের বাসস্থান এবং  ইস্থারের সিংহাসন অবলোকন করলেন  বিশাল বিশাল সিডার গাছ অবস্থান করছে পাহাড়ের সামনের দিকে তাদের সুন্দর, সুশীতল ছায়ায় ঢেকে আছে সবুজ তৃণভূমি   

সেখানেই সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে গিলগামেশ একটি কূপ খনন করলেন উঠে গেলেন পাহাড়ে   সেখানে জমির ওপর বসে ভালো ভালো খাদ্য দ্বারা নিজেদের উদর পূর্তি করলেন  তারপর বললেন, 'হে দেবতাদের বাসভুমি পর্বত! আমার জন্য একটি  অনুকূল স্বপ্ন নির্মাণ করুন  বন্ধুর হাতে হাত রেখে ওরা শুয়ে পড়লেন সংলগ্ন ভুমিতে ওদের চোখে নেমে এলো রাত্রিকালীন ঘুমের ঘোর গিলগামেশ একটি স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে জেগে উঠলেন   বন্ধুকে বললেন,  'এনকিডু, এটা কি হল? তুমি তো আমাকে ঘুম থেকে জাগাওনি!  বন্ধু, তাহলে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম ওই দেখো সুউচ্চ পাহাড় চুড়া ওখান থেকে দেবতারা আমাকে যে ঘুমের জগতে প্রেরণ করেছিলেন তা সমাপ্ত হয়ে গেল  ওহ,  বন্ধু, কি অদ্ভুত সন্ত্রাস এবং বিভ্রান্তি মাখানো স্বপ্ন ছিল সেটা!  আমি অরণ্য প্রান্তরে একটা বুনো ষাঁড় ধরেছিলাম সেই প্রানী দাপাদাপি করে উদ্দামতার সাথে চারিদিকে ধুলা ছিটাচ্ছিল পুরো আকাশ অন্ধকার  হওয়া পর্যন্ত ওটা তার দাপট দেখিয়ে গেল   আমার বাহু যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছিল জিভ অসাড় হয়ে এসেছিল আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলাম ওই সময় কেউ একজন আমাকে তার ভিস্তি থেকে জল পান করাল 
এনকিডু বলল, “প্রিয় বন্ধু, আমরা যে ঈশ্বরের নিকট যাচ্ছি তিনি কোন   বুনো ষাঁড় নন  যদিও তার রুপ রহস্যজনক আপনি যে বন্য ষাঁড়টিকে দেখেছেন তা হ'ল স্বয়ং রক্ষক শামাশ  আমাদের বিপদের মুহূর্তে  উনি আমাদের  হাতে হাত মেলাবেন  যিনি তার ভিস্তি থেকে আপনাকে জল দান করেছেন তিনি  আপনার অভিভাবক ঈশ্বর আপনার রক্ষক  লুগুলবান্দা উনাদের আশীর্বাদের ছায়ায় সংযুক্ত হয়ে আমরা একসাথে এমন একটি কাজ সম্পাদন করব যার খ্যাতি কখনই এ জগত থেকে বিলুপ্ত হবে না ''
গিলগামেশ বললেন, “আমি এরপরেও একটা স্বপ্ন দেখেছি আমরা এমন এক  গভীর গর্তসম পাহাড়ি উপত্যকায় দাঁড়িয়েছিলাম যে, আমাদেরকে জলাভুমির মাছির মতো ছোট দেখাচ্ছিল    হঠাৎ করে আশে পাশের পর্বতমালায় ধ্বস নামল। আমি আঘাত পেলাম এবং আমার পা কেউ যেন নীচ থেকে চেপে ধরেছিল তারপরেই একটি অসহনীয় আলোয় উদ্ভাসিত হল চারপাশ যার ভেতর থেকে এমন একজন কে দেখা গেল যার সপ্রতিভতা এবং সৌন্দর্যর তুলনা এ জগতে নেই।  তিনি  আমাকে পাথরের নীচে থেকে টেনে তুললেন।  আমাকে জল  পান করালেন। আমার ব্যথিত হৃদয় এবং  মন সান্ত্বনা পেল তার অনুগ্রহে এবং তিনিই আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন।”
একথা শুনে সমভূমির সন্তান এনকিডু ঈশ্বরসম তরুণ গিলগামেশকে বললেন, “আসুন আমরা পাহাড় থেকে নিচে নেমে যাই এবং এ বিষয়ে আলোচনা করি। আপনার স্বপ্ন খুবই ভালো ইঙ্গিত বাহী।   আপনার স্বপ্ন অসাধারন। আপনি যে পাহাড়টিকে দেখেছেন সেই হল হুমবাবা বোঝাই যাচ্ছে আমরা তাকে  মেরে ফেলতে সক্ষম হব এবং ওর শরীরটাকে ছুড়ে ফেলে দেব ঠিক যেমনভাবে পর্বতটি  সমতলে ধ্বসে পড়ে গেল। ''
পরের দিন আরো কুড়ি লিগ পথ পার করার পর ওরা প্রথম খাদ্য গ্রহণ করলেন। তারপর আরো   তিরিশ লিগ পথ পাড়ি দিয়ে থামলেন নৈশকালীন বিশ্রামের জন্য।  সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে উভয়ে মিলে  আবার একটি কূপ খনন করলেন এবং জমিতে উপাদেয় খাদ্যাদি রেখে গিলগামেশ বললেন, “হে পর্বত, দেবতাদের বাসস্থান, আজ এনকিডুর জন্য একটি স্বপ্ন প্রেরণ করুন
পর্বত এন কিডুর জন্য স্বপ্ন প্রেরণ করল। সে স্বপ্ন এল এক অশুভ স্বপ্ন রূপে।  এক শীতল বৃষ্টি ধারা এনকিডুকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। কাঁপিয়ে দিয়ে গেল ঠিক যেমন ভাবে পাহাড়ি বৃষ্টিতে কাঁপতে কাঁপতে নুয়ে যায় পাহাড়ি শস্য   ওদিকে গিলগামেশ  হাঁটুতে চিবুক রেখে বসে রইলেন যতক্ষন না তার চোখে নেমে এল ঘুমের ছায়া । মধ্যরাতে সহসাই তার ঘুম ভেঙে গেল।   তিনি উঠে তার বন্ধুকে বললেন, “তুমি কি আমাকে ডাকলে? তা না হলে আমার ঘুম ভেঙে গেল কেন? তুমি কি আমাকে ছুঁয়েছিলে তা না হলে আমার মনে এ কিসের  আতঙ্ক? দেবতারা কি  আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন, তা না হলে   আমার অঙ্গ প্রত্যয়ে ভয়ে অসাড় হয়ে গেল কেন ? হে বন্ধু, আমি তৃতীয় স্বপ্ন দেখলাম এবং এই স্বপ্নটি পুরোপুরি ভয়াবহ ছিল আকাশ থেকে ভেসে আসছিল গর্জন  গর্জন শোনা যাচ্ছিল পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকেও।    দিবালোক নির্বাপিত হল   নেমে এল অন্ধকার  বিদ্যুৎ চমকে উঠল জ্বলে উঠল আগুনমেঘ নেমে এল অনেক নীচে তারা মৃত্যু বৃষ্টি করল বিদায় নিল উজ্জ্বলতা  নিভে গেল আগুন চারদিকে শুধুই পোড়া ছাইয়ের স্তুপ। চলো, আমরা এই পাহাড় থেকে নেমে যাই তারপর এ বিষয়ে আলোচনা করিএবার আমাদের কি করা উচিত তা বিবেচনা করা দরকার। ''
পাহাড় থেকে নেমে আসার পর  গিলগামেশ  তার কুঠার দিয়ে একটি সিডার গাছ কাটলেন। সেই বিশাল বৃক্ষের পতনের শব্দ কানে গেল হুমবাবার। শোনা গেল তার ক্রোধান্বিত   চিৎকার  বলল, “কে সেই অর্বাচীন যে আমার এলাকায় প্রবেশের সাহস দেখিয়েছে? আমার অরন্যের গাছ কাটছে?
ওদিকে গৌরবময় শামাশ স্বর্গ থেকে গিলগামেশদের ডেকে বললেন, “এগিয়ে যাও, ভয় কোরো না
কিন্তু গিলগামেশ সহসাই আচ্ছন্ন হলেন  দুর্বলতায়গভীর ঘুমের ঘোর নেমে এল তার চোখে।    নির্বাকভাবে মাটিতে শুয়ে পড়লেন উনি।  যেন চলে গেছেন স্বপ্নের জগতে। এনকিডু তার শরীর স্পর্শ করলেন তবুও তিনি উঠলেন না অনেকবার ডাকলেন কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না  “ হে  গিলগামেশ, কুল্লাব সমভূমির প্রভু, পৃথিবীর অন্ধকারে বেড়ে যাচ্ছে,  ছড়িয়ে পড়ছে ছায়ার চাদর,   সন্ধ্যা সমাগত শামাশ চলে গেছেন, তাঁর উজ্জ্বল মস্তক এই মুহূর্তে তাঁর মা নিনগালের কোলে হে গিলগামেশ, আপনি আর কতক্ষণ এভাবে ঘুমের ঘোরে শুয়ে থারেন? যে মা আপনাকে জন্ম দিয়েছে্ন তাকে  নগর চত্বরে শোকে বিহ্বলা অবস্থায় আসতে দেওয়া কিন্তু উচিত হবেনা।”     
এইবার গিলগামেশের নিদ্রা ভঙ্গ হল।  তিনি তার বক্ষ আবরণকারী ‘নায়কদের আওয়াজ’ নামে খ্যাত বর্ম হাতে তুলে নিলেন। ত্রিশ শেকেল [১ শেকেল= ২৫২ রতি] ওজনের বর্মটিকে  এমনভাবে উঠালেন যেন ওটা একটা হালকা পোশাকবর্মটি তার শরীরকে সুরক্ষা প্রদান করল। দাঁত কিড়মিড় করে উনি সজরে জমিতে পদাঘাত করলেন, যেভাবে মত্ত  ষাঁড় জমিতে পা ঠোকে।  “যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন এবং আপন ক্রোড়ে ধারন করেছেন সেই নিন্সান এবং যিনি আমাকে জীবন দিয়েছেন সেই ঐশ্বরিক পিতা লুগলবান্দার দিব্যি।” পর পর দুবার এ কথা উচ্চারণ করে তারপর বললেন, “ যতক্ষণ না আমরা এই মানুষটির বিরুদ্ধে লড়াই করছি,  অবশ্য সে যদি মানুষ হয় তবেই, আমি পিছু হটবো না। যদি ঈশ্বর বাক্য মিথ্যা হয়, তাহলে আমি যেস্থানে বসবাস করতাম সেই নগরীতে আর ফিরে যাবোনা।”   
তখন তার বিশ্বস্ত সহচর এনকিডু তাকে অনুরোধসূচক ভাবে বললেন,   'হে আমার প্রভু, আপনি   এই দানবটির বিষয়ে কিছুই জানেন নাআর সেই কারনেই  আপনি ভয় পাচ্ছেন না আমিই সেই যে ওকে জানি সেই জন্যই আমি  আতঙ্কগ্রস্ত তার দাঁত ড্রাগনের মতো  তার মুখ সিংহসম।  তার হাঁটাচলা বন্যার স্রোতের মত।  তার চেহারার স্পর্শে অরন্যের গাছ নুয়ে পড়ে জলাভুমির শর কাঠির মত।  হে প্রভু, আপনি যদি চান আপনি ওই এলাকায় প্রবেশ করতেই পারেন। কিন্তু   আমি ফিরে যাব নগরে। সেখানে গিয়ে আপনার  মাকে আপনার সমস্ত মহিমান্বিত কাজের বিবরণ শোনাবো ।  যতক্ষণ না উনি আনন্দে উল্লাসে মেতে ওঠেন। তারপর তাকে শোনাবো বাকি কথা। যা শুনে উনার চোখ বেয়ে নেমে আসবে জলের ধারা ।”
গিলগামেশ এসব কথা শুনে বললেন, ' আত্মবলিদান এবং শেষকৃত্যর সময় এখন উপস্থিত হয়নি আমার জন্য  মৃতদের বহনকারী নৌকাও আমার জন্য অপেক্ষায় নেই । সেই তিন প্রস্থ কাপড় আমার জন্য তৈরি হয়নি এখনো যা আমার শবদেহকে আচ্ছাদিত করবে। সেই সময় আসেনি যখন জনগণ বিষাদগ্রস্থ  হয়ে  আমার চিতা জ্বালাবে  এবং আমার বাসস্থান আগুনে পোড়াবে
বন্ধু এনকিডু, আজ, তুমি আমাকে তোমার  সহায়তা প্রদান কর । আমার পাশে দাঁড়াও। আমিও সেটাই করব তোমার সাথে।    আমাদের দুজনকে একসাথে হারানোর ক্ষমতা কার আছে?  সমস্ত জীবিত প্রানী যাদের জন্ম হয়েছে  মাংসের দেহ থেকে তাদের একদিন বিনাশ হবে । সবাইকেই আরোহন করতে হবে  পশ্চিমগামী নৌকায়  যখন সেটা ডুবে যাবে, যখন মাগিলামের নৌকা ডুবে যাবে, তখন সবাইকে চলে যেতে হবে। কিন্তু এখন আমরা এগিয়ে যাবো এবং খুঁজে বার করব সেই দানব কে।  যদি তোমার হৃদযয়ে ভয়ের সঞ্চার হয় তাহলে সেই ভয়কে ছুঁড়ে ফেলে  দাও।  যদি সন্ত্রাস হানা দেয়, দূরে সরিয়ে দাও তাকেও।  হাতে তুলে নাও কুড়ুল,  আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হো।  যে লড়াই অসম্পূর্ণ রেখে বিদায় নেয় সে কখনো  শান্তিতে থাকে না
ঠিক ওই মুহূর্তে হুমবাবা বেড়িয়ে এল তার অরন্যের ঘাঁটি থেকে  
এনকিডু বললেন, 'হে গিলগামেশ, এবার উরুকে আপনার আত্মগর্বের কথা মনে করুন এগিয়ে যান, আক্রমণ করুন, হে উরুকের পুত্র, ভয় পাওয়ার কিছু নেই
 এই কথাগুলি শুনে  গিলগামেশের সাহস বেড়ে গেল। উত্তরে বললেন, জলদি, আমার পাশে এসে দাঁড়াও।  ওর দিকে নজর রাখো। ও যেন অরন্যে লুকিয়ে না পড়ে। তাহলে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হবে। আপাতত ও তার সাত বিস্ময়কারী ক্ষমতার প্রথমটা প্রয়োগ করেছে।  এখনো বাকি আছে ছটা ও সশস্ত্র হওয়ার আগেই চলো ওকে ফাঁদে ফেলা যাক
এসব কথা শুনে অরন্যের রক্ষক বুনো ষাঁড়ের মত দাপিয়ে উঠল। চিৎকার করে জানান দিল তার তরফের সতর্কতা। মাথা ঝুঁকিয়ে, ভয়ানক ভাবে আন্দোলিত করে সে গিলগামেশকে দেখল । সেই দৃষ্টিতে মৃত্যুর শীতলতা। গর্জন করল গিলগামেশকে উদ্দেশ্য করে।    
তখন গিলগামেশ অশ্রু ভরা দৃষ্টিতে মহান  শামাশকে আহ্বান করে বল লেন  , 'হে মহিমান্বিত শামাশ, আপনি যে আদেশ দিয়েছেন আমি সেই পথ অনুসরণ করেছি, কিন্তু এখন যদি আপনি কোন সহায়ককে না পাঠান তাহলে এ বিপদ থেকে কিভাবে রক্ষা পাব?”
  মহিমান্বিত শামাশ তাঁর প্রার্থনা শুনে  ডেকে পাঠালেন উন্মত্ত বাতাস, উত্তরে বাতাস, ঘূর্ণিঝড়,   বরফ শীতল বাতাস এবং উত্তপ্ত  বাতাসকে। তারা ধেয়ে এল ড্রাগনের মতো, জ্বলন্ত আগুনের মতো, বিশালকায় সাপের মতো,  রক্ত জল করে দেওয়া হিমশীতল চাহনির মতো,  ধ্বংসকারী বন্যার মতো এবং বুক কাঁপানো বিদ্যুত ঝলকের মতো আট  প্রকারের বাতাস  আক্রমণ করল হুমবাবাকে। ধাঁধিয়ে দিল তার দৃষ্টি। আটকে রেখে দিল এক জায়গায় ।  সেই বিশাল দানব না পারছিল এগোতে, না পারছিল পিছিয়ে যেতে। 
 গিলগামেশ চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমার মাতা নিন্সান এবং  পিতা ঐশ্বরিক লুগলবান্দার দিব্যি করে বলছি, আমার প্রাণোচ্ছল নগরের প্রতিনিধি রূপে,  আমি তোর বাসস্থান খুঁজে বার করেছি। আমার  স্বল্প ক্ষমতা এবং সামান্য ক্ষুদ্র অস্ত্র নিয়েই আমি এই এলাকায় এসেছি তোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। এবার আমি তোর বাসস্থানে প্রবেশ করবো।”


কথা শেষ করেই গিলগামেশ একটা সিডার গাছ তার অস্ত্রের আঘাতে ভুপাতিত করে পাহাড়ে পা রাখলেন।  এটা দেখে হুমবাবা আগুন ঝরা চোখে ওদের দিকে তাকাল । কিন্তু ওরা তাতে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ওরা আরো সাতটা সিডার গাছ কেটে পাহাড়ের নিচে ফেলে দিল। প্রত্যেকবার  হুমবাবা রাগে গর্জন করে উঠল। আগুনের হল্কা ধেয়ে এলো তার নিঃশ্বাস বেয়ে।   এভাবে পর পর সাতবার হুমবাবা তার ক্রোধ বর্ষণ করার পর ওরা  পৌছে গেল হুমবাবার কাছে।  হুমবাবা রাগের চোটে নিজের উরুতে সজোরে এক চাপড় মারল  দানবটাকে দেখে মনে হচ্ছিল এক বিশাল আকৃতির ষাঁড়কে যেন কেঊ পাহাড়ের গায়ে বেঁধে রেখেছে। যে চেষ্টা চালাচ্ছে বন্ধন ছিন্ন করার।  অথবা এমন এক যোদ্ধা যার কনুই দুটো বেঁধে দেওয়া হয়েছে । কিছু করতে না পেরে অসহায় ভাবে অশ্রু বর্ষণ করতে করতে সেই দানব বলল,  ' হে গিলগামেশ, আমাকে কথা বলতে দাও আমি জানিনা কে আমার মাতা, কেই বা আমার পিতা। কেউ আমাকে লালন পালন করেনি। আমি এই পর্বতেই জন্মেছি। সেই  আমাকে লালনপালন করেছে। মহান এনলিল আমাকে এই বনের রক্ষক বানিয়েছি্লেন আমাকে মুক্তি দাও, গিলগামেশ, আমি তোমার গোলাম হয়ে থাকব।   তুমি হবে আমার প্রভুএই পাহাড়ে যত গাছ আমি বাঁচিয়ে রেখেছি সে সবের মালিক হবে তুমি।  আমি সব কেটে ফেলব এবং তোমাকে একটি প্রাসাদ বানিয়ে দেব ''
এরপর সে নিজে পথ দেখিয়ে গিলগামেশকে নিজের বাসস্থানে নিয়ে গেল।  ফলে গিলগামেশের হৃদয়ে জন্ম নিল সহানুভূতিতিনি স্বর্গীয় জীবন, পার্থিব জীবন, পাতালের নামে  শপথ নিয়ে বললেন  “ বন্ধু এনকিডু, জালে আটকে পড়া পাখির তার বাসায় ফিরে যাওয়ার  বা কারাগারে আবদ্ধ বন্দীর তার মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার সূযোগ পাওয়া কি উচিত নয় ?
 এনকিডু জবাব দিলেন, “সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষও যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন তাহলে তিনি দুর্ভাগ্যের মারে কাবু হয়ে যান। নামতার নামের সেই দুষ্ট ভাগ্য, কোনো বাছ বিচার করে না, সবাইকে গিলে খায় । যদি ফাঁদে আটকে যাওয়া পাখি বা কারাগারের বন্দী তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে সক্ষম হয়, তাহলে শুনে রাখুল বন্ধু গিলগামেশ আপনি আর নিজের  শহরে ফিরে যেতে পারবেন নাযেখানে আপানার জন্মদাত্রী মা আপনার জন্য অপেক্ষায় আছেন।  একবার সুযোগ পেলে ওই দানব পাহাড়ে আপনার রাস্তা আটকাবে এবং সমস্ত পথ করে দেবে দুর্গম
হুমবাবা বললেন, 'এনকিডু, তুমি যা যুক্তি দিচ্ছ তা মোটেই ভালো নয় । তুমি নিজে তো একজন  ভাড়াটে সেনা।  প্রভুর ওপর নির্ভরশীল রুটিরুজির জন্য! ঈর্ষায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর ভয়ে তুমি যা নয় তাই  খারাপ কথা বলে যাচ্ছ । ''
এনকিডু বললেন, ' ওর কথা শুনবেন না বন্ধু , গিলগামেশ এই হুমবাবার মৃত্যু হওয়া দরকার।  আগে ওকে হত্যা করো তারপর ওর সহচরদের খতম করব।”
 গিলগামেশ বললেন, “আমরা যদি ওকে  এই অবস্থায় হত্যা করি তাহলে  আমাদের মনেই তো সংশয়ের জন্ম হবে। সঠিকার্থে লাভ হবে কি? মানসিক সন্তুষ্টির উজ্জ্বল রশ্মিতো নিভে যাবে
এনকিডু গিলগামেশকে বললেন, “ হে  বন্ধু, মোটেই না প্রথমে পাখিটিকে ফাঁদে ফেলুন। তাহলে তার বাচ্চারা কোথায় পালাবে? এদিকে সেদিকেই লুকিয়ে থাকবে ।   আসল কাজ সমাধা করে  আমরা সেই সব গৌরব এবং ঐতিহ্যের  অনুসন্ধান করব। যা আমাদের ভুষণ হবে।”
গিলগামেশ তার সঙ্গীর কথাকেই গুরুত্ব দিলেন।  উঠালেন কুড়ুল,  কোষমুক্ত করলেন
তরোয়াল তারপর সময় নষ্ট না করে হুমবাবার কাঁধে আঘাত করলেন প্রায় একই সাথে এনকিডুও আক্রমণ করলেন  এরপর আরো একবার যৌথ আক্রমণ হতেই   হুমবাবা পড়ে গেল সত্যি সত্যিই তারা  বনের অভিভাবক দানবটাকে ভুপাতিত করতে পেরেছেন এটা ওদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। যার কণ্ঠস্বর শুনে হার্মান এবং লেবানন কেঁপে ওঠে সেই বনের প্রহরীকে   এনকিডু যখন ধরাশায়ী করলেন তখন আশেপাশের দুই লিগ ব্যাপি অঞ্চলের সমস্ত সিডার গাছ থর থর করে কেঁপে উঠল কেঁপে উঠল পাহাড় গড়িয়ে পড়ল বড় বড় নুড়ি পাথর সিডার বনের রক্ষক নিহত হুমবাবার সাত  ক্ষমতার আর কোনো অস্তিত্ব রইলো না এটা বুঝে দুই বন্ধু তাদের আট ট্যালেন্ট দীর্ঘ তরোয়াল দিয়ে সিডার গাছ কাটতে শুরু করলেন গিলগামেশ এক এক করে ভুপাতিত করছিলেন গাছগুলোকে আর এনকিডু উঠিয়ে ফেলে দিচ্ছিলেন সেই সব গাছের শিকড় সহ বাকি অংশকে, যা মাটির তলা দিয়ে ইউফ্রেতিস নদীর এলাকা অবধি চলে গিয়েছিল এভাবেই তারা উন্মুক্ত করলেন পবিত্র আনুনাকির বাসস্থান   
 এরপর ওরা হুম বাবার মাথা কেটে মহান এনলিলের সামনে পেশ করলেন এবং অস্ত্র শস্ত্র নামিয়ে রেখে ভুমি চুম্বন করলেন । এনলিল হুমবাবার কাটা মস্তক  দেখে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। জানতে চাইলেন, “কেন তোমরা এই কাজ করলে? এখন থেকে তোমাদের মনে এই অনৈতিক কাজের তাপ প্রবাহ সব সময় প্রজ্জ্বলিত থাকবে  যে রুটি তোমরা খাবে বা যে হল তোমরা পান করবে সবেতেই থাকবে তার ছোঁয়া।”  
মহান এনলিল এবার হুমবাবাকে প্রদান করা তেজ এবং সাত বিশেষ ক্ষমতা ফিরিয়ে নিলেন।  প্রথম ক্ষমতাটিকে তিনি দিয়ে দিলেন নদীকে। তারপর এক এক করে সিংহকে, শিলালিপিকে,  পাহাড়কে এবং নরকের রানির ভয়ঙ্কর কন্যাকে দান করে দিলেন বাকি ক্ষমতাগুলো
হে গিলগামেশ, ভয়ংকর আগুন, পাহাড় দাপিয়ে বেড়ান ষাঁড়ের মত দানবকে পরাহত করা সম্রাট  যিনি সমুদ্রকে অতিক্রম করেন, তার গৌরবের সাথে জড়িয়ে থাকল এনকিডুর গৌরবাহ্নিত সাহসিকতার গাথা 
দ্বিতীয় অধ্যায়
অরণ্য সফর
দেবতাদের পিতা পর্বতের অধিবাসী এনলিল গিলগামেশর ভাগ্য নির্ধারণ করছিলেন তারই সুত্রে গিলগামেশ একটি স্বপ্ন দেখলেন এবং এনকিডুকে  তার বিবরণ শোনালেন।  এনকিডু  বললেন, “ হে গিলগামেশ, এই স্বপ্নের অর্থ, দেবতাদের পিতা আপনাকে রাজত্ব প্রদান করেছেনঅধিকার দিয়েছেন শাসন করার । এটাই আপনার নিয়তি চিরস্থায়ী অমর জীবন আপনার ললাটলিখন নয় এই কথা শুনে  মনকে দু: খিত করবেন না, শোক করবেন না বা অবসাদে ভেঙে পড়বেন না। তিনি আপনাকে একইসাথে সবকিছু একত্র করার এবং বিলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন। আপনি একইসাথে মানবজাতির জন্য  অন্ধকার এবং ঐশ্বরিক আলোর সমান । তিনি আপনাকে জনগণের উপর আধিপত্য করার সীমাহীন ক্ষমতা দান করেছেন । যে যুদ্ধ থেকে একজনও পরাজিত পালিয়ে যেতে পারে না, এমন বিজয়গৌরব লাভের সুযোগ প্রদান করেছেনকিন্তু হে গিলগামেশ এই শক্তিকে অপব্যবহার করবেন না আপনার পরিচারক কর্মচারীদের সাথে প্রাসাদে ন্যায়বিচার করুনশামাশের সম্মুখে নিজেকে  ন্যায়দাতা রূপে প্রতিষ্ঠিত  করুন
এই কথাগুলো বলতে বলতে এনকিডুর চোখ ভিজে গিয়েছিল অশ্রুধারায় । মুখে ফুটে উঠেছিল ব্যাথার ছাপ। একটা তীব্র দীর্ঘশ্বাস ফেলেন উনি।   গিলগামেশ সেটা দেখে জানতে চান, ' হে বন্ধু, তুমি এত কাতর  দীর্ঘশ্বাস কেন ফেলছ?
 এনকিডু উত্তরে বললেন, “আমি নিজেকে দুর্বল অনুভব করছি। আমার বাহু শক্তি হারিয়েছেদুঃখ দলা পাকিয়ে আটকে আছে আমার গলার ভেতরে । আমি অলসতার দ্বারা নিপীড়িত বোধ করছি
তখন মহান  গিলগামেশের  ভাবনামুখ নিজ রাজ্য ও দেশবাসির প্রতি আকৃষ্ট হল। সিডার[দেবদারু গাছ] বনভুমির দিকে তাকিয়ে তার নতুন বন্ধু তথা সহায়ক এনকিডুকে বললেন, ' যেহেতু নিয়তির আদেশ অনুসারে আমার ভাগ্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে, তাই আজ অবধি আমি কোথাও  আমার নাম কোনোভাবেই উৎকীর্ণ করার চেষ্টা  করিনিএবার আমি সেই সমস্ত স্থানে যাব যেখানে বনভুমি পরিষ্কার করে নতুন বাসস্থান স্থাপিত হয়েছে।   সেখানে আমার নাম স্থাপন করব যেখানে ইতিহাস বিখ্যাত পুরুষদের নাম খোদিত হয়েছে তোরনে । আর যেখানে কোনও মানুষের নাম লেখা নেই সেখানে স্থাপন  করব দেবতাদের স্মৃতিস্তম্ভতার সাথেই এবার আমরা অরন্যে সফর করব। ধ্বংস করব সেই  দুষ্ট শয়তানকে । যার নাম  হুমবাবা যার নামের অর্থ ’বিশালতা’ সে এক অতি হিংস্র দৈত্য
এই কথা শুনে  এনকিডু পুনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 'আমি যখন বুনো জন্তুদের সাথে অরন্যে বসবাস করতাম তখনই ওই অরণ্য আমি ঘুরে দেখেছি। এই অরন্যের সব দিকে দশ হাজার লিগ  [ তিরিশ হাজার মাইল] বিস্তৃত । মহান এনলিল এই অরণ্য রক্ষার জন্য হুমবাবাকে নিযুক্ত করেছিলেন।  তাকে সাজিয়ে দেন আতঙ্কের নানান সামগ্রী দিয়ে।  এমন আতঙ্ক যা যে কোনো জীবিত প্রানীর রক্ত জল করে দিতে সক্ষম। সে যখন গর্জন করে তখন তা সামুদ্রিক ঝড়ের শব্দের  মতো শোনায়তার শ্বাসপ্রশ্বাস আগুনের সমান।   তার চোয়ালের কাছে যাওয়ার অর্থ নিজে মৃত্যুকে ডেকে আনা তার শ্রবন শক্তি এত ভালো যে কোনো বাছুর যদি ষাট লিগ দূর থেকেও ডাকে সে শুনতে পায় তার আওয়াজ। এসব জেনে কার আর সাহস হবে  ওই অরণ্যর গভীরে পদার্পণ করার?  আমি এটাও শুনেছি, যে ওর কাছে  যায় তাকেই  দুর্বলতা গ্রাস করেএই কারনেই কেউ যখন হুমবাবার সাথে লড়াই করার চেষ্টা করে সেটা সঠিক মাত্রার  সংগ্রাম হয় না মোটেই। সে একজন দুর্দান্ত যোদ্ধা  সবকিছু তছনছকারী এক শক্তি। আরো শুনে রাখুন হে   গিলগামেশ, বনের ওই প্রহরী কখনও ঘুমায় না
গিলগামেশ এসব কথা শুনে বললেন, “স্বর্গে সহজে স্থান লাভ করে এমন কাউকে দেখেছ কি?   কেবলমাত্র দেবতারাই গৌরবময় শামাশের সাথে চিরকাল বেঁচে থাকেনআর আমাদের মত মানূষের জন্য জীবনকাল নির্ধারণ করে রাখাই আছে । আমাদের জীবন যাপন বাতাসের একটা ঝাপটের মত এসব কি তোমার জানা নেই? তাহলে কেন আগে থেকেই ভয় পাচ্ছ ! যদিও আমি তোমার প্রভু তবু চিন্তা নেই, আমিই আগে যাব ওই অরন্যে। তুমি  নিরাপদ অনুভব করলে হাঁক দেবে, ‘সামনে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই!  এরপরে যদি আমি হেরে যাই বা মরে যাই,  তাহলে আমার নাম স্থায়ী হয়ে থেকে যাবে।  মানুষেরা আমার সম্পর্কে বলবে, " গিলগামেশ সেই জন যে হিংস্র হুমবাবার সাথে লড়াই করতে গিয়ে প্রান দিয়েছে অনেক অনেক যুগ পড়া করেও যখন আমার  পরিবারে নতুন প্রজন্ম আসবে, তখনো তারা আমার সাথে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা স্মরণ করবে
এনকিডু  এবার গিলগামেশকে বললেন, 'হে প্রভু, আপনি যদি নিতান্তই ওই এলাকায়  প্রবেশ করবেন মনস্থ করে থাকেন, তাহলে এই সিডার গাছের  এলাকার মালিক যিনি, সেই সূর্য দেবতা মহান শামাশের কাছে সবার আগে  যান
গিলগামেশ একহাতে একটি দাগহীন সাদা এবং একটি বাদামী রঙের ছাগলছানা বুকের কাছে চেপে ধরে সূর্যালোকে গিয়ে দাঁড়ালেন অন্যহাতে রৌপ্য রাজদণ্ডটি চেপে ধরে  গৌরবময় শামাশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে মহান শামাশ, আমি আপনার অধিক্রিত এলাকায় প্রবেশ করতে চলেছি আমি জোড় হাত করে প্রার্থনা করছি আমার আত্মার যেন কোন ক্ষতি না হয়  আমি যেন আবার উরুকের ছায়ায় ফিরে আসতে পারি  আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করুন, আমি আপনার প্রদান করা সুরক্ষা চাই, শুভকামনা চাই
 গৌরবময় মহান শামাশ উত্তর দি্লেন, “গিলগামেশ, তুমিতো শক্তিশালী তাহলে আবার এসব প্রার্থনা করা কি কারন?”
 হে মহান শামাশ, শুনুন,  আমার কথা শুনুন এখানে নগরে মানুষ অবসাদগ্রস্থ হৃদয়ে  মারা যাচ্ছে  মানুষ তার মনে হতাশায় জর্জরিত হচ্ছে   আমি দেখেছি প্রাচীরের ওপাড়ে মানুষের শবদেহ  নদীর উপর ভাসছে  সেখানে আমার নগরের মানুষও আছে   আমি জানি  সবচেয়ে লম্বা মানুষ স্বর্গের নাগাল পায় না  সবচেয়ে বিশালকায় মানুষের ক্ষমতা নেই পৃথিবীকে পরিবেষ্টন করার সেই স্বরগকে নাগালের ভেতর পাওয়ার  জন্যই এবার  আমি ওই এলাকায় প্রবেশ করব কারণ আমি আমার ভাগ্যবলে চিহ্নিত তাই আজ অবধি কোনো স্থানে  আমার নাম খোদাই করিনি এবার আমি সেস্খানেই যাব যেখান থেকে সিডার গাছের কাঠ সংগ্রহ করা হয়  আমি এবার সেই খিলানে নাম খোদাই করাবো যেখানে বিখ্যাত মানুষদের নাম খোদাই করা হয়  আমি সেখানে একটি   স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করব দেবতাদের উদ্দেশ্যেআবেগে গিলগামেশের চোখ দিয়ে  অশ্রু নির্গত হল হায় ভাগ্য, জানিনা কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমাকে  হুমবাবার এলাকায় পৌছাতে  হবে এই উদ্যোগটি যদি সাধিত না হয়, তবে হে মহান শামাশ,  কেন আপনি আমার মনে এই   আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করেছেন?   আমি কিভাবে সফল হতে পারি, যদি আপনি আমাকে সফলতা প্রদান না করেন ? আমি যদি ওই এলাকায় গিয়ে মারা যাই তাহলে তা নিয়ে আফশোস কিছু থাকবে না আর যদি আমি ফিরে আসি তবে মহান শামাশের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরুপ আমি সেরা  উপহার পেশ করব ''
অগত্যা শামাশ গিলগামেশের  কান্না ভেজা আবেদন  স্বীকার করলেন  করুণাময় মানুষের মতই তাকে করুণা প্রদান করলেন গিলগামেশের জন্য তিনি শক্তিশালী বাহিনীকে নিযুক্ত করলেন যারা ছিল জনৈক  মাতার পুত্র তাদের উনি পর্বতের গুহাগুলি পাহারার দায়িত্ব দিলেন বিভিন্ন   দুর্দান্ত শক্তির বাতাসেরাও নিযুক্ত হল তার নির্দেশে    উত্তরের বাতাস, ঘূর্ণিঝড়, সাধারন ঝড় এবং বরফ শীতল বাতাস, পাহাড়ী ঝড় এবং সামুদ্রিক বাতাস সবাই একত্রিত হল যারা সাপের মতো, ড্রাগনের মতো, জ্বলন্ত আগুনের মতো ক্ষমতার অধিকারী  যাদের আক্রমণ হৃদয়কে হিমশীতল করে দিতে পারে গিলগামেশ আনন্দিত হলেন এটা দেখে যে,  তাকে সাহায্য করতে বিধ্বংসী   বন্যা এবং বিদ্যুতের ফলাকেও  নিযুক্ত করলেন মহান শামাশ   
গিলগামেশ এবার কামার শালায় গিয়ে আদেশ দিলেন, “ আমাদের জন্য অস্ত্র নির্মাণ কর অস্ত্র নির্মাতা কারিগরেরা নিজেদের ভেতর আলাপ আলোচনা করে চলে গেল  সমতলভুমির অরন্যে  সেখান থেকে দরকার মত কাঠ কেটে নিল নয় স্কোর বা একশো আশি পাউন্ড ওজনের কুঠার বানানোর জন্যনির্মাণ করল ছয়টি স্কোর পাউন্ডের দুর্দান্ত তরোয়াল যার সাথে  ছিল ত্রিশ পাউন্ড ওজনের হাতল এবং খাপ  তারা গিলগামেশের জন্য বিশেষ ভাবে নির্মাণ করল 'বীর শক্তিকুঠার এবং আনশান ধনুক  এভাবেই সংগ্রামের জন্য তৈরি হলেন গিলগামেশ   এবং এনকিডু   
সাত কীলকের বিশাল দরজার নিকটে বাজার চত্বরে উরুকের সমস্ত মানুষ সমবেত হল, গিল গামেশের যুদ্ধ যাত্রা দেখার জন্য গিলগামেশ তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,  'আমি, গিলগামেশ, সেই ভয়ানক প্রাণীটির সন্ধানে যাচ্ছি   যার সম্পর্কে চারদিকে নানান  গুজব শোনা যাচ্ছে আমি ওই সিডারের অরন্যেই  ওকে ভুপাতিত করব দেখিয়ে দেব উরুকের মানুষের শক্তি    সমস্ত পৃথিবীও সেটা দেখতে পাবে  আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই উদ্যোগ সফল করার জন্য ওই পাহাড়ে আরোহন করে, সিডার গাছ কেটে আমি নিজের নাম চিরস্থায়ী করে রেখে যাব 
 বাজারে উপস্থিত উরুকের পরামর্শদাতারা তাকে বলল, ‘হে, গিলগামেশ, আপনি যুবক, আপনার সাহস আপনাকে বহুদূর নিয়ে যাবে  আপনি জানেন না, যে উদ্যোগ আপনি করছেন, যে   পরিকল্পনা আপনি সাজিয়েছেন, তার ফলাফল কী হতে পারে   আমরা শুনেছি হুমবাবা সাধারন মানূষের মতো নয় তার নাকি মৃত্যু নেই   তার অস্ত্রগুলি এমনই যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না  ওই অরণ্য প্রতিটি দিকে দশ হাজার লিগ করে  প্রসারিত  কে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করার জন্য ওই গভীর অরন্যে অন্বেষণ করার কথা ভাবে? হুমবাবার গর্জন ঝড়ের গর্জনের স্মতুল  তার নিঃশ্বাস আগুনের মতো এবং তার চোয়ালসহ দাঁত সাক্ষাৎ মৃত্যুর প্রবেশদ্বার হে গিলগামেশ  কেন আপনি এই জিনিসটি করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন? ঐ মৃত্যুদূত হুমবাবার সাথে লড়াই যে  অসম লড়াই, আপনি কি জানেন না!”
 পরামর্শদাতাদের এই কথাগুলো শুনে গিলগামেশ তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “আমি এসব কথার কী উত্তর দেব ওদের? আমি কি বলব যে, আমি হুমবাবাকে ভয় করি? জীবনের বাকি দিনগুলো সেই ভয়ে নিজের ঘরে বসেই কাটিয়ে দেব?”
গিলগামেশ এনকিডুর উদ্দেশে বললেন,  'হে বন্ধু, চলুন আমরা আমাদের প্রাসাদ  এগালমাতে যাই ওখানে আছেন নিন্সান রানী নিন্সান গভীর জ্ঞানের অধিকারিনী তার কাছ থেকেই যেনে নিই আমাদের যাত্রাপথের পরামর্শ উনিই জানিয়ে দেবেন কিভাবে কি করতে হবে
 ওরা এক অপরের হাত ধরে একসাথে  এগালমায় গেলেন এবং মহান রানী নিন্সানের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার জন্য  গিলগামেশ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন এবং নিন্সানকে বললেন,  মাতা নিন্সান মন দিয়ে আমার কথা শুনুন  আমরা এক দীর্ঘ সফরে যাচ্ছি হুমবাবার এলাকায়      অজানা পথ পাড় করে সেখানে  এক অদ্ভুত লড়াইয়ের সম্মুখীন হওয়ার জন্য  সফর শুরু করা থেকে ফিরে আসা অবধি, সিডারের অরন্যে প্রবেশ করা থেকে সেই শয়তানকে, যাকে শামাস স্বয়ং ঘৃণার চোখে দেখেন,  হত্যা করা অবধি আপনি আমার জন্য মহান শামাশের কাছে প্রার্থনা করবেন!”    
নিন্সান এসব কথা শুনে তার ঘরে ফিরে গেলেন পড়লেন এক সুন্দর পোশাক স্তনদ্বয়কে সজ্জিত করলেন মূল্যবান  গহনা দ্বারা   মাথায় পড়লেন টায়রা  পোশাকের নিম্নদেশ স্পর্শ করে থাকল জমিকে সজ্জিত হয়ে ইনি উঠে গেলেন প্রাসাদের ছাদে উপস্থিত হলেন সূর্য দেবতার বেদীর নিকটে প্রজ্জ্বলিত করলেন ধূপ  তার ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠতে শুরু করার সাথে সাথে নিন্সান উপরের দিকে   হাত তুলে বললেন,  'হে শামাশ, আপনি কেন আমার পুত্র গিলগামেশকে এইরূপে অস্থির করে তুলেছেন  ? আপনার ইচ্ছাতেই সে এখন মানসিক ভাবে প্রস্তুত দীর্ঘ সফরের জন্য সে যাচ্ছে হুম বাবার এলাকায়  অজানা পথ পাড়ি দিয়ে সে চলেছে   অদ্ভুত এক সংগ্রাম করতে  অতএব তার যাত্রার শুরু থেকে ফিরে আসা অবধি, সেই সিডারের অরন্যে প্রবেশ করা, যাকে আপনি ঘৃণা করেন সেই শয়তানকে খুঁজে বের করা, এবং তাকে হত্যা করা অবধি অনুগ্রহ করে তাকে বিস্মৃত হবেন না আপনার সহধর্মিণী  আয়া যেন প্রতিদিন ভোরে তার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দেয় রাত হলে তাকে রক্ষা করার দায়িও প্রদান করবেন রাতের প্রহরীর হস্তে তার যেন কোন  ক্ষতি না হয়
এরপরে গিলগামেশের মাতা নিন্সান  প্রজ্জ্বলিত ধূপ নির্বাপণ কবাপ এবং এনকিডুকে  ডাকলেন তাকে উপদেশ প্রদান করলেন,  হে, শক্তিশালী এনকিডু, তুমি আমার দেহজাত সন্তান নও, তবুও আমি তোমাকে গ্রহণ করব আমার দত্তক পুত্ররূপে তুমি আমার সেই সন্তানদের মত যাদের  মন্দিরে খুঁজে পাওয়া যায়   মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রূপে যেভাবে  গিলগামেশের সেবা করেন করা  যাজক পুরোহিতেরা, সেভাবেই তুমি তার দেখাশোনা করবে  এই স্থানে উপস্থিত সমস্ত মানুষ, সমস্ত মহিলা, সমস্ত পুরোহিত এবং সমস্ত যাজকদের সম্মুখে আমি প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করলাম '' তারপর এনকিডুর গলায় পড়িয়ে দিলেন একটি তাবিজ এবং   বললেন, “আমি ওর রক্ষার দায়িত্ব তোমার উপর অর্পণ করলাম ওকে নিরাপদে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে
এরপর সমস্ত  অস্ত্রশশ্ত্র   তাদের কাছে নিয়ে আসা হল   সোনার খাপবদ্ধ অসাধারন তরোয়াল তারা উঠিয়ে নিলেন হাতে স্পর্শ করলেন ধনুক এবং তীর গিলগামেশ নিলেন কুঠার কাঁধে ঝোলালেন তূণীর  হাতে তুলে নিলেন আনশান ধনুক    কোমর বন্ধনীতে বেঁধে নিলেন  তরোয়াল  সশস্ত্র যোদ্ধারা প্রস্তুত সফরের জন্য   এবার একের পর এক মানুষ এসে তাদের শুভেচ্ছা জানাল জানতে চাইল,  আপনি আবার কবে এই নগরে   ফিরে আসবেন?”
পরামর্শদাতারা গিলগামেশকে আশীর্বাদ করার সাথেই সতর্ক করে দিলেন, “নিজের শক্তির উপর খুব বেশি বিশ্বাস করবেন না সদা সতর্ক থাকবেন   আঘাত পাওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবেন  যে সামনে এগিয়ে যায় সে তার সঙ্গীকে রক্ষা করে ভাল পথ প্রদর্শক জানে কিভাবে তার সাথীকে বাঁচানো যায় এনকিডুকে সুযোগ দিন নেতৃত্ব করার সে ভালো করে চেনে  অরন্যের পথ ঘাট সে  হুমবাবাকেও দেখেছে তাছাড়া তার  অভিজ্ঞতাও আছে যুদ্ধ করার  ওকেই প্রথমে এগিয়ে যেতে দেবেন  ওকে নিজের জন্য সাবধান হতে দিন তবেই  এনকিডু তার বন্ধুকে রক্ষা করতে পারবে  নিরাপদে আবার এই রাজপথে ফিরে আসতেও পারবেন আপনারা হে এনকিডু, আমরা  উরুকের পরামর্শদাতারা আমাদের রাজাকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছি ; ওকে নিরাপদে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আপনার
গিলগামেশকে পুনরায় তারা বলল, “শামাশ আপনাকে আপনার অন্তরের আকাঙ্ক্ষা পুর্ন করার বরদান করুন তিনি আপনাকে সেই শক্তি দিন,  যাতে  নিজের চোখে আপনি  সেই কাজ সম্পন্ন হতে দেখুন যার কথা আপনার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে    তিনি আপনার জন্য সমস্ত  অবরুদ্ধ   পথ খুলে দিন এই কামনা করি  সমস্ত পথ মসৃণ হোক  পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য    আপনার পারাপারের জন্য যেন কোন পর্বত বাধা হয়ে না দাঁড়ায়  সুখদায়ক হয়ে উঠুক দিন শেষের রাত্রিযাপন  অভিভাবক দেবতা লুগলবান্দা বিজয়ের আশীর্বাদ নিয়ে  আপনার পাশে  দাঁড়ান
আপনি পাশে একজন শিশুকে নিয়ে যুদ্ধ করলেও যেন সেই  যুদ্ধে আপনি জয়লাভ করেন      হুমবাবা নদীর জলে ধূয়ে নেবেন আনার পা সন্ধ্যাকালে কূপ খনন করে তার বিশুদ্ধ জলে ধুয়ে ফেলবেন আপনার দেহ ত্বক  শীতল জল উৎসর্গ করবেন মহান দেবতা শামাশকে ভুলে যাবেন না যেন লুগলবান্দার কথাও
অতঃপর এনকিডু বললেন , “চলুন এগোনো যাক সামনে, ভয়ের কিছু নেই আমাকে অনুসরণ
করুন, কারণ আমি জানি যে হুম বাবা কোথায় থাকে এবং কোন কোন  পথে সে ঘুরে বেড়ায়   
হে পরামর্শদাতাগন এবার আপনারা ফিরে যান এখানে ভয়ের কোন কারণ নেই
 পরামর্শদাতারা যখন এই কথা শুনলেন তখন তারা তাদের নায়ককে ওখানেই বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন,  যান, গিলগামেশ, কামনা করি   অভিভাবক ঈশ্বর আপনাকে রক্ষা করুন সত্বর নিরাপদে আপনি উরুকের উপকূলে পুনরায় ফিরে আসুন  
একটানা কুড়ি   লিগ পথ হেঁটে চলার পর ওরা খাদ্য গ্রহণ করলেন এবং আরো তিরিশ লিগ প্তহ পার করে ওরা  রাতে বিশ্রাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন    পঞ্চাশ লিগ পথ তারা একদিনে হাঁটলেন এভাবে   তিন দিনে তারা  এক মাস এবং দুই সপ্তাহের যাত্রাপথ পাড়ি দিলেন  হিসাবে   সাতটি পাহাড় অতিক্রম করে তারা উপনীত হলেন অরন্যের প্রবেশ দ্বারে
এনকিডু গিলগামেশকে ডেকে বললেন, “এই প্রবেশদ্বার খুলতে গিয়ে যদি   আমি ভুপাতিত হই তাহলে আপনি একা একা বনে প্রবেশ করবেন না
গিলগামেশ একথা শুনে তাকে বললেন, 'প্রিয় বন্ধু, কাপুরুষের মতো কথা বোলো না আমরা যে এত বিপদ স্নকুল পথ চরম কষ্ট সহযোগে পাড়ি দিয়ে এলাম, সেটা কী শেষ মুহূর্তে   ফিরে যাওয়ার জন্য? তুমি আমার পাশে থাকো কোনোরকম ভয় পাবে না  মৃত্যুর ভয় পাবে না আমার পাশে থাকলে তোমার দুর্বলতা কেটে যাবে থেমে যাবে হাতের কম্পন। আমি কী আমার বন্ধুকে পিছনে ফেলে চলে যাব? না, আমরা একসাথেই বনের ভেতর প্রবেশ করব আসন্ন যুদ্ধের জন্য তোমার সাহসকে জাগ্রত কর    মৃত্যুর কথা ভুলে যাও এবং আমাকে অনুসরণ কর বোকার মত ভাবনা নিয়ে কেউ কোনো কাজ করে না   দু'জন এক সাথে গেলে একে অপরকে  রক্ষা করতে পারবো আর যদি আমরা হেরেও যাই আমাদের নাম চিরস্থায়ী হয়ে থেকে যাবে ''
ওরা একসাথে অরন্যে প্রবেশ করলেন উপস্থিত হলেন   সবুজ পাহাড়ে  সেখানে দাঁড়িয়ে ওদের বাক্যস্ফুরণ হচ্ছিল না  চুপচাপ দাঁড়িয়ে তারা বিশাল অরণ্যর রুপ দর্শন করছিল দেখছিল সিডার গাছগুলোর উচ্চতা, অরণ্য অভ্যন্তরে প্রবেশের পথ এবং সেই বিশেষ রাস্তা যেখান দিয়ে হুম বাবা যাতায়াত করে    পথটি বিস্তৃত  এবং চলাচলের পক্ষে বেশ ভাল ওরা দেবদারু পর্বতে, দেবতাদের বাসস্থান এবং  ইস্থারের সিংহাসন অবলোকন করলেন  বিশাল বিশাল সিডার গাছ অবস্থান করছে পাহাড়ের সামনের দিকে তাদের সুন্দর, সুশীতল ছায়ায় ঢেকে আছে সবুজ তৃণভূমি   

সেখানেই সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে গিলগামেশ একটি কূপ খনন করলেন উঠে গেলেন পাহাড়ে   সেখানে জমির ওপর বসে ভালো ভালো খাদ্য দ্বারা নিজেদের উদর পূর্তি করলেন  তারপর বললেন, 'হে দেবতাদের বাসভুমি পর্বত! আমার জন্য একটি  অনুকূল স্বপ্ন নির্মাণ করুন  বন্ধুর হাতে হাত রেখে ওরা শুয়ে পড়লেন সংলগ্ন ভুমিতে ওদের চোখে নেমে এলো রাত্রিকালীন ঘুমের ঘোর গিলগামেশ একটি স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে জেগে উঠলেন   বন্ধুকে বললেন,  'এনকিডু, এটা কি হল? তুমি তো আমাকে ঘুম থেকে জাগাওনি!  বন্ধু, তাহলে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম ওই দেখো সুউচ্চ পাহাড় চুড়া ওখান থেকে দেবতারা আমাকে যে ঘুমের জগতে প্রেরণ করেছিলেন তা সমাপ্ত হয়ে গেল  ওহ,  বন্ধু, কি অদ্ভুত সন্ত্রাস এবং বিভ্রান্তি মাখানো স্বপ্ন ছিল সেটা!  আমি অরণ্য প্রান্তরে একটা বুনো ষাঁড় ধরেছিলাম সেই প্রানী দাপাদাপি করে উদ্দামতার সাথে চারিদিকে ধুলা ছিটাচ্ছিল পুরো আকাশ অন্ধকার  হওয়া পর্যন্ত ওটা তার দাপট দেখিয়ে গেল   আমার বাহু যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছিল জিভ অসাড় হয়ে এসেছিল আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলাম ওই সময় কেউ একজন আমাকে তার ভিস্তি থেকে জল পান করাল 
এনকিডু বলল, “প্রিয় বন্ধু, আমরা যে ঈশ্বরের নিকট যাচ্ছি তিনি কোন   বুনো ষাঁড় নন  যদিও তার রুপ রহস্যজনক আপনি যে বন্য ষাঁড়টিকে দেখেছেন তা হ'ল স্বয়ং রক্ষক শামাশ  আমাদের বিপদের মুহূর্তে  উনি আমাদের  হাতে হাত মেলাবেন  যিনি তার ভিস্তি থেকে আপনাকে জল দান করেছেন তিনি  আপনার অভিভাবক ঈশ্বর আপনার রক্ষক  লুগুলবান্দা উনাদের আশীর্বাদের ছায়ায় সংযুক্ত হয়ে আমরা একসাথে এমন একটি কাজ সম্পাদন করব যার খ্যাতি কখনই এ জগত থেকে বিলুপ্ত হবে না ''
গিলগামেশ বললেন, “আমি এরপরেও একটা স্বপ্ন দেখেছি আমরা এমন এক  গভীর গর্তসম পাহাড়ি উপত্যকায় দাঁড়িয়েছিলাম যে, আমাদেরকে জলাভুমির মাছির মতো ছোট দেখাচ্ছিল    হঠাৎ করে আশে পাশের পর্বতমালায় ধ্বস নামল। আমি আঘাত পেলাম এবং আমার পা কেউ যেন নীচ থেকে চেপে ধরেছিল তারপরেই একটি অসহনীয় আলোয় উদ্ভাসিত হল চারপাশ যার ভেতর থেকে এমন একজন কে দেখা গেল যার সপ্রতিভতা এবং সৌন্দর্যর তুলনা এ জগতে নেই।  তিনি  আমাকে পাথরের নীচে থেকে টেনে তুললেন।  আমাকে জল  পান করালেন। আমার ব্যথিত হৃদয় এবং  মন সান্ত্বনা পেল তার অনুগ্রহে এবং তিনিই আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন।”
একথা শুনে সমভূমির সন্তান এনকিডু ঈশ্বরসম তরুণ গিলগামেশকে বললেন, “আসুন আমরা পাহাড় থেকে নিচে নেমে যাই এবং এ বিষয়ে আলোচনা করি। আপনার স্বপ্ন খুবই ভালো ইঙ্গিত বাহী।   আপনার স্বপ্ন অসাধারন। আপনি যে পাহাড়টিকে দেখেছেন সেই হল হুমবাবা বোঝাই যাচ্ছে আমরা তাকে  মেরে ফেলতে সক্ষম হব এবং ওর শরীরটাকে ছুড়ে ফেলে দেব ঠিক যেমনভাবে পর্বতটি  সমতলে ধ্বসে পড়ে গেল। ''
পরের দিন আরো কুড়ি লিগ পথ পার করার পর ওরা প্রথম খাদ্য গ্রহণ করলেন। তারপর আরো   তিরিশ লিগ পথ পাড়ি দিয়ে থামলেন নৈশকালীন বিশ্রামের জন্য।  সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে উভয়ে মিলে  আবার একটি কূপ খনন করলেন এবং জমিতে উপাদেয় খাদ্যাদি রেখে গিলগামেশ বললেন, “হে পর্বত, দেবতাদের বাসস্থান, আজ এনকিডুর জন্য একটি স্বপ্ন প্রেরণ করুন
পর্বত এন কিডুর জন্য স্বপ্ন প্রেরণ করল। সে স্বপ্ন এল এক অশুভ স্বপ্ন রূপে।  এক শীতল বৃষ্টি ধারা এনকিডুকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। কাঁপিয়ে দিয়ে গেল ঠিক যেমন ভাবে পাহাড়ি বৃষ্টিতে কাঁপতে কাঁপতে নুয়ে যায় পাহাড়ি শস্য   ওদিকে গিলগামেশ  হাঁটুতে চিবুক রেখে বসে রইলেন যতক্ষন না তার চোখে নেমে এল ঘুমের ছায়া । মধ্যরাতে সহসাই তার ঘুম ভেঙে গেল।   তিনি উঠে তার বন্ধুকে বললেন, “তুমি কি আমাকে ডাকলে? তা না হলে আমার ঘুম ভেঙে গেল কেন? তুমি কি আমাকে ছুঁয়েছিলে তা না হলে আমার মনে এ কিসের  আতঙ্ক? দেবতারা কি  আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন, তা না হলে   আমার অঙ্গ প্রত্যয়ে ভয়ে অসাড় হয়ে গেল কেন ? হে বন্ধু, আমি তৃতীয় স্বপ্ন দেখলাম এবং এই স্বপ্নটি পুরোপুরি ভয়াবহ ছিল আকাশ থেকে ভেসে আসছিল গর্জন  গর্জন শোনা যাচ্ছিল পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকেও।    দিবালোক নির্বাপিত হল   নেমে এল অন্ধকার  বিদ্যুৎ চমকে উঠল জ্বলে উঠল আগুনমেঘ নেমে এল অনেক নীচে তারা মৃত্যু বৃষ্টি করল বিদায় নিল উজ্জ্বলতা  নিভে গেল আগুন চারদিকে শুধুই পোড়া ছাইয়ের স্তুপ। চলো, আমরা এই পাহাড় থেকে নেমে যাই তারপর এ বিষয়ে আলোচনা করিএবার আমাদের কি করা উচিত তা বিবেচনা করা দরকার। ''
পাহাড় থেকে নেমে আসার পর  গিলগামেশ  তার কুঠার দিয়ে একটি সিডার গাছ কাটলেন। সেই বিশাল বৃক্ষের পতনের শব্দ কানে গেল হুমবাবার। শোনা গেল তার ক্রোধান্বিত   চিৎকার  বলল, “কে সেই অর্বাচীন যে আমার এলাকায় প্রবেশের সাহস দেখিয়েছে? আমার অরন্যের গাছ কাটছে?
ওদিকে গৌরবময় শামাশ স্বর্গ থেকে গিলগামেশদের ডেকে বললেন, “এগিয়ে যাও, ভয় কোরো না
কিন্তু গিলগামেশ সহসাই আচ্ছন্ন হলেন  দুর্বলতায়গভীর ঘুমের ঘোর নেমে এল তার চোখে।    নির্বাকভাবে মাটিতে শুয়ে পড়লেন উনি।  যেন চলে গেছেন স্বপ্নের জগতে। এনকিডু তার শরীর স্পর্শ করলেন তবুও তিনি উঠলেন না অনেকবার ডাকলেন কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না  “ হে  গিলগামেশ, কুল্লাব সমভূমির প্রভু, পৃথিবীর অন্ধকারে বেড়ে যাচ্ছে,  ছড়িয়ে পড়ছে ছায়ার চাদর,   সন্ধ্যা সমাগত শামাশ চলে গেছেন, তাঁর উজ্জ্বল মস্তক এই মুহূর্তে তাঁর মা নিনগালের কোলে হে গিলগামেশ, আপনি আর কতক্ষণ এভাবে ঘুমের ঘোরে শুয়ে থারেন? যে মা আপনাকে জন্ম দিয়েছে্ন তাকে  নগর চত্বরে শোকে বিহ্বলা অবস্থায় আসতে দেওয়া কিন্তু উচিত হবেনা।”     
এইবার গিলগামেশের নিদ্রা ভঙ্গ হল।  তিনি তার বক্ষ আবরণকারী ‘নায়কদের আওয়াজ’ নামে খ্যাত বর্ম হাতে তুলে নিলেন। ত্রিশ শেকেল [১ শেকেল= ২৫২ রতি] ওজনের বর্মটিকে  এমনভাবে উঠালেন যেন ওটা একটা হালকা পোশাকবর্মটি তার শরীরকে সুরক্ষা প্রদান করল। দাঁত কিড়মিড় করে উনি সজরে জমিতে পদাঘাত করলেন, যেভাবে মত্ত  ষাঁড় জমিতে পা ঠোকে।  “যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন এবং আপন ক্রোড়ে ধারন করেছেন সেই নিন্সান এবং যিনি আমাকে জীবন দিয়েছেন সেই ঐশ্বরিক পিতা লুগলবান্দার দিব্যি।” পর পর দুবার এ কথা উচ্চারণ করে তারপর বললেন, “ যতক্ষণ না আমরা এই মানুষটির বিরুদ্ধে লড়াই করছি,  অবশ্য সে যদি মানুষ হয় তবেই, আমি পিছু হটবো না। যদি ঈশ্বর বাক্য মিথ্যা হয়, তাহলে আমি যেস্থানে বসবাস করতাম সেই নগরীতে আর ফিরে যাবোনা।”   
তখন তার বিশ্বস্ত সহচর এনকিডু তাকে অনুরোধসূচক ভাবে বললেন,   'হে আমার প্রভু, আপনি   এই দানবটির বিষয়ে কিছুই জানেন নাআর সেই কারনেই  আপনি ভয় পাচ্ছেন না আমিই সেই যে ওকে জানি সেই জন্যই আমি  আতঙ্কগ্রস্ত তার দাঁত ড্রাগনের মতো  তার মুখ সিংহসম।  তার হাঁটাচলা বন্যার স্রোতের মত।  তার চেহারার স্পর্শে অরন্যের গাছ নুয়ে পড়ে জলাভুমির শর কাঠির মত।  হে প্রভু, আপনি যদি চান আপনি ওই এলাকায় প্রবেশ করতেই পারেন। কিন্তু   আমি ফিরে যাব নগরে। সেখানে গিয়ে আপনার  মাকে আপনার সমস্ত মহিমান্বিত কাজের বিবরণ শোনাবো ।  যতক্ষণ না উনি আনন্দে উল্লাসে মেতে ওঠেন। তারপর তাকে শোনাবো বাকি কথা। যা শুনে উনার চোখ বেয়ে নেমে আসবে জলের ধারা ।”
গিলগামেশ এসব কথা শুনে বললেন, ' আত্মবলিদান এবং শেষকৃত্যর সময় এখন উপস্থিত হয়নি আমার জন্য  মৃতদের বহনকারী নৌকাও আমার জন্য অপেক্ষায় নেই । সেই তিন প্রস্থ কাপড় আমার জন্য তৈরি হয়নি এখনো যা আমার শবদেহকে আচ্ছাদিত করবে। সেই সময় আসেনি যখন জনগণ বিষাদগ্রস্থ  হয়ে  আমার চিতা জ্বালাবে  এবং আমার বাসস্থান আগুনে পোড়াবে
বন্ধু এনকিডু, আজ, তুমি আমাকে তোমার  সহায়তা প্রদান কর । আমার পাশে দাঁড়াও। আমিও সেটাই করব তোমার সাথে।    আমাদের দুজনকে একসাথে হারানোর ক্ষমতা কার আছে?  সমস্ত জীবিত প্রানী যাদের জন্ম হয়েছে  মাংসের দেহ থেকে তাদের একদিন বিনাশ হবে । সবাইকেই আরোহন করতে হবে  পশ্চিমগামী নৌকায়  যখন সেটা ডুবে যাবে, যখন মাগিলামের নৌকা ডুবে যাবে, তখন সবাইকে চলে যেতে হবে। কিন্তু এখন আমরা এগিয়ে যাবো এবং খুঁজে বার করব সেই দানব কে।  যদি তোমার হৃদযয়ে ভয়ের সঞ্চার হয় তাহলে সেই ভয়কে ছুঁড়ে ফেলে  দাও।  যদি সন্ত্রাস হানা দেয়, দূরে সরিয়ে দাও তাকেও।  হাতে তুলে নাও কুড়ুল,  আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হো।  যে লড়াই অসম্পূর্ণ রেখে বিদায় নেয় সে কখনো  শান্তিতে থাকে না
ঠিক ওই মুহূর্তে হুমবাবা বেড়িয়ে এল তার অরন্যের ঘাঁটি থেকে  
এনকিডু বললেন, 'হে গিলগামেশ, এবার উরুকে আপনার আত্মগর্বের কথা মনে করুন এগিয়ে যান, আক্রমণ করুন, হে উরুকের পুত্র, ভয় পাওয়ার কিছু নেই
 এই কথাগুলি শুনে  গিলগামেশের সাহস বেড়ে গেল। উত্তরে বললেন, জলদি, আমার পাশে এসে দাঁড়াও।  ওর দিকে নজর রাখো। ও যেন অরন্যে লুকিয়ে না পড়ে। তাহলে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হবে। আপাতত ও তার সাত বিস্ময়কারী ক্ষমতার প্রথমটা প্রয়োগ করেছে।  এখনো বাকি আছে ছটা ও সশস্ত্র হওয়ার আগেই চলো ওকে ফাঁদে ফেলা যাক
এসব কথা শুনে অরন্যের রক্ষক বুনো ষাঁড়ের মত দাপিয়ে উঠল। চিৎকার করে জানান দিল তার তরফের সতর্কতা। মাথা ঝুঁকিয়ে, ভয়ানক ভাবে আন্দোলিত করে সে গিলগামেশকে দেখল । সেই দৃষ্টিতে মৃত্যুর শীতলতা। গর্জন করল গিলগামেশকে উদ্দেশ্য করে।    
তখন গিলগামেশ অশ্রু ভরা দৃষ্টিতে মহান  শামাশকে আহ্বান করে বল লেন  , 'হে মহিমান্বিত শামাশ, আপনি যে আদেশ দিয়েছেন আমি সেই পথ অনুসরণ করেছি, কিন্তু এখন যদি আপনি কোন সহায়ককে না পাঠান তাহলে এ বিপদ থেকে কিভাবে রক্ষা পাব?”
  মহিমান্বিত শামাশ তাঁর প্রার্থনা শুনে  ডেকে পাঠালেন উন্মত্ত বাতাস, উত্তরে বাতাস, ঘূর্ণিঝড়,   বরফ শীতল বাতাস এবং উত্তপ্ত  বাতাসকে। তারা ধেয়ে এল ড্রাগনের মতো, জ্বলন্ত আগুনের মতো, বিশালকায় সাপের মতো,  রক্ত জল করে দেওয়া হিমশীতল চাহনির মতো,  ধ্বংসকারী বন্যার মতো এবং বুক কাঁপানো বিদ্যুত ঝলকের মতো আট  প্রকারের বাতাস  আক্রমণ করল হুমবাবাকে। ধাঁধিয়ে দিল তার দৃষ্টি। আটকে রেখে দিল এক জায়গায় ।  সেই বিশাল দানব না পারছিল এগোতে, না পারছিল পিছিয়ে যেতে। 
 গিলগামেশ চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমার মাতা নিন্সান এবং  পিতা ঐশ্বরিক লুগলবান্দার দিব্যি করে বলছি, আমার প্রাণোচ্ছল নগরের প্রতিনিধি রূপে,  আমি তোর বাসস্থান খুঁজে বার করেছি। আমার  স্বল্প ক্ষমতা এবং সামান্য ক্ষুদ্র অস্ত্র নিয়েই আমি এই এলাকায় এসেছি তোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। এবার আমি তোর বাসস্থানে প্রবেশ করবো।”


কথা শেষ করেই গিলগামেশ একটা সিডার গাছ তার অস্ত্রের আঘাতে ভুপাতিত করে পাহাড়ে পা রাখলেন।  এটা দেখে হুমবাবা আগুন ঝরা চোখে ওদের দিকে তাকাল । কিন্তু ওরা তাতে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ওরা আরো সাতটা সিডার গাছ কেটে পাহাড়ের নিচে ফেলে দিল। প্রত্যেকবার  হুমবাবা রাগে গর্জন করে উঠল। আগুনের হল্কা ধেয়ে এলো তার নিঃশ্বাস বেয়ে।   এভাবে পর পর সাতবার হুমবাবা তার ক্রোধ বর্ষণ করার পর ওরা  পৌছে গেল হুমবাবার কাছে।  হুমবাবা রাগের চোটে নিজের উরুতে সজোরে এক চাপড় মারল  দানবটাকে দেখে মনে হচ্ছিল এক বিশাল আকৃতির ষাঁড়কে যেন কেঊ পাহাড়ের গায়ে বেঁধে রেখেছে। যে চেষ্টা চালাচ্ছে বন্ধন ছিন্ন করার।  অথবা এমন এক যোদ্ধা যার কনুই দুটো বেঁধে দেওয়া হয়েছে । কিছু করতে না পেরে অসহায় ভাবে অশ্রু বর্ষণ করতে করতে সেই দানব বলল,  ' হে গিলগামেশ, আমাকে কথা বলতে দাও আমি জানিনা কে আমার মাতা, কেই বা আমার পিতা। কেউ আমাকে লালন পালন করেনি। আমি এই পর্বতেই জন্মেছি। সেই  আমাকে লালনপালন করেছে। মহান এনলিল আমাকে এই বনের রক্ষক বানিয়েছি্লেন আমাকে মুক্তি দাও, গিলগামেশ, আমি তোমার গোলাম হয়ে থাকব।   তুমি হবে আমার প্রভুএই পাহাড়ে যত গাছ আমি বাঁচিয়ে রেখেছি সে সবের মালিক হবে তুমি।  আমি সব কেটে ফেলব এবং তোমাকে একটি প্রাসাদ বানিয়ে দেব ''
এরপর সে নিজে পথ দেখিয়ে গিলগামেশকে নিজের বাসস্থানে নিয়ে গেল।  ফলে গিলগামেশের হৃদয়ে জন্ম নিল সহানুভূতিতিনি স্বর্গীয় জীবন, পার্থিব জীবন, পাতালের নামে  শপথ নিয়ে বললেন  “ বন্ধু এনকিডু, জালে আটকে পড়া পাখির তার বাসায় ফিরে যাওয়ার  বা কারাগারে আবদ্ধ বন্দীর তার মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার সূযোগ পাওয়া কি উচিত নয় ?
 এনকিডু জবাব দিলেন, “সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষও যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন তাহলে তিনি দুর্ভাগ্যের মারে কাবু হয়ে যান। নামতার নামের সেই দুষ্ট ভাগ্য, কোনো বাছ বিচার করে না, সবাইকে গিলে খায় । যদি ফাঁদে আটকে যাওয়া পাখি বা কারাগারের বন্দী তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে সক্ষম হয়, তাহলে শুনে রাখুল বন্ধু গিলগামেশ আপনি আর নিজের  শহরে ফিরে যেতে পারবেন নাযেখানে আপানার জন্মদাত্রী মা আপনার জন্য অপেক্ষায় আছেন।  একবার সুযোগ পেলে ওই দানব পাহাড়ে আপনার রাস্তা আটকাবে এবং সমস্ত পথ করে দেবে দুর্গম
হুমবাবা বললেন, 'এনকিডু, তুমি যা যুক্তি দিচ্ছ তা মোটেই ভালো নয় । তুমি নিজে তো একজন  ভাড়াটে সেনা।  প্রভুর ওপর নির্ভরশীল রুটিরুজির জন্য! ঈর্ষায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর ভয়ে তুমি যা নয় তাই  খারাপ কথা বলে যাচ্ছ । ''
এনকিডু বললেন, ' ওর কথা শুনবেন না বন্ধু , গিলগামেশ এই হুমবাবার মৃত্যু হওয়া দরকার।  আগে ওকে হত্যা করো তারপর ওর সহচরদের খতম করব।”
 গিলগামেশ বললেন, “আমরা যদি ওকে  এই অবস্থায় হত্যা করি তাহলে  আমাদের মনেই তো সংশয়ের জন্ম হবে। সঠিকার্থে লাভ হবে কি? মানসিক সন্তুষ্টির উজ্জ্বল রশ্মিতো নিভে যাবে
এনকিডু গিলগামেশকে বললেন, “ হে  বন্ধু, মোটেই না প্রথমে পাখিটিকে ফাঁদে ফেলুন। তাহলে তার বাচ্চারা কোথায় পালাবে? এদিকে সেদিকেই লুকিয়ে থাকবে ।   আসল কাজ সমাধা করে  আমরা সেই সব গৌরব এবং ঐতিহ্যের  অনুসন্ধান করব। যা আমাদের ভুষণ হবে।”
গিলগামেশ তার সঙ্গীর কথাকেই গুরুত্ব দিলেন।  উঠালেন কুড়ুল,  কোষমুক্ত করলেন
তরোয়াল তারপর সময় নষ্ট না করে হুমবাবার কাঁধে আঘাত করলেন প্রায় একই সাথে এনকিডুও আক্রমণ করলেন  এরপর আরো একবার যৌথ আক্রমণ হতেই   হুমবাবা পড়ে গেল সত্যি সত্যিই তারা  বনের অভিভাবক দানবটাকে ভুপাতিত করতে পেরেছেন এটা ওদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। যার কণ্ঠস্বর শুনে হার্মান এবং লেবানন কেঁপে ওঠে সেই বনের প্রহরীকে   এনকিডু যখন ধরাশায়ী করলেন তখন আশেপাশের দুই লিগ ব্যাপি অঞ্চলের সমস্ত সিডার গাছ থর থর করে কেঁপে উঠল কেঁপে উঠল পাহাড় গড়িয়ে পড়ল বড় বড় নুড়ি পাথর সিডার বনের রক্ষক নিহত হুমবাবার সাত  ক্ষমতার আর কোনো অস্তিত্ব রইলো না এটা বুঝে দুই বন্ধু তাদের আট ট্যালেন্ট দীর্ঘ তরোয়াল দিয়ে সিডার গাছ কাটতে শুরু করলেন গিলগামেশ এক এক করে ভুপাতিত করছিলেন গাছগুলোকে আর এনকিডু উঠিয়ে ফেলে দিচ্ছিলেন সেই সব গাছের শিকড় সহ বাকি অংশকে, যা মাটির তলা দিয়ে ইউফ্রেতিস নদীর এলাকা অবধি চলে গিয়েছিল এভাবেই তারা উন্মুক্ত করলেন পবিত্র আনুনাকির বাসস্থান   
 এরপর ওরা হুম বাবার মাথা কেটে মহান এনলিলের সামনে পেশ করলেন এবং অস্ত্র শস্ত্র নামিয়ে রেখে ভুমি চুম্বন করলেন । এনলিল হুমবাবার কাটা মস্তক  দেখে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। জানতে চাইলেন, “কেন তোমরা এই কাজ করলে? এখন থেকে তোমাদের মনে এই অনৈতিক কাজের তাপ প্রবাহ সব সময় প্রজ্জ্বলিত থাকবে  যে রুটি তোমরা খাবে বা যে হল তোমরা পান করবে সবেতেই থাকবে তার ছোঁয়া।”  
মহান এনলিল এবার হুমবাবাকে প্রদান করা তেজ এবং সাত বিশেষ ক্ষমতা ফিরিয়ে নিলেন।  প্রথম ক্ষমতাটিকে তিনি দিয়ে দিলেন নদীকে। তারপর এক এক করে সিংহকে, শিলালিপিকে,  পাহাড়কে এবং নরকের রানির ভয়ঙ্কর কন্যাকে দান করে দিলেন বাকি ক্ষমতাগুলো
হে গিলগামেশ, ভয়ংকর আগুন, পাহাড় দাপিয়ে বেড়ান ষাঁড়ের মত দানবকে পরাহত করা সম্রাট  যিনি সমুদ্রকে অতিক্রম করেন, তার গৌরবের সাথে জড়িয়ে থাকল এনকিডুর গৌরবাহ্নিত সাহসিকতার গাথা 
২য় অধ্যায় সমাপ্ত

৩য় অধ্যায় লিঙ্ক
https://amarkolponarjogot.blogspot.com/2020/04/blog-post_6.html

No comments:

Post a Comment