তৃতীয় অধ্যায়
২য় অধ্যায় লিঙ্ক
ইস্থার এবং গিলগামেশ, তৎসহ এনকিডুর মৃত্যু
গিলগামেশ ধুয়ে নিলেন তার লম্বা চুল । ছড়িয়ে দিলেন কাঁধের
ওপর। পরিষ্কার করলেন অস্ত্র শস্ত্র। নোংরা
দাগযুক্ত পোশাক ত্যাগ করে পরিধান করলেন নতুন বস্ত্র। সে পোশাক রাজকীয়। সবশেষে গিলগামেশ যখন মাথায় মুকুট পড়লেন তখন, গৌরবময়ী
দেবী ইস্থার গিলগামেশের সৌন্দর্যর দিকে তাকিয়ে মোহিত হয়ে গেলেন। বললেন, “ হে গিলগামেশ আমার কাছে এসো, আমার স্বামীর স্থান গ্রহণ কর। আমাকে তোমার দেহের
বীজ দাও । আমাকে তোমার
স্ত্রী হওয়ার অধিকার দাও । আমার স্বামী
হওয়াই তোমার উচিত কাজ। আমি তোমার জন্য সোনা
এবং মরকত মনি দিয়ে এক বিশেষ রথ নির্মাণ করব। যার চাকা হবে সোনার । নানা স্থানে ব্যবহার
হবে তামা। তোমার রথ টেনে নিয়ে
যাবে ঝড়দানবের শক্তি সম্পন্ন খচ্চরেরা। তুমি
যখন আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করবে তখন দেবদারু
গাছের সুগন্ধিত দরজার চৌকাঠ তোমার পদচুম্বন করবে। তোমার স্পর্শ লাভের অপেক্ষায় থাকবে সিংহাসন । সমস্ত রাজা, শাসকগণ এবং
রাজকুমাররা তোমার সামনে মাথা নত করবে। তারা তোমার ইচ্ছামতো পাহাড় ও সমভূমি থেকে কর আদায় করে দেবে। তোমার
পোষা ছাগলদের তিনটে করে এবং ভেড়াদের সব
সময় যমজ বাচ্চা জন্মাবে । তোমার পোষা গাধারা
খচ্চরদের থেকেও বেশী কাজ করবে। তোমার ষাঁড়ের মতো ষাঁড় থাকবে না কার কাছেই। আর
তোমার রথের ঘোড়াগুলি প্রসিদ্ধ হবে তাদের দ্রুত গতির কারনে।”
গিলগামেশ সৌন্দর্য ময়ী ইস্থারকে উত্তর
দিলেন,
'আমি যদি আপনাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করি তাহলে তার
বিনিময়ে আমি কি উপহার পেশ করব? আপনার শরীর
পরিচর্যার জন্য নানা উপাদান এবং পোশাক
জোগাড় করব কোথা থেকে ? আমি আনন্দের সাথে আপনাকে রুটি এবং সমস্ত ধরণের খাবার দিতে
সক্ষম । এমন মদ দিতে পারি যা কেবলমাত্র
রানীরাই পান করেন। আমি আপনার শস্যাগার
ভর্তি করে দিতে পারি দানাদার বার্লি দিয়ে।
কিন্তু আপনাকে আমার স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমার সাথে আপনি কী করে একসাথে থাকার কথা
ভাবতে পারেন ? আপনার প্রেমিকেরা আপনার ভেতর খুঁজে
পেয়েছিল সেই উষ্ণতা যা শীতের দিনে গরম পোশাকে পাওয়া যায়। আপনার ভালোবাসা তাদের
কাছে ছিল সেই পিছনের দরজার মত যা বাইরে
আটকে রেখে দেয় সমস্ত রকম বাতাস বা ঝড়কে।
সেই দুর্গ যা আক্রমনকারীদের আটকে রাখে। সেই আবরণ যা শরীরকে রক্ষা করে জলের ঝাপটা
থেকে। তারপর তাদের অবস্থা হয়েছে কার্নিশ থেকে খসে পড়া একটি পাথরের মত। সেই বিধ্বস্ত সেনার মত যে শত্রুর নিগ্রহ সহ্য করেছে। সেই মানুষের মতো যার
জুতো ছিঁড়ে গেছে দীর্ঘ সফরের মাঝখানে। আপনার প্রেমিকদের মধ্যে কোনজন কে আপনি চিরদিনের
জন্য ভালোবেসেছেন? কোন সে রাখাল যাকে সর্বকালের জন্য আপনই সন্তুষ্ট
করতে পেরেছেন?
আসুন, আমি আপনাকে আপনার প্রেমিকদের
গল্প বলি শুনুন। যৌবনে তাম্মুজ ছিল আপনার
প্রেমিক। তাকে আপনি বছরের পর বছর বিলাপ করার শাস্তিই শুধু দিয়েছেন। আপনি তার নানা রঙে
রঙিন পালকের মত উচ্ছলতাকে পছন্দ করেছেন, তবুও আপনি
তার ডানা ভেঙে দিয়েছেন। আজও সে উপবনে শুধুই চিৎকার করে চলে, "কাপ্পি,কাপ্পি, আমার ডানা, আমার ডানা। "
আপনি অপরিসীম শক্তি সম্পন্ন সিংহকে
ভালবেসেছিলেন। কি করলেন তারপর? একের পর এক গর্ত খনন করে দিলেন তার চলাফেরার পথে।
আপনি যুদ্ধের সেই দ্রুতগামী ঘোড়াকে
ভালবেসেছিলেন । তাকে ভোগ করতে হয়েছে চাবুকের আঘাত। সাধ্য না থাকলেও তাকে ছুটে যেতে
হয়ে সাত লিগের পথ। তবেই সে জলপান করতে পেয়েছে। তার নিরীহ মায়ের ভাগ্যে জুটেছে শুধুই জন্য বিলাপ
করেছেন।
আপনি ভালোবাসতেন পশুপালককে। সে দিনের
পর দিন আপনার জন্য খাবার বানিয়েছে। সে নিজের ছেলেদের হত্যা করেছে আপনার জন। তার
বিনিময়ে আপনি তাকে আঘাত করেছেন। তাকে
নেকড়েতে পরিণত করেছেন। সে এখন নিজের দলের
মানুষের তাড়া খেয়ে পালায়। তার পোষা কুকুরেরাই তাকে জখম করে।
আপনি তো ইশুল্লানুকেও ভালবেসেছিলেন
তাই না? যে ছিল আপনার পিতার খেজুর বাগিচার মালী? সে তোমাকে এনে দিত ঝুড়ি ঝুড়ি খেজুর।একদিন আপনি তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, "প্রিয়তম ইশুল্লানু, আমার কাছে এসো। উপভোগ করো তোমার পুরুষত্ব। আমাকে গ্রহণ করো। আমি তোমার। "
ইশুল্লানু জবাব দিয়েছিল," আপনি আমার কাছে কি
চাইছেন?
আমি আমার মায়ের
হাতে বানানো খাবার খেয়েই সুখী। আমার যা আছে আমি তো তাতেই সুখী। শীতল ঝড়ের হাত থেকে
বাঁচার ক্ষমতা আমার আছে।”
তার উত্তর শুনে আপনি তাকে আঘাত করেছিলেন । তাকে অন্ধ করে পাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ছুঁচো বানিয়ে। যাতে তার চাওয়া পাওয়া সর্বদা নাগালের বাইরে থাকে। এসব জেনেও যদি আমি আপনার
প্রেমিক হই, তাহলে তো আমার অবস্থাও ওদের মতই হবে, যাদেরকে একদা আপনি আপনি ভালোবাসতেন, তাই না? '
এইসব
কথা শুনে ইস্থার তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়লেন
এবং ফিরে গেলেন স্বর্গে । পিতা আনু এবং মাতা আন্টামের সামনে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে
বললেন, “হে পিতা, গিলগামেশ আমাকে অপমান করেছে । আমার আচরণ জীবন যাপন নিয়ে অত্যন্ত জঘন্য সব কথা বলেছে ।”
আনু বললেন, “তুমি কি নিজেকে দেবতাদের পিতা মনে কর? তুমি রাজা
গিলগামেশের সাথে ঝগড়া না করলে, সে তোমার
ঘৃণ্য আচরণ জঘন্য কাজের প্রসঙ্গ উথাপন
করত না।''
ইস্থার সে কথায় কান না দিয়ে বলল, “ পিতা, আমাকে স্বর্গের ষাঁড় প্রদান করুন । আমি গিলগামেশকে ধ্বংস করতে চাই। গিলগামেশকে আরো উদ্ধত হতে দিন । যা তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। আপনি যদি স্বর্গের
ষাঁড়টিকে দিতে অস্বীকার করেন, তাহলে আমি নরকের দরজা ভেঙে দেব। যার ফলে অতল গভীরতার বাসিন্দাদের বিষয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেবে। আমি মৃতদেরকে
ওপরে উঠিয়ে আনব। তারা জীবিতদের মতো খাবার খেতে শুরু করবে। জীবিতদের চেয়ে মৃতদের সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি।”
আনু মহান ইস্থারকে বললেন, “তুমি যা চাইছ আমি
যদি তা করি তাহলে তার পরিনামে উরুক জুড়ে সাত বছরের খরা তার প্রকোপ বিস্তার করবে। ভুট্টা গাছে জন্মাবে না একটাও দানা। তুমি কি
সাধারন মানুষ এবং গবাদি পশুদের জন্য শস্য
এবং ঘাস সঞ্চয় করে রেখেছ? ”
ইস্থার জবাব দিলেন, “ হ্যাঁ আমার কাছে
মানুষের জন্য শস্য এবং গবাদি পশুদের জন্য ঘাস রাখা আছে। সাত বছর ধরে বীজবিহীন ভুট্টা জন্ম নিলেও কোনো অসুবিধা
হবেনা। ''
মহান আনু তার কন্যা ইস্থারের এই কথা শুনে তাকে স্বর্গের ষাঁড় প্রদান করলেন । যে
উরুকে তার তান্ডব চালাবে। ওরা উপস্থিত হল
উরুকের প্রবেশ দ্বারে। ষাঁড়টি ছুটে গেল নদীর দিকে। তার প্রথম জোরালো নিঃশ্বাস আঘাত হানল পৃথিবীর বুকে, সৃষ্টি হল এক বিরাট ফাটল । যার ভেতর শতাধিক
যুবক তলিয়ে গেল। পৌছে গেল মৃত্যুর
দেশে। তার দ্বিতীয় নিঃশ্বাসের আঘাতে আরো
একটি ফাটলে হারিয়ে গেল দু'শো মানুষ। ষাঁড় টা
তার নিঃশ্বাস দ্বারা তৃতীয় ফাটল সৃষ্টি করা মাত্র, এনকিডু উদ্যোগ
নিলেন একে আটকানোর। এক লাফে ষাঁড়ের পিঠে চেপে তার শিঙ দুটোকে চেপে ধরলেন। স্বর্গের সেই দুর্দান্ত ষাঁড় ফেনা মাখা থুতু
ছিটিয়ে দিল এনকিডুর মুখে। বারংবার চাবুকের মতো মারতে থাকল তার লেজ দিয়ে। এনকিডু গিলগামেশের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন, “হে বন্ধু, আমরা গর্ব
করে বলেছিলাম যে, আমরা আমাদের নাম এজগতে অক্ষয় করে রেখে যাব আমাদের কাজ দ্বারা। এই সুযোগ আপনি আপনার তরোয়াল দিয়ে আঘাত করুন এই
দুর্দম ষাঁড়ের দুই শিংয়ের মাঝে।”
একথা শুনে গিলগামেশ এগিয়ে গিয়ে ষাঁড়টির লেজ চেপে ধরলেন এবং এনকিডুর
নির্দেশ মত নিজের তরোয়াল সজোরে বিদ্ধ করলেন দুই শিংয়ের মাঝখানে । ষাঁড়টি মারা গেল। ওরা স্বর্গের ষাঁড়ের হৃদয় কেটে নিয়ে অর্ঘ রূপে
প্রদান করলেন শামাশকে । তারপর দুজনে বিশ্রাম নিলেন।
এসব দেখে ইস্থার উঠে গেলেন উরুকের
বিশাল প্রাচীরের ওপরে। তারপর আরোহণ করলেন একটি মিনারে। সেখান থেকে অভিশাপ
দিয়ে বললেন, “গিলগামেশের দুর্ভাগ্য শুরু
হল। কারণ সে স্বর্গের ষাঁড়কে হতা করে আমাকে বদনামের ভাগীদার করেছে।”
এনকিডু এই কথাগুলো শুনে, ষাঁড়টার ডান উরুর অংশটা ছিঁড়ে ছুঁড়ে মারলেন দেবী
ইস্থারের মুখ লক্ষ্য করে এবং বললেন, “ আমি যদি আপনাকে হাতের নাগালে পেতাম তাহলে এই
কাজটা আপনার সাথে করতাম। সাথেই চাবুকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিতাম আপনাকে।”
ইস্থার একথা শুনে চারদিক থেকে
মানুষদের তার কাছে আসার আহ্বান জানালেন। ডাক দিলেন গায়িকাদের, নর্তকীদের, মন্দিরের
পতিতাদের এবং বহুগামীনিদের । তারপর ষাঁড়ের উরুটিকে সামনে রেখে শুরু করলেন বিলাপ।
গিলগামেশ ডেকে পাঠালেন তার কারিগর
এবং অস্ত্র নির্মাতাদের। সকলেই যাঁড়টির শিং
এর গঠন দেখে অভিভুত হল। দু আঙুল মোটা
ধাতুর পাত দ্বারা আবৃত ছিল সে দুটি। মরকত মনি দিয়ে অলংকৃত করা ছিল তার ওপর। প্রতিটার
ওজন ছিল কম পক্ষে ত্রিশ পাউন্ড ।
গিলগামেশ যাঁড়টির শরীর নানান উপাচার সহযোগে তার অভিভাবক দেবতা
লুগলবান্দার উদ্দেশ্যে নিবেদন করলেন। শুধু
শিংগুলো সাথে নিলেন প্রাসাদে
দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখার জন্য। তারপর গেলেন ইউফ্রেতিস নদীতে। দুজনে পরিষ্কার করলেন নিজেদের শরীর এবং একে
অপরকে আলিঙ্গন করে ফিরে চল লেন নগরের পথে। তাদের দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল উরুকের মস্ত মানুষ।
গিলগামেশ গায়িকাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, নায়কদের মধ্যে
সবচেয়ে গৌরবময় কে? পুরুষদের মধ্যে
সবচেয়ে খ্যাতিমান কে?”
তারা জানালো, “গিলগামেশ নায়কদের
মধ্যে সবচেয়ে গৌরবময় । তিনিই আবার পুরুষদের ভেতর সবচেয়ে
খ্যাতিমান।”
এরপর রাজপ্রাসাদে শুরু হল আনন্দ উত্সব
এবং মহাভোজ । সব কিছু সম্পন্ন হলে দুই নায়ক শয্যায় দিকে দৃষ্টি পাত করে বললেন, “আপাতত আজকের রাত আমাদের বিশ্রামের জন্য অপেক্ষমান ।”
দিনের আলো যখন ছড়িয়ে গেল চরাচরে, এনকিডু ঘুম
থেকে উঠে গিলগামেশকে কান্না জড়িত স্বরে জানালেন, 'হে আমার ভাই, বন্ধু, গত রাতে আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। আনু, এনলিল, ইয়া এবং মহান শামাশ
আলচনায় বসেছেন। আনু, এনলিলকে বললেন, " যেহেতু তারা স্বর্গর
ষাঁড়কে হত্যা করেছে এবং ওরা দু'জন মিলে সিডার পর্বত রক্ষাকারী হুমবাবাকে হত্যা করেছে । তাই ওদের ভেতর একজনকে মরতে হবেই।”
গৌরবময় শামাশ তার উত্তরে মহান এনলিলকে
বললেন, "আপনার ইচ্ছানুসারেই
তারা ষাঁড়ের স্বর্গকে হত্যা করেছিল এবং হুমবাবাকেও
হত্যা করেছিল। আর এরজন্য নির্দোষ এনকিডুকে মারা যেতে হবে?”
গৌরবময় শামাশের এ হেন কথা শুনে মহান এনলিল অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে
বললেন, " আপনি এই কথা বলার সাহস দেখান কি করে? অশ্য আপনি তো প্রতিদিন ওদের সাথেই থাকেন
। যেন ওরা আপনার নিজের পক্ষের লোক। "
তাই এনকিডু গিলগমেশের সামনে
সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে অশ্রু বিগলিত চোখে বল
লেন, “হে আমার ভাই, তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো, আমি তোমার
এতো প্রিয়, তবুও তারা আমাকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে
যাবে। আমি অবশ্যই মৃতদের নগরের দ্বারপ্রান্তে বসে থাকব।
আমি কী আর কখনও আমার প্রিয় ভাইকে দেখতে
পাব না? ''
এনকিডু মানসিকভাবে বিচলিত অবস্থায় একা শুয়ে শুয়ে প্রবেশ দ্বারটির
উদ্দেশ্যে অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকলেন, যেন ওটা একটা জীবিত প্রানী। “ এই যে কাঠের
প্রবেশ দ্বার। নিস্তেজ, সংবেদনহীন, নির্বোধ, আমি তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছিলাম অন্তত কুড়ি লিগ
এলাকায়। যতক্ষণ না জবর দস্ত দেবদারু গাছ চোখে পড়েছে আমি আমার খোঁজ থামাইনি ।
তোমার মতো কোনও কাঠ নেই এই সম গ্র দেশে। বাহাত্তর হাত উচ্চ
এবং চব্বিশ হাত প্রস্থ । আঁশ হীন, নমনীয় অথচ শক্ত, যাকে বেলে একেবারে নিখুঁত । নিপ্পুরের একজন দক্ষ অভিজ্ঞ কারিগর তোমাকে তৈরি
করেছেন । কিন্তু আমার অন্তিম অবস্থা এরকম হবে যদি জানতাম!
যদি জানতাম এত এত ভাল কাজ করার ফল এই হবে! তাহলে কুড়ুল দিয়ে তোমাকে আমি ছোট ছোট টুকরো করে
কেটে ফেলতাম। এই দ্বার নির্মাণ হতেই দিতাম না। যদি ভবিষ্যতের কোনও রাজা তোমাকে এখানে নিয়ে আসত
তাহলে ভাল হত। বা কোনও
দেবতা। আমার নামের বদলে অঙ্কিত হত তার
নাম। তাহলে তাদের ওপর নেমে আসত সেই অভিশাপ যা আমার ওপর নেমে এসেছে।”
ভোরের প্রথম আলো ফুটে উঠতেই এনকিডু
মাথা তুললেন । সূর্যের সামনে দাঁড়িয়ে
কাঁদতে থাকলেন। সূর্যের তাপে তার অশ্রু ধারা বাস্প হয়ে গেল । এনকিডু বললেন, “ হে
সূর্য দেবতা, আমি মিনতি করছি, আপনি, সেই জঘন্য শিকারীকে শাস্তি দিন। সেই শিকারি যার কারনে আমি
আমার বন্ধুর চেয়ে কম শক্তিশালী মানুষেতে পরিণত হয়েছি। তার জীবন দুর্বিষহ করে দিন।
সে যেন কম শিকার করতে পারে । তাকে দুর্বল করুন । তার পাওনার ভাগ কমিয়ে দিন । তার জাল ছিঁড়ে যেন
শিকার পালিয়ে যেতে পারে।”
শিকারিকে অভিশাপ দেওয়ার পর তার মনে
পড়ল সেই গনিকার কথা। তাকে অভিশাপ দেওয়ার জন্যও তার মনে উত্সাহের সঞ্চার হল। “ হে নারী, তোমার জন্য আমি এক মহা অভিশাপ ঘোষণা
করছি! অনন্তকালীন এক নিয়তির প্রতিশ্রুতি। আমার অভিশাপ শীঘ্রই এবং
হঠাৎ তোমার উপর নেমে আসবে। তোমার ব্যবসা চলতে থাকবে কিন্তু তোমার কোনো ছাদের আশ্রয় থাকবে না। যেখানেই তুমি ব্যবসা করবে
সেখানেই আগমন হবে মাতালদের । তারা বমি করে
নোংরা করে দেবে তোমার আবাস । মাটির ঘর ছাড়া আর কিছু জুটবে না তোমার। যা কিছু সঞ্চয়
সব হারিয়ে যাবে মাটির গর্তে। তোমাকে বসে থাকতে হবে রাস্তার চৌমাথায় । রাতের অন্ধকারে তোমাকে বিছানা পাততে হবে গোবরের ওপর।
আর দিনের বেলা প্রাচীরের ছায়ায় নিতে হবে
আশ্রয় । পাথরের কুচি আর কাঁটাগাছ তোমার পাকে করবে ক্ষতবিক্ষত। মাতালেরা আঘাত করবে তোমার মুখে। তৃষ্ণায় শুকনো কন্ঠা
হবে ব্যাথায় কাতর। তোমার চুলের বেগুনি রঙ ছিনিয়ে নেওয়া হবে। কারণ একদা আমিও
আমার বন্য জীবনে আমার স্ত্রীকে জীবনের সব সুখ দেব
আশা করেছিলাম !”
শামাশ যখন এনকিডুর কথা শুনতে পেলেন
তখন তাকে ডেকে বললেন: 'এনকিডু, তুমি সেই নারীকে
কেন অভিশাপ দিচ্ছ? সেই তো তোমাকে
দেবভোগ্য রুটি আর রাজভোগ্য দ্রাক্ষারস পান করা শিখিয়েছিল? সেই তো তোমাকে সাজিয়ে দিয়েছিল সুন্দর পোশাকে। সেই তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল গৌরবময়
গিলগামেশের সাথে । সেই গিলগামেশ কি তোমাকে
নিজের ভাই বলে মেনে নিয়ে, রাজকীয় বিছানায় বিশ্রাম করতে দেয়নি? সম্মান
দেয়নি তার বাম দিকের আসনে বসার? এই জগতের
তার কারনেই তোমার পদ চুম্বন করেছে। আর এখন উরুকের
সমস্ত লোক শোক করছে, বিলাপ করছে তোমার জন্য । তুমি মারা গেলে তারা নিজেদের চুল কাটবে না। দীর্ঘ হতে দেবে । তারপর সিংহের
চামড়া পড়ে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াবে।”
মহিমান্বিত শামাশের কথা শুনে এনকিডুর ক্রুদ্ধ
হৃদয় শান্ত হয়ে উঠল। সে তার অভিশাপ ফিরিয়ে নিল
। “ হে নারী, মহিলা, আমি তোমাকে অন্য এক
নিয়তির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। যে মুখে তোমাকে অভিশাপ দিয়েছিলাম, আবার সেই
মুখেই তোমাকে আশীর্বাদ করছি! রাজা রাজড়া,
রাজপুত্র এবং রাজকর্মচারীরা তোমাকে ভালোবাসবে, পছন্দ করবে । তোমার কথা শুনে বারো মাইল দূরে থাকা মানুষের শিহরণে গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাবে।
মানুষেরা তাদের ধন সম্পত্তি উজাড় করে দেবে তোমার সকাশে। তোমার সব ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
তোমার ধনাগারে জমা হবে সোনাদানা মনিমুক্তো। তোমার হাতের সব সময় থাকবে একটি আংটি এবং পরনে থাকবে
সুন্দর পোশাক । পুরোহিত নিজে তোমাকে দেবতাদের সামনে নিয়ে যাবে। তোমার জন্যই আমি
ত্যাগ করেছিলাম সাত সন্তানের জননী এক স্ত্রীকে।”
এনকিডু
মানসিক বিচলিত অবস্থায় একাকী শুয়ে থাকতে
থাকতে তার মনের তিক্ততার কথা তার বন্ধুর উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করলেন। “আমিই সেই যে সিডার গাছ কেটেছিলাম । আমিই সেই যে বন ভুমি সাফ করেছিলাম। আমি সেই যে হুম
বাবাকে হত্যা করতে সহায়তা করেছি । আর এখন দেখুন আমার কি অবস্থা হয়েছে। শোনো হে বন্ধু আমার, কী সেই স্বপ্ন যা আমি গত রাতে দেখেছি। আকাশ থেকে গর্জন ভেসে এসেছে। পৃথিবীও দিয়েছে তার জবাব । তাদের তান্ডবের মাঝে আমি এক ভয়াবহ সত্তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। এক বীভৎস মুখের পক্ষীমানব ছিল সে। আমাকে সে তার উদ্দেশ্য জানিয়েছিল। তার মুখ
রক্তচোষা সদৃশ । পা সিংহের মত । হাত
ঈগলের মত নখরযুক্ত। সে অতিদ্রুত আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল আমার চুল । আমার দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর সে আমার রুপ বদলে দেয়। আমার বাহু পরিনত হয় পালক যুক্ত ডানায়। আমার দিকে তাকিয়ে সে ইশারা করে তার সাথে যাওয়ার।
আমরা পৌছে যাই অন্ধকারের রাণী ইরকাল্লার প্রাসাদে। সেই প্রাসাদ
যেখানে কেউ প্রবেশ করলে আর কখনও ফিরে আসে না। ওটা ছিল সেই রাস্তা যা দিয়ে
ফিরে আসার উপায় নেই।
“ সেখানকার বাড়িগুলোতে মানুষেরা অন্ধকারে বসে থাকে; ধুলো তাদের খাদ্য এবং মাটিকে তারা মাংস বলে মনে করে। তাদের গায়ে পাখির মতো পোশাক । তারা কোনও আলো দেখতে পায় না। অন্ধকারই তাদের আশ্রয়স্থল। আমি ধুলো কক্ষে প্রবেশ করলাম এবং দেখতে পেলাম আমি পৃথিবীর সমস্ত রাজা, শাসক এবং রাজকুমারদের মুকুট পড়ে আছে ধুলোয় । সেই সমস্ত মানুষ যারা অন্তত
একবার রাজকীয় মুকুট পরেছিলেন এবং কোনও না
কোনো সময়ে বিশ্ব শাসন করেছিলেন তাদেরকেও
দেখতে পেলাম। যারা একদা একে, আণু বা
এনলিলের মত দেবদেবীর জায়গায়
দাঁড়িয়েছিল, তারাই এখন সেই ধুলো কক্ষে দাসদাসীর কাজ করছে । মাংস রান্না করছে,
খাবার বহন করে আনছে, ভিস্তি করে বয়ে আনছে ঠাণ্ডা জল। সেই ধুলো কক্ষের ভবনে আমি মহাযাজক এবং তার অনুগামী এবং মন্ত্র উচ্চারণ করা পুরোহিতদের দেখাও
পেয়েছি। মন্দিরের পরিচর্যাকারীদের দেখাও পেয়েছি সেখানে। দেখতে
পেয়েছি কিশের রাজা ইটানাকে।
যাকে প্রাচীন কালে ঈগলেরা স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গবাদি পশুর দেবতা সামুকান এবং ভূগর্ভস্থ জগতের
রানী ইরেশকিগাল। ছিলেন বেলিট-শেরি। যিনি দেবতাদের সমস্ত কিছু নথি ভুক্ত করে রাখেন। তিনি মৃত্যু পুস্তকের সংরক্ষক। একটি শিলালিপি থেকে
উনি পাঠ করছিলেন। তারপর মাথা উঁচু করে আমাকে দেখে বললেন: "
একে এখানে কে নিয়ে এসেছে? " ওই সময়েই আমার ঘুম
ভেঙে গেল। আমার অবস্থা তখন শরীর থেকে সব রক্ত বেড়িয়ে যাওয়া বিদ্ধ্বস্ত মানুষের মত
যে নোংরা আবর্জনার ভেতর পড়ে আছে । যার সব কিছুই বজেয়াপ্ত হয়েছে । যার হৃদয়ে শুধুই সন্ত্রাসের
ঝড়।”
এই স্বপ্ন বিবরণ শুনে গিলগামেশের চোখ
দিয়ে বাহিত হল অশ্রুধারা। ছিঁড়ে ফেললেন নিজের পরনের পোশাক। এনকিডুকে বললেন, “ এই শক্তিশালী প্রাচীরযুক্ত
উরুকের মধ্যে এমন জ্ঞানবান আর কে আছে? অদ্ভুত সব বিষয়ের কথা শুনলাম। এরকম অদ্ভুত
কথা কেন তোমার হৃদয় থেকে উদ্ভুত হচ্ছে? স্বপ্নটা ছিল দুর্দান্ত, কিন্তু তার সাথে জড়িয়ে থাকা সন্ত্রাসের মাত্রা অস্বাভাবিক। যতই ভয়ানক হোক না
কেন এই স্বপ্ন আমরা এর মূল্য খুঁজে বার করবোই। কারন এই স্বপ্ন প্রমান দিচ্ছে যে,
অতিমাত্রায় স্বাস্থ্যকর মানুষের জীবনেও শেষ পর্যন্ত দুর্ভোগ আসে । জীবনের শেষ হয় দুঃখতেই।” গিলগামেশ বিলাপ
করে বললেন, “ আমি এখন মহান দেবতাদের কাছে
প্রার্থনা জানাব, কারণ আমার বন্ধু
একটি অশুভ স্বপ্ন দেখেছে।”
যে দিনটিতে এনকিডু স্বপ্ন
দেখেছিলেন সেইদিন শেষ হয়ে এল। মানসিক অসুস্থতা নিয়ে একটা গোটা দিন এনকিডু নিজের বিছানায় শুয়ে থাকলেন।
তার কষ্ট আরও বেড়ে গেল। যার কারনে তার বন্য
জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল সেই গিলগামেশকে বললেন, “একদা আমি তোমার কাছে ছুটে এসেছিলাম, জীবন জল প্রাপ্তির আশায়। আর এখন
আমার কাছে কিছুই নেই।”
আরো একটা দিন এনকিডু বিছানাতেই শুয়ে থাকলেন । গিলগামেশ তার দিকে নজর রেখেছিলেন কিন্তু অসুস্থতা
কমার বদলে বেড়েই চলল। তৃতীয় দিনেও তিনি শুয়েই থাকলেন। কাঁদতে কাঁদতে এনকিডু প্রায় অন্ধ
হয়ে গেলেন। সব সময় উনি গিলগামেশের নাম ধরেই ডেকে চলেছিলেন। দশ দিন তিনি এই ভাবে শুয়ে রইলেন এবং কষ্টর
পরিমাণ আরো বেড়ে গিয়েছিল । একাদশ এবং দ্বাদশ
দিনেও যন্ত্রনায় কাৎরাতেই থাকলেন এনকিডু। তারপর
গিলগামেশকে ডেকে বললেন, “ হে বন্ধু, মহান দেবী আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন এবং আমার
মৃত্যু এভাবে লজ্জাজনক ভাবেই হবে। যুদ্ধে
মৃত্যু বরণ করার সম্মান আমার ভাগ্যে নেই। মরতে তো আমাকে হবেই। যুদ্ধক্ষেত্রে
মৃত্যু কে আলিঙ্গন করতে পারলে আমি খুশী হতাম। ধন্য হতাম।” একথা শুনে গিলগামেশ পুনরায় কেঁদে ফেললেন।
পরের
দিন ভোরের প্রথম আলো ফোটা মাত্র গিল গামেশ উচ্চকিত স্বরে উরুকের পরামর্শদাতাদের উদ্দেশ্যে
বললেন -
'আমার কথা শুনুন, উরুকের মহান মানুষেরা,
আমি আমার বন্ধু, এনকিডুর জন্য অশ্রুপাত করছি ।
একজন নারীর মতোই শোক প্রকাশ করছি।
আমি আমার ভাইয়ের জন্য কাঁদছি।
হে এনকিডু, হে আমার ভাই,
তুমি সব সময় সাথে থাকা কুড়ুলসম
আমার বাহুর শক্তি, আমার কোমরবন্ধনীর তরোয়াল,
আমাকে রক্ষাকারী ঢাল,
জমকদার পোশাক, আমার সবচেয়ে সুন্দর অলঙ্কার;
দুষ্ট
ভাগ্য এসব আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চলেছে।
বুনো গাধা এবং গ্যাজেল হরিণ
সমস্ত দীর্ঘ-লেজযুক্ত প্রাণীরা
যারা তোমাকে পিতা মাতার মতো
লালন পালন করেছে
তোমার জন্য আজ কাঁদছে,
সমভূমি এবং চারণভূমির সমস্ত বন্য
উপাদান,
সেই রাস্তাগুলো যা দিয়ে তুমি সিডার
বনে বিচরণ করতে
তোমার জন্য দিন রাত অশ্রুপাত করছে।
দৃঢ় প্রাচীরযুক্ত উরুকের মহান মানুষেরাও,
তোমার জন্য অশ্রুপাত করবেন ।
এনকিডু, ছোট ভাই আমার
শোক বিলাপ করার সময়
তোমার
জন্য আশীর্বাদের হাত প্রসারিত হোক।
সারা দেশ জুড়ে মায়ের শোকসম
বিলাপের
প্রতিধ্বনি গুঞ্জিত হচ্ছে।
সে সমস্ত পথেরা কাঁদুক যেখানে আমরা একসাথে হাঁটতে
হাঁটতে
পশু
শিকার করেছি । মেরেছি কত ভাল্লুক এবং হায়না, '
বাঘ এবং প্যান্থার, চিতাবাঘ এবং সিংহ,
বলগা হরিণ এবং আইবেক্স, ষাঁড় এবং মাদী
হরিণ।
সেই নদীর তীর যার পাশ দিয়ে আমরা
হাঁটতাম,
তারাও কাঁদুক তোমার জন্য,
এলামের উলা এবং প্রিয় ইউফ্রেটিস
যেখান থেকে একবার আমরা ভিস্তিতে জল
সংগ্রহ করেছিলাম ।
সেই পাহাড় যেখানে উঠে আমরা হত্যা করেছিলাম বন রক্ষককে,
তারাও তোমার জন্য কাঁদছে।
শক্তিশালী প্রাচীরযুক্ত উরুকের
যোদ্ধারা
যেখানে স্বর্গ ষাঁড়টিকে হত্যা করা হয়েছিল,
তারাও কাঁদছে তোমার জন্য।
এরিডুর সমস্ত মানুষ
তোমার জন্য কাঁদছে এনকিডু।
যারা তোমার খাওয়ার জন্য শস্য নিয়ে
এসেছিল
এখন তারাই তোমার জন্য শোকপালন করছে ;
যে তোমার পিঠে তেল মাখাত
সেও এখন তোমার জন্য বিলাপ করছে ;
যে তোমার জন্য উত্তেজক পানীয় নিয়ে আসত
শোক মগ্ন আজ সেও।
যে গণিকা নারী তোমাকে সুগন্ধযুক্ত মলম মাখিয়ে
দিয়েছিল
তার কন্ঠেও শোনা যাচ্ছে বিলাপ;
প্রাসাদের সেই নারীরা, যারা তোমার জন্য একজন কে স্ত্রী রূপে এনে দিয়েছিল
,
ভাল পরামর্শ সহযোগে প্রদান করেছিল বিশেষ আংটি,
তারাও এখন তোমার জন্য বিলাপ করছে।
আর সেই যুবকেরা যারা তোমাকে ভাইয়ের
মত মনে করত
তারা নারীদের মত
শোক পালন করার জন্য চুল কাটা বন্ধ
করেছে
কোন সে স্তব্ধতার নিদ্রা যা এখন তোমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে?
তুমি অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছ। আমার
কথা আর শুনতে পাচ্ছ না। ”
গিল গামেশ, এন কিডুর বুক স্পর্শ
করলেন । হৃদপিন্ডের চলন অনুভুত হল না । চোখ খুলে দেখলেন ও না তার ভ্রাতৃ সম বন্ধুকে। গিলগামেশ
পুনরায় তার হৃদয়ের কাছে হাত রাখলেন। না কোন স্পন্দন এবারও অনুভব করতে পারলেন না । অতঃপর
গিলগামেশ একটি চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন বন্ধুর
শরীর। যেমন করে সদ্য বিবাহিত নারী নিজেকে ঢাকে। গিলগামেশের মনে উদ্ভুত হল সিংহের মতো রাগ । যেন কেউ তার সিংহীকে ছিনিয়ে
নিয়ে গেছে। উনি এন কিডুর বিছার চারদিকে
উন্মত্তের মত পাইচারী করলেন। নিজের চুল ছিঁড়ে ছড়িয়ে দিলেন চার দিকে। পরনের জাঁকজমকপূর্ণ
পোশাকটিকেও ছিড়লেন টেনে টেনে, যেন ওটা তার শরীরকে যন্ত্রনা প্রদান করছিল।
ভোরের প্রথম আলোয় গিলগামেশ চিৎকার করে বলে উঠলেন, 'আমি তোমাকে রাজকীয় বিছানায় বিশ্রাম করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। আমার বামদিকে ছিল তোমার বসার আসন। জগতের সব রাজপুত্রেরা
তোমার পদ চুম্বন করত। আমি উরুখের সমস্ত মানুষকে তোমার জন্য কাঁদতে আহ্বান
করব। অনুরঢ জানাব শোক সঙ্গীত গাওয়ার জন্য। আনন্দে মেতে থাকা মানুষেরা নিমজ্জি হবে দুঃখের সাগরে।
তুমি যখন এই পৃথিবীতে থাকবে না তখন আমি আমার চুল বড় হতে দেব
তোমার সম্মানে । মরুভূমিতে বনাঞ্চলে সিংহের চামড়া পড়ে ঘুরে বেড়াব । ''
পরের দিনও, প্রথম আলোয় জগত উদ্ভাসিত হওয়া মাত্র, গিলগামেশ বিলাপ করলেন। এভাবে সাত দিন এবং সাত রাত তিনি এনকিডুর জন্য কাঁদলেন। যতক্ষণ না এনকিডুর নশ্বর শরীরে পোকা ধরে গেল। কেবল মাত্র তখনই গিল গামেশ বন্ধুর দেহকে
প্রদান করলেন পৃথিবীর উদ্দেশ্যে । মহান বিচারক আনুনাকি ফিরিয়ে নিলেন তার সন্তান কে।
তখন
গিলগামেশ জমির মধ্য দিয়ে একটি ঘোষণা জারি করলেন, তিনি তাদের সমস্তকে ডেকে পাঠালেন,
গিল গামেশ এবার একটি ঘোষণা করলেন
সমগ্র দেশ জুড়ে। যার সূত্রে উনি ডেকে পাঠালেন সমস্ত তাম্রকার, স্বর্ণকার, প্রস্তর খোদাইকারী
ভাস্কর দের। তাদের আদেশ দিলেন, “আমার বন্ধুর একটি মূর্তি তৈরি কর। মূর্তিটির বুকে সাজানো থাকবে অসংখ্য মরকত
মনির কারু কার্য । সম্পূর্ণ শরীর নির্মাণ কর সোনা দিয়ে।
এরপর শক্ত কাঠের একটি টেবিল প্রস্তুত
করা হল । তার ওপরে রাখা হল কার্নেলিয়ান
পাথর দিয়ে নির্মিত একটি বাটি ভর্তি মধু। আর মরকত মনি দিয়ে বানানো বাটিতে মাখন। গিলগামেশ এই ভোগ উৎসর্গ করলেন সূর্যের উদ্দেশ্যে ।
তারপর কাঁদতে কাঁদতে ওখান থেকে বিদায়
নিলেন।
৩য় অধ্যায় সমাপ্ত
বাকি চার অধ্যায়ের লিঙ্ক
https://amarkolponarjogot.blogspot.com/2020/04/blog-post_21.html
বাকি চার অধ্যায়ের লিঙ্ক
https://amarkolponarjogot.blogspot.com/2020/04/blog-post_21.html
No comments:
Post a Comment