জগন্নাথ
মন্দিরের ইতিহাস
প্রথম
অধ্যায়
মুসলিম
শাসন কালে জগন্নাথ মন্দিরের ইতিহাস
১
নিয়ামত-উল্লাহ তার মাখযান-ই-আফগানা পুস্তকে লিখেছেন, কালাপাহাড় জাজপুরের দিক থেকে পুরীতে গিয়েছিলেন
জগন্নাথ মন্দিরের দিনলিপি বা মাদলাপঞ্জী জানাচ্ছে, কালাপাহাড়ের আগমনের কথা শুনে জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান পরিচালক বা পারিছা জগন্নাথ মন্দির থেকে মূর্তি সরিয়ে নিয়ে চিলকা হ্রদের ভেতর অবস্থিত ছাপালাই হাতিপদ নামক দ্বীপে নিয়ে চলে যান।
খুর্দায় পাওয়া একটি পান্ডুলিপি অনুসারে, খুর্দায়
কাছে কোক্লো গ্রামের গ্রামের প্রধান দনপাহন্ত সিং এর সাথে কালাপাহাড়ের দেখা হয়। কালাপাহাড় জানতে চান, “উড়িষ্যা রাজ্যের প্রধান দেবতা এই মুহূর্তে কোথায়?” দনপাহন্ত সিং তাকে বলে, কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে আমি জানি। কালাপাহাড় তার নির্দেশ অনুসারে যায় এবং জগন্নাথের মূর্তিটি খুঁজে পায়। এর সূত্রে পুরী জেলাতেই ওই বিশ্বাসঘাতক দনপাহন্ত সিংকে জায়গির দেওয়া হয়।
মাদলা
পঞ্জী অনুসারে জানা যায়, কালাপাহাড় সেই মূর্তি হাতির পিঠে চাপিয়ে নিয়ে চলে যান। সাথেই জগন্নাথ মন্দিরের সমস্ত সম্পত্তি লুট করেন। মন্দিরের অন্য বাকি মূর্তিগুলোকে ভেঙেচুরে নষ্ট করে দেন। কল্পব্রত গাছটিকে মাটি খুঁড়ে তুলে তাতে আগুন লাগিয়ে দেন।
নিয়ামাত-উল্লাহ এটাও লেখেন, সুলাইমান জগন্নাথ মন্দিরের ধ্বংসের দিকে মন দেন এবং তার সৈন্যদল নিয়ে সেখানে যান। মন্দির ভেঙ্গে ফেলার আদেশের সাথে
সাথেই খুব সুন্দর করে বানানো সোনার যে কৃষ্ণ মূর্তি ছিল সেটাকে ভেঙে কোথাও ফেলে দিতে। ওই
মূর্তির চোখে দুটো বাদাকশান রুবি বসানো ছিল। সেটা উপড়ে নেন তার আগে। শহরের নানা
স্থানে আরো সাতটি সোনার মূর্তিকেও ভাঙা হয়। তৎকালীন আকবরী ওজন অনুসারে পাঁচ মনের সমান ওজন ছিল সেগুলোর। সেই সোনা অবশ্য সাথে করে
নিয়ে যান। সেই সময় ওই এলাকার মানুষেরা পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেননি। যখন মুসলিম সেনারা আক্রমণ করে তখন ব্রাহ্মণ মহিলারা নিজেদের সমস্ত রকম ধনসম্পত্তি গয়নাগাটি মণিমুক্তো ফেলে দিয়ে আশ্রয় নেন জগন্নাথ মন্দিরে। যখন তাদের কে জানান হয়, মুসলিমরা মন্দির আক্রমণ করতে আসছে,
তারা মন্দির ভেঙে দেবে এবং তাদের বন্দী করে নিয়ে যাবে। তখন অনেকেই এই আক্রমণের কথা বিশ্বাস করতে পারেননি। অবাক হয়ে বলেছিলেন, “সেটা কী করে সম্ভব! তাদের ক্ষমতাই হবে না এই দেবতার কোন ক্ষতি
করার।” যার ফলস্বরুপ বিষ্ময়াহত চোখে তারা প্রত্যক্ষ
করেন কালাপাহাড়ের আক্রমণ। নিজেরা বন্দীও হন।
নিয়ামাত-উল্লাহ কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিয়েই জগন্নাথ মন্দিরের এই আক্রমণের ঘটনা লিখেছিলেন। জগন্নাথের মূর্তি বানানো হত কাঠ দিয়ে সোনা দিয়ে নয়। উড়িষ্যার মানুষেরা এতটাও বোকা ছিলেন না যে, তৎকালীন সমাজে মুসলিমদের আক্রমণ হতে থাকার ঘটনা জানতেন না । কারণ ১৫১১ তেই সুলতান হুসেন শাহ উত্তর উড়িষ্যার অনেক মন্দির ধ্বংস করেছিলেন।
আবুল ফজল এর বক্তব্য এক্ষেত্রে অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি যায়। কালাপাহাড়, সুলাইমানি কারনানির সেনানায়ক, ওই দেশ দখলের জন্য অগ্রসর হন। ওখানকার মূর্তিগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দেন এবং তারপর সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
বাদাওনির লেখনি অনুসারে, সুলাইমান বেনারস এবং উড়িষ্যার এলাকা দখল করে ওই স্থানকে মুসলিমদের বাসস্থানে পরিণত করেন।
মাদলা
পঞ্জীর লেখা অনুসারে, কালাপাহাড় জগন্নাথের মূর্তিকে [দারু ব্রহ্ম] যতদুর জানা যায় গঙ্গা নদী অবধি নিয়ে
এসেছিলেন। ওখানেই চেষ্টা করেন মূর্তিটাকে পুড়ানোর। আগুনের তাপে যখন সেই মূর্তির কাঠে ফাটল ধরে, তখন আধপোড়া সেই মূর্তি ছুঁড়ে ফেলে দেন গঙ্গার জলে। একজন মুসলিম আমির সেটাকে নদী থেকে তুলে নেন এবং নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখেন। বেসরা মহান্তি নামের এক বৈষ্ণব সাধু কালাপাহাড়ের পিছু নিয়েছিলেন। উনি সেই পুড়ে যাওয়া মূর্তি আমিরের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন এবং সেটাকে অত্যন্ত গোপনে নিয়ে যান কটক জেলার কুজাঙ্গে।
গ্রন্থ
সুত্র
দ্য
কারনানি অ্যান্ড লোহানি রুল ইন বেঙ্গল – এন বি রায়, বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড
প্রেজেন্ট, ভলিউম ৭২ পৃষ্ঠা ২২
আইন-ই-আকবরী
ভলিউম ২, পৃষ্ঠা ১২৮
মুন্তাখাবুত
তারিখ ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ১৬৩
মাদলা
পঞ্জী [প্রাচী সংস্করণ]
২
এটা কোন ভাবেই বিশ্বাস করা যায় না যে, কালাপাহাড় জগন্নাথের ওই ভারী মূর্তিটা বহন করে চিলকা হ্রদ এর এলাকা থেকে গঙ্গার তীর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। এমন কি পবিত্র কিছুকে অপবিত্র করার কারনে তার চটজলদি মৃত্যুও ঘটেনি।
অতএব স্বাভাবিক মানসিকতা থেকে যে
কথা মনে করা যেতে পারে, তাতে মনে হয় জগন্নাথ দেবের মূর্তিকে কুজাঙ্গের কাছেই কোন সমুদ্রতীরে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই তত্ত্বকে সমর্থন করার জন্য বেসরা মহান্তির ওই সময় কুজাঙ্গে অবস্থানকে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
আঠারো শতকের শেষের দিকে দানাই দাস বিষ্ণু জগন্নাথ দেবের মূর্তি পোড়ানোর একটি ঘটনা তার তার গোপী ভাষা [ বিষ্ণু প্রতিমা আনালে দাহিলু] নামক কবিনর শুরুতে লেখেন। এটা সেই সময়ের কথা যখন খুর্দার রাজা ছিলেন রামচন্দ্রদেব। যার কথা এই সময় থেকেই বেশি করে মানুষের সামনে আসে। রামচন্দ্র দেব গঞ্জাম জেলার উত্তর দিকে এবং পুরী জেলার দক্ষিণ প্রান্তে একটা ছোট্ট রাজ্যের শাসক ছিলেন। খুর্দা ছিল তারই রাজধানী।
জগন্নাথ মন্দিরের দিনলিপি বলছে, নবম অঙ্ক বা স্থানীয় হিসাব অনুসারে সপ্তম বর্ষের রাজত্বকালে রামচন্দ্র দেব সেই দারুব্রহ্ম বা পবিত্র মূর্তিটিকে কুজাঙ্গ থেকে নিয়ে আসেন এবং খুর্দায় তার অনুকরণে নতুন মূর্তি বানিয়ে স্থাপন করেন। একাদশ [দশম
হওয়াই উচিত] অঙ্কে পুরীতে এই মূর্তি জগন্নাথ দেবের মন্দিরে স্থাপন করা হয়। কর্কটকের ১৮ তম দিনে, ১৭ ই জুলাই ১৫৭৫ সালে, উৎসাহ-উদ্দীপনা উৎসবের সঙ্গে এই বিশেষ অনুষ্ঠান হয়েছিল।
বলা হয়ে থাকে রামচন্দ্রদেব মোঘল সেনানায়ক খান-ই-খানান মুনিম খান দ্বারা দাউদের পরাজয়ের সুযোগ নিয়ে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে এই মূর্তি স্থাপন করেন। মাদলা পঞ্জীর এই তথ্যকে মেনে নেওয়ার জন্য আরো কিছু সঠিক প্রমাণের প্রয়োজন আছে। কুতলু খান লোহানী, যার তত্ত্বাবধানে দাউদ আকবরের শাসনকে অস্বীকার করার ঘোষণা করেন। লোহানী এই সময়টাতে জগন্নাথ দেবের এলাকা এবং তার আশেপাশের এলাকায় নিজের কর্তৃত্ব চালাচ্ছিলেন।
১২ এপ্রিল ১৫৭৫ সালে দাঊদ একটি সন্ধি চুক্তি করেন মুনিম খানের সাথে। তাবাকাত- ই- আকবরী থেকে জানা যায় এই সূত্রেই উড়িষ্যার শাসন ক্ষমতা তার হাতে চলে যায় ।
কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই যে দাউদ বা কুতলু ১৫৭৫ সালের জুলাই মাসে জগন্নাথ দেবের মন্দির সংস্কারের অনুমতি দিয়েছিলেন। মাত্র দশ বছরের কম সময় আগেই আফগান সেনারা সেই মন্দির ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল।
রাজা টোডরমল যিনি মোঘল সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সেনানায়ক ছিলেন, তিনি নাকি জগন্নাথ মন্দির সংস্কারের কথা চুক্তির মধ্যে রেখেছিলেন। কিন্তু দুটো তথ্য এই কথাকে সমর্থন করে না । এক, আবুল ফজল বা নিজাম-উদ্দিন যিনি তাবাকাত-ই- আকবরের লেখক, জগন্নাথ দেবের মন্দির এর এই সংস্কার কার্যের টোডরমলের সমর্থনের কোনো তথ্য লিখে রেখে যাননি। দুই, রাজা টোডরমল শান্তি চুক্তিটির নিয়ম নীতি স্থির করেননি।
যেটা ১৫৯১ সালে রাজা মানসিংহ উড়িষ্যায় মুঘলদের শাসনকালে করেছিলেন। বাস্তবিক পক্ষে টোডরম্লের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা না করেই মুনিম খান দাউদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি করেছিলেন।
এরপর দাউদ আবার বিদ্রোহ করেন। খান-ই-জাহান এবং রাজা টোডরমলের বিরুদ্ধে ১৫৭৬ সালের যুদ্ধে তিনি হেরে যান এবং তার মৃত্যুদণ্ড হয়। মুঘলদের শাসন উড়িষ্যাতে খুব সামান্য সময়ের জন্যই ছিল। ১৫৮০ সালে আফগানরা উড়িষ্যার মোঘল গভর্নর কুইয়া খানকে হত্যা করে। মোঘল এবং আফগানদের ভেতরে উড়িষ্যা কে নিয়ে যুদ্ধ চলে ১৫৮৪ সাল অবধি। তারপরে একটি সন্ধিচুক্তি দ্বারা উড়িষ্যা কুতলু খানের দখলে আসে। এরকম কোন প্রমাণ নেই যে, কুতলু খান জগন্নাথ দেবের উপাসনা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সোজাসুজি ভাবে এটাই ধরে নেওয়া যেতে পারে, সমর্থনযোগ্য তথ্য থাকা সত্বেও, দাউদ এবং কুতলু খান লোহানীর শাসনকালে পুরীতে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে তার উপাসনা হতো না।
এর সূত্র ধরে অবশ্য রামচন্দ্র দেবের গজপতি উপাধি, যা উড়িষ্যার স্বাধীন রাজারা গ্রহণ করতেন, নেওয়াটা কোনও রকম প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ছে না। তার শাসন কালের নানান সূত্র নানান জায়গায় লিপিবদ্ধ আছে। হিন্দি এবং ওড়িয়া ভাষায় লেখা ১৫৮৭ সালের একটি দ্বিভাষিক পান্ডুলিপি থেকে জানতে পারা যায় ১৫৮৭ সালের অর্থ ২৪ অঙ্ক। রাজার নাম সেখানে উল্লেখ নেই। কিন্তু আমরা তাকে খুর্দার রাজা রামচন্দ্র দেব হিসেবেই ধরে নিতে পারি। শ্রীজংগ এবং বালাসোর জেলা থেকে পাওয়া দুটি পাণ্ডুলিপিতে রামচন্দ্র দেবকে ‘শুদ্র গজপতি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেখানে তার ২৮ থেকে ৩০ বছরের স্থানীয় রাজত্বকালের উল্লেখ মিলছে।
আফগানরা উড়িষ্যাতে রাজত্ব করে ১৫৬৮ থেকে ১৫৮৯ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে রাজা মানসিংহ উড়িষ্যা অভিযানে যান। সীমানা পার হয়ে মুঘল সেনাবাহিনীকে আটকাতে আসেন কুতলু খান এবং মৃত্যুবরণ করেন । তার উজির ইসা খান শান্তির চুক্তি করতে বাধ্য হন। আর সেই চুক্তির একটা অংশ ছিল জগন্নাথ মন্দির এবং তার আশেপাশের সমস্ত এলাকাকে বিশেষ স্থান বলে ঘোষণা করা হবে।
তথ্যসূত্র
লেজেন্ড
অ্যান্ড হিস্ট্রি [ওড়িয়া] – ডঃ কে সি পানিগ্রাহি পৃষ্ঠা ৬৮
তাবাকাত-ই-আকবরী
ভলিউম ২ পৃষ্ঠা ৪৩১
বাইলিঙ্গুয়াল
স্টোন ইন্সক্রিপশন অফ দ্যা বারিপদ মিউজিয়াম – এস দে, ও এইচ আর জে ভলিউম ৩ পৃষ্ঠা
৯৪
শ্রীজং
ইন্সক্রিপশনস – এস পটনায়েক – জার্নাল অফ ওড়িষ্যা
অ্যাকাডেমি, মে ১৯৪০
আকবর
নামা
৩
পূর্বোক্ত
সুত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে ১৫৮৯ সালের সন্ধির পরেই মন্দির সংস্কার করা হয় এবং জগন্নাথ মূর্তি স্থাপন করা হয়, ১৫৭৫ সালে নয়। যা মাদলা প ঞ্জীতে বলা হয়েছে। আবুল ফজল লেখেন, মানসিংহ চলে যাওয়ার পর আফগানরা পুনরায় মুঘলদের শাসনকে অমান্য করে এবং জগন্নাথ মন্দিরকে উপাসনা অযোগ্য করে দেয়। ১০০০ হিজরী সন [১৫৯১-৯২], মানসিংহ আবার উড়িষ্যায় আসেন। আফগানরা পরাজিত হয় এবং পুনরায় ওড়িষ্যা মুঘলদের হাতে যায়। মানসিংহ, খুর্দার রাজা রামচন্দ্র দেবের ক্ষমতা কমাতে চান। কিছু আফগান আমীরকে উনি আশ্রয় দিয়েছিলেন এই অজুহাতে।
এবার আমরা আবুল ফজলের কিছু লেখা পড়ে দেখতে পারি। যেখানে উনি তার প্রভুর[আকবর] পক্ষ নিয়েই লিখেছেন। “ রাজা [মান সিংহ] রামচন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন কিন্তু উনি এলেন না। এর ফলে একটা অন্যরকম সমস্যার সৃষ্টি হল।” খুর্দার উদ্দেশ্যে পাঠানো হলো সেনাবাহিনী। “এই কথা শুনে সম্রাট রীতিমত রেগে গেলেন এবং এর বিরুদ্ধে নিজের আদেশ প্রেরণ করলেন। যে কথা ভিত্তিতে রাজা মানসিংহ তার সেনা ফিরিয়ে নিলেন এবং ক্ষমা চাইলেন। রামচন্দ্রদেব সম্রাটের এই মহানুভবতা দেখে নিজের শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। ২১ বাহমান[ হিজরি ক্যালেন্ডারের ১১ তম মাস] দিনে উনি রাজা মানসিংহের সঙ্গে দেখা করলেন এবং অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে তার সাথে ব্যবহার করলেন মান সিংহ।” আকবর সম্ভবত উড়িষ্যার হিন্দুদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার রাখতে চেয়েছিলেন এবং রামচন্দ্র দেবকে সেই জন্য সহায়তা করেছিলেন জগন্নাথ মূর্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে। এটা একজন হিন্দু প্রধান এর উদ্দেশ্যে সম্রাটের মহানুভবতার পরিচয় তো অবশ্যই।
বুদ্ধিমান রাজা মানসিংহ আকবরের আচরণ দেখে নিজের কলাকৌশল বদলে ফেলেন। বুঝতে পারেন রামচন্দ্র দেব আকবরের স্নেহের বা বিশেষ বিশ্বাস ভাজনের তালিকায় আছেন। এরফলেই মানসিং দ্বারা রামচন্দ্র দেব জগন্নাথ মন্দিরের অভিভাবক হওয়ার দায়িত্বও পান।
রামচন্দ্রদেবের
১২ অঙ্ক বা শাসনকালীন বছরে তেলিঙ্গার এক ব্যক্তি, মান কুন্ডদেব, দিল্লির বাদশাহর উদ্দেশ্যে নিজের ক্ষোভ জাহির করেন। বাদশা, রাজা মানসিংহ পাঠান যে এই মুহূর্তে উড়িষ্যার নেতাকে কে সেটা তদন্ত করে দেখে আসতে। তাকেই রাজা বলে ঘোষণা করে আসার নিরদেশো দেন তিনি । মানসিংহ উড়িষ্যাতে আসেন মান কুন্ডদেবের ছেলের সঙ্গে। রাজা রামচন্দ্র দেব তার সঙ্গে দেখা করেন।
চন্দন যাত্রা যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন ওখানকার পুরোহিতরা রাজা মানসিংহকে জিজ্ঞেস করেন গদি প্রসাদ [যা বিশেষভাবে দেবতার উদ্দেশ্যে অর্পণ করা হয় সেই প্রসাদ] কাকে দেওয়া হবে? মানসিংহের বলেন, “প্রসাদ এখানে নিয়ে আসুন।” সেই প্রসাদ যখন তারা নিয়ে আসেন, মানসিং সেটা রামচন্দ্র দেবের হাতে তুলে দেন। এভাবেই উড়িষ্যার রাজা হিসাবে রামচন্দ্রদেবকে তিনি স্বীকৃতি দেন। যদিও এটা একটা নেহাতই সাম্মানিক স্বীকৃতি ছিল, তবু এই সূত্রেই রামচন্দ্রদেব জগন্নাথ মন্দিরের অভিভাবক এ পরিণত হন।
মাদলা পঞ্জী থেকেই জানতে পারা যাচ্ছে, রাজা মানসিংহের মহিষী গৌরী মহাদেবী জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে সংযুক্ত এলাকায় মুক্তি
মণ্ডপ নির্মাণ করে দেন। হিস্ট্রি অফ ওড়িষ্যা গ্রন্থে স্টিরলিং জানাচ্ছেন, ১৫৯১ সালের সময় রাজা মানসিংহ একটি অজানা সূত্র থেকে রাজস্ব আদায় করতেন । এই থেকেই সম্ভবত অনুমান করা যেতে পারে রামচন্দ্রদেব কে আসলে সাড়ে তিন হাজারী মনসবদার নিযুক্ত করা হয়েছিল ।
জগন্নাথ মন্দির মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে সবচেয়ে বিখ্যাত হিন্দু মন্দির এ পরিণত হয়েছিল। এমনকি মুসলিমরাও এটা বিশ্বাস করতেন যে জগন্নাথ দেবের অসাধারণ কিছু ক্ষমতা আছে । মাখযান-ই- আফগানাতে, যা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সম্ভবত লেখা হয়েছিল, সেখানেও এইরকম সবকথার উল্লেখ পাওয়া যায়। জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করার পর সেখানে কি ঘটেছিল নিয়ামত-উল্লাহ সেইসূত্রে লেখেন, “যারা ওই মন্দিরের মূর্তিগুলো তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাদের জীবনে নেমে আসে দুর্ভাগ্য। তারা নানারকম সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। ওদের মধ্যে কেউই নাকি আর এক বছরের বেশি বাঁচেনি।”
হাফত-ইকলিম বা সপ্ত ঋতুর লেখক আহমেদ রাজি তার লেখায় লিখেছেন, যা লেখা হয়েছিল আকবরের শাসনকালের একবারে শেষ মুহূর্ত অথবা জাহাঙ্গীরের শাসনকালে শুরুতে, পুরুষতম গ্রামে একটা মন্দির ছিল। সেখানে একটি অসাধারণ মুহূর্ত ছিল। যে মূর্তিকে সবাই বলতেন জগন্নাথ। ভারতের মানুষেরা জগন্নাথ এর উপর অসম্ভব পরিমানে বিশ্বাস করেন। এই মন্দিরে এসে হিন্দুরা তাদের রক্ত দান করেন এবং প্রয়োজনে সেই রক্তদান করা হয় জিভ কেটে। এরপর যখন সেই ক্ষত স্থান মূর্তিতে ছোঁয়ানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্ষত সেরে যায়। বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী কেউ যদি ওই মূর্তির সঙ্গে অসম্মান জ্ঞাপক আচরণ করে তাহলে তার তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়।”
তথ্যসুত্র
ওড়িষ্যা
হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ জার্নাল, আসগর আলি, ভলিউম ২ পৃষ্ঠা ৮১-৮২
ট্র্যাভেলস
অফ ট্যাভারনিয়ের, পৃষ্ঠা ৪৩২
আকবর
নামা
বর্তমান
গ্রন্থ লেখকের পিতামহ লোকমুখে প্রচলিত এরকম একটি গল্প সংগ্রহ করেছিলেন। নিশাপুরের
মৌলানা লুতফুল-উল্লাহ তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে জগ্ননাথ দর্শনে গিয়েছিলেন।
ব্রাহ্মণদের তারা রাজি করান একবার মুর্তিটা দেখতে দেওয়া জন্য। অবশ্যই এই শর্তে যে
তাদের ভেতর কেউ কোন রকম অসম্মান প্রদর্শন করবেন না। মৌলানার দলবল মন্দিরের ভেতর
প্রবেশ করার খানিকক্ষণ বাদেই দলের এক সদস্য মূর্তি লক্ষ্য করে থুতু নিক্ষেপ করেন।
সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। মৌলানা এই ঘটনা দেখে বিষ্ময়াহত হয়ে গিয়েছিলেন। একটা
অনড় পাথরের মূর্তির এরকম ক্ষমতা কি করে সম্ভব?
উনি
এই প্রশ্নের উত্তর পান নজফের পবিত্র মহজিদে গিয়ে। ওখানে তাকে কেউ একজন জানান,
“জগন্নাথের এই মহা শক্তির উৎস সেই সমস্ত মানুষ যারা তাকে বিশ্বাস করেন। তাদের সামগ্রিক
শক্তি ওই মূর্তির ভেতর সমাবদ্ধ হয়ে আছে। সময়ে সময়ে তার বহিঃপ্রকাশ হয়।”
রিয়াজ-আস-সালাতিন
এর লেখক তার কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছেন এরকমই একটি লেখায়। “জগ্ননাথ, হিন্দুদের
একটি সুবৃহৎ মন্দির, অবস্থান ওড়িষ্যা সুবাতে। বলা হয়ে থাকে হিন্দুরা জগ্ননাথের
অর্চনা করার জন্য আগে পারুস্তম গ্রামে যান । সেখানে তারা মহান সন্ত কবীরের বাড়ির
দরজার কাছে নিজেদের মস্তক মুন্ডন করেন। এই কবীর ছিলেন তাঁতির সন্তান। সেখানে তারা
খাবার ও জল গ্রহণ করেন। যাকে ওই স্থানের ভাষায় বলা হয় ‘তোরানি’। এই কাজ করার পর
ওরা জগ্ননাথের উপাসনা করার জন্য এগিয়ে যান। একমাত্র এই পারুস্তম গ্রামেই হিন্দুরা
মুস্লমান বা অন্যান্য জাতের মত এক পাত্র থেকে সবাই খাদ্য গ্রহণ করেন। যা আর কোথাও
দেখা যায় না। এখানকার বাজারে নানা রকম রান্না করা খাবার পাওয়া যায়। যা কিনে হিন্দু
ও মুসলমানেরা একসাথে বসে খান। পানীয়ও গ্রহণ করেন।”
[পুরীতে
কবীর পন্থীদের একটি ছোট মঠ আছে । ওড়িয়া ভাষায় তোরানি মানে ভাতের ফ্যান। ]
পুরীতে
জাতপাতের ভেদাভেদ না করে একসাথে বসে খাওয়ার এই রীতির উল্লেখ মেলে ১৭৯০ সালে লেখা
আই ক্রফোর্ডের লেখা বই “হিস্ট্রি, রিলিজিয়ন অ্যান্ড লার্নিং অ্যান্ড ম্যানার্স অফ
হিন্দুস” পুস্তকের ৩৮ পৃষ্ঠায়।
এবার
দেখা যাক দুই মুসলিম কবির লেখা দুটো হিন্দী কবিতার সুত্র, যেখানে জগ্ননাথ মন্দিরের
উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। শেরশাহের রাজত্বকালে মালিক মহম্মদ জৈসি লিখেছিলেন ‘পদ্মাবতী’ । কবি তার নায়িকা মেবারের রতনসিকে ওড়িষ্যা নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি সেখানে
দেবতার উপাসনা করেন । কবিতা সুত্রেই জানা যায় সেখানে “রিন্দা [রাঁধা] ভাত” বিক্রি
হয়।
জাহাঙ্গীরের
শাসনকালে গাজিপুরের কবি ওসমান একটি রহস্যময় ভালোবাসার কবিতা লেখেন ‘চিত্রাবলী’
নামে। সেই কবিতার একটি অংশ ‘জগন্নাথ খন্ড’। নেপালের রাজপুত্র সুজন রাই এর
জাহাজডুবি হয় ওড়িষ্যার উপকুলে। উনি কোন মতে তীরে পৌছে এক স্নানরত ব্রাহ্মণকে
জিজ্ঞেস করেন, “এই এলাকার অধিপতি কে?” ব্রাহ্মণ ক্ষুব্ধ স্বরে জবাব দেন, “আপনি কী
অন্ধ? এই এলাকার অধিপতি জগন্নাথ। যিনি সারা জগতের আলোক স্বরুপ। যাকে সারা পৃথিবীর
মানুষ অর্চনা করেন। যার পদস্পর্শে সমস্ত পাপ বিলীন হয়ে যায়।” নেপালের রাজপুত্র
জগন্নাথ মন্দিরে গিয়ে দেবতার অর্চনা করেন।
যাই
হোক আবার আমরা বাস্তব ইতিহাসের পাতায় ফিরে আসি। জাহাঙ্গিরের শাসনকালে জগন্নাথ
মন্দিরকে অনেক ঝড় ঝাপটা সহ্য করতে হয়। কারন
সম্রাট দক্ষিন ওড়িষ্যাতে সাম্রাজ্য বিস্তার করবেন ঠিক করেন। ওড়িষ্যার মোঘল
সুবাদারেরা একের পর এক আক্রমণ চালান মন্দির সংলগ্ন এলাকায়। ১৬০৭ সালে ওড়িষ্যাকে
যখন সুবা বলে ঘোষণা করা হয়, তখন হাসিম খানকে এর সুবাদার নিযুক্ত করা হয়।
কেসোদাস
মারু নামের এক রাজপুত প্রধান তার রাজত্বকালে জগন্নাথ মন্দির আক্রমণ করেন। মির্জা
নাথান নামের এক সমকালীন লেখক তার ‘বাহারিস্তান-ই-গাইবি’ নামক পুস্তকে এই আক্রমণে
বিবরণ লিখে গেছেন।
“কেসোদাস
মারু আর তার সাথীরা তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করেন এবং গায়ের
জোরে মন্দির দখল করেন। মন্দিরে থাকা প্রায় দুই থেকে তিন কোটি টাকা মূল্যে সম্পত্তি
লুঠ করেন এবং ব্রাহ্মণদের আরো ঢং সম্পত্তি নিয়ে আসার আদেশ দেন। এই সংবাদ পৌছে যায়
রাজা পুরুষোত্তমের কাছে। উনি সিদ্ধান্ত নেন বর্ষা ঋতু শেষ হওয়ার আগে এবং রাজকীয়
সেনানায়কদের আগমনের পূরবেই উনি কেসোদাস মারুকে আক্রমণ করবেন। খুর্দা থেকে দশ হাজার
অশ্বারোহী, তিন চার লাখ সাধারন সেনা এবং অজস্র রথ নিয়ে উনি অগ্রসর হন। এক একটি রথে
পাঁচশো থেকে হাজার মানুষ ছিল। যেগূলো দু তিন হাজার মানুষ টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
“কেসোদাসের
সেনারা কাপড়ের গোলকে আগুন লাগিয়ে ছুঁড়তে শুরু করেন। শতাধিক রথ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে বাংলা থেকে কেসোদাসকে সাহায্য করার জন্য রাজকীয় সেনানায়কদের পাঠানো হয়।
পুরুষোত্তম এবার ভয় পেয়ে যান। উনি সম্রাটের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ এবং
তিন লক্ষ টাকা ‘পেসকি’ বা নজরানা রূপে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।”
তথ্যসুত্র
রিয়াজ-আস-সালাতিন,
পৃষ্ঠা ১৮
বাহারিস্তান-ই-গাইবি,
প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা ৩৫-৩৮
৫
খড়ের
গাদায় সূচ খোঁজা আর এই কাহিনী থেকে সত্যি বুঝে নেওয়া একই ব্যাপার। খুর্দার রাজা পুরুষোত্তমের
কাছে খুব বেশী হলে এক লাখ সৈন্য ছিল সে সময়। উড়িষ্যার সেনাবাহিনীতে রথের ব্যবহার
হত না। খুর্দা থেকে পুরীর দূরত্ব মোটামুটি ৫০ মাইল। ফলে পদব্রজে যাওয়াটা কোনো
বাপার না সেই সময়ের নিরিখে। এছাড়াও ওই লেখনীতে পাওয়া যায় জগন্নাথ মন্দির ঘিরে এক
দেওয়াল ছিল যা তাকে দুর্গের মত রক্ষা করত। এটাও ভুল।
মাদলা
পঞ্জী, প্রাচী সংস্করণের ৬৫ পাতা থেকে যা জানা যায় তা অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য।
কেসোদাস মারু পুরীতে তীর্থ যাত্রা করতে এসেছিলেন। এই সময় জগন্নাথ দেবের অধিষ্ঠান ছিল গুন্ডিচা মন্দিরে।
সেখানে স্থিত তিনটি দেব রথ কেসোদাস পুড়িয়ে দেন এবং একটা পাল্কিতে করে জগ্ননাথের
মূর্ত্রকে নিয়ে যান মূল মন্দিরে। তারপর সেই মন্দির এক মাস ধরে অবরুদ্ধ করে রেখে
দেন। এরপর খুর্দার রাজার সাথে তার সন্ধি চুক্তি হয়।
মাদাল
পঞ্জীর বিবরণ থেকেই জানা যাচ্ছে, হাসিম খান পুরী আক্রমণ করেন এবং মন্দির থেকে
জগ্ননাথের মূর্তি বার করে দেন। বাহারিস্তান-ই-গাইবি অনুসারে, খুর্দার রাজা
পুরুষোত্তম, কেসোদাস মারুর সাথে হওয়া চুক্তির কারনে দারুন ভাবে ভেঙে পড়েন। ১৬১১
সালের জুলাই মাসে রাজা কল্যাণকে হাসিম খানের বদলে উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করা
হয়। রাজা পুরুষোত্তম আশা করেছিলেন রাজা টোডরমলের ছেলে এ বিষয়ে তাকে সাহায্য করবেন,
কিন্তু সে আশা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
[বাহারিস্তান-ই-গাইবির
৩৫-৩৮ পৃষ্ঠা অনুসারে, ১৬০৯ বা ১০ সালে এই অবরোধের ঘটনা ঘটেছিল। ১৬১০ সালের ১০ই
এপ্রিল মুঘলদের তরফ থেকে ভালো কাজের নজরানা স্বরুপ একটি ঘোড়া পাঠানো হয় কেসোদাস
মারুকে। জগন্নাথ মন্দিরে উপাসনা বন্ধ করে দেওয়ার সুত্রেই, কোন আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে না এই
শর্তে তাকে চার হাজার অশ্বারোহী সেনা
সাথে রাখার অনুমতি ও দেওয়া হয়।
জার্নাল
অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রির একাদশ খণ্ডর, ৩৯৬ পাতায় শ্রী রাম শর্মা জানিয়েছেন, কেসোদাস
১৫০০ অশ্বারোহী সেনা থেকে ২০০০ অশ্বারোহী সেনা রাখার স্তরে উন্নীত হন। যা ঘটেছিল
জাহাঙ্গীরের শাসনকালের প্রথম বছরে।]
রাজা
কল্যাণ, কেসোদাস মারুর সাজানো ছকেই হাঁটতে থাকেন। উনি খুর্দার সীমানা ধুলোয় মিশিয়ে
দেন। কেসোদাস যে সমস্ত শর্ত আরোপ করেছিল সে সবই পুরুষোত্তমকে মানতে বাধ্য করেন।
যার কারনে উনি নিজের মেয়েকে সম্রাটের হারেমে পাঠাতে বাধ্য হন এক বিপুল পরিমাণ
অঙ্কের নজরানা সহযোগে। সাথেই তার হস্তীশালার সেরা হাতিগুলোকেও পাঠাতে হয় সম্রাটের
সেনা ছাঊনিতে।
মাদলা
পঞ্জীতে খুর্দার রাজার সাথে রাজা কল্যাণের এই গন্ডগোলের উল্লেখ থাকলেও একটা ভুল
তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। ওই লেখা অনুসারে খুর্দার সেনাদের হাতে রাজা কল্যাণ নিহত হন ।
জাহাঙ্গীর
তার স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ১৬১৭ সালে রাজা কল্যাণ উড়িষ্যা থেকে ১৮টি হাতি নিয়ে
এসেছিলেন। কিন্তু খুর্দার রাজকুমারীর হারেমে আসার কোন উল্লেখ সেখানে নেই।
মুকাররম খান, যিনি রাজা কল্যাণের পর সুবাদার হন
তিনি খুর্দার রাজার সমস্ত ক্ষমতাই কেড়ে নেন। সাধারন জমিদারে পরিণত করেন তাকে।
পঞ্জীর
বিবরণ অনুসারে মুকাররম খান বেশ কিছু হিন্দু মন্দির ভেঙে দেন। তৎকালীন জগন্নাথ
মন্দিরের পুরোহিতেরা পুনরায় দেব মূর্তি নিয়ে চিল্কা খাঁড়ি এলাকায় পালিয়ে যান।
১৬২৩
সালে বিদ্রোহী শাহজাহান দক্ষিন দিক থেকে উড়িষ্যাতে প্রবেশ করেন। এই সময় পঞ্জী
অনুসারে পুরুষোত্তমের উত্তরাধিকারী হয়ে ছিলেন নরসিংহদেব। উনি শাহজাহানের পক্ষ নেন।
শাহজাহানের সাথে থাকা রাজপুত প্রধান ভীম সিং মন্দিরে মূর্তি স্থাপনায় সাহায্য
করেন। শাহজাহানের রাজত্বকালে জগন্নাথ মন্দিরে মুসলিমদের আক্রমণ হয়নি। ১৬৩৬-৩৭ সালে মন্দির ভালো ভাবেই সংস্কার করা হয় ।
তথ্যসুত্র
বাহারিস্তান-ই-গাইবি,
পৃষ্ঠা ১৪৪-১৪৫
তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি,
পৃষ্ঠা ৪৩৩
জার্নাল
অফ বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সোসাইটি, জে এন সরকার, সপ্তম খন্ড পৃষ্ঠা ৩৩৮
জার্নাল
অফ বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সোসাইটি, জে এন সরকার, সপ্তম খন্ড পৃষ্ঠা ৪৩৫
১৬৬০
সালে আওরংজেব দ্বারা উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন খান-ই-দৌরান । এই সময় খুর্দার
রাজা মুকুন্দদেবকে তার প্রকোপ সহ্য করতে হয়। তার সাথেই যারাই মূঘল শাসনের বিরোধিতা
করেছিল তাদের শাস্তি পেতে হয়।
কেন্দ্রাপাড়াতে
অবস্থিত বলদেব এর মন্দির ধ্বংস করেন
খান-ই-দৌরান এবং সেখানে একটি মহঃজিদ নির্মাণ করেন। কিন্তু জগন্নাথ মন্দিরে
হাত পড়েনি। এর একমাত্র কারন এক বিপুল পরিমাণ কর সেখান থেকে আদায় হত।
১৬৭৬
সালে শায়িস্তা খান নতুন সুবাদার নিযুক্ত হন। পঞ্জী অনুসারে শায়িস্তা খানের পুত্র
আবু নাসির জগন্নাথ মন্দির আক্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে পুরী রওনা দেন। কিন্তু পিপলির
কাছে তার শিবিরে মুহুর্মুহ বজ্রপাত হয়। নাসির কটকে ফিরে যান। যদিও এই বিবরণের
শক্তপোক্ত প্রমান মেলে না।
[বাহারিস্তান-ই-গাইবির
লেখক নাথান শাহজাহানের দলে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বিদ্রোভী সম্রাট পুত্রের সাথে
খুর্দার রাজার সম্পর্কের কথা কিছু লেখেন নি।
রাজা
মুকুন্দদেব ছিলেন এলাকা সমস্ত জমিদারদের মাথা। যার কথা বাকি জমিদারেরা মেনে চলতেন।
তাকে দেবতার মত সম্মান দিতেন। তার কথা না মানাকে পাপ বলে মনে করতেন। এই কথা জে এন
সরকার তার জার্নাল অফ বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সোসাইটি, জে এন সরকার, ২য়
খন্ডতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ১৯ শতকের কিছু নথি থেকে এটাও জানা যাচ্ছে উড়িষ্যার অনেক
রাজা বা জমিদারই খুর্দার রাজাকে খুব একটা সম্মান দিতেন না।]
১৬৮৭
সালে এক্রাম খান নতুন সুবাদারের দায়িত্ব পান। তাবসিরাত-উল-মাইজিরিন থেকে উল্লেখ
করে ডঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র জানাচ্ছেন, জগন্নাথ মন্দির আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন
সম্রাট আওরংজেব। মন্দির ভেঙ্গে দিয়ে মুর্তিটা তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
খুর্দার রাজা নবাব এক্রাম খানের কাছে জগন্নাথ মূর্তি সম্রাটের কাছে পাঠাতে রাজি
হয়ে যান। চন্দন কাঠ দিয়ে একটা মুর্তি
বানিয়ে উনি পাঠিয়ে দেন। যার চোখে লাগান ছিল দুটি মূল্যবান পাথর। বিজাপুরে এই
মূর্তি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ওই মূর্তি ভেঙে নষ্ট করে একটি
মহঃজিদের ধাপ নির্মাণ করা হয়।
মাদলা
পঞ্জীতে এই ঘটনার উল্লেখ মিলেছে। “মুঘলদের কারনে রাজ্যে চরম সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে।
রাতের বেলায় সমস্ত মূর্তি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চন্দন পুরে। নবাব এক্রাম খান তার
ভাই মারস্তাম খান এবং পঞ্চাশ জন সেনা নিয়ে আক্রমণ করেন। প্রধান প্রবেশদ্বারের চুড়া
এবং ভোগ মণ্ডপের ছাউনী ভেঙে দেয় তারা। কাঠ দিয়ে বানানো একটি জগন্নাথ মূর্তি তারা
সাথে করে নিয়ে যান। নবাবের ভাই পবিত্র স্তম্ভটিকে ভেঙে দেন এবং মন্দিরের দরজা
চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।”এ ঘটনা ঘটেছিল ১৬৯২ সালের মে মাসে। এই সময় থেকে
পরের পনের বছর, আওরংজেবের মৃত্যু কাল অবধি, জগ্ননাথের মুল মূর্তি চিল্কা হ্রদের এলাকায় বানপুরে লুকিয়ে রেখে
দেওয়া হয় ।
১৭১৩
সালে, প্রথম মুর্শিদকুলি খাঁর জামাই সুজা-উদ-দ্দিন উড়িষ্যার ডেপুটি-সুবাদার
নিযুক্ত হন। এই মানুষটি উদার মানসিকতার ছিলেন। ফলে জগন্নাথ মন্দির সংস্কারের
অনুমতি প্রদান করেন।
১৭২৭
সালে সুজা-উদ-দীনের ছেলে তাকি খান তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। ইনি আবার এক্রাম
খানের মতোই মানসিকতার মানুষ ছিলেন। সেই সময়ে খুর্দার রাজা দ্বিতীয় রামচন্দ্র দেবকে
উনি গ্রেপ্তার করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহনে বাধ্য করেন।
বন্দীদশা
থেকে মুক্ত হয়ে দ্বিতীয় রামচন্দ্র দেব ওরফে হাফিজ কাদির জগন্নাথ মন্দিরের দেখভাল
চালিয়ে যেতে থাকেন ।
কিন্তু
ইসলাম ধর্মে সাথে যুক্ত হওয়ার কারনে তাকে ধার্মিক সমস্যার মুখে পড়ে হয়। তাকি খানের
রোষ থেকে বাঁচাতে জগন্নাথ মূর্তি আবার বানপুরে লুকিয়ে রাখা হয়। যা চলে যায় আথগড়ের
জমিদারদের কাছে।
১৭৩৪
সালে তাকি খান মারা গেলে তার শালা দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি তার জায়গা নেন। জগন্নাথ
দেবের মূর্তি মন্দিরে না থাকার কারনে বছরে নয় লক্ষ টাকা কর আদায় কমে গিয়েছিল।
উপদেষ্টা মীর হাবিব, ডেপুটি সুবাদার দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলিকে বলেন মূর্তি ফিরিয়ে
আনার ব্যবস্থা করতে। পুরোহিতদের সেটাই জানানো হয়।
জগন্নাথ
দেবের বার বার গোপন স্থানে যাওয়া এবার থামে। বাংলার সিংহাসন দখল করার পর, ১৭৪১
সালে আলিবর্দী খান দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলিকে
পরাজিত করে উড়িষ্যা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন। মীর হাবিব মারাঠাদের সাথে যোগ
দেয় এবং বাংলা আক্রমণের ছক কষে।
দ্বিতীয়
রামচন্দ্র দেবের পুত্র বীর কেশরী দেব দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলির পলায়নের সুযোগ নেন। ১৭৪৩ সালে যখন রঘুজী ভোঁসলে কটকের দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন, তখন
বীর কেশরী তার পেশকার বা দূত বাহাদুর খানকে উত্তর উড়িষ্যাতে পাঠান তার সাথে দেখা
করার জন্য। বাহাদুর খান একটা ‘চিতাউ’ বা চিঠি পাঠান জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিত বা
‘সেবক’দের উদ্দেশ্যে। সেখানে উনি জানান মারাঠা আক্রমণ বিষয়ে তারা যেন অযথা ভয় না
পান । নিয়মিত উপাসনাও যেন বন্ধ না হয়।
মুহম্মদ
তাকি খান নিশ্চিত ভাবেই তার কবরের ভেতর নড়ে চড়ে উঠতেন, যদি জানতে পারতেন মাত্র দশ
বছরের ভেতরেই একজন মুসলিম ডেপুটি সুবাদার জগন্নাথ মন্দিরের সংস্কারের আদেশ
দিয়েছেন। কারন কর আদায় হচ্ছে না প্রভুত পরিমাণে। এবং জনৈক উচ্চপদস্থ মুসলিম
কর্মচারী মহাপ্রভুর উপাসনা বন্ধ যেন না হয় তার নির্দেশ পাঠাচ্ছেন।
১৭৫১
সালে উড়িষ্যাতে মুসলিম শাসনের পাকাপাকিভাবে অবসান হয়। আলিবর্দি খানের সাথে
মারাঠাদের চুক্তির মাধ্যমে। যদিও ১৭৫৯ সাল অবধি ডেপুটি সুবাদার পদে মুসলিম
শাস্কদেরকেই দেখা গেছে।
১৭৬০
সালে সেও ভাট শাঠে উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন । এই সময় থেকে উড়িষ্যা চলে যায়
মারাঠাদের হাতে।
তথ্যসূত্র
সীয়ার-উল-মুখতারিন
পৃষ্ঠা ৪৯৮
রিয়াজ-আস-সালাতিন
পৃষ্ঠা ৩০২-৩০৩
জার্নাল
অফ বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সোসাইটি, জে এন সরকার, তৃতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ৪২
মাদলা
পঞ্জী [প্রাচী সংস্করণ] পৃষ্ঠা ৭৬
স্টাডিজ
ইন হিস্ট্রি, আরকিওলজি অ্যান্ড আর্কাইভস – পি আচার্য, পৃষ্ঠা ২৪৩
০০০০০
History of the Jagannath Temple by
Sir Hans Singer[editor]
এর আমার করা অনুবাদ
[সম্ভবত
মূল লেখাটি ১৯৫৮ সালে লিখেছিলেন অমর নাথ দ্বিবেদী]
*জলদি আসবে দ্বিতীয় অধ্যায় “ মারাঠা
শাসনকালে জগন্নাথ মন্দিরের ইতিহাস”