বিশ্ব জোড়া বিশ্ব সৃষ্টির ১০টি “মিথ” কথন
প্রতিম দাস
**********
এ ধরাধামে আছে শত শত দেশ । সেখানে বাস করে নানান জাতি উপজাতি ।আমরা সকলেই
মানুষ নামক একটি জাতি । অথচ প্রায় সক লে্র ই
আছে নিজ নিজ গল্প কথা বা মিথ এই জগতের সৃষ্টি বিষয়ে । তার কোনটা অতি
ক্ষুদ্র আবার কোনটা বেশ বড় । কোথাও আকারে ইঙ্গিতে বোঝানো হয়েছে বিশেষ তত্ব আবার
কোথাও বিস্তারিত ভাবে । পড়ে মনে হয় গল্প গুলো যেন বাস্তব নয় । যেন স্বপ্নকথন ।
প্রথম গল্প
আছোমাউই [ACHOMAWI]
উত্তর ক্যালিফোরনিয়ার এক শান্তিপ্রিয় উপজাতি এরা । এদেরকে কো’ম্ম ইদাম বা তুষারের মানুষ নামেও
ডাকা হয়ে থাকে। শিকার, মাছ ধরা এবং নানান ঔষধি গাছ গাছড়া উৎপাদন এদের জীবিকা। মধ্য
১৯ শতকে কুখ্যাত গোল্ড রাস ভায়োলেন্স এর দুর্ভাগ্যজনক শিকার হয়েছিল এই
উপজাতির মানুষেরা। আছোমাউই রা তাদের বিশ্ব সৃষ্টি লোক গ্লপে দুটো প্রানীর উল্লেখ
করে । প্রথম এক রুপালী শিয়াল এবং দ্বিতীয় চিরন্তন ধোঁকাবাজির প্রতীক, কয়োটি [বুনো
কুকুর] ।
সেই আদি সময়ে কেবল মাত্র জল আর পরিষ্কার আকাশ ছিল ।সহসাই এক মেঘের আবির্ভাব হল
আর সেটা বদলে গেল কয়োটিতে আর জলের অপর যে
কুয়াশা জমে ছিল সেটা রুপ নিলো রুপালী শেয়ালের। দুজনেই কোনো অজানা এক কারনে একটি নৌকার
মতো কিছুর চিন্তা করলো একসাথে আর একটা নৌকার আবির্ভাব হল সাথে সাথেই। অনেক অনেক
দিন ধরে রুপালী শেয়াল আর কয়োটি ওই নৌকায় ভেসে রইলো । কিন্তু কাঁহাতক আর ভালো লাগে
এই একঘেয়েমি । তাই একটা অন্য কিছু করার জন্য রুপালী শেয়াল ঘুম পাড়িয়ে দিলোকয়োটিকে
। তারপর ওর গায়ের লোমে আঁচড় কেটে কিছু লোম ছাড়িয়ে নিয়ে একটা মাদুরের মতো জিনিষ
বানালো । তারপার সেটাকে বিছিয়ে দিলো জলের ওপর । তার পর মনে মনে কল্পনা করলো
গাছপালা, পাথর, লতা গুল্ম, ঘাস এবং ফলের । সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সৃষ্টি হলো । এবার
শেয়াল জাগিয়ে দিলো কয়োটিকে ।সে জেগে উঠে সব কিছু দেখে শুনে অবাক হয়ে গেল। খিদেও পেয়েছিল খুব । শুরু করে দিলো খেতে ।
আপাতত ওই স্থানেই ওরা থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো । রুপালী শেয়াল বানালো জগতের প্রথম
ঘর।
***
###জল থেকে এ জগত জন্ম নেওয়ার গল্প এই ক্ষুদ্র কাহিনীতে বিবৃত হয়েছে । রুপালী
শেয়াল আর কয়োটি আসলে আমাদের জীবনে অবস্থা্নকারী দু ধরনের
চরিত্রের প্রতিনিধি । প্রথম দলে থাকে বুদ্ধিমান এবং ইতিবাচক সত্তারা। আসলে এটা
মানবতার প্রতীক। আর দ্বিতীয় দলে যারা কিছু না করে অলস জীবনযাপন করে এবং
ভোগের জন্য বাঁচে । মজা এটাই যে সবকিছুতেই ভারসাম্য দরকার সেটাও জানানো হয়েছে সুকৌশলে। শুধু এক ধরনের দিয়ে কিছু
সৃষ্টি হয় না। বৈপরীত্য বা বৈষম্যও দরকার । ###
দ্বিতীয় গল্প
ACOMA[AA’KU]
বর্তমান দিনে নিউ মেক্সিকো এলাকার পুয়েব্লো সংস্কৃতির মানুষ এই আকোমা[আ’কু]
নেটিভ আমেরিকান উপজাতি । ৬০০ ফুট উঁচূ এক টেবিল টপ পাহাড়ের ওপর এদের পবিত্র
গ্রামের অবস্থান। ওরা যাকে বলে “আকাশ নগরী” । ওদের মতে আজ যেখানে আমেরিকার অবস্থান
সেটাই ছিল এই জগতের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রাম । ১৬
শতকে স্পেনীয়দের হাতে ওদের স্বাধীনতা খর্ব হয় । শুরু হয় নতুন ধর্ম পালন
। তবু নিজেদের প্রাচীন বিশ্বাস ও আচার প্রথা পালন বন্ধ করেনি ওরা । ওদের ভাষার নাম কেরেস । সেই কেরেস ভাষায়
প্রচলিত বিশ্ব সৃষ্টি কাহিনীটি নিচে দেওয়া হলো ।
আদিকালে মাটির নিচের অজানা অন্ধকারে দুই বোনের আত্মার জন্ম হয়েছিল । যেহেতু
ওরা অন্ধকারেই বড় হয়েছিল তাই একে অপরকে ওরা বুঝতে পারতো কেবলমাত্র স্পর্শ দিয়ে।
কিছু সময় ধরে ওদের খাওয়ানোর দায়িত্বে ছিলেন সিচতিনাকো [যে মহিলা ভাবতে পারে] নামের
এক আত্মা। উনিই ওদের কথা বলতে শিখিয়েছিলেন । সেই আত্মার যখন মনে হলো বোনেরা বড় হয়ে
গেছে তখন উনি একটা ঝুড়িতে করে সমস্ত রকম গাছের বীজ ওদের দিলেন
। সাথেই দিলেন আগামী দিনের সব রকম জীব জন্তুর মূর্তি । জানালেন এই ঝুড়ি ওদের বাবার
দেওয়া। ওটাকে মাটির ওপরের জগতে আলোয় নিয়ে যেতে হবে । এরপর উনি বোনেদের সাহায্য করলেন চারটে বীজ খুঁজে নিতে । বোনেরা সেই বীজগুলোকে
অন্ধকারেই রোপন করলো । অনেক অনেক সময় পার করে সেই চারটে বীজ থেকে চারা বের
হল । ওদের ভেতর একটা – পাইন গাছ – বিরাট লম্বা হয়ে মাটি ফুঁড়ে ছোটো একটা ফুটো দিয়ে
উঠে গেল বাইরের জগতে । সিচতিনাকোর সহায়তায় বোনেরা এবার খুঁজে পেলো ব্যাজারের [এক
ধরনের প্রানী] মূর্তি । ওরা ওকে প্রান দান করলো এবং নির্দেশ দিলো ওই ফুটো টাকে বড়
করার । সাথে এটাও বললো, খবরদার যেন বাইরের আলোর জগতে না যায় । ব্যাজারটা সেটা
মেনেও নিলো । এর বিনিময়ে সে পেলো বাইরের জগতে চিরন্তন আনন্দে বসবাস করার আশীর্বাদ
। এবার বোনেরা ঝুড়ি থেকে খুঁজে বার করলো পঙ্গপালের মূর্তি । ওটাকেও জীবন্ত করে
নির্দেশ দিলো গর্তের মুখটাকে মসৃণ করার । একইসাথে গর্তের বাইরে যেতে বারন
ও করলো । পঙ্গপাল কাজ সেরে এসে জানালো সে বারন সত্বেও কৌতূহল সাম্লাতে না
পেরে বাইরের জগতটাকে দেখে এসেছে । বোনেরা জানতে চাইলো, “ কেমন সে জগত ?” পঙ্গপাল
জানালো, “সমতল।”
ঠিকঠাক কাজ করার জন্য বোনেদের সাথে
বাইরের জগতে যাওয়ার অনুমতি পেলো পঙ্গপাল । কিন্তু কথা না শোনার অপরাধের
দন্ডস্বরুপ শাস্তি হল ওকে বসবাস করতে হবে জমির ওপরে । আয়ু হবে খুব কম এবং প্রত্যেক বছর নতুন করে জন্ম নিতে হবে ।
সিচতিনাকোর কথা মতো এবার পাইন গাছের গুঁড়ির সাহায্য নিয়ে বাইরের জগতে বেরিয়ে
এলো যমজ বোনের আত্মারা। সাথে থাকলো সেই ঝুড়ি, ব্যাজারটা আর পঙ্গপাল । অপেক্ষা করলো সূর্য
ওঠা পর্যন্ত । সিচতিনাকো বলে দিয়েছিল ওটার আগমন হবে পূর্ব দিকে । উনিই ওদের চিনিয়ে
দিয়েছিলেন বাকি তিনটে দিক । সাথেই শিখিয়ে
দিয়েছেন সূর্য বন্দনা । সূর্য উঠতে দেখে ওরা সেই বন্দনা গান জোরে জোরে উচ্চারন
করলো । এটাই ছিল এ জগতের আদি সঙ্গীত।
সিচতিনাকো ওদের জানিয়েছিল সে এই কাজ করছে স্রষ্টা উচতসিতির নির্দেশ অনুসারে।
যিনি এই জগত বানিয়েছেন এক দলা রক্ত পিন্ড থেকে। বোনেদের কাজ হলো সেই জগতে ঝুড়ির
জিনিষগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং প্রান দান করা। ওরা সেই কাজটাই করলো । বীজ রোপণ করলো
আর জীবজন্তুর মূর্তিগুলোতে দিলো প্রান ।
ওদের জীবনে এলো প্রথম রাত । অন্ধকারে ভয় পেয়ে ওরা স্মরণ করলো সিচতিনাকোকে।
তিনি এসে জানালেন এটা হল ঘুমানোর সময় । চিন্তার কিছু নেই সূর্য আবার ফিরে আসবে ।
### আকোমাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক । যে কারনে এদের গল্পে সেই
অর্থে পুরুষ দেবতার অস্তিত্ব নেই । জগতের
সৃষ্টি হচ্ছে মাটির তলায় বা পৃথিবীর ভেতরে । আসলে এতো মাতৃ গর্ভের প্রতীকী রুপ ।
একবার মাত্র মহান স্রষ্টার কথা উল্লেখ হয়েছে । মেয়েদের হাতে শাসনের ভার অতএব
স্বাভাবিক ভাবেই গল্পেও তার প্রতিচ্ছবি । মহান স্রষ্টার কাজ বীজ দিয়েই শেষ বাকি সব
কিছুই করছে মহিলারা । সিচতিনাকো নামক চরিত্রটি আসলে চিরন্তন ওঝা বা পুরোহিততন্ত্রের প্রতিনিধি । যদিও
আকোমাদের কাহিনীতে তার উদ্দেশ্য সব সময়েই ইতিবাচক পথ নির্দেশকের।
আত্মা বলে উল্লেখ করলেও আমরা আত্মা বলতে যা বুঝি তা ঠিক নয় এরা । আসলে এরা এক
ধরনের বিশেষ সত্তা । সময়ের সাথে সাথে নিয়ম
অনুসারেই উপরিউক্ত কাহিনীতে অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে। কোথাও দুই বোনের মধ্যে ঝগড়া
দেখানো হয়েছে। কোথাও মহান পিতার আদেশ না
মেনে রামধনুর থেকে ঝড়ে পড়া গরম বৃষ্টির ফোঁটা নিজের শরীরে ধারন করে নউতসিতি
গর্ভবতী হয়েছে। জন্ম দিয়েছে দুই সন্তানের । আর এর শাস্তি স্বরুপ সিচতিনাকো ওদের
ছেড়ে চলে গেছে। এদের মধ্যে একটিকে মানুষ করেছে প্রথম বোন ইয়া-তিকু । পরে সে ওর
স্বামীতে পরিণত হয়েছে । ওদের থেকেই জন্ম হয়েছে এই জগতের প্রথম মানুষদের ।
এই উপজাতির ভেতর আর একটি গল্প চালু আছে। যেখানে বলা হয়েছে কাচিনা নামক একদল
আত্মার কথা। নিউ মেক্সিকো আর অ্যারিজোনা অঞ্চলের পুয়েব্লো মানুষদের কাছে এ এক অতি
পরিচিত নাম । কোনো গল্পে এই কাচিনাদের সৃষ্টি করেছে ইয়া-তিকু । ###
তৃতীয় গল্প
AINU [আইনু]
জাপানের উত্তর প্রান্তের দ্বীপে বসবাস কারী এবং জাপানী ভাষায় কথা না বলা
মানুষের গোষ্ঠী আইনু বা ইজো । যার অর্থ মানুষ বা জনগণ ।
একেবারে শুরুর সময়ে কাদা এবং জলের এক মিশ্রন ছিল । তার থেকেই এই জগতের সৃষ্টি
। সে সময় কোন জীবন্ত প্রানী ছিল না। ভগবান, শয়তান এবং নানান পশু বসবাস করতো আমাদের এই
জগতের ওপর এবং নীচের দুটো আলাদা জগতে ।
ওপরের জগতকে বলা হয় স্বর্গ । সবচেয়ে উঁচু স্বর্গে বসবাস করেন স্রষ্টা ভগবান
কামুই । তার এলাকা ঘেরা আছে সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে । তাতে লাগানো আছে লোহার এক দরজা
। কামুই ঠিক করলেন বিশাল এক মাছের পিঠে
একটা জগত বানাবেন । যাকে ছেড়ে দেবেন জলে । সে নড়াচড়া করলে সমুদ্রের ঢেউ সৃষ্টি
হবে।
সবার আগে উনি বানালেন একটা ছোট্ট ওয়াগটেইল পাখি । চারদিকে তো জল ।
বেচারী পাখি কি করে । সে তার ডানা ঝাপ্টাতে থাকলো জোরে জোরে । সেই হাওয়া লেগে
কাদামাটি শুকালো । জন্ম হল একটা দ্বীপের । সেই দ্বীপেতেই এখন আইনু
রা বসবাস করে ।
### আর একটি গল্প অনুসারে শয়তান স্রষ্টার কাজে বাধা দেওয়ার জন্য
সূর্যকে গিলে নিয়েছিল । সেটাকে উদ্ধার করার জন্য কামুই একটা কাককে পাঠিয়ে দেন ।
সূর্যের আলোয় নতুন জগতটা খুব ভালো লাগে কাকটির । সে অনুরোধ জানায় তার
ওখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক । তখন কামুই মাটি আর কিছু কাঠি দিয়ে আইনুদের দ্বীপটাকে
বানিয়ে দেন।
আইনু গোষ্ঠীর লোকেদের গায়ে বড় বড় লোম । তারা মনে করে তাদের আদি ভগবান ভাল্লুক ছিল । ওদের সভ্যতায় ভাল্লুকের টোটেম
বা চিহ্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ।
আরো একটি কাহিনী অনুসারে, যেখানে জাপানী প্রভাব দেখা যায়, জানা যায় এক স্বর্গীয় দম্পতির কথা। ওকিকুরুমি এবং তুরেশ । যাদের সাথে জাপানী উপকথার ইজানামি এবং
ইজানাগির খুব মিল । এদের নির্মাণ
করে এ জগতে পাঠিয়েছিলেন মহান স্রষ্টা । ওরা বসবাস করতো এক পাহাড়ের ওপর। এদের প্রথম
সন্তানই হল প্রথম আইনু । কারো মতে তার নাম ছিল আইয়োনিয়া। এই ছেলে ওদের সংস্কৃতিতে
একজন নায়ক । যে ওদের শিখিয়েছিল কি ভাবে বেঁচে ও টিঁকে থাকতে হয় । সে যখন স্বর্গে
যায় তখন নাকি তার পোশাক থেকে মানুষের গন্ধ মুছে যায়নি । তাই তাকে আবার এ জগতে ফিরে
আসতে হয় । আইয়োনিয়া সে পোশাক ত্যাগ করলে
সেটা থেকে নানান জীব জন্তুর জন্ম হয় । এই গল্পের আরো একটি রূপান্তর অনুসারে আইয়োনিয়া
আসলে স্রষ্টা নিজেই । যিনি মানুষের রুপে মানুষকে পথ দেখানোর জন্যই তাদের সাথে
বসবাস করতেন । ###
চতুর্থ গল্প
ALGONQUIN [অ্যালগনকূইন]
অ্যালগনকুইন নামে একটি ভাষাও আছে । যা ব্যাপকভাবে অনেক নেটিভ আমেরিকান
গোষ্ঠীরা ব্যবহার করে থাকে। আনিশিনাবে, ব্ল্যাকফুট বা পেনবস্কট তাদের ভেতরে
উল্লেখ্য। আজকের অ্যালগনকুইনরা কানাডার একটি নেটিভ ইন্ডিয়ান উপজাতি । যাদের
অ্যানিসিনাপে বা ওমানি উইনিনিওয়াক নামেও ডাকা হয় ।
এদের একটি গল্প অনুসারে মহান পৃথিবী মাতা এই জগতের নির্মাণ করেছেন । উনি
সৃষ্টি করেন দুই সন্তানকে । ওদের নাম দেন গ্লুস্ক্যাপ [ বা মিছাবো ] এবং মালসুম ।
প্রথম জন সংস্কৃতির নায়ক এবং ইতিবাচক নির্মাতা । দ্বিতীয়টি ধ্বংসাত্বক নির্মাতা
এবং শয়তান। রুপ নেকড়ের ।
পৃথিবী মাতা একদিন মারা গেলেন । গ্লুস্ক্যাপ নিজের শরীরের অংশ দিয়ে নির্মাণ
করলো এ জগতের সব কিছু । বানালো নানান প্রানী এবং মানুষ । অন্যদিকে শয়তান মালসুমও
বসে রইলো না। সেও বানালো যত রাজ্যের ভয়ানক প্রানী এবং গাছপালাদের ।
এই দুই বিপরীতমুখী ভাইয়ের ভেতর সংঘাত নিশ্চিত ছিল । দুজনেরই ছিল একটি করে
দুর্বল বিষয় । মালসুম এর মৃত্যু হবে এক বিশেষ ফার্ন গাছের শিকড়ের সহায়তায় । আর
গ্লুস্ক্যপ এর মৃত্যুর কারন হবে একটি প্যাঁচার পালক ।
মালসুম প্যাঁচার পালকের তীর বানিয়ে হত্যা করলো গ্লুস্ক্যাপকে । শুরু হল
শয়তানের রাজত্ব । যদিও অলৌকিক উপায়ে বেঁচে গেল গ্লুস্ক্যাপ । কারন ভালোর কখনো
খারাপ পরিণতি হয় না । এবার সে শেষ করে দিলো মালসুমকে । কিন্তু মালসুমকেও সম্পূর্ণ
নিশ্চিহ্ন করা গেল না। এটাই চিরন্তন ভারসাম্য । ভালো থাকলে খারাপকেও থাকতে হবে।
এবার তার স্থান হল মাটির নিচে পাতালে । অন্যদিকে গ্লুস্ক্যাপ তার সাদা ক্যানো [এক
ধরনের নৌকা] তে করে চলে ওপরে, স্বর্গে।
এরপর এক বছর কেটে গেল । মানুষের বসতির পাশ দিয়ে যে জল ধারা বয়ে যেত সেটা
শুকিয়ে গেল । মানুষদের এক জন উত্তর দিকে দেখতে গেল এরকম হওয়ার কারনটা কি । চলতে চলতে সে জলধারার এক অপেক্ষাকৃত চওড়া স্থানে এসে উপস্থিত হল । দেখতে পেলো
সেখানকার জল হলুদ এবং দুষিত হয়ে গেছে। মানুষটার খুব তেষ্টা পেয়েছিল । যে কারনে
ওখানে বসবাসকারি মানুষদের কাছে একটু জল চাইলো খাওয়ার জন্য। উত্তরে, মানুষগুলো
জানালো ওরা জল দিতে পারবে না। জল নিতে হলে আরো উত্তর প্রান্তে গিয়ে এই জল ধারার
মালিকের অনুমতি নিতে হবে। অগত্যা মানুষটা চললো সেই মালিকের কাছে। মালিক আসলে ছিল
এক দৈত্য । একটা বিরাট গর্ত খুঁড়ে সে সব জল সেখানে আটকে রেখে দিয়েছিল ।
তৃষ্ণার্ত মানুষটা জল চাইলো দৈত্যটার কাছে। সেটা শুনে বিশাল এক গর্জন করে
দৈত্যটা হাঁ করলো । দেখা গেল ওটার বিরাট বিরাট দাঁতের ফাঁকে নানা পশুপাখী ও
মানুষের দেহাবশেষ লেগে আছে। বোঝাই যাচ্ছে
সে ওদের চিবিয়ে খেয়েছে।
এই দেখে এক ছুটে মানুষটা পালিয়ে এলো নিজেদের এলাকায় । সবাইকে জানালো কি দেখেছে
সে। এদিকে ওপরে স্বর্গ থেকে সব কিছু দেখতে পেলো গ্লুস্ক্যাপ । নিজের সৃষ্টি করা
সন্তানদের সাহায্য করার বাসনা জাগলো তার মনে । পড়লো যুদ্ধের সাজ। রন হুঙ্কার এবং
ওজনদার পদক্ষেপে কাঁপিয়ে দিলো জমি । লোহা পাথরের একটা পাহাড় উপড়ে নিয়ে বানাল এক
অতিকায় ছোরা । তারপর উপস্থিত হল দৈত্যের ডেরায়। লেগে গেল ধুন্ধুমার যুদ্ধ । দৈত্য
গিলে ফেললো গ্লুস্ক্যাপকে। সাথে সাথেও ছোরা দিয়ে পেট চিরে বেরিয়ে এলো উপকথার নায়ক
গ্লুস্ক্যাপ ।
আটকে রাখা গর্তের জল আবার বইতে শুরু করলো জলধারা দিয়ে। দৈত্যটাকে দুমড়ে মুচড়ে
ছোট্ট করে একটা বড় কোলাব্যাঙে রূপান্তরিত করে ছুঁড়ে ফেলে দিল কাদায় ভরা
জলাভুমিতে।
### আকাশ থেকে নয় এই জগত থেকেই সব কিছুর জন্ম হয়েছে এই ভাবনা পৃথিবীর অনেক
জনগোষ্ঠীই বিশ্বাস করে । এই গল্প তার একটা প্রমান । পৃথিবী মাতার শরীর থেকেই সব
জীব জন্তু গাছপালার জন্ম হয়েছে আর উনি নিজের আত্মাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাদের ভেতরে।
নিজের শরীরটাকে দান করেছেন তাদেরই বাসস্থান রুপে।
জন্ম- জীবন - মৃত্যু – পুনঃ জন্ম এই চক্রে চলে সব কিছু । কোনো দেবতার
নিয়ন্ত্রনে নয় এটাই মানে অ্যালগনকুইনরা ।
শিকারের চেয়ে চাষাবাদে বেশী ভরসা করে ।
তাই এ কথনে শিকারের কোনও উল্লেখ নেই । ###
পঞ্চম গল্প
ALTAIC [ অ্যালতেইক ]
অ্যালতেইক শব্দটি তুর্কী, মঙ্গোলিয়া এবং টাঙ্গুস এই তিন প্রধান ধারার একত্রিত
রুপ বলেই মানা হয় । যদিও বিষয়টি সার্বজনীন মান্যতা পায়নি । এশিয়া মাইনর থেকে মধ্য,
পূর্ব এবং উত্তর এশিয়া জুড়ে এই ভাষায় প্রচুর মানুষ কথা বলেন । তুর্কী ও মঙ্গোলিয়ার মানুষ ছাড়াও সেখানে আছে
মাঞ্চুরিয়ান এবং ককেশাসের মানুষ । নিম্নলিখিত কাহিনী প্রচলিত আছে ককেশাসের এলাকায়
।
সৃষ্টির আদিকালে এ জগতে জল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। একদিন সেই জলের ওপরে দুটো
কালো রাজহাঁস এদিকে ওদিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল । ওদের ভেতরে একটি আসলে স্রষ্টা স্বয়ং ।
আর দ্বিতীয় টা প্রথম মানুষ । একই সাথে সে আবার শয়তান। সে চেষ্টা করছিল স্রষ্টা
ভগবানের চেয়ে উঁচুতে ওড়ার । এটা বুঝতে পেরে রেগে গিয়ে ভগবান মানব-শয়তানকে ফেলে
দিলেন জলে। হাবুডুবু খেতে খেতে সে সাহায্য চাইলো । ভগবান বললেন, যাও ডুব দিয়ে জলের
তলা থেকে একটা পাথর তুলে নিয়ে এসো । মানব-শয়তান সেটাই করলো । ভগবান সেটা পরিবর্তিত
করলেন পৃথিবী রুপে। এবার পৃথিবীকে সাজানোর জন্য আরো কিছু পাথর তুলে আনতে বললেন।
শয়তান সেটা করলো কিন্তু কিছু পাথর নিজের
মুখের ভেতর লুকিয়ে রাখলো । ভগবান মন্ত্রবলে পাথরগুলোকে বড় করতে শুরু করতেই শয়তানের
মুখের পাথরগুলোও বড় হতে থাকলো । ভয় পেয়ে সে আবার সাহায্য চাইলো । বেশ কিছুক্ষন
কষ্ট ভোগ করানোর পর ভগবান মানব-শয়তানকে বললেন পাথরগুলো উগড়ে দিতে । সেই সব লালা
মাখা পাথর থেকে এ জগতে জন্ম হলো জলাভুমির।
সাইবেরিয়া এলাকা থেকে প্রাপ্ত আর
একটি অ্যালতেইক কথন ।
কাহিনী অনুসারে জানা যায় স্রষ্টার নাম
আলজেন এবং মানুষের নাম এরলিক । আলজেন আদিম জলের ওপর দিয়ে কাদা মাটির ঢেলা ভেসে
যেতে দেখছিলেন একদিন। তার ভেতরেই একটাতে তিনি দেখতে পান প্রথম মানুষের মুখাবয়ব ।
তাকেই প্রান দান করেন । সেই হয় এরলিক । কিছু দিনের ভেতরেই এরলিকের মনে হয় সেও
আলজেনের মতো মানুষ নির্মাণ করতে পারে । এই ঔদ্ধত্য দেখে ভগবান ওকে পৃথিবীর শেষ
প্রান্তে ছেড়ে দিয়ে আসেন । এখানে সে শয়তানে পরিণত হয় । তারপরেই ফিরে আসে ।
এরলিককে তাড়িয়ে দেওয়ার পর ভগবান পৃথিবী নির্মাণ করেন । আটটা গাছ বানিয়ে তার
ওপর আটটা মানুষকে স্থাপন করেন । সোনার
পাহাড়ের ওপর অবস্থান কারী অষ্টম গাছের
অষ্টম মানুষটার নাম ছিল মেইদেরে । ভগবানের ইচ্ছানুসারে মেইদেরে নির্মাণ
করেন প্রথম মানবীকে। কিন্তু তাকে প্রান দিতে পারে না। সাহায্য নেওয়ার জন্য চলে যায় আলজেনের কাছে। মানবীকে রেখে যায় এক লোমহীন কুকুরের
তত্ত্বাবধানে । এই সময় এরলিক আসে কুকুরটার কাছে । লোমের একটা কোট
দেওয়ার লোভ দেখায় । বিনিময়ে চায় মানবীকে একবার দেখতে । শুধু দেখেই না সে তাকে
শোনায় সপ্তসুর । এর ফলে মানবী প্রান পায় । সাথেই নানা রকম ধরনের বাজে ব্যবহার করার
প্রবণতাও ঢুকে পড়ে মানবীর ভেতরে।
মেইদেরে ফিরে এসে মানবীকে জীবন্ত দেখে অবাক হয়ে যায় । জানতে পারে এরলিকের
আগমনের কথা সাথেই কুকুরটার বেইমানী । অভিশাপ দেয় এখন থেকে সারাজীবন লাথি ঝাঁটা খেয়েও মানুষের প্রতি তাকে
অনুগত্য দেখাতে হবে ।
### দ্বৈত সত্তার অবস্থান অ্যালতেইক মিথের মূল ভিত্তি । ইসলাম, বৌদ্ধ,
জরাথুস্ট্র এবং খ্রিষ্টান ধর্মের প্রভাব গল্প গুলিতে দেখতে পাওয়া যায় । এরলিকের
শয়তানে পরিণত হয়ে মানবীকে মানসিক ভাবে দুষিত করা আর
হিব্রু কাহিনীতে সাপের দ্বারা জগতের আদিম মহিলাকে প্রলুব্ধ করার উল্লেখ এ প্রসঙ্গে করা যেতেই পারে ।
এদের কাহিনীতে শয়তানের এক বিশেষ ভুমিকা লক্ষনীয় । জগত নির্মাণ প্রক্রিয়ায় এদের
সক্রিয় অংশ গ্রহণ থাকে। মূল কাজ হল আদিম মানব মানবীর মানসিকতাকে দুষিত করা ।
প্রচলিত নানান গল্প ভালো করে পড়লে কেন জানিনা মনে হয় স্বয়ং ভগবানই যেন চেয়েছেন
এরকম কিছু হোক । ###
ষষ্ঠ গল্প
ANATOLIAN [আনাতোলিয়ান]
খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় সহ স্রাব্দের শুরুর দিকে এক ইন্দো ইউরোপীয়ান ছিল। যাদের
পরিচিতি ছিল হিত্তি নামে । এরা দখল করেছিল তত্কালীন এশিয়া র তুর্কী এলাকা । যার
নাম ছিল তখনকার দিনে আনাতোলিয়া । এরা কিউনিফরম লিপি ব্যবহার করলেও হিত্তি ভাষাই
ছিল প্রধান। এদের প্রতিবেশি ছিল হুরিয়ান রা। অনেক রকম ভাষা এবং ধর্ম প্রচলিত ছিল
সেখানে । ফল এ এক জগাখিচুড়ী সংস্কৃতি বজায় ছিল বলা যেতে পারে। তার কারনেই এদের
পৌরানিক কাহিনীতে শুধু হিত্তি বা হুরিয়ান বা হাত্তিক ভাবনার প্রকাশ দেখা যায়
না। প্রাক গ্রীক এবং প্রাক ইসলামিক
আনাতোলিয়াতে মিলে মিশে গিয়েছিল নানা ধরনের গল্প কথা । যার সাথে যুক্ত হয়েছিল মেসোপ
টেমিয়া এবং কান্নাইট দের ভাবনা।
হাত্তিয়ান দের এক অতি প্রাচীন দেবী মাতার উল্লেখ পাওয়া যায় । যার উ ৎ প ত্তির
শিকড় নিও লিথিক ক্যাটাল হুইউক এর সাথে জুড়ে আছে । ইনিই সমস্ত জীবনের উৎস এবং ঝড়ের
দেবতার স্ত্রী । এই ঝড়ের দেবতা জিউস, ইন্দ্রম থর বা ওই ধরনের দেবতাদের সমগোত্রীয় বলা যায় ।
অবস্থান করেন পর্বতের চুড়ায় নিজের রাজ ধানীতে । বেশীর ভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন নিজের
সিংহাসন বাঁচানোর যুদ্ধে ।
দেবী মাতা এবং ঝড়ের দেবতার দুই মেয়ে । মেজুল্লা এবং ইনারা । প্রথম জন, মানুষ
এবং স্বর্গের ভেতর সংযোগ রক্ষা কারীনি । দ্বিতীয় জন , বাবার সাথে ব্যস্ত থাকেন
যুদ্ধ বিগ্রহে ।
### আনাতোলিয়ান সংস্কৃতি তে সেইভাবে
কোনও গল্প পাওয়া যায় না যার সাহায্যে
বিশেষ কোনো সৃষ্টি তত্ব বর্ণিত হয়েছে । কিন্তু আদি মাতা যে আসলে উর্বরতার প্রতীক
এবং ঝড়ের দেবতা মানেই বৃষ্টিপাত এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না । অর্থাৎ
সেই চিরন্তন কাহিনী । শুধুমাত্র ইঙ্গিতে বলা আছে।###
সপ্তম গল্প
ANISHINABE [OJIBWE, CHIPPEWA]
অ্যানিশিনাবে [অজিবুই, চিপ্পিউয়া ]
অ্যালগনকুইন ভাষায় কথা বলা একটি প্রজাতির মানুষদের ডাকা হয় অ্যানিশিনাবে
নামে। অজিবুই বা চিপ্পিউয়া নামেও পরিচিত
এই মানুষদের বসবাস ক্ষেত্র ছিল গ্রেট লেক এলাকা । যা এখন আমেরিকা ও কানাডা নামে
পরিচিত। অ্যানিশিনাবে নামের অর্থ “জনগণ” । এদের পৌরানিক গল্প কথায় নানাবোঝো বা মানবোঝো বা মিছাবো বা মিশাবুজ বা
বিরাট খরগোশ ইত্যাদি নামধারী পথপ্রদর্শক সংস্কৃতি নায়ক এবং কৌশলবাজ আত্মার উল্লেখ
পাওয়া যায় । এই নানাবোঝোর সাহায্যে একটি ভগ্নপ্রায় জগত পুনঃ নির্মাণের কাহিনীই মূল
বিষয় ।
মহান সত্তা বা আত্মা কিচি-ম্যানিতু আসল জগত এবং তার আসল অধিবাসী অ্যানিশিনাবেদের
নির্মাণ করেছিলেন। সে জগত ছিল দারুন সুন্দর । কিন্তু মানুষ আস্তে আস্তে শয়তানে পরিণত
হয়। নষ্ট করতে শুরু করে সব কিছু। এর ফলে প্রকৃতির সাথে তাদের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে
যায় । এসব দেখে মহান সত্তা এক বিশাল বন্যার জন্ম দেন । যার ফলে নানবোঝো এবং কিছু
সাঁতার কাটতে ও উড়তে সক্ষম প্রানী ছাড়া সব ধ্বংস হয়ে যায় । একটি ভাসমান গাছে
গুঁড়িতে আশ্রয় নেয় নানাবোঝো আর ওই প্রানীরা ।
বেশ কিছু সময় কেটে যাওয়ার পর নানাবোঝো বলে সে জলের তলায় ডুব দিয়ে মাটি তুলে
আনবে এবং নতুন জগত নির্মাণ করবে। অনেক অনেক দূর পর্যন্ত ডুব দিয়েও নানাবোঝো মাটি
দেখতে পায় না। ওর সাথে যে প্রানীরা ছিল তাদের অনেকেই জলে ডুব দিতে ওস্তাদ । তারা
নানা বোঝোকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। লুন নামক বড় জলজ পাখি ব্যর্থ হলো । এক এক করে
হেল্ডাইভার হাঁস, মিঙ্ক এবং কচ্ছপ ও কিছুই খুঁজে পেলো না । প্রায় মরো মরো হয়ে ফিরে
এলো সব । তখন মাস্কর্যাট অনুমতি চাইলো একটা চেষ্টা করে দেখার । বাকি প্রানীরা ওই
ছোট্ট প্রানীর কথা শুনে বারন করলো কাজটা করতে । কিন্তু নানবোঝো বললো, ঠিক আছে দেখো
একবার চেষ্টা করে ।
জলে ডুব দিলো মাস্ক র্যাট । অনেক অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার ভেসে উঠলো ছোট্ট
প্রাণীটা । নানাবোঝো ওকে তুলে নিলো গুঁড়ির ওপর
এবং বুঝতে পারলো প্রাণীটা মরে গেছে। কিন্তু দেখা গেল মাস্কর্যাটের থাবায়
আটকে আছে মাটি । অর্থাৎ জলের একেবারে নিচে যেতে পেরেছিল ছোট্ট মাস্ক র্যাট ।
এবারে কচ্ছপটা প্রান উৎসর্গ করলো এবং নিজের শরীরকে স্থাপন করলো জলের ওপর ।
মাস্কর্যাটের থাবায় থাকা মাটি দিয়ে ছোট্ট
একটা গোলক বানিয়ে রাখা হল কচ্ছপের পিঠের
ওপর । বাকি প্রানীরা কিচি-ম্যানিতুর কাছে সাহায্যের প্রার্থনা জানালো । কিচি-
ম্যানিতু চারদিক থেকে হাওয়া পাঠালেন। কচ্ছপের দেহর ওপর থাকা মাটির
গোলকে সেই হাওয়া লাগতেই ওটা বাড়তে শুরু
করলো এবং একসময় সেটা পরিণত হল একটা দ্বীপে । এমন এক দ্বীপ যা অবস্থান করছে কচ্ছপের
পিঠের ওপর। এসব দেখে নানাবোঝো আর বাকি প্রানীরা আনন্দে নাচতে ও প্রার্থনা করতে
থাকলো । ধীরে ধীরে আরো অনেক কিছু জন্ম নিলো সেই বিশাল গোলকে। সেই গোলকই আজকের
পৃথিবী যেখানে আমরা বসবাস করি ।
### আদি জগত, সেখানে বিশাল মাপের বন্যা এবং নতুন জগতের বিনির্মাণের কাহিনী
অনেক অনেক দেশের সংস্কৃতিতেই দেখতে পাওয়া যায় । অ্যানিশিনাবেদের এই কথনে একাধিক
নেটিভ আমেরিকান গোষ্ঠীর মতোই জলে ডুব দিয়ে মাটি তুলে আনার উল্লেখ রয়েছে। কচ্ছপের দ্বারা এ জগতের ভার নেওয়ার গল্পও বেশ
কিছু মিথ কথনে অতি প্রচলিত। সামান্য দৈবিক সাহায্য ব্যতীত নতুন জগত নির্মাণ এজগতের
প্রানীদের দ্বারাই হচ্ছে এটাও এ কাহিনীর এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য । ছোট্ট মাস্কর্যাটের
আত্ম বলিদান ইঙ্গিত করে মহান সত্তা যতই বড় হোন না কেন ক্ষমতাবান হোন না কেন
ক্ষুদ্র প্রানীদের অবদান কিছুতেই অস্বীকার করা উচিত নয় কোনও কাজের
ক্ষেত্রে। ###
অষ্টম গল্প
ARANDAN [ARUNTAN]
আরান্ডান [আরুন্টান]
মধ্য অস্ট্রেলিয়ার আপার ফিস্কে নদীর এলাকায় বসবাসকারী উপজাতি আরান্ডান বা আরুন্টানরা। এদের কথনটি নিম্নরুপ ।
একেবারে সুরুর সময়ে স্রষ্টা কারোরা , ইল-বালিন্তজা নামক জায়গায় শুয়ে ঘুমিয়ে
পড়েছিলেন । যা পরবর্তী সময়ে জলাভুমিতে পরিণত হয় । উনার শরীর ঢেকে যায় ভালো উর্বর
মাটি এবং এক গাছপালার বাগানের তলায় । সে সময় চারদিক অন্ধকার ছিল। সহসাই জমি ভেদ
করে এক জীবন্ত দারুন ভাবে সাজানো
নাতান্তজা বা জুরুঙ্গা নামের দন্ডের
আবির্ভাব হয় এবং সেটা উঠে যায় আকাশের দিকে। ওই দন্ডের ঠিক তলায় থাকে স্রষ্টা
ভগবানের মাথা। এই মাথা যা ভাবে সেটাই বাস্তবে হতে থাকে। সেই রকম ভাবনার ফলেই তার
নাভিকুন্ড আর বগল ভেদ করে বেশ কিছু বিরাট
মাপের ইঁদুর বেরিয়ে এলো এবং মাটি কেটে উঠে
গেল ওপরে ।ওই সময় সূর্য উঠতে শুরু করলো ইল-বালিন্তজাতে । সূর্যের আলো গায়ে লাগতেই কারোরা মাটি
সরিয়ে এক ঝটকায় উঠে পড়লেন। এর ফলে উনি যেখানে শুয়েছিলেন সেখানে একটা বিরাট গর্তের
জন্ম হলো । যার নাম ইল-বালিন্তজা গর্ত । ওই গর্ত ভর্তি ছিল রক্তের মতো দেখতে
মধুতে। মাটির ভেতর থেকে উঠে আসার প্র কারোরার সব জাদু ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছিল সাথেই
পেয়েছিল খুব খিদে । কাছেই চড়ে বেড়ানো দুটো ধেড়ে ইঁদুর ধরে সূর্যের আলোয় ঝলসে খেলেন
।
একসময় রাত ঘনিয়ে এলো । কারোরার মনে হল এক জন সাহায্যকারী থাকলে ভালো হতো ।
ভাবতে ভাবতেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন । তার পরেই উনার বগলের তলায় দেখা গেল একটা বিশেষ বাদ্যযন্ত্র যার নাম
বুল-রোয়ারার বা রোম্বাস বা টারন্ডান ।
যেটা বদলে গেল এক তরুণ যুবকের দেহতে ।
কারোরা ঘুম ভাঙতেই দেখতে পেলেন সেই দেহ । সে দেহে প্রান ছিল না। ঘুমের পর আবার বিশেষ
শক্তি সব ফিরে এসেছিল কারোরার ভেতরে । উনি পবিত্র রায়াঙ্কিন্তজা চিৎকার ছাড়লেন ।
সেই শব্দে প্রান পেলো যুবক । সেটা দেখে নেচে উঠলেন স্রষ্টা। সাথে সাথে নাচতে থাকলো
যুবকটিও ।
পরের দিন রাতে কারোরার দেহ থেকে আর অনেক দেহ জন্ম নিলো । সবাইকে প্রান দিতেই
ওরা খাবার খেতে শুরু করলো । আর একটাও ধেড়ে ইঁদুর র ইলো না কোথাও । তৃতীয় রাতে নতুন মানুষেরা শুনতে পেলো
বুল-রোয়ারার এর শব্দ । কোথা থেকে আসছে সে
শব্দ খুঁজতে শুরু করলো । ওদের সামনে এসে
উপস্থিত হল একটা অদ্ভুত রোমশ প্রানী। একজন চেঁচিয়ে বল লো, ‘এটা হল বালি পাহাড়ের
ওয়ালাবি ।’ হাতে থাকা লাঠি দিয়ে মেরে প্রানীটার একটা পা খোঁড়া করে দিলো ওরা। সাথেই
সাথেই প্রাণীটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘তোমারা আমার পা ভেঙে দিলে। আমি কিন্তু কোনও পশু
নই । আমি জেন্তেরামা, তোমাদের মতোই একজন মানুষ । ’ কারোরা সৃষ্ট মানুষগুলো পিছিয়ে
আসতেই ওয়ালাবিটা পালিয়ে গেল ।
ওরা ফিরে আসার পর কারোরা ওদের নিয়ে গেলেন ইল-বালিন্তজা গর্তর কাছে । নিজের
সন্তানদের গোল করে গর্তটার চারপাশে
বসতে বললেন । বসার প্রায় সাথেই সেই লালছে মধুর রস ওদের টেনে নিলো গর্তের ভেতরে। নিয়ে গেল সেইখানে
যেখানে আহত জেন্তেরামা ছিল । যে ওদের নতুন নেতায় পরিণত হলো । ওখানেই থেকে গেল
কারোরার সন্তানেরা । আগামীদিনের মানুষদের জন্য ওরা হয়ে গেল দেবতা ।
কারোরা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন তার আগের জায়গায় । মানুষেরা এখনো
প্রকৃতির জিনিষপত্র দিয়ে কারোরাকে সম্মান ভক্তি জানায় ।
### নাতান্তজা বা জুরুঙ্গা নামের যে দন্ডের
উল্লেখ করা হয়েছে সেটাকে ওই গোষ্ঠীর ওঝা সম্প্রদায়ের মানুষেরা জাদুদন্ড রুপে মান্যতা দেয়। মনে করে
ওটাই তাদের সব শক্তির উৎস। ওটা তাদের বাঁচিয়ে রাখে সমস্ত রকম চুরি চামারির হাত
থেকে। বুল-রোয়ারার থেকে যে গুন গুন শব্দ সৃষ্টি হয় তাকে ওরা মনে করে ভগবানের
কণ্ঠস্বর । একটি কাঠের টুকরোর ওপরে করা ফুটতে চুলের মতো জিনিষ লাগানো থাকে। যাকে আঙুল
দিয়ে নাড়লে গুন গুন শব্দের উৎপত্তি হয়। এই শব্দ ওরা ব্যবহার করে ভুতপ্রেত তাড়াতে,
রোগ সারাতে, জীব জন্তুকে ফাঁদের কাছে ডেকে আনতে বা সম্মোহন করতে বা নতুন কিছুর
আগমনকে স্বাগত জানাতে।
ইল-বালিন্তজা গর্ত বা ইল-বালিন্তজা সোক সত্যি করেই আছে । আর ওই নাতান্তজা
দন্ডকেও দেখা যায় একটি বিশেষ গাছ রুপে। যাকে ওরা মানে এ জগতের কেন্দ্র স্থল রুপে।
###
নবম গল্প
ARAPAHO [আরাপাহো]
আল গন কুইন ভাষায় কথা বলা পূর্ব আমেরিকার জঙ্গল এলাকায় বসবাস কারী এক উপজাতি
ছিল আরপাহোরা। পরে চলে আসে গ্রেট প্লেইন নামে পরিচিত স্থানের উয়োমিং, নেব্রাস্কা
এবং কলোরাডোতে। এদের ভেতর থেকে অনেককে
আমেরিকান সরকার পরে ওক্লাহামাতে পাঠিয়ে দেয়
। যেখানে ওদের সাথে দেখা হয় চেয়েন্নেদের ।
ওদের কাহিনী অনুসারে শুরুতে সব জায়গা ছিল জল মগ্ন। ফ্ল্যাট পাইপ একা একা জলে
ভেসে বেড়াচ্ছিল। মহান আত্মা ওকে বললেন সে যেন নিজের আশেপাশে এক জগত
নির্মাণ করে। ফ্ল্যাট পাইপ হাঁসেদের কথা ভাবলো । হাঁসেদের জন্ম হলো । সে ওদের বললো
জলে ডুব দিয়ে দেখে আসতে তলায় কি আছে। হাঁসেরা সে চেষ্টা করলেও সফল হল না । ফ্ল্যাট
পাইপ আরো অনেক রকম জলজ পাখীর নির্মাণ করলো কিন্তু কেউই জলের তলায় কি আছে দেখে আসতে
পারলো না।
অবশেষে মহান আত্মার ইচ্ছানুসারে ফ্ল্যাট পাইপ এক প্রানীর কথা ভাবতে সক্ষম হল
যে একই সাথে জলে ও স্থলে বসবাস করতে পারে। আসলে মহান আত্মা চাইছিলেন ফ্ল্যাট
পাইপের আগে আর কেউ যেন জলের তলায় কি আছে সেটা জানতে না পারে। ফ্ল্যাট পাইপের ভাবনা
অনুসারে এবার জন্ম নিলো কচ্ছপ । সে গেল জলের তলদেশের উদ্দেশ্যে । অনেকটা সময় পার
হয়ে যাওয়ার পর সে ফিরে এলো এবং তার স্রষ্টার সামনে উগড়ে দিলো কিছুটা মাটি । সেই
মাটি থেকেই আজকের পৃথিবীর জন্ম হয়েছে। সব পশু পাখীদেরকেও বানিয়েছিল ফ্ল্যাট পাইপ ।
### বুঝতে অসুবিধা হয়না এ গল্পে অন্যান্য আলগনকুইন উপজাতিদের কথনের প্রভাব
বর্তমান । জলের তলা থেকে মা্টি আনা বা ভাবনা থেকে নতুন প্রজাতির জন্ম কাহিনী অনেক
গল্পেই শোনা যায় । ###
দশম গল্প
AYMARAN [আইমারান]
বলিভিয়ার একটি উপজাতি এই আইমারান । মনে করা হয় তিয়াহুয়ানাকোর বিখ্যাত নগর এর
স্রষ্টা ছিলেন আইমারান এবং কুয়েক হুয়ান উপজাতি বা ইনকারা। যে কারণে আইমারান এবং কুয়েক হুয়ান দের ভাষায়
সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। আইমারানদের সাথে কুয়েক হুয়ানদের যুদ্ধ হয়েছে । স্প্যানিশদের
বিরুদ্ধেও এরা রুখে দাঁড়িয়েছিল । বেছে নিয়েছিল বিপ্লবের পথ।
আইমারানদের স্রষ্টা ভগবানের নাম কুন । যিনি তুষারের দেবতা। মানব জাতির ওপর
রেগে গিয়ে কুন বরফ আর তুষার দিয়ে সমগ্র জগতকে ঢেকে দেন । কেবল মাত্র শয়তান আত্মারা
সেই জগতে বিচরন করে বেড়াচ্ছিল । বরফের এই ভয়ানক সময় পার হলে উর্বরতার দেবতা তার
ছেলেদেরকে জগতে পাঠান। যাদের পরিচিত ঈগল
মেন নামে । ওরা নির্মাণ করেন পাকা-জেক্স বা নতুন মানুষের
দলকে । আজও টিটিকাকা হ্রদের
কাছে বসবাস করে এদের বংশ ধরেরা ।
উপরিউক্ত কাহিনীকে মাথায় রেখেও এটাও আর এক প্রচলিত কথন যে আইমারানদের আসল
স্রষ্টা ভগবান সূর্য দেবতা পাচাকামাক । যিনি তিয়াহুয়ানাকোর স্থপতি । পাচাকামাক উঠে
এসেছিলেন টিটিকাকা হ্রদের ভেতর থেকে। পৃথিবী নির্মাণ করার পর সৃষ্টি করেন দৈত্যদের
। তাদের আচরণে তাকে ক্রুদ্ধ করে এবং এক ভয়ানক বন্যার মাধ্যমে ওদেরকে নিশ্চিহ্ন করে
দেন । এরপর মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেন মানুষদের
। নানান উপজাতিতে তাদের ভাগ করে পাঠিয়ে দেন নানান প্রান্তে।
### আইমারানদের মিথ কথনের সাথে অনেক সাদৃশ্য দেখা যায় কুয়েক হুয়ান ভাষায় কথা
বলা ইনকাদের কাহিনীর সাথে। এতোটাই সে মিল যে এই দুই সংস্কৃতিকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত
করা বেশ মুশকিল । এর ফলে প্রমানিত হয় এরা এক সময় একটাই জাতি ছিল ।
প্রথম সৃষ্টি করা জগতকে ধ্বংস করে দেওয়া কাহিনীও এ পৃথিবীর অনেক মিথ কথনেই পাওয়া যায়। এ
আসলে ভুল ভ্রান্তিতে ভরা এক সৃষ্টিকে ধ্বংস করে নতুন নিখুঁত নির্মাণের ইঙ্গিত
বহনকারী গল্প । নতুন কিছু বানাতে হলে অনেক
নির্দোষীকে মরতে হয় যা আসলে বলিদানের নামান্তর । ###
** কেমন লাগলো এই প্রচেষ্টা সম্ভব হলে জানাবেন ।
## বিনীত অনুরোধ আরো অনেক লেখা আছে আমার ব্লগে । সাবস্ক্রাইব করুন এবং পড়ুন । অন্যদের পড়তে ব্লুন যদি ভালো লাগে।##
*** জলদি মোট ৫০ টি গল্প নিয়ে আসছে এই সিরিজের প্রথম ই-বুক। পাওয়া যাবে কিন্ডল ও গুগল এ।