Search This Blog

Friday, April 20, 2018

জীবনের কিস্তি... প্রতিম দাস


জীবনের   কিস্তি...
প্রতিম দাস
[ বছরের শুরুতেই স্বয়ং  Robert Burton Robinson এর কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছিলাম তার লেখা অনুবাদ করা ও আপনাদের পড়ানোর । আজ  তৃতীয় গল্প  “ Heart of Gold”   গল্পের ভাবানুবাদ  “জীবনের   কিস্তি...” ]
কার্ডিওলোজিস্ট  এর কাছে যাওয়ার দিনটাকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না।    উনি বললেন,  "রয়, তোমাকে সসেজ, ধূমপান, ভাজা খাবার, চিপস এবং নুন খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে।
উত্তরে   বললাম, "ডক, এর চেয়ে তুমি আমাকে এখনই একটা হাইডোজ  মারাত্মক ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলো !"
প্রত্যুত্তরে  আমাকে উনি একটি  সমাধান সুত্র বাতলে দিলেন।    হার্ট অফ গোল্ড ক্লিনিক " যতদূর  শুনেছি রা খানে প্রায় অলৌকিক কাজ করে।"
হার্ট অফ গোল্ড শব্দটা শুনেই মনের ভেতর একটা স্বস্তির বাতাস বয়ে গেল।   মনে হলো হ্যাঁ ওরাই পারবে আমার   যথাযথ যত্ন নিতে । 
"কিন্তু খরচা হবে ভালোই"
" সে হোক । ও নিয়ে ভাবছি না।   কিন্তু কোনোভাবেই  রাত জেগে ফুটবল খেলা দেখা ছাড়তে পারবো না।’ আর সেটা করতে হলে   ভাজা চিংড়ি, চিপস,  ফিস ফ্রাই , বাডউইজার   এর সদব্যবহার না করে থাকাও যাবে না।   নামী দামী খেলোয়াড়দের জবরদস্ত পায়ের খেলা দেখতে দেখতে  বড় মোটা  সিগার খাওয়ার মজা কাকে বলে তা তো আপনি  জানেন না ডক।’  
মুখে খরচ করবো কথাটা বললেও এই মুহূর্তে সেভাবে খরচ করার মতো  অতিরিক্ত  টাকা আমার ছিল না। কিছুদিন আগেই নতুন  ৬০  ইঞ্চির হাই ডেফিনেশন থ্রিডি টিভি কিনেছি। তা ছাড়া গাড়িটাতেও ভালোই খরচা হয়েছে  এই মুহূর্তে জীবন উপভোগ করার মতো সব উপাদান আমার কাছে মজুত । কি করে জানবো এর মাঝেই এক মোক্ষম ঘা কষানোর জন্য আমার হৃদয় তৈরী হয়ে বসেছিল।?
আরে চিন্তার কি আছে এই সব সময়ে জন্যই তো   বীমা কোম্পানীগুলো আছে, তাই নয় কি  ? মাসে মাসে একটা ছোট্ট অ্যামাউন্ট দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার আছে। আর হার্ট অফ গোল্ডের কাজ করার জন্য অনেক বীমা কোম্পানীই এগিয়ে আসবে।  অতএব দেরী না করে    হার্ট অফ গোল্ড ক্লিনিকে   একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট  বুক করলাম আমাকে জানানো হলো দ্রুত রেজিস্ট্রেশন করার জন্য।    কোন সমস্যা নেইবুঝতেই পারলাম আসলে ডাকা হচ্ছে ঠিক ঠাক খরচাপাতি করতে পারবো কিনা জেনে নেওয়ার জন্য।   
ওখানে যাওয়ার পর অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য রকম হ লো ।  আমাকে ফিল আপ করার জন্য কোনো ফর্ম দেওয়া হলো না । বদলে  ডেস্ক কর্মী আমাকে  ওদের ফাইন্যান্স বিভাগে নিয়ে গেলেন । জানতে পারলাম আমার জন্য কোনো রকম বীমার ব্যবস্থা করা নাকি সম্ভব নয় । 
" কেন বলুন তো? ঠিক কত টাকা দরকার একাজে  ?"
যে উত্তরটা এলো তাতে আমার বুকের ভেতরে দামামা বেজে উঠলো । থেমেও গিয়েছিল নিশ্চিত কয়েক সেকেন্ডের জন্য হ্রদপিন্ডের চলন।   
শুনতে পেলাম সামনের মানুষটার পরবর্তী কথাগুলো । "  চিন্তা করবেন না ।  আমাদের কাছে সব রকম   প্রয়োজনের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা আছে খুব কম গ্রাহকই  পুরো অর্থ একেবারে নগদ দেয় এখানে।   "
  গ্রাহক?  রোগী নয়!  আমার তখন ই বোঝা উচিত ছিল হার্ট অফ গোল্ডের কাজ কারবারে কিছু একটা রহস্য আছে।  কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার সামনে আর কোনো  পথ খোলাও ছিল না ভাবনাচিন্তা করার জন্য।   যদিও একটু খোঁজ খবর নেওয়া যেতেই পারতো ।
" মাসিক কি পরিমাণ  পেমেন্ট আপনি  দিতে সক্ষম  ?"
 এখন বুঝতে পারি এই সময়েও আমার বোঝা উচিত ছিল ।  পাক্কা সেলস ম্যানের মতো আচরণ ছিল মানুষটার।  যেন কিস্তিতে গাড়ী কিনতে চাইছি আমি ।  এদের মুল লক্ষ্যই থাকে ইন্টারেস্ট নেওয়া । শোধ কবে করতে পারবো  জানতে চায় না।       শুধু জানতে চায় আমি মাসে মাসে অর্থ দিতে পারবো কি পারবো কিনা।  আর তারফলে বেশীরভাগ সময়ে এরকমটাই দেখা যায়,  আসল দামের প্রায় দ্বিগুন দেওয়া হয়ে গেছে সাময়িক সুবিধা নিতে গিয়ে ।   
কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে তো হচ্ছে না ওদের তরফ থেকে বিশেষ কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে। জীবন বা মৃত্যু  কোনো একটা বেছে নেওয়ার খাদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ওই মুহূর্তে । হতাশার অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে বললাম,    "আমি খুব বেশী হলে মাসে মাসে ১৫    দিতে পারবো"
"হুম।" একটা শব্দ করে মানুষটা কম্পিউটারে কি সব হিসাব নিকাশ শুরু করে দিলেন।  ওদিকে আমার হৃদপিন্ডের গতি বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে ।
অনেকটা সময় এভাবে উৎকণ্ঠার চরমে কাটানোর পর শুনতে পেলাম ,   " মনে  হচ্ছে  আমরা আপনাকে সাহায্য  করতে পারি।"
  ডেস্কের ওপর রাখা  প্রিন্টার থেকে বেশ কয়েকটা পাতা বেরিয়ে এলো ।    সিগনেচার করার আগে আমার ওগুলো  পড়ে নেওয়া উচিত ছিল।   
ডঃ মালিনী সিনহা   ছোটখাটো গড়নের    মহিলা  দেখতে বেশ সুন্দর.বিবাহবিচ্ছেদ করলে উনি আমাকে আগামী জীবন সাথী করবেন কিনা জানার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। অত্যন্ত সপ্রতিভ মহিলা। নাহ, এর কাছে  অপারেশন হলে আমার চিন্তার কিছু নেই ।   
নি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন আমার নতুন নকল হৃদপিন্ডটা ঠিক কেমন হবে। জানতে পারলাম ওটা স্পেস এজ  প্লাস্টিক এবং ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে  তৈরি ওর মধ্যে চারটি কম্পিউটার থাকবেসেটা জেনে আমার কোনো লাভ নেই । কারন কম্পিউটার সম্পর্কে   আমি কিছুই জানি না
  অস্ত্রোপচার সম্পূর্ণ সফল নিজেকে এক নতুন জীবন পাওয়া মানুষের মতো মনে হচ্ছিল । সব চেয়ে বড় কথা এই যে আমার যে সব বাজে হ্যাবিট আছে সেগুলো   ছেড়ে দিতে হবে না   এই নতুন চিত্তাকর্ষক হৃদয় আমার সব ধমনী এবং শিরাদের  পরিষ্কার রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা করবে।   সুতরাং,   খরচ যাই হোক না কেন,  প্রতিটি পাই পয়সার দাম এই যন্ত্র আমাকে মিটিয়ে দেবে।   
 এর সবচেয়ে ভালো দিকটা হলো এর   রিমোট কন্ট্রোলটাযা দিয়ে অনেক কাজ ই করা যায়সবচেয়ে দরকারি কাজ যা এটা করতে পারে তা হলো এটা আমাকে ঘুম পারিয়েও দিতে পারে।   বিছানায় যাওয়ার আগে ওটাতে   ঘুমের মোডে সেট করে দিলেই , ব্যাস আর কিছু করার দরকার নেই। একেবারে ঘুমে চোখ ঢুলে আসে।   
আবার যখন   বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলার জন্য নামি তখন  অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয়সে কাজটাও করে দেয় রিমোট কন্ট্রোল । বিশেষ মোডে সেট করলেই আমার ভেতর ঘোড়ার মতো উদ্যম ও দম জন্ম নেয় ।  আসল হৃদপিন্ডের চেয়ে যে এটা অনেক ভালো তা স্বীকার করতেই হবে।   
কিন্তু মাসে মাসে ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার ব্যাপারটাই   সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে   আমার পুরনো   পিকআপ ভ্যানটা কিছু দিন আগেই বদলেছি । ওটা ছাড়া ব্যবসা চালানো অসম্ভব ।   নতুন মডেলটা নিতে ভালোই গচ্ছা গেছে। উপরন্তু মাসে মাসে ৩০ হাজার  করে দিতেও হচ্ছে বাকি শোধ করার জন্য।   
এমনিতেই মাসের নানান খরচা চালনোটাই মুস্কিল হয়ে পড়েছে।     চেষ্টার কমতি করছি না তবুও    সবকিছু চালানো যাচ্ছে না।   গৃহহীন হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই । ইচ্ছে নেই ভ্যানটা হাতছাড়া করারও।  তাই  পরের দু’ মাস    হার্ট অফ গোল্ডের  মাসিক পেমেন্ট দিলাম না।     কি করবে ওরা ? আমার হৃদপিন্ডটাকে উপড়ে নেবে  ?
ইতিমধ্যে একদিন   টেক্সট মেসেজ এলো । পড়ে অবাক হলাম । বলা হয়েছে কন্ট্র্যাক্ট পেপার গু্লো যেন মন দিয়ে একবার পড়ে নিই ।   মাসিক পেমেন্ট জমা দেওয়া হয়নি ।  আমাকে সতর্ক করা হচ্ছে । দুদিনের ভেতর যেন আমি   আমার অ্যাকাউন্ট আপ টু ডেট করে নিই
আমি মনে মনে বললাম, রা এ ব্যাপারে কি করবেটা কি ? গুন্ডা পাঠিয়ে আমাকে পিটাবে নাকি?
পরের দিন  আরেকটি টেক্সট মেসেজ  পেয়েছিলাম। আপনার একাউন্টে ৬০দিনের অর্থ ডিঊ হয়ে আছে    চুক্তি অনুসারে । আজ  মধ্যরাত্রিতে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।   
  আমার সাথে মজা করছে নাকি? আমি এখন ওদের কোনো পেমেন্টই করবো না । এমন কি টাকা থাকলেও করবো না।   
যদিও মাঝরাতের কথা ভেবে একটা উৎকণ্ঠা আমাকে ঘিরে ধরছিল । কি হবে ওই সময়? কেউ কি এসে দরজার বেল বাজাবে? না না ওসব কিছুই হবে না ওরা আমাকে  আসলে ভয় দেখাচ্ছে।  
তবুও, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম রান্নাঘরে  টা বিশেষ অ্যাটোমিক ক্লক । ফলে সময়ের হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। ছোটো কাঁটাটা বারোটার ঘরের দিকে এগোনো শুরু করতেই   আমি ঘামতে শুরু করলাম। আর   মাত্র পনেরো   সেকেন্ড বাকি ।
দশ সেকেন্ড   অনুভব করতে পারছিলাম রিমোট ছাড়াই  হৃদপিন্ড রেসের ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করেছে।  গতি ৯২ ।   আমার স্বাভাবিক বিশ্রামের হারের চেয়ে যথেষ্ট বেশিতবে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয় ।   
পাঁচ সেকেন্ড এখন পালস: ১০৪
চার সেকেন্ড ... তিন ... দুই ... পালস: ১২৭
মধ্যরাত্রি।
 পালস ? কিছুই দেখাচ্ছে না
  আঙ্গুল দিয়ে   ঘাড়ের পাশে চেপে ধরলাম ।   না কোনো সাড়া নেই ।  রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে!!
মাসিক পেমেন্ট না করার জন্য ওরা আমাকে হত্যা করবে? 
 ঘড়ির দিকে তাকালাম ।  ঠিক কি দেখতে চাইছিলাম তা আমি জানি না।
মধ্যরাত পার করে   পাঁচ সেকেন্ড কেটে যাওয়ার  পর আবার   আমার হৃ্দপিন্ড চালু হলো । 
যথেষ্ট ভয়ঙ্কর ব্যাপার । তার পর মনে হলো , ধুস কি সব উলটোপালটা   ভাবছি । এটা সম্ভবত সফ্টওয়্যারের    কিছু গণ্ডগোল হয়েছিল ।   কালকেই চেক করিয়ে আনবো ।   
মন টা একটু শান্ত হতেই  আমি নিজের আচরনের কথা ভেবে নিজেই হেসে উঠলাম।    কি সব ভাবছি ? হার্ট অফ গোল্ড ক্লিনিকের কেউ কি ওখান থেকে আমার নকল হৃদপিন্ডটাকে   নিয়ন্ত্রণ করছে  ? কি হাস্যকর ! ওরা  আসলে আমার মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে ঐ অদ্ভুত টেক্সট   সতর্কবার্তা পাঠিয়ে ।   আমাকে বিভ্রান্ত করছে।
 আর ঠিক  কুড়ি সেকেন্ড বাদেই ... আমার হৃদপিন্ড   বন্ধ হয়ে গেল !
ছয় সেকেন্ড পরে  পুনরায় চলতে শুরু করলো ।  আমি ত্রস্ত হয়ে পড়লাম ।  যেন এক ছকে বেঁধে করা হচ্ছে   !!!  আমার হৃদপিন্ড প্রথমে  পাঁচ সেকেন্ডের জন্য থেমেছিল ... তারপর  ছয় সেকেন্ড ... এবার হয়তো সাত ... এভাবে চললে আমি   অ্যাম্বুলেন্স ডাকার সময়টাও পাবো না ।  তার আগেই মরে যাবো!!!
  ফোনে মেসেজ আসার ধ্বনি শুনতে পেলাম ।    নতুন মেসেজ!
আগামীকাল মাঝরাতের মধ্যে বকেয়া জমা না হলে বন্ধ করা হৃদপিন্ড আর চালু হবে না ।   
আমার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছিল ।   মনে মনে বললাম, কিছুতেই  ওই সংস্থা আমার সাথে এরকম করতে পারে না । আমি এই টেক্সট মেসেজ  পুলিশকে দেখবো।  ভাবতে ভাবতেই দেখলাম মেসেজটা মুছে গেল স্ক্রিন থেকে । আমি ডিলিট করিনি ।  নিজে নিজে অদৃশ্য হয়ে গেল!    আগের মেসেজগুলিও সব মুছে গেছে।
পরের দিন, দেরী না করে আগে গিয়েছিলাম হার্ট অফ গোল্ডের অফিসে । দুমাসের পাওনা মিটিয়ে দিয়েছি । এখনো অবধি  নিয়ম মতো দিয়েও চলেছি । 
আমার হয়তো উচিত হার্ট অগ গোল্ডের এই বিষয়টা   সম্পর্কে অন্যান্য মানুষদের  জানিয়ে দেওয়া। কিন্তু এটাও ভালো করে জানি কেউই আগাম  সতর্কবার্তা শুনতে ভালোবাসে না। শুনলেও পাত্তা দেয় না।   কেউই নিজেদের শরীরের যত্ন নিজে থেকে নিতেই চায় না । খেটে খুটে নিয়ম মেনে শরীর ভালো রাখার ইচ্ছে বেশীর ভাগ মানুষেরই নেই ।   তাদের প্রভুত অর্থ আছে আর সেটা দিয়েই তারা সব সময় সহজ সমাধানের পথ খুঁজে নেয় । 
সবাই বোকা... একদম আমার মতোকিছুই তলিয়ে ভাবিনা আগে থেকে ।
 অন্তত এখন আমি বুঝতে পেরেছি যে   হার্ট অফ গোল্ড মানে  আসলে কি।
আপনাকে ওরা হৃদয় দেবে বিনিময়ে আপনার সব সঞ্চয় কেড়ে নেবে ।      

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment