Search This Blog

Thursday, December 23, 2021

ড্রাকুলা বা ভ্যাম্পায়ারের ইতিহাস সন্ধান - প্রতিম দাস

 


  

[২০১৮ সালে কলকাতার একটা ভয় বিষয়ক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।] 

ড্রাকুলা বা ভ্যাম্পায়ার এর ইতিহাস  সন্ধান করতে গেলে নিশ্চিতভাবেই আমাদের হাজার হাজার বছর পিছিয়ে যেতে হবে ।   প্রাচীন কুসংস্কারের সুত্র ধরে গবেষনা শুরু করলে সম্ভাব্য    ড্রাকুলার উৎস হয়তো আমরা খুঁজে পাবো।    যে ড্রাকুলাকে আমরা   চিনি  তিনি আসলে কেমন? এই প্রশ্ন সামনে রেখে এগোলে যে সহজ সরল উত্তর মেলে তা থেকে বলতেই পারি,  মানুষ বিশ্বাস করে ড্রাকুলা কাহিনীর মূল সুত্র  ভ্লাদ   দ্য ইম্পেলারযদিও   ব্রাম স্টোকার নানান ভ্যাম্পায়ার কাহিনী এবং আইরিশ কিংবদন্তী এই কাহিনী রচনার সুত্র রুপে ব্যবহার করেছিলেন। 

দুচার কথা জেনে নেওয়া যাক সেই কিংবদন্তীর মানুষটার বিষয়ে।  

শুধু সাধারন মানুষই নয়, বেশিরভাগ গবেষকও এটাই বিশ্বাস করেন যে, ব্রাম স্টোকার   রোমানিয়ায় ওয়ালাচিয়া নাম স্থানের ১৫ তম শতাব্দীর রাজকুমার ‘ইভিল কাউন্ট ড্রাকুলা’র   আসল জীবনের উপর   ভিত্তি করেই তার কাহিনী লিখেছিলেন।    ভ্লাদ ড্রাকুলা   বা ভ্লাদ টেপেস বা ভ্লাদ দ্য ইম্পেলার , ইতিহাসের অন্যতম একজন ভয়ানক মানুষ এবং বর্বর শাসক বলেই পরিচিত

শত্রুপক্ষের সৈন্যদের ওপর  তার করা  নৃশংস অত্যাচারের কারণেই তাকে ভ্লাদ দ্য ইম্পেলার নামে ডাকা হতো ।    তীক্ষ্ণ বিন্দুর লৌহ শলাকার ওপর এমন ভাবে ধৃত বন্দীদের বসিয়ে দেওয়া হতো যাতে শলাকা গুলি একটু একটু করে শরীর ভেদ করে । ইংরেজিতে একে বলে ইম্পেল।  যন্ত্রনাকাতর মানুষদের রক্তপাত ও চিৎকার শুনে এক পৈশাচিক  আনন্দ পেতেন ভ্লাদ। 

 এই ‘ইম্পেল’ পদ্ধতি  নির্যাতন ও হত্যার একমাত্র উপায় ছিল না ড্রাকুলার নানা পৈশাচিক সৃজনশীল  উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন কাউন্ট ড্রাকুলা ।  বন্দীদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে নেওয়া তো ছিল সাধারন ব্যাপার। জীবন্ত মানুষক কে ফুটন্ত জলে সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে ডুবিয়ে দিয়ে বিকৃত আনন্দ উপভোগ করতেন মানুষটি । জ্যান্ত অবস্থায়  চামড়া ছাড়িয়ে নিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধ বোধ করতেন না। হিংস্র জন্তুর সামনে নিরস্ত্র ম্নূশকে ছেরে দিয়ে তাদের মৃত্যু দৃশ্য দেখা ছিল কাউন্টের প্রাত্যহিক বিনোদন ।    স্যাক্সন রেকর্ড অনুসারে ভ্লাদ দ্য ইম্পেলার ৪০ জাহার থেকে ১ লক্ষাধিক মানুষকে এভাবে হত্যা করেছিলেন। তবে    তিনি সত্যিই তার বন্দীদের রক্ত ​​পান করতেন  কিনা তার শক্তপোক্ত প্রমান মেলে না । সম্ভবত ওটা ছিল কল্পনাপ্রবন মানুষের সৃষ্ট কাহিনী।   

 ভ্লাদ দ্য ইম্পেলার তার ড্রাকুলা উপাধি পেয়েছিলেন তার পিতা দ্বিতীয় ভ্লাদ ড্রাকুল এর সুত্রে। যাকে হাঙ্গেরীর রাজা সিগিস্মুন্ড নিজের সমাজভুক্ত নাইট রুপে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেই সমাজের পরিচিতি ছিল ‘দ্য অর্ডার অফ দ্য ড্রাগন’ নামে । এই সমাজ ভুক্ত দের মূল ল ক্ষ্য হতো ক্রশেডের যুদ্ধে অংশ নেওয়া। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ড্রাকুল শব্দের অর্থ ড্রাগন । তার ছেলেকে ড্রাকুলা বলা হয় ।

 

পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পরে, ভ্লাদ তার ডাকনাম  ‘দ্য ইম্পালার’ গ্রহণ করেন বা মানুষ তাকে ওই নামে ডাকতে শুরু করে বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে কারন আগেই বলা হয়েছে। 

 

ভ্লাদ ড্রাকুলা দেখতে কেমন ছিলেন? সারা জীবন   বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছিল তাকে । বার কয়েক শত্রুদের হাতে ধরাও পড়েন তিনি । সেই সময়ের   একজন বিশপের লিখিত   বর্ণনা  থেকে জানা যায়  :

"খুব একটা লম্বা ছিলেন না।    খুব ঠাণ্ডা  এবং দৃঢ় মানসিকতার মানুষ।  , আচরণে ভয়ানক রকমের এক তাচ্ছিল্যযুক্ত শীতলতার আভাস পাওয়া যেত।  লম্বা উচুঁ সরু নাকনাকের ফুটো গুলো বড় বড়।   মুখের চামড়া লালছে । বড় বড় রোম যুক্ত   চোখের পাতা। মনি সবুজ ।   কালো মোটা ঝুলো ভুরু । গোঁফ ছাড়া বাকি অংশ মসৃণ ভাবে কামানো। সব মিলিয়ে যথেষ্টই আতঙ্কজনক। "

নিশ্চিতভাবেই আমরা যে   ড্র্যাকুলা চরিত্রকে চিনি তার সাথে এর কোনোই মিল নেই।

 

  সমস্ত গবেষকেরাই যে  ভ্লাদকে ড্রাকুলার একমাত্র ভিত্তি হিসাবে নির্দেশ করেন তা কিন্তু নয়  কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, আইরিশজাত ব্রাম স্টোকার নানান    আইরিশ লোককথাকে ব্যবহার করেছিলেন তার কাহিনীর ভিত্তি রুপে।   আইরিশ পৌরাণিক কাহিনি এবং ইতিহাস থেকে এক রহস্যময় চরিত্রর সন্ধান মেলে । যার নাম আভারতাক । ৫ম শতাব্দীর এই রাজা  আকৃতিতে বামন  ছিলেন।   ১৮৭৫ সালের একটি কাহিনী সুত্রে জানা যাচ্ছে -   

"...  ওই বামন ছিল এক ভয়ঙ্কর অত্যাচারী  জাদুকর  শাসক  মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার করতো সে।  শেষ পর্যন্ত  তাকে হত্যা করা হয় ... দন্ডায়মান অবস্থায় তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল কিন্তু পরের দিনই তাকে   দেখা গিয়েছিল মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতে! যে গোষ্ঠী প্রধান তাকে হত্যা করেছিলেন  তিনিই    তাকে দ্বিতীয়বার হত্যা করেন  এবং পুনরায় তাকে   কবরস্থ করা হয় ।   আবার সেই শয়তান কবর থেকে পালিয়ে যায়  এবং সারা দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েএবার গোষ্ঠীপ্রধান  এক জাদু বিদ্যায় দক্ষ মানুষের   পরামর্শ   এবং   নির্দেশ অনুসারে   তৃতীয়বার বামনটিকে হত্যা করেন    একই জায়গায় তাকে কবর দেওয়া হয় । তবে এবার   মাথা  নিচের দিকে করে দেওয়া হয় । এর ফলে ওই শয়তানের কালো   জাদুকরী শক্তি বিনষ্ট হয় ।  সে আর পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারেনা"

এই চরিত্রটির প্রভাব যে ব্রাম স্টোকারের লেখা পড়েছিল তা অনুমান করে নেওয়া যেতেই পারে।

 

উপন্যাসের ড্রাকুলার ইতিহাস অনুধাবন করতে হলে ১৭০০ সালের যুগটায় যে  সমস্ত কাল্পনিক কাহিনী এ বিষয়ে রচিত হয়েছিল তাদের দু একটিকে একটু    যাচিয়ে দেখতে হবে   ১৮৯৭ সালে ড্রাকুলা প্রকাশিত হওয়ার আগে ইউরোপের সমাজ ছিল ভ্যাম্পায়ার ভাবনায় আচ্ছন্ন । অনেক দেশেই এই বিষয়ে  দীর্ঘদিনের কুসংস্কার গেঁথে বসেছিল মানুষের মনে।   এই সময়ের  লিখিত নানান ভ্যাম্পায়ার সম্পর্কিত   কাল্পনিক সাহিত্যিক কাজগুলি এটাই নির্দেশ করে যে, ড্রাকুলার ধারণাটি ব্রাম স্টোকারের নিজস্ব মৌলিক ভাবনা ছিলনা মোটেই। 

১৭৪৮ সালে হাইন রিখ   আগস্ট ওসেনফেল্ডার   দ্য ভ্যাম্পায়ার নামে একটি   রোমান্টিক কবিতা লিখেছিলেন। যেখানে  একটি ভ্যাম্পায়ার এক যুবতীর প্রতি আকৃষ্ট হয় ।   কিন্তু যুবতীটি তার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীনী মায়ের কথা শুনে চলেছিল বলে সে মেয়েটিকে কব্জা করতে পারছিলনা ।  মেয়েটিকে তার মা   সতর্ক করে দেন, জানিয়ে দেন ওই পুরুষ সাধারন মানুষের মতো জীবন্ত নয় ।     ভ্যাম্পায়ারটি    বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটির দিকে  তাকিয়ে থাকতে থাকতে  শপথ করে, সুযোগ পেলেই   "চুম্বন" করার অছিলায় সে মেয়েটির রক্ত পান করবে এবং কেড়ে নেবে তার জীবন ।   

সবচেয়ে বেশী যে কাহিনীটি ড্রাকুলার ভিত্তি বলে মনে করা হয় সেটির নাম কারমিল্লা।   রচয়িতা জোসেফ শেরিডান লে ফানু ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল - ড্রাকুলার ২৬ বছর আগে। এই গল্পেও ভ্যাম্পায়ারের প্রেমানুরাগ জনিত আকাঙ্ক্ষার রোমান্টিক থিম রয়েছে। যা অবশ্যই সেই   সময়ের প্রেক্ষিতে এক অনন্য বিষয়কারন এই গল্পের মূল চরিত্র একটি  মহিলা ভ্যাম্পায়ার, কারমিল্লা ।   

  এই সময়ের   বেশ কয়েকটি কাল্পনিক লেখা তৈরি হয়েছিল, যেগুলোকে নিশ্চিতভাবেই  স্টোকারের লেখাকে প্রভাবিত করেছিল বলেই আমরা ধরে নিতে পারি ।   ১৭৭৩ সালে  গটফ্রিড আগস্ট বারগার  ‘লেনোরে’   নামে একটি ব্যাল্যাড রচনা করেছিলেন। যেখানে for the dead ride first  শব্দ বন্ধ টি ব্যবহার হয়েছিল । যা সরাসরি  স্টোকার তার উপন্যাসে ব্যবহার করেছিলেন।

লেখকের পুত্রের কথানুসারে, সিনিয়র স্টোকার নাকি বলতেন তার লেখার    অনুপ্রেরণা ছিল একটি  দুঃস্বপ্ন ।   

  ড্রাকুলার সৃষ্টি কাহিনী রুপে যে সমস্ত গল্প চালু আছে তাদের বিশ্বাস করতে মানুষ দ্বিধা করেনি   কারণ, সে সমস্ত গল্পের সাথে জড়িয়ে আছে আংশিক কিছু সত্য ঘটনা।  তবে  একটি অবিসংবাদিত সত্য এই যে স্টোকার এই কাহিনী লেখার জন্য কারে কমপক্ষে সাত বছর ধরে ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। নিশ্চিত ভাবেই অনেক গবেষনা যে লেখক করেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই ।   পঞ্চদশ শতাব্দীর ওয়ালাচিয়ার ওয়ারলর্ড,  ভ্লাদ " দ্য ইমপেলার" বা কাউন্ট ড্র্যাকুলা   নামটি রোমানিয়া বাইরে সেই অর্থে কেউ জানতোইনা।   স্টোকারের সুত্রে  ঐতিহাসিক এই চরিত্র ভ্যাম্পায়ার   কল্পকাহিনীর মূল সুত্র রুপে   বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে যায়।      ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা নির্মিত ১৯৯২ সালের চলচ্চিত্র “ব্রাম স্টোকা্র’স ড্রাকুলা”  মানুষের মনে এই বিশ্বাস আরো গভীর ভাবে গেঁথে দেয় যে    ভ্লাদের কাহিনীই ছিল ড্রাকুলা উপন্যাসের মূল ভিত্তি।    অথচ সিনেমায় যে বিষয় দেখানো হয়েছে -  কয়েক শতাব্দী আগে  হারিয়ে যাওয়া প্রেমের পুনরুত্থানের জন্য     ড্র্যাকুলার অনুসন্ধান -   তা না মূল উপন্যাস বা  তার সংগৃহীত নোটসগুলিতে  কোথাও দেখা যায়  

নাটকীয়তা বিনির্মাণের স্বার্থে    চলচ্চিত্র নির্মাতারা যে কোনো গল্প উপন্যাস কে নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করেন । সম্ভবত, একইভাবে   প্রাপ্ত সুত্র ও তথ্যাদিকে নিজের কাহিনীতে কতটা বদলাবেন এই ভাবনাই স্টোকারকে সাতবছর ধরে ভাবতে বাধ্য করেছিল। প্রায় সব লেখকই লেখক কোনো বড় কাহিনী সৃষ্টি  করার সময়    নিজের কল্পনাপ্রসূত একাধিক চিন্তা ভাবনার কতটা ব্যবহার করবেন তা নিয়ে সমস্যায় ভোগেন । সেই চিন্তার চাপ একজন লেখককা নানা প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় । স্টোকার ও তার থেকে বাদ পড়েন নি এটা সহজেই অনুমেয় । হয়তো এই ভাবনাটাও তার মাথায় এসেছিল, আদপেই কি এই লেখা মানুষ মনে রাখবে?       

ব্রাম স্টোকার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার ভ্যাম্পায়ার বিষয়ক কিংবদন্তী তার ভালো লাগে কারন একই সাথে ওর ভেতর মিলে মিশে থাকে সত্য এবং রহস্য ।

 ৯০ শতাংশ মানুষ গুজব ছড়াতে ভালোবাসে এটা একটা অমোঘ সত্য। তৎকালীন সময়ের গ্রাম জীবনে অশিক্ষিত, বোকা,  মাতাল বা  বেশ্যা বৃত্তির সাথে যুক্ত মানুষেরা ছিল গুজব সৃষ্টির আঁতুড় ঘর ।  সাধারন প্রাকৃতিক ঘটনা তাদের বর্ণনা তে পরিণত হয়েছে অ প্রাকৃতিক রহস্যে ।     কোন একজন  মানুষ  প্রায় মরার মতো হয়ে গেছে । আবার বেশ কয়েক ঘণ্টা বাদে বেঁচে উঠেছে এরকম ঘটনার কথা আজ আমারা জানি। বিজ্ঞান এর ব্যাখ্যাও দিয়েছে ।   কিন্তু সেই সময়ে এরকম ঘটনার পেছনে সত্য খোঁজা সম্ভব হয়নি সাধারন মানুষের পক্ষে। ফলে জন্ম নিয়েছে রহস্য ।  জন্ম দিয়েছে ভয়ঙ্কর গুজবের । সিনেমা নির্মাতাদের মতোই গুজব নির্মাতা তাতে চাপিয়েছে আতঙ্কের রঙ ।   জন্ম হয়েছে ভ্যাম্পায়ার সুলভ কিংবদন্তীর।    

প্রায় প্রতিটি দেশের আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে ক্ষুধার্ত মৃতদের কাহিনী পাওয়া যায় । সেসবের  বৈচিত্র্যময়তা প্রভাব ফেলেছে    কথাসাহিত্যতে।    ব্রাম স্টোকারও হেঁটেছেন সেই পথে ।   বিশ্বাসযোগ্যতার একটি মাপকাঠি বজায় রাখার জন্য তিনি ফরাসি বাইবেল বিষয়ক পণ্ডিত ডম অগাস্টিন ক্যালমেট লিখিত Dissertations sur les apparitions des esprits et sur les vampires  এর তথ্য তার কাহিনীতে অভিযোজিত করেছেন।   ভ্যাম্পায়ার ধ্বংসের পদ্ধতি তিনি খুঁজে পেয়েছেন এখানেই ।  

সুচালো কাঠের টুকরো হৃদপিন্ডে গেঁথে বসিয়ে দেওয়ার চিরন্তন পদ্ধতি ।

বেশিরভাগ ভ্যাম্পায়ার কিংবদন্তীতে কবর থেকে মৃত শরীরের আত্মা বেড়িয়ে এসে রক্তপান করে মৃত শরীরে ফিরে যায় এরকমটাই পাওয়া যায় । ১৮৮৮ সালের এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা সংস্করণটিতেও এই সুত্র উল্লেখ আছে ।   সেখানে ব্রাম স্টোকার সরাসরি ড্রাকুলাকেই শারীরিকভাবে ব্যবহার করেছেন তার কাহিনীতে রক্তচোষা দানব রুপে । সম্পূর্ণ নতুন এই ভাবনা মানুষ কতটা গ্রহন করবে এটা হয়তো তার মনে সংশয়ের জন্ম দিয়েছিল।

  তিনি ড্রাকুলাকে একটি বাদুড় জাতীয়  প্রানীর আকারে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা দিয়েছেন। এটাও সেই সময়ের প্রচলিত কোনো লোক কথায় পাওয়া যায়না।    নেকড়ে রূপ ধারণ করার অতিরিক্ত ক্ষমতাও তিনি দিয়েছেন ছিল ড্রাকুলার।    সাবিন বারিং-গোল্ডের বই ‘দ্যা বুক অফ ওয়ার উল্ভস’ এ একটি তথ্য পেয়েছিলেন স্টোকার। যেখানে বলা হয়েছে, গ্রীক বিশ্বাস অনুসারে, ওয়ার উলফ রা মরে গেলে ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায়।  গোল্ডের লেখাতেই পাওয়া যায়, ওয়ার উলফের হাতের তালুতে লোম থাকে । সেটাই ব্যবহার করেছেন স্টোকার ড্রাকুলার রুপ বর্ণনার সময়ে। এছাড়াও গোল্ড বর্ণিত অনেক কিছুর সাথেই স্টোকারের বর্ণনার মিল পাওয়া যায় । উৎসাহী পাঠক মূল পুস্তক পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন।  

প্রচলিত লোক কথার নানান সূত্রই যে স্টোকার কে তার লেখায় অনুপ্রানিত করেছিল তার আর একটি উদাহরণ দিয়ে এই নিবন্ধের ইতি টানছি । সিনেমায় আমরা দেখি সূর্যের আলো সহ্য করতে পারেনা ভ্যাম্পায়ারেরা । কিন্তু কাউন্ট ড্রাকুলা দিনের বেলাতে লন্ডনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন । এই সূত্রও স্টোকার পেয়েছিলেন লোক গল্প থেকেই । সেখানে বলাই হয়, অন্যান্য শয়তানী সত্তার মতোই ভ্যাম্পায়ারেরা দিনের বেলায় বের হতে চায় না । কিন্তু তারমানে এই নয় যে সূর্যের আলো তাদের ধ্বংস করতে সক্ষম ।

  

 তথ্যসুত্র – ইন্টার নেটের বিভিন্ন সাইট এবং ডেভিড জে স্কাল লিখিত Something in the Blood: The Untold Story of Bram Stoker, the Man Who Wrote ‘Dracula’ 

[আরও কিছু তথ্য পেয়েছি সময় মত জুড়ে দেব।]

Sunday, November 28, 2021

বিশ্ব ভূত কথা – ঘুমাতে যাওয়ার আগে দ্বিতীয় অধ্যায় - প্রতিম দাস

বিশ্ব ভূত কথা – ঘুমাতে যাওয়ার আগে

দ্বিতীয় অধ্যায়

প্রথম বিখ্যাত ভূতের কথা

আদিকালের কিছু হিব্রু নথির খোঁজ পাওয়া গেছে  যেখানে জীবিত মানুষেরা মৃতদের বা ভূতেদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। 

এই সিরিজের প্রথম পর্বে  আমরা দেখেছিলাম, প্রায় সব সভ্যতা বিশ্বাস করে যে, মৃত্যুর পর কিছু একটা রূপের অস্তিত্ব  আছে। সেখানে অনেকেই বলেছেন,   শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়া আত্মারা   একটা ‘ইথার’ জগতে অবস্থান করে। যার সময়ের পার্থিব নিয়ম কানুন মেলে না।  আর সেই জন্যেই যারা মারা যায় তারা  অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত দেখতে সক্ষমঅতএব যদি আপনি সত্যিই জানতে চান যে, আগামীকাল কী ঘটতে চলেছে, তাহলে এ ব্যাপারে যারা সবচেয়ে ভাল জানে, সেই ‘তেনা’দের শরণাপন্ন হওয়াই সঠিক কাজ। কি বলেন?

আর এই কথাকেই বাস্তবে পরিণত করতে সব সমাজেই সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত, এমন  সব বিশেষজ্ঞদের দেখতে পাওয়া গেছে বা যায় এবং যাবেও  যারা জীবিত মানুষের সাথে   আত্মার   যোগাযোগ করতে সাহায্য করতে এক পা বাড়িয়ে বসে আছেন। তাদের পরিচয় আপনারা সবাই জানেন। এরা মৃতদের সাথে কথোপকথন করার জন্য এক  বিশেষ ধরণের ভবিষ্যদ্বাণী বা ভাগ্য বিচার করা পদ্ধতি ব্যবহার করে। যা নেক্রোম্যান্সি নামে পরিচিত। এই শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দ ‘নেক্রোম্যান্টিয়া’ শব্দ থেকে। যার ভেতর আছে দুটো শব্দ ‘নেক্রস’ বা মৃত মানুষ এবং ‘ম্যান্টেইয়া’ বা ভবিষ্যত কথন।

 

কবরের বা সমাধির ভেতর থেকে উঠে আসা আওয়াজ

আজ যদিও নেক্রোম্যান্সি শব্দটা ম্যাজিক এর  আর এক রূপ হিসাবে ব্যবহার হয়, কিন্তু মূল শব্দর সাথে কিছু পরিমাণ গুপ্ত এবং অপ্রীতিকর বিষয় মিশে আছে। একদা নেক্রোম্যান্সি এই শব্দটা কেবলমাত্র মৃতের আত্মাকে ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য  আহ্বান জানাতে সক্ষম বিদ্যার জন্যই ব্যবহার ত বা এই  কলাবিদ্যাকেই   নির্দেশ করত।

 নেক্রোম্যান্সিকে বাস্তবিক পক্ষেই যে কোনও  ভাগ্য গণনাকারী, জাদুকর এবং বিশেষত মায়াবী জাদুকর বা ‘সরসরার’দের জন্য এক  অপরিহার্য দক্ষতা হিসাবে বিবেচনা করা হত। একটা আত্মা আহ্বান প্রক্রিয়ায় প্রকৃত জাদুকরকে যথেষ্ট কৃচ্ছসাধন করতে হত। যার ভেতর অন্যতম ছিল উপবাস । তা ছাড়াও ছিল  গোপন আচারপ্রথা পালন নানা অজ্ঞাত মন্ত্র সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে শেখা। সাথেই জাদুবৃত্ত অঙ্কণ প্রনালী অধ্যয়ন। যার সামান্য মাপের গণ্ডগোলে জগত ভারসাম্য ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

 

গত  লেখার শেষ প্যারাগ্রাফের সূত্রে একটা প্রশ্ন মনে জাগছে। আচ্ছা বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে এত অশান্তির কারণ অশিক্ষিত জাদুকরদের ভুলভাল কাজকর্ম নয় তো? ভাল একটা গল্পের প্লট কিন্তু।  শুধু তাই নয় যে কোনও সমস্যা এই একটা যুক্তিতেই সমাধান করে দেওয়া যায়। - অধম লেখকের একান্ত  ব্যক্তিগত মত

প্রাচীন যুগের উইচক্র্যাফটের প্রামান্য নথি

নেক্রোম্যান্সির ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত নথিভুক্ত ঘটনা হল, উইচ অফ এন্ডোরের কাছ থেকে সাউলের পরামর্শ নেওয়া যা পবিত্র বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে পাওয়া যায়।   প্রথম স্যামুয়েলের পুস্তক: ২৮-৭১৬।

মোজেসে প্রচলিত আইন অনুসারে নেক্রোম্যান্সি এবং জাদুবিদ্যা ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল।  

"তোমার বেঁচে থাকার জন্য কোনও উইচ’কে কষ্ট পেতে দেওয়া চলবে না।" (এক্সোডাস ২২:১৮)

"যে পুরুষ বা মহিলার পরিচিত বা অধীনস্থ আত্মা বা যে একজন জাদুকর থাকবে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে।" (লেভিটিকাস ২০:২৭ )

"তোমাদের মধ্যে যেন এমন কাউকে   খুঁজে পাওয়া   না যায়, যে  ভবিষ্যদ্বাণী করে [সুথসেয়ার] বা একজন জাদুকর  বা একজন উগা’[এরা কোন একটা ছোট জন্তু কেটে তার আঁতড়ি বা নাড়িভুড়ির অবস্থান দেখে ভাগ্য বিচার করতেন] বা একজন  মায়াবী জাদুকর[সরসরার] বা একজন ‘চার্মার’ বা একজন ‘মিডিয়াম’ বা ‘উইজার্ড’ বা নেক্রোম্যান্সারের জীবন ধারন করে বেঁচে আছে।  যে কেউ এই কাজগুলো করে সে মহান প্রভুর কাছে একজন ঘৃণ্য সত্তা রুপে বিবেচিত।"(ডিউটেরোনমি ১৮:১০১৩)

সাউল নিজেই ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে জাদুবিদ্যাকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন, " পরিচিত বা অধীনস্থ আত্মা বা যে একজন জাদুকর থাকবে যাদের তাদের" তাড়িয়ে দেওয়া হবে তবুও, অবস্থার বিপাকে পড়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাজা  একজন নেক্রোম্যান্সারের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন।

কেন? সে গল্প শুনুন তাহলে।

মহান প্রভু তথা ঈশ্বর ডেভিডকে সাউলের উত্তরসূরি হিসাবে অভিষিক্ত করেছিলেন। যার প্রস্তুতি হিসাবে   ডেভিড শাসকের  বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন শুরু করেন। এমতাবস্থায় সাউলের  পরামর্শ প্রয়োজন ছিল এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় ততই ভালো। ফলে নিজেই অবৈধ ঘোষনা করা নেক্রোম্যান্সীর সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কী করবেন এটা জানার জন্য তিনি    স্যামুয়েলের আত্মাকে ডেকে আনার কথা ভাবেন। খোঁজ খবর নেওয়ার সময় সাউল জানতে পারেন  এন্ডোর শহরে এরকম একজন আছেন যিনি এই নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম  

যাতে তাকে চেনা না যায় তার জন্য সাউল ছদ্মবেশ ধারণ করে এবং তথাকথিত উইচ অফ এন্ডোর’ এর কাছে যান। ওই নেক্রোম্যান্সার স্যামুয়েলের আত্মাকে জাগ্রত করেছিলেন, কিন্তু মৃত রাজা  এই ঘটনায় এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি সাউলকে সাহায্য বা পরামর্শ দিতে অস্বীকার করেছিলেন। যার ফলস্বরুপ উনি যুদ্ধে ডেভিডের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন

বর্তমান সময়ের গবেষকদের মতে   উইচ অফ এন্ডোর সম্ভবত সেই অর্থে ডাইনী বা জাদুকর ছিলেন না। বরং বলা যেতে পারে প্রাচীন গ্রীসের অর‍্যাকল জাতীয় কিছু একটা ছিলেন। প্রসঙ্গত জানাই, প্রাচীন গ্রীসের এই অর‍্যালেরা ভবিষ্যতের খবর সংগ্রহ করতেন দেবতাদের কাছ থেকে। কখনও সে কাজে তারা মৃতদেহের সাহায্য নিতেন। 

ডেলফিতে এ্যাপোলোর অর‍্যাকল ছিলেন সেই সময়ের অসংখ্য  অর‍্যাকলদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ।  এই অর‍্যাকলেরা প্রায় সবাই মহিলা ছিলেন। যারা প্রাচীন গ্রীসে মন্দিরেই বসবাস করতেনঅর‍্যাকলের সাথে পরামর্শ করার জন্য,   প্রার্থনাকারীকে  পর্যাপ্ত নৈবেদ্য’ পেশ করতে হত। তবেই সুযোগ পাওয়া যেত  ভবিষ্যতের ঘটনা সম্পর্কে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার অর‍্যাকলদের ‘ভর’ বা ‘ট্রান্স’ হত বা উঠত বলাই ভাল, দেবতাদের সাথে পরামর্শ করার আগে।   প্রয়োজনে তারা আন্ডারওয়ার্ল্ডে বাস করা আত্মাদের সাথেও কথা বলতেন অর‍্যাকল সর্বদা তার উত্তর ধাঁধার মত ছন্দে দিতেন । সেই উত্তরের আসল অর্থ প্রশ্নকারীকে নিজেকেই বুঝে নিতে হত। 

আধুনিক বাইবেলের গবেষক পণ্ডিতরা জানিয়েছেন যে,  হিব্রু গ্রন্থের গ্রিক সেপ্টুয়াজিন্ট অনুবাদে   নেক্রোম্যান্সার "উইচ" এর পরিবর্তে "বেলি-টকার" হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যার অর্থ হল এই বিদ্যায় শিক্ষিত মানুষেরা  গ্যাস্ট্রোম্যান্সি অনুশীলন করে নিজের কণ্ঠস্বর এবং মাত্রাকে এতটাই নামিয়ে উচ্চারণ করতে সক্ষম ছিলেন যে সেটা শুনে মনে হত মাটির তলা থেকে শব্দ উঠে আসছে। আর যদি এই তথ্য সত্যি হয় তাহলে বলতেই হবে, উইচ অফ এন্ডো কোন মায়াবী জাদুকরছিলেন না। বরং উনি ছিলেন এই বিশ্বের আদিযুগের একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্ট!

প্রথম শতাব্দী, লুকান নামের একজনের বয়ান অনুসারে এক নেক্রোম্যান্সির ঘটনা পাওয়া যায়। ৪৯ বা ৪৮ খ্রিস্ট পূর্ব সময়ে সিজার আর পম্পেইয়ের যুদ্ধর কি ফলাফল হবে সেটা জানার চেষ্টা করে এক থেসালিয়ান উইচ। ওই সময় চলতে থাকা এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে সেই নারী এমন এক মৃত দেহ খুঁজে নেয় যার ফুসফুসের কোনও ক্ষতি হয়নি। তাকে মন্ত্র বলে জীবিত করে সে। তারপর একের পর এক মন্ত্রের প্রয়োগ করে। জীবন্ত সাপ দিয়ে চাবুকের মত প্রহার করে। ততক্ষণ অবধি যতক্ষন না সেই পুনরায় জীবিত সৈন্য তার প্রশ্নের উত্তর দেয়। প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের  মৃতদেহকে মন্ত্র বলে জীবিত করার এই পদ্ধতিগত কিংবদন্তী থেকেই সম্ভবত পরবর্তী সময়ে ভ্যাম্পায়ার এবং জোম্বি জাতীয় ‘ভয়ানক’ চরিত্র নির্মাণ হয়েছে। 

সবই খুব অদ্ভুত বা দুর্বোধ্য!

হাজার হাজার বছর পার করে আসার পর এটা বলা খুব মুশকিল যে, ভূত বিষয়ক যে সব নথি সেই সময়ে   লেখা হয়েছিল সেগুলো লেখকদের কল্পনার বিকাশ বা  সাহিত্য,  নাকি বাস্তবিক পক্ষেই ‘অ্যাপারিশন’ জাতীয় কিছু ঘটেছিল।

 নবম শতাব্দীর গ্রিক মহাকাব্য হোমার রচিত ইলিয়াডে জন্য দায়ী, ভূতেদের সভ্যভব্য, নিষ্ক্রিয় আত্মা বলাই যায় তারা জীবিতদের বিরক্ত করে না এবং জীবিতরা তাদের সম্পর্কে খুব একটা উদ্বিগ্ন নয়। যথাযথ  শেষকৃত্য এবং আচার অনুষ্ঠান পালন করা হলে তাদের আর সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না।

মৃত্যুর পরে, মৃত ব্যক্তির আত্মা হেডিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়, যা পৃথিবী পৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত এক নেতি জগত। যার শাসক দেবতা হেডিস। পৃথিবী  পৃষ্ঠের কিছু ফাটল, কিছু গুহা এবং বিশেষ গোপন কিছু স্থান ওই আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রবেশপথ। যা আজ বিজ্ঞানের যূগে এসে হাস্যকর বলেই প্রতিভাত হয়। যাই হোক এসব স্থানে সব সময়  একজন পুরোহিত,  বা একজন অর‍্যাকল সব সময় উপস্থিত থাকেন বলেই বিশ্বাস।

ঐতিহ্যগতভাবে হোমারের দ্বারা রচিত বলেই বিখ্যাত আর একটি মহাকাব্য ওডিসিতে, জাদুকরী সিরসে নায়ক ওডিসিয়াসকে নির্দেশ দিয়েছিল কিভাবে হেডিসে পৌঁছতে হবে। যাতে সে   দীর্ঘকাল আগে মৃত ভাববাদী টাইরেসিয়াসের আত্মার সাথে পরামর্শ করতে পারে । সিরসে ওডিসিয়াসকে বলেছিল, ওসিয়ানাসের জলরাশি পার হওয়ার পর পর্যাপ্ত পরিমাণে নৈবেদ্য পেশ করতে হবে এবং বলি দিতে হবে। সাথেই একটা পরিখা খনন  করে সেটাকে ভর্তি করতে হবে   মধু, দুধ, মদ, জল, বার্লি এবং ভেড়ার রক্তের মিশ্রণ দিইয়ে। মৃতদের আত্মারা ওই পরিখার কাছে এসে উপস্থিত হবে ওই মিশ্রণ পান করার আশায়।  কিন্তু যতক্ষণ না টাইরেসিয়াসের আত্মা উপস্থিত হবে ততক্ষণ ওডিসিয়াস যেন তাদের  তলোয়ার দিয়ে তাদের ভয় দেখানো থেকে বিরত না হয়।

আচ্ছা, যারা মিশ্রণ খেতে আসবে তারা তো ভূত। তাহলে তাদের তো দেহ নেই। দেহ নেই তো যেটা খাবে সেটা যাবে কোথায়? আর দেহ নেই তাহলে তরোয়াল দেখে ভয় পাবে কেন? দুঃখিত ভূতগন, একটু ইয়ার্কি করার সুযোগ পেয়ে ছাড়তে পারলাম না। ঘাড় মটকে দিও না বাপু!   

ওডিসিয়াস নির্দেশাবলী অনুসরণ করেছিলেন। টাইরিসিয়াস সেই মিশ্রণ পান করার পর যা পরামর্শ প্রদান করেন।  ওডিসিয়াস তার মা, অ্যাকিলিস, আগামেমনন, ইডিপাসের স্ত্রী/মা এবং লেডার ভূতেদের সাথেও কথা বলেছিলেন। রাজহাঁসের রূপে থাকা এই লেডার সাথেই জিউসের মিলনে জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত ‘হেলেন অফ ট্রয়’ এর।

ইউলিসিস ওই রকম ভূগর্ভস্থ জগতেই  হারকিউলিসের  দেখা পেয়েছিলেন। তবে মহাকাব্যের নায়ক ওটাকে  ‘ফ্যান্টম ডাবল’ বা ‘এইডোলন’ বলেই ধরে নিয়েছিলেন।  কারণ আসল  হারকিউলিস তখন  দেবতাদের সাথে মাউন্ট অলিম্পাসে ছিলেন। আরিব্বাস! ভুতেদেরও স্টান্টম্যান!

বর্ণনা অনুসারে হেডিসে যে আত্মাদের দেখা গিয়েছিল তার ছিল অস্থির প্রকৃতির এবং ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছিল;   অন্যথায়, তারা নিরীহই  ছিল বলা যায়। তাদের অবয়ব বিশেষ কোন পদার্থ দ্বারা গঠিত ছিল নাউদাহরণস্বরূপ, যখন ইউলিসিস তার মাকে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করেছিল,  তার হাত শূন্যের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিল।   

হোমারের সময়কাল (খ্রিস্টপূর্ব ম শতাব্দী) থেকে  গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের সময় কালে (৪৬৯? -৩৯৯)  যখন আমরা পৌঁছাই দেখা যায় ভূত এবং তাদের প্রকৃতি সম্পর্কেবিশ্বাসে একটা বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এ সময় ভূতেদের সহায়ক এবং সান্ত্বনাদায়ক রূপ দেখতে পাওয়া গিয়েছে। তারমানে অবশ্য এই নয় তারা কোন ক্ষতি করছে না।  এই সময়ের বিশ্বাস অনুসারে মনে করা হত যে,  ভূতেরা  শোরগোল করতে ভালোবাসে, প্রকৃতি অস্থির এবং   যারা তাদের বিরক্ত করে বা যারা খুব কাছাকাছি  যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের ওরা তাদের আঘাত বা হত্যা করতে সক্ষম বিগত শতাব্দীগুলোতে ‘ওঝা’ জাতীয় মানুষেরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে। এবার দেখা গেল ভূতেরাও মানুষের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার দাবি জানান শুরু করেছে! এই সময় বলা হচ্ছে, যারা অকালে বা বিশেষ করে হিংস্রতার কারণে  মারা গেছে তাদের ভূত বিপজ্জনক ।

 এই সময়ের মানুষ মনে কর  মৃত ব্যক্তির আত্মা তার কবরের আশেপাশেই অবস্থান করে।   বিশেষত করে যারা  আত্মহত্যা করে বা কারও দ্বারা খুন হয় বা অকালে মারা যায়।  গ্রীক দার্শনিক প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্ব) তার ‘ফ্যাডো’ নামক লেখায় লিখে গেছেন - ''সমাধিস্থল এবং শবাধারের আশেপাশে চৌর্য বৃত্তির আকাঙ্ক্ষায় যারা ঘুরে বেড়ায়, তারা বলেছে, ওই স্থানে  ভূতুড়ে চেহারাদের আবির্ভূত হতে দেখা যায়। ওই সব আত্মারা শুদ্ধ না হওয়ার কারণে এ জগত থেকে বিদায় নিতে পারেনি।"

বিশ্বাস অনুসারে, আপনার আত্মা যদি প্রকৃত পক্ষে শুদ্ধ না হয় তাহলে এ জগতের ওপরে অবস্থিত ‘ইথার’ জগতে যেতে পারে না।   ভূগর্ভস্থ ‘নরক’ জগতে সে বাধ্য থাকে। যেখানে তাদের শুদ্ধিকরণ হয় নানা কষ্টদায়ক পদ্ধতিতে। আপনি মৃত্যুর পর যদি এই সব যন্ত্রনা ভোগ না করতে চান, তাহলে জীবন যাপন করুন শুদ্ধাচারী ভাল মানুষ রূপে।

সূচনা লগ্নের একাধিক খ্রিষ্টান লেখক এই ভাবনায় জারিত হয়েছিলেন। এই ভাবনাকে মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। এখান থেকেই ‘পার্গেটরি’ বা পরিশুদ্ধ হতে হবে ভাবনার জন্ম হয়। বুঝতে অসুবিধা সেই সময়ের সমাজবাদীরা এভাবেই মানুষকে ভাল হয়ে থাকার এবং সমাজকে সুস্থ করার একটা চেষ্টা করেছিলেন। যদিও নিজস্ব মতামত মানুষকে মানতে বাধ্য করতে গিয়ে তারা নিজেরাই একাধিক নৃশংস পথের আশ্রয় নিতেন। যার কথা আমার “শেষপাতে” সিরিজের অন্তিম তিন পোস্টে জানিয়েছিলাম।

আমি কোন পথে যাব বা কী বিশ্বাস করব?

মানুষ বিশ্বাস করত বা করে যে ভূত আছে এবং তারা বস্তুগত জগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। মৃত্যুর পর আত্মার কী হয় তার সাথে এই বিশ্বাসের  সরাসরি সম্পর্ক আছে। 

এবার মৃত্যুর পর আত্মা বিষয়ে প্রাচীন  গ্রীসের কিছু বিশ্বাসের কথা আপনাদের জানাই।  

মৃতদেহ এবং আত্মা সমাধির ভেতর একসাথেই অবস্থান করে।  এমন কিছু সমাধিস্থলের খাওঁজ পাওয়া গেছে যেখানে জমির ওপর থেকে শবাধারের ভেতর অবধি নল লাগানো আছে। যাতে  মৃত ব্যক্তির জন্য পুষ্টিকর তরল পাঠানো যায়।  প্রার্থনা বা নেক্রোম্যান্সি জাতীয় আচার দ্বারা এইসব আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করা যেত।   

মৃতদেহ ত্যাগ করার পর আত্মাকে   চক্রাকার যন্ত্রণাদায়ক  পথ পার হয়ে হেডিসে পৌঁছতে হয়।   খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সেখানে মনে করা হত মৃত্যুর পরের  জীবনে থাকার জন্য দুটো ভিন্ন অঞ্চল আছে।  এক সুখ-সমৃদ্ধ, মনোরম এলাকা  যেখানে ধার্মিকদের আত্মা অবস্থান করে। এই স্থান কে কোথাও কোথাও   ‘এলিসিয়াম’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। দুই,  টারটারাস। এই নামটা নিউ টেস্টামেন্টেও পাওয়া যায়।  যেখানে স্থান হত দুষ্ট আত্মাদের। যেখানে তারা যন্ত্রণা ভোগ করত।  এই বিশ্বাসটাই  নানান ধর্মের  স্বর্গ ও নরকের ভাবনার মতই।  

আত্মা শরীর ত্যাগ করে এক  আধ্যাত্মিক জগতে চলে যায়। যা এক ইথারের জগত, অবস্থান  পৃথিবীর ওপরে। যেখানে গিয়ে এই আত্মারা স্রষ্টা বা চূড়ান্ত সত্তার সাথে মিশে যায়।

আত্মাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো যায় এবং শাস্তি হিসেবে সেখানে তাকে  মানবেতর রূপে জীবনযাপন করতে হতেও পারে।

দেহের মৃত্যুর সাথেই আত্মার মৃত্যু হয়।   এপিকিউরিয়ানদের দ্বারা সমর্থিত, এই ভাবনা নিশ্চিত ভাবেই কম জনপ্রিয় ছিল।

সেই সময়ের ভুতের দল

প্রাচীন গ্রীক এবং রোমান আমলের ভূতের গল্প জগতে এবার চলুন একটু ঘুরে আসি। এই ধরনের গল্পগুলো রহস্য ভিত্তিক সাহিত্য কল্পনা বলে ধরে নেওয়া যেতেই পারে। ‘মার্চেন/মার্কেন স্টোরি’ নামে পরিচিত এই গল্পগুলোর প্রমাভিত্তিক নির্ভরযোগ্যতা ছিল অতি সামান্য। সাধারণভাবে এগুলোকে কাল্পনিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। অন্যদিকে ‘সেজেন লিজেন্ড’ জাতীয় লেখাগুলোকে  সত্যি ঘটনার সাথে আলঙ্কারিক সাহিত্য মিশিয়ে নির্মাণ করা হত বলেই গবেষকেরা মনে করেন।  

 ভূতুড়ে বাড়ি সংক্রান্ত সর্বপ্রথম লেখাটা সম্ভবত লিখেছিলেন রোমান লেখক, রাজনীতিক, এবং বাগ্মী প্লিনি দ্য ইয়াঙ্গার [৬২? – ১১৩ খ্রীষ্টাব্দ]। একটা চিঠিতে  উনি তার পৃষ্ঠপোষক, লুসিয়াস সুরাকে লিখেছেন এথেন্সের এক  ভিলা সম্পর্কে।  কেউ ওই ভিলা  ভাড়া নিতে চাইছিল না, কারণ ওখানে  ভূত আছে। অগভীর রাতে ওই ভিলায় ভয়াবহ সব আওয়াজ শোনা যায়। শোনা যায় শিকলের ঝনঝনানি, যার শব্দমাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে রাত বাড়ার সাথে সাথে।  হঠাৎ হঠাৎ একজন নোংরা এবং দরিদ্র বৃদ্ধের ভয়াবহ  অশরীরীর আবির্ভাব হয়। যার লম্বা দাড়িতে জট পড়ে গেছে । মাথায় অবিন্যস্ত  সাদা চুল ।  পায়ে বাঁধা আছে  ভারী লোহার পাত। যা ওই  অশরীরী আর্তনাদ সহযোগে অতি কষ্টে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। বৃদ্ধর দুই হাতের  কব্জিতে আটকানো আছে শিকল সহ হাতকড়া। মাঝে মাঝেই চরম ক্রোধে উনি দুহাত ওপরের দিকে তুলে ওই শিকল বাঁধা হাত ঝাঁকাতে থাকেন।  একবার, কয়েকজন অতি সাহসী সন্দেহবাদী ওই ভিলায়  রাত কাটায়। সকালে সবাইকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। যারাই ওই সন্ধ্যার পরে ওই অভিশপ্ত বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে হয় তারা দারুন ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বা মারা গেছেন।

ভিলার এই কুখ্যাতি থাকা সত্বেও আরেক এথেনীয় দার্শনিক এথেনোডোরাস ওই ভিলা ভাড়া নেওয়া থেকে বিরত হননি।  আসলে  ওই ভুতুড়ে কুখ্যাতির কারণে ভাড়া অত্যন্ত কম থাকায় এবং নিজের খুব বেশি আর্থিক সামর্থ না থাকায় কিছুটা বাধ্য হয়েই এথেনোডোরাস ওই স্থান ইজারা নিতে বাধ্য হন।   

প্লিনির মতে, এথেনোডোরাস ভিলায়   প্রথম রাতেই ভূতের দেখা পেয়েছিলেন।   অস্পষ্ট শিকলের শব্দ ভেসে আসে সবার আগে। তার পরেই আবির্ভূত হন সেই বৃদ্ধ। তাঁর দেখানো পথে যাওয়ার জন্য দার্শনিককে   ইশারা করে সেই ভৌতিক অবয়ব।  এথেনোডোরাস সেটা করতে না চাইলে বৃদ্ধ রাগের চোটে জোরে জোরে শিকল ঝাঁকাতে থাকেন।  যতক্ষণ না দার্শনিক ওঁর সাথে যেতে রাজি হলেন ততক্ষণ উনি এক ভাবে শিকল নাড়িয়ে চ্ললেন।  অশরীরী এথেনোডোরাসকে ভিলা সংলগ্ন বাগানে নিয়ে যান এবং একটা  স্থান ইশারা করে  অদৃশ্য হয়ে যান।

পরের দিন, এথেনোডোরাস তার অভিজ্ঞতার গল্প স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানান। ওরা  বাগানের ওই নির্দিষ্ট স্থান খনন করেন। পাওয়া যায় শৃঙ্খলে আবদ্ধ একটা মানুষের কঙ্কাল। অবশিষ্ট হাড়গুলোকে সঠিক নিয়ম মেনে সমাধিস্থ করা হয় ।   বাড়িটাকেও  আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে  শুদ্ধ করা হয়। এরপর আর ওই বৃদ্ধের ভূতকে ওখানে কোনও দিন দেখা যায়নি।  

 


ওরা ফিরে আসে - কিসের জন্য?

যথাযথ শেষকৃত্য করার  দাবি নিয়ে  ভূতের আবির্ভাব ক্লাসিক গ্রীক এবং রোমান সাহিত্যের এক অতি পরিচিত বিষয়। তিনটে উদাহরণ পেশ করছি:

ট্রয় যুদ্ধের সময়, প্যাট্রোক্লাসের অশরীরী তার সহযোদ্ধা  অ্যাকিলিসের কাছে উপস্থিত হয়েছিল।  । চেয়েছিল সঠিকভাবে তাকে দাহ করা হোক।  ভূতটা অবশ্য এর সাথে একটা দুঃসংবাদও দিয়েছিল- অ্যাকিলিসও এই ট্রয়েযুদ্ধেই মারা যাবে।

ইউলিসিসের  সমুদ্র যাত্রার এক সাথী এলপেনর। যার মৃত্যু হয়েছিল সির্সের দ্বীপে।   তার আত্মাফিরে আসে, ইউলিসিসকে ওই দ্বীপে ফিরে গিয়ে  যথাযথভাবে তাকে সমাধিস্থ করার আবেদন জানায়

রোমান সম্রাট ক্যালিগুলার ভূত ল্যামিয়ানের উদ্যানে ঘুরে বেড়াত। হত্যা করার পর তার দেহ দ্রুত পুড়িয়ে দিয়ে ওখানেই পুঁতে দেওয়া হয়েছিল।   একজন সম্রাটের উপযোগী শেষকৃত্যের নুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত তার ভূতকে অনেকেই ওই স্থানে দেখতে পেয়েছিলেন।  তাঁর ছাই রাখা হয়েছিল।  যে স্থানে ক্যালিগুলাকে খুন করা হয়েছিল সেই স্থানে তাকে ছাড়াও ন্যান্য অনেক  ভূতের দেখা পাওয়া যেত বলে জানা যায়।    

অনেক সময় দেখা গেছে নিজের চেনা মানুষদের কাছে বা কোনও কোনও সময় অপরিচিত মানুষের কাছেও ভূতের আগমন হচ্ছে, জীবিত জীবনের বা পরবর্তী সময়ে তার জন্য করা  নানান কাজের  ধার শোধ করার জন্য।  

রোমান রাজনীতিক এবং লেখক সিসেরো (খ্রিস্টপূর্ব ১০৬-৪৩), সিমোনাইডস নামক   মানুষের   কথা লিখেছেন। যে এক অজানা আগুন্তুকের মৃতদেহ  কবরস্থ করেছিল। সেই আগন্তুকের ভূত সিমোনাইডসের কাছে উপস্থিত হয়েছিলতাকে পরামর্শ দিয়েছিল জাহাজে সফর না করার।   সিমোনাইডস অশরীরীর কথা মেনে নিয়েছিলেন ।  পরে জানতে পারেযে, জাহাজটা সমুদ্রের বুকে হারিয়ে গেছে।  


এমন অনেক নমুনাও পাওয়া যাচ্ছে যেখানে ভুত বা আত্মারা  বর্তমান ঘটনা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না কিন্তু অতীত সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন । খ্রীষ্ট পূর্ব পঞ্চম শতাব্দীগ্রিক তিহাসিক হেরোডোটাস লিখে গেছেন,  খ্রিস্টপূর্ব ৫ ম শতাব্দীর মানুষ পেরিয়ান্ডারের স্ত্রীর কথা। গ্রীস করিন্থের শাসকের স্ত্রীর আত্মা মৃতদের জগত থেকে ফিরে এসেছিলেন স্বামীর   হারিয়ে যাওয়া এক মূল্যবান বস্তু খুঁজে পেতে সাহায্য করার জন্য।   

সব ভূতই ভবিষ্যৎ বলতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, এটাকে একটা  ক্ল্যাসিক্যাল যুগের সমাপ্তি রূপে  আমরা ধরে নিতে পারি।  একের পর এক অর‍্যাকলদের অবলুপ্তি ঘটার পর দেখা যায় ভূতেরা  ভবিষ্যতের ঘটনার পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা নিজেদের ভেতর বিকশিত করেছে।   

শোকাহতদের সান্ত্বনা দিতেও ভূতেরা ফিরে আসে।   এনিয়াসের স্ত্রীর ভূত [নাকি পেত্নী বলব?], যিনি ট্রয়ের যুদ্ধর সময় আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন, ফিরে এসেছিলেন স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে ।

এছাড়াও সেই সমস্ত মানুষদের ভূতেরাও ফিরে ফিরে আসে যাদের মৃত্যু হয়েছে কোনও   হিংসাত্মক পরিণতিতে। তাদের আত্মারা ‘ভূত’ এর রূপে নিয়ে   ফিরে আসে জীবিত মানুষদের  কাছে তাদের হত্যাকারীকে  খুঁজে পেতে সাহায্য করার জন্য।

রোমান কবি ওভিড (৪৩ খ্রিষ্টপূর্ব – ১৮ খ্রীষ্টাব্দ) রেমাসের  অশরীরীর সম্পর্কে লিখে রেখে গেছেন। যে ফিরে এসেছিল তার আততায়ীর নাম জানানোর জন্য।

‘ডি ডিভিনেশনে’, সিসেরোর লেখায় পাওয়া যায় এক সরাই খানায় দুজন বন্ধু আশ্রয় নিয়েছিল। এদের ভেতর একজনকে  সরাইখানার মালিক হত্যা করে।  তার ভূত ফিরে আসে এবং নিজের  মৃতদেহ খুঁজে পেতে সাহায্য করে বন্ধুকে। সাথেই যথাযথ শেষ কৃত্য করার অনুরো জানায়।

 

ভূতকে বিঘ্নকারী বিরক্তি উদ্রেক কারী সত্তা রুপেই মানা হয়ে থাকে । এর সূচনাও আদিম কাল থেকেই।  দ্বিতীয় শতাব্দীতে, গ্রিক লেখক পৌসানিয়াসের লেখায় এরকম এক ভুতুড়ে বর্ণনা পাওয়া যায়। উনি লিখেছেন, ৬০০ বছর আগে ম্যারাথনের যুদ্ধ যেখানে হয়েছিল, সেই স্থানেই মৃত যোদ্ধাদের কবর দেওয়া হয়েছিল। সেখানে রাতের বেলায় [কেন? যুদ্ধ তো দিনের বেলা হয়েছিল?]  যুদ্ধের সময় সৈন্যদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি শোনা যায়।   

 ‘লাইফ অফ সিমন’ -এ, গ্রীক জীবনীকার প্লুটার্ক ( ৪৬?-১২০? খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন,  চ্যারোনিয়ায় স্নানাগারগুলো  ভুতুড়ে। ওখানে একজন খুন হওয়া মানুষের ‘ডেমন’ [এরা ঠিক কী ধরণের সত্তা সে বিষয়ে ‘শেষপাতে’ তে লিখেছিলাম] ঘুরে বেড়ায়। যে জীবিত কালে এক জন গুন্ডা ছিল। মাঝে মাঝে অশরীরী অবয়বের আবির্ভাব, গোঙানি এবং আরও সব ভয় ধরানো শব্দ শোনা যেত ওই সব স্নানাগারের ভেতর। যার সহ্য করা অনেকের অক্ষেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে ওখানকার   বাসিন্দারা স্নানাগারগুলো বন্ধ করে দেয়।   

কিছু কাহিনী অনুসারে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভূত কোনও মধ্যস্থতাকারীর  জন্য অপেক্ষা করে না। এরকম অনেক কিংবদন্তী আছে যেখানে স্বয়ং ভুত নিজেই তার খুনি বা হামলাকারীদের শাস্তি দিয়েছে।  যদিও ভূতেদের পক্ষে কোনও জীবিত মানুষকে ছোঁয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করা হয়, তবুও কিছু ক্ষেত্রে তেনারা নিজেরাই তাদের অপরাধীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে সক্ষম  বলেও বিবৃত হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সব ভূতেদের ঠিক থাক ভাবে শেষকৃত্য সম্পাদন করা হয়নি।

এইসব থেকে কী এটাই মনে হয় না সুধী পাঠক পাঠিকাগন - আসলে এই সব গল্প কথা সৃষ্টি করার আসল উদ্দেশ্য ছিল, একজন মানুষের দেহটাকে সঠিক পদ্ধতিতে পঞ্চভূতে বিলীন করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা? যা একদিকে পরিবেশ সহায়ক।  

 

তৃতীয় শতাব্দীতে,  প্রাচীন গ্রীস এবং রোমে খ্রিস্টধর্ম  তাদের ভিত্তি অনেকটাই শক্ত করে ফেলেছিল। এর সাথেই পৌত্তলিকদের কাছে নিজেদের ধর্মকে আকর্ষণীয় করে তোলার উদ্দেশ্যে   সেই সময়ের খ্রিস্টান চার্চ  প্রচলিত জনপ্রিয় ধর্মীয় অনেক বিষয়কেই তাদের আচারের ভেতর সংযুক্ত করে নিয়েছিল।  বিশেষ করে ভূত এবং পরকালের অনেক আচার সেখানে ঢুকে যায়।

সেই সময়ের খ্রিস্টান লেখকদের ভেতর একজন  জাস্টিন  মার্টিয়ার জানিয়েছেন, নতুন এই ধর্ম ব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হতে থাকে মৃত্যুর পরেও একটা জীবন আছে।  উনি ওল্ড টেস্টামেন্টের সাউলের কাহিনীর, যার কথা আমি আগেই বলেছি, দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন যেখানে পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে খ্রিস্টানরা মৃত্যুর পর আত্মা বা ভূতে বিশ্বাস করে।    

প্রথমদিকের খ্রিস্টান চিন্তাবিদরা বলতেন,  ভূত আছে এবং তারা শুধুমাত্র অশরীরী অবয়ব ছাড়া আর কিছু নয়। আর এর জন্যই, মৃত্যুর পরে, সমস্ত মানুষ সামাজিক স্তরে একই ধরণের সত্তায় পরিণত হয়।  এই বিশেষ ধারণাটা স্বাভাবিক ভাবেই সমাজের সেই সমস্ত জনসাধারণের কাছে প্রবল আকর্ষণীয় হয়েছিল যারা তুলনামূলক ভাবে সমাজের নিচের দিকে অবস্থান করত। মৃত্যু পরবর্তী সময়ে উচ্চস্তরের সমকক্ষ হওয়ার ভাবনা তাদের প্ররোচিত করেছিল নতুন ধর্ম পালনে। আর এই সূত্রেই একাধিক ভূতের গল্প তথা কিংবদন্তী জন্ম নিতে থাকে।

এরকম একটা সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকাটা খ্রিস্টান চার্চের পক্ষে  যে একটা বড় ব্যাপার ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারন এর সূত্রেই এসেছিল সেই অমোঘ প্রশ্ন -   একজন মানুষ মারা যাওয়ার পর তার আত্মা কোথায় যায়?  এখন আপনি বলতেই পারেন যেখানেই যাক না কেন এ নিয়ে এত ভাবার কী আছে? কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এর সাথেই আরও একটা প্রশ্ন জুড়ে যাচ্ছে যে, যে আত্মা অন্য জগতে গেল, সে কী তাহলে ইচ্ছেমত এই জগতে ফিরে আসতেও পারে?   

 

সূচনা লগ্নের খ্রিস্টান তাত্ত্বিক এবং লেখকরা একমত ছিলেন যে, আত্মা কোনও একটা জায়গায় অবশ্যই যায়। এবং অপেক্ষা শেষ বিচারের। তারা  তিনটে সম্ভাব্য স্থানের কথাও বলেছিলেন -  

১। এক অদৃশ্য অঞ্চল যা  ঈশ্বরের দ্বারা সংরক্ষিত বা নিয়ন্ত্রিত।

২। তথাকথিত ‘আব্রাহামের বক্ষদেশ’। যদিও কেউ ঠিকঠাক জানত না যে এটা কী বা কোথায় এর অবস্থান।  

৩। আন্ডারওয়ার্ল্ড বা ভূগর্ভস্থ এক জগত যেখানে শাস্তি পেতে হয় নাকি  আরামদায়ক সেটা নিশ্চিত হতে পারেননি তারা।  মধ্যবর্তী একটা অঞ্চল বলেই মানা হত।

পারগেটরি বা প্রায়শ্চিত্ত পরিশোধক ব্যবস্থা বা পরিশুদ্ধিকরণ:   ​​স্বর্গও নয় নরকও নয়  

  মহান খ্রিস্টান তাত্ত্বিক সেন্ট অগাস্টিনও বলেননি, তার আত্মা আসলে কোথায় গিয়েছিল তার মৃত্যুর পর।  দ্বাদশ শতাব্দীর সময় যখন মধ্যযুগ ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে এ জগত থেকে,  তখন এই পরিশুদ্ধিকরণের ধারণা ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  স্বর্গ এবং নরকের মধ্যে এমন এক ‘ইথার জগত’ যেখানে আত্মাদের থাকতে হয়। পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয়বার পার্থিব জীবন ধারণের।   

১২৫৪ সালে সম্ভবত পোপ চতুর্থ ইনোসেন্টকে লেখা একটি ধর্মীয় চিঠিতে ‘পারগেটরি’ শব্দটার প্রথম ‘অফিসিয়াল’ ব্যবহার হয়েছিল ।   ১২৭৪ সালে কাউন্সিল অফ লিওন্সে এ নিয়ে আলোচনা করা হয়  কাউন্সিল অফ ফ্লোরেন্সে  (১৪৩৮-১৪৪৩) এ  এ নিয়ে ব্যাপক চর্চা হয়েছিল।

কাউন্সিলের পক্ষে থেকে ঘোষণা করা হয়,  মূল্যের বিনিময়ে মৃতদের সাথে যোগাযোগ, অলৌকিক পদ্ধতিতে বার্তা প্রেরণ করা এবং তাদের কাছ থেকে কোন বিষয়ে সংবাদ প্রাপ্তি  বাস্তবে সম্ভব।  শুধু তাই নয়   চার্চের নিয়ামকেরা মৃত মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধিকরণ কষ্টের পরিমাণ কমানোর জন্য বিশেষ আচার প্রথাও চালু করে। মূল উদ্দেশ্য কী ছিল তা আশাকরি বলে দেওয়ার দরকার নেই। সমঝদারোকে ইশারাই কাফি! আসলে সারা বিশ্বের সমস্ত [ অনুগ্রহ করে কেউ রাগ করবেন না] ধর্মের কিছু সুবিধাবাদী মানুষ বা সংস্থা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, এরকম সব কিংবদন্তী ও আচার প্রথার জন্ম দিয়েছেন এবং বাধ্য করেছেন সবাইকে মেনে নিতে। শান্ত মনে সামাজিক অবস্থান বুঝে ভেবে দেখুন, আমার কথাটা ভুল নয় বলেই মনে হবে।

আত্মার আবির্ভাব বা অ্যাপারিশনের একাধিক ঘটনা অন্ধকার এবং মধ্যযুগ জুড়ে অব্যাহত ছিল। ভূতের নানবিধ রূপ এবার হাজির হতে শুরু করে মানুষের স্বপ্নের জগতেও।   সেই সময়ের বেশিরভাগ বর্ণনা অনুসারে, মানুষের আকারে যে ভূতের দেখা যেত তাদের অবয়ব হত  ফ্যাকাশে   এবং মুখেচোখে থাকত বিমর্ষ দুঃখের ছাপ। ৯০ শতাংশ অশরীরীর গায়ে হাত পায়ে এবং মুখে দেখা যেত পোড়া দাগ ও ক্ষত চিহ্ন। যা আসলে ছিল পরিশুদ্ধি করণের চিহ্ন।   কখনও কখনও, এই সব ভূতেরা   মানবেতর রূপেও উপস্থিত হত। অনেকেই   আলোর বল বা ঘুঘুপাখি রূপে এদের দেখা পেতেন।

গল্প  অনুসারে খ্রিস্টান অশরীরীর দল   ফিরে আসত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বীকারোক্তি দিতে এবং   ক্ষমা চাইতে। জীবিত থাকার সময় যে পাপ তারা করেছে তার কথা বলত। তার জন্য কী প্রায়শ্চিত্ত তাদের করতে হচ্ছে সেটাও জানাত।  একটা বিষয়ে ওই যুগের প্রায় সব ভূতের গল্পেই মিল পাওয়া যায়।  জীবন যাপনের  সময় সমস্ত ধরণের ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং নিয়ম কানুন মেনে চলার   প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তারা সতর্ক করে দিত। 

কিছু কী বুঝতে পারছেন পাঠক পাঠিকাবৃন্দ ভুতের গল্পের আসল উৎস কোথায়?

কিন্তু যুগের বদল মানেই পরিবর্তনের হাওয়া। এ সিরিজে আগামী কোনও এক সময়ে আমরা দেখব  ১৬ শতাব্দীতে, সংস্কারবাদী প্রোটেস্ট্যান্ট লেখক এবং চিন্তাবিদরা ভূতের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন।

যাইহোক  তাত্ত্বিক এবং চিন্তাবিদদের ভাবনা চিন্তা থেকে একটু সরে আসি এবার। শতাব্দীর পর  শতাব্দী ধরে মানুষ আসলে কী ধরণের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, যাতে তাদের বেশিরভাগের মনেই  এ ধারণা নিশ্চিত হয় যে, মৃত্যুর পরেও জীবন আছে?

আপাতত এই সিরিজের ২য় অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি। পরবর্তী অধ্যায়ে ভুতেদের প্রকৃতি খোঁজার চেষ্টা চালাব।  যদি সত্যিই তাদের অস্তিত্ব থাকে তাহলে তাদের নির্মাণ কী দিয়ে তৈরি হতে পারে?