Search This Blog

Tuesday, August 1, 2017

#প্রাচীন_সপ্তাশ্চর্যের_খোঁজ[২৪-২৭] ২য় অধ্যায়- **একটি প্রাক অভিযান**[ সম্পূর্ণ] প্রতিম দাস

প্রাচীন_সপ্তাশ্চর্যের_খোঁজ[২৪]
**একটি প্রাক অভিযান**
প্রতিম দাস
০০০০০০০০০০০০০০০০০


*আগ্নেওগিরি*
উত্তরপূর্ব উগান্ডা
২০ শে মার্চ ১৯৯৬

প্রথম অভিযানের ১০ বছর আগে

কানিয়ামানাগা আগ্নেওগিরির অভ্যন্তরে
উগান্ডা, আফ্রিকা
২০শে মার্চ, ১৯৯৬, সকাল ১১টা ৪৭মিনিট
ওয়েস্টের স্বপ্ন দৃশ্য –
এক প্রাচীন যুগের পাথরের সুড়ঙ্গ পর ধরে ওয়েস্ট ছুটছে। সাথে আছে উইজার্ড। ওদের ল ক্ষ্য সেই দিক যেদিক থেকে ভেসে আসছে ড্রামের শব্দ, মন্ত্রের উচ্চারন । আর তার সাথেই এক মহিলার তীব্র চিৎকার।
দারুন গরম জায়গাটা।
একেবারে নরকের মতো।
আর যেহেতু জায়গাটা আগ্নেওগিরির অভ্যন্তরে ফলে দেখতেও লাগছে একেবারে নরকের মতই।
ওরা মাত্র দুজ ন – আর সাথে আছে অবশ্যই, হোরাস। এই সময়ে কলোসাস অভিযানের টিমটার কোন অস্তিত্বই ছিল না।
ওদের পোশাকে লেগে আছে কাদা আর আলকাতরা – এক দারুন বিপদজনক এবং লম্বা পথ পেরিয়ে এখানে আসতে পেরেছে ওরা ।  ওয়েস্টের মাথায় সেই ফায়ারম্যান হেলমেট আর পায়ে মোটা সোলওয়ালা আর্মি বুট। ২৭ বছরের যুবক, অনেক বেশী আইডিয়ালিস্টিক কিন্তু   হঠকারী নয় মোটেই। চোখ কুঁচকানো , মনোযোগের প্রতীক। বাঁ হাতটা এখনো অক্ষত।
ডুম দুম ডুম!!! ড্রাম বাজছে।
বাড়ছে মন্ত্রের গতি।
মহিলার আর্ত চিৎকারে মথিত হচ্ছে চারপাশ।
ওরা অনেক গুলো বুবি ট্র্যাপ লাগানো সুড়ঙ্গ পথ পেড়িয়ে এলো – সবগুলোই পশ্চিম মুখী।
দশ রকমের রোগ জীবানু বহন কারী মোলোসিড বাদুড়েরা নখ যুক্ত থাবা বাগিয়ে ওদের দিকে ধেয়ে এলো অন্ধকার ছাদের দিক থেকে – হোরাস উড়ে গেল ওয়েস্টের কাঁধের ওপর থেকে। লাঞ্চটা ওর ভালোই হবে। শূন্যে লেগে গেল ঝটাপটি। ক্যাঁচ কোঁচ তীক্ষ্ণ চিকা। দুটো বাদুড় পড়ে গেল মেঝেতে। হোরাসের শিকার ।
  কমে গেল বাদুড়দের ধেয়ে আসা, দুজন মানুষ এগিয়ে গেল সামনের দিকে। একটু বাদেই হোরাস এসে গেল ওদের কাছে।
ওয়েস্টের সামনে এখন একটা যথেষ্ট লম্বা ঢালু সুড়ঙ্গ। প্রায় ১০০ মিটার লম্বা পাথরের একটা নল। দারুন রকম কোনে কাত করা। ভেতরের ফাঁকটা একজন মানুষ চলে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
ড্রাম বেজেই চলেছে অবিরাম।
শয়তানি মন্ত্রোচ্চারণ অনেকটাই কাছের থেকে শোনা যাচ্ছে এখন।
মহিলার কন্ঠ থেকে যে চিৎকার ভেসে আসছে সেরকম অমানুষিক আদিম বেপরোয়া আর্ত চিৎকার  ওয়েস্ট আগে কোনো দিন শোনেনি।  
একবার তাকালো উইজার্ডের দিকে।
বয়স্ক মানুষটি হাত নাড়লেন। ‘যাও! জ্যাক! যাও! ওকে উদ্ধার করো ! আমি তোমার পেছন পেছনেই ঠিক পৌছে যাবো !’
পাথরের অতিকায় নলটার ভেতর আগে পা ঢুকালো ওয়েস্ট। ছেড়ে দিলো শরীরের ভার, পিছলে সড়সড়িয়ে শুরু করলো নামতে।
পাঁচটা ট্র্যাপ পার হয়ে এসে নেমে এলো নলটার একেবারে বাইরে ...
... এটা একটা ব্যালকনির মতো।
একটা ব্যালকনির অন্য দিকে    দেখে মনে হচ্ছে একটা বড় মাপের উৎসব পালন করার গুহা।
রেলিংএর ওপর দিয়ে তাকাতেই ওর নজরে এলো বীভৎস দৃশ্যটা।

মহিলাটি একটা রুক্ষ পাথরের চত্বরের ওপর হাত পা ছড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। বেঁধে রাখা হয়েছে। পা দুটো ছড়ানো। ছটফট করছে । ভয়ের ছাপ চোখে মুখে।
চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে অন্তত জনা কুড়ি পুরোহিত জাতীয় মানুষ। সবাই পড়ে আছে মাথা ঢাকা দেওয়া কালো পোশাক । একই সাথে সকলের মুখেই ইজিপশিয়ান দেবতা আনুবিসের আদলের ভয়ানক শেয়ালের মুখোশ।
ছয় জন পুরোহিত বিরাট বিরাট সিংহের চামড়া লাগানো ড্রাম পেটাচ্ছে।
বাকিরা এক অদ্ভুত ভাষায় করে যাচ্ছে মন্ত্র উচ্চারন।
এর ভেতরেই আর বেশী অবাক করে দেওয়ার মতো বিষয় হলো বাইরের দিকে মুখ করে ওই পুরোহিতদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ষোলো জন প্যারাট্রুপার । জাতে ওরা ফরাসী। প্রত্যেকের হাতে এফ এন –ম্যাগ অ্যাসল্ট রাইফেল।   দৃষ্টিতে মৃত্যুর হিমশীতলতা।
এসব বাদ দিয়ে আপাতত   কক্ষটা   ওয়েস্টের নজর কেড়েছে।
আটকোনা আকৃতির ঘরটার ভেতরে আগ্নেওগিরির লালছে আলোর আভা দেখা যাচ্ছে।
ওটাও খুব প্রাচীন – অতি প্রাচীন।
ওখানকার সব দেওয়াল সমতল। পাথরের দেওয়াল গুলো এতো নিখুঁতভাবে কাটা যে আশেপাশের সাথে দারুন বেমানান দেখতে লাগছে। পাশের দেওয়াল থেকে বেড়িয়ে আছে আয়তাক্ষেত্রাকার ধারালো কানাতওয়ালা পাইপের মুখ।
দেয়াল জুড়ে হিয়েরো গ্লিফিক বর্ণমালা খোদাই করা আছে। মূল দরজার ওপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে –
“ স্ব ইচ্ছায় প্রবেশ করো আনুবিসের আলিঙ্গনে, তবেই তুমি বেঁচে থাকবে রা’য়ের আগমনের পরেও । ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি প্রবেশ করো , তোমার লোকজনেরা একযুগ ধরে শাসন করবে সব কিছু । কিন্তু তুমি বেঁচে থাকবে না । এখানে ভেতরে যদি একেবারেই প্রবেশ না করো না, তাহলে এ জগতও থাকবে না।’
দেখার মতো একটা বিষয়  হলো, ঠিক যে ছকে উঁচু ছাদ নির্মিত হয়েছে ঠিক সেই ছকেই এ ক্ষের মেঝে বানানো হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ ফুট নিচুতে।
ছাদে একটা সরু উলম্ব নলাকৃতি জিনিষ লাগানো আছে – একেবারে মাঝখানে, ঠিক নিচের পাথরের চত্বরটার ওপরে।
অতি সরু উলম্ব ওই পাথরের নল নিশ্চিত সব কিছু ভেদ করে উঠে গিয়েছে একেবারে পৃথিবীর ওপরে। কারন ঠিক এই মুহূর্তে দুপুরের সূর্যালোক – একবারে সোজাসুজি লম্বাভাবে দারুন রকমের ঝকঝকে , লেজারের মতো সুক্ষ – সেই নলের ভেতর দিয়ে এসে, পড়েছে ...
... পাথরের চত্বরটার ওপর, যেখানে মহিলাটিকে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে।
আরো একটা ব্যাপার –
মহিলাটি গর্ভবতী।
তার থেকেও বড় ব্যাপার।
মনে হচ্ছে বাচ্চা  কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রসব হবে ...
যথেষ্টই কষ্টকর যন্ত্রনাদায়ক এই মুহূর্ত , কিন্তু সেটাই একমাত্র কারন নয় তার চিৎকারের ।
‘আমার বাচ্চাকে কেড়ে নিও না!” চিৎকার করছিল মহিলাটি। ‘আমার...বাচ্চাকে...কেড়ে ...নিও ...না!’
পুরোহিতগুলো পাত্তাই দিচ্ছিলো ওর কথায়। চালিয়ে যাচ্ছিলো মন্ত্রোচ্চারণ আর ড্রাম বাজানোর কাজ।
অন্তত পঞ্চাশ ফুট চওড়া এবং ভগবান জানে কত ফুট গভীর সামনের ওই উপাসনা কক্ষটা, এই ভাবনা নিয়ে অসহায়ের মতো ওয়েস্ট তাকিয়ে  ছিল সামনের দিকে।
সহসাই এই সব হইহট্টগোলের মাঝে আরো একটা তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা গেল।
একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ ।
মহিলাটির প্রসব  হয়ে গেল ...জন্ম দিলেন এক শিশুর ...
পুরোহিতগুলো উল্লাসের চিৎকার করে উঠলো।
আর প্রধান পুরোহিত – যিনি একমাত্র লাল পোশাক পড়ে ছিলেন, মুখোশহীন – নাড়ী ছিঁড়ে বাচ্চাটিকে তুলে নিলেন মহিলাটির কাছ থেকে । তুলে ধরলেন সেই আলোর দিকে যা আসছে পৃথিবীর ওপর থেকে।
সুক্ষ লেজার বিমের মতো সূর্যের আলো।
চিৎকার করে বললেন, ‘ছেলে!’
বাকি পুরোহিতেরা আবার উল্লাসের ধ্বনি ছাড়লো।
ঠিক যে মুহূর্তে প্রধান পুরোহিত শিশুটিকে ওপরের দিকে তুলে ধরলেন , ওয়েস্ট দেখতে পেলো পুরোহিতের মুখ।
‘ডেল পিয়েরো ...’ একইসাথে শ্বাস ছেড়ে উচ্চারন করলো।
মহিলাটি কেঁদেই চলেছে, ‘দয়া করো। ভগবানের দোহাই! ওকে কেড়ে নিও না! না আআআআ !’
কিন্তু ওরা ওকে কেড়েই   নিলো, ফিরিয়ে দিলো না
  সতর্ক সশস্ত্র প্যারাট্রুপারদের পাহারায়, একেবারে মাঝে উঁচু করে শিশুটিকে ধরে , পুরোহিতগুলো বেড়িয়ে গেল প্রধান দরজা দিয়ে যার অবস্থান বেশ কিছুটা দূরে। ওদের যেতে হল একটা ছোট্ট সেতুর ওপর দিয়ে। হাওয়ায় উড়ছিল ওদের পোশাক ।
ওরা চলে যেতেই বাইরে আকাশে দুপুরের সূর্যের স্থানের ও পরিবর্তন হল। নেমে আস্তে থাকা সেই সুক্ষ উলম্ব আলোর রেখা মিলিয়ে গেল ।
প্রধান পুরোহিত – ফ্রান্সিসকো ডেল পিয়েরো –কক্ষে থাকলেন শেষ অবধি একা ।  চারদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে পা দিয়ে চাপ দিলেন প্রধান দরজার কাছের একটা ট্রিগার স্টোনে এবং চলে গেলেন।
যার ফল হলো সাংঘাতিক এবং নিমেষের মধ্যে 
গুহার দেওয়ালের গর্তগুলো দিয়ে ঢুকতে শুরু করলো আগ্নেওগিরির গরম লাভার স্রোত। ধেয়ে চললো চত্বরটার দিকে। মধ্যে পড়ে থাকা পাথরটা লক্ষ্য করে।
একই সাথে নামতে শুরু করলো কক্ষটার ছাদ , নিচের দিকে – ওপরের নানান এলোমেলো খোদাই করা আকার আকৃতিগুলো নামতে থাকলো মেঝের খোদাই করা ফাঁকে নিখুঁত ভাবে মিলে যাওয়ার জন্য। এবার দেখা গেল মধ্য চত্বরটাকে বিশে ভাবে ঢাকার জন্যেও ওখানে স্থান নির্দিষ্ট করা আছে।
পাথরের ওপর পড়ে থাকা মহিলাটি এসব লক্ষ্য করেনি ।
মানসিক যন্ত্রনায় বা অত্যধিক রক্তক্ষরনের কারনে, পড়ে আছে নিথর   নিশ্চল ভাবে।
উইজার্ড এসে দাঁড়ালেন ওয়েস্টের পাশে। তাকালেন বীভৎস দৃশ্যটার দিকে।
‘ওহ মাই গড, আমাদের দেরী হয়ে গেল আসতে,’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।
ওয়েস্ট সোজা হয়ে দাঁড়ালো ।
‘ফরাসী প্যারাট্রুপারদের সাথে ওখানে ডেল পিয়েরো ছিল।’
উইজার্ড ঢোঁক গিকে বললেন , ‘তারমানে ভ্যাটিকান আর ফরাসীরা  একসাথে একটা দল বানিয়েছে ...’
এর ই মধ্যে ওয়েস্ট একটা প্রেসার গান বার করে কক্ষের নামতে থাকা ছাদের দিকে ফায়ার করলো । একটা আংটার মতো জিনিষ গেঁথে বসে গেল পাথরের ভেতর। ওটার সাথে বাঁধা আছে একটা দড়ি।
উইজার্ড অবাক হয়ে বলে উঠলেন, ‘কি পাগলামো করতে যাচ্ছ তুমি?’
‘আমি ওইখানে যাচ্ছি। আমাকে যেতেই হবে ওকে বাঁচানোর জন্য । পারি বা না পারি। কিন্তু চোখের সামনে অকারনে ওকে মরে যেতে দিতে   পারবো না।’
বলার সাথে সাথেই দড়িটা ধরে মারলো ঝাঁপ।
ছাদ ক্রমশ নামছে।
চারদিক থেকে গড়িয়ে আসছে গরম লাভা। এগিয়ে আসছে পাথরটার কাছে।
যদিও ওয়েস্টের ঝুলে যাওয়ার গতি   অনেক বেশী এসবের তুলনায়। এক লহমায় ও গিয়ে দাঁড়ালো মহিলাটির শরীরটার কাছে।
দ্রুত পালস পরীক্ষা   করে বুঝলো মহিলা আর বেঁচে নেই।
চোখটা বুজে এলো ওয়েস্টের।
‘অ্যায়াম সরি ম্যালেনা ...’ ফিস ফিস করে বললো, ‘...অত্যন্ত দুঃখিত।’
‘জ্যাক! জলদি!’ উইজার্ড চিৎকার করে বললেন ব্যালকনি থেকে। ‘লাভা এগিয়ে আসছে!’
লাভা আর মাত্র আট মিটার দূরে ... দুদিক থেকেই এগিয়ে আসছে জ্যাকের দিকে।
এ ঘর থেকে বার হওয়ার প্রবেশ পথটার ওপরের একটা গর্ত থেকে যে লাভার প্রপাত পড়ছে তাতে একটা পর্দার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে ওটা দরজাটা আড়াল করে।
হাত বাড়িয়ে ওয়েস্ট ম্যালেনার চোখের পাতা দুটো নামিয়ে দিলো। এখনো ওর শরীর গরম হয়ে আছে। তাকালো শরীরটার দিকে। তলপেটের ফোলাটা অনেকটাই কম । চামড়া নেমে গেছে নিচের দিকে প্রসবের পর ।
হঠাৎ কিছু একটা দেখে ওয়েস্ট ম্যালেনার পেটে হাত দিলো।
হ্যাঁ কিছু একটা নড়ছে।
চমকে গিয়ে সরিয়ে নিলো হাতটা।
‘ম্যাক্স! যেভাবেই হোক এখানে আসুন! এক্ষুনি!’
এক অতি আশ্চর্যজনক স্বপ্ন দৃশ্য –
চারদিকে গড়িয়ে আসছে লাভা। নেমে আসছে কক্ষের ছাদ। দুজন মানুষ পাথরের চত্বরটার ওপর ওয়েস্টের লেদারম্যান চাকুর সাহায্যে   মগ্ন এক সিজারিয়ান অপারেশনে।
তিরিশ সেকেন্ড পর ... উইজার্ড তুলে ধরলেন আর একটি শিশুকে, মহিলাটীর চিরে ফেলা গর্ভাশয়ের ভেতর থেকে।
একটি কন্যাসন্তান।
চুলগুলো লেপ্টে লেগে আছে মাথায় সাথে । গোটা গায়ে রক্ত আর গর্ভাশয়ের তরল, চোখ দুটো বন্ধ, কোঁচকানো ।
ওয়েস্ট এবং উইজার্ড দুজনের গায়েই লেগে আছে নোংরা । এক বিরাট যাত্রা পথের শেষে দুই অভিযাত্রী একে ওপরের দিকে তাকালেন দুই গর্বিত পিতার মতো।
ওয়েস্ট তাকিয়ে ছিলো ছোট্ট শিশুটির দিকে ।
‘জ্যাক !’ উইজার্ড ডাকলেন । ‘ কাম অন! এবার আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।‘
ঘুরে ঝুলতে থাকা দড়িটা ধরতে গেলেন – গড়িয়ে আসা লাভা ততক্ষনে ছুঁয়ে ফেলেছে সেই দড়ি । ধরার আগেই হুউউউস করে আগুন লেগে গেল ওটাতে।
ওই পথ আপাতত বন্ধ হয়ে গেল ।
বাচ্চাটাকে হাতে ধরে ওয়েস্ট ঘুরে তাকালো প্রধান দরজাটার দিকে।
পনের মিটার গভীর লাভা জমে আছে ওটার সামনে ।
সাথেই এক লাভা স্রোতের চাদর বাধা হয়ে ঝুলছে দরজাটার সামনে।


একই সাথে ওর চোখে পড়লো  দরজার ফ্রেমটার বাঁ পাশে একটা ছোট্ট গোল গর্ত। এক হাত মতো চওড়া। কিন্তু ওটার সামনেও সেই লাভা স্রোতের চাদর ঝুলছে।
ওয়েস্ট উইজার্ডকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ সোল কতটা মোটা আপনার বুটের?’
উইজার্ড উত্তর দিলো , ‘কিছু সেকেন্ডের জন্য কাজ চলে যাবে। কিন্তু ওই  ঝরে পড়তে থাকা লাভা আটকানোর তো কোন উপায় নেই।’
‘আছে, ওখানেই আছে,’ ওয়েস্ট ছোট্ট গর্তটা দেখিয়ে বললো। ‘গর্তটা দেখতে পাচ্ছেন। ওর ভেতরে পাথরের একটা ডায়াল আছে, ওই লাভার চাদরের ঠিক পেছনে। এক বিশেষ প্রযুক্তি যা ওই লাভা পতনকে আটকে দিতে সক্ষম।’
‘কিন্তু জ্যাক যে কেউ ওটার কাছে গেলে তাকে –’
উইজার্ড দেখতে পেলেন ওয়েস্ট কিছুই শুনছে না।  এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেওয়ালের গর্তটার দিকে।
ওয়েস্ট ঠোঁট কামড়ে ধরে এক অসম্ভব কথা ভাবছিল।
একটা ঢোঁক গিলে, উইজার্ডের দিকে ঘুরে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো, ‘ম্যাক্স , আপনি আমাকে একটা নতুন হাত বানিয়ে দিতে পারবেন?’
উইজার্ড স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বুঝতে পারছেন এটাই একমাত্র পথ এই জায়গা থেকে প্রান নিয়ে পালাবার জন্য।
‘জ্যাক। তুমি যদি আমাদের এই নরক থেকে বার করে নিয়ে যেতে পারো... আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে এমন হাত বানিয়ে দেবো যা জন্মসুত্রেও তুমি পাওনি।’
‘বেশ তাহলে একে ধরুন , আর আসুন আমার সাথে,’ ওয়েস্ট শিশুটিকে উইজার্ডের হাতে দিলো ।
এগিয়ে গেল ওরা যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব লাভার স্রোত ঠেলে। সমানে ওয়েস্ট, পেছনে বাচ্চাটাকে হাতে নিয়ে উইজার্ড। এক ইঞ্চির বেশী লাভা এখন মেঝেতে। গড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ওদিকে একটু একটু করে গলে যাচ্ছে ওদের জুতোর সোল প্রতি পদক্ষেপে।
পৌছালো লাভা প্রপাতের চাদরের সামনে। একটুও সময় নষ্ট না করে ওয়েস্ট এগিয়ে গেল দরজার ফ্রেমের পাশের গর্তটার দিকে । একটা বড় শ্বাস নিলো এবং –
বাঁ হাতটাকে ঠেলে দিলো লাভা প্রপাতের চাদরের ভেতর দিয়ে গর্তের ভেতরে কনুই অবধি!
‘আআআআঅ্যা হহহহহহ!’
এই যন্ত্রনার সাথে আজ অবধি ওয়েস্টের পরিচয় ছিল না। এ যেন সব শরীরের সব কিছু ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে।
নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে লাভার গলা পাথুরে আগুন ওর হাতটাকে খেয়ে নিচ্ছে যেমন করে ব্লো টর্চ গলিয়ে দেয় ধাতুর চাদরকে। দ্রুতই ওটা ওর হাতটাকে পুড়িয়ে শেষ করে দিলো। কিন্তু এর মধেই কিছু সময়ের জন্য নিজের বাঁ হাতের আঙুলগুলো ব্যবহারের একটা শেষ সুযোগ পেয়েছিল ওয়েস্ট। আর সেটাই ওর দরকার ছিল। ছুঁতে পেরেছিল ...
ওই গোল গর্তের ভেতরে থাকা একটা পাথরের ডায়ালকে ।
ছোঁয়া মাত্রই শরীরের সব শক্তি দিয়ে ওটাকে চেপে ধরে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সাথে সাথেই কনুই থেকে পুরো হাতটাকে আর চেনা যাচ্ছিলো না। আর একটা কাজ ও হয়েছিল একই সাথে। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল লাভা প্রপাত।
ছাদটাও থেমে গিয়েছিল মাঝ পথে।
প্রবেশপথের মুখে ছিল না কোন বাধা।
ওয়েস্ট টলতে টলতে সরে এসেছিল গর্তটার কাছে থেকে...
...কনুই এর কাছে থেকে বাঁ হাতের চিহ্ন হিসাবে ছিল গলে যাওয়া হাড় আর পুড়ে যাওয়া মাংসের কিছু কুচি।
ওয়েস্ট দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না ঠিক মতো।
উইজার্ড দুজনকেই ধরলেন , সাথেই নিজেও টাল সামলালেন কোনওমতে। কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেলেন একটা পাথরের সুড়ঙ্গের  দিকে।
ওয়েস্ট নিজের দগ্ধ বামহাতটা চেপে ধরে অজ্ঞান হয়ে গেল।
বাচ্চাটাকে নামিয়ে রেখে উইজার্ড দ্রুত নিজের জুতোটা খুলেই ওয়েস্টের জুতোটা খুলে দিলেন সবার আগে। দুজনের জুতোই আর কয়েক সেকেন্ড খুব বেশি হলে টিকে থাকতো।
নিজের জামা খুলে বেঁধে দিলেন ওয়েস্টের হাতটাকে। অত্যধিক গরম লাভা হাওয়ায় দ্রুত ঠান্ডা হয়ে জমে আটকে দিয়ে রক্তক্ষরন।
এ স্বপ্ন দৃশ্যের এখানেই সমাপ্তি।

শুরু হলো পরের বা অন্তিম স্বপ্ন। এখানে উইজার্ড আর ওয়েস্ট। আগ্নেওগিরির পেটের ভেতরে দুজনে বসে আছে সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে। দুজনেই ক্লান্ত বিধ্বস্ত। দুজনের মাঝখানে পড়ে আছে ছোট্ট শিশু কন্যা।
উইজার্ড বললেন –
‘এটা ... এটা একেবারেই ছকের বাইরের একটা ঘটনা। এ রকম কোন কিছুর উল্লেখ কোন ইতিহাসের পাতায় নেই । দুজন ভবিষ্যৎ বক্তা । টুইন  অর‍্যাকলস। এটা ডেল পিয়েরোও জানতোনা...’
ওয়েস্টের দিকে ঘুরলেন । ‘ডিয়ার ইয়ং ফ্রেন্ড। আমার সবচেয়ে সাহসী তরুণ বন্ধু। বুঝতে পারছো কি ? এর ফলে পুরো ব্যাপারটা অন্য রকম একটা মোড় নিলো। হয়তো এটাই আমাদের একটা সুযোগ করে দিলো আগত ভীষণ সংগ্রামে নতুন করে লড়াই করার জন্য। এই ব্যাপারটা আমাদের সংগঠনের সমস্ত দেশগুলোকে জানিয়ে দিতে হবে। একটা মিটিং এর আশু প্রয়োজন। সম্ভবত আধুনিক যুগের সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ মিটিং হতে চলেছে এটা।’

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

No comments:

Post a Comment