মনস্তাত্বিক অপরাধ কাহিনী...
নাম
প্রতিম দাস
টিউশ্যনী ছিল না। তাতাইরা নেই।
মামাতো দাদার বিয়েতে গেছে। কলকাতা। হাত মুখ ধুয়ে বাড়িতে চা না খেয়ে গেলাম বাপিনদার
দোকানে। সকালে ওখানে জড়ো হয় পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা। চা খাওয়ার সাথে সাথে জমে ওঠে
আড্ডা। টিউশ্যনী থাকে বলে আমার যাওয়া হয় না তবে এরকম ফাঁক পেলে সুযোগটা নষ্ট করি
না। গিয়ে দেখলাম আড্ডা জমজমাট। ব্রিজের তলায় আবার একটা বডি লেগে আছে। তারই খেই ধরে কে
কবে কোথায় এরকম জলে ভেসে আসা ‘বডি’ দেখেছে
তার ব্যাখ্যান দিছিল।
এই মফস্বল শহরটায় বয়ে যাওয়া
নদীটার বাঁকে ব্রিজটা তৈরি হওয়ার পর থেকে প্রায়ই এরকম বেশ কিছু জলে ডোবা মৃতদেহ
এসে আটকে যায়। প্রথম প্রথম লোকে দল বেঁধে দেখতে যেত। তারপর যা হয় – উৎসাহে ভাঁটা
পড়েছে – এখন শুধু আলোচনাই জমে ওঠে।
ভেসে আসা বডিটা যে কার কে জানে...কোথা থেকেই বা এল...নাম ই বা কি? এসব কথা
বার্তার মধ্যেই শোনা গেল ক্লাবের সিনিয়র সদস্য বুদ্ধুদার গলা – যেটা ভেসে এসেছে
সেটা কোন হতভাগ্যর শরীর তা হয়তো কোনদিনই জানা যাবে না। কিন্তু ব্রিজটা তৈরি হওয়ার
পর প্রথম যে দেহটা এসে আটকে ছিল সেটার কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। তোরা বোধ হয়
শুনিসওনি সেটার ব্যাপারে-
বাপিনদা বললো, বুদ্ধু সেই ব্যাঙ্কের পাওনা আদায়কারী লোকটার কথা বলছিস তো?
তোর মনে আছে বাপিন?
থাকবে না। বাব্বা! তখন যা হইচই হয়েছিল। কাগজেওতো বের হয়েছিল কয়েক দফায় ঘটনাটা।
তা আমরাও একটু শুনি কি হয়েছিল, বললো সুজয়।
নামটা আমার ঠিকঠাক মনেও নেই।ঘাঘু পাব্লিক। যে ব্যাঙ্কে কাজ করতো সেই
ব্যাঙ্কেরই টাকা মেরে দেয়। বছর ২৭ আগের ঘটনা । ৪ লক্ষ টাকা। যদিও টাকাটার কি হলো
তার হদিশ করা যায় নি। লোকটা নিজেই ধরা দিয়েছিল। বছর পাঁচেকের জেল হয়। ছাড়া পাওয়ার
মাসখানেক বাদে এখানে পাওয়া গিয়েছিল লোকটার মৃতদেহ। জলে ডোবা কেস। কোন আঘাতের চিহ্ন
ছিল না দেহে। গলায় একটা লকেট ছিল। তার সাহায্যেই পুলিস লোকটার পরিচয় বার করে।
এই সাধারন ঘটনাটা আবার কাগজে বার হয়েছিল, মন্তব্য করলো আইনের ছাত্র রাজা।
ডিস কেবল ইন্টারনেটের যুগে এ খবর
তোদের কাছে গুরুত্বহীন।কিন্তু সে সময়ে খবরটা যথেষ্টই আলোড়ন তুলেছিল। তার সাথে ছিল
অত টাকার ঘাপলা।
এরপর একথা সেকথায় বয়ে গেল সময়। বাড়ি আসার পর সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো
ঘটনাটা। এক সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করলাম। যদি আরো কিছু তথ্য জানা যায় এই আশায়।
কিন্তু লোকটার নাম আর আধা সরকারী ব্যাঙ্কটার নাম ছাড়া আর কিছু বেশি জানা গেল না বুদ্ধুদার বলা
তথ্যর বাইরে।
দুদিন কেটে গেল মাথা থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না বিষয়টা। শেষে খাতা
কলম নিয়ে বসেই পড়লাম। যুক্তি বাস্তবের যেখানে শেষ সেখানেই তো কল্পলোকের জন্ম।
*****
আদর্শ সৎ কর্মচারী বলতে লোকেরা ভবানীপ্রসাদ রায় এর নাম করে। গত বারো বছরে
নিজের দায়িত্ব একনিষ্ঠ ভাবে পালন করে চলেছে। ম্যানেজার খুব প্রশংসা করেন ওর। করবেন
নাই বা কেন? আজ পর্যন্ত এক পয়সার গণ্ডগোল হয়নি খাতা পত্রের হিসাবে। যদিও কাজটা খুব
লোভসৃষ্টকারী। সরাসরি ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ কিস্তি পরিশোধের টাকা আদায় করে
আনা। কোন কোন দিন টাকার অঙ্কটা ৭০-৮০ হাজারে হয়ে যায়।
বেশ চলছিল কাজকর্ম। হঠাৎই ভবানী প্রসাদ খবর পেল লাখ চারেক টাকা আদায় হবে। আর
তার জন্য ওকে যেতে হবে পাশের জেলা শহরে। এতদিনের বিশ্বস্ত কর্মচারীর মানসিকতা
পথভ্রষ্ট হল। এজন্যই বোধ হয় বলে মন না মতিভ্রম। অবশ্য এরকম কোন বড় সুযোগের
অপেক্ষাতেই ছিল কিনা ভবানী রায় সেটা ওপরওয়ালাই জানেন। অনেক হিসেব নিকেষ করে এক
প্ল্যান কষলো টাকাটা হাতানোর। এমতাবস্থায় ভবানী রায়ের সামাজিক অবস্থানটা একটু দেখে
নেওয়া যাক। ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনায় বাবা মা একসাথে মারা যান। ভাইবোন ছিল না। কাকার
কাছে লাথিঝ্যাঁটা খেয়ে মানুষ। নিজ অধ্যাবসায়ে এই কাজটা জুটিয়েই সে পাট চুকিয়ে
ভবানী চলে আসে এই প্রান্তিক শহরটায়। ব্যাঙ্কের কয়েকজন মানুষ, দুধ ওয়ালা, কাজের
মাসি আর পাড়ার চায়ের দোকানদার ছাড়া আর কারো সাথে তেমন মেলা মেশা করতো না। অবশ্য
কাজের চাপে সময় ও পেত না। সাধাসিধা জীবন যাপনে ছিল না কোন উচ্চাশার ছোঁয়া।
ম্যানেজারের কাছ থেকে কাজটার বিস্তৃত হাল হকিকত জেনে নিয়ে পাঁচদিনের ছুটির আবেদন করলো ভবানী।সাথেই জানালো
একেবারে টাকাটা নিয়ে এসেই পুনরায় জয়েন
করবে। ১২ বছরের চাকরী জীবনে প্রথম ছুটির আবেদন। মঞ্জুর হতে বেশি সময় লাগলো না।
ছুটির প্রথমদিনটা বাড়িতেই কাটালো ভবানীপ্রসাদ। প্ল্যানটা বারবার খতিয়ে দেখলো।
দ্বিতীয় দিন সকালে গেল জেলা শহরটায়। খূঁজে বার করলো এমন একটা লফার্ম যারা ওর মতই
বিশ্বস্ততা আর গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করে। রাতটা ওখানকারই একটা হোটেলে কাটিয়ে
ফিরে এলো নিজের চাকুরিস্থলে। অফিসে গেল । জানালো ওর কাজ মিটে গেছে। শুধু শুধু কাজে
ফাঁকি দিয়ে কি হবে। কাজকে ভালোবাসার আরও একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো ভবানী প্রসাদ
রায়।
এলো আদায় করতে যাওয়ার
দিন। ম্যানেজার জানালেন আদায় শেষে ওই দিন শেষ বাস ধরেই ফিরে আসতে পারবে ভবানী।
ওখানে কার্যত সেটা হলনা। ভাগ্যর সহায়তায় টাকাটা হাতে পেতে পেতে পেরিয়ে গেল শেষ
বাস ছাড়ার সময়।ফলে একটা মিথ্যে কম বলতে হল ওকে। পে বুথ থেকে ফোন করে জানিয়ে দিল
কারণটা না ফিরতে পারার।
রাতে ভবানী গেল সেই ল ফার্মটায়। দেখা করলো আসল মালিকের সাথে।
-বলুন কি প্রয়োজন আপনার?
ভবানী ইতিমধ্যে আগের দিনের হোটেলটায় আবার ঘর ভাড়া নিয়েছে। এখানে আসার আগে
ওখানে গিয়ে একটি বিশেষ প্যাকেট বানিয়ে মধ্যে টাকাটা ঢুকিয়ে গালা সিল করে নিয়ে
এসেছে। সেই প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রেখে বললো – এটা অনির্দিষ্ট কালের জন্য আপনার
ফার্মে গচ্ছিত রাখতে চাই।
-অনির্দিষ্ট কাল মানে!?
-মানে, আমি একটা বিশেষ কাজের জন্য বাইরে যাচ্ছি। কবে ফিরবো সেটা ঠিক জানা নেই।
এই প্যাকেটের জিনিষটা সাথে নিয়ে ঘোরাটা আমার পক্ষে বিপজ্জনক। আর আমার সে রকম কোন
আত্মীয়স্বজন নেই যার কাছে এটা রেখে যেতে পারি।
-বুঝলাম। কিন্তু এরকম কাজের ফিজ তো বেশ মোটা রকম।
- সে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনার ফিজের কয়েক গুন দামী জিনিষ ওতে আছে।
- ঠিক আছে। কোন চিন্তা করবেন না। বলুন কি নামে রিসিপ্ট দেব।
রিসিপ্ট! ভবানী ভাবলো রিসিপ্ট নিয়ে কোথায় রাখবো? কাছে তো রাখাই
যাবে না।আর কোন জায়গাও নেই ওর।
আইন জীবি মানুষটি আবারো বললেন – বলুন কি নাম লিখবো রিসিপ্টে?
- দেখুন এরকম কি করা যায় যে রিসিপ্টটাও আপনার কাছেই থাকবে।
- সে আবার কি কথা?
- আপনি আমায় একটা কোড
নম্বর বলুন। আমি ফিরে এসে ওটা বলবো এবং আমার নামটাও তবেই আপনি আমায় প্যাকেট ফিরিয়ে
দেবেন। সঠিক নাম ও নম্বর না বললে কেও ওটা নিতে পারবে না। এর জন্য যা এক্সট্রা
লাগবে আমি দেব।
- হুম ... ওকে...কিন্তু...
- কোন কিন্তু নয়। রিস্ক ফ্যাক্টর যা থাকছে তা তো আমার দিক
থেকে। আপনার তো কোন চিন্তা নেই। শুধু সুরক্ষিত ভাবে এটাকে রাখা ছাড়া। আশা করি
এটুকু বিশ্বাস বা ভরসা আপনার ফার্ম কে করাই যায়।
ল ফার্মের
মালিক একটু ভাবলেন তারপর বললেন – ওকে আপনার যা ইচ্ছে তাই হোক তা আপনার নামটাতো
বলবেন এবার?
- পুন্ডরীকাক্ষ পতিতুন্ড... নির্বিকার কণ্ঠে বললো ভবানী
প্রসাদ রায়।
- আপনার জন্ম তারিখ বলুন ওটাই হবে আপনার কোড নম্বর।
*****
আরো আধ ঘণ্টা
বাদে ভবানী প্রসাদকে দেখা গেল হোটেলের বিছানায় শায়িত অবস্থায়। ওর পরিকল্পনার প্রথম
পর্ব নির্বিঘ্নেই মিটেছে।
আগামী পরশু বিকেলে শুরু হবে
দ্বিতীয় পর্ব। অফিসে গিয়ে সব কথা খুলে বলা। যার একটাই পরি নতি অফিস দ্বারা পুলিসের
হাতে সমর্পণ। আদালতের রায়ে বেশ কয়েক বছর কারাবাস। তার পর মুক্তি এবং নতুন নামে ......
পরবর্তী দিনে নির্দিষ্ট সময়
পেরিয়ে যেতেই কপালে ভাঁজ পড়লো ম্যানেজারের। জেলা শহরে ঋণ গ্রহীতার কে ফোন করলেন।
জানা গেল ভবানী প্রসাদের কথামতই গতকাল পেমেন্ট হয়েছে এবং দিতে বেশ দেরীই হয়েছিল।
কপালের ভাঁজ পুরো কমলো না ম্যানেজার বাবুর। তবুও গত ১২ বছরের কথা ভেবে আরও খানিকটা
সময় অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন উনি।
সে সময়ও চলে গেল। ব্যাঙ্ক পরিচালন
কমি টিকে বলতে বাধ্য হলেন ঘটনাটা। ওরা পুলিসে খবর দিলেন। ভবানীপ্রসাদের জানানো
হোটেলটিতে খোঁজ নেওয়া হল। জানা গেল সকালেই চেকআউট করেছে ভবানী।
প্ল্যান মাফিক বিকেলে ছুটির
কিছু আগে ব্যাঙ্কে এলো ভবানী। চুল উসকো খুসকো। মুখ চোখ শুকিয়ে গেছে। ওকে দেখেই
গুজুর গুজুর শুরু হল । সে সবে কান না দিয়ে ভবানী সোজা গিয়ে ঢুকলো ম্যানেজারের ঘরে।
বেশী হইচই না হওয়ার এটাই সবচেয়ে ভালো পথ ও জানে। ওকে দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে
পড়ায় চেঁচিয়ে উঠলেন – ওফঃ ভবানী! তুমি তো আমায় মেরেই ফেলেছিলে হে। তা কি ব্যাপার
এতো দেরী?
অন্য কেও হলে কি গল্প শোনাতো কে
জানে। ভবানী কিন্তু সত্যি কথাই বলল ওর প্ল্যান অনুসারে। একটু মিশেল দিয়ে।
- স্যার লোভ সামলাতে না পেরে টাকাটা নিয়ে আমিই ট্রেনে চেপে
বিহার পালাচ্ছিলাম। কিন্তু চিরকালই আমার ভাগ্য খারাপ। ট্রেনে যেতে যেতে একটি লোকের
সাথে পরিচয় হয়। সে চায়ের সাথে কি মিশিয়ে যে খাইয়ে দিয়েছিল জানিনা। মরন ঘুমে
পেয়েছিল আমায়। ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন জামা কাপড়টা ছাড়া আর কিছুই সাথে ছিল না। আমার
আর কিছুই বলার নেই। এবার আপনার যা বিবেচনা...
হতভম্ব স্তম্ভিত ম্যানেজার
যন্ত্রের মতো হাত বাড়ালেন টেলিফোনের দিকে। পুলিস এলো। গ্রেপ্তার করলো ভবানীপ্রসাদকে।
হাজার জেরাতেও ভবানী তার রচনা করা গল্প থেকে এক পা নড়ল না। আদালত ব্যাঙ্কের তরফে
বলা গত ১২ বছরের কলঙ্ক হীন রেকর্ড শুনে ওকে ৭ বছরের বদলে ৫ বছরের জন্য কারাদন্ডে
দণ্ন্ডিত করলো। হয়তো আপীল করলে রায় ভবানীর পক্ষে যেত।কারন কোন শক্তপোক্ত প্রমান ওকে
দোষী সাব্যস্ত করার জন্য ছিলনা।কিন্তু ও সেটা করলো না। সরকারী উকিলের সহায়তাও ও নিতে রাজী হয়নি ।
জেল খানাতেও আদর্শ কয়েদীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো
ভবানী প্রসাদ। কোন রকম ঝুটঝামেলা না করে কেবলমাত্র শরীরটার যত্ন নিয়ে সময় কাটাতে
থাকলো। বড়
দাঁও মারার জন্য ও মনেমনে এই কারাবাসটাকে তার মাসুল রুপেই মেনে নিয়েছিল। সাথেই ছকে
নিয়েছিল ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। এখান থেকে মুক্তি পেয়ে দূরের কোন শহরে গিয়ে সঠিক অর্থেই ভালো মানুষ রুপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত
করবে। গচ্ছিত টাকার বেশ খানিকটা ব্যয় করবে নাম কামানোর জন্য। আর বাকি টাকা ঠিকঠাক
লগ্নি করার হাজার উপায় সে জানে ব্যাঙ্কে কাজ করার সূত্রেই। ফলে বাকি জীবনটা পায়ের
ওপর পা তুলেই কাটবে। চাকরি করে সারা জীবনেও ও সেটা কোন দিনই করতে পারতো না।
কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা কি সব
সময় হয়? ধর্মের কলটা কোন এক অজানা বাতাসে ঠিক নড়ে যায়।
মুক্তি পেল ভবানী প্রসাদ রায়।
গত পাঁচ বছরের মেহনতে শরীর হয়েছে সুগঠিত। সযত্নে দাড়ি গোঁফ রেখে বদলে ফেলেছে মুখের
ভোল। চুল এখন আঁচড়ায় ব্যাকব্রাশ করে। সেটাও আবার কাঁধ ছোঁয়া। চট করে দেখলে চেনা
মুশকিল ৫ বছর আগের ভবানীকে। ছাড়া পেয়েই কিন্তু ও সেই আইন জীবীর কাছে ছুটলো না। বলা
যায় না পুলিসের নজর থাকতেই পারে ওর গতিবিধির ওপর। ৪ লক্ষ টাকা বলে কথা। কারাবাসে
এতদিন কাজ করে যে পারিশ্রমিক পেয়েছিল সে অর্থে একটা অতি সস্তার হোটেলে একটা মাস
কাটিয়ে দিল ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখতে দেখতে।
মাসখানেক পর...
পাঁচ বছরে ল- ফার্মটার প সার
বেড়েছে। বদলেছে অফিসের ঠিকানা। সাথে সাথেই হয়েছে আরও একটা বদল। যার কাছে ভবানী ওর
প্যাকেট গচ্ছিত রেখেছিল সেই মানুষটি মারা গেছেন।এখন অফিসের দায়িত্বে ওনার মেজ
ছেলে। ঠিকানা খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগলো না ভবানীর। বাসে আসতে আসতে ভাবছিল ওকে
চিনতে পারবে তো সেই আইনজীবী ভদ্রলোক। এখন মালিকানা বদল হয়েছে জেনে বেশ খানিকটা উৎকণ্ঠা
ওকে গ্রাস করলো।
স্লিপ পাঠানোর পর আধঘণ্টা বসে
থেকে তবে ডাক পেল ভবানী।
- বসুন। বলুন কি দরকার?
- আর একজন ভদ্রলোক ...মানে আমি যখন ৫ বছর আগে...
- হ্যাঁ, উনি আমার বাবা। তিনবছর আগে ... আপনি নিশ্চিন্তে
আপনার কথা বলতে পারেন।
সব কথা
খুলে বললো ভবানী। উত্তরও পেল সদর্থক।
-আরে
আপনই সেই মানুষ!! বাবা আমাকে বলেছিলেন আপনার কথা সেই দিনই যে দিন আপনি ওটা রেখে
যান। যাক এতদিনে তাহলে সময় হল আপনার।
বিদলিত
একটা হাসি উপহার দিল ভবানী। সাথে সাথেই গোটা শরীরটা রোমাঞ্চিত হল ওর। প্ল্যান
সাকসেসফুল। আর কিছুক্ষন বাদেই আমি হয়ে যাবো চার লাখ টাকার মালিক।
- এবার তাহলে আমার জিনিষটা ফিরিয়ে দিন।
- অবশ্যই। সেটাই তো আমাদের কাজ। কিন্তু তার আগে আপনাকে প্রমান
দিতে হবে যে আপনিই সেই মানুষটা।
- মানে?
- বাবা বলেছিলেন আপনি আপনার নাম আর একটা নম্বর বল বেন । যদি
সেটা মেলে তবেই আমি ওটা আপনাকে দেব। একটু বসুন আমি রেজিস্টারটা নিয়ে আসি......
হ্যাঁ নম্বরটা
বলুন আগে।
- জন্ম তারিখটা বললো ভবানী।
- হুম, একদম ঠিক। এবারে আপনার নাম?
অভ্যাস মতো
ভবানী উত্তর দিল – ভবানীপ্রসাদ রায়।
- এখানে এরকম কোনও নামতো লেখা নেই। ... চশমার ওপর দিয়ে ভুরু
কুঁচকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন আইনজীবী।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ভবানীর।
তাইতো ... এনাম তো বলেনি সেসময়। নামটা... কি যেন?... গত পাঁচ বছর এক মাস ধরে অন্যসব
কিছু নিয়ে চিন্তা করলেও নামটা নিয়ে একবারো মাথা ঘামায়নি ও। মনের পাতা থেকে কোথায়
যেন হারিয়ে গেছে সেদিনের বলা সেই নামটা, বিজ্ঞানের সুত্র মেনেই।
- আই অ্যাম সরি মিঃ...
- হৃদপিণ্ড সজোরে লাফিয়ে উঠলো ভবানীর। ঝিম ঝিম করে উঠলো
মাথাটা। শরীরটা যেন কেমন অবশ হয়ে আসছে। বিড় বিড় করে বললো – নামটা হল... নামটা...
- আই থিঙ্ক ইউ ক্যন
লিভ নাও মিঃ ফ্রড। না হলে পুলিস ডাকতে বাধ্য হবো।
পুলিশ শব্দটা
ভবানীর অবশতা কাটিয়ে দিল এক নিমেষে। জীবনের ৫টা বছর ও বলি দিয়েছে যার জন্য সেটা
এখন ওর এতো কাছে অথচ একটা নামের জন্য সেটাই ওর ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মাতালের মতো
পদক্ষেপে অফিসটা থেকে বেরিয়ে এলো ও। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন ... নামটা
কি?
উদভ্রান্তের
মতো হাঁটতে হাঁটতে, একে তাকে ধাক্কা মেরে, পথচলতি যানবাহনের ধাক্কা থেকে কোন ক্রমে
বেঁচে, অজস্র গালি গালাজ গিলে[ যা অবশ্য ঐ মুহূর্তে ওর মাথাতেও ঢুকছিল কিনা
সন্দেহ] এক সময় ও পৌঁছে গেল শহরটির এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির ধারে।
সান্ধ্যকালীন বাতাসে কিছুটা স্বস্তি পেল ওর শরীর মন। চিন্তাটা যদিও তালবাদ্য
বাজিয়ে চলেছে ওর মস্তিষ্কে।
আশে পাশে
মানুষ নেই কোন। ভবানী ভাবলো, মুখে চোখে জল দিলে একটু শান্ত হবে মনটা। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলেই মনে পড়ে যাবে নামটা।
এগিয়ে গেল
জলের দিকে। পাড়ে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে জলের দিকে হাত বাড়ালো। সাথে সাথে একটা শিহরন জাগানো
ভাবনা ওকে কাঁপিয়ে দিল ... যদি আর কখনই মনে না পড়ে নামটা, তাহলে? গোটা শরীরটা আবার
অবশ হয়ে এলো ভবানীর। বুঝতে পারলো ওর পা নিয়ন্ত্রন হারাচ্ছে ওর শরীরের ভারবহনের।
ঝপ করে একটা
শব্দ হল। হাঁচড় পাঁচড় করে জলের ভেতর থেকে মাথা তুললো ভবানী। কিন্তু জুতো পড়া পায়ে
নদীর তলার জমিতে দাঁড়ানোর সুযোগটা পেলনা অবসন্ন শ রীরটা। ঠিক মতো টাল সামলানোর
আগেই আবার ডুবে গেল ও। একরাশ কাদাজল ঢুকে
গেল ওর নাকেমুখে। অদম্য শক্তিতে চেষ্টা করলো নিজেকে ভাসিয়ে তোলার। সাঁতার না জানা
থাকায় যেটা সম্ভব হল না। আর এই টানাপোড়েনে ৫ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক কুঠরির দরজাটা খুলে গেল। নামটা মনে
পড়লো ভবানীর। পু ন্ড রী কা ক্ষ প তি তু
ন্ড। সর্ব শক্তি দিয়ে ও বলার চেষ্টা করলো “মিঃ লইয়ার, আমার মনে পড়েছে নামটা...সেটা
হল...”
এরফলে আরও
কিছুটা জল ঢুকে গেল ওর নাক মুখ দিয়ে।
চোরা স্রোতের
টান নাকি নিয়তির অলঙ্ঘনীয় নিয়ম কে জানে , শরীর আর সাথ দিল না ভবানীর। চরম শান্তি
দিতে চিরকালীন ঘুমের কাজল মাখানোর জন্য কলকল ছলছল করে বয়ে যাওয়া নদী তার নিজের কোলে
টেনে নিল একটি অতৃপ্ত জীবন কে।
সমাপ্ত।
নাম
No comments:
Post a Comment