Search This Blog

Thursday, June 29, 2017

নেই...... তবু ছিল - প্রতিম দাস[অশরীরী কাহিনী]

নেই...... তবু ছিল
প্রতিম দাস
[ধন্যবাদ অ্যালিবাই পত্রিকা সম্পাদক ও টিম... ছবি-অ্যালিবাই পত্রিকা]


নেই...... তবু ছিল
প্রতিম দাস

চাপা আওয়াজটার কারনেই ক্যাম্বারটন বুঝতে পারলো ওকে কোন টেলিফোনের রিসিভারটা ওঠাতে হবে। তবুও   মনে দোনোমোনো ভাব। এরকম সময়ে এই গোপন লাইনটায় কে ফোন করতে পারে ?
আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মাত্র ছজন মক্কেল জানে এই নাম্বারটা। যার মধ্যে দুজন একটু আগেই এখান থেকে বিদায় নিয়েছে । দুজন এখন ইউরোপে আর একজন জেলে। ষষ্ঠ জন, বারকে হটিন । কিন্তু সে তো মারা গেছে ।
চাপা আওয়াজে আবার বেজে উঠলো টেলিফোনটা। মাংসল হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা উঠালো ক্যাম্বারটন। কোনও সাড়া নেই ও প্রান্ত থেকে । ক্যাম্বারটন নিজে কখনো এই নাম্বারে আগে কথা বলে না। যারা এই নাম্বার জানে তারা একটা সঙ্কেত শব্দও জানে । যেটা শুনতে পেলে তবেই ক্যাম্বারটন কথা বলে।
শোনা গেল শব্দটা – ‘রেফারেন্স রুমকন্ঠস্বর অচেনা, একটু কাঁপাকাঁপা ধরনের।
গোল ময়দার তালের মতো ভাবলেশহীন মুখোসের মত মুখ আর সন্দেহের চাপে পুঁতির মতো ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখে ক্যাম্বারটন কর্কশ স্বরে বললো, ‘কে আপনি?’
‘হটিনের একজন বন্ধু,’ অচেনাস্বর ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ওই আমাকে নাম্বারটা দিয়েছে। বলেছে ফোন করতে যদি... যদি আমি কোন সমস্যায় পড়ি তাহলে ।’
‘আপনার নাম?’
‘স্মিথ। জন স্মি –‘
‘খুবই অচেনা নাম,’ ক্যাম্বারটন অবজ্ঞার স্বরে বললো , ‘আমি আগে কোন দিন শুনিনি । আপনাকে চিনি বলেওতো মনে হচ্ছে না ।’
‘অত চিন্তার কিছু নেই। আপনি আমাকে দেখলেই চিনতে পারবেন।’
‘আপনার সাথে দেখা করবোই বা কেন?’
‘কারন আপনার কাছ থেকে আইনানুগ সাহায্য নেওয়ার জন্য আমি প্রচুর অর্থ দিতে রাজি আছি । আপনি এখন একা আছেন তো?’
‘হ্যাঁ তা আছি,’ ক্যাম্বারটনের উত্তর দেওয়ার ভঙ্গীতে পাত্তা না দেওয়ার ছোঁয়া থাকলেও কুতকুতে চোখ দুটোতে লোভের আগুন জ্বলজ্বল করে উঠলো ।
‘আপনি জানে আমার এখানে কিভাবে আসতে হবে?’
‘আমি আপনার বিষয়ে সব কিছুই জানি যা হটিন জানতো। আমি পিছনের দরজা দিয়েই আসবো – যেমন – ঠিক যেমন ও যেতো আপনার কাছে প্রত্যেকবার। আমি দশ মিনিটের মধ্যেই আসছি আপনার কাছে।’

হোরেস এল ক্যাম্বারটন, অন্য মানুষরা যে চোখেই ওকে দেখুক না কেন একজন ক্রিমিন্যাল লইয়ার, রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো । চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আবার তাকালো খবরের কাগজের সেই লেখাটার দিকে যেটা ও পড়ছিল ফোনটা আসার আগে। খবর অনুযায়ী, আজ সকালে চিকাগোর দক্ষিন পশ্চিম শহরতলী উইলো রিজের ফার্স্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাঙ্কে ডাকাতি করতে গিয়ে বারকে হটিন আর তার দুই সহযোগী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। হটিনের মৃতদেহ পুলিস শনাক্ত করেছে । বাকি দুজন নেহাত ছুটকো অপরাধী। নাম এখনো জানা যায় নি।
ক্যাম্বারটনের দুঃখ হচ্ছিল খবরটা পড়ে, কারন ওর রোজগার একটু কমে গেল। হটিন পয়সাকড়ির ব্যাপারে একেবারে মুক্ত হস্ত মক্কেল ছিল । অবশ্য গত বছরে একদিনের জন্যেও ওর কাছে কোন পরামর্শ নিতে আসেনিতবে আসতেই হতো দুদিন আগে বা পরে যদি গুলিতে খতম না হয়ে যেত।
ক্রিমিন্যাল লইয়ার ভাবছিলো যে লোকটা  ফোন করেছিল সে হয়তো হটিনের ফাঁকা স্থানটা পূর্ণ করতে পারবে। অবশ্য এতোটা নিশ্চিত হওয়াও ঠিক না। তার চেয়ে যে আসছে তারজন্য সব রকম ভাবে তৈরী থাকাই ভালো।
লাইব্রেরীর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা গুলি ভর্তি রিভলবার ঢুকিয়ে নিলো কোটের ডানদিকের পকেটে। এবার গেল শোবার ঘরে এবং গুপ্ত আলমারীর টপ ড্রয়ারটা খুলে একটা গুলিভরা পিস্তল নিয়ে রেখে দিল বাঁ পকেটে।
তারপর ধীরে সুস্থে ফিরে এলো ক্লার্ক স্ট্রীটের পূর্ব দিকে ডাইভারসী পার্কওয়ের বহুতল বিশিষ্ট মালিকানা ভিত্তিক অ্যাভন আর্মস হোটেলের ঘরে। এই জায়গাটা যত গুন্ডা, ঠকবাজ, জালিয়াত এবং আড়ম্বরওয়ালা বদমাইসদের বাসা । যেখানে প্রায় সব সময়েই চলছে একে অপরকে ঠকানোর পালা  তবু এই পরিবেশেই নিজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ক্যাম্বারটন। এই মুহূর্তে ওর মনে একটা উৎকণ্ঠার ঝড়।  নিশাকালে আগত কোন এক অচেনা আগন্তুকের অপেক্ষায় এবং আগামী সমস্যার আশঙ্কায় এতটা উতলা ও আগে কখনো বোধ করেনি।
ডাক শুনে অতিথির একেবারে কাছে গিয়ে দরজা খুলবে না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যাম্বারটন দরজার ছিটকিনি খুলে ভেজিয়ে রেখে দিল। ফিরে এসে দরজার দিকে মুখ করে বসলো একটা এমন চেয়ারে যেটার পেছনটায় হেলান দিলে কাত হয়ে যায় না। দু হাত দুপকেটে আগ্নেয়াস্ত্রর ওপর।
“এবারে,” ক্যাম্বারটন ভাবলো, “যদি তোমার হালচাল আমার ভালো না লাগে মিঃ স্মিথ, অথবা তুমি যেই হও না কেন আর যাই হও না কেন, ওইখান থেকেই ফিরে যেতে বাধ্য করবো । আমার ওপর আঘাতের কোন সুযোগই তোমায় দেবো না।”

প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো একটা টোকা পড়লো দরজায়। যার জবাবে বোমা ফাটার মতো চেঁচিয়ে উঠলো ক্যাম্বারটন।
‘কাম ইন!’
নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা। পেশিবহুল চেহারা চওড়া কাঁধ, গায়ে জ্যাকেট একটি মানুষ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। ডান হাতটা পকেটে ঢোকানো। যা মনে হচ্ছে তাতে লোকটিও একটা আগ্নেয়াস্ত্র ধরে আছে ওখানে। অন্য হাতে কপালের ওপর থেকে টুপির কানাতটা  ওঠালো।
ক্যাম্বারটন বলে উঠলো, ‘ডারন্যাক!’ এই মানুষের নাম ভুল হওয়ার কোনো কারনই নেই। প্রায় প্রত্যেক দিনের কাগজে এর ছবি প্রকাশিত হয়। অ্যান্টন( টনি) ডারন্যাক। আমেরিকার এক নাম্বারের গনশত্রু।
‘ও! আপনি তাহলে আমায় চেনেন দেখছি,’ ঘোঁতঘোঁতে স্বরে বললো আগ ন্তুক। কথা বলার সময় চোয়াল নড়লো বেশ ভালো ভাবেই। ‘তাহলে তো এটাও জানেন আমার ধরতে পারলে ২৫ হাজার ডলার পুরষ্কার পাওয়া যাবে । কিন্তু –’ পকেটে স্থিত হাতটা নড়ে উঠলো। ‘ সেটা পাওয়ার ভাবনা মাথাতেও আনবেন না। বদলে আমি আপনাকে ওর দ্বিগুন – অবশ্য যদি আমার হয়ে কাজ করেন।’
থলথলে লোভী মুখটা চকচক করে ঊঠলো ক্যাম্বারটনের, যেটা আসলে ওর মানসিকতা অনুসারে আন্তরিক হাসির প্রকাশ। ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আসুন তাহলে, আমরা বন্ধুত্বে পথে হাঁটা শুরু করি।’
ডারন্যাক ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা এনে আইনজীবীর হাতটাকে নিজের থাবার মতো হাতে চেপে ধরলো। ‘ওকে। বেশ তাই হোক। আজ থেকে তুমিই আমার মুখপত্র । আর আমি মনে করি এবং চাই যে সে কাজটা তুমি ভালো মানুষের মতোই করবে।’
‘আমার মনে হয় আপাতত একপাত্র দরকার তোমার ।’
মুখোমুখী বসলো দুজনে। শুরু হলো কথোপকথন বা এটাই বলা ভালো যে একটানা কথা বলে চললো ডারন্যাক আর শ্রোতার ভূমিকায় ক্যাম্বারটন। সাথেই একের পর এক পাত্র পূর্ণ করে এগিয়ে দিতে থাকলো অতিথিকে। ক্যাম্বারটন এই পদ্ধতিটায় অভ্যস্ত। এ এক এমন পদ্ধতি যার সাহায্যে নিজের গোপন টেলিফোনের মক্কেলদের অনেক গোপন কথা ও সহজেই জানতে পারে।
পালিয়ে বেড়ানো ডারন্যাক ঊকিলের কাছে নিজের সব সমস্যার কথা এক এক করে খুলে বললো। যাকে আর পাঁচজন জানে এক নিষ্ঠুর মানুষ রুপে সে নিজেই এখন যথেষ্ট আতঙ্কিত। মনের শান্তি নষ্ট করার মতো কাজ করে করে সে কুখ্যাতি অর্জন করেছে । যে বন্দুকের জোরে সে দিন যাপন করে এখন সেরকমই কোনো বন্দুকের গুলিতে নিজের মৃত্যু হবে এই ভয়ে সে ভীত। সব মানুষের হাত এখন ওর দিকে উঠে আছে।
আরো এক পাত্র এক চুমুকে গলাধঃকরন করে বললো, ‘মিনেয়াপোলিসে হটিনের সাথে ছয় মাস আগে আমার দেখা হয়। ও আমার গ্যাং এ যোগ দেয় । আমরা একসাথে অনেক গুলো কাজ করি। শেষ কাজ সেন্ট লুইসে মাইনের টাকা ছিনতাই । কাজটা ঠিকঠাক করতে পারিনি আমরা। আমার তিনটে লোক খতম হয় ওটা করতে গিয়ে।‘
‘আমার মনে পড়েছে, আমি পড়েছিলাম ওটার ব্যপারে,’ ক্যাম্বারটন জানায়। ‘কিন্তু জানতাম না ওটার সাথে হটিন জড়িত ছিল – বা তুমি।’
‘কেউই জানতো না। হটিন এবং আর দুজন আজ সকালেই খতম হয়েছে।’ ঠোঁট চেটে ডাকাত সর্দার বল লো । ‘আমিও লটকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ভাগ্য সাথে ছিল। এটা একটা দারুন সু্যোগ আমার কাছে । যা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। এক লক্ষ ডলার সটকাতে পেরেছিলামযার কিছুটা অবশ্য হটিনের প্রাপ্য ছিল। কিন্তু সেতো এখন মৃত। বাকিদের মধ্যে যারা মরেনি সব জেলে ঢুকে গেছেফলে কারোর সাথেই ভাগাভাগি করার দরকার নেই। এটা শুধু তুমি জানলে। এখন বলো, কত নেবে এদেশ থেকে আমাকে পালানোর ব্যবস্থা করে দিতে?’
ক্যাম্বারটন শুকরের মতো কুতকুতে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো আগন্তুকের দিকে । অপহৃত অর্থের ওই বিশাল পরিমাণ কি সত্যিই ওই গরিলাসদৃশ বর্বরটার কাছে আছে? ওকি আমাকে তার থেকে অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ দেবে নিজের চামড়া বাঁচাতে? ওর উকিলি বুদ্ধি বলছে এ দুটো প্রশ্নের উত্তরই ইতিবাচক হবে।
‘হুম, খুবই কঠিন কাজ,’ বললো ক্যাম্বারটন। ‘যে মহিলাকে তুমি ঠকিয়েছিলে সেই মহিলা তোমার ছবি পুলিসকে দিয়ে দিয়েছে।  আর সেটা ছাপিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে তুমি এখন বেব রুথের মতোই জনপ্রিয়। তোমার হাল হকিকত সব পুলিস দপ্তরে, সব গোয়েন্দা দপ্তরে এমন কি পোস্ট অফিসগুলোতেও পাঠানো হয়েছে।’
‘একেবারে ঠিক বলেছো তুমিএখন অবস্থা এরকম যে  কেউ মোটামুটি আমার মতো দেখতে হলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে । পালানোর চেষ্টা করলেই গুলি ।’ ডারন্যাক চেঁচিয়ে উঠলো , ‘এরকম অবস্থায় আমি কি করবো বলতে পারো?’
ক্যাম্বারটন মক্কেলকে ভালো করে দেখে নিয়ে বললো, ‘সে পথ একটা আছে , দারুন রকমের। কিন্তু করা বেশ কঠিন এবং ব্যয়বহুল। শুরুতেই বেশ ভালো খরচা আছে । সবার আগে আমাকে একজন ভালো প্লাস্টিক সার্জারি করতে পারে এমন একজনকে ভাড়া করতে হবে। যে তোমার জনপ্রিয় মুখটাকে বদলে দেবে । তারপর সব পথ পরিষ্কার করার জন্য খুঁজতে হবে কিছু সাহায্যকারী, তারপর আরো আছে –’
‘থামো দেখি, অনেক বকবক করেছ,’ ডারন্যাক কথার মাঝে বলে উঠলো, ‘তুমি যদি আমার খরচা করার ক্ষমতা কতটা এই নিয়ে ভেবে থাকো তাহলে এটা ধরো। এতে পঁচিশ হাজার আছে।’ কোটের বুক পকেট থেকে একটা সবুজ প্যাকেট বার করে ছুঁড়ে দিলো ক্যাম্বারটনের দিকে। ‘আর এটাও জেনে রাখো এটা যেখান থেকে এনেছি সেখানে আর লক্ষাধিক ডলার রাখা আছে। এখান থেকে কয়েকটা ব্লক পরেই আইডিয়াল শ্যু রিপেয়ার শপ । তারই মেঝের তলায় সযত্নে রাখা আছে ওগুলো।’  একটা হেঁচকি তুলে আর একপাত্র হুইস্কি গলায় ঢেলে বললো, ‘ঠিকই ধরেছো, আমিই আইডিয়াল শ্যু রিপেয়ার শপের মালিক। ওই বুড়ো মুচি আসলে মালিক নয়। কোনো লোক  এটা জানে না যে ও আসলে আমার হয়ে কাজ করে। একসময় সংশোধনাগারে ছিল, ওখানেই জুতো সারানো শিখেছিল।’
‘ও জানে ওখানে টাকাটা আছে?’
‘হাঃ হাঃ হাঃ! মোটেই না। বুড়ো ফ্রেড মিলার এতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানার অধিকারী নয়। ও শুধু জানে আমি এই দোকানটা আমার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে গোপন আলোচনার জন্য ব্যবহার করি। আর সে সময় ওর হাতে আমি কিছু আলগা ডলার গুঁজে দিই পানশালায় যাওয়ার জন্য। বাকি সময়টা ও ওখানে শুয়ে বসে কাটায়। আজ রাতের জন্যেও ওকে কিছু দিয়ে দিয়েছিভেবেছিলাম তোমার আমার মধ্যে আলোচনাটা ওখানে বসেই করবো ।’
ক্রিমিন্যাল লইয়ারের লোভী চোখ দুটো ক্ষনিকের জন্য ঝলসে উঠলো ডারন্যাকের ডলার গুলোর কথা ভেবে। ওর মনে ভাবনার গতি বাড়লো। এই কাজটা করার ঝুঁকি নিতে কত ডলার খরচ হবে? যদি ধরা পড়ে জেলে যেতে হয় এ মক্কেলকে আমেরিকার বাইরে পাচার করতে গিয়ে ? চিন্তার ভারে ময়দার তাল সদৃশ মুখে বেশ কিছু ভাঁজ পড়লো।
সহসাই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা সমাধান সূত্র পেয়ে গেল ক্যাম্বারটন। শয়তানের দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ডারন্যাকের দিকে। সে দৃষ্টি বুঝতে পেরে হতভম্বের মতো চাইলো পালিয়ে বেড়ানো অপরাধী। চেষ্টা করলো আগ্নেয়াস্ত্রটা বার করারকিন্তু ওকে চমকে দিয়ে মোটা থলথলে চেহারার আইনজীবী তড়িৎ গতিতে পিস্তল বার করে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে গুলি করলো। চেয়ার থেকে ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল জনপ্রিয় কুখ্যাত অপরাধী । একেবারে কপালে ঢুকে গেছে গুলিটা।
নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বারুদ পোড়া গন্ধ নাকে টেনে ক্যাম্বারটন তাকালো শিকারের প্রানহীন দেহটার দিকে, যে হাতে ধরে আছে একটা রিভলবার । ওইটাই ওর আত্মরক্ষার গল্পটাকে সাজাতে সাহায্য করবে। এবার উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে । তারপর সবার আগে দেওয়াল আলমারীর লকারে ঢুকিয়ে রাখলো সবুজ প্যাকেটটা । খুলে রেখে দিলো দরজাটা । হুইস্কির বোতল আর গ্লাস দুটো সরিয়ে ফেললো ওখান থেকে। এবার হোটেলের অফিসের সাথে যুক্ত টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিলো হাতে।
শান্ত ভাবে জানালো, ‘দয়া করে পুলিসকে খবর পাঠান এখানে আসার জন্য। আমি এই মাত্র এক সিঁধেল চোরকে গুলি করে মেরে ফেলেছি । যাকে দেখতে টনি ডারন্যাকের মতো।’

কিছুক্ষন বাদে পুলিস, সংবাদপত্রের রিপোর্টার আর হোটেলের কর্মচারীরা ভিড় জমালো ক্যাম্বারটনের ঘরে। আর ও শোনালো এক শিহরনউদ্রেককারী ঘটনার কথা । যেটায় ও জানালো সান্ধ্যকালীন ভ্রমণ সেরে ঘরে ফিরে ও দেখতে পায় ওই লোকটা ওর দেওয়াল আলমারীটা খুলে ভেতরটা হাতড়াচ্ছে ।
‘ও আমার দিকে ধেয়ে এলো রিভলবারটা আমার দিকে তাক করে । নিজেকে বাঁচাতে আমি গুলি চালালাম।’
 পুলিস সার্জেন্ট জানতে চাইলো, ‘আগে কখনো দেখেছেন ওকে?’
‘মোটেই না। খবরের কাগজে ওর ছবি দেখেছিলাম তাই চিনতে পারি ।’
এক রিপোর্টার বললো, ‘মিঃ ক্যাম্বারটন, আপনি তো কেল্লাফতে করে দিয়েছেন। ওর মাথার দাম এখন পঁচিশ হাজার ডলার।’
‘তাই বুঝি! আমি অতশত ভেবে কিছু করিনি। শুধু নিজের প্রাণটা বাঁচাতে চেয়েছিলাম। তবে হ্যাঁ এখন আমি দাবি করতেই পারি যে সমাজের বুক থেকে আমি একটা দাগী অপরাধীকে হঠিয়ে দিয়েছি । আর তার জন্য কিছু পুরষ্কার আমার পাওয়া উচিত।’
নিজের ওপর নিজে দারুনভাবে সন্তুষ্ট আইনজীবী এবার বিভিন্ন সংবাদপত্রের জন্য বিভিন্ন ভঙ্গীতে নিজের ছবি তুলতে দিলেন। কখনো পিস্তল হাতেকোনোটায় দেওয়াল আলমারীটা দেখাচ্ছেন। সার্জেন্ট এর সাথে করমর্দনের ছবিও উঠলো। হোটেল ম্যানেজার, বেলবয়, পরিচারিকাদের কাউকেই মনে দুঃখ পেতে দিলেন না, সবার সাথে ছবি তুললেন। শুধু নিজের শিকারের সাথে একটাও ছবি তুললেন না।  উপস্থিত ফটোগ্রাফারদের সবরকম চাহিদা মিটালেন – শুধু একজনের বাদে। উনি চেয়েছিলেন ক্যাম্বারটন মৃতদেহটার ওপর পা দিয়ে দাঁড়ান শিকারীর ভঙ্গীতে। উকিল মহাশয় বিনয়ের সাথে বললেন সেটা ওনার সম্মানের পক্ষে খুব খারাপ একটা ব্যাপার হবে।

রাত পেরিয়ে ভোর হওয়ার একটু ক্যাম্বারটন বেরিয়ে এলো রাস্তায়টেলিফোন ডিরেক্টরী ঘেঁটে আইডিয়াল শ্যু রিপেয়ার শপের ঠিকানাটা যোগাড় করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। ৬৯২ এলওয়েল কোর্ট। চারটে ব্লক পরেই। পকেটে রিভলবার, ছোটো একটা টর্চ আর মাথায় টুপি পড়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঝোলানো সিঁড়ির সাহায্যে পেছনের সরু গলিপথটা দিয়ে শুরু করলো হাঁটা।
ক্লার্ক অ্যান্ড ব্রডওয়ের আলোকোজ্জ্বল অংশটা থেকে কিছু দূরেই এলওয়েল কোর্ট। গলি পথ সংলগ্ন একটা ভাঙ্গা চোরা বস্তির মতো এলাকাটা। ৬৯২ নাম্বারের ঠিকানাওলা বাড়ীটার
 সামনের দরজার কাঁচে লেখা আছে   “শ্যু রিপেয়ারিং” । কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবে না এখানে লুকানো আছে লক্ষাধিক ডলার। ক্যাম্বারটন কিন্তু আত্মবিশ্বাসী যে ওই টাকাটা সে আত্মসাৎ করতে পারবে। ডারন্যাক যে খুব একটা বুদ্ধিমান নয় এটা    সহজেই বুঝে গিয়েছিলোতার প্রমান এখানেও, একটা সাধারন তালা লাগিয়ে রেখেছে দরজাটায়। স্কেলিটন কি ব্যবহার করে সহজেই ওটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো ক্যাম্বারটন।

ভেতরে আবছা গা ছমছমে পরিবেশ। দূরে লাইট পোস্ট থেকে ঝাপসা আলো জানালার নোংরা কাঁচ ভেদ করে ঢুকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে বাধা পেয়ে অদ্ভুত দর্শন ভ্রান্তিকর সব ছায়া অবয়বের জন্ম দিয়েছে। আন্দাজ করে করে ও সামনের দিকে এগোলো । নরম কিছু একটায় ওর পা পড়তেই “ফ্যাঁ অ্যা অ্যা স” শব্দ ওকে চমকে দিলো। দুটো হলুদ চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। টর্চটা জ্বালাতেই বিড়ালটা লাফিয়ে পালিয়ে গেল। বিড়বিড় করে কিছু গালাগাল ছুঁড়ে দিলো ক্যাম্বারটন ওটার উদ্দেশ্যে । ঘরের চারদিকে আলো ফেলে নিজের অবস্থানটা এবার বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলো ।
দোকানের পেছন দিকেও একটা দরজা আছে। ওটা দেখতে পেয়েই দ্রুত টর্চটা নিভিয়ে দিলো । ডারন্যাকের কথা মতো বুড়ো মিলার হয়তো ওই ঘরেই শুয়ে আছে পানশালা থেকে ফিরে এসে। ডলার খোঁজার আগে একবার ওই ঘরটা দেখে নিতে হবে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দরজাটার দিকে। হাত রাখল ডোরনবে। অতি ধীরে ধীরে শব্দ না করে ঘোরালো ওটাকেএক অজানা আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেল ওর শরীরে । যেটা অস্বাভাবিক নয় মোটেই । ক্যাম্বারটন নিজেকে এ পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি বলে মোটেই মনে করে না। ও মোটেই সে ধরনের মানুষ নয় যারা অন্ধকার ও রাগী বিড়ালের চোখকে ভয় পায় না । কিন্তু এই মুহূর্তে যে ভয়ের ছোঁয়াচ ওকে ঘিরে ধরছে সেটা ঠিক কি রকমের সেটা ও বুঝতে পারছিলনা । কেন জানিনা একটা রাগ জন্ম নিচ্ছিল।
সাবধান হওয়ার কথা ভুলে গিয়ে এক ধাক্কায় দরজাটা খুললো ক্যাম্বারটনএক দমক হিমেল হাওয়া এসে আছড়ে পড়ল ওর ওপর। কনকনে ঠান্ডার সেই অনুভুতিতে ওর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। কিছু একটা গণ্ডগোল আছে বলে মনে হল ওর। জুলাই মাসে এতো ঠান্ডা! মনের জোর দরকার এই মুহূর্তে নিজের এই থলথলে শরীরটাকে চাঙ্গা রাখতে । এ ঘরটা আগের ঘরটার চেয়ে বেশী আলোকিত। পাশের বাড়ীর দেওয়ালের একটা আলো জানলা দিয়ে সরাসরি ঢুকছে এ ঘরে।
মনের মধ্যে একটা উদ্বেগ নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ক্যাম্বারটন থমকে গেল অন্ধকার কোনে একটা কিছু দেখে। দেখে মনে হচ্ছে একটা বিছানা, আর তাতে কেউ একজন শুয়ে আছে। বুড়ো মুচিটাই হবে, মদ্যপান সেরে এসে ঘুমাচ্ছেকিন্তু ক্যাম্বারটনের নাকে এমন একটা গন্ধ ভেসে এলো যা মোটেই অ্যালকোহলের নয়। খুব চেনা একটা গন্ধ। যা মোটেই মানানসই নয় এ জায়গার সাথে। রিভলবারটাকে চেপে ধরে জোরে জোরে কয়েকবার নাক টেনে গন্ধটা শুঁকলো ক্যাম্বারটন তারপর পা টিপে টিপে এগোতে থাকলো শুয়ে থাকা অবয়বটার দিকে এবং থেমেও গেলো দু পা এগিয়েই। একেবারে পাথরের মূর্তির মতো। বিস্ফারিত চোখে ত্রাসের ছায়া।

বিছানায় অবয়বটা উঠে বসেছে – এবং ওটা কোনো বুড়ো মানুষের দেহ নয় । পেশী বহুল, চওড়া কাঁধ ওয়ালা টনি ড্যারন্যাকের অবয়ব। আমেরিকার এক নম্বর অপরাধী। টনি ডারন্যাক! যার মৃতদেহ এই মুহূর্তে মর্গের খুপরিতে থাকা দরকার সে এখানে উঠে বসেছে ! এক অপার্থিব সবজেটে আলোর ছটায় আলোকিত হয়ে আছে তার মুখ । ভয়ানক । তাকিয়ে আছে ক্রুর চোখে এক দৃষ্টে আতঙ্কিত আইনজীবীর দিকে। কপালে একটা বুলেটের ফুটো। আর যে গন্ধটা ক্যাম্বারটনের মস্তিষ্কে গুটি গুটি করে পা  চালিয়ে ঢুকে পড়ছে তীব্রভাবে সেটা পোড়া বারুদের।
ক্যাম্বারটনের গোলাকৃতি মুখ ফ্যাকাশে থেকে আরো ফ্যাকাশে হতে থাকল। মাংসল কোটর থেকে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার যোগাড়থরথর করে কাঁপতে থাকা মুখে কিছু বলার আকুতি কিন্তু শব্দহীন।
‘তুমি!’ অবশেষে কঁকিয়ে উঠলো, ‘তুমি !– কেন ?- কিভাবে ? তুমি ! ডারন্যাক! নিকুচি করেছি তোমার! একবার তোমায় হত্যা করেছি। জানিনা কি ভাবে বেঁচে গেছো। আবার করবো !’
লক্ষ্যস্থির করে রিভলবার উঁচিয়ে ধরলো। ঘরটা কেঁপে কেঁপে ঊঠলো একের পর এক গুলি চা্লানোর শব্দে। গুলি গুলোর কোনোটাই অবয়বটার শরীরে বিদ্ধ হচ্ছিল না। ভেদ করে চলে যাচ্ছিলো । সাথে সাথেই ওটা এগিয়ে আসছিলো ক্যাম্বারটনকে লক্ষ্য করে এক পা এক পা করে। ক্যাম্বারটন পিছাচ্ছিল । গুলি চালানো থামায় নি । চেষ্টা করেছিল কিন্তু ঘুরে দৌড়ে পালাতে পারেনি। সুযোগই হয়নি । সম্মোহনের অমোঘ মায়ায় ওর সামনের অবয়বের চোখ দুটো ওকে আটকে রেখেছিলো। যেন ওরা এক সুতোয় বাঁধা । একজন কেবল এগোবে – আর অন্য জন পিছাবে --- আর কিছুই সম্ভব নয় এর বাইরে।
অসম্ভব ঘামতে ঘামতে পকেটে রাখা দ্বিতীয় আগ্নেয়াস্ত্রটা বার করে সব গুলি চালিয়ে গেল ক্যাম্বারটন। একসময় ট্রিগারেই শুধু চাপ পড়ছিল কিন্তু আর গুলি বের হচ্ছিল না।

আর এই ভঙ্গীতেই পুলিসের টহলদারী গাড়ীর লোকেরা ওকে দেখতে পায়। পাগলের মতো দুহাতে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র ধরে ট্রিগার টিপেই চলেছে। প্রথম গুলিটা চলার কিছু বাদেই টহলদারী গাড়ী এসে যায়। গুলির শব্দ পেয়েই পাশের বাড়ির বাসিন্দারা জেগে উঠে পুলিসে ফোন করে, ‘৬৯২ এ কিছু একটা ঘটছে...’

বিছানার ওপরেই পড়ে ছিল   গুলিতে ছিন্ন ভিন্ন হওয়া বুড়ো ফ্রেড মিলারের প্রানহীন দেহ। পুলিস দেখতে পায় ওই অদ্ভুত পাগলটা যাকে মানুষ হোরেস এল ক্যাম্বারটন , ক্রিমিন্যাল লইয়ার,‌ নামে চেনে সে রিভলবার দুটোর ট্রিগার টিপেই চলেছিল যন্ত্রের মতো।

বুড়ো মুচিকে খুনের দায়ে মামলা বেশী দিন চলেইনি । কারন ক্যাম্বারটনের কিছু বোঝার মতো ক্ষমতাই লোপ পেয়েছিল সে কি করেছে ওই দিন ভোরে। আপাতত উন্মাদাগারে পাগল অপরাধীদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটার এক কোনে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে । তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে । মনে হতো ডারন্যাকের সেই চাহনি আজও ওকে বেঁধে রেখেছে এক সুতোয় ।

কিছু মানুষের অনুমতি ছিল ওর সাথে দেখা করার। খুব কম লোকই আসতো অবশ্য । উন্মাদাগার আধিকারিকের কথানুসারে মাঝে মাঝেই ক্যাম্বারটনের মুখটা এক অভূতপূর্ব আতঙ্কের চাপে এমন বিকৃত হয়ে যেত যে অতি শক্ত মানসিকতার মানুষেরও বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যেত। যে আতঙ্কের অনুভুতি মাঝে মধ্যে ওর মুখকে বিকৃত করতো একসময় সেটা প্রায় সব সময় হতে থাকলো । এর ফলে যে শাস্তি ক্যাম্বারটন ভোগ করছিল প্রতিনিয়ত সেটার তুলনায় আর কোনও বড় শাস্তি এ জগতের আদালতের দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

সমাপ্ত
Attorney for the Damned

Reniyers Wyers

2 comments:

  1. প্রতিম দাসের প্রায় সব রচনা/পোস্টই না-পিডিএফ...পিডিএফ হ'লে নীচে নামিয়ে রাখা যেত...লেখকের আপত্তি থাকলে, আমার অনুরোধ নাকচ ক'রা যেতেই পারে...

    ReplyDelete