Search This Blog

Tuesday, June 20, 2017

দ্যা_লাস্ট_ম্যান... মেরি শেলী...বাংলা অনুবাদ মূল পর্ব - প্রথম পর্ব - ১ম পরিচ্ছেদ

দ্যা লাস্ট ম্যান
মেরি শেলী
বাংলা অনুবাদ – “শেষের সেইজন”
প্রতিম দাস
মূল পর্ব - প্রথম পর্ব - ১ম পরিচ্ছেদ

সমুদ্রে ঘেরা এক স্থানে আমি থাকি।  মেঘের ছায়ায় ঢাকা একটা অতি ক্ষুদ্র স্থান সেটা এই বিশাল পৃথিবীর অসীম সমুদ্র আর বিশাল বিশাল মহাদেশের তুলনায়। বলা যেতে পারে একটা ছোট্ট কনা মাত্র । কিন্তু মানসিক শক্তির দিক থেকে বিচার করলে এর ক্ষমতা অনেক অনেক বড় বড় ভুখন্ড এবং জনসংখ্যার অধিকারীদের চেয়েও বেশীএকটা দারুন সত্যি কথা হলো মানুষের কাছে যা ভালো বা যা মহান সে সব কিছুর স্রষ্টা হল মানুষের মন। আর সেই সত্তাটাই হলো তার একমাত্র নিয়ন্ত্রক। ওই যে উত্তরের প্রান্তে একটা দেশ ছিল যার নাম ইংল্যান্ড । সেটা এখন মাঝে মাঝেই আমার স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে। একটা বিরাট জাহাজের রুপ নিয়ে।   হাওয়ার প্রতিরোধ ভেঙে গর্বিতের মতো সে এগিয়ে চলেছে ঢেউ এর তালে ভেসে ভেসে। আমি যখন বালক ছিলাম তখন ওটা আমার জগত ছিল । আমি যখন আমার আদিম জন্ম স্থানের পাহাড় চুড়ায় দাঁড়িয়ে যত দূর সম্ভব আমার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দিতাম, আমার চারপাশের কোলাহলময় জগত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, তখন  ওইটাই হয়ে যেত আমার কাছে  এই পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল  । আর বাকি সব কিছু ঝাপসা হয়ে যেত, ওদের আমি ভুলে যেতামওসবের কোন মূল্য আমার কল্পনার জগতে থাকতো না।
শুরু থেকেই আমার ভাগ্য এক এমন শক্তির উদাহরন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে তার বিবর্তন এক মানব জন্মের ভেতর অনেক মানব জন্মের রুপ প্রকাশ করবে বলে ঠিক করেছিল। আর এব্যাপারটা আমি পেয়েছিলাম উত্তরাধিকার সুত্রে। আমার পিতা ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন যাকে এই প্রকৃতি দিয়েছিল সেরা ক্ষমতা , জ্ঞান আর কল্পনার ক্ষেত্রে। আর সেটাই তাকে করে দিয়েছিল জীবন তরীর চলার পথে বাকিদের জন্য পথ প্রদর্শক। পিতার ভাবনা বা বক্তব্য বোঝা কঠিন ছিল অনেকসময় কিন্তু তার ফলাফল যা হতো সেটাই তাকে জনগনের আলোচনার তালিকায় স্থান দিয়ে দিয়েছিল। এর ফলে উত্তরাধিকার সুত্রে যা পেয়েছিলেন সব ব্যয় করে ফেললেন সাজ পোশাকের পেছনে কারন  আদতে তিনি একজন অভিনেতা ছিলেন এই জীবনের রঙ্গমঞ্চে।  যৌবনের সেই ভাবনা চিন্তাবিহীন দিনগুলোতে তাকে বড় লোকের উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তানেরা  খুব পছন্দ করতো । কিন্তু তাদের কাছে পাত্তা পেতেন না যারা এই সব মেকি হুল্লোড় ছেড়ে সমাজে প্রকৃত পক্ষেই কিছু কাজকর্ম করতেন।  আমার পিতার চাহিদাগুলো কখনোই তার নিজের নিয়ন্ত্রনে ছিল না । আর এর ফলেই তিনি ক্রমশ সমস্যার জগতে নিমজ্জিত হচ্ছিলেন।   একদিকে নিজের দেখনদারি বজায় রাখার জন্য যখন তার ঋণ বেড়েই চলেছে অন্যদিকে উচ্ছন্নে যাওয়া ধনী সন্তানদের টেবিলে  সাহচর্য দেওয়ার চাহিদা বিন্দমাত্র কমেনি  অথচ কেউ একবারের জন্যও তার আসল অবস্থাকে বোঝার চেষ্টা করেনি । আর উনি ওদের বিষাক্ত চাটুকারিতায় মজে ছিলেন।
এইধরনের জনপ্রিয়তা অন্য যে কোনরকম জনপ্রিয়তার মতই খুব সহজে অন্তর্হিত হয়ে যায় ।   তারফলে যে সমস্যার মুখোমুখী উনি হচ্ছিলেন তার বিপদজনক অনুপাত দিন দিন বেড়েই চলেছিল।   এ সময়েই হঠাৎ করেই রাজার তরফ থেকে অনুগ্রহ লাভ তাকে বাঁচিয়ে দিলো। প্রায় সমস্ত ধার বাকি মিটে গেল ।  প্রতিশ্রূতি পেলেন নতুন করে জীবন শুরু করার ।  কিন্তু তিনি যে সামাজিক পাঁকে নিমজ্জিত হয়েছিলেন , মেকি প্রশংসা পাওয়ার লোভ, জুয়া খেলার নেশা ইত্যাদির তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পেরে সে প্রতিশ্রুতি তার কোন কাজেই লাগলোনা। অতি সহজে পরিস্থিতি বিচার করা তা ধাতে ছিল না। এর ফলে   কমে আসছিল তার মানসিক শক্তির ধারটাওইত্যবসরে রাজা বিবাহ করলেন অস্ট্রিয়ার রাজকন্যকে।   ইংল্যান্ড পেলো তাদের নতুন রানী । ফ্যাশনের চূড়ামণি তিনি, তার চোখে ধরা পড়লো স্বামীর নানান বিক্ষেপ। পিতার জন্য যে সব সুবিধাগুলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সেগুলোও তার ভালো লাগলো না। পিতা বুঝতে পেরেছিলেন তার তনের দিন এগিয়ে আসছে । তবু ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থায় নিজেকে বাঁচানোর জন্য তিনি শেষ একটা চেষ্টা করবেন এই সঙ্কল্প নিয়ে খারাপ কাজের পথ থেকে সরে যাওয়ার কথা ভাবলে  নিজেকে সেই  উপভোগের জগতেই আরো বেশি করে সঁপে দিলেন, যা তার ভাগ্যকে প্রতারনা আর ক্রুরতার পাকে ডুবিয়ে দিয়েছে   
রাজা মশাই ছিলেন এমন মানুষ যাকে খুব সহজেই বশীভুত করা যেত , তিনি এখন পরিণত হলেন তার জাঁদরেল স্ত্রী এর একান্ত অনুগত স্বামীতে। আর তার ফলেই আমার পিতার ব্যাপারে চরম পদক্ষেপ নেওয়ার পথটা প্রশস্ত হলো  অস্বীকার করা যাবে না যে পিতার উপস্থিতির প্রভাব এতটাই ছিল যে  এসব সমস্যার মেঘকে তা অনেকটাই সরিয়ে দিতে পারছিল  কারন তার আচার ব্যবহার, মেলামেশার পদ্ধতি বা কথা বলার মিষ্টতার প্রভাব ছিল অমোঘ। তবুও  কেউ যদি সব সময়ে কা্রো কানে কোনো মানুষের কেবলমাত্র দোষের দিকগুলোই বলে যেতে থাকে  তাহলে আর কোন যুক্তিই কিছু কাজ করে না। রানীর নিপুণ চালে এটা আরো বেশি করে উদ্ভাসিত হলো। অবশেষে রাজা সব কিছুর খোঁজ খবর নিলেন। কটু সত্যিগুলোকে আর চেপে রাখা গেল না।  উনি সবরকম সুবিধা পাওয়া থেকে পিতাকে বরখাস্ত করলেন।
এরকম একটা ঘটনার পেছনে বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য আবেগ তো থাকা দরকার। একজন শক্তিমান রাজা, কোন ভালো কাজের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে একেবারে মুখ বুজে সব কিছু মেনে নিলেননা ।    মৃদু ভৎসনার সাথে  পিতাকে বুঝিয়ে দিলেন যে ,তার যে বিশেষ ক্ষমতা আছে সেটা ভালো কাজে ব্যবহার হোক । দেশের প্রয়োজনে লাগুক। আমার পিতা হয়তো  এবার সেটা বুঝতে পারলেন । কিছু সময়ের জন্য এক উচ্চাশার স্বপ্ন স্রোত বয়ে গেল তার সামনে দিয়ে। উনি ভাবলেন বর্তমান পরিস্থিতি বিসর্জন দিয়ে এক মহান কাজেই মনোনিবেশ করা দরকার। আন্তরিকতার সাথে উনি প্রতিশ্রুতি দিলেন ভালোভাবে জীবন কাটাবার এবং নতুন দায়িত্ব পালন করার।   এর কারনে উনি আবার ভালো পরিমাণ অর্থ পেলেন   সমস্ত ধার মুক্ত হওয়ার জন্য। অথচ সেইদিন রাতেই  সব অর্থ হেরে বসলেন জুয়ার টেবিলে, দ্বিগুন করার নেশায়আর মুখ রইলো না রাজার কাছে কিছু চাওয়ার। অতএব বিদায় নিলেন ইংল্যান্ড থেকে। একাকী ঘুরে বেড়াতে থাকলেন দূরান্তে পাহাড় জলাশয় সংলগ্ন এলাকায়। তার   জ্ঞান, তার বুদ্ধি দৃপ্ত পরিহাসের ক্ষমতা, ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা, অসাধারন আচার ব্যবহার এবং সামাজিক স্তরের বিভিন্ন রকম প্রতিভা  অনেকদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হয়ে চললো । এতো কিছুর মধ্যেও কেউ কিন্তু এটা বললো না যে ওই মানুষটার এখনো কিছু প্রতিদান পাওয়া উচিত। আসলে মানুষটা এক মেঘের দেশে হারিয়ে গিয়েছিল। রাজামশাই তার প্রিয় বয়স্যের ফাঁকা স্থানটা মাঝে মধ্যে অনুভব করতেন। তার বলা বিভিন্ন কথাগুলো ওনার মনে পড়তো। মনে পড়তো সেই সব অভিযান যেগুলো ওরা একসাথে করেছিলেন। কিন্তু এখানেই থেমে যেত তার স্মৃতিচারনা।
ওদিকে আমার পিতা সব কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেও  ভুলতে পারতেন না।  মনের ভেতর একটা খুঁতখুঁতে ভাব সসময় ওকে খোঁচাতো আর সেটা নিছক দু্মুঠো খাবার বা নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার চাহিদা ছিলনা চাহিদা ছিল সেই জীবনটার যেখানে ছিল উদ্দাম উল্লাস আর প্রশংসা, একটা ঝকমকে জীবন । এসময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন  তার দেখা শোনা করে এক গরিব ঘরের   কন্যা। যেখানে উনি থাকতেন সেই গৃহের অধিবাসিনী।  দেখতে সুন্দরী, নম্র স্বভাব এবং তার থেকেও বড় কথা কিছুটা যেন পিতার প্রতি অনুরক্তা। পিতাযে সব উচ্চবংশের মহিলাদের দেখেছেন সেই সমস্ত কন্যাদের তুলনায় এ কিছুই না। কিন্তু যা হবার তাই হলো এই চাহিদা রুপ পেল এক দুর্ভাগ্যজনক বিবাহতে।  তার ফসল আমি। আমার মায়ের কোমলতা এবং মিষ্টতাকে তিনি কখনোই বুঝতে পারেন নি। তিনি যেন সেই আগের জগতেই আছেন এমন ভাব দেখাতেন।  তার জানাই ছিল না নিজের পরিবারকে তিনি কিভাবে সাহায্য করবেন।  কখনো ভাবতেন আবার একবার রাজার কাছে আবেদন জানাবেন, কিন্তু লজ্জায় সেটা  পারতেন নাবিশেষ কিছু করার আগেই অবশ্য তার দেহাবসান হলো । আর এর ঠিক কিছু আগের মুহূর্তে উনি তার পরিবারের ভবিষ্যতের দিকটা নিয়ে  একবার ভেবে দেখার চেষ্টা করেছিলেন ।   তার ফলশ্রুতি স্বরুপ লেখেন এক চিঠি । যার ছত্রে ছত্রে মকে নাড়া দেওয়ার মতো কথায় ভর্তি। জানানোর চেষ্টা যে একসময় তিনি ছিলেন রাজা মশাই এর অতি প্রিয় পাত্র।   সেজন্য উনি তার স্ত্রী আর সন্তানকে রেখে দিয়ে যাচ্ছেন  রাজার সাহায্যের আশায়, ভরসায়জীবনে যা এরা পায়নি সেটাই হয়তো   পাবে ওর মৃত্যুর পর। চিঠিটা একজন ভালো মানুষের হাত দিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থাও করে দেন উনি যাতে ওটা রাজার কাছে পৌছায়।
এক রাশ দেনা মাথায় নিয়ে পিতা মারা যান  এবং যা সামান্য সম্পত্তি ছিল সব সাথে সাথেই দখল করে পাওনাদারেরা।   আমার মা তার দুই সন্তানকে নিয়ে দিনের পর দিন মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকেন, সেই চিঠির হয়তো একটা কোন জবাব আসবে।  যা কোনদিনই আসেনি। নিজের বাবার সামান্য ঘরটায় থাকা ছাড়া আর কোন রকম বড় স্বাচ্ছ্যন্দের অভিজ্ঞতা আমার মায়ের হয়নি। পিতা বেঁচে থাকার সময় অনেক বড় বড় নামের মানুষদের কথা উনি শুনেছেন। কিন্তু শোনাই সার বাস্তবটা কিছু বদলায় নি। দিনের পর দিন বেড়েছে দারিদ্র আর হতাশা।
যত দিন গড়াতে থাকলো আমাদের অবস্থা আর খারাপ হতে থাকলো। মায়ের বাবা ছিলেন একজন দেশান্তরী মানুষ। তিনি কবেই মারা গেছেন। এমন কোন আত্মীয় নেই যারা একটু সাহায্য করতে পারে। অর্থাৎ আমার ছিলাম তস্য গরীব। ভিখিরির অধম। একমাত্র মানুষের দয়াতে বেঁচে থাকতে সক্ষম।
মা যখন মারা গেলেন আমার বয়স পাঁচ। আমিই বড় । মাঝে মাঝেই মায়ের বলা কথাগুলো মনে পড়ে। এমন একটা দিন হয়তো আসবে যখন বাবার সুত্রে পাওয়া আমার মাথার ভেতরে থাকা জ্ঞানগুলো কাজে দেবে। আমিও সেই সবের স্বপ্ন দেখি। কেমন যেন মনে হতো ওটা যেদিন ঘটবে আমি আমার আশেপাশে থাকা সকলের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে যাবো। কিন্তু কিভাবে আর কবে সেটা ঘটবে তা জাতে বা বুঝতে পারছিলাম নারাজা সহ বিভিন্ন মহান মানুষের নাম আমার মাথার মধ্যে নড়াচড়া করে বেড়াতো। কিন্তু সেগুলো দিয়ে কি কাজ হবে এটা আমি ধারনাতেই আনতে পারছিলাম না। আমি নিজের সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বুঝতাম যে আমি একজন অনাথ আর আমাকে রক্ষা করার মত কেউ নেই। একসময়  কাজ নিলাম এক কৃষকের  অসংখ্য ছাগল ভেড়া কাছের উপত্যকায় চড়ানোর।  আমার একটা কুকুর ছিল, যে আমার পাশেই শুতো। এরকম একটা জীবন আমি মোটেই  পছন্দ করছিলাম না । সত্যি বলতে আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট ছিল । হ্যাঁ প্রকৃতির সাথে স্বাধীন ভাবে মিশে থাকার একটা সুযোগ হয়তো ছিল কিন্তু একাকীত্বকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। ছাগল ভেড়াদের দেখভাল করা বা ঋতু পরিবর্তন কিছুই আমার আগ্রাসি সত্তাকে শান্ত করতে পারছিল না। কোনও রকম বাধাবন্ধনহীনতাই আমাকে নিয়ে যায় এক নিয়ম ভাঙার মানসিকতার পথে। আস্তেস্তে মি খোঁজ পেলাম আমার মতোই অনেক ছেলেপিলেরওদের নিয়ে বানালাম একটা দল।   হলাম দলপতি। যখন আমাদের ভেড়া ছাগলগুলো এদিকে ওদিকে চড়ে বেড়াতো আমরা মেতে উঠতাম দল বেঁধে নানা দুষ্টুমি নষ্টামি করার নেশায়। যেহেতু আমিই ছিলাম ওদের নেতা এবং রক্ষক তাই ওরা যা বদমাইশি করতো তার প্রভাব আমাকে সইতে হতো। আর তার ফলে ওদের প্রাপ্য শাস্তি  আমি নিজে মাথা পেতে নিতাম আমার হিরো সুলভ মানসিকতা দিয়ে । বদলে ফিরে পেতাম ওদের আনুগত্য আর প্রশংসা।
আর এভাবে চলতে চলতে আমার আমার ভেতর একটা অনমনীয় জেদ শক্তপোক্ত হয়ে বাসা বাঁধতে শুরু করলো। আত্মবিশ্বাস আর অনুগত ছেলেগুলোর প্রশংসা আমার পিতার চরিত্র ও রক্তের সুত্রে পাওয়া গুনগুলোকে উদ্দীপিত   করে আমাকে    বেপরোয়া চিন্তাভাবনাহীন মানুষের রুপে গড়ে পিটে নিচ্ছিলো। আমি ছিলাম শুকনো মাটির মতো রুক্ষ আর পশুর মতো অশিক্ষিত। মাঝে মাঝেই আমি এই কথাটা ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিতাম যে এটাই আমাকে পৃথিবীর সমস্ত হীনমন্যতা থেকে দূরে রাখবে। আর এই অশিক্ষিত দর্শনের পাখনায় ভর দিয়ে আমি সেই রোমান সাম্রাজ্যের নেকড়ে পালিত স্রষ্টার মতো এক উদ্দাম জীবন যাপন করে চলেছিলাম ইংল্যান্ডের পাহাড়ি এলাকায়।  একটাই আইন আমি মানতাম, আর সেটা  হলো  আমার আত্মিক শক্তি কারো কাছে মাথা নত করার জন্য জন্ম নেয়নি ।
এর সাথেই আমাকে অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে সংযত করতেও হতো । আমার মা মারা যাওয়ার সময় অনেক কথা বলার সাথে সাথেই তার দ্বিতীয় সন্তানটির দেখভাল করার পূর্ণ দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। আর এই একটা কাজ আমি করেছি আমার হৃদয়ের যতটা সম্ভব  সমস্ত ক্ষমতা নিংড়ে দিয়ে । আমার বোন আমার চেয়ে তিন বছরের ছোটো। আমি ওকে একটা ছোট্ট শিশুর মতোই দেখা শোনা করেছি। সমাজের নিয়ম অনুসারে আমাদের কখনোই একই ধরনের কাজ করার সুযোগ ঘটেনি , থাকতে হয়েছে দূরে দূরে । তবুও সে সব য়েই আমার স্নেহের ভালোবাসার ছায়াতেই ছিল। অনাথ হিসাবে আমরা ছিলাম গরীবস্য গরীব এবং অতিমাত্রায় অশ্রদ্ধার পাত্র। আমার বেপরোয়াভাব আমাকে কিছু পরিমাণে মানুষের কাছে শ্রদ্ধা অর্জনের সুযোগ করে দিলেও মেয়ে হওয়ার কারনে সে ছিল অনেকটাই মানসিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির। সাথে সাথেই পারিপার্শ্বিকতার নোংরা প্রভাব তার চরিত্রকে দৃঢ় করতে পারেনি। 
সেও ছিল আমার মতই একাকী মানসিকতার। ওর মধ্যেও ফুটে উঠছিল আমার পিতার নানান গুনাবলীর ছাপ।  নিজেকে প্রকাশ করা সবার সামনে পেশ করাটাই যেন ওর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। ওর চোখের মনিতে তেমন কোন উজ্জ্বলতা না থাকলেও গভীরতা ছিল । ওর চোখের দিকে তাকালে মনে হতো ওর বুদ্ধির তল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। মনে হতো ওই চোখ পারে অন্যের আত্মাকে দেখে নিতে ।  মনে হতো জগতের যত ভাবনা সব ওখানে সমাহিত হয়ে আছে। ফ্যাকাশে ফর্শা ছিল ওর গায়ের রঙ। একঢাল সোনালী চুল মাথার ওপর দিয়ে ছড়িয়ে থাকতো। যার ঔজ্জ্বল্য এক বৈপরীত্যের জন্ম দিতো ওর শ্বেত পাথর সুলভ দেহত্বকের সাথে।  রুক্ষ চাষাড়ে পোশাক অবশ্য ওর মুখে যে ভাব ফুটে থাকতো তাকে ভালোই সঙ্গত দিতো । ওকে দেখে গুইডোর সন্ন্যাসিনীদের কথা মনে হতো। কিন্তু ওর হৃদয়ে আর সামগ্রিক চরিত্রে একটা স্বর্গীয়তা আছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হতো না । যে কেউ ভালো করে তাকালেই সেটা ধরতে পারতো, তার পোশাক তার হাবভাব তাতে বিন্দুমাত্র ছায়া ফেলতে পারত না।
কিন্তু এটা বলতেই হবে, বেচারি পারডিটা [ এই নামটাই একমাত্র সুন্দর জিনিষই যা  ও  পেয়েছিল আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে] কিন্তু সব মিলিয়ে মোটেই সন্ন্যাসী সুলভ আচরণ করতো না। ওর আচরণ ছিল শীতল প্রত্যাখানের সাথে তুলনীয়। আসলে ও যদি আদরযত্নে ঠিকঠাক বড় হতো তাহলে হয়তো এটা আশা করা যেত। কিন্তু ধিক্কার আর অবিশ্বাসের আহাওয়ায় যে বড় হয়েছে  তার কাছে নম্রতার আশা করা বৃথা। ও যাদের কাছেই কাজ করতো হাভাবে তাদের প্রতি নিজের আনুগত্য দেখাতো কিন্তু একটা অপছন্দের ভ্রু কোঁচকানো সব সময়েই ওর মুখে দেখতে পাওয়া যেত ।   কাজকর্মেও তার ছাপ পড়তো। ও চাইতো একা থাকতে। ও চাইতো সেই সব নির্জন দুরূহ উচ্চস্থানে উঠতে বা   যেখানে মানুষ যায়নি এমন সব জায়গায় যেতে। মাঝে মাঝেই সে জঙ্গলের মধ্যে ঘন্টার পর ঘণ্টা একাকী ঘুরে বেড়াতো। আইভি লতা এবং ফুল দিয়ে বানাতো ফুলের ডালি । অথবা এক মনে দেখতো পাতায় পাতায় আলোছায়ার নাচন। কখনো বসে থাকতো কোন বয়ে যাওয়া ছোট্ট জল ধারার পাশে, ভাবনার ধারাস্রোত থেমে গেলে সে হাতের ফুল বা পাশে পড়ে থাকা নুড়ি পাথর ছুঁড়ত জলে । এক মনে দেখতো কিভাবে ফুল ভেসে যায় বা নুড়ি ডুবে যায়। অথবা পাতা বা গাছের ডালকে ভাসিয়ে দিতো নৌকার মতো সাজিয়ে এবং চেয়ে চেয়ে দেখতো সেই খেলনা নৌকা কিভাবে ভাসতে ভাসতে দুলতে দুলতে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে কোন সুদুরের পথে। এরমাঝেই তার স্বপ্ন কল্পনা দিতো উড়ান; সে স্বপ্ন দেখতো এক বিধংসী বন্যার, যাতে তছনছ হয়ে গেছে সব।   সেই স্বপ্নের জগতে সে হারিয়ে যেত এবং ফিরেও আসতো অনিচ্ছার সাথে এই সাধারন জীবনে দারিদ্র একমাত্র আবরণ ছিল যা তার সদ্গুনগুলোকে ঢেকে রেখে দিয়েছিল। আর এতেই চাপা পড়ে গিয়েছিল ওর সব  ভালোকিছুআমি যতটাও বা আমার অভিভাবকদের কথা মনে করতে পারতাম ও সেটা পারতো না।  বাবার আমার কাছেই সে ফিরে আসতো, কারন আমি তার ভাই এবং তার একমাত্র বন্ধুও। আর এটা যারা ওকে পছন্দ করতো তাদের অপছন্দের বিষয় ছিল ।   সেজন্যই ওর ছোটোখাটো ভুলকে ওরা বড় অপরাধ বলে গণ্য করতো।  ও যদি সঠিক পরিবেশ পেতো বড় হয়ে ওঠার তাহলে জন্মসুত্রে যে মানসিক কোমলতা লাভ করেছিল সেটার কারনে সকলের ভালবাসার পাত্রী হয়ে যেত; সাথে সাথেই ওর সমস্ত আচরণ মানুষের কাছে খ্যাতি লাভ করতো শত দোষ থাকলেও। যে সমস্ত গুনাগুন সে পিতার কাছ থেকে রক্তসুত্রে লাভ করেছিল ; যা তার শিরায় শিরায় ছুটে বেড়াতো; যেখানে দক্ষতা, ঈর্ষা, নীচতা ইত্যাদি হয়ে দাঁড়াতো ওর চরিত্রের সহায়ক। ওর উপস্থিতিই এক মিত্রতা সুলভ আলোকের দ্যূতি মেখে ওকে হয়তো বানিয়ে দিত কোন দেশের রানী।    ওর চোখ তখন নিশ্চিত হয়ে উঠতো উজ্জ্বল, ভয়হীন।
আমাদের অবস্থা এবং অনিশ্চয়তা আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল চলতি সমাজ থেকে। আমাদের মধ্যেও তৈরি হয়েছিল এক নিদারুন বৈপরীত্য। আমি সব সময় চাইতাম উত্তেজনা আর আর সহচরদের প্রশংসা। পারডিটা কিন্তু ছিল নিজের জন্য নিজেই সব ধরনের চরিত্র। আইনের গন্ডি ভাঙা আমার আচরণ   সমাজের কাছে একটা বিপত্তি হলেও মান্যতা ছিল , কিন্তু ওর ছিল চরম উদাসীনতা। আমার জীবন যখন কাটছে কঠোর বাস্তবে ওরটা ছিল স্বপ্নের জগত। আমি  বলতেই পারি যে আমি আমার শত্রুদেরকেও ভালোবাসি কারন ওরা আমাকে দেয় জীবনের রসদ; পারডিটা কিন্তু নিজের বন্ধুদের পছন্দ করতো না, কারন তারা ওর স্বপ্নের জগটাতে ঢুকে পড়তো। জয়  হোক বা পরাজয় আমার অনুভুতি তখনই খারাপ হতো যখন বুঝতাম আমি ওতে অংশগ্রহনটাই করতে পারিনি; অন্যদিকে পারডিটা আনন্দ পেলেও একাকিত্বের জগতে বিচরন করতো । সেখানেই আটকে থাকতো দিনের পর দিন। কোন রকম আবেগের প্রকাশ দেখাই যেতোনা বা অন্যের মনের ভাব জানতেও চাইতো না। হয়তো সে তার কোন বন্ধুর  জন্য ভালোবাসা অনুভব করতো কিন্তু সেটা প্রকাশে ছিল তার অনীহা। যে কোন আবেগ প্রকাশ তার কাছে ভাবালুতার নামান্তর ছিল। পারডিটা একমাত্র তখনই নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতো যখন আর কোন পথ খোলা থাকতো না  । ছিল সেই ধরনের উর্বর জমি যেখানে নির্মল বাতাস বয়ে যায়, ঝড়ে পড়ে স্বর্গীয় শিশিরকনা । এমন  জমিতে যেখানে জন্মাতে পারে উৎকৃষ্ট ফসল কিন্তু   কোন এক আঁধারে ডুবে থাকার কারনে,   কোন রকম বীজই   জীবনের স্বাদ গ্রহন করতে পারত না।
পারডিটা থাকতো একটা কুটীরে যার সবুজ ঘাসে ভরা ঢালু জমি নেমে গিয়েছিল আলসয়াটার লেকের জলে। দূরে গাছের সারির পেছনে পাহাড়। সেখান থেকে নেমে আসা এক ছোট্ট নদী কুলুকুলু শব্দে পপলার গাছের তলা দিয়ে বয়ে এসে মিশে যেত লেকের জলে। আমি থাকতাম এক কৃষকের সাথে তার পাহাড়ের ওপর দিকের একটা বাড়ীতে। একটা কালো এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ের চুড়া ছিল ঠিক তার পেছনে, উত্তর দিকে। গরম কালেও যার খাঁজে খাঁজে জমে থাকতো তুষার । ভোর হতে না হতেই আমি আমার গবাদি পশুর পাল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। আর পাহারা দিতাম সারা দিনভর। জীবন ছিল দুঃসহ; রোদের তুলনায় বৃষ্টি আর ঠান্ডার প্রকোপ ছিল বেশী । যদিও আমি গর্ব অনুভব করতাম এই সব কষ্টকে মেনে নিতে পারছি বলে। আমার প্রিয় বিশ্বাসী কুকুর  ছাগল ভেড়াগুলোর দিকে নজর রাখতো আর আমি উধাও হয়ে যেতাম আমার সঙ্গীদের সাথে নতুন নতুন অভিযানের জন্য। দুপুর বেলায় সবাই একত্র হতাম তারপর মেতে উঠতাম আগুন জ্বালিয়ে কোন জায়গা থেকে চুরি করে আনা মাংস ঝলসে খাওয়ার উল্লাসে। এর সাথে সাথেই চলতো ধারাবিবরণী কিভাবে পালিয়েছি, কুকুরদের সাথে লড়াই করেছি , প্রয়োজনে হত্যাও করেছি । জিপসিদের মতো একটা পাত্র থেকেই সবাই চেটেপুটে খেতাম। এরপর বাকি বিকেলটা এদিক ওদিকে ছিটকে যাওয়া গবাদি পশু খুঁজে আনতাম বা আগের করা শাস্তি থেকে নিজেদের বাঁচানোর পথ খুঁজতাম কিংবা শাস্তি ভোগ করতাম । সন্ধে হলেই আমার গবাদি পশুর পাল ঢুকে যেত তার নিজের জায়গায় আর আমি ফিরে আসতাম আমার বোনের কাছে।
এটা খুবই কম ঘটেছে যখন আমরা পালাতে সক্ষম হয়েছি। ওই চুরি চামারির ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই  ধরা পড়ে মার খাওয়া আর হাজতবাস ভাগ্যে জুটতো। তেরো বছর বয়সে আমাকে একমাসের জন্য কাউন্টি কারাগারে পাঠানো হলো। একময় ছাড়াও পেলাম। কিন্তু তাতে আমার নৈতিকতার উন্নতি বিন্দুমাত্র হল না। বরং যাদের জন্য কারাবাস করতে হলো সেই সমাজটার প্রতি আমার ঘৃণা দশগুন বেড়ে গেল। শুধুমাত্র প্রতিদিনের নিশ্চিন্ত খাবার প্রাপ্তি আমার রক্তের উদ্দামতাকে সামাল দিতে সক্ষম ছিল না।  একাকী কারাবাস আমাকে কোন ভালো ভাবনার জন্য উদ্দীপিত করতেও পারেনি। আমার ক্রোধ আর বেড়ে গিয়েছিল।    আরো অস্থির প্রকৃতির আর হতাশাময় মানসিকতার দাস হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কাছে একমাত্র আনন্দের মুহূর্ত ছিল সেইগুলো যখন আমি মনে মনে পরিকল্পনা করেছি কিভাবে বাইরে গিয়ে ওদের শাস্তি দেব। আর এই পরিকল্পনা করতে গিয়ে আমি একাকী থাকার ক্ষেত্রে নিপুণ হয়ে উঠেছিলাম। সেপ্টেম্বরের শুরুতে একটু আগে ভাগেই  ছাড়া পেয়ে গেলাম ।   এতে আমি নিজে এবং আমার সঙ্গীরা খুশীই হলাম। সেটা ছিল একটা দারুন শীতকাল। চরম ঠান্ডা আর দারুন তুষারপাত জীবজন্তুকে বাইরে বের হতেই দিলো না ।   মানুষজনতো ফায়ারপ্লেসের পাশ ছেড়ে না ওঠার পন করেছিল। যার ফলে আমাদের মজাই হল। আমরা এতো শিকার করেছিলাম যে নিজেরাই খেতে পারিনি। ওদিকে আমার বিশ্বাসী কুকুরটা রোগা হয়ে গিয়েছিল আমাদের সাথে না যেতে পেরে।

এভাবেই সময় কাটতে থাকলো । আর সেই সব বছরের সুখ স্মৃতি তাদের জন্যই জমা হল যারা আমার মতো বন্য আর রুক্ষ প্রকৃতির নয়। ষোল বছর বয়সে আমি একজন জোয়ান মানুষের মতো দেখতে হয়ে গিয়েছিলাম। লম্বা এবং ছটফটে।  নিজের শক্তি বাড়ানোর দিকেও আমি মনোযোগ দিয়েছিলাম। সাথে সাথেই সহ্য করতে শিখে গিয়েছিলাম প্রাকৃতিক ঝড় ঝাপ্টার দাপটকে।   চামড়া রোদে পুড়ে বাদামি হয়ে গিয়েছিল। আমার প্রতি পদক্ষেপে আত্মবিশ্বাসে ভরা শক্তির ছাপ পড়তো।    কাউকেই ভয় করতাম না। আর কাউকে ভালোওবাসতাম না। পরবর্তী জীবনে সেইদিনগুলোর কথা ভেবে আমি অবাক হয়েছি কিসের জন্য বাঁচতাম তখন তাহলে; কি উৎকট রকমের একটা জীবেই না আমি পরিণত হতাম যদি সেই নিয়মবন্ধনহীন আইনভঙ্গকারি রুপেই জীবনটা কাটাতাম। আমার সেই জীবনটা ছিল একটা পশুর মতো আর আমার মন এটাই ভেবে চলতো চারপাশের সব কিছুই আমার পক্ষে বিপদজনক এবং খারাপ। তখনো অবধি, আমার বুনো মানসিকতার জীবন সে অর্থে কোন বিরাট রকমের বাজে কাজ অবশ্য রেনি। আমার শারীরিক শক্তি তার ছত্রচ্ছায়ার বেড়ে উঠেছে ।   মনটা দিন দিন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে একই ধরনের রুষ্ট ভাগ্যের নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে।   এই সময় থেকে আমার উদ্দীপিত স্বাধীনতার কুটকুটে এক ফলা রোজ আমায় খোঁচাতে শুরু করে স্বেচ্ছাচারে জন্যচাইছিলাম স্বাধীনতা যেন আমার কাছে পরিণত হয় একটা অধিকারে। যৌবন থেকে পুরুষত্বে প্রবেশের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার আবেগ তখন অরন্যের বিশাল গাছের মতই শক্তপোক্ত। তার কামনার শিকড় ছড়িয়ে গেছে আমার শরীরে ।   তাদের ছায়া পড়তে শুরু করেছে আমার জীবন পথে।
আমি আমার ছোট্ট বেলার সমস্ত বঞ্ছনাকে একত্র করে মনে মনে অনেক গুমড়ালাম ।   তার সৌধের ওপর আমার বিক্ষুব্ধ স্বপ্নগুলোকে সাজিয়ে নিয়ে তৈরি হলাম ভবিষ্যতের পথ বেছে নেওয়ার জন্য।   এড়িয়ে চলা শুরু করলাম আমার পুরোন সাথীদের এবং এক সময় তাদের ভুলে গেলাম। ওরাও সেই বসে পৌছে গিয়েছিল যখন নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নিতে হয়। আর সেখানে আমি এক জন পথভ্রষ্ট, কেউ নেই যে আমায় পথ দেখাবে বা সাথ দেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।  বয়স্করা আমাকে উদাহরন হিসাবে দেখাতে থাকলো অন্যদের কাছে আর  অল্প বয়েসীরা আমাকে এমন চোখে দেখতে শুরু করলো যেন আমি মানুষ ই না।   ওদের প্রতি বাড়তে থাকলো আমার ঘৃণা। সাথেই আরো খারাপ যেটাটলো আমি নিজে নিজেকেই ঘৃণা করতে শুরু করলাম। আমি আমার বাজে অভ্যাসগুলোর সাথেই বেঁচে রইলাম , যদিও তার অধিকাংশই আমি পরিত্যাগ করেছিলামতবু এই সভ্যতার বিরুদ্ধে আমার লড়াই চলতেই থাকলো । আবার সাথে সাথেই সেই ইচ্ছেটাকেও লালন পালন করতে থাকলাম; একদিন আমি এই সভ্যতার অংশ হবো।

  ফিরে ফিরে মনে করার চেষ্টা করলাম আমার মা যা যা বলেছিলেন আমার পিতার আগেকার জীবন সম্বন্ধে।   উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া তার কিছু জিনিষপত্র আমি খুঁজে খুঁজে বার করলাম। কিন্তু সেগুলো তেমন কোনও পথের হদিশ দিতে পারলো না যা আমাকে একটা স্বচ্ছল জীবন দিতে পারে। আমার বাবা সব সময় মহান মানুষদের সাথে মেলামেশা করেছেন। কিন্তু আমি যতদূর জানি সে সব মেলামেশার বেশির ভাগটাই ছিল মেকি এবং  পাত্তা না পাওয়া ধরনের । রাজা নামধারী ওই যে এক ব্যক্তি – যার কাছে আমার পিতা মরার আগের মুহূর্তে কিছু  সাহায্য পাওয়ার আবেদন করেছিলেন। যে আবেদনে কেউ সাড়া দেয়নি , এর সাথে একটাই বিষয় মিশে আছে তা হলো অমানবিকতা। অবিচার এবং বিদ্বেষ । আমি জন্মেছিলাম আমি যা ছিলাম তার চেয়ে বড় কিছুর জন্য – আর তারচেয়েও বড় কিছু আমি হবো। কিন্তু মহানতা ব্যাপারটা বোধ হয়, অন্তত আমার বিক্ষিপ্ত ভাবনাচিন্তায়, কোন ভাবেই ভালোর সাথে সংযুক্ত নয় বলেই মনে হতো  আমার নিজস্ব জগতে এই ব্যাপারটা আমার বন্য জান্তব মানসিকতা দ্বারা অপরীক্ষিত ভাবেই থেকে যায়। লে আমি দাঁড়িয়ে থাকি এমন এক স্থানে যার  সামনে একটা শয়তানি ভাবনার সমুদ্র আমার পায়ে ক্রমাগত ঝাপ্টা মারতে থাকে  ।  নিজেকে মিশিয়ে দিই তার ভেতর আর ধেয়ে যাই ঝড়ের বেগে সামনের সমস্ত বাধা বন্ধনকে ঠেলে আমার লক্ষ্যের দিকে---ঠিক তখন একটা অদ্ভুত কিছুর প্রভাব আমার ভাগ্যের ওপর আছড়ে পড়ে।   অট্টহাসি হেসে  সে  বদলে দেয় তার গতিপ্রকৃতি এমন শান্তভাবেতে যার তুলনা করা যেতে পারে সেই সবুজ ঘাসে ভরা প্রান্তরের যাকে একটা শান্ত জলস্রোত সব সময় ঘিরে থাকে   ।

প্রথম পর্ব প্রথম পরিচ্ছেদ সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment