ভৌতিক রোমাঞ্চ কাহিনী।
“রাতের ডাক”...
[লেখাটি
প্রকাশিত হয়েছে পানকৌড়ি প্রকাশনের “একটু একটু গা ছম ছম” সংকলনে]
এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা
দেওয়া যায় না। আমি নিজে একজন যুক্তিবাদী
মানুষ।তাই এই কাহিনী প্রতাক্ষদর্শীর মুখ থেকে শুনেও বিশ্বাস করতে পারিনি। যার কাছে
শোনা তিনি আমার খুব চেনা মানুষ। তার
অনুমতি নিয়েই স্থান কাল পাত্র বদলে এটাকে
কাহিনীর আকারে পেশ করলাম। বাকিটা আপনাদের ব্যাপার। - লেখক।
যদিও পেশায় ডাক্তার তবু সময় পেলেই ছবি আঁকে
তিস্তা। তিস্তা চক্রবর্তী।। এই যেমন এখন আঁকছে।মরা চাঁদের আলোয় জমিদার বাড়ি। তিন
মাস ধরে আছে এই অস্থায়ী আস্তানাটায়। এটা একটা আউট হাউস। আর তারই জানলা দিয়ে দেখা
যাচ্ছে শতাধিক বছরের পুরনো জমিদার বাড়িটাকে। এই আউট হাউসটা ওই জমিদারবাড়িরই অংশ।
তৈরিও হয়েছিলো পারিবারিক চিকিৎসকদের থাকার জন্য। কিন্তু অজপাড়াগ্রামে
ডাক্তার নিয়ে আসা হলেও থাকেনি কেও বেশী দিন। ভালো মাইনে পেলেও সম্ভবত বৈচিত্রহীন
তার অভাবেই কেউ থাকেনি। এরপর সময় বদলেছে। দেশ স্বাধীন
হয়েছে।জমিদারী গেছে। গ্রামে গ্রামে তৈরী হয়েছে স্বাস্থ্য কেন্দ্র। নিয়মমাফিক
তিস্তার মতো নতুন ডাক্তারদের আসতেও হচ্ছে এরকম গ্রামে। তবে বেশিদিন কোন ডাক্তারই
এখানে থাকতে চায় না। জমিদারবাড়িটা ফাঁকাই
পড়ে আছে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বংশধরেরা ছড়িয়ে গেছে দেশে বিদেশে। একাধিক
অংশীদারের ঝামেলায় বাড়িটা বিক্রীও হচ্ছে না। যে তালাটা লাগানো আছে তার চাবিটা বুড়ো মালির কাছে থাকলেও অনুমতি নেই
ভেতরে ঢোকার।অবশ্য সেটা কেবল রটনা কিনা কে জানে। পুরোনো দিনের বাড়ি ফাঁকা পড়ে
থাকলে যা হয় , লোকমুখে বেশ কিছু ভুতুড়ে কাহিনী তৈরী হয়েছে। যেগুলো ওই
চিরাচরিত কাহিনীর মতই। নতুনত্ব কিছু নেই । বুড়ো মালি ছবিলাল অবশ্য বেশী কথা বলে
না। তিস্তাকে একটাই কথা বলে ছিল এখানে আসার দ্বিতীয় দিনের মাথায় – রাতে যেই ডাকুক
না কেন দরজা খুলবেন না দিদিমণি।
জীব বিজ্ঞানী বাবার মেয়ে এবং ডাক্তারি পড়ার সূত্রে তিস্তা
যথেষ্টই শক্ত মানসিকতার মেয়ে। ফলে যখন এই অজপাড়াগ্রামে
ওকে যেতে হবে, এবং একা, জানা গেল তখন ও
সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিয়েছিল।মায়ের আপত্তি থাকলেও বাবার সম্মতি্তে খামতি ছিল
না। না এখনও পর্যন্ত কোনও অশরীরীর আবির্ভাব ওর জীবন যাপনে বিঘ্ন ঘটায় নি। আর রাতেও
আজ অবধি কোনও রকম আহবান আসেনি, না ভুতের না মানুষের। ডাক্তারি কল ও পায়নি।
গ্রামের মানুষগুলো খারাপ না। অতি কৌতূহলও কেউ দেখায়নি।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রর কাজ আর ছবি আঁকা এবং বিশ্ব সাহিত্যের বই পড়ে দিনগুলো ভালই
কাটছে তিস্তার।
আশেপাশের গোটা কতক নিসর্গ দৃশ্য আঁকার পর ও
জমিদারবাড়িটাকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে আঁকা শুরু করেছে। গল্প উপন্যাস বা সিনেমায়
যে সমস্ত হন্টেড হাউস পড়া বা দেখা যায় তার সাথে এই বাড়ির এবং পরিবেশের দারুন
মিল। চারদিকে বড় বড় গাছ। সামনে অগোছালো
বিরাট বাগান। অব্যবহৃত ফোয়ারা। ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া ১২-১৪ টা সিঁড়িতে জমে আছে মরা পাতা। বিশাল কালছে
কাঠের দরজাটায় ঝুলছে এক ব্রিটিশ আমলের তালা। দিনেরবেলায় কাঁচ লাগানো জানলাগুলো ভেদ
করে ভেতরের কিছু দেখা যায় না। বরং একাধিক ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আবছা আলোয় ভেতরের
আসবাবপত্রের অবয়বগুলো একটা শিরশিরে রোমাঞ্চ জাগায় শরীর মনে। আর রাতে তো কথাই নেই। অপ্রাকৄত অনূভূতি এমনিই এসে যায়।
আজ দিনটা খুব ব্যস্ততায় কেটেছে তিস্তার। এর কম হয় এক এক
দিন। একের পর এক রোগী আসতে থাকে। দুপুরে খেতে খেতে তিনটে বেজে গিয়েছিল। তারপর আবার যেতে
হয়েছিল একটা বাড়িতে। দিনকয়েক আগে জন্মানো একটা শিশুকে দেখতে। সেখান থেকে আসার পথে
উঠলো ঝড়। কাল বৈশাখীর। যখন থামল চারদিকে তার তান্ডবের চিহ্ন। ওই বাড়ির একজন অবশ্য
পৌঁছে দিয়ে গেল তিস্তাকে। গুমোটভাবটা কেটে গিয়ে বেশ একটা স্বস্তি নেমেছে আব হাওয়ায়
। শরীর ক্লান্ত থাকলেও মনটা ফুরফুরে হয়ে ছিল তিস্তার। আকাশটাও ঝকঝকে। কদিন আগেই অমাবস্যা গেছে । কাটা
চাঁদের আলো আঁধারীতে আশেপাশের গাছগাছালি নিয়ে জমিদারবাড়িটা গা ছমছমে একটা দৃশ্য
সাজিয়ে বসে আছে।
এর একটা ছবি আঁকতেই হবে ঠিক করলো তিস্তা। সেটা করতে করতে রাত
দশটা বাজলো। কিছু রাতচরা পাখির ডাক আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ
ছাড়া সব নিস্তব্ধ। না এবার খেয়ে শুয়ে পড়াই ভালো। সারাদিনের খাটুনীতে চোখ জড়িয়ে
আসছে।
রাতের রান্নাটা ওর কাজের মাসী করে দিয়ে যায় সকালেই। গ্যাস
জ্বেলে একটু গরম করে নেয় তিস্তা প্রয়োজন মতো। লাগোয়া রান্না ঘরটায় গিয়ে সেটা করার
সময়েই শব্দটা শুনতে পেল ও। মচ মচ মচ......শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো। একটা মৃদু শিরশিরানি আনুভব করলো তিস্তা। আসলে
এটা একটা সময় আনুসারিক মানসিকতার । রোমাঞ্চ কাহিনী পড়ার ফল। এরকম সাতপাঁচ ভেবে
তিস্তা নিজেকে শান্ত করলো।
ডাল আর তরকারিটা গরম করে নিয়ে যেই খেতে বসেছে জেনারেটরটা
গেল বন্ধ হয়ে।
এ গ্রামে এখনও ইলেকট্রিকের লাইন ঢোকেনি। তাই মিনি
জেনারেটরের ব্যবস্থা।
নিকষ কালো একটা অন্ধকারের চাদরে যেন ঢেকে গেল তিস্তা। ভেসে
এলো একটা শীতল বাতাস রান্নাঘরের জানলা দিয়ে। কাল বৈশাখীর ঝড়ের পর এমনটা হয়েই থাকে।
চাঁদের মৃদু আলোয় চোখটা একটু সইয়ে নিয়ে তিস্তা উঠে হাত ধুলো। জেনারেটরটায় দু চার
চাপড়ে কোনও কাজ হল না দেখে অগত্যা টর্চ আনতে ঘরের দিকে গেল। ঠিক তখনি ওর কানে এলো
পুরোনো কোনো দরজা খোলার সেই চিরপরিচিত “ ক্যাঁ... আ...অ্যাচ” শব্দ। অনেক বড়ো ও
ভারি কোনো দরজা।
টর্চটা নিয়ে এসে
দুটো মোমবাতি জ্বালানোর পর একবার তাকাল জমিদারবাড়ির সদর দরজাটার দিকে। না
এখান থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই।
খাওয়া শেষে বাসন কোসনে জল ঢেলে, হাত মুখ ধুয়্ দুটোর একটা
মোমবাতি নিভিয়ে একটা নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। মশারী টাঙ্গানোর সময়েও চোখ গেল বাড়িটার
দিকে। কেউ কি এলো জমিদারবাড়িতে? না বেশী ভেবে লাভ নেই।
সকালে খোঁজ নিলেই হবে। গাছ পাতার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে আওয়াজ, দূর থেকে ভেসে
আসা শিয়ালের ডাক শুনতে শুনতে কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল তিস্তা।
“ঠক ঠক... ঠক ঠক” আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল
স্বপ্ন দেখছে বোধ হয়। কিন্তু না আবার “ঠক ঠক” – দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে। টেবিলে
রাখা ডিজিট্যাল টেবিল ক্লকটার দিকে তাকালো তিস্তা। রাত ১টা ১৭। এতরাতে আবার কে
এলো। অজান্তেই একটা মৃদু শিহরন জেনে খেলে গেল ওর মনে। রাতের ডাক??? মালির কথা মতো
চুপ করে থাকবে নাকি...
অবশ্য লড়াইতে জয়ী হল ওর ডাক্তারি মন... বলা যায় না খুব
অসুস্থ কোনো মানুষের জন্য কেউ এসেছেন।
- কে?
গমগমে একটা পুরুষকণ্ঠ উত্তর দিল – মিস
চক্রবর্তী, দরজাটা একবার খুলবেন, প্লিজ।
-কে আপনি?
-আমি শঙ্করনারায়ণ সিংহ। প্রতাপনারায়ন সিংহের পৌত্র।
-প্রতাপনারায়ন সিংহ ...মানে জমিদার প্রতাপনারায়ন সিংহ?
- হ্যাঁ। দয়া করে দরজাটা খুলুন , খুব দরকার।
- সে তো বুঝতেই পারছি ...কিন্তু এতো রাতে আপনি এখানে কি
ভাবে?
-সব বলছি আগে দয়া করে দরজাটা খুলুন।
- ওকে ওকে... ওয়েট অ্যা মিনিট প্লিজ...
- ও ইয়েস।
জেনারেটর এর স্যুইচটা দুবার খুটখাট করে ওর মনে পড়লো ওটাতো
বিকল হয়েছে । অগত্যা আবার মোম বাতি ।
রাতপোষাকের ওপর ঢোলা গেঞ্জীটা পড়ে নিয়ে দরজা খুল লো তিস্তা।
কাঁপতে থাকা মোমবাতির আলোয় দৃশ্যমান হলেন ফেল্ট ক্যাপ, সাদা
জামা ও ধুসর কোনো এক রঙের প্যান্ট পড়া একটি মানুষ। মুখটা খুব ভালো দেখা না গেলেও
সুদৃশ্য গোঁফজোড়া নজর এড়াল না তিস্তার।
-
বলুন কি দরকার ?
-
মিস চক্রবর্তী প্রথমে ধন্যবাদ দরজা এত রাতে
বিশ্বাস করে খোলার জন্য। আর দরকারটা হল আপনাকে একবার আমার সাথে যেতে হবে।
-
যেতে হবে!! কোথায়??
-
জমিদারবাড়িতে।
আগামীকাল শেষ কিস্তি...
-
কোথায় !!! জমিদার বাড়িতে? সেতো তালা বন্ধ পড়ে
আছে কবে থেকে?
-
হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন আপনি। তবে আপাতত ওটা খোলা
হয়েছে।
-
মানে?
-
আমরা কাল বিকেলেই এসে যেতাম। কাল বৈশাখীর ঝড়ে
রাস্তায় আটকে পড়েছিলাম। আর সেই ঝড়ের সাথে হওয়া বৃষ্টিতে ভিজে আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ
হয়ে পড়েছেন। ওর আবার শ্বাসটানের সমস্যা আছে। তাই আপনি যদি একটু দেখে আসেন বড় ভালো
হয়।
তিস্তার আবার মাথায় খেলে গেল বুড়ো মালির সতর্কবাণী
...
- কিন্তু এতো রাতে ....
- কোনো চিন্তা করবেন না মিস
চক্রবর্তী । মালিবাবা মানে ছবিলালই বললো আপনার কথা। আপনিইতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রর নতুন
ডাক্তার?
- হ্যাঁ ... ওকে
ছবিলাল যখন বলেছেন তখন ঠিকই আছে। আপনি একটু দাঁড়ান আমি রেডি হয়ে আসছি।
দ্রুত পোষাক বদলে নিয়ে ডাক্তারি ব্যাগটা নিয়ে
পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে এলো তিস্তা। আগন্তুক তখন অস্থির পদচারনায় মগ্ন
আউট হাউসের বারান্দায়। তিস্তাকে বের হতে দেখে এগিয়ে এসে হাত থেকে ব্যাগটা নিলে্ন
শঙ্কর নারায়ন। দরজায় ছোট্ট তালাটা লাগিয়ে তিস্তা বললো – চলুন।
মিনিট দুয়েক হেঁটে ওরা পৌছালো জমিদারভবনে ওঠার
সিঁড়িগুলোর সামনে। বিকেলের ঝড়েই সম্ভবত সব পাতা উড়ে গেছে। এদিক ওদিকে দুটো একটা পড়ে
আছে। শঙ্কর নারায়ণ এতো দ্রুততার সাথে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেলেন যে তিস্তার মনে হল যেন
ভেসে গেলেন। অবচেতন মস্তিস্ক আবার প্রভাব বিস্তার করছে পরিবেশ অনুসারে এটা ভেবে
তিস্তা নিজেকে শক্ত করলো। এই বাড়িটার ভেতরে ঢোকার ইচ্ছে সে এখানে আসার
পর থেকে মনে মনে লালনপালন করে এসেছে। সুযোগটা এলো, তবে অদ্ভুত
পরিস্থিতিতে।
“ক্যাঁ—অ্যা—চ” শব্দ করে দরজাটা যখন খুললেন শঙ্কর নারায়ণ তখন আর কোনো ভাবেই শরীরের
কাঁপুনিটাকে আটকাতে পারলো না তিস্তা। গায়ের প্রতিটি রোমকনায় অনুভূত হল এক শিরশিরে
ভাব। হৃদপিণ্ড লাফিয়ে প্রায় গলার কাছে পৌঁছে গেল।
ভেতরে হাল্কা আলো। দেওয়ালে লাগানো দেওয়াল গিরির
ভেতর জ্বলছে আলো। শঙ্কর নারায়ণকে অনুসরণ করে তিস্তা প্রবেশ করলো একটা বিরাট কক্ষে।
যার মধ্যে গোটা ছয়েক আউট হাউস ঢুকে যাবে। উত্তরপূর্ব কোনে এক বিশাল কাজ করা কাঠের
পালঙ্ক।পাশে একটি কাঠের টেবিল। এদিক ওদিকে গুটিকয়েক চেয়ার।টেবিলে একটি তামাটে রঙের
বাতিদানে দুটি মোমবাতি জ্বলছে। ঘর এবং সুউচ্চ ছাতের বেশীর ভাগটাই আঁধারে ঢেকে আছে।
একদিকে একটি বড় তৈলচিত্র। একেবারে জীবন্ত,অন্তত মানুষটির চোখদুটো, দেখে মনে হচ্ছে
যেন তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে।
তিস্তা এগিয়ে গেল পালঙ্কের দিকে। মোম বাতির
নিস্প্রভ আলোয় হাল্কা রঙের শাড়ী পরিহিতা এবার নজরে এলো ওর। শঙ্কর নারায়ণের কাছ
থেকে ব্যাগটা নিয়ে টেবিলে রাখতেই একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন শঙ্কর বাবু পালঙ্কের
পাশে। বসার পর মহিলার হাতটা হাতে নিয়েই শিউরে উঠলো তিস্তা। একেবারে বরফের মতো
ঠাণ্ডা। তাড়াতাড়ি ঝুঁকে নাকের কাছে হাতটা নিয়ে গেল ও। না, আশংকা অমূলক। নিঃশ্বাস
পড়ছে তবে অতি মৃদু।
ব্যাগ থেকে স্টেথো বার করে আগে নাড়ির গতি
পরীক্ষা করলো ।
- এক গ্লাস জল চাই।
বলতে না বলতে ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে জল পৌঁছে গেল
টেবিলে। কে দিলো ... কোথা থেকেই বা এলো সেটা ভাবার সময় নেই
তিস্তার। ব্যাগ থেকে ট্যাবলেটের স্ট্রিপটা বার করে ডাকল শঙ্কর নারায়ণকে।
- একটু এদিকে আসুন,
ওনাকে তুলে ধরুন...ট্যাবলেটটা খাওয়াতে হবে।
খাওয়ানোর পর ট্যাবলেটের স্ট্রিপটা শঙ্কর
নারায়নের দিকে এগিয়ে ধরে বললো – এতে আরো তিনটে থাকলো । মনে হয় না দরকার হবে। তবুও
দিয়ে রাখলাম। কাল সকালে এসে আমি আবার দেখে যাবো।
হাত জোড় করে শঙ্কর নারায়ণ গমগমে স্বরে বললেন- অনেক অনেক
ধন্যবাদ মিস চক্রবর্তী ।
তারপর প্রায় জাদু দেখানোর মতো করে একটা সাদা খাম বাড়িয়ে
ধরলেন – আপনার ফিজটা।
- ওটার প্রয়োজন নেই
মিঃ সিংহ। এমনিতেই আপনাদের আউট হাঊসে ফ্রীতে আছি। সামান্য হলেও এটা করা আমার
কর্তব্য।
- সেটা আপনার
মহানুভবতা । কিন্তু আমাদের বংশে বিনা পারিশ্রমিকে কিছু করানোর রেওয়াজ নেই। তার ওপর
অসময়ে আপনাকে ...
শঙ্কর নারায়নের বলার ভঙ্গীতে আর কথা না বাড়িয়ে
তিস্তা খামটা নিলো। বেশ মোটা। ঢুকিয়ে রাখলো ব্যাগে।
- চলুন আপনাকে
এগিয়ে দিয়ে আসি।
- না না আপনাকে আর
যেতে হবে না। আপনি বরং ওনার কাছে থাকুন। এটুকু পথ আমি চলে যেতে পারবো।
- ওকে অ্যাজ ইউ
উইশ। গুডনাইট মিস চক্রবর্তী। অ্যান্ড থ্যাঙ্কস এগেন।
- ইউ আর ওয়েলকাম
মিঃ সিংহ। গুডনাইট।
দ্রুত পায়ে ফিরে এসে দরজাটা কোনোমতে লাগিয়ে
পোষাক না বদলেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাতের ডাকে না যাওয়ার নিষেধাজ্ঞাটা অমান্য করলো
বলেই না আজ ও জমিদার বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পেল। কি মনে হতে উঠে একবার জানলার
কাছে গেল। না কিছু বোঝা যাচ্ছেনা। আর পাঁচটা দিনের মতোই আবছা অন্ধকারের চাদর গায়ে
দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ভবনটা।
ডিজিটাল ঘড়ির সময়মাফিক আওয়াজে ঘুম ভাঙল তিস্তার। টেবিলে
রাখা ব্যাগটার দিকে নজর পরতেই গত রাতের ঘটনাবলী সিনেমার মতো চোখের সামনে ভেসে এলো।
দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে চললো মিসেস সিংহ কেমন আছেন সেটা জানার জন্য।
গোটা চত্বরটা কালকের বৃষ্টিতে কাদা কাদা হয়ে আছে। কাল রাতে
তো বোঝা যায়নি। আসলে উত্তেজনায় এটা খেয়ালই করিনি ভাবলো তিস্তা।
সিঁড়ির কাছে পৌঁছে থমকে গেল ও। রাতে কি আবার ঝড় হয়েছিলো?
এতো পাতাওতো কাল ছিলনা এখানে!!
স্তম্ভিত হওয়ার ষোলোকলা পূর্ণ হল দরজাটার দিকে তাকিয়ে। এটা
কি করে সম্ভব?? একটা ঠাণ্ডা জলের স্রোত বয়ে গেল তিস্তার শিরদাঁড়া দিয়ে। আদ্যিকালের সেই
তালাটা একই ভাবে ঝুলছে। বেশ কিছুটা মাকড়শার জালসহ। একটা শুকনো পাতাও আটকে আছে
জালে। মাথাটায় একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তিস্তা দাঁড়িয়ে থেকে গেল।
- কি দেখছেন
ডাক্তার দিদি?
সম্বিৎ ফিরলো ছবিলালের আওয়াজে।
- না মানে ...
হ্যাঁ ... বলছি যে কাল রাতে কি এখানে কেও এসেছিল?
পরবর্তী ১০মিনিট একটানা বলে যাওয়া তিস্তার কথা
চুপ করে শুনল ছবিলাল। তারপর বললো
– আমিতো আপনারে বারণই করেসিলাম রাতে কেও ডাইকলে
দরজা খুইলবেন না। আপনার বাপ ঠাকুরদার পূইন্য আর আপনার মুনের জোর আপনারে বাঁচায়ে
রাখেছে। ইয়ার আগে তিনজনকে জ্ঞানহারা আর
একজনকে ...। তবে এসব লিয়ে আমি বাপু বেশী কিছু বুইলতে চাই না। মাফ কইরবেন।
সত্যিই আর একটাও কথা বের হলোনা ছবিলালের মুখ
দিয়ে।
ফিরে এলো ঘরে। চেয়ারে বসে থাকলো থম মেরে। মাঝে মাঝেই শরীরটা শিহরিত হচ্ছিল। ওর যুক্তিবাদী
মনটা ওকে বললো আসলে ও একটা স্বপ্ন দেখেছে। তাহলে কি ছবিলালের কথা সব সাজানো???
না স্বপ্ন তিস্তা দেখেনি। তার দুটো প্রমান ওর হাতে। এক, ওর ব্যাগে একটা ট্যাবলেটের স্ট্রীপ কম এবং
দুই, এই নোটগুলো। যা ছিল শঙ্কর নারায়নের দেওয়া সাদা খামে। এই ধরনের ১০ টাকার নোট
কেবলমাত্র বই এর ছবিতে বা সংগ্রাহকদের কাছেই দেখতে পাওয়া যায়। অন্ততঃ ১০০ বছর আগে এগুলোর
চল ছিল। তাহলে?????
সমাপ্ত
Darun. khubi suspensive.
ReplyDeleteDhanyobaad Rai
ReplyDelete