Search This Blog

Monday, June 5, 2017

ডসনের চিঠি [কল্প বিজ্ঞানের গল্প]


 এটি আমার লেখা প্রথম কোনও কল্পবিজ্ঞানের [এটা Science fiction নাকি fantasy সুধী পা্ঠকেরা ভালো বুঝবেন] গল্প যা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল। ইচ্ছেফড়িং নামের একটি পত্রিকাতে ।পোস্ট করলাম নিজের একটা “নস্টালজিয়া” কে আমার নতুন বন্ধুদের জন্য।

১৬ নভেম্বর ২০১৫
অবশেষে সমাধান হল রজার পিটারসন রহস্যের, আজ। ওর মৃত্যুর   দিন পর। পিটার ডসনের চিঠিটা পাওয়ার পর না এভাবে শুরু করলে আপনারা কি করে বুঝবেন। চলুন যাওয়া যাক  ওর মৃত্যুর ঠিক পরের দিনটিতে।
নভেম্বর ২০১৫
বিশ্বাস করুন আমাকে খুন করেছিল- ধরা পড়ার পর থেকে একটা কথাই সমানে বলে গিয়েছিল রজার। রজার পিটারসন।
গতকাল রাত ১টা বেজে ৫৮ মিনিটে বাথরুম যাওয়ার পথে কোনো ভাবে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গেছে রজার। দীর্ঘ ৭২ বছর এই অ্যাসাইলামে থাকার পর ১৮ই এপ্রিল ১৯৪৩ যেদিন গ্রেপ্তার হয় সেদিন থেকে মৃত্যুদিন পর্যন্ত। যে কথায় কে কোনোদিন বিশ্বাস করেনি। আমিও করিনি। আজ ডায়েরীটা পড়ার পরেও বিশ্বাস করতে পারছি না।
আট বছর আগে শৈল শহরের প্রান্ত দেশে এই মেন্টাল অ্যাসাইলামটায় আমি বদলি হই। রাঁচি থেকে এখানে পাঠানো হয় আমাকে। মাত্র ২৯ জন অসুস্থ মানুষ ছিল আট বছরে সংখ্যাটা বেড়ে ৩৪ হয়েছে এখন অবশ্য ৩৩। এখানকার সবচেয়ে প্রবীন ছিল রজার। ২০০৭ ওর বয়েস ছিল ৯০ কেস হিস্ট্রিটা পড়েই আলাদা একটা আগ্রহ তৈরি হয় ওর বিষয়ে
খুন করার দায়ে আজীবন কারা দন্ড কারাবাসের বদলে পাগলা গারদ। ফাঁসিই হত হয়তো হয়নি অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং সম্ভবত ব্রিটিশ বলে। রজার যাকে খুন করেছিল সেই নাকি খুন করেছিল রজার কে। অদ্ভুত এই কথাটির জন্যই আদালত রজারকে পাগল বলে রায় দেয়।
আচার আচরণ কথাবার্তা একে বারে স্বাভাবিক শুধু ওই কথাটি ছাড়া। প্রতিদিন ওকে এক বিশেষ কষ্টকর অবস্থা্র মুখোমুখী হতে হতো। রাত ১টা বেজে ১০ মিনিটে ওই সময় ওর গোটা শরীর শক্ত হয়ে যেত, অনেকটা মৃগী রোগীদের মতো। মিনিট ৪৫ স্থায়ী হতো অবস্থাটা। তারপর আবার স্বাভাবিক। কোনও মেডিসিনেই এর সুরাহা করা যায়নি।
দেখে মনে হতোনা রজারের বয়স নয়ের কোঠায়। ৪০ এর বেশী তো মনেই হতনা। একবার জানতেও চেয়েছিলাম, রহস্যটা কি রজার? উত্তরে হেসে বলেছিল, অভিশাপ। শ্যামলালের অভিশাপ। আমার মৃত্যু নেই ডাক্তার। আই অ্যাম ইমমরটাল। আমি অমর।
গত বছরে ওর সাথে একটা আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ওকে দেখলেই আমার বৃদ্ধ বাবার কথা মনে পড়ে যেত। কি চোখে আমায় দেখতো তা অবশ্য বলতে পারবোনা। তবে কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে ওর অনেক ব্যক্তিগত কথাই আমি জানতে পেরেছিলাম।
রজারের বাবা জ্যাক পিটারসন ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। বর্তমান মধ্যপ্রদেশ ছিল কর্মস্থান। সেখানেই বানিয়েছিলেন বাড়ি। ভারতেই শেষজীবন কাটানোর ইচ্ছে ছিল ইচ্ছে পূরন হয়নি। রজারের কলেজ জীবন শেষ হওয়ার আগেই আকস্মিক হৃদ গোলযোগে দেহাবসান হয় তার। মা আগেই মারা গিয়েছিলেন। ভাই বোন না থাকায় ঝাড়া হাতপা স্বাধীন জীবন হয়ে যায় রজারের। এর পরেই বিশেষ কাজে ভারতে আসে রজার এবং ঘটনাচক্রে আজ সে মানসিক অ্যাসাইলামের চিরস্থায়ী সদস্য।  
মাস পাঁচেক আগের কোন একদিন রজার আমাকে বললো, সঞ্চিতা আমাকে একটা পুরনো ডায়েরী আর গোটা কতক কলম দিতে পারবে? আর হ্যাঁ একটা ব্রাউন এনভেলপ যাতে ওই ডায়েরীটা ঢোকানো যায়।
ঠাট্টার ছলে বললাম, আত্মজীবনী লিখবেন নাকি মিঃ পিটারসন?
শুনে আমার হাতটা চেপে ধরে এমন একটা কণ্ঠস্বরেপ্লিজ সঞ্চিতাবললো যে আর কিছু বলতে পারলাম না। অ্যডমিনিস্ট্রেটরের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দিলাম একটা ডায়েরী। পুরনো নয় নতুনই। আর কিছু ইউজ এ্যন্ড থ্রো পেন এবং একটা এনভেলপ।
ঘণ্টা তিনেক আগে সেই ডায়েরীটা আমাকে দিয়ে গেছেন ওয়ার্ড মাস্টার। কারন ওটা ঢোকানো ছিল সেই ব্রাউন পেপারের এনভেলপে ওপরে বড় বড় করে লেখা ONLY FOR DR. SANCHITA
ডায়েরীটার মাস ছয়েকের পৃষ্ঠা ব্যবহার হয়েছে। প্রথম দুমাসের পাতায় কিছুই নেই লেখা জাতীয়। নাহ ঠিক বলা হলনা কথাটা! লেখা আছে ইংরেজি অক্ষ a b c d প্রথম দিকে বাচ্চাদের মতো আঁকা বাঁকা বড় বড়। তারপর ছোটো হয়েছে স্বাভাবিক লেখার আকারে। আসতে আসতে হয়েছে পাঠ যোগ্য।
মুল লেখার শুরু এভাবে ... “Almost after a long 70 years …. প্রায় ৭০ বছর বাদে লিখতে চেষ্টা করে দেখলাম কিছুই পারছি না। অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। অবশ্য শুধুমাত্র অনভ্যাস নয় নতুন ধরনের এই কলমগুলিও অন্যতম কারন।
তবে অভ্যাসে কি না হয়। দু মাস ধরে চেষ্টার ফল এই লেখা। অনেকটা আয়ত্তে এসেছে তবুও হয়তো পড়তে অসুবিধা হবে তোমার।
বিশ্বাস করো সঞ্চিতা যাকে আমি খুন করেছিলাম সেই আমাকে খুন করেছিল। ভাবছো তো আবার সেই পাগলের প্রলাপ। অনুরোধ একটাই , কষ্ট করে গোটাটা পড়ে তবেই রায় দিও ...”
পড়েছি গোটাটা। কিন্তু আগেও বলেছি আবারো বলছি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা আছে লেখাটায় সে সব বাদ দিয়ে মূল ঘটনা সাজিয়ে দিচ্ছি আপনাদের সামনে। বিশ্বাস যেমন করতে পারছি না তেমনি প্রশ্নও জাগছে মনে একজন ৯০+ বয়সী মানুষ কি শুধু শুধু একগাদা মিথ্যে কথা লেখার জন্য কষ্ট করে আবার লেখা শিখলেন?
রজার পিটারসন এবং পিটার ডসন। দুজনের নামের মধ্যে পিটার কথাটা থাকা এবং বিভিন্ন পছন্দে মিল থাকায় ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বন্ধুত্ব জমে উঠতে সময় লাগেনি খুব বেশি। প্রথম জন খাঁটি ব্রিটিশ দ্বিতীয়জন জন্মসূত্রে দক্ষিন আফ্রিকান রক্তে ব্রিটিশ
দু বন্ধুরই অন্যতম প্রিয় বিষয় প্রাণ রহস্য। সময় পেলেই ওরা নিয়ে আলোচনা করতো এর মধ্যেই ওদের হাতে এসে যায় মেরি শেলীর যুগান্তকারী রচনাফ্রাঙ্কেন্সটাইন পড়ার পর দুজনেরই বিশ্বাস দৃঢ় বদ্ধ হয় যে বৈদ্যুতিক শক দ্বারা মৃত প্রানীকে জীবিত  করা সম্ভব। অবশ্য শুধুমাত্র শক দিলেই হবে  না, কিছু রাসায়নিক উপাদান দেহে প্রয়োগ করতে হবে। তর্ক বিতর্ক আলোচনা সমালোচনা চলতে থাকে। একদিন খাতায় কলমে তারা প্রমান পায় তাদের ভাবনা একদম সঠিক। [ এবার রজারের ডায়েরী থেকে কিছু নির্বাচিত অংশ]
... ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি পাওয়ার পর চারটে দিন ধরে অনেক ভাবলাম। খাতায় কলমে যা সত্যি তার বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্রিটেনে সম্ভব নয় অতএব...
ডসনকে জানালাম সে রাজি থাকলে গবেষণার বাকি কাজটা ভারতে গিয়ে করবো। এক কথায় রাজি হয়ে গেল ও। শুধু গবেষণা নয় ভারত ভ্রমনের ইচ্ছেও ওর অনেকদিনের।
দু সপ্তাহ হল এসে পৌঁছেছি ভারতে। খোঁজ খবর নিয়ে যোগাড় হয়েছে একটা বাড়ি। বাবার তৈরী বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। কোন এক মিঃ রবার্ট বানিয়েছিলেন। চারদিকে জঙ্গল। নির্জন। আমাদের গবেষণার পক্ষে আদর্শ। কিনেই নিলাম বাড়িটা।
আগামী সপ্তাহেই এসে যাবে সব সরঞ্জাম। মৃত পশু পাখি যোগাড় করে রাসায়নিক তরলে সংরক্ষণ করছি।
দেখতে দেখতে কেটে গেল এক বছর ভারতে আসার পর। একের পর এক পরীক্ষায় সফল আমরা। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার বেশী স্থায়ী হচ্ছে না নবজন্ম। কেবল মাত্র আমরা দুজনা বুঝতে পারি এমন সাংকেতিক ভাষায় লিখে রাখছি গবেষণার খুটিনাটি। এই লেখার শেষে সেই সংকেত তার মানে দেওয়া থাকলো মিরাকলের আশায়। যদি কোনদিন
কোনোভাবে নদীর জলে ভেসে যাওয়া গবেষণার নোটস ফিরে পায় কেও।
১৫ এপ্রিল ১৯৪৩
গতকাল এখানকার এক আদিবাসী  যুবকের মাধ্যমে এক ৪৮-৫০ বছরের মানুষের মৃতদেহ যোগাড় করা গেছে। কৃতিত্ব প্রাপ্য ডসনের। ইতি মধ্যে বেশ ভালো হিন্দী রপ্ত করে নিয়েছে। আমিও কাজ চালানো গোছের পারছি।
মৃতদেহটা থেকে গন্ধ ছাড়ছে শক্তও হয়ে গেছে। দিন দুয়েকের মরা মনে হল। ৩০০ টাকা নিল যুবকটা। ভাবভঙ্গী ভাল লাগলো না যুবকের। কেমন যেন একটা হিংস্র ভাব চোখে। বৃদ্ধ টির মাথার পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। রক্ত শুকিয়ে  চুলে দলা বেঁধে গেছে। খুন বলেই মনে হচ্ছে। আমি ন্দেহের কথাটা ডসন কে বল তেই বল লো, ডোন্ট ওরি।
১৬ এপ্রিল ১৯৪৩
রাত ১১টা ৫৬ নিনিটে নব জন্ম দিয়েছি মানুষটাকে। মাথার কাটা দাগ মিলিয়ে গেছে। চুড়ান্ত শক দেওয়ার ৪১ মিনিট বাদে চোখ খোলে লোকটির। হার্টবিট আরও ১৩ মিনিট সময় নেয় স্বাভাবিক হতে। চেতনা ফিরে পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল লোকটি।  স্বাভাবিক আমরাও পৌঁছে গিয়েছিলাম উত্তেজনার চরমে। পরীক্ষার নিশ্চিত সাফল্য দেখে। বাকি ২৩ ঘণ্টা মিনিট আমি দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তন নোট করে গিয়েছি সমান তালে।
 ডসন যখন শ্যামলাল(লোকটির নাম)কে সব কথা জানালো, ভয় অবিশ্বাস মেশানো অভিব্যক্তিতে ছেয়ে গেল মুখটা। বিস্ময়ের রেশ কেটে যাওয়ার পর একটানা অনেক কথা বলে গিয়েছিল শ্যাম। তার ভেতর আসল কথা ছিল একটাই। ভগবানের নিয়মের ওপর হাত চালানো উচিত নয়। কথাটা বুঝতে পেরে হেসে উঠেছিলাম আমি। কারন আমি জানি ভগবান টগবান সব মিথ্যে। আসলে নিয়ম মাফিক কিছু জৈবিক ক্রিয়ার একত্রতার ফসল প্রান। ডসন কিন্তু হাসেনি। উলটে আমাকে ধমকে উঠেছিল রজার ইউ শ্যূড নট লাফ অ্যাবাউট দ্য ফেইথ অফ পার্সন।
-মুঝে ছোড় দিজিয়ে সাব। মুঝে ঘর জানা হ্যায়।
প্রাণ ফিরে পাওয়ার ঘণ্টা ২১ মিনিট বাদে বললো শ্যাম লাল।
সম্ভব নয়, জানালাম আমি।
-কিঁউ?
-তোমার আয়ু আর মাত্র কয়েক ঘন্টা।
-তো ফির মুঝকো পহেলে জ্যায়সা বনা দিজিয়ে। মার ডালিয়ে হামে।
-সেটাও সম্ভব নয়।
-কিঁউ সাব, কিঁউ?
- আমাদের গবেষণার মানে কাজের স্বার্থে।
- হে ভগয়ান। ভাগ মারি হামার। ইয়ে কাহা ফাসা দিয়া হামে।
দুফোঁটা জল গড়িয়ে এসেছিল শ্যামের চোখ দিয়ে।
আরো ১১ ঘণ্টা পর...
সহসাই কেশে উঠলো শ্যামলাল। সাথে সাথেই ফেটে গেল গালের চামড়া। কিন্তু কোনো রক্ত বের হল না।
ঘরঘরে স্বরে শ্যামলাল বললো বহুত তকলিফ হো রহা হ্যায় সাব। বহুত কষ্ট হো রহা হ্যায়। ভগওয়ান আপকা ভালা করেগা, মুঝে মার ডালিয়ে। ইয়ে মেহেরবানি কিজিয়ে সাব।
ডসনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে ও। বললাম কেন অযথা অনুরোধ করছ শ্যাম। যাকে জীবন দিয়েছি তাকে মারতে পারবো না।
শুনতে পেলাম ডসনের গলা ডু ইট রজার। অ্যাজ হি উইশ।
-আর ইউ ক্রেজি ডসন? দিস ইজ আওয়ার রিসার্চ। ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল!
-প্লিজ রজার।
- নো মোর ওয়ার্ড ফ্রেন্ড।
পরবর্তী এক ঘন্টায় শ্যামলালের দেহের অনেক গুলো জায়গা ফেটে ফেটে গেল।রক্তপাত হীন ভাবে। মাথার পেছনের কাটা দাগটা আবার পরিস্ফুট হয়েছে। শ্যাম সমানে একই আর্জি জানিয়ে চলেছে। আমি সিদ্ধান্তে অনড়। ডসন বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে।
শ্যামলাল আমায় ডাকলো রজার সাব জরা শুনিয়ে।
কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল ওর তখন। জড়িয়ে যাচ্ছিলো উচ্চারণ। গেলাম কাছে।
সাব ইয়ে আখরি বার ক্যাহ রাহা হু মুঝে মার ডালিয়ে?
ওহ গড...কি করে যে তোমায় বোঝাই? আমি পারবো না।
সাব মেরা বাত মান লিজিয়ে। উপরবালে কে কানুন মে হাত মত দালিয়ে।নেহি তো একদিন এ্যায়সা আয়েগা জব আপ খুদ মওত কে ভিখ মাগেঙ্গে আউর মওত নেহী মিলেগা।
বুঝলাম আর কোনো উপায় না দেখে মেন্টাল প্রেসার দিতে চাইছে শ্যাম। তাই পাত্তা না দিয়ে সরে এসেছিলাম ওর কাছ থেকে। ডিয়ার সঞ্চিতা, সেদিন ওর কথা মানলে হয়তো আজ আমাকে এই লেখা লিখতে হতোনা।
২৪ ঘণ্টা পূর্ণ হওয়ার ১০ মিনিট আগেফিরে এসেছিল ডসন।ত তক্ষনে কমে গিয়েছিল শ্যামের হৃদপিণ্ডের গতি। রক্তচাপ।শরীরের সজীবতা। পারিনি ভাঙতে সময়ের অমোঘ বন্ধন। ঠিক ২৪ ঘণ্টাতেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব। এক দেহে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় কোন ফল হয়না জেনেও আরো একবার চেষ্টা করেছিলাম জীবনদানের। কোনও লাভ হয়নি।
২৪ ঘণ্টারও বেশি সময়ের টানটান স্নায়ুচাপের পর সারা শরীর অবসন্ন বোধ করছিল। দরকার বিশ্রামের। গবেষণা সংক্রান্ত কাগজপত্র সব কালো চামড়ার ফোলিও ব্যাগে পুরে ডসনকে বললাম আমি বাড়ি যাচ্ছি। তুমি সব বন্ধ করে এসো।
-এতো রাতে কি না ফিরলেই নয় রজার?
-না বন্ধু, আর পারছি না। শরীর আরাম চাইছে। দীর্ঘ পথচলার শেষের আরাম।
- দেন ওকে, অ্যাজ ইউ উইশ। গুডনাইট।
-গুডনাইট ডিয়ার ফ্রেন্ড। সি ইউ টুমরো।
-ইউ টু।


বাড়ি ফেরার পথটা একটু আঁকা বাঁকা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। জমাট অন্ধকার। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ। সাথে অচেনা রাতচরা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। তিন ব্যাটারীর টর্চটা জ্বালিয়ে অভূত পূর্ব ঘটনাটির কথা ভাবতে ভাবতে ফিরছি। সহসা পেছন দিকে কেমন যেন একটা আওয়াজ শুনলাম বলে মনে হল। দাঁড়িয়ে গেলাম। থেমে গেল শব্দটাও। তবু সন্দেহ হওয়াতে ঘুরে দাঁড়ালাম। টর্চের আলোয় দেখতে পেলাম সেই যুবকটিকে। যে শ্যামলালের মৃতদেহ এনে দিয়েছিল। হাতে একটা লাঠি। গোটা শরীরটা কেঁপে উঠলো অদ্ভুত আশঙ্কায়। অশুভ কিছু একটা যেন হতে চলেছে। ঝোলানো ব্যাগটা বুকের কাছে চেপে ধরলাম। হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছিল টেনিস বলের মতো। নিজের কানে নিস্তব্ধ রাতে শুনতেও পাচ্ছিলাম তার শব্দ।
কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম হোয়াট ডু ইউ ওয়া... কেয়া চাহিয়ে?
হাত তুলে ব্যাগটা দেখিয়ে বললো উয়ো থলিয়া।
-ইস্মে কুছ নেহি হ্যায়। অনলি সা...
- বাত মত বাড়াইয়ে। দে দিজীয়ে...
গবেষণার সব কাগজ ওই ব্যাগে। প্রানের চেয়ে প্রিয় ওই ব্যাগ তখন আমার কাছে। বললাম তুম কাল বাংলো মে আজাও। যো কুছ বোলনা হ্যায় উহা পর বোলনা।
কর্কশ হিংস্রস্বরে  বললো - আপ থলিয়া দেগা কে নেহি? মুঝে আচ্ছি তরাহ সে মালুম হ্যায় উস্মে বহুত সারে রুপিয়া হ্যায়।
নেহি নেহি তুমকো লতি হো রহা হ্যায়। ইস্মে থোড়া কাগজাদ...
ঝুট মত বোলিয়ে! সিধা সিধা দে দিজিয়ে নেহিতো ...
নেহি তো কেয়া হোগা?
এক পা এগিয়ে এলো যুবকটি। লাথির মাঝখানটা একহাতে ধরে অন্যহাতে একবার ঘুরিয়ে টান দিতেই বেরিয়ে এলো চকচকে জিনিসটা। একটা সরু লোহার লম্বা ফলা। ভারতে একে বলে গুপ্তি। বুঝে গেলাম কি হতে চলেছে। দু পা পিছিয়ে ঘুরে পালাতে গিয়ে পড়ে গেলাম। সাথে  সাথেই শিরদাঁড়ার পাশে তীক্ষ্ণ ফলাটা ঢুকে গেল বুঝতে পারলাম। টর্চের আলো থাকা সত্বেও আমার চোখে নেমে এলো একরাশ কালো অন্ধকার।
 [রজারের ডায়েরীর পরের কিছু পাতার লেখনীর সারমর্ম।]
দুর্ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার মিনিট ২৫ বাদে ডসন সব গুছিয়ে গবেষনাগার বন্ধ করে ফেরার পথে রক্তাক্ত মৃত অবস্থায় পায় রজারকে। কালো চামড়ার ব্যাগটা ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে আবার গবেষনাগারে ফিরে যায় ডসন। অবশ্যই রজারের মৃতদেহ নিয়ে। পর পর নিয়ম মেনে প্রয়োগ করে সঞ্জীবনী শক। জীবন ফিরে পায় রজার। ডসনের কাছ থেকে জেনে নেয় যুবকটির বাড়ির ঠিকানা। কোনও কথা শোনে না ডসনের। ভোরের আলো ফোটার সামান্য পরেই পৌঁছে যায় যুবকটির বাড়ি। প্রথমে সামনে আসতে রাজি না হলেও রজারের কথায় আশ্বস্ত হয়ে কথা বলতে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। জানায় টাকা পয়সা কিছু না পেয়ে ব্যাগটা নদীতে ফেলে দিয়েছে। এটা শুনেই মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে রজারের। ব্যাগটা পেলে যা হয়তো তোনা সেটাই ঘটে যায়। ভয় দেখাবে বলে নিয়ে আসা রিভলবারটা বার করে সকলের চোখের সামনে গুলি করে মারে যুবকটিকে।
পৈত্রিক বাড়িতে ফিরে আসার ঘণ্টা চারেক বাদেই রজারকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিষ।ইছে ছিলনা সামান্য এক নেটিভ খুনের দায়ে রজার কে গ্রেপ্তার করার। কিন্তু তখন দেশ জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঢেউ। অতিরিক্ত ঝামেলা না বাড়াতেই ওরা এটা করে। কোনো কথা না বলে ধরা দেয় রজার। কারন সে জানতো কেওই তার আর কিছু করতে পারবে না, আইন তো নয়ই। পৃথিবীতে তার মেয়াদ আর কিছু ঘণ্টা।
[আবার রজারের ডায়েরী থেকে।]
বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম। এক সময় পেরিয়ে গেল ২৪ ঘণ্টা। কোথায় মৃত্যু? কোথায় কষ্ট?? আরও বেশি সুস্থ সতেজ মনে হচ্ছিল নিজেকে।
মাঝে মধ্যেই চলছিল মামুলি পুলিশি জেরা। ব্রিটিশ বলেই কোনও শারীরিক নির্যাতন করেনি ওরা আমার ওপর একটাই প্রশ্ন ওদের, কেন খুনটা করলাম আমি? কোন উত্তর দিইনি প্রথম দিকে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টাতেও যখন কিছু লো না তখন সত্যি কথাই বললাম। ওই যুবকটা আমাকে খুন করেছিল তারই প্রতিশোধ নিতে আমি এই কাজ করেছি। ওদের মুখ গুলো প্রথমে বিস্ফারিত হল বিস্ময়ে। তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। সব কথা খুলে বলা আমার পক্ষে অসম্ভব তাই আমি ওই একটা কথাই বলে গেলাম।
একই প্রশ্ন একই উত্তর। সারাদিন চল লো একই ঘটনা। ডসন কিন্তু একবারও এলো না। ঠিকানা জানিয়ে বললাম খোঁজ নিতে। রা জানালো তালা ঝুলছে মিঃ রবার্টের বাড়িতে। আমার নিজের বাড়িতেও কে আসেনি।
স্বাভাবিক ভাবেই ওদের চোখে আমি অপ্রকৃতস্থ সাব্যস্ত হলাম। আদালতও একই রায় দিলো। আমার নতুন ঠিকানা  হল মেন্টাল অ্যাসাইলাম।
ডসন আমাকে নবজন্ম দিয়েছিল রাত ১টা বেজে ১০ মিনিটে। মাস কয়েক পর থেকে ঠিক ওই সময়ে আমার শরীরে প্রতিদিন এক এমন টানাপোড়েন শুরু হয় যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব ন্য়। শ্যামলালের মতই মৃত্যু কামনা করি ওই সময়টায়। কিন্তু মৃত্যু আমাকে ছুঁয়েও দেখে না। আত্মহত্যা করার মতো মানসিক দৃঢ় আমি নই। দিন দিন আমার শরীর আরও সজীব হচ্ছে।
সঞ্চিতা যদি তোমার আগে আমার মৃত্যু হয় তবেই রহস্য তুমি জানতে পারবে। নচে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও ... জানিনা সে অপেক্ষা হবে কতদিনের।
লেখার শেষ এখানেই এরপরে কিছু সঙ্কেত তাদের মূল অর্থ লেখা আছে যা আর কোনওদিনই কাজে লাগবে না ভেবেছিলাম।
রজারের মৃত্যুর দিন পর।
কেন বেঁচে গিয়েছিল রজার? কেন বার বার পরীক্ষিত ফলাফল পালটে গিয়েছিল আবিষ্কারকের বেলায়? এসব উত্তর হয়তো কোনোদিনই জানতে পারতাম না যদি না রজারের কেস হিস্ট্রি ফাইলটা আবার আমারহাতে আসতো। ওর মধ্যে ডেথ সার্টিফিকেটটা রাখতে গিয়ে অন্যমনস্কভাবে একটা পাতা উলটানোর সময় চোখে পড়লো নোটটা। রাঁচির পাগলা গারদে থাকে ২১ তম বছরে একটা চিঠি এসেছিল রজারের নামে। কে পাঠিয়েছিল জানা যায়নি। কিন্তু এসেছিল দক্ষিন আফ্রিকা থেকে। দক্ষিন আফ্রিকা? তবে কি??
খোঁজ নিয়ে জানলাম চিঠিটা এখনো রাঁচিতেই আছে।
আরও দিন পর।
অপেক্ষার অবসান। ঘন্টা  দুয়েক আগে চিঠিটা হাতে পেয়েছি। সে সময়ে খুলে দেখেছিল ওখানকার আধিকারিকেরা। কিছু বুঝতে না পেরে পাঠিয়ে ছিল গোয়েন্দা দপ্তরে। তার প্রমানও আছে। কিন্তু ওরাও বিফল হয়েছিল রজারদের সঙ্কেত ডিকোড করার ক্ষেত্রে। ডায়েরীতে লেখা সঙ্কেতলিপি কাজে লেগে গেল। আমার অনুমান সঠিক, চিঠিটা পিটার ডসনের।
ডিয়ার
রজার
জানিনা চিঠি তোর হাতে পৌঁছাবে কিনা? চিঠি পেলে অবাক যে হয়েছিস এটা নিশ্চিত। হয়তো বা গালাগালিও দিচ্ছিস। দিতেই পারিস ওটা আমার প্রাপ্য। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তোর সাথে আর কোন যোগাযোগ না রাখার কারন জানাতেই এই চিঠি লিখলাম। এটাও জানিনা কথা গুলো কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে তোর কাছে।আমার সাক্ষ্য তোকে পাগ লাগারদ থেকে বাঁচাতে পারলেও কারাবাস তোর হতই। কারন খুন যে তুই করেছিলি এটাতো সত্যি। আরো বড় সত্যি হল আমি ভয় পেয়েছিলাম। যে সময়ে আমরা ভারতে ওই পরীক্ষা করছিলাম সে সময়ের পক্ষে ওই গবেষণা অনেক এগিয়ে থাকা সময়ের। যুগে যুগে যা হয়েছে আমাদেরও তাই হতো। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ হয় ডাইনীবিদ্যা অথবা ভগবানের বিরোধিতা করার অপ রাধে আমাদের মেরে ফেলতো। কোনও আইনই আমাদের বাঁচাতে পারতো না জনরোষ থেকে।
এছাড়াও বেআইনি ভাবে যোগাড় করা শ্যাম লালের মৃত দেহটার পক্ষে কোন সঠিক যুক্তি ওই সময়ে দেওয়ার কথা আমি ভাবতেও পারিনি। আরো একটা খুনের দায় চাপতো নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ আমি বন্ধুকৃত্য পালন করিনি। আমি ক্ষমা চাইছি তার জন্য। করা বা না করা তোর হাতে।
অবশ্য আরও একটা যুক্তি আমার আছে নিজের সাফাই এর জন্য। একটা প্রশ্নর সমাধান করা। সেটা হল তোর জীবন রহস্য। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েও কি ভাবে বেঁচে থাকলি তুই? এর উত্তর খূঁজে বের করার আগ্রহও অন্যতম কারন আমার পালিয়ে যাওয়ার। বিগত বছর গুলোতে আবার কেঁচে গণ্ডূষ করেছি। সব কাগজ পত্র তো ওই হতভাগাটা জলেই ফেলে দিয়েছিল। নাহ নতুন করে কাকে জীবন দেওয়ার চেষ্টা করিনি। অত আর্থিক সামর্থ্য আমার নেই। তাই খাতায় কলমেই শুরু করি উত্তর খোঁজার কাজ। পেয়েছি সম্ভাব্য উত্তর। আর তাই এই চিঠির অবতারনা।
আমরা শ্যামলাল পর্যন্ত যতগুলো পরীক্ষা করেছিলাম সবগুলোই দুই বা তিনদিনের পুরনো মরা দেহ ছিল। দেহ এবং মস্তিষ্ক কোষেরা সম্পূর্ণ ভাবে মৃত। হারিয়েছে কর্মক্ষমতা। আমাদের তৈরি রাসায়নিক তাকে সাময়িক উজ্জীবিত করছিল মাত্র। যার ফলে শক পেয়ে কাজ শুরু করলেও ওরা পারেনি নতুন করে কোষ গঠন করতে। ফলে নবজন্ম কখনই দীর্ঘায়িত হয়নি।
তোর ক্ষেত্রে ঘটনাটি ঘটেছিল সম্পূর্ণ আলদা রকম। মৃত্যুর ঘণ্টার মধ্যেই প্রয়োজনীয় পদ্ধতি প্রয়োগ হয়েছিল তোর শরীরে। দেহ মস্তিষ্ক কোষেরা তখন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি। আমাদের রাসায়নিক অনেক বেশী প্রানবন্ত করে দেয় ওগুলোকে। বাকি কাজটা ওরাই করে নেয়। আমার অনুমান সঠিক হলে তোর শরীরে বয়সের ছাপ পড়বে সাধারন মানুষের চেয়ে অনেক ধীরগতিতে। দুর্ঘটনা না ঘটলে তোর মৃত্যু কবে হবে তার কোন ঠিক ঠিকানা থাকবে না।
ওকে বন্ধু, এখানেই থামলাম। আরও একবার ক্ষমা চাইছি। সঙ্কেত মাধ্যমেই লিখলাম। আশা রাখছি ভুলে যাসনি।
তোর
একান্ত প্রিয়
ভীতু ক্ষমা প্রার্থী বন্ধু
পিটার ডসন
১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৪
সমাপ্ত।





4 comments: