Robert
Silverberg এর Back from the grave গল্পের ভাবানুবাদ
অবশেষে...মুক্তি...
প্রতিম দাস
০০০০০
চেতনায় ফিরে আসতেই ওঠার চেষ্টা করলেন ম্যাসী। একটা অসহ্য
রকমের যন্ত্রনার অনুভুতি ছড়িয়ে আছে সারা শরীরে। মনে হচ্ছে মৃত্যু যেন পাকেপাকে
জড়িয়ে রেখেছে ওকে। চারপাশের হাওয়াটা কেমন যেন ভ্যাপ্সানো, চ্যাটচেটে, হাল্কা
দুর্গন্ধময় । সাথেই অন্ধকার।
বেডরুমের জানলাগুলো মনে হয় লাগানো আছে । সেজন্যই এরকম দমবন্ধ
করা পরিবেশ মনে হচ্ছে। ‘লুইজি! লুইজি!’ ডাক দিলেন স্ত্রীর উদ্দেশ্যে। যাতে সে কোনো পরিচারিকাকে পাঠিয়ে দেয় যে পর্দাগুলো সরিয়ে জানলা খুলে ঘরে আলো বাতাস আসার পথ করে দেবে।
নিজের গলার আওয়াজ কেমন যেন চাপাচাপা ঠেকলো নিজের কানেই। মনে
হলো কাছাকাছি কিছু থেকে ধাক্কা খেয়ে যেন ফিরে এলো।
‘লুইজি !! কি হলো শুনতে পাচ্ছোনা নাকি! আমি ডাকছি যে!’
কোন উত্তর দিলোনা কেউ।
চারপাশের উষ্ণ চ্যাটচেটে ভাবটা ম্যাসীর ভালো লাগছিল না। না
এখন যা মনে হচ্ছে আমকেই উঠে জানলাগুলো খুলতে হবে। কনুইতে ভর দিয়ে উঠতে গেল একপাশে
কাত হয়ে। সাথে সাথেই ম্যাসী ভালোভাবেই বুঝতে পারলো আপাতত ও যেখানে আছে সেটা বিছানা
নয়। এটাও বুঝতে পারলো উঠে বসার উপায়ও নেই। এক সীমাহীন আতঙ্ক ওকে ঘিরে ধরলো।
আঙ্গুল দিয়ে মাথার
ওপর দিকে ছুঁয়ে বুঝতে পারলো ইঞ্চিখানেক জায়গা আছে ওখানে। মসৃণ স্যাটীন ধরনের কাপড় লাগানো চারপাশে।
বাঁপাশে, ডানপাশে, নিচে উপরে সব জায়গায় ।
নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে এখন। মনে হচ্ছে বাতাস যেন কমে
গেছে। নড়াচড়া করার মতো একটুও জায়গা নেই । যেটার ভেতর ও শুয়ে আছে সেটা একেবারে ওর
শরীরের লম্বা চড়ার মাপে টায়েটায়ে বানানো।
আর এরকম জিনিষ এক মাত্র বানানো হয় বিশেষ প্রয়োজনে ।
ম্যাসীর মনে হচ্ছিল অদৃশ্য দুটো হাত যেন ওর গলা চেপে ধরছে।
ও ভাবলো – মাই গড! ওরা ভুল করে ফেলেছে! ওরা ভেবেছে আমি মরে গেছি। আমাকে ওরা কবর
দিয়ে দিয়েছে! আমি—আমি—মরিনি ---জ্যান্ত কবরস্থ হয়েছি!!!
চরম সত্যিটাকে মেনে নেওয়ার জন্য বেশ কিছুক্ষন চুপ করে শুয়ে
থাকলো ম্যাসী। না কিছুতেই উদ্বেগগ্রস্থ হওয়া
চলবে না। সেটা করার অর্থ তাড়াতাড়ি মৃত্যুকে ডেকে আনা। শান্ত থাকতে হবে। কিছু একটা
উপায় বার করতে হবে, উত্তেজিত হলে চলবে না।
ও এখন কফিনের ভেতর। যেখানে জায়গা খুব কম। হাওয়াও কম। এর
ভেতরে যারা থাকে তাদের হাওয়ার দরকার হয় না।
কিছুটা হাওয়া এখনো আছে এর ভেতর। আর সেটা কমে যাচ্ছে। ওকে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস
নিতে হবে।
আচ্ছা এমনওতো হতে পারে ওরা ওকে কবর দেয়নি। হয়তো কোন
ফিউনেরাল পার্লারে ওকে রাখা হয়েছে কফিন সমেত। কফিনের ঢাকনা লাগানো হয়েছে কিন্তু
এখনো কবর দেয়নি। সেক্ষেত্রে...
‘কে আছো?’ জোরে একটা চিৎকার করলো। কোনো সাড়া নেই।
না এরকম চিৎকার করা মানে অক্সিজেন নষ্ট করা। কফিনের ভারি
ঢাকনা ভেদ করে ওর আওয়াজ বাইরে যাচ্ছে না। অথবা... এক শিরশিরে অনুভুতি বয়ে গেল
শিরদাঁড়া বেয়ে... ওকে কবর দেওয়া হয়ে গেছে। পবিত্র বাইবেল পাঠ সমাপ্ত। সবাই চলে
গেছেন ওকে একা রেখে ।
এর একটাই অর্থ সে এখন ছ’ফুট মাটির নিচে । এক বিশাল ওজনের
মাটি এখন চাপানো কফিনটার ওপর। একমাত্র সুপারম্যানের পক্ষে সম্ভব একে ঠেলে সরানো।
শত শত পাউন্ড মাটির ওজনের নীচে চেপে বন্ধ হয়ে থাকা কফিনের ডালা খোলার প্রানপন
প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ম্যাসী নামের একটা মানুষ। কমে আসছে বাতাস। কমে যাচ্ছে জীবনদায়ী
অক্সিজেন । কষ্টের চাপে নিজের গলা নিজেই চেপে ধরছে মানুষটা। তাও একহাতে। কারন দুটো
হাত একত্র করার জায়গাও নেই কফিনের ভেতর। না এখন এসব ভাবা চলেবে না। আমি এসব ভাববো না মোটেই – নিজেকে বললো ম্যাসী।
এরকম ভাবলে পচে
গলে মরতে হবে এই কফিনের ভেতরে ...না না ... কিন্তু এরকম আমার সাথে হলো কিভাবে ?
...কখন
না মরতেই কবর দেওয়ার ঘটনা ও এর আগেও শুনেছে। যার বেশির ভাগই
ওই আল্যান পো এর গল্পের মতো। কষ্টকল্পনাকে বাস্তবের মতো করে বর্ণনা করা। কিন্তু
এটা তো মিথ্যা নয়...কল্পনা নয়... পো
এর গল্পও নয় । ও জেমস রোনাল্ড ম্যাসী, বয়স চুয়াল্লিশ । সম্পত্তির মত পরিমাণ পাঁচশো
হাজার ডলার। সাতটি কর্পোরেশনে সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত। আপাতত বন্দী হয়ে গেছে ওর
শরীরের থেকে সামান্য বড়মাপের একটা কফিনের ভেতর। যার ভেতরের বাতাস হাওয়ায় দাপটে গলে
ছোট হয়ে যেতে থাকা মোমবাতির মাপের মতোই কমে যাচ্ছে।
এটা স্বপ্নের মতোই...তবে দুঃস্বপ্ন ।
একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে দুহাতে কফিনের ঢাকনা টাকে উপরের
দিকে ঠেলতে শুরু করলো ম্যাসী যতক্ষন দম রইলো আর হাতে যন্ত্রনার অনুভূতি নাহলো। কিন্তু
লাভ কিছু হলোনা। এককনাও নড়লো না ওটা!!
হাত নামিয়ে নিলো ম্যাসী। সারা শরীর ভিজে গেছে ঘামে। কুটকুট করছে গোটা গা। যে দামী জামাকাপড় ও পড়ে সেসব আপাতত ও পড়ে নেই বোঝাই যাচ্ছে। নিকৃষ্টমানের পোশাক
পড়ানো হয়েছে ওকে শেষ সময়ে।
আর কতটা সময় আছে হাতে? বাকি হাওয়া আর কতক্ষণ থাকবে? দশ
মিনিট? এক ঘণ্টা? খুব বেশি হলে একটা গোটাদিন?
কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর আবার একবার চেষ্টা চালালো ঢাকনাটা
ঠেলে খোলার। সেটা করতে করতেই ওর মাথায় ছায়াছবির
মতো ভেসে এলো গত তিনবছরের নানান স্মৃতি। ওর বিবাহিত জীবনের স্মৃতি-
মাত্র তিনবছর হল ওদের বিয়ে হয়েছে। চল্লিশ পার হওয়া ম্যাসীর
কনে লুইজির বয়েস তখন ছিল মাত্র তেইশ। যুবক অবস্থায় নানান কাজে ব্যস্ত থাকতে থাকতে
বিয়ে করার সময় পায়নি ম্যাসী। বিভিন্ন কর্পোরেট ব্যবসায় মনোযোগ দিয়ে বাড়িয়ে গেছে
অর্থ বিনিয়োগ আর উপার্জনের মাত্রা। এই মুহূর্তে একটা বিদ্রুপের হাসি ওর মনে খেলে
গেলো । শুধুই রোজগার... আর কোন দিকে চিন্তা করিনি নজর দিইনি...
কিসের জন্য? মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে জ্যান্ত কফিন বন্দী
হয়ে কবরে থাকার জন্য? এখান থেকে অস্বাভাবিক কোন ঘটনা ঘটিয়ে বের হতে না পারলে মাঝ বয়স বলে আর কিছুই থাকবে না ওর জীবনে। লুইজিকেও
আর কোন দিন কাছে পাওয়া যাবে না...
এক সামার রিসোর্টে দেখা হয়েছিল লুইজির সাথে। সাথে ছিল ওর বাবা মা। ম্যাসীর হাতে সে সময় ছিল দুষ্প্রাপ্য
ছুটির কিছু দিন। তারসাথে ডাক্তারের নির্দেশও ছিল
কিছুদিন কাজের চাপ মুক্ত হয়ে দিন কাটানোর।
দুটো সপ্তাহ কোন দিক দিয়ে কেটে গিয়েছিল
বুঝতেই পারেনি। নিজে থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল ম্যাসী। আরো বেশি অবাক হয়েছিল লুইজি সেটা মেনে নেওয়ায়।
একমাস পরে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান করে ওরা বিয়ে করে। ব্যবসার সুত্রে
চেনাশোনা সবাইকে নেমন্তন্ন করেছিল । দক্ষিন আমেরিকায় করে হনিমুন। একমাসের মধ্যে
ফিরেও আসে কাজের ক্ষতি হয়ে যাবে এই বাহানায়। লুইজি অবশ্য তাতে রাগ করেনি বরং কাজের
প্রতি এইটানে বেশ খুশি হয়েছিল বলেই মনে হয়েছিল।
বিয়ের প্রথম দিকের মাসগুলো ছিল ম্যাসীর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের । লুইজির চলাফেরা দেখাটাই ছিল
একটা আলাদা রকমের অনুভুতি। একটা উন্মাদনা।
সেই উন্মাদনার টানটাই ম্যাসীকে আপাতত এই কফিনের ভেতর থেকে
বের হওয়ার জন্য অনুপ্রানিত করলো । চোখের সামনে ভেসে উঠলো পাতলা, ছিপছিপে, আকর্ষণীয়
দেহবল্লরীর অধিকারিনী
সোনালী চুলওয়ালা লুইজির ছবি। দারুন সুন্দর, প্রানছোঁয়া স্নিগ্ধতার সেই স্পর্শ আবার
পেতে হবে আমাকে।
মনের ভেতর উদ্বেগ ...হাঁস ফাঁস করতে থাকা ফুসফুসকে নিয়ন্ত্রন
করতে করতে ম্যাসি নিজেকে বললো – সময় এখনো আছে। ঠিক জায়গাটা খুঁজে নিয়ে ঠেলতে পারলেই
খুলে যাবে। কতই বা আর ওজন হবে একটা কফিনের ঢাকনার? উত্তরটাও ওর মন দিয়ে দিলো সাথে সাথেই, প্রচুর! কারন উপর চেপে বসে আছে মনখানেক ধুলো মাটি।
‘না!” চিৎকার করে উঠলো ম্যাসী। ‘মোটেই না। আমি এখনো বাইরেই
আছি। আমায় এখনো কবর দেওয়া হয়নি। আমি চেষ্টা ছাড়বো না।’
অনেক কষ্ট করে একপাশ হয়ে শুলো । কাঁধটা ঠেকলো কফিনের ডালায়।
আবার একটা গভীর শ্বাস নিয়ে চাপ দিলো ওপরের দিকে। একসময় ব্যাথায় ভরে গেল ওর কাঁধ
দুটো। তার তাড়না ছড়িয়ে গেল গোটা শরীরে।
ডালাটা একটুও নড়লো না।
মনের শান্ত ভাবটা আর বজায় রাখতে পারছে না ম্যাসী। হাওয়া
কমছে... বাড়ছে কার্বন...কবরের ভ্যাপসা দুর্গন্ধ ওর নাক দিয়ে ঢুকে ওকে এগিয়ে নিয়ে
যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে । সহসাই পাগলের মতো হাসতে শুরু করলো ম্যাসি। ভুলেই গেলো এভাবে
হাসলে অক্সিজেন আর কমে যাবে।
ওর মনে পড়ে গেছে শেষদিনের কথাগুলো... মনে পড়লো সেই দৃশ্য...
হেনরি মার্শালের বাহুলগ্না লুইজি...
ওদের বিয়ের ঠিক একবছরের মাথায় আবির্ভাব হয়েছিল হেনরির।
সেইদিন বিকালে লুইজি জানিয়েছিল , ‘আজ রাতে
একজনকে ডেকেছি ডিনারে?’
‘তাই নাকি? বেশ বেশ । তা আমি কি তাকে চিনি?’
‘না । ওর নাম হেনরি মার্শাল। আমার ছেলেবেলার খেলার সাথী।
আমি ওকে বেশ কয়েকবছর দেখিনি।’
ম্যাসী প্রশ্রয়ের হাসি হাসলো । ও সবসময়েই চায় লুইজি খুশি
থাকুক। আনন্দে থাকুক। কখনোই যেন ওর মনে এটা না আসে যে ওর চেয়ে বেশি বয়সী মানুষকে
বিয়ে করে ও ঠকেছে।
ওই দিন ঠিক সন্ধে ছটায় এলো হেনরি । বয়স পঁচিশ। লম্বা,
হ্যান্ডসাম, ঢেউখেলানো সোনালী চুল । স্বচ্ছন্দ খোলামেলা ব্যবহার। মানুষকে সহজেই
আকর্ষণ করতে সক্ষম। আর সেটাই পছন্দ হয়নি ম্যাসীর। সব ব্যাপারে নাকগলানো মানুষদের
ওর একদম ভালো লাগে না।
খুব একটা আরামদায়ক ছিলনা সেই সন্ধেটা। লুইজি আর হেনরি মেতে
ছিল পুরানোদিনের স্মৃতি চারনে। মাঝেমাঝেই এমন সব কথার সাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠছিল ওরা যেগুলোর কোন মানেই
ছিল না ম্যাসীর কাছে ।রাত এগারোটায় প্রচুর বকবক করে বিদায় নিলো হেনরি। সেদিন রাতেই
ম্যাসী লুইজিকে নিয়ে বেডরুমের পথে যাওয়ার সময় অনুভব করলো যেন একটা কাঠের পুতুল
যাচ্ছে ওর সাথে। এটা আগে কখনো মনে হয়নি। পরবর্তী ভালোবাসাবাসির পর্বটাও যান্ত্রিক
আড়ষ্ঠতার মধ্যে ঘটে গেল।
এসব নিয়ে পরে ভাবলেও সে ভাবনার কথা লুইজিকে বলেনি কোনদিন
বলেনি ম্যাসী। হেনরির আগমন হতে থাকলো ঘনঘন । শুরু হল দু’তিনদিন করে থেকে যাওয়াও।
কিন্তু বরাবরের মতো লুইজির আনন্দের কথা ভেবে সব মেনে নিয়েছে ম্যাসী।
কফিনের দমবন্ধ করা অন্ধকারে শুয়ে ম্যাসীর মনে পড়লো হেনরির শেষ
আগমনের দিনটার কথা। আর এবারের ঘটনা ছিল মাত্রাতিরিক্ত ...
দিনটা ছিল শুক্রবার। হেনরি এসেছিল ডিনারের নির্দিষ্ট সময়ে।
এখন এ বাড়ির ভৃত্যরাও ওকে চিনে গেছে। নিয়ে গেল উত্তর দিকের ঘরটায় । এক রকম হাসি
উচ্ছ্বাসে মেতে থাকলো ওরা । মাথা ধরার বাহানা করে আগেই উঠে যায় ম্যাসী। বিছানায়
শুয়ে পড়লেও ঘুম আসেনি । এপাশ ওপাশ করছিলো অস্বস্তির সাথে। যার অর্ধেক ছিল আগামী
সোমবার যে লৌহআকরের ডিলটা হতে চলেছে সেটার ভাবনা ; আর বাকিটা এই বাড়ীর ছাদের তলায়
ওই ফাজিল বাচাল যুবকের উপস্থিতিজনিত কারন ।
দেখতে দেখতে গড়িয়ে গেল অনেকটাই রাত হয়ে গেল। প্রিয়তমা
লুইজির উত্তেজক দেহবল্লরীর টানে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো ম্যাসী। চললো স্ত্রীর ব্যক্তিগত
বেডরুমের দিকে। পেটা ঘড়ির আওয়াজ জানান দিলো এখন রাত তিনটে বাজে ।
লুইজির বেডরুমের দরজায় ঝুলছিল “ডোন্ট ডিস্টার্ব” লেখা
বোর্ড। আলতো চাপ দিয়ে দরজা খুললো ম্যাসী। যদি ঘুমিয়ে পড়ে থাকে লুইজি তাহলে জাগাবো
না । মনে মনে বললো।
পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে।
লুইজি মোটেই ঘুমায়নি। তাকিয়ে আছে ম্যাসীর দিকে। সে চোখের
ভাষা ঠিক ধরতে পারলো না ম্যাসী।
লুইজি একা নয়।
পাশে শুয়ে আছে হেনরি মার্শাল। একটা হাত লুইজির নগ্ন কাঁধের
ওপর রাখা।
এক লহমায় সব পরিষ্কার হয়ে গেল। সন্দেহ তাহলে অমুলক ছিলনা । হেনরি
মার্শালের বারবার এবাড়ীতে আগমনের উদ্দেশ্য এটাই। লুইজি ম্যাসীকে ঠকিয়েছে!!
একটা চরম কষ্টের জ্বলন্ত শিখা ম্যাসীর সারা শরীরকে আষ্টে
পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছিল। আগুনের একটা ছুরি কি কেউ ওর হৃদপিণ্ডে বসিয়ে দিলো? বিভ্রান্তি
আর মর্মবেদনা ওর গলার কাছে দলা পাকিয়ে যাচ্ছিলো।
‘লুইজি!—আমি বুঝতে...’
ওরা দুজনেই উঠে বসলো বিছানায়। দুজনের মুখেই হাসির রেখা। তার
মানে ওরা মোটেই ভয় পাচ্ছেনা!
‘জেনেই গেলেন তাহলে?’ হেনরি বললো।‘আমাদের সম্পর্কটা অনেকদিন
ধরেই চলছে। এবার বলুন মাননীয় ধেড়েখোকা আপনার কি বলার আছে?’
ম্যাসীর হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছিল ধড়াস ধড়াস করে। পা কাঁপছিল। পড়ে
যেতে যেতে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলো খাটের
বাজুটা ধরে নিয়ে। হাত-পা কিরকম যেন ঠান্ডা হয়ে আসছিল। মৃত্যুর শীতলতা কি ওকে গ্রাস
করছে।
লুইজি ধীরে ধীরে বললো, ‘আজ বা কাল কিংবা পরশু তুমি আমাদের
ব্যাপারটা জেনেই যেতে। হেনরি আর আমি একে অপরকে ভালোবাসি । সেই তখন থেকে যখন আমার
বয়েস ছিল উনিশ। কিন্তু বিয়ে করতে পারিনি আমরা। এরপর তোমার সাথে দেখা হয় । ও রাজি
হয় কয়েক বছর অপেক্ষা করতে। এদিকে আমিও জেনে যাই তোমার ব্যক্তিগত ডাক্তারের মতামতটা।
যেটা অবশ্য উনি তোমাকে বলতে বারনই করেছিলেন।’
ম্যাসীর উথালপাথাল হতে থাকা শরীরের ভেতরের সব রক্তস্রোত
একসাথে গিয়ে ধাক্কা মারলোমাথায়।
লুইজি বললো, ‘ডাক্তার রবিনসন আমায় বলেছেন, তোমার জটিল হৃদরোগ
আছে। যে কোন রকমের জোরালো মানসিক বা শারীরিক আঘাত তোমার পক্ষে সমান ক্ষতিকর। সাথে
সাথে অবশ্য উনি আর একটা কথাও জানাতে চাননি। তুমি আর মাত্র কয়েকদিনের মেহমান এই
পৃথিবীতে । যে কারনে আমরা, আমি আর হেনরি, চেয়েছিলাম তুমি শেষ দিনকটা শান্তিতেই
কাটাও। তারপর সব সম্পত্তির মালিক হবো আমি। বিয়েতেও কোন বাধা থাকবে না।’
ম্যাসি টলমল পায়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। চোখে লাল-নীল
আলোর ঝলক, পা অবশ হয়ে আসছে।
‘লুইজি... এটা হতেই পারে না । এসব সব স্বপ্ন দেখছি আমি তাই
না?’
‘মোটেইনা বুড়ো ভাম। তুমি জেগে আছো। এসব সব বাস্তবে ঘটছে।
তুমি মরবে কখন ? বুড়ো ভাম কোথাকার!’
নিজের দেহটার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে গেল ম্যাসীর। ও টলে
পড়ে গেল লাল কারপেটে ঢাকা মেঝের ওপর। দুহাত বাড়ালো কিছু একটা আঁকড়ে ধরার জন্য। কয়েক
মন ওজনের ভারী কিছু একটা যেন ওর বুকের ওপর চেপে বসছে। আর সেই ব্যাথার অনুভুতি ভেদ
করে ভেসে আসছে লুইজির কণ্ঠ, ‘মর !মর! মরে যা বুড়ো ভাম। এক্ষুনি মরে যা!’
ম্যাসীর সব মনে পড়ে গেল। ঘটনাটা তাহলে এরকম হয়েছিল। লুইজি
আর হেনরিকে একসাথে দেখার পর ওর হার্ট অ্যাটাক হয়। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। ও পড়ে যায়
। সম্ভবত কোমায় আচ্ছন্ন হয়... ডাক্তাররা ওকে মৃত বলে ঘোষনা করেন । অবিশ্বাস্য
ব্যাপার! এতই কি মৃদু হয়ে গিয়েছিল আমার হৃদপিণ্ডের গতি যে নামি দামি ডাক্তাররা কেউ
বুঝতেই পারলেন না আমি বেঁচে আছি। নাকি... অন্ধকারে থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো ম্যাসী।
লুইজি আর ওর প্রেমিক ডাক্তার ভাড়া করে এনে আমায় মৃত
ঘোষনা করিয়ে দেয়!
লুইজি জানতো আমি বেঁচে আছি। তবু আমাকে জ্যান্ত ঢুকিয়ে দেয়
কফিনে! পাঠিয়ে দেয় এই অন্ধকারের জগতে!!
এই ভাবনা ম্যাসিকে নতুন করে উজ্জীবিত করে এখান থেকে বের হওয়ার
জন্য। ওকে বেরোতেই হবে। অনেক অনেক সমস্যার মুখে পড়েছে জীবনে । কোথাও হারেনি। মনের
ইচ্ছে ওকে জিতিয়ে দিয়েছে সব জায়গায়।
এখান থেকে ও নিজেকে বাইরে নিয়ে যাবেই।
যেভাবেই হোক...
এ কবরের ভেতর
থেকে পালাতেই হবে। ফিরতেই হবে জীবনে। আলোতে। লুইজিকে শাস্তি দিতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত
করাতেই হবে ওই বিশ্বাসঘাতকতার।
এ তার প্রতিজ্ঞা। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো মরতে ম্যাসি রাজি
নয়।
ইদুরের কথা মনে হতেই আর এক বিভীষিকাময় ভাবনা ওর মনে জেঁকে
বসলো। ও শুনেছে মাটির তলায় বিশেষ করে
কবরস্থানে একজাতের কালো রোমশ ইঁদুর থাকে। যারা টাটকা মরার মাংস খাওয়ার জন্য উৎসুক
হয়ে থাকে।
ম্যাসির কল্পনা করার জগতটা বিস্তৃত হতে থাকলো। এই মুহূর্তে
একটা কালো চাদরের মতো অন্ধকার ওকে জড়িয়ে আছে। তার মধ্যেও ওর কল্পনার দৌড়ত থামছে না
দেখতে পাচ্ছে ওই রোমশ প্রানীগুলো চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে। ওরা আজ তাজা মাংসের গন্ধ
পেয়েছে। ওদের মনে আজ উল্লাস। ওরা এসে গেছে ডজন ডজন । কফিনটার চারপাশে। ওটাকে কেটে
ওরা ঢুকে পড়ছে এক এক করে। ওর গলার নরম মাংসের কাছে নাক ছুঁইয়ে দেখছে। ওইতো ওদের
ধারাল দাঁত ওরা বসিয়ে দিলো চিবুকের তলায়। ফোয়ারার মতো রক্ত ছিটকে বেরিয়ে এলো।
চোখের মনি দুটো খুবলে খাওয়ার জন্য ওদের নিজেদের ভেতরেই লেগে গেছে মারামারি ।
কিসের একটা শব্দ হলো না?
কাঠে কামড়ানোর শব্দ? এসেই গেল তাহলে ওরা।
কই নাতো কোন শব্দই নেই । সব কিছু চুপচাপ নিস্তব্ধ। নিঝুম
নিথর।
একই বলে কবরের নিস্তব্ধতা। মনে মনে খুশীই হলো ম্যাসী। এখনো
মনের ভেতরটা পুরো অসাড় হয়ে যায়নি। মনের
ভাবনা এখনো ভাষা সঞ্চয়ন করে চলেছে।
না আর কল্পনার জগত নয়। এটা ফিউনেরাল পারলার নয়। কফিনে
সাধারণত তালা মারার কোন ব্যবস্থা থাকে না। ও ওটাকে ঠেলে তুলতে পারছে না তার মানে
একটাই ওকে কবর দেওয়া হয়ে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে ওরা দুজনে যত তাড়াতাড়ি পেরেছে কাজটা
সেরে ফেলেছে।
এবার ম্যাসি ওদের চমকে দেবে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে
এখন।
কফিনের ডালা ঠেলে তলার চেষ্টা করা অযৌক্তিক। অনেকবার সে
চেষ্টা করা হলো। এবার এটাকে ভাঙার চেষ্টা করতে হবে। তবেই এর থেকে বার হওয়া যাবে।
আর বার না হতে পারলে নিজেই নিজেকে খুন করবে। ওই ইঁদুরগুলো
জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে তার থেকে অনেক অনেক ভালো হবে সেটা।
হাওয়া এখন অনেক বেশী চ্যাটচেটে। শ্বাস নিতে ভালোই কষ্ট
হচ্ছে । হাতড়ে হাতড়ে ম্যাসী খুঁজতে শুরু করলো স্যাটীনের কাপড়টা কোথায় সেলাই করা
আছে। পেয়েও গেল। টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়লো ওটাকে। অনুভব করলো পাইন কাঠের কফিনটাকে। ভালো
ভাবে ঘষেমেজে বানানো হয়েছে । সেরা জিনিষটাই কিনে এনেছে লুইজি । হয়তো নাটক করেছে,
কান্না ভেজা চোখে, আমার প্রিয়তমর জন্য বাজারের সেরা জিনিষটা চাই।
শুরু করলো কাঠে আঘাত করা। করেই চললো...একটা কাঠফাটার আওয়াজ
শোনার জন্য ওর কান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল । ভালো করে দম নেওয়ার জন্য ওর বুকের
ভেতরটা আঁকুপাকু করছিল। এখন যে বাতাস শ্বাসের সাথে ঢুকছে তার পুরোটাই দুষিত।
ওর মনে আবার কল্পনার জগত উঁকি মারলো। আচ্ছা ওরা ওকে কফিন
উলটো করে কবর দেয়নিতো । তাহলেতো কোনদিনই এখান থেকে মুক্তি পাওয়া যাবেনা । অসম্ভব,
নিজেই নিজেকে বললো, আমার অস্থির মন এসব ভেবে আমার সাথে ইয়ার্কি মারছে। ওসব ভাবলে
চলবেনা । এ কফিনটাকে ভাঙতে হবেই।
যে হাত কোনও দিন শ্রমিকের কাজ করেনি আজ সেদুটোই বাঁচার জন্য
শুরু করলো আপ্রান চেষ্টা। পাইনের কাঠ আঁচড়াতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হল নখ। কয়েকটা উঠে
গেল মাংস ছিঁড়ে। চরম যন্ত্রনা সহ্য করেও ম্যাসী চেষ্টা করেই চললো। সাথেই চালাচ্ছিল
চিৎকার ... ‘বাঁচাও! কেউ কি শুনতে পাচ্ছো না ? আমাকে জ্যান্ত এখানে কবর দেওয়া
হয়েছে! আমাকে যে বাঁচাবে তাকে আমি দশ হাজার ডলার দেবো! বিশ হাজার! পঞ্চাশ হাজার
ডলার দেবো ! শুনতে পাচ্ছো? পঞ্চাশ হাজার ডলার!’
কারোর কানে পৌছালো না এই আবেদন। কেউ সাড়াও দিলো না। সম্ভবত
এখানে এখন আর কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। ওদিকে লুইজি আর হেনরি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে
খুব হাসছে।
আড়ষ্ঠ আঙুল দিয়ে ব্যর্থভাবে আঁচড়েই চললো ওপরের কাঠে। আঁচড়েই
চললো যতক্ষন না ক্রমাগত যন্ত্রনার প্রভাবে সব স্নায়ূ অসাড় হয়ে গেল । হারিয়ে গেল
যন্ত্রনাবোধ। ওদিকে হাওয়াও সব খতম ।
মনের কিছু অংশে সাড় এখনো আছে। সে অংশ এখনো করে চলেছে নিত্যনতুন
পরিকল্পনা। কফিনের ঢাকনায় একটা ফুটো করতে হবে সেই অংশটা জানালো। সেটাকে বড় করতে
হবে...তারপর সেখান দিয়ে বেড়িয়ে যেতে হবে বাইরের আলোর জগতে। মাটি এখনো নরম, ঝুরঝুরে
আছে । একবার মাথাটা বার করতে পারলেই ব্যাস!
তারপর লুইজি আর হেনরির সাথে বোঝা পড়া।
পুরো ব্যাপারটা কি সহজ। কিন্তু প্রথম কাজটাই যে করা যাচ্ছে
না কিছুতেই। হাওয়া যেভাবে তলানিতে এসে ঠেকেছে তাতে শ্বাসরোধকারি অবস্থা চেপে ধরছে
সবদিক থেকে। ক্রমাগত দুষিত বাতাস ঢুকে ঢুকে কমে যাচ্ছে মস্তিষ্কের ক্ষমতা। সোজা
ভাবে আর কিছু ভাবাই যাচ্ছে না। ইঁদুরগুলোও বোধ হয় এসে গেছে । শুরু করে দিয়েছে কাঠ
চেবানো। পেয়ে গেছে জ্যান্ত শরীরের গরম রক্তের গন্ধ।
আর ওর হৃদপিণ্ড যেটা ভুল করে একবার থেমে গিয়েছিল বলে ওকে আজ
এখানে ঢুকে থাকতে হচ্ছে সেটা এখন পাগলের মতো লাফাচ্ছে ধড়াস ধড়াস করে ।
ব্যাথাটা যেন সেদিন লুইজির বেডরুমের
থেকেও বেশি। ম্যাসি বুঝতে পারছে না আর কতক্ষণ এই যন্ত্রনার চাপ সহ্য করতে পারবে।
ইদুররা...আসছে...আমাকে খেতে... হাওয়া শেষ...অন্ধকার...
নিঃসীম অন্ধকার... আর পারছে না আমার হৃদপিণ্ড...অলৌকিক কিছু হওয়া দরকার...এখান
থেকে আমাকে বের হতে হবে...যন্ত্রনা...
যন্ত্রনা!!!
সহসাই সব যন্ত্রনা উধাও হলো। এক চরম শান্তি । ম্যাসি অনুভব করলো
আর একটুও ব্যাথা নেই। অনেক সুস্থ বোধ হচ্ছে...অনেক উদ্বেগহীন...
কি বোকার মতো চেষ্টা ও এতক্ষন ধরে করছিল এখান থেকে বেরিয়ে
আসার জন্য... শুধুমাত্র একটু ভেসে থাকার চেষ্টা... একটু ভেসে থাকার চেষ্টা করতেই
সব ঘটে গেল...অলৌকিক ভাবে... নিটোল কাঠের কফিন, যেটা ও ভাঙার চেষ্টা করছিলো সেটা
ভেদ করে ও বেরিয়ে এলো...কালো অন্ধকার ভেদ করে ...ভ্যাপ্সানো দুর্গন্ধে ভরা মাটির
তলা থেকে... একেবারে সোজা সবুজ ঘাসের ওপর...
মুক্তি!!!
এখন সময় দুপুর । গনগনে সূর্য মাথার ওপর। যা আর কোনোদিন
দেখতেই পাবেনা বলে মনে হয়েছিল । ফুট
পঞ্চাশেক দূরে কিছু লোক একটা সাদা ফলকের চারপাশে জড়ো হয়েছে। ম্যাসী এগিয়ে গেল ওদের
দিকে।
‘ওরা আমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিয়েছিল ! শুনছেন! এই দেখুন
আমি বের হয়ে এসেছি। দয়া করে কবরটা খুড়ে দেখতে বলুন...প্লিজ!’
অদ্ভুত ব্যাপার! ওরা কেউ ওকে পাত্তা দিলো না। মনে হলোনা কেউ
ওর কথা শুনতে পাচ্ছে। ম্যাসী বারবার কথাগুলো বললো ওদের চারদিকে ঘুরেঘুরে।
গভীরভাবে একটা শ্বাস নিলো, একরাশ তাজা বসন্তের বাতাসে ভরে
গেল ওর ফুসফুস। ওর নাকের ফুটো দিয়ে কোনও ঠান্ডা বাতাস ঢুকলোইনা সেই রাতটার মতো।
ম্যাসী এবার তাকালো নিচে মাটির দিকে। এক অদ্ভুত রকমের দৃশ্য ওর সামনে উন্মোচিত হলো। ও দেখতে পেলো
কফিনটা শোয়ানো আছে । আর সেটা ভেদ করে ও দেখতে পেলো ওর ভেতর শুয়ে আছে একটা
যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহ। তার চারদিকের
স্যাটিনেরকাপড় ছেঁড়া । হাতের নখগুলো ক্ষতবিক্ষত । দেহটা এক মধ্যবয়সি মানুষের। মুখে
দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের যন্ত্রনার ছাপ ...
মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছেনা ... নাম জেমস রোনাল্ড
ম্যাসী।
সমাপ্ত
wow......
ReplyDelete