“শীতল শরীর, ফ্যাকাশে রঙ, তরুণাস্থি বিশিষ্ট হাড়ের কাঠামো, বিকই
দর্শন চামড়া, হিংস্র
আচরণ, অদ্ভুত চোখ, কটু গন্ধ,
কর্কশ কন্ঠস্বর,
অস্বাভাবিক বাসস্থান, এবং ভয়ানক বিষ থাকার কারণে সরীসৃপ জাতীয়
প্রাণীরা ঘৃণ্য প্রজাতির জীব ; যে কারণে সৃষ্টিকর্তা ওদের খুব
বেশী বানানোর কথা ভাবেননি।"
লিনিয়াস,
১৭৯৭
"আপনি কখনোই এক নতুন ধরণের জীবনের সৃষ্টি করতে পারবেন না।"
এরউইন চারগাফ ১৯৭২
0000000
"দ্য ইনজেন ইন্সিডেন্ট"
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিস্ময়কর এক বৈজ্ঞানিক গোল্ডরাসের ছবি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়: যেখানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে বাণিজ্যিকীকরণের জন্য একটা উচ্ছাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ছুটতে শুরু করে ক্ষিপ্ত গতিতে। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়েছে - খুব কমই এ বিষয়ে
খবর মানুষ জানতে পেরেছে – এতটাই কম ছিল সে তথ্য যে, এর মাত্রা এবং প্রভাব ঠিক কেমন সেটা খুব একটা কেউ বুঝতেই পারেনি।
বায়োটেকনোলজি মানব ইতিহাসের এক অনন্য বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই দশকের শেষের দিকে, এই ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তি এবং কম্পিউটার বিষয়ক অগ্রগতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে দিয়েছে। একজন পর্যবেক্ষকের ভাষায়, “বায়োটেকনোলজি মানুষের জীবনের প্রত্যেকটা দিককে বদলে দিতে চলেছে : চিকিৎসা, খাদ্য স্বাস্থ্য, বিনোদন, শরীর সব ক্ষেত্রে। আর কিছুই আগের মতো থাকছে না। আক্ষরিক অর্থেই এটা আমাদের চেনা গ্রহের ভোল বদল করতে চলেছে।
মনে রাখতে হবে বায়োটেকনোলজির এই বিপ্লব এর আগে যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক রূপান্তর ঘটিয়েছে তার থেকে তিনটে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একেবারেই আলাদা। প্রথম, এই পরিবর্তনের সীমানা ব্যাপক। আমেরিকা লস আলামোসে এক একক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাজের সূত্রে পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করে। কম্পিউটার যুগে এ দেশের প্রবেশ ঘটেছে প্রায় এক ডজন কোম্পানির প্রচেষ্টার মাধ্যমে। কিন্তু বায়োটেকনোলজির গবেষণা শুধুমাত্র আমেরিকাতেই দু হাজারেরও বেশি গবেষণাগারে হয়ে চলেছে। পাঁচশো কর্পোরেশন বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে এই প্রযুক্তিতে।
দ্বিতীয়, এইসব গবেষণার বেশিরভাগই ভাবনা চিন্তাহীন বা অসাড় বলেই মনে হয়। প্রচেষ্টা করা হচ্ছে জলের ভিতর ভালোভাবে দেখাযাবে এমন ট্রাউট মাছ জন্ম দেওয়ার, গাছের গুঁড়িকে চারকোনা করা যাতে কাঠ কম নষ্ট হয় বা এমন কোনও ‘ইনজেক্টেবল সেন্ট সেল’ তৈরি করা যাতে সবসময় আপনার প্রিয় গন্ধটাই আপনি দেহে মনে অনুভব করবেন – এসব শুনে হাসি পেতে পেতে পারে। কিন্তু না তা নয় মোটেই। প্রকৃতপক্ষে, এটাই সত্যি যে, বায়োটেকনোলজির এই শক্তিশালী নতুন প্রযুক্তিকে ঐতিহ্যগতভাবেই নানান শিল্প ক্ষেত্রে যেনতেনভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সেটা ফ্যাশন হোক বা প্রসাধনী কিংবা অবসর বিনোদনের কার্যক্রম।
তৃতীয়, যা ঘটে চলেছে সবটাই অনিয়ন্ত্রিত। কেউ এর তদারকির দায়িত্বে নেই। না। কোনও ফেডারেল আইন নেই একে নিয়ন্ত্রণ করার জন। আমেরিকা বা এ জগতের কোথাও কোনও সুসংগত সরকারি নীতি নেই এই ক্ষেত্রে। সবচেয়ে বড় কথা বায়োটেকনোলজির রেঞ্জ বা সীমানা সাধারণ পণ্য থেকে শুরু করে ড্রাগস হয়ে কৃষি ক্ষেত্র থেকে কৃত্রিম তুষার বানানো সবক্ষেত্রেই কাজ করতে পারে। ফলে সবকিছুর জন্য কোনও একটা নির্দিষ্ট নীতি নির্ধারন করা কঠিন।
এরচেয়েও বিরক্তিকর বা চিন্তাজনক সত্যি এটাই যে, যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে কাজ করছেন তাদের দিক থেকে কোনও হেলদোল নেই। নজরদারি হোক কেউ যেন চাইছেন না। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এটাই জেনেটিক্সের গবেষণা সাথে যুক্ত প্রায় সব বিজ্ঞানীই বায়োটেকনোলজির আর্থিক বাজারে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। আলাদা করে কেউ এসবের দিক নজর রাখছেন না। প্রত্যেকেই কোনও না কোনও বাজি জেতার দিকে ছুটছেন।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে আণবিক জীববিজ্ঞান বা মলিকিউলার বায়োলজির বাণিজ্যিকীকরণ এক অতিমাত্রায় অত্যাশ্চর্য নৈতিকতার বিষয়। আর এটা ঘটেছে বিস্ময়কর গতিতে। গ্যালিলিওর পর থেকে চারশো বছর ধরে প্রকৃতি বিষয়ে বিজ্ঞান সর্বদা মুক্ত এবং খোলামেলা অনুসন্ধান হিসাবেই পথ হেঁটেছে। বিজ্ঞানীরা সবসময় জাতীয় সীমানাকে উপেক্ষা করেছেন। নিজেদেরকে রাজনীতি এবং এমনকি যুদ্ধর মতো অস্থায়ী উদ্বেগের ঊর্ধ্বেই রেখেছেন। গবেষণা ক্ষেত্রে লুকিয়ে-চুরিয়ে কিছু করার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সর্বদাই বিদ্রোহ করেছেন। অনেকেই নিজেদের আবিষ্কারের পেটেন্ট নেওয়ার ভাবনাকেও ভ্রুকুটি করেছেন।
সবসময়েই তারা সমস্ত মানবজাতির কল্যাণের
প্রেক্ষিতে নিজেদের কাজকে
গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রজন্মের
পর প্রজন্ম ধরে, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারগুলো বাস্তবিকপক্ষেই অদ্ভুতভাবে নিঃস্বার্থ থেকেছে।
১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ডের দুই তরুণ গবেষক জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক যখন, ডিএনএ-র স্ট্রাকচার ডিসাইফার করলেন, তখন তাদের কাজ মানব সভ্যতার এক বিজয়
ফলক হিসাবে প্রশংসিত হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক উপায়ে মহাবিশ্বকে অনুসন্ধান করার কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন পথে এসে পড়েছিল নতুন আলো।
মনে করা হয়েছিল তাদের এই আবিষ্কার নিঃস্বার্থভাবে মানবজাতির বৃহত্তর সুবিধার জন্য ব্যবহার হবে।
যদিও তা হয়নি। তিরিশ বছর বাদে দেখা গেল, ওয়াটসন এবং ক্রিকসের প্রায় সব
সহকর্মীই সম্পূর্ণরূপে অন্য ধরণের এক উদ্যোগে নিযুক্ত হয়ে
গিয়েছেন।
মলিকিউলার জেনেটিক্সের গবেষণা
ক্ষেত্রে পরিণত হয় মাল্টি
বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যিক উদ্যোগে। এর সূচনা
কিন্তু ১৯৫৩ সালে নয়, বরং হয়েছিল ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে।
ওই
সময়টা এক বিখ্যাত আলোচনা সভার সময়কাল। যেখানে রবার্ট সোয়ানসন, নামের
ভেঞ্চার
ক্যাপিটালিস্ট, ইউনিভারসিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার একজন বায়োকেমিস্ট হার্বার্ট বয়ারের সাথে দেখা করেন। এই দুজন মানুষ বয়ারের জিন-বিভক্ত করার কৌশল [জিন
স্প্লাইসিং] কে কাজে লাগিয়ে একটা বাণিজ্যিক উদ্যোগ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের নতুন কোম্পানি, জিনটেক, দ্রুত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং স্টার্ট-আপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে সফল
হয়ে ওঠে।
হঠাৎ এরকমটাই মনে হতে থকে যে সবাই যেন একসাথে ধনী হতে চায়। নতুন নতুন কোম্পানীর নাম প্রায় প্রতি
সপ্তাহে সামনে আসতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরাও জেনেটিক্সকে কাজে লাগাতে ভিড়
জমাতে শুরু করেন এই ধরণের গবেষণা ক্ষেত্রে। ১৯৮৬ সাল নাগাদ কমপক্ষে ৩৬২ জন বিজ্ঞানীকে, যার মধ্যে ৬৪ জন ন্যাশনাল অ্যাকাডেমীর, বায়োটেক সংস্থাগুলোর উপদেষ্টা বোর্ডের
আসনে দেখতে পাওয়া গেল। প্রায় একই মাত্রার পদে বা পরামর্শদাতা হিসাবে এর চেয়ে
অনেক বেশি যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন এই জগতটায়।
মনোভাবের এই পরিবর্তন আসলে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তাও
একটু দেখা দরকার। অতীতে,
প্রকৃত বিজ্ঞানীরা তাদের
কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকে একটা নোংরা দৃষ্টিভঙ্গির মানসিকতা
মনে করতেন। তাদের
কাছে অর্থ উপার্জনের সাধনা ছিল বৌদ্ধিক দিক থেকে একটা আগ্রহহীন বিষয়।
এটা দোকানের মালিকদের জন্য উপযুক্ত বিষয়। শিল্পের জন্য গবেষণা করতে
দেখা যেত তাদেরকেই যারা
বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার ছাড়পত্র জোটাতে পারেনি। এমনকি মর্যাদাপূর্ণ বেল বা আই বি এম ল্যাবে কাজ করার ক্ষেত্রেও একই ভাবনা বিরাজ করত বিশুদ্ধ চিত্তের
বিজ্ঞানীদের মাথায়। সোজা কথায়
‘অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স’ এবং ‘ইন্ড্রাস্ট্রি’ ক্ষেত্রে যারা কাজ করতেন অর্থের
বিনিময়ে
তাদের প্রতি এইসব বিজ্ঞানীদের
মনোভাব ছিল সমালোচনামূলক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের এই বৈরিতা তাদের উপর
‘ইন্ড্রাস্ট্রি’র কলুষতার ছাপ লাগতে দেয়নি। যখনই প্রযুক্তিগত বিষয় নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, একমাত্র তখনই এই উদাসীন বিজ্ঞানীরা সর্বোচ্চ স্তরে সমস্যা নিয়ে আলোচনা
করার জন্য সময় দিয়েছেন।
কিন্তু এসব কথার এখন আর কোনও দাম নেই। এই মুহূর্তে খুব কমই মলিকিঊলার বায়োলজিস্ট এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে, যারা এখনও বাণিজ্যিক অধিভুক্তির
অন্তর্গত হয়নি। পুরনো দিন আর নেই। জিনগত গবেষণা আগের চেয়ে আরও ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে
চলেছে। তবে সেসবই হচ্ছে গোপনে, তাড়াহুড়ো করে এবং লাভের কথা মাথায়
রেখে।
এই বাণিজ্যিক
আবহাওয়ায়, পালো অল্টোর
ইন্টারন্যাশনাল জেনেটিক টেকনোলজিস, ইনক এর মতো কোম্পানীর মাথাচাড়া
দিয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক অনিবার্য ছিল। তার সাথেও এটাও বিন্দুমাত্র অবাক হওয়ার মতো
বিষয় নয় যে, এরা যে জেনেটিক সঙ্কট তৈরি করেছে তার
দিকে কারও নজর পড়বে না। মনে রাখতে হবে, ইনজেনের গবেষণা গোপনে পরিচালিত হয়েছিল;
আসল ঘটনাটা
ঘটে মধ্য আমেরিকার এক প্রত্যন্ত
অঞ্চলে; যা দেখার জন্য
কুড়িজনেরও কম মানুষ সেখানে ছিল৷ এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনই বেঁচে যায়।
এমনকি শেষ পর্যন্ত, ১৯৮৯ আলের
৫ই অক্টোবর যখন ইন্টারন্যাশনাল
জেনেটিক টেকনোলজিস চ্যাপ্টার ইলেভেন সুরক্ষার জন্য মামলা দায়ের করে তখন সেটা প্রেস মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করতেই পারেনি
সেভাবে। পুরো ব্যাপারটা অতি সাধারণ মাত্রার মনে হয়:
ইনজেন তৃতীয় ক্ষুদ্র
মাত্রার একটা আমেরিকান বায়োইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি
হিসাবে সামনে আসে যারা ওই বছর ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৮৬ সাল থেকে এরকম ঘটনার তালিকায় যারা ছিল সপ্তম স্থানে। কিছু
নথি মানুষের সামনে আনা হয়। পাওনাদার ছিল জাপানি বিনিয়োগকারী, হামাগুরি এবং ডেনসাকার
মতো কোম্পানি যারা চিরন্তন ঐতিহ্য অনুসারে বিজ্ঞাপন ব্যাপারটাকে পাত্তাই দেয় না।
অপ্রয়োজনীয়
ঝামেলা এড়াতে কোয়ান, সোয়াইন এবং রস এর ড্যানিয়েল রস, ইনজেনের হয়ে
সোচ্চার হন, উনি আবারজাপানি
বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিত্ব করতেন। শুধু তাই নয় ভাইস কনসাল অফ কোস্টারিকার বিশেষ
তথা অস্বাভাবিক আবেদনের
শুনানি হয় বন্ধ দরজার পিছনে। সুতরাং এতেও আশ্চর্যর কিছু ছিল
না যে, এক মাসের মধ্যে, ইনজেনের সমস্ত সমস্যা শান্ত এবং বন্ধুত্বপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
এই মীমাংসার সময় যারা
উপস্থিত ছিলেন, যার মধ্যে বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে গঠিত এক বোর্ড অফ অ্যাডভাইসাররাও ছিলেন, একটা নন
ডিসক্লোজার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যেখানে
কী ঘটেছিল সে নিয়ে একটাও কথা ভবিষ্যতে বলবেন না বলে সম্মত হন। কিন্তু এই ‘ইনজেন ইন্সিডেন্ট’ এর সাথে জড়িত প্রধান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অনেকেই
ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর
করেননি। যার প্রেক্ষিতে তারা ১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসের শেষ দুই দিনে কোস্টারিকার পশ্চিম উপকূলের এক প্রত্যন্ত দ্বীপে
ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে
ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
.
প্রাককথন: দ্য বাইট অফ র্যাপটর
গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টি অঝোরে এবং সজোরে ঝরে পড়ছিল ক্লিনিক বিল্ডিংয়ের
ঢেউ তোলা করোগেটেড ছাদের উপর। ধাতব নর্দমার নলের ভিতর দিয়ে সগর্জনে নেমে এসে আছড়ে পড়ছিল নিচের জমিতে। রবার্টা কার্টার দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার বাইরে তাকাল। ক্লিনিক থেকে, নিচের দিকে ভেসে থাকা কুয়াশায় আবৃত সমুদ্র সৈকত বা দুরের সমুদ্রের কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না।
বাহিয়া আনাসকো, কোস্টারিকার পশ্চিম উপকূলের এই জেলেদের গ্রামে
সে যখন ভিজিটিং ফিজিশিয়ান হিসাবে দু মাস কাটাতে এসেছিল তখন এরকম কিছুর আশা
করেনি। দুবছর ধরে শিকাগোর মাইকেল রিস-এ এমারজেন্সী মেডিসিন বিভাগে কাজ করার পর ববি কার্টার সূর্যর আলোয় দিন কাটানোর পরিকল্পনা করে এসেছিল এখানে ।
তিন সপ্তাহ হয়ে গেল বাহিয়া আনাসকোতে আসার পর। প্রত্যেকদিন বৃষ্টি হয়েছে। সেটা বাদ দিলে বাকি সব ঠিকই আছে। তারসাথেই ভাল লেগেছে এখানকার মানুষের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার। বিশ্বের কুড়িটা সেরা চিকিৎসা কেন্দ্রের একটা আছে কোস্টারিকায়। এই প্রত্যন্ত উপকূলীয় গ্রামে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও এই ক্লিনিকে উচ্চমানের রক্ষণাবেক্ষণ, সব রকম সামগ্রীর পর্যাপ্ত পরিমাণে উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য বিষয়। তার প্যারামেডিক সহকারী, ম্যানুয়েল আরাগন বুদ্ধিমান এবং দারুণভাবে প্রশিক্ষিত। শিকাগোতে ববি যে ধরণের ওষুধ নিয়ে কাজ করেছে এখানে সেরকম ওষুধ পেতে তার অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু অসহ্য বৃষ্টি! অবিরাম, অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েই চলেছে!
পরীক্ষাগারের ঘর থেকে ম্যানুয়েল মাথা বার করে বলল, “শুনতে পাচ্ছেন?" "হ্যাঁ, ভালো করেই শুনতে পাচ্ছি, ববি বলল।
“আমি অন্য কিছুর কথা বলছি। ভা্লো করে শুনুন।"
এবার ববিও শুনতে পেল। বৃষ্টির সাথে মিশে যাচ্ছে আরেকটা শব্দ। একটা গুড়গুড়
করে কিছু কাঁপার মত শব্দ । বাড়ছে, স্পষ্ট হচ্ছে। একসময় পরিষ্কার শোনা গেল হেলিকপ্টারের
পাখা ঘোরার নির্দিষ্ট তালের শব্দ। এরকম আবহাওয়ায়
তো ওগুলো উড়তে পারে না বলেই জানতাম, মনে মনে বলল ববি।
কিন্তু শব্দটা একভাবে হয়েই চলেছিল, বাড়ছিল। তারপরেই
একটা হেলিকপ্টার সমুদ্রের দিকে ভেসে থাকা নিচু
কুয়াশা ভেদ করে নিচের দিকে নেমে এসে এক পাক
মেরে ফিরে গেল। ববি দেখল হেলিকপ্টারটা জলের উপর ফিরে এক চক্কর মেরে, মাছ ধরার নৌকাগুলোর কাছাকাছি এসে, কাঠের জেটির একপাশ দিয়ে উড়ে চলে গেল
সমুদ্র সৈকতের দিকে।
ওটা অবতরণ করার জায়গা খুঁজছিল।
বড় মাপের দেহ যুক্ত সিকোরস্কি হেলিকপ্টার। পাশে একটা
নীল স্ট্রাইপ, ওখানে লেখা আছে ‘ইনজেন কনস্ট্রাকশন’।
ওই নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান উপকূলীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে একটাতে নতুন একটা
রিসর্ট তৈরি করছে। অসাধারণ একটা রিসর্ট হবে
বলে জানা গেছে
বেশ জমকালো ধরণের হবে বলেই শোনা যাচ্ছে; দু বছরেরও
বেশি সময় ধরে ওটা নির্মাণে স্থানীয় অনেক লোক কাজ করছে। ববি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছে - সুইমিং পুল এবং
টেনিস কোর্ট সহ ওটা আর পাঁচটা বিশাল আমেরিকান
রিসর্টগুলোর মতোই একটা তৈরি হবে। যেখানে অতিথিরা তাদের ডাইকুইরিস পান করতে করতে জুয়াখেলায়
মেতে যাওয়ার সুযোগ পাবে। যার সাথে তাদের দেশের বাস্তব জীবনযাত্রার কোনও মিল নেই।
ববি ভাবার চেষ্টা করল, ওই দ্বীপে কী এমন দরকার
পড়ল যে, এরকম আবহাওয়াতে হেলিকপ্টারটাকে আকাশে
উঠতে হলো। জানলার কাঁচের এপার থেকে ও দেখতে
পেল সৈকতের ভিজে বালিতে হেলিকপ্টারটাকে নামাতে
পেরে পাইলট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। ইউনিফর্ম পরা করা কিছু মানুষ লাফ দিয়ে বের হয়ে এল এবং ওটার পাশের
বড় দরজাটা খুলে দিল। ভিতর থেকে স্প্যানিশ ভাষায় তারস্বরে চিৎকার শুনতে পাওয়া গেল।
ম্যানুয়েল তাকে আলতো একটা খোঁচা মারলেন।
ওরা একজন ডাক্তারকে খুঁজছেন।
একজন সাদা চামড়ার মানুষের কাছ থেকে আদেশসূচক শব্দ উচ্চারিত হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে দুজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ ববির কাছে একটা ল্যাতপ্যাত করতে থাকা শরীর বয়ে নিয়ে এল। শ্বেতাঙ্গ
মানুষটার গায়ে হলুদ রঙের স্লিকার । মাথার বেসবল টুপির নিচে চারপাশে দেখা যাচ্ছে লাল
চুল। "এখানে কি কোনও ডাক্তার আছেন?" লোকটা এগিয়ে আসতে থাকা ববিকে উদ্দেশ করে জানতে চাইল।
"আমি ডাঃ কার্টার," ববি বলল। ওর মাথা
আর কাঁধের উপর বৃষ্টি ঝরে পড়ছিল মোটামোটা দানায়। লাল চুলের লোকটা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ববির পরনে এই
মুহূর্তে কাট-অফ
জিন্স এবং ট্যাংক টপ। গলায় ঝুলছিল স্টেথোস্কোপ, যেটায় ইতিমধ্যেই নোনা বাতাস লেগে মরচে ধরেছে।
"আমি এড রেজিস। আমাদের সাথে
একজন খুবই অসুস্থ লোক আছে।"
"তাহলে আপনি ওকে সান হোসে নিয়ে যান,"
ববি বলল বলল। সান হোসে রাজধানী,
আকাশপথে মাত্র কুড়ি মিনিটের পথ।
“আমরা সেটাই করতে চাইছিলাম। কিন্তু এই আবহাওয়ায় পাহাড় অতিক্রম করতে পারব না।
আপনি এখানে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।”
ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সময় ববি আহত ব্যক্তির
পাশে পাশে হেঁটে চলল। অসুস্থ মানুষটা একটা অল্পবয়সী ছেলে। আঠারো বছরের বেশি হবে না। রক্তে ভেজা শার্টটা উঠিয়ে নিতেই
দেখা গেল কাঁধ বরাবর একটা বড় মাপের চিরে যাওয়ার মতো ক্ষতের দাগ।
একই রকম আরেকটা দাগ পায়ে।
"কি হয়েছে ওর?"
"কন্সট্রাকশনের কাজের সময় দুর্ঘটনা,"
এড চেঁচিয়ে বললেন। "ও
পড়ে গিয়েছিল। একটা
ব্যাকহো [মাটি খোঁড়ার যন্ত্র] ওকে ঘষটে চলে গিয়েছে"
অজ্ঞান
হয়ে যাওয়া ছেলেটা মুখচোখ ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছিল, কাঁপছিল।
ক্লিনিকের উজ্জ্বল সবুজ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে
ছিল ম্যানুয়েল। হাত নেড়ে ইশারা করল। ছেলেটাকে
কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ দুটো বয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরের মাঝখানে টেবিলের উপর রাখল। ম্যানুয়েল
ইন্ট্রাভেনাস লাইন খোঁজার
কাজ শুরু করলেন। ববি
ছেলেটার উপর জোরালো আলোটা টেনে নিয়ে এল। ভালো করে দেখল ক্ষতস্থান।
মোটেই ভালো লাগল না তার। ছেলেটার মরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
কাঁধ
থেকে শরীরের নিচের দিকে গভীর ক্ষতটা নেমে গিয়েছে। চামড়ার নিচের মাংস একেবারে ছিন্নভিন্ন
হয়ে গিয়েছে। মাঝখানে কাঁধের হাড় স্থানচ্যুত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে ফ্যাটফেটে সাদা হাড়। একই রকম একটা ক্ষত চিরে
দিয়েছে উরুর পেশী। এতটাই গভীর সেই ক্ষত যে ভিতরের ফেমোরাল ধমনীর
স্পন্দন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ববির মনে হলো, ছেলেটার পা-টা দু
টুকরো হয়ে গিয়েছে।
"কীভাবে এ আঘাত লাগল সেটা আমাকে আর
একবার বলুন," প্রশ্ন করে।
"আমি নিজের চোখে
দেখিনি," এড বললেন. " ওরা
বলেছে একটা যে ব্যাকহো ওর গায়ের উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল।"
"কিন্তু দেখে তো
মনে হচ্ছে কিছু একটা ওকে আক্রমণ করেছিল," ববি কার্টার বলে, ভালো করে ক্ষতটা দেখে। এমারজেন্সিতে কাজ করার
সুবাদে এরকম ধরণের আহত মানুষ সে এর আগেও দেখেছে গত দুবছরে। দুটোর কথা ওর মনে আছে। প্রথমটায় একটা দু বছরের শিশুকে একটা রটওয়েলার কুকুর
আক্রমণ করেছিল। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এক মাতাল সার্কাস কর্মীকে এক বেঙ্গল টাইগারের খপ্পরে পড়ে গিয়েছিল। উভয় ক্ষেত্রেই আঘাত
একই রকমের ছিল। পশুদের আক্রমণের একটা বিশেষ ধরণ থাকে।
"আক্রমণ?"
এড বলে উঠলেন, "না, না। সেরকম কিছু না, ব্যাকহোর কারণে এটা ঘটেছে, বিশ্বাস করুন।" এড
কথা বলার মাঝে একবার ঠোঁটটা চেটে নিলেন। একটু উত্তেজিত
দেখাচ্ছিল মানুষটাকে। আচরণ থেকে মনে হচ্ছে
কিছু একটা লুকাতে চাইছেন।
ববি অবাক হয়ে ভাবল, কেন! তবে এরা যদি অনভিজ্ঞ স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করায় তাহলে তো সব
সময় এরকম দুর্ঘটনা ঘটবে।
ম্যানুয়েল বললেন, "আপনি কি জায়গাটা পরিষ্কার করতে চান?"
"হ্যাঁ," কার্টার
বলল। "আপনি ব্লক করার পরে।"
নিচু হয়ে আঙুল
দিয়ে ক্ষতস্থান ছুঁয়ে দেখল। যদি মাটি খোঁড়ার যন্ত্রের দাঁত দেহটার উপর দিয়ে ঘষটে
চলে যায় তাহলে ক্ষতস্থানের ভিতরে মাটি
ঢুকে যেতে বাধ্য। কিন্তু
ওখানে
এরকম কিছুই নেই। শুধু পিচ্ছিল,
পাতলা ফেনার মতো কিছু লেগে আছে। তাছাড়া ক্ষত
থেকে এক অদ্ভুত রকমের গন্ধ ছাড়ছে। এক
ধরনের পচা দুর্গন্ধ, যার সাথে মিশে আছে মৃত্যু এবং ক্ষয়ের নির্যাস। এরকম কোনও গন্ধ এর আগে কার্টারের নাকে কোনোদিন প্রবেশ করেনি।
"এ ঘটনা কতক্ষণ
আগে ঘটেছে?"
"এক ঘন্টা আগে।"
আবার কার্টার লক্ষ্য করল এড রেজিসের মুখে একটা ইতস্ততভাব। মনে হচ্ছে লোকটার
স্নায়বিক উত্তেজনার মাত্রা একটু বেশি। লোকটাকে
দেখে কন্সট্রাকশন কোম্পানীর ফোরম্যান বলে মনে হচ্ছে না। বরং
একজন একজিকিউটিভ অফিসার যেন। স্পষ্টতই বিষয়টার গুরুত্ব তাকে চাপে ফেলে দিয়েছে।
ববি কার্টার ক্ষতস্থানের দিকে মুখ ফেরাল। যেকোনো কারণেই হোক
তার এর সাথে
যান্ত্রিক কিছুর যোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। এটা মোটেই সেরকম দেখাচ্ছে না। ক্ষতস্থানে কোনও ধুলো মাটি নেই, নেই যার সাথে ধাক্কা লেগেছে
তার কোন কুচি। যেকোনো
রকম যান্ত্রিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে - তা সে গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগুক বা কারখানার কোনও দুর্ঘটনা - প্রায় সবসময়েই কিছু না কিছু উপাদান লেগে থাকে রক্ত মাংসের সাথে। কিন্তু এখানে
কিছুই নেই। পরিবর্তে, ছেলেটার চামড়া ফেঁড়ে গিয়েছে - ছিঁড়ে গেছে
বলা ভালো — কাঁধ থাকে শরীরের
নিচের দিকে এবং পুরো উরু জুড়ে।
এটা নিশ্চিতভাবেই কিছুর আক্রমণের মতোই দেখাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা শরীরের অধিকাংশই অংশেই কোনও আঘাতের দাগ নেই। যেতা
আবার একটা প্রাণীর আক্রমণের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যাপার।
ববি পুনরায় তাকাল মাথা, বাহু, হাত-
হাতগুলো।
ছেলেটার হাতের দিকে তাকাতেই এক ঠান্ডা জলের স্রোত বয়ে
যাওয়ার অনুভূতি হলো। দুহাতের
তালুতেই চিরে যাওয়ার মতো কাটা দাগ। একই রকম দাগ কব্জি এবং বাহুতেও।
তা জানতে শিকাগোতে দীর্ঘ সময় কাজ করার কারণে
তার জানা আছে এর অর্থ কী ।
"ঠিক আছে," কার্টার
বলে, "বাইরে অপেক্ষা করূন।"
"কেন?" এড শঙ্কিত স্বরে জানতে চান। তার এটা পছন্দ নয়।
"আপনি কি চান,
আমি ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, নাকি চান না?" কথাটা বলে একরকম ঠেলে বাইরে বার করে এডের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। কী ঘটছে সেটা বুঝতে
পারছিল না ববি, কিন্তু যা ঘটছে তা ওর ভালো লাগছে না। ম্যানুয়াল ইতস্তত ভঙ্গীতে
বললেন, "আমি পরিষ্কার করার কাজ করব?"
"হ্যাঁ," বলেই ছোট্ট অলিম্পাস পয়েন্ট-এন্ড-শুট ক্যামেরাটা হাতে তুলে নিল।
ক্ষতস্থানের বেশ কিছু ছবি তুলে নিল। ভালো করে দেখার
জন্য আলোটা কিছুটা সরিয়ে আনল। ক্ষতগুলো
কিছুতে কামড়ানোর মতোই দেখাচ্ছে বলে কার্টারের মনে হলো। এইসময় ছেলেটা গুঙ্গিয়ে উঠল।
ক্যামেরাটা একপাশে রেখে
ববি ওর দিকে ঝুঁকে তাকাল। ঠোঁটটা নড়ছিল, জিভ ফুলে গিয়েছে।
"র্যাপ্টর,"
ছেলেটা বলল, "লো সা র্যাপ্টর..."
কথাটা শুনে, ম্যানুয়েলের হাড়হিম হয়ে গেল, ভয়ে
পিছিয়ে গেল এক পা।
"এর মানে কী?" ববি জানতে চাইল।
ম্যানুয়াল মাথা নাড়ল। “আমি জানি না,
ডাক্তার। 'লো সা র্যাপ্টর' - এটা স্প্যানিশ নয়।"
"নয়?"
স্প্যানিশের মতোই তো শোনাচ্ছে। "যাই
হোক দয়া করে জায়গাটা দ্রুত ওয়াশ ক্রে ফেলুন।"
"না, ডাক্তার
কার্টার।" নাকে কুঁচকে বললেন ম্যানুয়েল।
"খারাপ গন্ধ।" চাপাস্বরে একটা গালাগাল দিল।
ববি আবার ক্ষতস্থানে ছড়িয়ে
থাকা পিচ্ছিল ফেনার মত বস্তুর দিকে তাকাল। ওতে আঙুল ঠেকিয়ে দু আঙ্গুলে নেড়ে দেখল। প্রায়
লালার মতো কিছু মনে হচ্ছিল.…
আহত ছেলেটার ঠোঁট আবার নড়ল। "র্যাপ্টর," ফিসফিস করে বলল।
ভয়ের সুরে ম্যানুয়েল বললেন, "এটা
ওকে কামড়ে দিয়েছে।"
"কিসে কামড়েছে?"
"র্যাপ্টরে।"
"র্যাপ্টর
কী?"
"এর মানে হুপিয়া।"
ববি ভুরু কুঁচকে
তাকালেন। কোস্টারিকানরা খুব একটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন
নয়। কিন্তু এর আগেও সে একটা
গ্রামে এই হুপিয়া শব্দটা শুনেছিল। যারা নাকি রাতচরা ভূত, মুখবিহীন ভ্যাম্পায়ার। যারা ছোটো
বাচ্চাদের অপহরণ করত। বিশ্বাস অনুসারে,
হুপিয়া একদা কোস্টারিকার পাহাড়ে বাস করত। কিন্তু এখন উপকূলীয়
দ্বীপে বসবাস করে।
ম্যানুয়েল দু পা পিছিয়ে গিয়ে, বিড়বিড় করে ধার্মিক সংকেত এঁকে বললেন, "এটা মোটেই স্বাভাবিক নয়, এই গন্ধটা!
এটা হুপিয়ার গন্ধ।"
আহত ছেলেটার ক্ষতস্থান
পরিষ্কার করার নির্দেশ দিতে যাবে কার্টার এমন সময় ছেলেটা
চোখ খুলে টেবিলে সোজা
হয়ে উঠে বসল। ম্যানুয়াল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন। আহত ছেলেটা আর্ত হাহাকার করে মাথা ঘুরিয়ে বড় বড় চোখে ডান ও বাম দিকে তাকাতে থাকল। য় এরপর
মুখ থেকে হড়হড় করে বের হয়ে এল রক্ত। শরীর জুড়ে শুরু হলো খিঁচুনি, সারা শরীর
কাঁপতে শুরু করল চরমভাবে। ববি
ওকে চেপে ধরেও টেবিল থেকে কংক্রিটের মেঝেতে পড়ে যাওয়া থেকে আতকাতে পারল না। আবার
এক ঝলক রক্তবমি করল ছেলেটা।
রক্ত ছিটিয়ে গেল চারদিকে। এড দরজা খুলে ভিতরে এলেন, “কী হলো, এসব কি হচ্ছে?" তারপরেই চারদিকে রক্ত দেখে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বেরিয়ে গেলেন।
ছেলেটার দাঁতের ফাঁকে একটা কাঠের
টুকরো ঢোকানোর চেষ্টা করল ববি। কাজটা করতে পারলেও ও বুঝতে পারছিল লাভ কিছু হবে না। একটা চূড়ান্ত খিঁচুনির ঝাঁকুনি দিয়ে ছেলেটার শরীর শিথিল হয়ে গেল। থেমে গেল সব স্পন্দন।
কার্টার মুখ থেকে মুখে শ্বাস দেওয়ার কাজটা করার জন্য নিচু হতেই
ম্যানুয়েল তার কাঁধ চেপে ধরে পিছনের দিকে জোরে টান দিলেন। "না," বললেন। "হুপিয়ার প্রভাব ছড়িয়ে যাবে ।"
"ম্যানুয়েল, ঈশ্বরের দোহাই-"
"না।" উনি
ববির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “না। আপনি সব কিছু জানেন না ।”
ববি মাটিতে পরে থাকা শরীরের
দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, চেষ্টা করেও কোনও লাভ হবে না; ছেলেটাকে বাঁচানোর আর কোনও সম্ভাবনা নেই। ম্যানুয়েল সেই লোকগুলোকে ডাকলেন,
ঘরের ভিতর এসে দেহটা নিয়ে
যাওয়ার জন্য। এড
আবার এলেন ঘরের ভিতরে।
হাতের উল্টোদিক দিয়ে
মুখ মুছে বিড়বিড়
করে বললেন, "আমি নিশ্চিত আপনি যা করতে পারতেন সেটাই
করেছেন!"
ববি দেখল দেহটা নিয়ে
লোকগুলো হেলিকপ্টারে উঠে গেল। একটু বাদেই ওটা জোরালো আওয়াজ ছেড়ে আকাশে উঠে গেল।
"এটাই ভালো হলো," ম্যানুয়েল বললেন।
ববি ছেলেটার হাতের
কথা ভাবছিল। ওখানে একাধিক
কাটা ছেঁড়ার দাগ ছিল। যেগুল নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে হয়েছে, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল বৈশিষ্ট্যগত ‘প্যাটার্ন’ দেখেই।
নিশ্চিতভাবে ছেলেটা কন্সট্রাকশন জনিত দুর্ঘটনায়
মারা যায়নি; ওর উপর হামলা হয়েছিল,
এবং ছেলেটা আক্রমণকারীর হাত
থেকে বাঁচতে নিজের হাত ব্যবহার করেছিল। “এই দ্বীপটা কোথায়, যেখান থেকে
ওরা এসেছিল?” জিজ্ঞাসা করল।
"সমুদ্রের মধ্যে।
সম্ভবত সমুদ্রের তীর
থেকে একশো থেকে একশো কুড়ি মাইল দূরে।”
"একটা রিসর্টের
পক্ষে বেশ দূর," ববি বলল।
ম্যানুয়েল হেলিকপ্টারটাকে
দেখছিল। "আশা করি ওরা আর কখনই ফিরে আসবে না।"
সে যাই হোক, ববি ভাবছিল, অন্তত তার কাছে ছবিগুলো আছে। কিন্তু ফিরে তাকাল
টেবিলের দিকে, দেখতে পেল ক্যামেরাটা ওখানে নেই।
অবশেষে সেদিন রাতে একটানা হতে থাকা বৃষ্টি থামল। ক্লিনিকের পিছনে বেডরুমে
একা
ববি তার বহু ব্যবহারে বিধ্বস্ত পেপারব্যাক স্প্যানিশ অভিধানটা হাতড়াচ্ছিল।
ছেলেটা "র্যাপ্টার" বলেছিল এবং ম্যানুয়েলের অস্বীকার সত্ত্বেও, ওর সন্দেহ হয়েছিল ওটা
একটা স্প্যানিশ শব্দ। সে ভাবনা ঠিকই ছিল, অভিধানে
সে ওই শব্দটা খুঁজে পেয়েছে। এর অর্থ "হামলাকারী"
বা "অপহরণকারী।"
মানেটা জানার পর ববি ভাবতে শুরু করেছিল। শব্দের অর্থটা সন্দেহজনকভাবে হুপিয়ার অর্থর কাছাকাছি
মনে হচ্ছে। ও নিজে কুসংস্কারে
বিশ্বাসী নয়। কোনও ভূতের পক্ষে ওভাবে হাত কেটে দেওয়া সম্ভব নয়।
ছেলেটা তাকে কী বলতে চাইছিল?
পাশের ঘর থেকে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ শোনা গেল। গ্রামের এক মহিলা
প্রসববেদনার প্রথম পর্যায়ে আছে। স্থানীয়
ধাত্রী এলেনা মোরালেস ওর দেখাশোনা করার জন্য ওখানে আছেন। ববি ওই ঘরে গিয়ে এলেনাকে ইশারা করলেন কিছুক্ষণের জন্য বাইরে
আসার।
"এলেনা..."
"হ্যাঁ, বলুন ডাক্তার?"
"আপনি কি জানেন র্যাপ্টর কি?"
এলেনা পাকা চুলের ষাটোর্ধ্ব, বাস্তবের মাটিতে বসবাসকারী একজন শক্তপোক্ত মানসিকতার মহিলা।
রাতের আকাশের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বললেন,
"র্যাপ্টর?"
"হ্যাঁ। আপনি কি এই কথাটা আগে শুনেছেন?"
"সি, হ্যাঁ।" এলেনা মাথা নাড়লেন।
“এর মানে… এমন একজন কেউ যে রাতের বেলায় আসে এবং একটা শিশুকে নিয়ে চলে যায়।"
"একজন কিডন্যাপার?"
"হ্যাঁ।"
"হুপিয়া?"
শব্দটা
শুনে এলেনা একটু যেন চমকে গেলেন। "এই
শব্দটা উচ্চারণ করবেন না, ডাক্তার।"
"কেন করব না?"
"এখন হুপিয়া নিয়ে কথা বলব না," এলেনা
মাথা নেড়ে দৃঢ়ভাবে কথাটা বলে কাতরাতে থাকা
রোগিণীর দিকে এগিয়ে গেলেন। "এ নিয়ে এখন কথা বলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।"
"কিন্তু একজন র্যাপ্টার কি তার শিকারকে
কামড়ে কেটে ছিঁড়ে দেয়?"
" কামড়ে কেটে ছিঁড়ে দেওয়া?" এলেনা
হতভম্ব হয়ে বললেন। “না, ডাক্তার। এরকম কিছু ঘটে না। একজন রাপ্টার এমন একজন মানুষ যে সদ্যজাত বাচ্চা নিয়ে চলে যায় নেয়।" মুখ দেখে
মনে হচ্ছিল এ নিয়ে কথা বলতে তার ভাল লাগছে না। যেনতেন প্রাকারে কথা থামাতে পারলে বেঁচে
যায়। এলেনা ক্লিনিকের ঘরে দিকে ঘুরে হেঁটে যেতে যেতে বলল, “ ডাক্তার, আমি আপনাকে ডাকব যখন ওর সময় হবে। মনে হয়
আরও এক বা দু ঘণ্টা খুব বেশি হলে।”
ববি আকাশের তারার দিকে তাকাল। কানে ভেসে আসছিল
সমুদ্র সৈকতে ঢেউয়ের আছড়ে
পড়ার নরম শব্দ। ওদিকে তাকাতেই অন্ধকারে উপকূলে
নোঙর করা মাছ ধরার নৌকাগুলোর ছায়া দেখতে পেল। পুরো দৃশ্য জুড়ে ছড়িয়ে ছিল নিশ্চিন্ত
শান্তভাব। সবকিছু একেবারে স্বাভাবিক, এর মাঝে ভ্যাম্পায়ার
এবং অপহৃত শিশুদের কথা ভেবে ওর নিজেকেই কেমন যেন
বোকা বোকা মনে হচ্ছিল।
ববি নিজের ঘরে ফিরে গেল। ওর আবার মনে পড়ল ম্যানুয়েলের
কথা। উনি জোর দিয়ে বলেছিলেন ওটা কোনও স্প্যানিশ শব্দ নয়। কৌতূহলবশত, ও একটা ইংরেজি অভিধান টেনে নিল। অবাক হয়ে দেখল ওখানেও শব্দটা আছে:
raptor\n [deriv.
of L. raptor plunderer,
fr. raptus]:
bird of prey.
যার অর্থ র্যাপ্টর শব্দটা এসেছে ল্যাটিন র্যাপ্টাস থেকে। অর্থ লুণ্ঠনকারী। এছাড়াও এর অর্থ শিকারী
পাখি।
No comments:
Post a Comment