Search This Blog

Friday, October 13, 2017

#প্রাচীন_সপ্তাশ্চর্যের_খোঁজ (৮৮-৮৯-৯০-৯১-৯২-৯৩-৯৪-৯৫) নবম অধ্যায় - চতুর্থ অভিযান - জিউসের স্ট্যাচু এবং আরটেমিসের মন্দির[প্রথম ভাগ]

#প্রাচীন_সপ্তাশ্চর্যের_খোঁজ (৮৮-৮৯-৯০-৯১-৯২-৯৩-৯৪-৯৫ )
নবম অধ্যায় - চতুর্থ অভিযান
জিউসের স্ট্যাচু এবং আরটেমিসের মন্দির 
প্রতিম দাস
০০০০০০০০০০০০০০

নবম অধ্যায়
চতুর্থ অভিযান
জিউসের স্ট্যাচু এবং আরটেমিসের মন্দির
০০০
প্যারিস – রোম
১৮ই মার্চ , ২০০৬
টারটারাসের আগমনের ২ দিন আগে
০০০০০
দ্যা চ্যাম্প-এলিসেস
প্যারিস, ফ্রান্স
১৮ই মার্চ , ২০০৬, সকাল ১১টা
টারটারাসের আগমনের ২ দিন আগে
০০০০০

আর্ক ডে ট্রায়াম্পের চারপাশের বিরাট বিরাট মালটি লেনগুলোয় ভিড়ের ভেতরে চার চাকার এস ইউ ভি টা নিয়ে চক্কর মারছিল জ্যাক ওয়েস্ট জুনিয়র।
লিলি বসে আছে প্যাসেঞ্জার সিটে । পেছনে পুহ বিয়ার, স্ট্রেচ আর বিগ ইয়ার্স।
শ্ত্রুর  এলাকায় সাংঘাতিক রকমের কোন মিশনে যাওয়ার আগে যেমনটা  হয় সেরকম উদ্বিগ্নতায় ভরা মুখে নীরবে বসে ছিল ওরা।
প্যারিসের মধ্য  এলাকাটা দেখতে খ্রীস্টান ক্রশের মতো।
লম্বা অংশটা হল চ্যাম্পস-এলিসিস, যে পথ ধরে এগোলে আর্ক ডে ট্রায়াম্প থেকে সোজা প্যালিস ডে ল্যুভরে যাওয়া যায়। আর আনুভূমিক ভাবে থাকা ক্রশের ছোটো বাহুর একপ্রান্তে অবস্থান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলীর। আর অন্য প্রান্তে অসাধারন সুন্দর সেন্ট মেরী ম্যাগডালেন চার্চ।
আর এই দুই বাহুর সংযোগ স্থলটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এখানেই অবস্থান প্লেস ডে লা কনকর্ডের ।
ফরাসি বিদ্রোহের সময় এই জায়গাটা বিখ্যাত হয়ে যায় শতাধিক বিখ্যাত পুরুষ আর মহিলার মৃত্যুদন্ডের স্থান রুপে। প্লেস ডে লা কনকর্ডে হলো রক্তাক্ত গিলোটিনের এলাকা ।
এখন অবশ্য সেখানে, ঠিক একই জায়গায় ... প্যারিসের একেবারে হৃদয়ে – সব সময়ের জন্য যেদিকে সকলের নজর থাকে – সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা সুউচ্চ ইজিপশিয়ান ওবেলিস্ক।
লাক্সারের মন্দিরের দ্বিতীয় ওবেলিস্ক।
পৃথিবীতে যত অবেলিস্ক আছে – ইজিপ্টে বা অন্য কোথাও – প্যারিসের এই ওবেলিস্ক এক দিক থেকে একেবারে অদ্বিতীয় এক বিশেষ কারনে –
এর পিরামিডিয়নটা যা ওর একেবারে ওপরে অবস্থান করছে তার রঙ সোনালী ।
ইতিহাসবিদ দের এটা খুব পছন্দের জিনিষ। কারন প্রাচীন ইজিপ্টে ওবেলিস্কের মাথা এভাবেই রঙ করা থাকতো । সে সময়ে প্রত্যেক ওবেলিস্ক এর মাথার ক্ষুদ্র পিরামিডটা মোড়ানো থাকতো ইলেক্ট্রাম দিয়ে । রুপ আর সোনা দিয়ে বানানো এক বিরল সংকর ধাতু ।
লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো এই যে প্যারিসের ওবেলিস্কে সোনালী পিরামিডিয়নটা কয়েক বছর আগে স্থাপন করা হয়  - বিখ্যাত এই পাথরের সুঁচের ওপর ওটা স্থাপন করা হয় ১৯৯৮ সালে।
‘পুহ,’ ওয়েস্ট গাড়ী চালাতে চালাতেই জিজ্ঞেস করলো , ‘ভূগর্ভস্থ সমাধি কক্ষের এলাকা দেখা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ দেখেছি । একেবারে ফাঁকা, চিন্তার কিছু নেই। ওখানে ঢোকার দরজা চারলস ডে গল ব্রিজের নিচে । টানেলটা চলে গেছে বুলেভারড ডীডেরট তলা ধরে দরজার তালাটা নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে।’
‘স্ট্রেচ ট্রেনের কি খবর?’
‘টিজিভি সার্ভিস। প্ল্যাটফর্ম ২৩। ১২টা ৪৪ এ ছাড়ে । প্রথম স্টপেজ ডিজনে ।’
‘বেশ, ভালো ।’
চ্যাম্প-এলিসেস দিয়ে গাড়ী চালানোর  সময় চয়া বুলেভারড দিয়ে সামনে তাকিয়ে ছিল প্যারিসের ওবেলিস্কটার দিকে । সমস্ত কিছুর মাথা টপকে প্রায় ছতলা বাড়ীর সমান উঁচু হয়ে দন্ডায়মান।
গাড়ীতে রয়েছে পাহাড়ে চড়ার সরঞ্জাম – দড়ি, হুক, পিটন, ক্যারাবাইনার – সব তৈরী ওই অতিকায় সুচে উঠে ওপরের জিনিষটাকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য। যে বেশবাস আপাতত ওয়েস্ট ধারন করে আছে তাতে ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও হল একজন বেপরোয়া থ্রিলারপ্রেমী । অতি দ্রুত কাজটা করতে পারলে পুলিস আসার আগেই সকান দিতে অসুবিধা হবে না। আর সেটা করেই ওরা চলে যাবে ল্যুভরে । আর বড় ও সাঙ্ঘাতিক কাজটা করার জন্য ।
কাছাকাছি পৌঁছে গেছে প্রায় এমন সময় , ট্র্যাফিকের ভী কিছুটা কমতেই –
‘ধ্যাত তেরে কি ...’ ওয়েস্ট বলে উঠলো ।
ওবেলিস্ক এর নিচের অংশটা বিশেষ কাঠামো দিয়ে ঘেরা । যা তিনটে স্তরে বিভক্ত এবং জাল দিয়ে ঘেরা । যার একটাই অর্থ ওখানে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে ।
আর ওই কাঠামোর ভেতরে ঢোকার একমাত্র পথে পাহারা দিচ্ছে ছয় জন সিকিঊরিটি গার্ড।
একটা বিরাট সাইন বোর্ড ঝোলানো আছে । যাতে ইংরেজি আর ফরাসী ভাষায় লেখা ‘অত্যাবশকীয় পরিষ্কার করনের কাজ চলিতেছে’।
স্ট্রেচ কিছু একটা সন্দেহ হচ্ছে এমন ভাবে বললো, ‘এটাকে পরিষ্কার করা হচ্ছে । ব্যাপারটা একটু কেমন কেমন মনে হচ্ছে না তোমার? আমার তো মনে হচ্ছে আমাদের ইউরোপিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বীরা আসলে তাদের কাজ করছে।’
‘ অসমর্থিত সেন্ট মার্কের গসপেল খুব বাজে একটা জিনিষ । এ পৃথিবীতে ওটার আর অনেক কপি আছে ,’ ওয়েস্ট বললো। ‘নিশ্চিত ভাবেই ডেল পিয়েরোর কাছেও ওটার একটা কপি আছে । আর সেটা পড়েই ও ওবেলিস্ক এর ব্যাপারটা ধরে ফেলে এবং আসল ব্যাপারটাকে মেপে বার করে নিয়েছে । যেহেতু ওটা ওখান থেকে এখন আর  সরানো সম্ভব নয় তাই ওটার কাছে যাওয়ার পথটাই আটকে দিয়েছে। যাতে আমরা কিছু করতে না পারি। এর অর্থ – ধ্যাত তেরে কি... নিকুচি করেছে – ডেল পিয়েরো আলেকজান্ডারের সমাধির প্রায় কাছেই পৌছে গেছে । সবার ওপরে থাকা টুকরোটা  ওই...’
কাঠামো দিয়ে ঘেরা ওবেলিস্কটাকে দেখতে দেখতে ওয়েস্ট , নতুন করে ভাবছিল, নতুন করে পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল, নতুন দিশা খুঁজছিল।
‘ সবকিছু উলটে পালটে গেলো । শোনো সবাই। পরিকল্পনা বদলাচ্ছি । এখন আর ওবেলিস্ক আমাদের প্রথম লক্ষ্য নয় । আমরা আগে যাবো ল্যুভরে । যে ভাবে কাজ করার কথা আছে সেটা করবো । তারপর ফিরে যাওয়ার সময় ওবেলিস্কটার ব্যাপারে মাথা ঘামাবো ।’
‘পাগল হলে নাকি, ‘ স্ট্রেচ বললো । ‘এর ফলে আমাদের জীবন সংশয় হবে । অর্ধেকের বেশী জেন্ডার মেরি আমাদের খোঁজে নেমে পড়বে ।’
‘স্ট্রেচ, এই মুহূর্তে ওবেলিস্ক দেখার চেষ্টা করে  ইউরোপিয়ান দের সাথে সরাসরি সং ঘর্ষে নামলে আরো বেশি  নজরে পড়ে যাব আমরা,’ ওয়েস্ট বললো । ‘আমি আশা করেছিলাম কেউ বুঝতে পারার আগেই আমি ওটাতে উঠতে এবং নামতে পারবো । যেটা এখন আর সম্ভব নয়। কিন্তু ল্যুভরে আমরা যেটা করতে চাই সেটা করলে গোটা প্যারিসের নজর ওই দিকে চলে যাবে – যে হইচই এর সৃষ্টি হবে সেটা আমাদের সুযোগ করে দেবে সিকিউরিটি গার্ডদের এড়িয়ে ওবেলিস্ক এর কাজটা সেরে নেওয়ার। আর সেটার ভাবনা থেকেই বুঝতে পারছি আমাদের পালিয়ে যাওয়ার গাড়িটা ভালোই কাজ দেবে।’
‘আমি ওটার ব্যাপারে কিছুই জানি ...’ স্ট্রেচ বললো ।
পুহ বিয়ার বলে উঠলো, ‘তুমি কি জানো আর কি জানো না সেটা এখন অপ্রয়োজনীয় বিষয়, ইজ্রায়েলী। সত্যি বলছি, তোমার সব ব্যাপারে সন্দেহ করাটা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। হান্টসম্যান যা বলছে সেটাই করো। এখানে ওই নেতৃত্ব দিচ্ছে ।’
স্ট্রেচ গম্ভীর মুখে পুহ এর দিক থেকে চোখ না নামিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে। সেটাই হোক । আমি মেনে নিচ্ছি ।’
ওয়েস্ট বললো, ‘বেশ । ল্যুভর এর পরিকল্পনা যা ছিল সেটাই থাকছে । বিগ ইয়ার্স, তুমি আর লিলি আমার সাথে থাকবে। আমরা ভেতরে ঢুকবো । পুহ আর স্ট্রেচ তোমরা পালিয়ে যাওয়ার গাড়ি নিয়ে তৈরি থাকবে ঠিক জায়গায় যখন আমরা লাফ দেবো ।’
পুহ বিয়ার মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, ‘ চিন্তা নেই অপেক্ষায় থাকবো হান্টস ম্যান।’

কুড়ি মিনিট বাদে, ওয়েস্ট, লিলি আর বিগ ইয়ার্স – বন্দুক ছাড়াই – মেটাল ডিটেক্টরের দরজা পার হয়ে ঢুকে গেল ল্যুভরের ভেতরে।
বিখ্যাত কাঁচের পিরামিডটা ঝুলছিল ওদের ওপরে । চত্বরটাকে ভরিয়ে রেখেছিল ঝকঝকে সূর্যের আলোতে।
কাঁচের পিরামিডটাকে দেখতে দেখতে বিগ ইয়ার্স বলে উঠলো, ‘আমার মনে হচ্ছে আমি যেন ড্যান ব্রাউনের গল্পের ভেতর ঢুকে পড়েছি ।’ 
ওয়েস্ট উত্তর দিলো, ‘ওরা সে সব করেনি যা আমরা করতে চলেছি দ্যা ভিঞ্চি কোডে।’
লিলি ওদের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল সুরক্ষা কবচ। যতই হোক একটা ছোটো বাচ্চাকে সাথে নিয়ে নিশ্চিত ভাবেই কোনো ছিনতাইকারীর দল এখানে ঢুকবে না !
ওয়েস্টের সেল ফোন বেজে উঠলো ।
পুহ বিয়ার । ‘আমারা পালানোর গাড়ী পেয়ে গিয়েছি। দরকার মতো কাজ হয়ে যাবে।’
‘দশ মিনিট সময় দাও ,’ ওয়েস্ট কথাটা বলেই এগিয়ে গেল।

মিনিট বাদে , দেখা গেল ওয়েস্ট আর বিগ ইয়ার্স দুজনের পরনেই সাদা  বিশেষ কভারঅল পোশাক । এটা পড়ে ল্যুভরের মেইন্টেন্যান্স কর্মীরা – মিউজিয়ামের নিচের ঘরে দুজন কর্মীকে অজ্ঞান করে এই পোশাক সংগ্রহ করা হয়েছে ।
ডেনন উইংএ প্রবেশ করলো ওরা এবং উঠতে শুরু করলো ডারু স্টেয়ারকেস ধরে । সিঁড়ি পথটা নানান দিকে এঁকেবেঁকে অনেক তোরনের স্তম্ভের পেছন দিয়ে ঘুরে গিয়ে পৌঁছেছে একটা চওড়া স্থানে । যেখানে রাখা আছে ...
... ডানাওয়ালা বিজয়িনী, উইংড ভিক্টরি অফ সামোথ্রেস ।
০০০০০
মূর্তিটা সত্যিই অসাধারন, মনোমুগ্ধকর ।
সামনে হাওয়ার দিকে বুক চিতিয়ে দেবী দাঁড়িয়ে আছেন । অতিশয় সুন্দর তাঁর ডানা দুটি পেছন দিকে অপেক্ষমাণ হাওয়া কেটে উড়ে যাওয়ার প্রতীক্ষায় । ভেজা পোশাক অনুপম দেহবল্লরীতে আটকে আছে । প্রতিটি ভাঁজ এবং খাঁজ নিপুণ নিখুঁত ভাবে শ্বেত পাথরের গায়ে ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষ শিল্পী ।
ছয় ফুট উঁচু । রাখা আছে পাঁচ ফুট উঁচু বেদীর ওপর । চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকদের মাথা ছাড়িয়ে গর্বিত ভাবে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে চলেছেন ডানাওয়ালা বিজয়িনী দেবী।
মাথা যথাস্থানে বর্তমান থাকলে ডানাওয়ালা বিজয়িনী ভেনাস ডি মেলো’র– যেটা ল্যুভরের আর এক আকর্ষণের বিষয়- মতই বিখ্যাত হয়ে যেতো । ভেনাসের চেয়ে সবদিক থেকে এই মূর্তির শৈল্পিক গুন অনেক অনেক বেশী উঁচুমানের ।
সাধারন দর্শক  সেটা না বুঝলেও ল্যুভরের ওপরওয়ালারা এটা নিশ্চিত ভাবেই বুঝেছেন । আর সেকারনেই এর অবস্থান এই ভবনের উচ্চতম স্থানে, দোতলায় । মোনালিসা থেকে খুব একটা দূরেও নয়। অন্য দিকে ভেনাসকে রেখে দেওয়া হয়েছে নিচের তলায় ।
যে বেদীটার ওপর দেবীকে রাখা আছে সেটা জাহাজের সামনের অংশের মতো সূঁচালো । কিন্তু এটা জাহাজের অনুকরন নয় মোটেই ।
এটা জিউসের সিংহাসনের হাতল । সামনের একটা ভাঙা অংশ ।
একটু ভালো করে দেখলে জিউসের দৈত্যাকার বুড়ো আঙ্গুলের অংশ ডানাওয়ালা বিজয়িনীর নিচে দেখতে পাওয়া যাবে
আর এর থেকেই যে অনুমানটা করা যায় তাতে চমকে যেতে হয় । যদি এই দেবী মূর্তি এতোটা বড় তাহলে জিউসের মূর্তিটা – মানে আসল আশ্চর্যটা , যা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেছে – নিশ্চিতভাবেই অতি অতিকায় ছিল।
ডেনন উইং এর দোতলায় মূর্তিটার অবস্থান ওয়েস্টকে একটা সমস্যায় ফেলে দিলো ।
ল্যুভরের দোতলায় রাখা সমস্ত রকম দ্রষ্টব্য বস্তু লেজার দ্বারা সুরক্ষিত ।  কোনো মূর্তি বা ছবি একটু নড়লেই এক অদৃশ্য লেজার সংকেত এর সাহায্যে কাছের সমস্ত দরজাগুলোতে নেমে আসবে স্টিলের গ্রিল । ভেতরে আটকে যাবে চোর ।
দোতলায় আর একটা অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া আছে । দারু স্টেয়ারকেস বা সিঁড়িটা নানা দিক দিয়ে এঁকে বেঁকে এলেও ওটাকে সম্পূর্ণ ‘সিল’ করে দেওয়া যায় । অর্থাৎ ওর ভেতরেও চোরকে আটকে রাখা অসম্ভব  নয় । তুমি ডানাওয়ালা বিজয়িনীকে সাথে হয়তো নিতে পারবে কিন্তু এখান থেকে বের হওয়া “না মুমকিন” ।
মেইনটেন্যান্স কর্মীদের পোশাকে সজ্জিত ওয়েস্ট আর বিগ ইয়ার্স সোজা উঠে গিয়ে দাঁড়ালো মূর্তিটার সামনে।
খুব একটা ভিড় নেই আজকে সেই অর্থে । ওরা দুজনে কিছু গাছের টব স্থানান্তরিত করতে শুরু করলো । যা সেভাবে কেউ নজর দিয়ে দেখলো না।
ওয়েস্ট দুটো গাছকে মূর্তির বাম দিকে রাখলো । বিগ ইয়ার্স  দুটো গাছকে নিয়ে গিয়ে বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার মাঝে দরজার তলায় রেখে দিলো । ওদিক দিয়ে দক্ষিন দিকে যাওয়া যায়। ওই দিকেই সীন নদী । লিলি ওই দরজাটার কাছেই দাঁড়িয়ে।
ওদের দিকে কারোর নজরই নেই।
ওরা দুজন মিউজিয়ামের কাজের লোক যারা এমন কিছু কাজ করছে যার খবর কেউ রাখে না, সম্ভবত ওপরওয়ালারা জানে।
ওয়েস্ট কছের একটা স্টোররুম থেকে দ্রুত “সারানোর কাজ চলছে” লেখা বোর্ড এনে মূর্তিটার সামনে রেখে দিলো দর্শকদের দিকে মুখ করে।
বিগ ইয়ার্সের দিকে তাকালো... বিগ ইয়ার্স  মাথা ঝোঁকালো ।
জ্যাক ওয়েস্ট জুনিয়র ঢোঁক গিললো ।
নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না ও কি করতে চলেছে।
একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো একেবারে শ্বেত পাথরের বেদীটার সামনে – যা জিউসের সিংহাসনের হাতল – মারলো এক ধাক্কা উইংগড ভিক্টরি অফ সামোথ্রেসের গায়ে ... ২২০০ বছরের প্রাচীন অমুল্য মূর্তিতে ... ওটা হেলে পড়লো মেঝের দিকে।
বেদী থেকে একটু নড়ে যেতেই শুরু হয়ে গেল সাইরেন বাজা এবং লাল আলোর নেভাজ্বলার ঝলকানি ।
প্রত্যেক দরজার মধ্যে নেমে এলো মোটা মোটা গ্রিলের আড়াল – ব্যাম! ব্যাম! ব্যাম! ব্যাম! – সম্পূর্ণ এলাকাটা “সিল” হয়ে গেল।
শুধু একটা দরজা বাদে ।
দক্ষিন দিকের দরজাটা ।
ওখানে গ্রিলটা বার বার নেমে এসেও আটকে যাচ্ছে দু ফুট উঁচুতে –
- আটকে যাচ্ছে কিছু আগে বিগ ইয়ার্সের রেখে দেওয়া টবদুটোর কাছে এসে ।
ওটাই বেরিয়ে যাওয়ার পথ ।
০০০০০
মূর্তিটা পড়লো দুটো গাছের টবের ওপর । যে টব দুটো ওয়েস্ট সেট করে রেখেছিল বাঁদিকে । পড়ার ধাক্কাটা অনেকটাই রুখে দিলো গাছের ডাল পালা ।
ওয়েস্ট দ্রুত ছুটে গেল মূর্তিটার কাছে। পরীক্ষা করে দেখল পা দুটো ... বা বলা যেতে পারে ছোট্ট ঘনক আকৃতির শ্বেত পাথরের টুকরো যার ওপর ওটার পা স্থিত ছিল।
মেইনটেন্যান্স রুম থেকে নিয়ে আসা বড় রেঞ্চটা বার করলো ।
‘বিশ্বের সমস্ত প্রত্নতত্ববিদরা আমাকে ক্ষমা করবেন,’ ফিসফিস করে বললো নিজের মনে এবং রেঞ্চটা দিয়ে দরকারি কাজটা শুরু করলো।
ক্যারাআআক! ক্যারাআআক!! ক্যারাআআআআআআআক !!!
আশে পাশে আটকে থাকা পর্যটকেরা বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে । দুজন এগিয়ে এসে দেখার চেষ্টা করছিল কি ঘটছে ভেতরে । বিগ ইয়ার্স অবশ্য চোখ পাকিয়ে তাদের ওখান থেকে সরিয়ে দেয়।
পর পর তিনটে জোরালো চাপের ফলে পায়ের তলার অংশটা আর রইলো না মূর্তিটার – কিন্ত্য তার বদলে দেখা গেল একটা সোনার ট্রাপেজয়েড টুকরোকে , ১৮ ইঞ্চি করে হবে এক একটা বাহু ।
ক্যাপস্টোনের তৃতীয় অংশ ।
 লুকানো ছিল বিজয়িনী মূর্তির পায়ের তলার ভিত্তিতে ।
‘লিলি!’ ওয়েস্ট ডাকলো। ‘চট করে এসে ভালো করে এটাকে দেখে নাও ! বলা যায় না এটাও যদি হাতছাড়া হয়!’
লিলি এলো, তাকালো ঝকমকে সোনালী ট্রাপেজয়েডটার দিকে । তারপর দেখল ওটার গায়ে খোদাই করা রহস্যময় চিহ্নগুলোকে ।
‘দুটো মন্ত্রের আরো কিছু লাইন,’ বললো লিলি ।
‘ বেশ । চলো এবার যাওয়া যাক,’ জানালো ওয়েস্ট   ।
টুকরোটা ঢুকে গেল বিগ ইয়ার্সের ব্যাকপ্যাকে । লিলি ছুটে গেল সবার আগে ... এক এক করে বুকে হেঁটে বেরিয়ে গেল দক্ষিন দিকের দরজাটার তলা দিয়ে টবদুটোর পাশ দিয়ে ।
তারপর জোরালো লাথি মেরে   টব দুটোকে ঢুকিয়ে দিল ভেতরে । সাথে সাথেই গ্রিল নেমে প্রকৃত ভাবেই সিল হয়ে গেল বিজয়িনীর এলাকা ।

একের পর এক লম্বা লম্বা করিডোর ধরে দৌড়ে চলছিল ওরা । পায়ে টান ধরছে, বুক ধরফর করছে ।
পেছন থেকে ভেসে আসছে – চিৎকার ফরাসী ভাষায় , মিউজিয়ামের রক্ষীরা তাড়া করে আসছে ।
ওয়েস্ট রেডিও মাইকে বললো , ‘ পুহ বিয়ার! যেখানে থাকার কথা সেখানে আছো তো?’
‘হ্যাঁ, আমরা অপেক্ষা করছি! আশা করি তুমি সঠিক জানলাটা খুঁজে পেয়েছো!’
‘খুব শিগগিরি আমরা ওটা খুঁজে নেবো!’
যে করিডোর ধরে ওয়েস্টরা দৌড়াচ্ছিল সেটা সহসাই শেষ হয়ে গেল ডান দিকের এক কোনায় । ওখান থেকে যেটা শুরু সেটা একটা বিরাট লম্বা হলওয়ে । আসলে এটা ল্যুভরের দক্ষিন অংশ । হলয়ের বাম দিকের দেওয়ালটায় পর পর টাঙানো আছে সব মাস্টারপিস পেইন্টিং। আর ফাঁকে ফাঁকে আছে উঁচু উঁচু ফরাসী স্থাপত্যের জানলা । যেখা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সীন নদী ।
আরো একদল রক্ষীর আওয়াজ ভেসে এলো এবার খুব কাছ থেকে ।
ওয়েস্ট সেই বড় রেঞ্চটা দিয়ে প্রথম জানলার কাঁচে মারল এক ঘা । ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ওটা কাঁচ । ছিটকে গেল চারপাশে।
উঁকি মারলো ওটা দিয়ে ।
দেখতে পেলো পুহ বিয়ার তাকিয়ে আছে ওর দিকে , সোজাসুজি ... কয়েক ফুট দূরে ...
...দাঁড়িয়ে আছে ছাদ খোলা একটা ডাবল-ডেকার বাসের ওপর!
ল্যুভর আর  সীন নদীর মাঝে একটা সরু রাস্তা আছে ... নাম কুয়াই ডেস টুইলেরিস। নদীর ধার ধরে চলা এ এক লম্বা রাস্তা । যা চলে গেছে নানান চড়াই উতরাই ধরে – খনো উঠে গেছে সেতুর ওপর আবার কখনো নেমে গেছে টানেল বা আন্ডারপাস রাস্তায় ।
আর সেই রাস্তাতেই পুহ বিয়ারের সদ্য চুরি করা ডাবল-ডেকার বাসটা এখন দাঁড়িয়ে , প্যালাইস  দ্যু ল্যুভরের গা ঘেঁষে। এটা সেই লাল রঙের ছাদ খোলা ডাব-ডেকার বাসগুলোর একটা, যা ভ্রমণকারীদের প্যারিস, লন্ডন বা নিউইয়র্ক ঘুরিয়ে দেখায় ।
‘ আরে! কিসের জন্য অপেক্ষা করছো তোমরা!’ পুহ বিয়ার চেঁচিয়ে বললো । ‘চলে এসো!’
‘হ্যাঁ, তাইতো!’
ওয়েস্ট লিলিকে আগে ছুঁড়ে দিলো । তারপর বিগ ইয়ার্সকে যেতে  দিলো টুকরোটা সমেত এবং নিজে ঝাঁপ মারলো দোতলার জানলা থেকে ডাবল-ডেকার বাসের ওপর – ওদিকে ধেয়ে আসা রক্ষীরা শুরু করে দিয়েছে গুলি চালানো।
ওয়েস্টের পা বাসের ওপর পড়তেই  ড্রাইভারের আসনে বসে থাকা স্ট্রেচ গ্যাসের স্যুইচ অন করে চালু করে দিলো বাস । শুরু হলো পালানো ।
বড়সড় লাল ডাবল-ডেকার বাসটাকে স্ট্রেচ যে গতিতে চালাতে শুরু করলো দুপুর বেলার প্যারিসের জনস্রোতের ভেতর দিয়ে সেই গতিতে ওই বাসটা কেউ কোনোদিন চালাবে বলে ভাবা হয়নি।
পেছন থেকে ভেসে আসছিল পুলিসের সাইরেন ।
ওয়েস্ট চিৎকার করে বললো, ‘ বাম দিকের পথটা ধরে এগোবে! ল্যুভরকে পাক মেরে যেতে হবে ! ওবেলিস্কটার কাছে!’
বাসটা বাম দিকে বেঁকলো দ্রুততার সাথে । ওয়েস্ট ওপর থেকে নিচে নেমে এসে স্ট্রেচের কাঁধের ওপর দিয়ে সামনের দিকে তাকালো।
‘ওখানে যাওয়ার পর , কি করবো?’ স্ট্রেচ জানতে চাইলো ।
ওয়েস্ট তাকালো – দেখতে পেল ওবেলিস্কটাকে বাঁদিকের গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে , তলাটা ঘেরা আছে বিশেষ কাঠামো দিয়ে ।
‘ আমি চাই যে তুমি সোজা গিয়ে ওই কাঠামোতে ধাক্কা মারো।’

ডাবল-ডেকার বাসটা প্লেস ডে লা কনকর্ডেতে ঢুকলো সশব্দে। স্পীডের চরম সীমায় উঠে ।
ওবেলিস্ক এর তলায় কাঠামোর আশে পাশে থাকা সিকিউরিটি গার্ডের দল প্রায় শেষ মুহূর্তে বুঝতে পারলো কি হতে চলেছে। পড়ি মরি করে ওরা সরে গেল ওখান থেকে। বাসটা গিয়ে সোজা ধাক্কা মারল কাঠামোটায়। ভেঙে ছিটকে গেল কিছুটা অংশ।
কাঁপতে কাঁপতে থামলো বাসটা –
- একই সাথে দেখা গেল বাসের ছাদের ওপর থেকে কাঠামোটার দ্বিতীয় ধাপে উঠে গেছে ওয়েস্ট। কাঁধে ঝুলছে দড়ি আর হাতে পাহাড়ে চড়ার সরঞ্জাম।
০০০০০
যত দ্রুত সম্ভব ওয়েস্ট উঠে গেল কাঠামোটার একেবারে ওপরে এবং ওবেলিস্কটাকে সামনাসামনি দেখলো।
একটা ঘণ্টা ঘরের মত আকারে, সারা গায়ে হিয়েরোগ্লিফিক্স এর আঁকিবুকি। মনে হচ্ছে আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেছে ।
হিয়েরোগ্লিফিক্স অক্ষরগুলোর আকৃতি বেশ বড় বড় এবং আনুভুমিক লাইনে লেখা আছে –   এক লাইনে তিনটে চিত্রলিপি, দেখানো আছে ফ্যারাওদের অলংকৃতর ফ্রেম, ওসাইরিসের ছবি এবং কিছু পশুপাখি... বেশ কিছু ফ্যাল্কন, বোলতা এবং ওপর থেকে দ্বিতীয় লাইনে প্যাঁচা।
গভীরভাবে খোদাই করা হিয়েরোগ্লিফিক্স এর খাঁজ ধরে পায়ের চাপ দিয়ে ওয়েস্ট উঠতে থাকলো ওবেলিস্কটার গা বেয়ে। মনে হচ্ছিল একটা বাচ্চা ছেলে বিরাট একটা গাছে চড়ছে যেন।
স্ট্রেচের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ইয়ার পিসে। ‘ওয়েস্ট! চ্যাম্প-এলিসেস দিয়ে ছ’টা পুলিসের গাড়ী এগিয়ে আসছে!’
‘কতটা দূরে?’
‘খুব বেশি হলে ৯০ সেকেন্ড, যদি...’
‘ঠিক আছে খবর দিতে থাকো । অবশ্য আমার মনে হচ্ছে প্যারিসের পুলিসের থেকেও চিন্তাজনক কিছুর মুখোমুখী হতে চলেছি আমরা।’
ওয়েস্ট দ্রুত উঠতে থাকলো সুউচ্চ পাথরের সূঁচটায় ... উঠতে থাকলো ওপরে আর ওপরে ... এতটা ওপরে যে ওখান থেকে বিরাট বাসটাকে দেখাচ্ছিল ছোট্ট খেলনার মতো।
সময় পৌছালো শীর্ষে। মাটি থেকে ৭০ ফুটের বেশি ওপরে। সূর্যের আলোয় ওপরের ছোট্ট পিরামিডিয়নটা চোখ ঝলসে দেওয়ার মতো চকচক করছিল।
হেসলারের নোটবুকের কথাগুলো মনে করলো
“রা’য়ের ক্ষমতাকে সুত্র বদ্ধ করে মহান রামেসিসের চোখের মতো
সুউচ্চ মিনারের সুঁচে
দ্বিতীয় প্যাঁচাকে প্রথমে
আর তৃতীয়কে দ্বিতীয়ের স্থানে ...
...সেখানেই ইস্কেন্দারের সমাধি উন্মোচিত হবে ।”
জোরে জোরে বললো, ‘দ্বিতীয় ওবেলিস্ক এর তৃতীয় প্যাঁচা।’
নিশ্চিত ভাবেই , এই ওবেলিস্ক এর গায়ের দ্বিতীয় লাইনে– এটাই তো লাক্সার মন্দিরের দ্বিতীয় ওবেলিস্ক –তিনটে প্যাঁচা পাশাপাশি খোদাই করা আছে।
আর ওই তিনটে প্যাঁচার মধ্যে তৃতীয়টার মাথার কাছে একটা ছোট্ট গোল সূর্যকে নির্দেশ করছে।
ওয়েস্ট বুঝতে পারলো ইতিহাসের পাতায় খুব কম মানুষই এরকম কাছ থেকে এত উঁচুতে এবং ওপরের এই খোদাইগুলো দেখেছে – কিন্তু কাছ থেকে এই ডিস্কের মতো সূর্য ব্যাপারটা  বিসদৃশ । তার কারন ওটা একটা খোদাই করা ছবি নয় মোটেই । বরং বলা যায় ... যাকে বলে ... একটা কিছু ঢোকানো আছে প্লাগের মতো পাথরের গায়ে একটা ফুটোতে।
ওয়েস্ট ওই টুকরোটা ধরে মারলো টান, খুলে গেল ওটা –
-দু আঙুল চওড়া, নিখুঁত গোলাকৃতি একটা ক্ষুদ্র টানেল, যা এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে ওবেলিস্কের।
নারকেল গাছে চড়ে তার গায়ে এক পাক মারার মতো করে অয়েস চলে গেল অন্য দিকটায় । ওদিকেও পাওয়া গেল একেবারে একই রকম একটা প্লাগ । ওটা খুলে নিতেই ওয়েস্ট ফু্টোটার ভেতর দিয়ে অন্য দিক দেখতে পেলো ।
‘ওয়েস্ট! জলদি! পুলিস প্রায় এসে গেল ...’
ওয়েস্ট ওর কথায় কান না দিয়ে জ্যাকেটের ভেতর থেকে দুটো হাই-টেক ডিভাইস বার করলো । প্রথমটা লেজার আল্টিমিটার। যা দিয়ে জমি থেকে ঠিক কতটা উঁচুতে এই ফুটো সেটা মাপা যাবে । আর দ্বিতীয়টা ডিজিটাল সারভের ইনক্লাইনোমিটার,  ফুটোটার আনুভূমিক এবং উলম্ব উভয় দিক থেকে সঠিক কৌনিক অবস্থান জানার জন্য ।
এই মাপগুলো জেনে নিয়ে ইজিপ্টের লাক্সারে গিয়ে “ভারচুয়ালি” একটা ওবেলিস্ক স্থাপন করে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের সমাধিস্থল খুঁজে নিতে অসুবিধা হবে না।
আল্টিমিটার বিপ শব্দ করে জানান দিলো উচ্চতার মাপ নেওয়া হয়ে গেছে।
এবার ইনক্লাইনোমিটারকে ফুটোটার ভেতর রাখলো। ওটাই বিপ শব্দ করে জানিয়ে দিলো কোনের মাপ নেওয়ার কাজ সমাপ্ত।
নামা যাক!
একজন দমকল কর্মী যে ভাবে মই এর দুপাশে পা রেখে সড় সড় করে নিচে নেমে আসে ওয়েস্ট সেভাবেই নেমে যেতে শুরু করলো ওবেলিস্কটার কানাত ধরে।
নিচে কাঠামোটায় ওয়েস্টের পা ঠেকা মাত্র  ছটা পুলিসের গাড়ী এসে ব্রেক কষে দাঁড়ালো  প্লেস ডে লা কনকর্ডের চত্বরে । গাড়ীগুলো থেকে বেরিয়ে এলো ডজন খানেক টুপি পড়া প্যারিসিয়ান পুলিস কর্মী ।
‘স্ট্রেচ! গাড়ী চালু করো! শুরু করে দাও পিছিয়ে যাওয়া ,’ বলেই ছুটতে শুরু করলো   কাঠামোটার ওপর দিয়ে  । ‘ আমি ঠিক উঠে পড়বো !’
বাসটা পিছিয়ে গেল কাঠামোটার কাছ থেকে , স্ট্রেচ এর দক্ষ চালনায় ঘুরলো বাসের মুখ । এগোতে শুরু করলো সামনের দিকে । ওদিকে ওয়েস্ট মারল এক লাফ কাঠামোর ওপর থেকে বাস লক্ষ্য করে ...
... ধপাস করে গিয়ে পড়লো বাসের ছাদের ওপর , ততক্ষনা ৎ চুড়ান্ত স্পিডে বাস ছুটে চললো সীন নদীর দিকে ।
 ল্যুভরে ওদের দুঃসাহসিক অভিযানের সাথে সাথেই সব ধরনের ফোরস নেমে পড়েছে তাদের কাজে।
ল্যুভরে চুরিটা সংগঠিত হওয়ার সাথে সাথেই খবরটা পুলিসের মাধ্যমে চলে গেছে অন্যান্য ফোরসের কাছে।
  স্ট্রেচ জানে না যে একই সাথে প্যারিস পুলিসের হাত থেকে বিষয়টা  উচ্চস্তরের বাহিনীর দায়িত্বে চলে গেছে ।
এখন ওদের খোঁজার দায়িত্ব ফ্রেঞ্চ আর্মির ।
 ঠিক যেমনটা ওয়েস্ট অনুমান করেছিল।
আর সেকারনেই বিধস্ত লাল রঙের ডাবল-ডেকার বাসটাকে ধাওয়া করে কোনও প্যারিস পুলিসের গাড়ী এলোনা ওদের পেছনে ওবেলিস্কের দিকে থেকে। ওরা কেবলমাত্র প্লেস ডে লা কনকর্ডের চত্বরটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকলো ।
একটু বাদেই পাঁচটা সবুজ রঙের দ্রূতগামী সশস্ত্র গাড়ী পুলিসদের গাড়ীগুলো পাশ দিয়ে হুস হুস করে  এগিয়ে গেল বাসটা যে পথে গেছে সেদিকে।
একই দিনে দ্বিতীয়বার কুয়াই ডেস টুইলেরিসের পথ ধরে তারস্বরে হর্ন বাজাতে বাজাতে সীন নদীর পাশ দিয়ে - পথ চলতি মানুষদের চমকে দিয়ে, রেড লাইটের সিগন্যাল না মেনে   একটা বিরাট রকমের হই চই পাকিয়ে ডাবল ডেকার বাসটা এগিয়ে চললো ।
ওদের পেছনেই আসছে ফ্রেঞ্চ আর্মির পাঁচটা গাড়ী।
প্যানহার্ড ভিবিএল নামের টার্বো চার্জড চারচাকার ডিজেল ইঞ্জিন যুক্ত সরু আকৃতির প্র্ত্যেকটা গাড়ীতে আছে তিনজন করে সেনা । অনেকটা স্পোর্টস ফোর ইন্টু ফোর গাড়ীর বর্ম পড়া সংস্করণ । অতি দ্রুতগামী এবং যে কোনোরকম রাস্তায় চলতে সক্ষম।
প্যানহার্ডগুলোতে নানান রকম আগ্নেয়াস্ত্র সেট করা আছে।  কোনোটায় লাগানো আছে ১২.৭ এম এম মেশিন গান , আবার কোনোটায় টি ও ডাবলু মিসাইল লঞ্চার।
বেশি সময় লাগলো না ওদের বাসটার নাগাল পেতে।
শুরু হয়ে গেল গুলি বর্ষণ। বাঁদিকের সব জানলাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল – খানিকবাদেই একটা সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে গেল বাসটা । সেনারা গুলি চালানো বন্ধ করতে বাধ্য হল।
দুটো প্যানহার্ড চেষ্টা করেছিল সুড়ঙ্গের ভেতর বাসের পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার । স্ট্রেচ ওদেরকে চেপে দিলো দেওয়ালের গায়ে।
এগনোর পথ না পেয়ে গতির মাথায় দুটো গাড়ীই পিছলে গিয়ে উলটে গেল ... পাক খেতে খেতে ... উঠে গিয়ে ধাক্কা খেলো সুড়ঙ্গের ছাদে ।
ওপরে বাসের ছাদে , পুহ বিয়ার আর ওয়েস্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো বুলেটের জবাব বুলেট দিয়েই দেওয়ার । পুহ দেখতে পেলো একটা প্যানহার্ড গাড়ীতে টি ও ডাবলু মিসাইল লাগানো আছে।
চিৎকার করে বললো, ‘ওদের কাছে মিসাইল আছে !”
ওয়েস্ট বললো, ‘ চিন্তা নেই, ওরা ওটা ব্যবহার করবে না! ক্যাপস্টোনের টুকরো টা ধ্বংস হয়ে যাক এটা ওরা মোটেই চাইবে না।!’
‘ওয়েস্ট!’ স্ট্রেচের কণ্ঠ শোনা গেল রেডিও মাইকে । ‘আর কিছুক্ষনের ভেতরেই ওরা রাস্তায় ব্যারিকেড সাজিয়ে ফেলবে! তখন আমরা কি করবো?’
‘যত জোরে সম্ভব চালাও!’ ওয়েস্ট জবাব দিলো । ‘ আমাদের চার্লস ডে গল ব্রিজ –’
সুউউউউম-!
-সুড়ঙ্গ ছেড়ে ওরা আবার সূর্যের আলোয় বেরিয়ে এলো। সাথে সাথেই দেখতে পেলো দুটো ফ্রেঞ্চ আর্মি হেলিকপ্টার ওদের মাথার ওপরে  আকাশে ভাসছে।
দুটো আলাদা আলাদা রকমের চপার – একটা ছোট গ্যাজেল গান শিপ। আকারে ছোট, দ্রুতগামী বিভিন্ন রকম আগ্নেয়াস্ত্র আর মিসাইলে সাজানো।
দ্বিতীয়টা আকারে বেশ বড় এবং সাঙ্ঘাতিক ধরনের । সুপার পুমা ট্রুপ ক্যারিয়ার । আমেরিকার সুপার স্ট্যালিয়নের ফরাসী রুপ। অতিকায় এবং শক্ত পোক্ত। একসাথে ২৫ জন সেনাকে বয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম।
আর এখন ঠিক সেই ২৫ জন সেনাই আছে ওটার ভেতরে।
সীন নদীর উত্তর পাড় ধরে এগিয়ে চলা ডাবল-ডেকার বাসটার ওপর দিয়ে ওটা ওঠানামা করে ভেসে ভেসে যাচ্ছিলো রাস্তার ঢালের কারনে । মাঝে মাঝেই ওটার পাশের দরজা খুলে গিয়ে ঝুলতে শুরু করছিল দড়ি – ওদের পরিকল্পনা বুঝতে অসুবিধা নেই।
ওরা বাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে – চলন্ত বাসে!
একই সাথে তিনটে প্যানহার্ড ঘিরে ধরে এগিয়ে চলেছে  তাল মিলিয়ে।
স্ট্রেচ বলে উঠলো, ‘যা মনে হচ্ছে আর কোনোভাবেই বাঁচার সুযোগ নেই।’
তাসত্বেও গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো একই গতিতে ডানদিকের প্যানহার্ডটাকে মারল এক ধাক্কা ...রাস্তা থেকে সরে গিয়ে ওটা ধাক্কা খেলো নিচু উচ্চতার রেল লাইনের রেলিঙ এ ... তার পর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ছিটকে উঠে গেল শূন্যে ... পড়লো গিয়ে সীন নদীর জলে ।

ওদিকে বাসের ছাদের ওপরে ভেসে থাকা সুপার পুমাটাকে গুলি করার চেষ্টা চালাচ্ছিল ওয়েস্ট । কিন্তু সহসাই গ্যাজেল গান শিপটা ওর দিকে গোঁত্তা মেরে নেমে এলো ফলে দ্রুত মেঝের ওপর শুয়ে পড়তে বাধ্য হলো ও । ওপরের প্রত্যেকটা আসন ঝাঁঝরা হয়ে গেছে বুলেটের বৃষ্টিতে ।
‘স্ট্রেচ! সম্ভব হলে আরো জোরে চালাও !’ চিৎকার করে উঠলো ওয়েস্ট, কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
দুন অসমসাহসী ফ্রেঞ্চ প্যারাট্রুপার সুপার পুমা থেকে চলন্ত বাসের ওপর ঝাঁপ দিয়ে নেমে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে। কয়েক ফুট দূরে ।
দেখতে পেয়ে গেছে ওরা ওকে। শুয়ে আছে দুদিকের আসনের মাঝের ফাঁক টাতে ... আর কিছু করার নেই... সব শেষ । ওরা বন্দুক তাক করে হাত রাখলো ট্রিগারে –
-সাথে সাথেই সেনা দুজনের পায়ের নিচের বাসের ছাদের মেঝে বিস্ফোরিত হল একাধিক গর্ত  সৃষ্টি করে... বুলেট চালানোর গর্ত ওগুলো ... ওদের ঠিক নিচ থেকে উঠে আসছে ওগুলো।
দুজন প্যারা ট্রুপারই পড়ে গেল... মৃত... কয়েক সেকেন্ড বাদে , পুহ বিয়ারের মাথা দেখা গেল সিঁড়ির  কাছে ।
‘পেরেছি কি মারতে ওদের? পেরেছি কি? ওয়েস্ট তুমি ঠিক আছোতো?’ পুহ জানতে চাইলো।
‘আমি একদম ঠিক আছি,’ ওয়েস্ট কথাটা বলেই দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে চলে গেল। ‘কাম অন, যেভাবেই হোক আমাদের চার্লস ডে গল ব্রিজ পৌছাতেই হবে এই বাস থেমে যাওয়ার আগে!’
এরকম গতিতে চড়াই উৎরাই রাস্তায় নদীর ধার দিয়ে বাসে করে যাওয়াটা পর্যটকদের কাছে বেশ ভালোই উপভোগের বিষয় ; ল্যুভরকে পেছনে ফেলে আসার পর রাস্তাটা পাশ কাটিয়ে গেছে সীন নদীর ভেতর অবস্থিত দুটো আইল্যান্ডের একটাকে, নাম আইলে ডে লা সাইটে । ডানদিকে অনেকগুলো সেতু ওই দ্বীপের উদ্দেশ্যে গিয়েছে।
ওয়েস্টদের বাস এভাবে নদীর ধার ঘেঁষে চলতে থাকলে ওরা খুব তাড়াতাড়ি পয়ছে যাবে আর্সেনাল চত্বরে – যেখানে এক সময় ছিল বাস্তিল দুর্গ।
ওটার পরে আসবে দুটো সেতু – পন্ট ডি’ অস্টারলিৎজ এবং পন্ট চার্লস ডে গল । দ্বিতীয়টার পাশেই অবস্থান মিনিস্ট্রি অফ ইকোনমিক্স এর আধুনিক হেডকোয়ার্টারের । যার পাশেই আবার দক্ষিন পূর্ব ফ্রান্স এর দ্রুতগামি ট্রেনের সবচেয়ে বড় স্টেশন গারে ডে লিয়ন।
বিরাট লাল ট্যূরিস্ট বাসটা নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে বুনো হাতির মতো মানুষ জনকে চমকে দিয়ে, আর্মির গাড়ীকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললো ।
অনেকগুলো ওভারব্রিজের তলা দিয়ে যেতে হল ওদের।  আবার কখনো উঠতে হলো দুটো বা তিনটে রাস্তার সংযোগের ওপরে । একবার ডান পাশে দেখা গেল বিখ্যাত নোটরড্যাম গির্জাটাকে, সম্ভবত এটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম ট্যুরিস্ট বাস যা থামলো না দৃশ্যটা দেখার জন্য।
ওয়েস্ট ওপর থেকে নিচে নেমে যাওয়া মাত্র , ফরাসী সেনার দল সুপার পুমা থেকে নেমে আসতে শুরু করলো নিচে –স্ট্রেচের  অ্যাঁকাব্যাঁকা ভাবে বাসটাকে  চালানোকে তোয়াক্কা না করেই ।
এক মিনিটের ভেতর নেমেও পড়লো ।
দুজন নামলো আগে...দড়ি ঝুলেই থাকলো ...নেমে এলো আরো দুজন ... আরো দুজন... তারপর আরো দুজন।
আটজন ফ্রেঞ্চ প্যারা ট্রুপার এগিয়ে চললো নিচে নামার সিঁড়ির দিকে। হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র । উদ্দেশ্য নিচেরতলাকে ছারখার করে দেওয়া...
... ঠিক তখন ওয়েস্ট নিচে বললো, ‘স্ট্রেচ! ছাদে অনেকেই নেমে পড়েছে! ওই একজিট র‍্যাম্পটার ওপর গাড়ী নিয়ে চলো !’
ওদের সামনেই ছিল একটা ওভারপাস রাস্তা ।  ডানপাশে জুড়ে আছে একটা একজিট র‍্যাম্প এই নদীর ধারের রাস্তার সাথে । একটা নিচু কংক্রিটের প্রাচীর এই রাস্তাটার সাথে ওভারপাসটার মধ্যে একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর পরে ওভারপাসের অংশটা একটা সুড়ঙ্গের পথে বদলে গেছে।
স্ট্রেচ অবাক হয়ে বললো, ‘কি?’
‘যা বলছি সেটা করো!’ ওয়েস্ট চেঁচিয়ে উঠলো । ‘ যে যা আছে   হাতের কাছে সেটাকে জাপটে ধরো ! যতটা গায়ে জোর আছে সব কাজে লাগাও   !
একই গতিতে বাসটা একজিট র‍্যাম্পে ঢুকে পড়লো, সাথে সাথেই উঠতে থাকলো ওপরের দিকে –
-স্ট্রেচ বামদিকে স্টিয়ারিং ঘুরাতেই বাসটা বাম দিকে ঘুরে ধাক্কা খায় নিচু কংক্রিটের প্রাচীরটায় এবং ...
... ওটার ওপর উঠে যায় ।
অত বড় বাসটা ওপর দিকে সোজা মুখ করে উঠে গেল শূন্যে  কংক্রিটের প্রাচীরটায় সাপোর্ট পেয়ে । এক পালটি মেরে... সজোরে ছাদের দিকটা আছড়ে পড়লো রাস্তায় – ওপরে থাকা আট ফ্রেঞ্চ ট্রুপারের ভবলীলা সাঙ্গ হলো সাথে সাথেই।
এতেই অবশ্য সব কিছু থামলো না ।
দুরন্ত গতিতে উলটানো অবস্থায় পিছলেও এগিয়ে যেতে থাকলো সামনের দিকে ।
আরো একটা নিচু প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে আবার এক পালটি মেরে অবিশ্বাস্য ভাবে নিজের চাকার ওপর ফিরে এলো বা সটা । ৩৬০ ডিগ্রীর পাক দুবারে ...  আবার শুরু হলো চলা ... সোজা সুড়ঙ্গের উদ্দেশ্যে ।
০০০০০
বাসের ভেতরে ... যারা ছিল তাদের জগত টাও পাক মেরেছে ১৮০ ডিগ্রি করে দুবার – একে বারে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে আগাপাস্তালা – লিলি স হ দলের বাকি সব সদস্য দের ।
এরকম একটা দুঃসাহসিক এবং চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও ওরা বেঁচে আছে।
সকলেই বাসের মেঝেতে পড়ে থাকলেও ওয়েস্ট উঠে দাঁড়িয়েছে , এগিয়ে চলেছে পরবর্তী কাজের লক্ষ্যে।
স্ট্রেচের কাছ থেকে নিয়েছে গাড়ী চালানোর দায়িত্ব। ক্ষতবিক্ষত চেপ্টেচুপ্টে যাওয়া বাসটাকে সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে আর্সেনাল এলাকায় । ওদিকে সুপার পুমা কিন্তু পিছু ছাড়েনি ।  নদীর ওপর দিয়ে নিচু হয়ে সমান্তরালভাবে বাসের সাথে সাথেই উড়ে চলেছে।
সামনেই দেখা যাচ্ছে কাঁচ এবং ষ্টীলের তৈরী এক আধুনিক স্থাপত্য । ইকোনমিক্স মিনিস্ট্রি হেড কোয়ার্টার ।
পুহ বিয়ার ওয়েস্টের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে  বল লো, ‘সামনে যে ব্রিজটা দেখা যাচ্ছে ওর নাম পন্ট ডি’ অস্টারলিৎজ ।   চার্লস ডে গল ব্রিজ ওর পরেরটা !’
‘ঠিক আছে,’ ওয়েস্ট বললো। ‘ সবাইকে বলে দাও পনি বোতল আর মাস্ক নিয়ে বাসের দরজার কাছে গিয়ে যেন দাঁড়ায় । যাও!’
পুহ বিয়ার সেটাই করলো । লিলি, স্ট্রেচ আর বিগ ইয়ার্সকে সাথে নিয়ে ও গিয়ে দাঁড়ালো বাসের পেছনের দরজার কাছে ।
পন্ট ডি’ অস্টার লিৎজ   পার হয়ে বাস এগিয়ে চললো পন্ট চার্লস ডে গল অভিমুখে। অস্টারলিৎজ ব্রিজও যেমন ছিল ঠিক তেমনই চার্লস ডে গল ব্রিজটাও ডান দিকে বেরিয়েনদীর ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে । ওর পেছনে  ইকোনমিক্স মিনিস্ট্রির গগনচুম্বী টাওয়ার দেখা যাচ্ছে।
চার্লস ডে গল ব্রিজ থেকে নদীর দিকে যাওয়া রাস্তা ঢালু হয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে । যা ওয়েস্টের পক্ষে লাভজনক।
অন্যান্য গাড়ি এই পথে যাওয়ার সময় তাদের গতি স্তিমিত করে কিন্তু ওয়েস্ট যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিলো ।
চমকপ্রদ গতিতে বাসটা উঠে গেল চার্লস ডে গল ব্রিজের ওপর । আর সাথে সাথেই দারুন ভাবে বিধ্বস্ত বাসটা শেষবারের মতো রাস্তার ছোঁয়ার অনুভুতি নিয়ে সোজা গিয়ে...
...ব্রিজের রাস্তার ধারের ফুটপাথে গোঁত্তা মেরে পুনরায় আকাশে উঠে এগিয়ে চললো সীন নদীর জলের দিকে । প্রায় উড়েই গেল বেশ খানিকটা পথ... তারপর একটা বিশাল অদৃশ্য বৃত্ত এঁকে চারকোনা বস্তুটা মুখ নিচু করে  শুরু করলো পড়তে ... ড্রাইভারের সিট থেকে ওয়েস্ট এবং পেছনের দরজা দিয়ে বাকি চারজন প্রায় একসাথে লাফ দিলো নদী বক্ষে । বিরাট একটা জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে ডাবল-ডেকার বাসটা পড়লো সীন নদীর জলে।
যখন সীনের জল ছুঁলো বাসটা একই সাথে ওয়েস্ট আর ওর দলবলও পড়লো জলে । ওদের পতনেও জলোচ্ছ্বাস হলো তবে সেগুলো অতি ছোটো বাস পতনের তুলনায়।
ফরাসী হেলিকপ্টার দুটোর আরোহীরা অবাক হয়ে দেখলো পাঁচজনের কেউই আর ভেসে উঠলো না ।
জলের তলায় অবশ্য চলছে হালচাল ।
কারোর কোনও ক্ষতি হয়নি । ওয়েস্ট এসে গেছে ওদের কাছে। সকলেই পড়ে আছে ডাইভিং মাস্ক ...শ্বাস নিচ্ছে পনি বোতল থেকে ।
বাদামী রঙা জলের তলা দিয়ে সাঁতার কেটে ওরা পৌছালো সীন নদীর উত্তরদিকের পাথরে মোড়া দেওয়ালের গায়ে । চার্লস ডে গল ব্রিজের নিচে ।
নদীর জলের তলায় এই মধ্যযুগীয় দেওয়ালের গায়ে একটা মরচে পড়া পুরোনো দরজা আছে যা ১৬০০ সালে লাগানো হয়েছিল ।
যে তালাটা ওতে লাগানো আছে সেটা নতুন এবং শক্তপোক্ত । কিন্তু ওইদিন সকালেই পুহবিয়ার বোল্টকাটার নিয়ে এসেছিল কিছু একটা করার জন্য। ভালো করে না তাকালে মনে হবে তালাটা ঠিকঠাকই নিজের জায়গায় ঝুলছে। পুহ বিয়ার ওটার পেছন দিকে কেটে রেখে গেছে । ফলে এখন হাত দিয়ে টানতেই ওটা খুলে গেল ।
গেটের পেছনে, একটা ইট দিয়ে বানানো প্যাসেজ ওয়ে দূরে আবছা আলোয় মিলিয়ে গেছে। ওরা সাঁতার কেটে এগিয়ে চললো পথটা দিয়ে – একেবারে শেষে বিগ ইয়ার্স, দরজাটা লাগিয়ে একটা নতুন তালা লাগিয়ে দিলো ভেতর থেকে। ঠিক একই রকম দেখতে যা লাগানো ছিলো আগে
কুড়ি গজ মতো যাওয়ার পর ভূগর্ভস্থ জল পথটা উঠে গেছে একটা সঙ্কীর্ণ ড্রেনের মতো সুড়ঙ্গে।
ওরা দাঁড়িয়ে ছিল দুর্গন্ধে ভরা সেই ড্রেনটায় হাঁটু অবধি ডুবে আছে নোংরা জলে।
‘একেবারে গথিক যুগ,’ স্ট্রেচ বললো ঠান্ডা গলায় ।
’১৭ শতকের খ্রিষ্টান ভূগর্ভস্থ সমাধি কুঠরি,’ পুহ বিয়ার বললো । ‘গোটা প্যারিসের তলায় এরকম জিনিষ ছড়িয়ে আছে । ২৭০ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ আর ভূগর্ভস্থ সমাধি কুঠরি। এই সব সুড়ঙ্গগুলো সোজা চলে গেছে বুলেভারড ডিডেরোতে। এই পথ আমাদের নিয়ে যাবে ইকোনমিক্স মিনিস্ট্রি পার করে গারে ডে লিওনের কাছে ।’
ওয়েস্ট ঘড়ি দেখলো ।
দুপুর ১২টা বেজে ৩৫ মিনিট।
‘চলো এগোনো যাক,’ বললো । ‘ট্রেন ধরতে হবে আমাদেরকে ।’

চার্লস ডে গল ব্রিজের ওপর ফ্রেঞ্চ আর্মির বাকি তিনটে প্যানহার্ড এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ওর আরোহীরা । জলের মধ্যে তখনো পুরো ডুবে যায়নি বিরাট লাল বাসটা ।
চপার দুটো দুর্ঘটনার এলাকাটাকে ঘিরে চক্কর মেরেই চলেছে। যদি কারো দেখা মেলে।
ব্রিজে জমেছে কৌতূহলী প্যারিসিয়ানদের ভিড়।
অতিরিক্ত কম্যান্ডো টিম পাঠানো হয়েছে মিনিস্ট্রী কমপ্লেক্সে এবং  সীন নদীর দক্ষিন দিকে চার্লস ডে গল ব্রিজের সাথে সরাসরি যুক্ত বিরাট রেল স্টেশন গারে ডি’ অস্টারলিৎজ এ ।
যে সমস্ত ট্রেন এখনো স্টেশন ছেড়ে যায়নি তাদের আটকে দেওয়া হয়েছে ওখানেই। বিশেষ সতর্কতা হিসাবে গারে ডে লিওনের – যা অবশ্য অনেকটাই উত্তর দিকে , তবু সুযোগ থাকতেই পারে – ট্রেনগুলোকেও আটকে দেওয়া হয়েছে।
দুপুর ১২টা ৪৪ এ গারে ডে লিওন থেকে শেষ ট্রেন ছেড়েছে । টিজিভি এক্সপ্রেস, প্যারিস টু জেনিভা, প্রথম স্টপেজ ডিজন ।

আর এক ঘন্টা বাদে,  শুকনো পোশাক পড়া , ওয়েস্ট আর ওর দল ট্রেন থেকে নামলো ডিজন স্টেশনে । মুখে হাসি, উৎফুল্ল তার ছাপ ।
ওখান থেকে একটা স্পেনের উদ্দেশ্যে আগে থেকে ঠিক করে রাখা বিমানে চেপে বসলো । ওখানে অপেক্ষা করে আছে স্কাই মনস্টার আর হ্যালিকারনাসসাস । ওটায় চেপে ওরা আবার ফিরে যাবে কেনিয়াতে ।
মুখের হাসি, উৎফুল্ল তার ছাপ জানান দিচ্ছিল সাফল্যর
পর পর দুটো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর – বা তিনটে বলা যেতে পারে সমাধি মন্দিরের টুকরোটাকে ধরলে – ওরা অবশেষে ক্যাপ স্টোনের একটা টুকরো হাসিল করতে সমর্থ হয়েছে ।
এবার ওরাও এই প্রতিযোগিতায় ছিনিয়ে নিয়েছে কিছুটা জমি।
সত্যি করেই এবার এই মরণ খেলায় ওরাও সমর্থ প্রতিদ্বন্দ্বী।


০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
[  চতুর্থ অভিযানের শেষ পর্ব - ভ্যাটিক্যান অভিযান  

No comments:

Post a Comment