#প্রাচীন_সপ্তাশ্চর্যের_খোঁজ (১০৩-১১২)
দশম অধ্যায়--পঞ্চম অভিযান
"ঝুলন্ত উদ্যান"[১-১০]
প্রতিম দাস
০০০০০০০০০০০০০০
দশম অধ্যায়--পঞ্চম অভিযান
"ঝুলন্ত উদ্যান"[১-১০]
প্রতিম দাস
০০০০০০০০০০০০০০
দশম অধ্যায়
পঞ্চম অভিযান
ঝুলন্ত উদ্যান
ইরাক
১৯শে মার্চ ২০০৬
টারটারাসের আগমনের ঠিক আগের দিন
০০০০০
নেবুচাডনেজারের স্বর্গ
প্রাচীন বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের ভেতরে ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের মতো রহস্যময়
আর কোনোটাই নয়।
আর তার সহজবোধ্য কারন আছে ।
সবগুলো আশ্চর্যের ভেতরে এই ঝুলন্ত উদ্যান একমাত্র জিনিষ যার কোনোরকম হদিশ
পাওয়া যায়নি। বিন্দুমাত্র কোনো সূত্র
মেলেনি। না এর ভিত্তি ভুমি, না একটা স্তম্ভ, না কোনো জল সুড়ঙ্গ ।
এতোটাই এর অস্তিত্ব সন্দেহের চাদরে ঢাকা যে দীর্ঘ সময় ধরে ইতিহাস বিদরা এর
অস্তিত্বকে পাত্তাই দিতে চাননি । বলেছেন এসব আসলে গ্রীক কবিদের কষ্ট কল্পনার ফসল।
আলাআসমাউই , ইউনিভারসিটি অফ সাউদারন ফ্লোরিডার প্রাচীন সপ্ত আশ্চর্য বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত
বলেছেন যে ব্যাবিলোনিয়ানরা তাদের সব কিছু বিষয় নথি ভুক্ত করে রাখতে ভালোবাসতো ।
অথচ এই ঝুলন্ত উদ্যান বিষয়ে তাদের কোন লেখায় কোনও উল্লেখ নেই ।
আবার আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর ব্যাবিলন ভ্রমনের একাধিক নথিতেও এরকম কোনও
উদ্যানের কথা বলা নেই ।
প্রমানের অভাব থাকা সত্বেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লেখকদের লেখনী থামেনি এই
উদ্যানের নানান রকম আশ্চর্যজনক বর্ণনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে । আর সব লেখনীতেই কয়েকটা
বিষয়ে সকলেই একই কথা বলেছেন –
১। ৫৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই উদ্যান বানিয়েছিলেন মহান মেসোপটেমিয়ান রাজা ,
নেবুচাডনেজার । তার মেদিয়া থেকে আসা স্ত্রী এর জন্য । যাতে উনি নিজের বাড়ীর মতো
পরিবেশ খুঁজে পান।
২। এটা বানানো হয়েছিল ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব দিকে
এবং
৩। উদ্যানের মাঝে ছিল এক বিশেষ মন্দির যা দুর্লভ “পারসিয়ান হোয়াইট ডেজারট” গোলাপ ফুলের
জন্য বানানো হয়েছিল। যে ফুল আজ আর কোথাও ফোটে না।
এই তথ্যটার ক্ষেত্রে অবশ্য নানা মুনির নানা মত আছে ।
কিছু ইতিহাসবিদ বলেন এই উদ্যানের অবস্থান ছিল একটা সোনালী জিগুরাতের ওপর । ওটার
চারদিক দিয়ে ঝুলত নানান গাছপালা গুল্ম লতার ডাল পাতা । ওটার চারদিকে এক ডজন জলপ্রপাত দিয়ে জল পড়তো নিচে।
কিছু ইতিহাসবিদ আবার বলেন উদ্যানটা নাকি একটা পাহাড়ের খাঁজ থেকে বের হয়ে থাকা পাথরের টুকরোর
ওপর ছিল – যে কারনেই ওটাকে আক্ষরিক অর্থেই ঝুলন্ত বলা হতো ।
একজনতো এরকমও বলেছেন ওটা নাকি ছিল এক বিরাট গুহার ভেতরে । যার গা থেকে বেরিয়ে
আসা স্ট্যালাক্টাইট পাথরের এক বিশাল টুকরোর গায়ে ওটাকে বানানো হয়েছিল।
এক ইন্টারেস্টিং সাইড নোট এর সাথেই ওই উদ্যান বিষয়ে আছে।
গ্রীক ভাষায় বাগান বা উদ্যানকে বলা হয় ক্রেমাস্তোস, যার অর্থ ঝুলন্ত । ফলে এর
থেকে ধারনা করা যেতে পারে যে ঝুলন্ত উদ্যানের অর্থ ঝুলিয়ে রাখা বা উঁচুতে উঠিয়ে
রাখা এক স্বর্গসম স্থান।
কিন্তু ক্রেমাস্তোস এর আরেক ভাবেও মানে করা যায় । যার অর্থ কোনো কিছুর ওপর
থেকে ঝুলে থাকা।
আর এর ফলেই প্রশ্ন ওঠে – এটা কি সম্ভব যে সেই প্রাচীন গ্রীক কবিরা আসলে একটা
সাধারন পাথরের জিগুরাতের গা থেকে ঝুলে থাকা গাছপালা ইত্যাদির বর্ণনাই দিয়েছিলেন
কেবলমাত্র? আসলে কি ওই তথাকথিত বিখ্যাত আশ্চর্য আসলে খুব খুব সাধারন মানের একটা
কিছু?
০০০০০
সৌদি আরবের আকাশ
১৯শে মার্চ ২০০৬, রাত ৩টে
টারটারাসের আগমনের আর এক দিন বাকি
০০০
হ্যালিকারনাসসাস ভেসে চলেছে রাতের আকাশ ভেদ করে।
কালো আনরেজিস্টারড ৭৪৭ প্লেন টা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এসে সৌদি আরবের ওপর দিয়ে
উড়ে এমন একটা জায়গায় যাচ্ছে যা এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্যতম অরাজকতাময় দেশ
রুপে পরিচিত।
ইরাক।
যাওয়ার পথে প্লেনটা এক জায়গায়
থেমেছিল।
সৌদি আরবের এক প্রান্তসীমায়, অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ছিল সেই থামাটা ।
শুনশান রুক্ষ পাহাড়ের মাঝে লুকানো এক গোপন স্থান। মানুষের বানানো কিছু
গুহা আছে সেখানে । অনেক দিন ধরে অব্যবহৃত
, গুহা মুখে ঝুলছে সময়ের মার খাওয়া ধুলোয় ভরা কম্বল । কাছেই এক অব্যবহৃত ফায়ারিং
রেঞ্জ, স্টাও ধুলোয় ভরা। এদিকে ওদিকে পড়ে আছে গোলা গুলির বাক্স ।
এটা এক সময় ছিল সন্ত্রাসবাদীদের ক্যাম্প।
মুস্তাফা জাঈদের একসময়ের বাড়ী ঘর – এবং সপ্ত আশ্চর্য বিষয়ে লব্ধ সব জ্ঞান ও
নোটসের আশ্রয় স্থল।
ওয়েস্ট, স্ট্রেচ আর পুহ বিয়ারের কড়া পাহারায় ফ্লেক্স কাফ বন্দী জাঈদ একটা
নির্দিষ্ট গুহার দিকে এগিয়ে গেল । একটা নকল দেওয়ালের পেছনে ইশারা করে দেখালো একটা
বড় ট্রাঙ্কের দিকে । যেটা ভর্তি ছিল অজস্র পুঁথি, ট্যাবলেট, বেলেপাথরের ইঁট, সোনা
ও ব্রোঞ্জের গয়না এবং অনেকগুলো নোট বুকে ।
ওর সাথেই ছিল একটা কালো জেড পাথরের সুন্দর বাক্স । আকারে একটা জুতোর বাক্সের
মতো । ট্রাঙ্কটা হস্তান্তরিত করার আগে ওয়েস্তদের অলক্ষ্যে জাঈদ ওই বাক্সটা খুলে ওটার ভেতরে থাকা
মিহিদানার কমলা রঙের বালির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো । এক ভাবে পড়ে আছে ওগুলো, অনেক বছর ধরে । এতো মিহি যে একটা আভা বের হচ্ছে ওই
বালির গা থেকে।
ঝপ করে ঢাকনাটা লাগিয়ে ওটাকে আবার
ট্রাঙ্কে রেখে দিলো ।
নকল দেওয়ালের পেছনে লুকানো স্থান থেকে বেরিয়ে আসার পথে একটা ছোট্ট ইলেকট্রনিক যন্ত্র চালু করে দিলো
জাঈদ।
দেওয়ালের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে ট্রাঙ্কটা ওয়েস্টের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো, ‘আমার
সারা জীবনের কাজ। আশা করি কাজে লাগবে।’
‘লাগলেই ভালো ,’ ওয়েস্ট বললো ।
ট্রাঙ্কটা উঠিয়ে নিয়ে ওরা ফিরে এলো হ্যালিকারনাসসাসে এবং উড়ে চললো ইরাকের দিকে।
হ্যালিকারনাসসাসের ভেতরে চেষ্টা চলছে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের স্থান বের
করার ।
ওয়েস্ট, পুহ বিয়ার আর লিলি ক্যালিম্যাচুসের পান্ডুলিপির লেখাটা থেকে
চেষ্টা চালাচ্ছে নতুন তথ্য উদ্ধারের । অন্য দিকে ফ্লেক্স কাফ মুক্ত জাঈদ হাঁটু
গেড়ে বসে হাতড়াচ্ছে তার ধুলো পড়া পুরনো ট্রাঙ্ক ।
‘যদি কিছু একটা ধারনা পাওয়া যেতো যে এই বাগানটা আসলে ঠিক কি রকম দেখতে ছিল
তাহলে বেশ ভালো হতো, ‘ পুহ বিয়ার বললো ।
ওয়েস্ট বললো, ‘বেশীর ভাগ যা আঁকা পাওয়া যায় সবই গ্রীক কবিদের বর্ণনার অতিকল্পিত
রুপ । প্রায় সবেতেই নানান রকম জিগুরাতের ছবি । আসল যে কি ছিল তার ছবি –’
‘অত তাড়াতাড়ি কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না ক্যাপ্টেন ওয়েস্ট! যা ভাবছেন তা নাও হতে
পারে! এই যে পেয়েছি !’ জাঈদ একটা খুব পুরোনো আয়তাক্ষেত্রাকার কাপড়ের টুকরো বার
করলো । একটা এ-ফোর মাপের কাগজের মতো মাপের । খসখসে কাপড়টার ধারগুলো জীর্ণ, সেলাই
করা নেই । দেখতে হাতে বোনা তাঁতের কাপড়ের মতো। দেখার জন্য দিলো ওয়েস্টদের।
‘ একে বলে ড্রাফট ক্লথ বা নকশা কাপড় । নির্মাণ সহায়ক বস্তু । প্রাচীন যুগের রাজারা এর সাহায্যেই তাদের
দূরবর্তী স্থানের কাজের অগ্রগতির খব রা খবর নিতেন। কোন এক রাজ দূত কাপড় নিয়ে চলে
যেতো কাজের স্থানে । সেখান থেকে সে এঁকে নিয়ে আসতো ছবি । ফিরে এসে কাপড়টা দিত
রাজাকে । ওর থেকেই রাজা বুঝে নিতেন কাজ কতটা এগিয়েছে।
‘আমি এই কাপড়ের টুকরোটা পেয়েছিলাম মধ্য ইরাকের আসা সাত্রা শহরের এক দুর্ভাগার
সমাধির নিচে - লোকটা ছিল এক অশ্বারোহী ।
ডাকাতদের খপ্পরে পড়ে ওর সব কিছু খোয়া যায় । প্রাণটাও । ওকে কবর দেওয়া হয় এক
ভিখারীর মতো । আসলে মানুষটা ছিল এক রাজদূত । যে নিউ ব্যাবিলনে ফিরে যাচ্ছিলো
নেবুচাডনেজারের কাছে ঝুলন্ত উদ্যানের ছবি আঁকা এই নকসা কাপড়টা নিয়ে । ভালো করে
দেখে নাও সবাই । আমার জ্ঞান মতে এটাই হলো ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের একমাত্র ছবি ।
ওয়েস্ট বললো, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে এটা কোনো পাহাড়ের গায়ে খোলা গুহা । শুধু
প্রবেশ মুখটাকে একটা দারুন রকমের আর্চে বদলে দিয়েছে ।’
‘উলটানো ত্রিভুজের মতো গুহার ছাদ থেকে ওটা কি ঝুলছে ?’ পুহ বিয়ার প্রশ্ন করলো।
‘মনে হচ্ছে ওটা একটা বিশাল স্ট্যালাকটাইটের টুকরো ...’ স্ট্রেচ বললো।
ওয়েস্ট বললো, ‘আর গুহার মেঝে থেকে যে স্থাপত্যটা সোজা উঠে গেছে মনে হচ্ছে ওটাই
জিগুরাত। ঢাকা আছে বিশেষ কিছুর স্তুপ দিয়ে । ওরই মণ্ড দিয়ে জিগুরাতের নির্মাণ করা
হয় । কাজ শেষ হলেই সব পরিষ্কার করে সরিয়ে নেওয়া হবে।’
জাঈদ আড়চোখে ওয়েস্টের দিকে তাকালো । ‘ ক্যাপ্টেন, যদি ওটা একটা প্রমান মাপের
জিগুরাত হয় তাহলে ওই স্ট্যালাক্টাইটটা অন্তত পনেরোতলা বাড়ীর সমান লম্বা । তার মানে বিরাট বিশাল ।’
লিলি জানতে চাইলো, ‘ওই দুটো স্থাপত্যকে ঘিরে যে সরু সরু দাগের মতো টানা আছে
সেটা কি ?’
‘ আমিও অনেক অনেক চিন্তা করেছি বুঝলে লিলি ওগুলোর ব্যাপারে,’ জাঈদ উত্তর দিলো
। ‘আমার মনে হয় ওগুলো প্রাচীন যুগের ভাড়া বাঁধার মতো কিছু একটা ব্যাপার । যার ওপর
উঠে স্থাপত্য নির্মাণ করা হতো। সম্ভবত ওগুলো কাঠের দন্ড । মনে রাখতে হবে এই কাপড়ের
ছবি কিন্তু কাজের অগ্রগতির খতিয়ান – তখন উদ্যান নির্মাণের কাজ চলছিল । যে কারনেই
আমি আগে একে বলেছিলাম নির্মাণ সহায়ক বস্তু । ’
পুহ বিয়ার জানতে চাইলো, ‘লিলি নিচে ওই লেখাগুলোর কি মানে?’
জাঈদ বললো, ‘বেরাদর , ওটা থথের ভাষায় লেখা নেই মোটেই । সাধারন কিউনিফর্ম। এক
রাজদূত তার রাজার উদ্দেশ্যে লিখেছে –’
‘লিলি কিউনিফর্ম পড়তে জানে ,’ ওয়েস্ট বললো । ‘লিলি, পড়ে দেখোতো কি লেখা আছে।’
লিলি লেখাটা পড়লো, ‘এতে লেখা আছে, অগ্রগতির খতিয়ান – কাজ তার নির্দিষ্ট সময় অনুসারেই
চলছে। উনিশজন কর্মী মারা গেছে । বাষট্টি জন আহত । এতে ক্ষতি তেমন কিছু হয়নি ।’
‘এতে ক্ষতি তেমন কিছু হয়নি,’ স্ট্রেচ পুনরাবৃত্তি করলো । ‘বোঝাই যাচ্ছে এই
এলাকার এক শ্রেনীর মানুষ সাধারন মানুষের প্রানের কোনো দামই দিতো না । আজ ও একই
ধারা বর্তমান।’
ক্যালিম্যাচুসের পান্ডুলিপির লিলির করা অনুবাদের ষষ্ঠ অংশটা আবার পড়ে দেখল ওরা
।
“ প্রাচীন
ব্যাবিলোনিয়ার ঝুলন্ত স্বর্গ ।
এগিয়ে গেছে
উদিত সূর্যের দিকে।
সেই স্থানের
দিকে যেখানে দুই জীবনদাতা এক হয়ে গেছে।
জাগ্রোসের
পাহাড়ের ছায়ায়,
দেখো তৃতীয়
মহান স্থপতি কারের সাজানো অতিকায় জল প্রপাত
লুকিয়ে রেখেছে
পথটাকে যা সে বানিয়েছে
একটা পথ যা
নিয়ে যাবে স্বর্গের প্রবেশ দ্বারে
যা বানিয়েছিল
শক্তিশালী নেবুচাডনাজার তার স্ত্রীয়ের জন্য ।”
‘এটার শুরু তাও
সহজভাবেই হয়েছে, ‘ওয়েস্ট বললো। ‘পূর্ব দিকে সেই বিন্দু লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে হবে
যেখানে দুই জীবনদাতা এক হয়েছে । মেসোপটেমিয়ানরা
“জীবন দাতা” এই উপাধি দিয়েছিল টাইগ্রিস
আর ইউফ্রেতিস নদীকে । এটা নিশ্চিত ভাবেই সেই স্থানটাকে নির্দেশ করছে যেখানে ওদের
মিলন ঘটেছে।’
‘বাগদাদ?’ পুহ
বিয়ার জানতে চাইলো । ‘টাইগ্রিস আর ইউফ্রেতিস নদীর মিলনস্থলেইতো ওর অবস্থান ।
প্রাচীন ব্যবিলনের ওখানেই তো অবস্থান ছিল তাই না?’
‘না তা নয় ,’
ওয়েস্ট উত্তর দিলো । ‘প্রাচীন ব্যবিলনের ওপর এখন অবস্থান করছে আধুনিক শহর হিল্লা ।
বাগদাদের দক্ষিনে । তা ছাড়া তোমার যুক্তি কবিতার কথাকে অনুসরণ করছে না সম্পূর্ণ
ভাবে। নদী দুটো বাগদাদের কাছে বেঁকে খুব কাছাকাছি গেলেও ওদের মিলনে একটা নদীর জন্ম
হয়নি মোটেই। সেটা ঘটেছে আর দক্ষিনে যাওয়ার পর। কুরনা শহরে । যেখানে ওই দুই নদী এক
হয়ে সৃষ্টি করেছে এক বিশাল নদীর – শাট আল-আরব – যা আরো দক্ষিনে বাসরার ভেতর দিয়ে
বয়ে গিয়ে পড়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের খাঁড়িতে।’
স্ট্রেচ একটু
তিক্ত স্বরে বললো, ‘ আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা মোটেই যে আমেরিকানরা এখনো উদ্যানটা
খুঁজে বার করতে পারেনি। ওদের এখনো প্রায় দেড় লক্ষ সেনা ইরাকে আছে । চাইলেই ওরা
জাগ্রোস পর্বতের পূর্বদিকের সবকটা জলপ্রপাত এক এক করে পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারে
যে কোনো মুহূর্তে । বাগদাদ, হিলা বা কুরনা যেখানেই হোক না কেন।’
ওয়েস্টের মুখ
দেখে মনে হলো কিছু একটা ভাবনা ওর মনে খেলা করছে । ‘যদি না...’
‘কি যদি না?’
‘হিল্লা শহর
দাঁড়িয়ে আছে নেবুচাডনেজারের ব্যবিলনের ধ্বংসাবশেষের ওপর,’ উত্তর দিলো ওয়েস্ট। ‘
কিন্তু আর ভালো করে ভাবার পর মনে হচ্ছে এই কবিতা মোটেই “ব্যবিলন” এর কথা বলছে না ।
এ বোঝাতে চাইছে প্রাচীন ব্যবিলোনিয়ার ঝুলন্ত উদ্যানের কথা । অর্থাৎ প্রাচীন
ব্যবিলন।’
‘সে আবার কি?’
পুহ বিয়ার বললো।
‘এ ভাবে ভেবে
দ্যাখো,’ ওয়েস্ট বললো । ‘নিউ ইয়র্ক। নিউ ইংল্যান্ড। নিউ অরলিয়েন্স। বর্তমানে অনেক
শহর বা এলাকা আছে যাদের পুরোনো স্থানের স্মৃতিতে নামকরন করা হয়েছে। বেশ কিছু
প্রাচীন পুঁথিতে নেবুচাডনেজারের ব্যাবিলনকে নিউ ব্যাবিলন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।
এটা তো হতেই পারে এই নিউ ব্যাবিলনে ওই উদ্যান বানানোই হয়নি। বরং এমন কোনও শহরে
বানানো হয়েছিল যার নাম ছিল ব্যাবিলন। পরে অনেক দূরে নতুন করে এক নগর নির্মাণ করা
হয় যার নাম দেওয়া হয় ওই আসল ব্যাবিলনের নামে।’
‘ হুম, এর
থেকে একটা ধারনা পাওয়া যেতে পারে যে কেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের জীবনীকাররা কখনোই
ওই উদ্যানের কোনও উল্লেখ করেনি । ব্যাবিলনের ভেতর দিয়ে গেলেও কেউ কেন হিল্লার কাছে
ওর দেখা পায়নি,’ স্ট্রেচ বললো। ‘আসলে ওরা সব সময় নিউ ব্যাবিলনের ভেতর দিয়ে
গিয়েছেন, প্রাচীন ব্যাবিলনের ভেতর দিয়ে নয় ।’
‘দুটো ব্যাবিলন।
দুটো শহর ,’ জাঈদ নিজের ছুঁচলো থুতনিতে টোকা মেরে বললো । ‘বাহ, বেশ ভালো একটা
থিয়োরী...’
তারপরই ওর চোখ
দুটো চকচক করে উঠলো । ‘ আরে হ্যাঁ! তাইতো ! আমি কেন এই বিষয়টা আগে ভেবে দেখিনি ?’
‘কি?’
জাঈদ নিজের
ট্রাঙ্কটার কাছে গিয়ে নোটবুক খুলে খুলে দেখতে শুরু করলো।
আর সেটা করতে
করতেই উত্তেজনায় বকর বকর করে গেল। ‘ আমি যদি ক্যাপ্টেন ওয়েস্টের থিয়োরীটাকে আর এক
ধাপ এগিয়ে নিয়ে ভাবি । আধুনিক যুক্তি এটা মনে করে থাকে যে টাইগ্রিস আর ইউফ্রেতিস নদী
আজও সেই পথেই বয়ে চলেছে যা ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যেতো । তুর্কী থেকে বইতে শুরু করে
ইরাক হয়ে কুরনার দক্ষিন প্রান্তের জলাভূমিতেতে জোড়া লাগার আগে ।
‘এবার এভাবে ভেবে দেখতে হবে । মেসো পটেমিয়া হলো যতরকম
বন্যার কল্পকথার জননী। নোয়ার আর তার নৌকার গল্প একেবারে জাইসুদ্রা আর তার পশুপাখী বহন করা
গল্পের নতুন রুপ ? কেন? কারন ইরাকের বন্যার কল্প কথাজন্ম নিয়েছে একেবারে আসল বন্যা থেকেই – সেই
বন্যা যা পারশিয়ান খাঁড়ির ওপর উপচে এসে ঢুকে পড়েছিল মানুষের বাসস্থানে । তছনছ করে
দিয়েছিল সমস্ত ভুমির অবস্থানকে। বদলে দিয়েছিল দুই মহান নদী, টাইগ্রিস আর
ইউফ্রেতিসের পথ চলাকেও। আন্ডার ওয়ার্ল্ড নামের এক বইয়েতে গ্রাহাম হ্যানকক নামের এক
পশ্চিমী লেখক এ বিষয়ে যথেষ্ট যুক্তি সহকারে লিখে ছিলেন। আহ- হা! এইতো পেয়েছি!’
একটা শত
ব্যবহার জীর্ণ বই বার করে জাইদ একটা পাতা খুললো যেখানে ইরাকের ম্যাপ দেখা যাচ্ছে।
টাইগ্রিস আর ইউফ্রেতিস নদীকে ওখানে
পরিষ্কার ভাবে দেখানো হয়েছে । যারা
গিয়ে শহরের দক্ষিনে ভি আকৃতিতে জোড়া লেগেছে।
জাঈদ ম্যাপটার
ওপর আগেই হিল্লা, কুরনা আর বাসরাকে চিহ্নিত করে রেখেছিল।
বুঝিয়ে বললো
বিষয়টাকে। ‘এবারে, আজও আমরা যা করে
থাকি সেই প্রাচীনকালেও মানুষ তাইই করতো ।
নদীর পাড়ে গড়ে তুলতো নগর। যেমন ওই দুই বিরাট নদীর তীরেও হয়েছিল। কিন্তু যখন
প্রাকৃতিক কারনে নদীর গতিপথ বদলে গেল তখন ওখানকার অধিবাসীরা ছেড়ে গেল পুরোনো শহরটাকে
। বানালো নতুন শহর । যা আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি নদীর ধারে ।
‘অনেক বছর আগে
এই ঝুলন্ত উদ্যান বিষয়ক হারিয়ে যাওয়া তথ্য খুঁজতে গিয়ে আমি ছেড়ে যাওয়া শহরের অবস্থান
বার করে ছিলাম । সেই শহরগুলো যা একসময় ছিল নদীর প্রাচীন পথচলার পাশে অবস্থিত ।
নদীর গতিমুখ বদলাতেই যাদের ছেড়ে চলে যায় মানুষ। আর সেই সব অবস্থানের ভিত্তিতে আমি
ওই দুই নদীর সেই সময়ের অবস্থানকে নির্ণয় করতেও সক্ষম হয়ে ছিলাম।’
ওয়েস্ট জানতে
চাইলো, ‘ তাহলে সেই সময়ে ওই দুই নদী কোথায় জোড়া লেগেছিল?’
জাঈদ হাসলো। ‘
মজাটা হলো সেই সময়ে আমি বুঝতেই
পারিনি – আসলে তখনতো জানতাম না ওই মিলনস্থল
এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।’
বলেই জাঈদ আর
একটা পাতা বার করলো । আর একটা ম্যাপ। ইরাকেরই। একটা বিন্দু দিয়ে আঁকা ভি আকৃতি দেখা
যাচ্ছে ওটাতে বর্তমান দিনেরটার ঠিক নিচে –
জাঈদ নতুন
সংযোগ স্থলের ভি এর ওপর আঙুল রাখল – অবস্থান কুরনার দক্ষিনে , মোটামুটি বাসরা আর
কুরনার মধ্যে মাঝামাঝি একটা জায়গা।
হ্যালিকারনাসসাস
উড়ে চললো ইরাকের পথে, দক্ষিনের এক আধা শহর আধা গ্রাম হারিথার উদ্দেশ্যে।
সাথে সাথেই
দলীয় সদস্যরা তৈরী হল নামার জন্য – গুছিয়ে নিলো বন্দুক, ম্যাপ, হেলমেট এবং নানান
জিনিষ যা সুড়ঙ্গ পথে দরকার হবে।
হোরাস বসে আছে
চেয়ারের ব্যাক রেস্টে, একা ওয়েস্ট অফিসে
এক মনে তাকিয়ে আছে ল্যাপটপ কম্পিউটারের
স্ক্রিনের দিকে। তিউনিসিয়ায় মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর উইজার্ড এটা সেট করেছিলেন।
এ এক
মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশন নেট ওয়ার্ক সিস্টেম যা ওয়েস্ট বলেছিল উইজার্ডকে তৈরী করার জন্য।
হ্যালিকারনাসসাসে যে কোনও সিগন্যাল আসা যাওয়া করলেই তার সংকেত জানাবে।
ইরাকের
সীমান্ত পার হতেই ল্যাপটপটায় সংকেত এলো ।
এই প্লেনের
ভেতরেই কেউ একজন সিগন্যাল পাঠালো।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
হারিথা, ইরাক
১৯শে মার্চ,
২০০৬ সকাল ন’টা
টারটারাসের
আগমনের ঠিক একদিন আগে
হারিথায়
পৌছাতে হলে হ্যালিকারনাসসাসকে বন্দর শহর বাসরাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে।
বাসরার পাশ
দিয়ে যাওয়ার সময় স্কাই মনস্টারের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওয়েস্টের কাছে। ‘ক্যাপ্টেন
ওয়েস্ট, এখানে আমার কাছে এসে ব্যাপারটা
একবার নিজের চোখে দ্যাখো।’
ওয়েস্ট ককপিটে
গিয়ে জানলা দিয়ে তাকালো।
বাসরা থেকে
বিরাট সব গাড়ীর সারি চলেছে উত্তরে হারিথার পথে ।
বিশাল সেই
সারি। সব আমেরিকান মিলিটারী গাড়ী।
ট্রূপ ট্রাক,
ইঞ্জিনীয়ারিং যান, হামভি, জিপ , মটোর বাইক সাথেই গোটা দশেক অ্যাব্রাম ব্যাটল
ট্যাঙ্ক আর অনেক ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার । সব এগিয়ে চলেছে।
সব মিলিয়ে
প্রায় ৫০০০ জনের বাহিনী।
পুহ বিয়ারের
সাথে জাইদ এসে দাঁড়িয়েছিল ওয়েস্টের পেছনে । ব্যাপারটা দেখে বললো, ‘এটা কি করে
সম্ভব হলো?’
ওয়েস্ট তাকিয়ে
ছিল কনভয়টার দিকে , চেষ্টা করছিল মনের ভাবনাটাকে সামলানোর। কে এইভাবে খবর পাচার
করছে?
‘ধ্যাত তেরে
কি!’ স্কাই মনস্টার বলে ঊঠলো হেড ফোনে কিছু একটা শুনতে পেয়ে । ‘ নাসিরিয়া থেকে
এক্ষুনি ফাইটার বিমান আসছে । এফ -১৫এস । হান্টসম্যান, আসল জায়গাটা আমাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বার
করতে হবে। ।’
কয়েক মিনিট
পরে ওরা নোংরা ধুলোয় ভরা শহর হারিথাতে নামলো । শাত আল-আরব নদীর পূর্ব দিকের পাড়ে ।
বাসরার মোটা মুটি ৫০ কিমি উত্তরে।
‘ওকে , স্কাই
মনস্টার পূর্ব দিকে মুখ ঘোরাও,’ ওয়েস্ট বললো।
স্কাই মনস্টার
হ্যালিকারনাসসাসের মুখ ঘোরাল নির্দেশ মতো । আর তখনই কুরনা থেকে আসা উত্তরদিকের
হাইওয়ের দিকে দুজনের নজর পড়লো –
- সেই হাইওয়ে
ধরে , ওরা দেখল এগিয়ে আসছে আর একটা আমেরিকান মিলিটারী গাড়ীর কনভয় ।
প্রায় প্রথম
কনভয়টার মতোই – অনেক অনেক ট্রুপ ট্রাক , হামভি এবং ট্যাঙ্ক। সাথে অন্তত ৫০০০
সেনা তো হবেই।
ওয়েস্টের মনে
ভাবনার ঝড়।
‘কুরনাতে জুডার
নিজের দলের লোক আছে নিশ্চিতভাবেই। যারা জলপ্রপাত খুঁজছে ,’ বললো। ‘কিন্তু
কুরনা ভুল জায়গা নদীর সংযোগস্থল রুপে। অনেক বেশি উত্তরে
খোঁজ চালাছিল ওরা আর এখন- হঠাৎ - জুডা সব খবর জানতে পেরে দক্ষিনে চলে আসছে,’ স্কাই মনস্টার বিষ্মিত ভাবে বললো।
‘এটা কি করে...’
ওয়েস্ট স্কাই
মনস্টারের কাঁধে আশ্বাসের চাপড় মেরে বললো ,’ বন্ধু ভাবনা পরে, আপাতত পূর্বদিকে
নিচু হয়ে চলো ।
ওদের অবস্থান
এখন ছবির মতো পরিষ্কার – প্রায় ইদূঁরের মতো আটকে গেছে দুদিক থেকে আসা দুটো বিশাল
মাপের সশস্ত্র আমেরিকান বাহিনীর মাঝে।
যদি ঝুলন্ত উদ্যানের খোঁজ পায় – যার কোনও
নিশ্চয়তা নেই – তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওটার ভেতরে ঢুকে জলদি বেরিয়ে আসতে হবে ।
কয়েক মিনিটের
ভেতরেই জ্যাগ্রোস পর্বতের এবড়ো খেবড়ো শিখর ওদের সামনে উপস্থিত হল। ইরাক আর ইরানের
সীমান্ত রেখা।
অনেক ছোট ছোট
নদী ওই এলাকায় নানান পাহাড় চুড়া আর উপত্যকার ভেতর দিয়ে নকশা বুনে বয়ে চলেছে – সব
গিয়ে মিশেছে শাত আল-আরব নদীতে। এদিকে ওদিকে দেখা যাচ্ছে একাধিক জলপ্রপাত - কোনোটা সরু সুতোর মতো অনেক উঁচু, আবার কোনোটা চওড়া স্বল্প উচ্চতার । এমনকি
অশ্বক্ষুরাকৃতির প্রপাতও দেখা যাচ্ছে।
অনেক জলপ্রপাত
দুটো ধাপে বিভক্ত । চারধাপের জলপ্রপাত ও দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা। তবে ওয়েস্ট দেখতে
পাচ্ছে একটাই তিন ধাপের জলপ্রপাত আছে এদের ভেতরে। হারিথার পূর্ব দিকে। এক
অত্যাশ্চর্য জলপ্রপাত। ওপর থেকে নিচ অবধি ৩০০ ফুট। জল পর পর আছড়ে পড়ছে দুটো চওড়া
পাথুরে কার্নিশের ওপর । তারপর জমির সংস্পর্শে এসে বয়ে যাচ্ছে আল-আরবের দিকে। প্রায়
সব জল প্রপাতগুলোই পার্বত্য এলাকাটি ডান দিকে অবস্থিত । যাদের ওপর দিয়ে দক্ষিন
ইরাকের বিস্তৃত জলাভুমির সমতল অঞ্চল দেখা যাচ্ছে ।
‘এটাই সেই
জায়গা,’ ওয়েস্ট বললো। ‘ আর ওটাই আমাদের
অভীষ্ট প্রপাত । স্কাই
মনস্টার আমাদেরকে এর ভেতরে যেখানে খুশি নামিয়ে দাও। আমরা এখান থেকেই যাত্রা শুরু
করবো। তুমি হ্যালিকে নিয়ে এই সহযোগিদের কাছে চলে যাবে এবং অপেক্ষা করবে আমার ডাক
পাওয়ার ।’ কথা শেষ করে একটা কাগজের টুকরো স্কাই মনস্টারের হাতে দিলো ওয়েস্ট।
‘রজার দ্যাট,
হান্টস ম্যান।’
হ্যালিকারনাসসাস
একটা প্রায় ১০০০ বছর আগে শুকিয়ে যাওয়া লেকের ভেতর নামলো ।
চাকাগুলো মাটি
ছূঁতে না ছুঁতেই পেছন দিকের ধাতব র্যাম্প খুলে গেল, এবং – জুওওওম! – একটা চার
চাকার ল্যান্ড রোভার বেরিয়ে এলো প্লেনের পেটের ভেতর থেকে । নেমে গেল শুকনো লেকের
বুকে এবং পেছন দিকে একরাশ বালিধুলো উড়িয়ে
যাত্রা শুরু করলো পূর্ব দিকে ।
হ্যালিকারনাসসাসের
ইঞ্জিন পুনরায় গর্জে উঠলো এবং উঠে গেল আকাশে । উড়ে চললো এক গোপন হ্যাঙ্গারের উদ্দেশ্যে
যেখানে পনেরো বছর আগে প্লেনটাকে পেয়েছিল জ্যাক ওয়েস্ট জুনিয়র।
ল্যান্ড রোভারটা
গিয়ে থামলো সেই তিনধাপের জলপ্রপাতটার সামনে। জল পড়ার শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে আশে
পাশে ।
‘ আশা করছি আল্লাহ এবার আমাদের দয়া করবেন ,’ পুহ বিয়ার জলপ্রপাতটার
শীর্ষ দেশের দিকে তাকিয়ে বললো। ৩০০ ফুট, ৩০ তলা স্কাইস্ক্যাপারের সমান।
‘ওইখানে!’
ওয়েস্ট বলে উঠলো।
একটা পাথরের সরু
পথ দেখা গেল জলপ্রপাতটার নিচের পেছনের দিকে চলে গেছে।
ওয়েস্ট ছুটে
গেল ওটার দিকে। বাকিরা ওকে অনুসরণ করলো । কিন্তু ওরা জল প্রপাতের পেছনের দিকে পৌছানোর পর
ওরা এমন জিনিষ দেখতে পেলো যা আশাই করেনি।
প্রত্যেক
ধাপের ওপর জলটা পড়ছে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে তার বিশাল প্রপাত গতির জন্য। যার অর্থ
প্রত্যেক ধাপের অনেকটা করে অংশতে জল পড়ছে না। তবে সেখানে জলের ফোঁটা ছিটকে পড়ার
কারনে শ্যাওলা জন্মেছে এবং পিছল । এর আরো একটা অর্থ প্রত্যেক ধাপের পাথুরে দেওয়াল জলপ্রপাতের
কারনে সামনে থেকে দেখা যায় না ।
আর জলের পেছনে
পাথুরে দেওয়ালের গায়ে আছে এক চমকে দেওয়ার মতো বিষয়।
প্রতিটা
পাথরের গায়ে সরু সরু দগের মতো কিছু পথ নির্দেশ করা
হয়েছে । ন খুব সরু সরু
পথ নানা আঁকা বাঁকা চলনে এগিয়ে চলেছে। অনেক বার
ওরা একে অপরকে ভেদ করে চলে গেছে। যা মনে হচ্ছে তাতে মোট ছ”টা পথ আছে। কিন্তু কেমন
যেন জড়াপুটকি পাকিয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেক অনেক পথ মিলে মিশে গেছে।
প্রথম ধাপের
পাথরের আঁকিবুঁকির দিকে তাকিয়ে ওয়েস্ট যথেষ্ট হতাশার সাথে দেখলো অনেক দেওয়াল গর্ত
এবং ব্লেড হোলস ওই রাস্তা পথে অপেক্ষায় আছে।
বুবি ট্র্যাপ
।
জাইদ অবাক হয়ে বললো, ‘ তৃতীয় ইমহোটেপ । একজন জিনিয়াস। কিন্তু শয়তানী
মানসিকতার জিনিয়াস। এই ফাঁদগুলো খুব দুর্লভ একটা পদ্ধতি তবে একেবারে ওনার নিজস্ব
ধরনের । এই পথগুলোর ভেতর একটা বাদে সব পথ বিপদ জনক।’
‘কি করে বুঝতে
পারবো কোন পথটায় ফাঁদের আশঙ্কা নেই?’ স্ট্রেচ জানতে চাইলো । ‘ সব গুলোকেই দেখেতো
মনে হচ্ছে একে অপরের সাথে যুক্ত।’
ওয়েস্ট ছাড়াও,
লিলি একমনে ওই পথের ছকটাকে দেখছিলো।
দেখতে দেখতেই
ওর মনে একটা ছবি ভেসে উঠলো ।
‘আমি এটা আগে
দেখেছি ...’
ওয়েস্টের
ব্যাকপ্যাকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা প্রিন্ট আউট বার করে আনলো।
যার ওপরে লেখা
আছে – ‘ওয়াটার ফল এন্ট্রান্স বা জলপ্রপাতের প্রবেশপথ – টলেমি সোতেরের সময় তৃতীয়
ইমহোটেপ পুন নির্মাণ করেছিলেন।
‘ বেশ, তাহলে
তুমিই এ ব্যাপারটা দ্যাখো...’ স্ট্রেচ বললো।
ছবিতে যা আঁকা
আছে তার সাথে সামনের পথের দারুন মিল বা কোনো অমিল নেই বলাই ভালো।
পুহ বিয়ার
জানতে চাইলো উদগ্রীব হয়ে, ‘কিন্তু কোন পথটা নিরাপদ ?’
‘সেটাতো আমি
জানি না ,’ লিলি হতাশ ভাবে বললো ।
‘একটু থামো,’
ওয়েস্ট বললো। ‘ হয়তো তুমি বুঝতে ...’
ব্যাকপ্যাকটা
হাতড়ালো একটু ... ‘পেয়েছি!’
একটা বাদামী
রঙের ব্যবহার জীর্ণ নোটবুক বার করে আনলো ।
নাজি
প্রত্নতত্ববিদ হেসলারের ডায়েরী ।
‘ হেস্লার
জানতেন নিরাপদ পথ কোনটা ,’ ওয়েস্ট বললো , পাতা উল্টাতে থাকলো অভীষ্ট পাতা খুঁজে
পাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ।
‘এই যে!’ একটা
পাতা খুলে সবার দিকে ঘুরিয়ে ধরলো । এমন একটা পাতা যা সে আগে দেখেছিল –
ওপরে লেখা আছে
“নিরাপদ পথগুলো” ।
ওয়েস্ট হাসলো
।
প্রিন্ট আউটের
ছবিটার পাশে নিয়ে এলো ডায়েরীর ছবিটাকে । সকলেই দেখতে পেলো ওয়েস্টের ডান হাতে ধরে
থাকা ছবির সাথে জড়া জড়ি করে মিশে থাকা রাস্তাগুলোর ভেতর থেকে একটা রাস্তা আলাদা
করে চেনা যাচ্ছে।
‘বুঝলেন ক্যাপ্টেন
ওয়েস্ট,’ জাঈদ বললো , ‘আমি যা ভেবেছিলাম আপনি তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান । আপনার
দিকে নজর রাখতে হবে দেখছি।’
‘ধন্যবাদ, ‘
ওয়েস্ট বললো পাত্তা না দেওয়ার স্বরে ।
কথা বলতে
বলতেই, একবার তাকিয়ে নিলো পেছনদিকের সমতল ভুমি অঞ্চলে । দূরে ধুলোর মেঘ দেখা
যাচ্ছে দিগন্তরেখা বরাবর – ধুলি ঝড় নাকি অন্যকিছু...
আসলে ও দুটো সেই
বিশাল কনভয় গুলোর এগিয়ে আসার ফলে সৃষ্ট ধুলোর মেঘ।
‘ জলদি,
আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই ,’ ওয়েস্ট বললো।
উলম্ব খাড়া
পাথুরে দেওয়ালের গায়ের নিরাপদ রাস্তা ধরে ওরা এগিয়ে চললো । পেছনে জলপ্রপাতের
উদ্দাম গর্জন এবং আড়াল। জলের ভেতর দিয়ে আবছা সূর্যের আলো এসে পড়েছে চলার পথে।
ওয়েস্ট সবার
আগে । বুকের থলের ভেতর হোরাস ।
রাস্তাটা
অ্যাঁকাব্যাঁকা ঘোরানো পেঁচানো ভাবে উঠেছে ওপরের দিকে । এতটাই সরু সে পথ যে
একজনের বেশি যাওয়ার উপায় নেই । তার ওপর আবার জন্ম নিয়েছে পিচ্ছিল শ্যাওলা । ফলে
ইচ্ছে থাকলেই খুব দ্রুত এগোতে ওরা পারছে না। এটা বলতেই হবে ওই ম্যাপটা না থাকলে
ওরা কিছুতেই এই নিরাপদ রাস্তাটা খুঁজে বার করতে পারতো না।
পর পর দুটো
ধাপের পাথরের চাতালে পাওয়া গেল একটা করে সুড়ঙ্গ পথ – যে পথ ধরে এগিয়ে পৌঁছানো গেল
পরের ধাপটায়।
কুড়ি মিনিট
এভাবে চলার পর ওরা তৃতীয় ধাপের মাথায় পৌছালো । ওখানে সূর্যের আলোয় চকচক করতে থাকা
জলপ্রপাতের সামনে গিয়ে পথটা শেষ হয়েছে ...
... তৃতীয়
সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে বের হতেই ওরা দেখতে পেলো একটা প্যাসেজওয়ে পাথরের গায়ে খোদাই করা আছে
যার শেষ দেখা যাচ্ছে না... অন্ধকার।
এই নতুন
সুড়ঙ্গে প্রবেশ করাটা অবশ্য আগের ছোট্ট সুড়ঙ্গ পথের থেকে আলাদা রকমের।
অলংকৃত
প্রবেশপথ । অবশ্য ঢেকে আছে সবুজ শ্যাওলায় ।
প্রবেশ পথের
চারদিকের চারকোনা ফ্রেম নিখুঁত বর্গ
ক্ষেত্র । নানান হিয়েরোগ্লিফিক্স লেখায় ভর্তি । অন্ধকারের ভেতর যত দূর দেখা যাচ্ছে
ওই চারকোনা পথই চলে গেছে ।
দরজার ওপরে
শ্যাওলার আড়াল থেকেও আবছা ভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেই চেনা চিহ্নটা এখানেও খোদাই
করা আছে।
ওয়েস্ট ছবিটার
দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, ‘আমরা এসে গেছি।’
০০০০০
ওয়েস্ট আর
বাকিরা যখন সুড়ঙ্গের পথটা পরীক্ষা করে দেখছিল , পুহ বিয়ার তখন জল প্রপাতের পাশ
দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া একটা কার্নিশ ধরে এগিয়ে
গেল।
ওখান থেকে
দেখা যাচ্ছিলো বিস্তৃত সমতল ভুমিটাকে । সেদিকেই উঁকি মারলো পুহ ।
যা দেখতে পেলো
তাতে ওর চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার যোগার হলো ।
সেই বিরাট
আমেরিকান মিলিটারী কনভয় দুটো – এখন একসাথে মিশে গেছে – এগিয়ে আসছে সামনের সমতল
ভুমি পার করে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে। চপার হেলিকপ্টারগুলো ঊড়ে আসছে নিচের সারবদ্ধ গাড়ীগুলোর
ওপর দিয়ে। সবার সামনে একটা কালো রঙের ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার।
দশ হাজার সেনা
, এগিয়ে আসছে ওদের দিকে ।
‘হায় আল্লাহ,’
একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বললো, ‘ইয়ে, হান্টসম্যান...’
ওয়েস্ট তাকালো
ওর ডাক শুনে । দেখলো বিশাল আমেরিকান বাহিনী । বিশেষ করে সামনের কালো ব্ল্যাক হকটাকে
।
ভ্রু কুঁচকে
গেল ওর ।
ওই হেলিকপ্টারটাকে
দেখে মোটেই...
চিন্তার চাপে
ঠোঁট গুটিয়ে টেনে ধরলো মুখের ভেতর ।
চারদিক থেকে
পৃথিবীটা খুব ছোটো হয়ে আসছে ওর কাছে ... বিকল্প পথ ক্রমশই কমে আসছে ওর সামনে।
‘ কাম অন পুহ,
আমাদের এখানে থেমে গেলে চলবে না।’
সুড়ঙ্গের
প্রবেশ পথের কাছে গিয়ে দলের সাথে যোগ দিলো ওরা । স্ট্রেচ জিজ্ঞেস করলো, এখানেও যদি
আগের মতো ফাঁদ থাকে তাহলে আমেরিকানদের
আগে ভেতরে যাওয়া এবং বেরিয়ে আসার কোনও
সুযোগই নেই।
জাঈদ পেছন
থেকে ধূর্ত তার সুরে বললো, ‘ আমার যদি ভুল না হয় , মনে হয় একটা পথ আছে ...’
স্ট্রেচ
সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো , ‘ কোন পথ?’
‘ পুরোহিতদের
নিজেদের পথ । ওই নাজি ডায়েরীতে এর উল্লেখ আছে। আমিও আমার রিসার্চের সময় এই কথাটা
পেয়েছিলাম। এরকম পথ অবশ্য খুব ছোট্ট হয়, অজ্ঞাত থাকে । পুরোহিতরা ব্যবহার করে
থাকেন মন্দিরকে জন সাধারনের জন্য বন্ধ করে
দেওয়া হলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য । আর এই স্থান ছিল রাজকীয় । তাই সামনে
থেকে বন্ধ থাকলেও একে পরিষ্কার রাখার জন্য এরকম কিছু অবশ্যই দরকার।’
‘পেছনের দরজা,
‘ ওয়েস্ট বললো ।
‘হ্যাঁ । যার
অর্থ আমরা এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবো এবং বেরিয়ে যাবো অন্যদিক দিয়ে। আর সে দিকটা হল
পুরোহিতদের প্রবেশপথ।
স্ট্রেচ বললো,
‘অবশ্য যদি আমরা ওটা খুঁজে পাই তবেই ।’
‘আমরা যদি এই
টুকরোটা হাসিল করতে না পারি ,’ ওয়েস্ট বললো, ‘তার একটাই অর্থ দাঁড়াবে... ডোরিস,
বিগ ইয়ার্স আর নডির শুধু শুধুই এ মিশনে নিজেদের জীবনহানি ঘটিয়েছে । আমি সেটা
কিছুতেই হতে দেবোনা । হয় আমি এই টুকরো হাসিল করবো আর তা না হলে এর শেষ দেখার জন্য
মৃত্যু পর্যন্ত যাবো ।’
কথাটা বলেই
লিলির হাত চেপে ধরে এগিয়ে যেতে শুরু করলো জলপ্রপাতের পেছনে থাকা সুড়ঙ্গের দিকে ।
পুহ বিয়ার
সঙ্গে সঙ্গে অনুসরণ করলো । দ্রুত কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘ হান্টস ম্যান , ওই
যে একেবারে সামনে যে চপারটা আসছে । কালো
ব্ল্যাকহকটা , ওটা দেখেছো তুমি?’
‘হ্যাঁ,’ মাথা
না ঘুরিয়েই উত্তর দিলো ওয়েস্ট ।
‘ওটা কিন্তু আমেরিকান
চপার নয়।’
‘জানি।’
‘ওর গায়ের
মারকিংটা চিনতে পেরেছো? ওটা –’
‘হ্যাঁ,’
ওয়েস্ট ফিসফিস করে জবাব দিলো , মাথা ঘুরিয়ে স্ট্রেচের দিকে তাকিয়ে। ‘একটা ইজ্রায়েলী চপার । যে
ভাবেই হোক ইজ্রায়েলীরা আমাদের অবস্থান জেনে যাচ্ছে । আর আমার অনুমান সেটা কিভাবে
তাও আমি বুঝতে পেরেছি। এখন ঘটনা হল এই যে ওরা আমেরিকানদের আগেই এখানে পৌছাতে চাইছে ।’
আর একবার স্ট্রেচের দিকে শানিত চোখে তাকিয়ে বললো, ‘ইজ্রায়েল সব সময় ইজ্রায়েলীদের
স্বার্থই দেখে । চলো এগোনো যাক ।’
কথা শেষ, ওরা
প্রবেশ করলো আর এক ফাঁদের জগতে । যা পাহারা দিচ্ছে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানকে ।
ওয়েস্টের
ফায়ারম্যান হেলমেটের আলো অন্ধকার সুড়ঙ্গ ভেদ করে সামনের দিকে গিয়ে পড়লো ।
ওর দল ওকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে। পেছন থেকে আশা দিনের আলোয় ওদের শ্যিলুয়েটের
মতো দেখাচ্ছে । ওদের মাথাতেও লাইট লাগানো হেলমেট । হোরাস উড়ে চলে
গেল সামনের দিকে ।
সুড়ঙ্গটা নিখুঁত বর্গাকারে পাথর খোদাই
করে বানানো । ঢালুভাবে নেমে গেছে নিচের
দিকে । যত নামছে তত পেছন থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে দিনের আলো । মাথার ওপরে ছায়াময়
চারকোনা গর্ত কাটা আছে । ভগবান জানে কি আছে ওগুলোর ভেতরে । বাইরে থেকে ভেসে আসছে
জলপ্রপাতের উদ্দাম ধ্বনি, এক টানা ঝর ঝর –
প্রথম ফাঁদ চালু হলো ।
সবাইকে কাঁপিয়ে দিয়ে ছাদের ওই কাটা গর্ত দিয়ে টন পাঁচেকের একটা বিশাল পাথর ধমাস করে
পড়লো প্রবেশ দ্বারটার সামনে । ঢেকে দিলো পুরো মুখটাকে । বাইরের আলো আসার পথ বন্ধ হয়ে গেলো একেবারেই !
এরপরেই ওয়েস্টের দলের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়ে পাথরটা এগিয়ে আসতে শুরু করলো ।
ঢালু পথে পিছলে চলে আসতে শুরু করলো – ওদের দিকে– ওয়েস্টদেরদের বাধ্য করলো
সামনের নিচের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে।
‘জলদি! জলদি!’ ওয়েস্ট চেঁচিয়ে উঠলো ।
বিশাল পাথরটার হাত থেকে বাঁচার জন্য ওরা শুরু করলো দৌড়াতে । মাথার ওপরের একের
পর কাটা গর্তগুলোর দিকে মাঝে মাঝেই ভয়ের দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে।
অতিকায় পাথরটা দ্রুত পিছলে এগিয়ে আসছিল ওদের দিকে , দুর্দমনীয় গতিতে –
একটা পাথরের খাঁজের মতো কার্নিশ।
তিরিশ মিটার মতো আসার পর সুড়ঙ্গটা শেষ হয়েছে সামনের এক নিঃসীম অন্ধকার গহ্বরের ভেতর
। দেখে মনে হচ্ছে না এই অন্ধকার ফাঁকা জায়গাটার পর আর কোথাও যাওয়ার পথ আছে। যা মনে
হচ্ছে তাতে এটাই এই সুড়ঙ্গের শেষ বিন্দু ।
পেছনে শমন সম ধেয়ে আসছে পাথরটা গড় গড় শব্দ করে।
ওয়েস্ট একটা আলোকদন্ড জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দিলো অন্ধকার গহ্বরে –
-দেখতে পেল এক দৈত্যাকার ঘনক আকৃতির ভূগর্ভস্থ গুহার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে ওরা ।
পঞ্চাশ মিটার মতো লম্বা এবং দশতলা বাড়ীর সমান উচ্চতা।
সমস্যা এটাই যে ওদের সুড়ঙ্গ গিয়ে শেষ হয়েছে এই গুহার ছাদ ছুঁয়ে ।
আলোকদন্ডের আলোয় ওয়েস্ট নিচের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো অনন্ত তিরিশ মিটার নিচে
গুহার মেঝে ।
একেবারে সমান...উন্মুক্ত এবং বালিতে ভর্তি ।
আর চিন্তার বিষয় এটাই, কিছু একটা গণ্ডগোলতো আছেই – একটু বেশীই সমতল ... একটু
বেশীই খোলামেলা ।
কার্নিশের কাছে পড়ে থাকা একটা পাথরের
টুকরো লাথি মেরে নিচের দিকে ফেললো ওয়েস্ট ।
দেখতে থাকলো ওটার পতন ।
পাথরটা গিয়ে পড়লো মেঝেতে।
লাফিয়ে উঠলো না ।
ভত করে বালির মতো দেখতে মেঝের ওপর পড়ে থমকে গেল যেন । তার পর আস্তে আস্তে ঢুকে
গেল মেঝের মধ্যে। দেখে মনে হল ওই আধা তরল পদার্থ যেন ওটাকে গিলে নিলো ।
‘বাহ-বা, চোরাবালি,’ জাঈদ উপভোগ করার সুরে বললো । ‘পুরো মেঝেটাই চোরাবালি...’
‘ হে ভগবান, তুমিও দেখছি ম্যাক্সের জুড়িদার,’ ওয়েস্ট বললো, পেছনের দিকে ধেয়ে
আশা পাথরটার দিকে তাকিয়ে- মিটার দশেক দূরে আছে ওটা । বাধ্য করছে চোরাবালির ভেতরে ঝাঁপা
দেওয়ার জন্য।
‘এই ফাঁদ পদ্ধতিতে সময় নষ্ট করা বলে কোনও ব্যাপারই নেই তাই না?’
কথাটা বলেই বর্গাকার বিশাল গুহার দিকে ফিরে এক বিশেষ জিনিষে চোখ পড়লো
ওয়েস্টের। সিলিংএ একটানা পর পর অনেকগুলো হাতল ঝুলছে । যেটা গিয়ে শেষ হয়েছে অপর
প্রান্তে আর একটা সুড়ঙ্গের মুখে । মাঝখানে পঞ্চাশ মিটারের ব্যবধান ।
সাথে সাথেই ওই সব হাতলের এপাশে ওপাশে বা মাঝখানে অন্ধকার সব গর্ত খোদাই করা আছে
ছাদের গায়ে।
‘লিলি আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ো ,’ ওয়েস্ট বললো । ‘জাঈদ, এই সব হাতলগুলো
বিষয়ে কোনো তথ্য তোমার সংগ্রহে আছে?’
জাইদ পেছনের পাথরটাকে একবার দেখে নিয়ে বললো , ‘ হু, মনে হচ্ছে পড়েছি। বালুকা
গুহায় উঁচু ছাদের হাতল । ওখানে বলা ছিল, “নিজের হাত দিয়ে হেঁটে যাও কিন্তু দূরে
থাক যে এটাকে বানিয়েছে তার থেকে , বর্জন করো এর স্রষ্টাকে ।” এটা বানিয়েছিল
তৃতীয় ইমহোটেপ । এর অর্থ আমি এর প্রত্যেক তৃতীয় হাতলকে স্পর্শ করবো না ।’
‘ভালো যুক্তি,’ ওয়েস্ট বললো, ‘কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনা । তাই তোমাকেই
সবার আগে যেতে হবে ওই পথে । চলো এগোও ।’
জাঈদ এগিয়ে গেল এবং এগিয়ে চললো প্রত্যেক তৃতীয় হাতলকে না ধরে ।
যখন দেখা গেল কোনো বিপদ ঘটছে না তখন ওয়েস্ট লিলিকে ইশারা করলো ভালো করে জাপটে
ধরার জন্য এবং চেঁচিয়ে বললো, ‘এভরিবডি ফলো আস!’
লিলি ঝুলে থাকলো ওয়েস্টের গলা জড়িয়ে ধরে । ওয়েস্ট এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালো প্রথম
হাতলটার দিকে...
... শুরু করলো ঝুলে এগিয়ে যাওয়া দশ তলা উচ্চতা দিয়ে ... নিচে নিথর চোরাবালি ।
অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য বলা যেতেই পেরে একে – পাঁচটা খুদে অবয়ব এক বিরাট ঘনক
আকৃতি গুহার ছাদের সাথে সংযুক্ত হাতল ধরে ঝুলে ঝুলে এগিয়ে যাচ্ছে লাইন বেঁধে । ওরা
ঝুলছে দশতলা বাড়ির সমান উচ্চতায়।
দলের একেবারে শেষে আছে পুহ বিয়ার । পেছনে ধেয়ে আশা পাঁচ টনের পাথরটা থেকে
ভাগ্যের জোরে বেঁচেছে বলা যেতে পারে । একেবারে শেষ মুহূর্তে , পুরো সুড়ঙ্গ জুড়ে ধেয়ে আসা পাথরটা
ক্ষনিকের জন্য যেন থমকে গিয়েছিল পড়ার আগে।
তারপর হোঁচট খাওয়ার মতো এগিয়ে গেল শূন্যে ... কাত হলো... এবং খাড়া দেওয়ালের
সাথে সমান্তরাল একটা দুরত্ব বজায় রেখে গিয়ে পড়লো ধপাক ধরনের একটা শব্দ করে
চোরাবালিতে ।
আবার ও ক্ষনিকের জন্য যেন থমকে গেল পাথরটার গতি – তারপর আস্তে আস্তে ডুবে যেতে
থাকলো – কিছুক্ষন বাদে ওটা আর দেখাই গেল না।
ওয়েস্ট দৃঢ় হাতে একটা একটা করে হাতল ধরে লিলির ভার বহন করে এগিয়ে যাচ্ছিলো ।
ওর পাশেই উড়ছিল হোরাস- সম্ভবত মজা পাচ্ছিলো মানুষ গুলোর এই অদ্ভুতভাবে এগিয়ে যাওয়া
দেখে।
জাইদকে অনুসরণ করে ওয়েস্ট প্রত্যেক তৃতীয় হাতল বাদ দিয়ে দিয়ে ধরছিল। অনুমান
ভুল হয়নি জাইদের। পরীক্ষামূলক ভাবে একহাতে অষ্টম হাতলটাকে ভালো করে চেপে ধরে নবম হাতলে টান
দিতেই ওটা ছেড়ে চলে এলো ছাদের গা থেকে । ফেলে দিলো ওটাকে ওয়েস্ট নিচের বালি ঢাকা
মরণ মেঝেতে।
প্রায় অর্ধেক পথ পেরিয়ে আসার সাথে সাথে সাথেই ওদের কানে এলো চিৎকার
চ্যাঁচামেচির শব্দ। সুড়ঙ্গটার ভেতরে থেকে ।
প্রথম চপারটা – ইজ্রায়েলী ব্ল্যাক হক -
নিশ্চিত সেনা নামিয়ে দিয়েছে একেবারে জল প্রপাতের ওপরে । ওদের খুঁজতে হয়নি
সঠিক পথ ওপরে উঠে আসার ।
ওয়েস্ট ধরেই নিলো ওরা সায়ারেট মাতকাল কম্যান্ডো বাহিনী । ইজ্রায়েলের সবচেয়ে সেরা
“সায়ারেট” বা “রিকন্নেইস্যান্স” এলিট ইউনিট । মাতকাল রা মায়াদয়া হীন খুনী ক্র্যাক
আসাসিন ইউনিট । বিশ্বের সর্ব শ্রেষ্ঠ স্নাইপার টিম। যে দলের সদস্য ছিল স্ট্রেচ।
এবার ওদের দল এগিয়ে আসছে।
দ্রুত ।
ওয়েস্ট চেঁচিয়ে বললো, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগোতে থাকো! আমাদের পেছনে সব্বচেয়ে
খতরনাক বন্দুকবাজেরা ধেয়ে আসছে !’
চোরাবালির মেঝের ওপর দশ তলা উঁচু ছাদের উচ্চতায় ওয়েস্ট দ্বিগুন গতিতে এগিয়ে যাওয়া
শুরু করলো – ঠিক যেভাবে বাঁদরেরা এগিয়ে যায় , ঝপ ঝপ করে ।
এবার ওদের কানে ভেসে এলো সেই পাঁচ টন পাথর পড়ার শব্দ আর একবার ...সাথে সাথেই
চিৎকার এবং দ্রুত দৌড়ে আসার পদধ্বনি ।
ইজ্রায়েলী দের প্রবেশের সাথে সাথেই ফাঁদের দ্বিতীয় পাথরটা প্রান পেয়েছে।
ওয়েস্ট আপাতত সেদিকে মন না দিয়ে এগিয়ে চললো ঝুলতে ঝুলতে সামনের দিকে।
জাঈদ পৌঁছে গেল অপর প্রান্তের সুড়ঙ্গের মুখে । লাফিয়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে। কয়েক
সেকেন্ডের মধ্যেই ওয়েস্টের পা খুঁজে পেল শক্ত জমি । ঘুরে দাঁড়ালো দলের বাকি
সদস্যদের সাহায্য করার –
-একটা লাল লেজার রশ্মির বিন্দু দেখা গেল ওর নাকের ওপর ... অন্য প্রান্তের
স্নাইপার রাইফেল ওই লেজার বিন্দুর উৎস । এক ইজ্রায়েলি স্নাইপার কম্যান্ডোর রাইফেল
ওটা । বসেছে হাঁটু মুড়ে ।
ওয়েস্টের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে ভেসে এলো একটা কণ্ঠস্বর – ‘যেখানে আছো ওখানেই
দাঁড়িয়ে থাকো ক্যাপ্টেন ওয়েস্ট । একটুও নড়ার চেষ্টা কোরোনা ।’
ওয়েস্ট পাত্তা না দিয়ে নড়তে যেতেই
বিন্দুটা একটু সরে গেল ...
... এবার ওটা স্থির হলো লিলির মাথার ওপরে ।
‘ আমি জানি তুমি কি ভাবছো ক্যাপ্টেন । উহু ওটা করতে যেও না । তা হলে খামোখাই
বাচ্চাটা মারা যাবে। কোহেন! এই হাতলগুলোর পদ্ধতিটা কি
?’
ঠিক তখনি ওয়েস্টের পাশে এসে নামলো স্ট্রেচ । পুহ বিয়ার এখনো ঝুলে ঝুলে এগিয়ে
আসছে যথেষ্টই কষ্ট করে হাঁফাতে হাঁফাতে ।
স্ট্রেচ আড়চোখে ওয়েস্টের দিকে তাকিয়ে নিজের মাইকে বললো, ‘ প্রত্যেক তৃতীয় হাতল
বাদ দিতে হবে মেজর ।’
ইজ্রায়েলিরা দ্রুত বেরিয়ে এলো সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে । চেপে ধরলো হাতল , শুরু
করলো উঁচু ছাদের তলা দিয়ে ঝুলে ঝুলে এগোনো ।
দলটা ছয়জনের , সবাই হাতলে ঝুলে পড়ার প্রায় সাথে সাথেই আরেকটা পাঁচ টনের পাথর
আগের বারের মতোই আবির্ভূত হল সুড়ঙ্গের মুখে এবং আছড়ে পড়লো চোরাবালির মেঝেতে ।
দরকার পড়লেই লিলির দিকে রাইফেল তাক করতে পারে একহাতে, এরকম ছক বানিয়ে এক
অদ্ভুত পদ্ধতিতে একে অপরকে সাহায্য করে দলটা এগিয়ে আসছিল। ।
এক মিনিটের ভেতরে গুহার ছাদ পার হয়ে এসে ওরা ঘিরে ধরলো ওয়েস্টদের ছোট্ট দলটাকে।
ইজ্রায়েলি দল নেতা ওয়েস্টকে আগুন ঝড়া দৃষ্টিতে দেখছিলেন।
স্ট্রেচ পরিচয় করিয়ে দিলো । ‘ক্যাপ্টেন জ্যাক ওয়েস্ট জুনিয়র ... ইনি হলেন
সারায়েত মাতকালের মেজর ইতঝ্যাক মিয়ার ।
সংকেত নাম আ্যভেঞ্জার ।
লম্বা চওড়া চেহারার মানুষ অ্যাভেঞ্জার । সাথেই ইস্পাত শীতল সবুজ চোখ । এই
মানুষের একটাই নীতি সাদা সবসময় সাদা, কালো সব সময় কালো । আর ইজ্রায়েল সবার আগে।
‘ফেমাস ক্যাপ্টেন ওয়েস্ট।’ অ্যাভেঞ্জার এগিয়ে এলো সামনে , ওয়েস্টের হোলস্টার থেকে
তুলে নিলো পিস্তলটা। ‘ আমি এর আগে এতো বার ব্যর্থ হওয়া কোনো সৈন্য দেখিনি। এতবার ব্যর্থ তবু হাল
ছাড়েনি । সব কিছু ঝেড়ে মুছে আবার কিছু করতে না পারার জন্য তৈরী ।’
‘ যতক্ষন না সব কিছু মিটছে ততক্ষন শেষ বলে কিছু হয় না,’ ওয়েস্ট জবাব দিলো
।
অ্যাভেনহার স্ট্রেচের দিকে ঘুরলো । ‘ক্যাপ্টেন কোহেন কনগ্র্যাচুলেশন্স। এক
অভূতপূর্ব দীর্ঘ কালীন মিশনে তুমি দারুন কাজ করেছো। তোমার কাজ সবচেয়ে সেরা রুপে নথিভুক্ত করা
হয়েছে। আমি ক্ষমা চাইছি তোমাকে এই ভাবে চমকে দেওয়ার জন্য ।’
স্ট্রেচ কিছু না বলে সামান্য মাথা ঝোঁকালো ।
পুহ বিয়ার অবশ্য এই সুযোগটা ছাড়লো না।
স্ট্রেচের দিকে গন গনে চোখে তাকিয়ে বললো, ‘আমার পক্ষ থেকেও কন গ্র্যাচুলেশন
হতচ্ছাড়া ইজ্রায়েলী । তুমিই তার মানে নাটের গুরু । তুমিই ওদেরকে আমাদের কাছে আসার
পথ দেখিয়েছো । আমাদের খাটনী ব্যর্থ করে ওদের হাতে তুলে দিচ্ছো টুকরোটাকে । আশা করি
এসব করে তুমি সন্তুষ্ট হয়েছো, মনের সব সাধ মিটেছে।’
স্ট্রেচ তবুও কোনো কথা বললো না।
লিলি তাকালো স্ট্রেচের দিকে। ‘স্ট্রেচ? কেন করলে ...?’
স্ট্রেচ নরম গলায় বল লো, ‘লিলি, বিশ্বাস করো । আমি এসব কিছু-’
অ্যাভেঞ্জার মুচকি হেসে বললো, ‘আরে এসব আবার কি? “স্ট্রেচ”? কোহেন, তোমার আবার
নতুন নামকরন হয়েছে বুঝি? আরে বাহ, বেশ মিষ্টি নাম ।’
পুহ বিয়ারের দিকে ঘুরে তাকালো, ‘হ্যাঁ , আরব,
তুমি ঠিকই বলেছো । শেষ ক্যাপস্টোনের টুকরো হবে আমাদের । একটাই টুকরো যা
ইজ্রায়েলকে সুযোগ করে দেবে ইউনাইটেড স্টেটসকে ল্যাজে খেলানোর । যাইহোক , ক্যাপ্টেন
ওয়েস্ট, এবার দয়া করে দায়িত্বটা নাও । পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো টুকরোটার কাছে । এখন
তুমি কাজ করবে ইজ্রায়েলের জন্য ।’
একটা শব্দও উচ্চারন করার আগে একটা বিরাট মাপের বিষ্ফোরনের শব্দ ভেসে এলো বাইরে
থেকে ।
সকলে ঘুরে তাকালো।
ওয়েস্ট তাকালো পুহ বিয়ারের দিকে।
সকলেই পুনরায় কিছু একটা শোনার অপেক্ষায় রইলো ।
কিছুই হলো না।
নিস্তব্ধ ।
আর ঠিক তখনি ওয়েস্ট বুঝতে পারলো এই নিস্তব্ধতাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা
। বাইরের ক্রমাগত জল পড়ার শব্দটাও আর শুনতে পাচ্ছে না ।
ঝর ঝর করে জল পড়ার শব্দ থেমে গেছে ।
বুঝতে পারলো আসলে ঠিক কি ঘটেছে।
জুডা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বদলে দিয়েছে জলপ্রপাতের পথ – পুরো জলপ্রপাতটাকেই! প্রবেশপথের মুখটাকে খুলে দিয়েছে সেনাবাহিনীকে
প্রবেশ করানোর জন্য।
দারুনভাবে নিজের কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটালেও ওয়েস্টের পক্ষে সম্ভব নয় বাইরের
বর্তমান দৃশ্যটা ঠিক কেমন সেটা বুঝতে পারা ।
জলপ্রপাতটা সত্যিই ঘুরে গেছে অন্যদিকে । বিশেষজ্ঞদের ছক অনুসারে ওটার ওপরে থাকা নদীতে
ঘটানো হয়েছে ধারবাহিক বিস্ফোরণ । এই মুহূর্তে তিনতলা পাথরের পাহাড়টার কোথাও এক
ফোঁটা জল নেই । উন্মুক্ত হয়েছে ওর রহস্য বিশ্বের সামনে।
এর সাথেই এক বিশাল আকারের মিলিটারি বাহিনী জমায়েত হয়েছে শুকিয়ে যাওয়া জল প্রপাতের
ভিত্তিস্থলে ।
কয়েক পল্টন সেনাবাহিনী নড়াচড়া করছে তিনতলা খাড়া দেওয়ালের তলায় হঠাৎ করে শান্ত হয়ে যাওয়া জলের পুকুরটার চারপাশে । ওদের ঘিরে পাক মারছে ট্যাঙ্ক আর হামভিগুলো ।
আকাশ থেকে নজর রাখছে অ্যাপাচে আর সুপার স্ট্যালিয়ন চপার ।
আর এদেরকে নিয়ন্ত্রন করছে নিজের মোবাইল কম্যান্ড গাড়ী থেকে মার্শাল জুডা ।
প্রথম দলটাকে সরাসরি নামিয়ে দিয়েছে তৃতীয় তলায়, সুপার স্ট্যালিয়ন থেকে দড়ি
ঝুলিয়ে।
বন্দুক উঁচিয়ে সেই দল ঢুকে পড়লো ভেতরে।
চোরাবালির মেঝে যুক্ত গুহার শেষপ্রান্তে ওয়েস্ট আর তার নতুন দলবল দেখতে পেলো
আমেরিকানদের বন্দুকের লাল লেজারের আলো প্রবেশ সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে ঝলচে
উঠছে । শোনা যাচ্ছে পায়ের আওয়াজ।
জাইদ হিসহিসিয়ে বলে উঠলো , আমেরিকান শু** গুলো ...’
আর প্রায় সাথেই আবার শোনা গেল সেই একই রকম একটা শব্দ ...তৃতীয় পাঁচ টনি পাথর
পতনের !
ভেসে এলো বন্দুকের শব্দ । স্লাইডিং স্টোনটা লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে আমেরিকানরা
!
শোনা গেল চিৎকার ।
তারপরেই দৌড়ে আসার শব্দ – পাগলের মতো ছুটছে ওরা ।
সেকেন্ড কয়েকের ভেতরেই দেখা গেল ঘনক আকৃতির গুহার কার্নিশের কাছে এসে
দাঁড়িয়েছে প্রথম আমেরিকান সেনাটি।
উদভ্রান্তের মতো সেনাটি এদিকে ওদিকে ওপরে নিচে বাঁয়ে ডানে তাকালো – দেখতে পেলো
নিচের বালি ঢাকা মেঝে এবং প্রায় সাথে সাথেই ছাদ থেকে ঝুলে থাকা হাতলগুলোকে।
লাফ দিয়ে ধরলো প্রথমটাকে। ঝুলে এলো দ্বিতীয়টায়, এবং তারপর তৃতীয় –
- সাথে সাথেই ওটা খুলে চলে এলো ছাদ থেকে ...ফল একটাই... অসহায় কম্যান্ডোটি দশ
তলা উঁচু ছাদের গা থেকে পড়তে শুরু
করলো নিচে ।
যতক্ষন শূন্যে থাকলো চিৎকার একবারের জন্য থামেনি – থামলো , থপাক করে বালির ওপর পড়ার সাথে
সাথে – এবং আবার শুরু হল চ্যাঁচানি , এবারের সুর আলাদা।
এমন এক চিৎকার যার সাথে আর্ত কথাটা জুড়তে হয় । এ চিৎকার নির্গত হচ্ছে এমন এক
সময়ে যখন মানুষটা বুঝতে পারছে সে মারা যাবে...এ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা
তার নেই।
ওর দলের বাকি পাঁচ সদস্য কার্নিশের কাছে এসে পৌছালো এবং দেখতে পেলো হাঁচড়পাঁচড়
করে একগাদা বালি গিলে ডুবে যাচ্ছে মানুষটা । পাঁচজনই একইসাথে একবার দেখলো
হাতলগুলোকে...তারপর পেছনের পাথরটাকে এবং সব শেষে নিচের মরণ চোরাবালির মেঝেটাকে।
দুজন একে একে আবার ঝুলে পড়লো হাতল ধরে ।
এদের প্রথম জন ষষ্ঠ হাতলটা ধরতেই – ফল হলো
কিছু আগের সেনাটির মতোই । ওর পরেরজন কি হলো দেখতে গিয়ে হারাল ভারসাম্য এবং
সেও আছড়ে পড়লো নিচে ।
বাকি তিনজনকে শেষ করে দিলো অতিকায় পাথরের টুকরো ।
সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে ওটা ধেয়ে এলো ট্রেনের মতো এবং ওদেরকে সাথে নিয়ে – উড়ে চলে
গেল শূন্যে। তারপর একটা বৃত্তাকার পথে
ভেসে গিয়ে প্রায় একসাথেই গিয়ে আছড়ে পড়লো চোরাবালির নিথরতায় ।
এক সেনার ওপরেই পড়লো পাথরটা । বাকি দুজনকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা গেল হাত
উচিয়ে বাঁচার প্রানপণ চেষ্টা করছে । যদিও লাভ কিছুই হলো না ওদেরকেও গ্রাস করলো
বালির মেঝে।
ওয়েস্ট আর ওদের দল এই সব দেখলো পাথরের মূর্তির মতো।
ওয়েস্ট, আ্যভেঞ্জারকে বললো, ‘এ ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটবে না। জুডা এই দলটাকে
পাঠিয়েই ছিল মরার জন্য – অনভিজ্ঞ দল, কোনো সুত্র বা সতর্কতা না দিয়েই ওদের পাঠিয়ে
ছিল। শুধু মাত্র ফাঁদটা বোঝার জন্য । ও নিজে যখন এখানে ঢুকবে অত বোকামী করবে
না।’
ইজ্রায়েলী মেজর সম্মতির ভঙ্গীতে মাথা ঝুঁকিয়ে ঘুরে তাকালো নিজের দলের দুজনের
দিকে । ‘শ্যাম্বারগ। ইয়েল। আপাতত এখানটা সামলানোর দায়িত্ব তোমাদের । যতক্ষন সম্ভব
ওদের আটকে রাখবে তার পর চলে আসবে আমাদের কাছে।’
‘ ওকে স্যার!’
‘ঠিক আছে স্যার!’
অ্যাভেঞ্জার এবার ওয়েস্টের কাছ থেকে এক ঝটকায় পোশাকের কলার ধরে লিলিকে টেনে
নিলো নিজের দিকে। ‘ক্যাপ্টেন এবার নিজের
কাজ শুরু করো। আমাদের পথ দেখাও ।’
সুড়ঙ্গ পথে দশ পা এগোতে না এগোতেই ওদের কানে ভেসে এলো বন্দুক চালনার শব্দ ।
নিজেদের দিক থেকে ।
নিয়মিত বিরতিতে আসছে শব্দ।
আর আমেরিকান সেনা এসে গেছে চোরাবালির গুহায় – সম্ভবত পাথর পতনের ফাঁদ
নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে ওরা ।
দুই ইজ্রায়েলি ওদের বেশিক্ষন আটকে রাখতে পারবে না।
০০০০০
দৈত্যাকার সিঁড়ি পথ
ছোট্ট সুড়ঙ্গটা পার হয়ে ওয়েস্ট তার নতুন দলকে নিয়ে উপস্থিত হলো আর একটা ঘনক
আকৃতির কক্ষে – পঞ্চাশ ফুট উঁচু, চওড়া এবং লম্বা – এবারে সুড়ঙ্গ শেষ হয়েছে ছাদে
নয়, নিচে মেঝেতে ।
ওর সামনে এখন একটা পাথরের রাস্তা যা গিয়ে ছুঁয়েছে কক্ষটার বাম দিকের দেওয়ালকে।
ডান দিকটা পুরোটা এবং বাকি মেঝে একই রকম চোরাবালি দিয়ে ঢাকা ।
নিচু পাথুরে পথটা যেখানে গিয়েছে সেটা এক অত্যাশ্চর্য বস্তু ।
সাতটা বিশাল বিশাল বিশাল মাপের পাথরের ধাপ । যা উঠে গেছে ওপরের দিকে একটা
দরজার মুখে। দরজাটার অবস্থান কক্ষের ছাদের গায়ে । প্রতিটা ধাপ কম করে সাত ফুট করে
উঁচু । সব ধাপে নানান মাপের নানান আকৃতির গর্ত ও আসনের মতো জিনিষ । তাদের কোনোটা
দরজার মতো মাপের আবার কোনোটা বাস্কেট বলের সাইজের । বলাই বাহুল্য সব গুলোর ভেতরেই
অজ্ঞাত ফাঁদেরা অপেক্ষা করছে কাজ শুরু করার জন্য। ট্রিগারে চাপ পড়লেই ব্যাস !
বিশাল এই সিঁড়ির পাশে যে দেওয়াল, যাকে ছুঁয়ে আছে পথটা সেটার গায়েও বিভিন্ন
মাপের সব ফাঁদ গর্ত খোদাই করা আছে ।
সিঁড়ির ডানদিকটা কিন্তু একেবারে ফাঁকা ।
উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে । সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলে তোমার জন্য অপেক্ষা
করে আছে চোরাবালি ।
‘ এটাই সেই স্তরভেদ,’ জাইদ বলে উঠলো ।
‘কি?’ ওয়েস্ট জানতে চাইলো ।
‘ মনে করে দেখুন সেই কাজের অগ্রগতির খতিয়ান কাপড়ের টুকরোটাকে। সেই আঁকাটা যেটায়
উদ্যান নির্মানের বিষয়ে দেখানো ছিল। এই ধাপগুলো আসলে কোনও ধাপ নয় । এগুলো আসলে স্তর যা নিয়ে
যাবে এই গুহার প্রধান আর্চওয়েতে । তৃতীয় ইমহোটেপ এটাকে পরিবর্তিত করেছিলেন ওপরে
ওঠার সিঁড়ির ফাঁদে।
‘খুব ভালো কথা!’
জাইদ বললো, ‘আমার অনুমান সঠিক হলে, ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান ওই ছাদের গায়ে যে
দরজা দেখতে পাচ্ছি তার অপর দিকে অবস্থান করছে।’
অ্যাভেঞ্জার ওয়েস্টকে এক ঠেলা মারলো সামনের দিকে-লিলিকে একই ভাবে চেপে ধরে আছে
। ‘ক্যাপ্টেন ওয়েস্ট প্লিজ । সময় বয়ে যাচ্ছে । আমাদের পথ দেখাও ।’
০০০০০
ওয়েস্ট সেটাই করতে বাধ্য হলো । উঠতে থাকলো দৈত্যাকার সিঁড়ি বেয়ে।
প্রায় সবরকমের ফাঁদের সম্মুখীন হতে হল ওকে ।
ধেয়ে এলো বালির স্রোত ... ট্র্যাপ ডোর... ঝপ করে উঠে এলো তীক্ষ্ণ ধাতব শলাকা,
বেকায়দায় হাত পড়লেই ঢুকে যাবে হাতের ভেতরে ...পঞ্চম ধাপে তো গড়গড় করে দেওয়ালের
ভেতর থেকে গড়িয়ে এলো এক টন খানেক ওজনের পাথরের বল ।
কিন্তু নিজের দক্ষতা, গতি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার জোরে ওয়েস্ট
সবগুলো ফাঁদকেই কাটাতে সক্ষম হলো। একসময় পৌছেও গেলো ছাদের গায়ের দরজার মুখটায় ।
ওখানে একটা অন্ধকার প্ল্যাটফর্মের অপর দাঁড়িয়ে ওয়েস্ট বুঝতে পারছিল ওর সামনে বিরাট মাপের প্রশস্ত খোলা স্থান অপেক্ষা করছে ।
একটা আলোকদন্ড জ্বালালো । উঁচিয়ে ধরলো ওপরের দিকে । নিঃসীম অন্ধকারের ভেতর একা
জ্যাক ওয়েস্ট জুনিয়র এমন এক দৃশ্য দেখল যা গত ২৫০০ বছরের বেশী সময় ধরে কেউ দেখেনি।
[ক্রমশঃ]
১০ম অধ্যায় শেষ অংশ
No comments:
Post a Comment