ইচ্ছেপুরন
প্রতিম দাস
----------------
“মাম্পু, ওঠ ওঠ, স্কুল যেতে হবে না নাকি ? সাড়ে ছটা বেজে গেছে...... হে ভগবান এ মেয়ের যে কি হবে, Exam-এর আর কদিন বাকি, খেয়াল আছে ?” রোজ সকালে এই কথাগুলো মাম্পুর মায়ের মুখে শোনা যায়। এটা মিসেস চক্রবর্তীর দুঃখের বহিঃপ্রকাশ। সারাদিনে কথাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকবারই শোনা যায়। চলতি সময়ের ইঁদুর দৌড়ে নিজের মেয়েকে চৌখোস করতে যা যা করার প্রয়োজন সব চেষ্টাই করে চলেছেন--- আঁকা, নাচ, গান, সাঁতার এবং অবশ্যই লেখাপড়া। কিন্তু মাম্পুর কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই, একমাত্র কার্টুন চ্যানেলগুলো ছাড়া। ওয়ান-টুতে পড়ার সময় তবু একটু মনোযোগ ছিল, এখন তার ১০% ও নেই। করতে হয় তাই করে। আঁকার স্যার, গানের দিদিমণি, পড়ার মিসের সাথে সাথে স্কুল থেকেও ইদানিং গার্জেন কল আসছে প্রায় প্রতি সপ্তাহে। একটাই কথা,বড্ড অমনোযোগি। আঁকার স্যার তো গত সপ্তাহে বলেই দিলেন—“ বৌদি মাম্পুর আঁকাটা বন্ধ করে দিন, অন্য কিছু হয়তো হতে পারে, আঁকানো জোর করে সম্ভব না।“ এ নিয়ে মাম্পুর বাবাকে কিছু বলতে গেলেই উনি বলেন “ওটা তোমার দপ্তর, সারাদিনের খাটুনির পর ও নিয়ে মাথা ঘামাতে পারব না। টাকাকড়ি যা লাগে দিয়ে দেব, বাকি দায়িত্ব তোমার।“
এমতাবস্থায় একদিন ফোন এল মিঃ অরিজিত সান্যালের, মিসেস চক্রবর্তীর ভাই। থাকেন জাপানে, রোবোটিক সাইন্সের পৃথিবী-সেরাদের অন্যতম। আর তার জন্যই বিশেষ সম্মান দিয়ে জাপানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওনাকে, জাপান গভমেন্টের বিশেষ প্রকল্পে, তা প্রায় বছর ছয়েক হয়ে গেলো। নমাসে ছমাসে দেশে আসেন মানুষটা। ফোনে অবশ্য মাঝে মাঝে কথা হয়।
দুচারটে মামুলি কথাবার্তার পর অরিজিত বাবু জানতে চাইলেন, “ আমার ভাগ্নির খবর কি ? পড়াশোনা ঠিকঠাক করছে তো ?”
এতোদিন সংকোচবশে মাম্পুর কথা কিছু বলেননি ভাইকে মিসেস চক্রবর্তী। আজ আর সামলাতে পারলেন না, বলেই ফেললেন, “খুব চিন্তায় আছি রে অরু, কি যে হবে”
--- “কেন রে, কি আবার হোলো ?”
“টিভি দেখা ছাড়া আর কিছুই তো মন দিয়ে করছে না। অরু তুই তো বড় বিজ্ঞানী, একটা কিছু করতে পারিস না মাম্পুটার, এমন কোনো ওষুধ-টোষুধ আবিষ্কার হয়নি যাতে একটু মনোযোগী হয় মেয়েটা ?” “দিদি অযথাই তুই চিন্তা করছিস, বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।“
“তুই তো বলেই খালাস, আমার জ্বালা তুই কি বুঝবি। “ কথার মোড় অন্যদিকে যাচ্ছে দেখে অরিজিত বাবু “দেখছি কি করা যায়” বলে ফোনটা কেটে দিলেন।
এর দিন সাতেক পর একটা মেসেজ এলো মিসেস চক্রবর্তীর ফোনে--- দিদি সামনের সপ্তাহে আমি ভারতে আসছি। তোর কাছেই যাব সবার আগে.........
একটি সুটকেস আর ল্যাপটপ সমেত
অরিজিত বাবু নামলেন ট্যাক্সি থেকে , মাম্পুদের বাড়ির সামনে। গতকাল রাতে নেতাজি
সুভাষ চন্দ্র বসু এয়ারপোর্ট এ নামার পর
হোটেলে রাত্রি যাপন করে সকালের ট্রেনে চলে এসেছেন ৭০ কিমি. দূরের দিদির বাড়িতে। ট্রেন
থেকে নেমেই ফোন করে দিয়েছিলেন, ফলে ডোরবেল বাজতেই মাম্পু ছুটল। মামা এলেই একটা না
একটা নতুন খেলনা প্রাপ্তি হবে এটা ও জানে। এমন সব খেলনা যা বন্ধুদের নেই। ফলে ওর
আগ্রহ একটু বেশি।
দুদিন পর...।
মাম্পুর বিষয়ে যাবতীয় অভিযোগ ও
চিন্তার কথাবার্তা সবই বলা সারা মিসেস চক্রবতীর। কাকুতিমিনতি করেছেন ভাই এর কাছে
কিছু একটা করার জন্য। অরিজিত বাবু হ্যাঁ বা না কিছুই বলেন নি।
ঘটমান দিনের সকাল বেলায় উনি
মাম্পুকে বললেন – চল আজ কলকাতা বেরিয়ে আসি। কিরে দিদি তোর আপত্তি নেই তো ? নিয়ে
যাবো ?
-কি আর বলব, একে মা মনসা তায়
ধুপের গন্ধ। আমি বারন করলে যেন শুনবে !!
একদিন পর...
সেই হোটেল এবং সেই ঘর যেখানে
অরিজিত বাবু ছিলেন তিন দিন আগে।
ল্যাপটপ এ কাজ করতে করতে
মাম্পুকে প্রশ্ন করলেন অরিজিত বাবু – আমার
সাথে জাপান যাবি মাম্পু?
বিন্দুমাত্র সময় চিন্তা না করে
মাম্পু বলল – যাবো, নিয়ে যাবে মামু, সত্যি?
-এক বছরের জন্য কিন্তু? মা বাবা
বন্ধু কারো সাথে দেখা হবে না। কথাও বলতে পারবি না, এমনকি ফোন করাও যাবে না।
কিছুদিন বাদেই এক্সাম এটা ভেবে
নিয়ে এবারেও বেশি সময় নিলনা মাম্পু সম্মতি জানাতে।
-ইঞ্জেকশান নিতে ভয় পাস?
-না তো। কেন মামু?
-বিদেশে যেতে হলে মেডিকেল টেস্ট
দিতে হয় তাই...
-তাই বুঝি?
- হুম । শোন তুই ওই বিছানায়
শুয়ে পর, আমি টেস্টটা করে নি তাহলে...
মাম্পু শুয়ে পড়লো বিনা বাক্য
ব্যয় করে ।ঘরের এক কোনে রাখা বড় বাক্সটা খুলে যে সিরিঞ্জটা বার করলেন অরিজিত বাবু
সেটা আমাদের চেনাজানা সিরিঞ্জের মতো নয়। আকারে বেশ বড়। দেখতেও অদ্ভুত।
ইঞ্জেকশান দেওয়ার মিনিট কয়েকের
মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল মাম্পু। এবার বড় বাক্সটা থেকে আর একটা বাক্স বার করলেন
অরিজিত বাবু। ডাটা কেবল দিয়ে ওটাকে সংযুক্ত করলেন ল্যাপটপ এর সাথে। আর ভ্যাকুয়াম
নোড লাগান বেশ কিছু কেবল লাগালেন মাম্পুর
শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। সবগুলোই আবার জোড়া হল ওই বিশেষ বাক্সে।
ঘরের কোনের বড় বাক্সটা থেকে এবার
বার করলেন আর একটি বাক্স। ঢাকনা খুলে বার
করে আনলেন বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। ও দিকে ল্যাপটপের স্ক্রীন এ ফুটে উঠেছে একটি
মানবদেহর আকৃতি। আশেপাশে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বাইনারি সংখ্যাদের হিসাবনিকাশের
নাচানাচি।
ঘণ্টা দুয়েকবাদে...
কাজ শেষ... ল্যাপটপ অফ করে সব
যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিলেন অরিজিত বাবু। এই সময় কেও এই ঘরে ঢুকলে অবাক হয়ে যেত নিশ্চিতভাবে...
পরের দিন...
-মাম্পু চল এবার বাড়ী ফেরা যাক
!
-সে কি তুমি যে বলেছিলে জাপান
নিয়ে যাবে!
-যাবোই তো। তার আগে তোর মা
বাবার সাথে কথা বলতে হবে না ... ভিসা পাসপোর্ট সব করতে হবে তো নাকি?
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছ মামু। ওদের
তো বলতে হবেই ...
মনের মতো উত্তর পেয়ে চোখ দুটো
চকচক করে উঠলো অরিজিত বাবুর।
পরের ট্রেন ধরেই মাম্পুরা বাড়ি
ফিরল। অরিজিত বাবু আর্জেন্ট কাজ এর নির্দেশ এসেছে জানিয়ে পরের ট্রেনেই কলকাতা চলে
গেলেন। সোজা হোটেলে।
দিন সাতেক পর জাপানগামী বিমানে
উঠতে দেখা গেল মিঃ অরিজিত সান্যাল কে,
সাথে একটি ছোট্ট মেয়ে।
.......
ইউনিট টেস্ট এ রেজাল্ট খারাপ করলেও হাফ ইয়ারলি
এক্সাম এ সবাইকে চমকে দিয়ে মাম্পু ২য় হল। একই সাথে আঁকা গান নাচ সব কিছুতেই
অভাবনীয় উৎসাহ দেখা গেল।
এরকম পরিস্থিতিতে একদিন ফোন এলো
অরিজিত বাবুর ... কি রে দিদি কেমন আছিস ? মাম্পুর খবর কি?
উচ্ছাসে ফেটে পড়লেন মাম্পুর মা –
অরু কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তুই কি তুক তাক করলিরে ভাই!! আমার মাম্পু আর সে মাম্পু নেই... কি বাধ্য হয়ে গেছে কি
বলবো...
- তাহলে তো তোর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে কি বলিস?
- হয়েছে মানে ...একশয় দু’শ ভাগ ... সব তোর কৃতিত্ব ...
- শোন তোকে একটা কাজ করতে হবে।
- -কি কাজ?
- মাম্পু মাসে মাসে যা নাচ গান আঁকা ইত্যাদি শিখছে তার ভিডিও
করে আমাকে পাঠাতে হবে। রেকর্ড করে মেল করে দিবি।
- কেন রে, কী জন্যে ?
- কী জন্যে আবার, ভাগ্ণীটার উন্নতি দেখার ইচ্ছে হতে পারে না
নাকি আমার?
......।
এভাবেই
কেটে গেল এক বছরের কিছু বেশি সময়। মাম্পু এই মুহূর্তে একটি নামি স্কুলে অ্যাডমিশন পেয়েছে
নিজের যোগ্যতায়। আজ ওদের ছুটি। সময় কাটাতে ছবি আঁকছিল ও। কার্টুন আর আগের মত অত
দেখে না। ডোরবেল বাজলো। মিসেস চক্রবর্তী
নিজেই গেলেন দরজা খুলতে...
খুলেই চমকে গেলেন ...
-অরু তুই খবর না দিয়ে... ও ওটা কে!!!
-মা আমাকে চিনতে পারছ না... এ কি গো ... একবছরে আমাকে ভুলে
গেলে!!!
- এ কে ... আ... আ...আমি তো কিছুই ... কথা আটকে গেল মিসেস চক্রবর্তীর।
-ভেতরে ঢুকতে দিবিতো নাকিরে বাবা?
যন্ত্রের মত পিছিয়ে গেলেন মাম্পুর মা ...
দু ঘণ্টা পর ...
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে গল্পে মত্ত দুই মাম্পু। একজন আসল আর
একজন অরিজিত বাবুর তৈরি হিউম্যানয়েড। উনি সফল এত দিনের গবেষণায়। হাতেকলমে
এক্সপেরিমেন্ট এর এমন সুযোগ আসবে ভাবতে পারেননি। দিদির সমস্যা্টা শুনেই সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলেন।নিজের দেশ ছেড়ে জাপানে গিয়ে এতবছর থাকাটা উসুল হল এতদিনে।
হোটেলের ঘরে বড় বাক্সে নিয়ে এসেছিলেন হিউম্যানয়েড এর টুকরো
গুলো। সেগুলো জোড়া দিয়ে নিজস্ব উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে আসল মাম্পুর ব্রেইন এর ভার্চুয়াল ম্যাপিং প্রতিস্থাপন করেন হিউম্যানয়েড
মাম্পুর মাথায়। শারিরীক আকৃতি এবং অন্যান্য সব কিছুর কপি বানান হয় থ্রিডি
প্রিন্টারএ । বায়ো জেনেটিক্যাল ল্যাটেক্স এর প্রলেপ স্নান এর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা
সৃষ্টি করেনি। খাওয়া এবং প্রাত্যহিক কাজকর্মর জন্য কিছু প্রোগ্রাম সেট করে
দিয়েছিলেন মিঃ সান্যাল। যাতে হিউম্যানয়েড মাম্পুকে কেও সন্দেহ না করে। আর বিশেষ
কিছু প্রোগ্রাম এর ফলে ওর সবকিছুর রেজাল্ট অত ভাল হয়েছে ... পরমাণু শক্তিতে চালিত
ব্যাটারির কারনে দরকার হয়নি চার্জ এর, এখনও এক বছর হেসে খেলে চলে যাবে।
সব কথা শুনে কপাল চাপড়ে মাম্পুর মা বললেন - এ তুই কি করলি
অরু ? আসল মাম্পু তো কিছুই জানে না। আমাকে কি সারাজীবন ওই নকল মাম্পুকেই মানুষের
সামনে দেখাতে হবে?
- প্র্যাক্টিক্যালি সেটা তুই করতেও পারবি
না।
- ক.. কেন?
- ওর তো বয়েস বাড়বেনা, শারীরিক বদল ও হবে
না।
- তাহলে কি হবে???
- চিন্তা করিস না দিদি।এই একটা বছরে তোর
আসল মাম্পু অনেক্তাই বদলে গেছে। প্রথম প্রথম যা ইছে করার সুযোগ পেয়ে ওর ভালই
লাগতো। কিন্তু মাস দেড়েক পরেই একঘেয়েমি আসে। বায়না ধরে আমায় ফিরিয়ে দিয়ে এসো। তখন
ওকে সব বুঝিয়ে বলি। সহজ ভাবে যতটা বলা যায়। মনে করিয়ে দিই দেশে এক বছরের আগে
কোনোভাবেই ফেরা যাবেনার শর্ত।একই সাথে একটা মিথ্যেও বলি ওকে , ঠিক ঠাক পড়াশোনা ও
অন্যান্য কাজ করলে তবেই দেশে ফেরা যাবে , না হলে সারা্জীবন এখানেই থেকে যেতে হবে।
- বুঝলাম। কিন্ত এই মাম্পু যা যা জানে
সেগুলো আসলজন কি করে জানবে?
- আরে এই জন্যই তো মাসে মাসে তোকে ভিডিও
গুলো পাঠাতে বলেছিলাম । আমার আসল ভাগ্নি সব শিখে নিয়েছে।
- অরু ওই মাম্পু্টার কি হবে এখন?
- কি আর হবে , ওর এখানের কাজ শেষ। ওকে
এবার শাটডাউন করে দেব।
কথাটা শুনে কিছুটা সময় পাথরের মত বসে থাকলেন মিসেস চক্রবর্তী। চোখের কোন দুটো
চিকচিক করে উঠলো । অনুভুতিটা দুঃখের না আনন্দের ঠিক বুঝতে পারছিলেন না উনি ...
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment