ভূতের গল্প
প্রতিম দাস
গতকাল রাতে একটা ঠিক ঠাক ভুতের গল্প লেখার জন্য ডায়েরী
খুলে বসে আছি। মাথার মধ্যে অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছিলো কিন্তু কি লিখবো বা কোথা
থেকে শুরু করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আসলে যেটাই লিখতে যাই কোন না কোন গল্পের
প্লটের সাথে মিল আছে বলে মনে হচ্ছিল। এদিকে
এক খ্যাতনামা পাবলিশিং হাউসের জনপ্রিয় ম্যাগাজিনের অশরীরী সংখ্যাটি বের হতে চলেছে তাতে আমার মতো নিতান্তই অখ্যাত
লেখককে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে কিছু লেখার জন্য।
কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আজ বিকেলে ভালোই বৃষ্টি
হয়েছে । ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া জানলা দিয়ে মাঝে মাঝেই বয়ে আসছিল । ডায়েরীর ওপর
পেনটা রেখে দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছি সহসাই প্রায় শীতকালের মতো কেঁপে উঠলাম ।
শীতল হাওয়া এসে ধাক্কা মারলো আমায়। এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসলাম।
আধা যান্ত্রিক আধা ফিসফিস একটা কণ্ঠস্বর যেন আমার মাথার
মধ্যে বললো, ‘ভুত সম্বন্ধে জানেন কতটা যে ভুতের গল্প লিখতে বসেছেন? করেনতো অনুবাদ
আর নিজে লেখেন কিছু সাইফাই গল্প। তাও তো ওগুলো সায়েন্স ফিকশন না ফ্যান্টাসী লেখেন
সে নিয়েই সন্দেহে ভোগেন ?’
বিশ্বাস করুন ঘাড়ের রোম খাড়া হওয়া শব্দটা শুনেছি অনেক
বার। লিখেওছি নিজের লেখায়। এই প্রথম বুঝতে পারলাম সেটা কি বস্তু।
আবার সেই শব্দ শোনা গেল, ‘এতো চিন্তার কিছু নেই। যা
ভাবছেন তাই। আমি ভুত। আপনার উদ্দেশ্যটা ভালো লাগলো তাই মনে হলো আপনাকে একটু
সাহায্য করা যেতেই পারে।’
কথা বললাম নাকি মনে মনে তা বলতে পারবো না তবে যা বললাম
তা হ লো – সাহায্য মানে?
‘এই আমাদের জগত নিয়ে দু চার কথা শোনাতে পারি। যদি আপনি
চান। সেগুলো গুছিয়ে লিখলে ভালোই একটা লেখা খাড়া হবে বলতে পারি। সাথে সাথেই ভুতের
গল্পতে কি থাকা দরকার না দরকার সেটাও বুঝে যাবেন।’
এর পরের অনেকটা সময় আমার মাথার মধ্যে সেই কন্ঠস্বর
ধ্বনিত হলো, আর আমার ডায়েরীর পাতা ভরে গেল লেখায়। সেটাই পেশ করছি[অবশ্য
তেঁনার কথানুসারে], দেখুন কেমন লাগে ......
“অন্ধকারে ঢাকা যে সমস্ত স্থান সেখানে কি রহস্য লুকিয়ে আছে সে
বিষয়ে জীবিত মানুষ খুব কমই জানে । না জেনেই
ভয় পায় বেশির ভাগ সময়ে। প্রায় সকলেই মনে করে ভূত বিষয়ে
তার সম্যক ধারণা আছে। সোজসুজি ভাবে সবাই এটাই ভাবে মরে যাওয়ার পর ভুতের জন্ম হয়। মরে যাওয়ার পর নশ্বর
দেহ ছেড়ে আত্মা নামধারী একটা কিছুর কল্পনা করে নিতে বেশ ভালই লাগে। এটা ভেবে
অনেক মানূশি খুশি হোন যে যাক মরে গেলেই সব শেষ নয় । মরার পরেও একটা জগত আছে যেখানে
আমাদের চেনা পরিচিতরা থাকেন। মৃত্যুর পরবর্তী বিশাল অজানা জগতটাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় সেই
জগতটার দ্বারা । যার সবটাই নাকি কল্পনা এটাই বলে থাকেন অনেক বিশেষজ্ঞ । কল্পনা
হোক বা যাই হোক , কি ভাবে এ কল্পনা মানুষ করেছিল তা বলতে পারবো না তবে ওটা কিন্তু
সত্যি। মানুষ মারা যায় । তারপরে
যায় প্রেতলোকে । কিন্তু সেখানে গিয়েও মানব
জীবনের পাওয়া না-পাওয়াগুলো ভুলতে পারে না।
অসমাপ্ত নানান কাজ, তার ওপর হওয়া অত্যাচার, অপূর্ণ প্রেম
ইত্যাদি ইত্যাদির ভাবনা তার সাথেই থেকে যায়। কি ভাবে থাকে তাও বলতে পারবো না । ওই
জগতে অনেক বিজ্ঞানী গবেষক থাকলেও তাদের সুযোগ নেই এ সবের উত্তর বার করার। অবশ্য গবেষনার
সুযোগ পেয়েও তো নশ্বর মানুষেরা কিছুই করতে পারছে না।
যাই হোক ভুত আছে বলে মানুষেরা এক ধরনের স্বস্তি পেলেও
আমি নিজে ভুত হয়েই স্বীকার করছি এই ভুত ব্যাপারটায় আতঙ্কজনক একটা ব্যাপার। মানুষতো
ছিলাম এককালে ফলে জানি ও ব্যাপারটা ঠিক কি। ভুত আছে বা ভুতে তাড়া করছে এটা অনুভব
হলে সব স্নায়ূ টান টান হয়ে যায়, শরীরে বয়ে যায় শীতল জল স্রোত। হাত পা কেমন যেন অবশ
হয়ে আসে। হাঁটু কাঁপে।
অদ্ভুত মানুষের মানসিকতা বুঝলেন। একদিকে তারা খুশী হয় যে
মরার পর চেনা পরিচিতরা একটা থাকার জায়গা পাচ্ছে , আবার সাথে সাথে তাদের সঙ্গে পুনরায়
দেখা হলে ঠকঠকিয়ে কাঁপতেও ছাড়ে না। এটার
উত্তর সবার আগে খুঁজে বার করা দরকার, বুঝলেন কিনা?
আসলে সেই কোন
আদিম যুগ থেকে এর শুরু। ভয় নামের একটা শব্দ । মৃত্যু ব্যাপারটাই এক রহস্যে মোড়া ।
যে কারনে এর পরবর্তী জগতটা এক বিভীষিকা।
যেহেতু আমাদের জগতের পুরোটাই মানুষের এখনও অজানা তাই বোধহয় এই ভয়ের সুত্রপাত। আর যাই হোক রুপ রস
গন্ধ স্পর্শের এই পার্থিব জগত্টাকে আর উপভোগ করা যাবে না, সব শেষ হয়ে যাবে -
হয়তো ওই অশরীরী জগত বার বার এটা মনে করিয়ে দেয় বলেই এর
কথা, এদের অধিবাসীদের কথা ভাবলে মানুষ ভয় পায় । অন্তত আমি তো তাই পেতাম।
আর এটাকেই কাজে লাগিয়েছেন নশ্বর জগতের কিছু মানুষ ।
আদিম কালে এর ব্যবহার হয়েছে অন্যান্য মানুষের ওপর প্রভুত্ব করার জন্য । এখনো
আপনাদের পৃথিবীর কোথাও কোথাও এ হয়েই চলেছে। আর এক বিশেষ প্রজাতির মানুষ একে কাজে
লাগিয়েছেন নিজেদের জীবিকা নির্বাহের কাজে। সেই প্রজাতির নাম লেখক ।
আধা বাস্তব [জানি না সে সব কি করে জানতে পেরেছিলেন, অতীত
দিনের উর্বর মস্তিষ্কের লেখকেরা] আর আধা কল্পনা দিয়ে গড়ে তুলেছেন আমাদের জগতটাকে ।
মৃত্যু পরবর্তী জগতটার নানান বিবরণ তারা দিয়েছেন কল্পনার আশ্রয় নিয়ে।
সেই জগতের বা
তার অধিবাসীদের মুখোমুখী হলে কি অভিজ্ঞতা মানুষের
হতে পারে তার দৃশ্যকল্প রচনা
করেছেন।
আপনিতো ভূতের গল্প লিখতে
চাইছেন? তো চলুন এক আদর্শ ভুতের
গল্প রচনা আগে জেনে নিই কি কি করা যেতে পারে ভুতের গল্পের ভেতরে। আসলে এটা এক খেলার মতো । ভীতু ভীতু বা অতি সাহসী
মানুষকে এক কল্পিত “ভয়” জগতে ছেড়ে দিয়ে সেই চরিত্রের বিধাতা হয়ে বসা।
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই
গল্পের মূল চরিত্র ঠিকঠাক ভাবে জানেই না কাকে ভুত বলে, কাকে বলে ভ্যাম্পায়ার বা
ওয়ার উলফ ই বা কি বস্তু। ওইসবের অস্তিত্ব আসলে আছে না
নেই অনিশ্চিত?
আসলে লেখকেরাই ঠিকঠাক জানেন না তো ওরা কি
করে জানবে । কিন্তু আছে , তার প্রমান আমি ।
কিছু কিছু মানুষ খোলা মনে সাহস দেখিয়ে তাদের মুখোমুখী
হতেও চায় । আর সেখানেই সমস্যাটা বাঁধে।”
অশরীরী এখানে একটু চুপ করে গিয়েছিল । জানতে চেয়েছিলাম কি
হলো।
“না মানে সেটা বলাটা উচিত হবে কিনা তাই ভাবছি। সব জগতেরই
তো কিছু রীতিনীতি থাকে। সব বলা নিষিদ্ধ । জীবিত আর মৃত । ম্যাটার আর অ্যান্টি
ম্যাটার । ন্যাচারাল আর সুপার-ন্যাচারাল
। তা সেই সুপার-ন্যাচারালের খবরা খবর তো
অত সহজে উন্মোচন করা যায় না । সহ্য করতেও পারবে না নশ্বর মানুষ ।
তা সে যতই ষ্টীল নার্ভের অধিকারী হোক না কেন। সে পাগল হয়ে যায় । আর সেটাকেই
ভুতে ধরা বলে। ন্যাচারাল মানুষের বিজ্ঞান বলে ম্যাটার অ্যান্টিম্যাটার একসাথে হলে
ধ্বংস তার পরিণাম । কিন্তু সুপার
ন্যাচারাল জগতের বাসিন্দা হয়ে আমি আপনাকে বলছি এক গোপন রহস্য। জীবিতের সংস্পর্শে
মৃতের আত্মা এলেও তা ধ্বংস হয় না । বরং দুজনের মূল বৈশিষ্ট লোপ পায় । জীবিত
ব্যক্তি মৃতের অনুকরন করে। আর সেই আত্মা আটকে থেকে যায় জীবিতের শরীরে।”
মনে হয় আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল এটা শুনে।
“ আরে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আপনাকে ছোঁব না। আমার একটুও
সাধ নেই আপনার শরীরে বন্দী হয়ে থাকার।
দেখুন এক সময় ভুতের গল্প ব্যবহার হয়েছে শিশুতোষের জন্য। তারপর তা সাবালক
মানুষের মনোজগতকে আশ্রয় করেছে । কল্পনা করে লিখতে লিখতে লেখকেরা অনেক সত্যিই
প্রকাশ করে ফেলেছেন আমাদের জগত সম্বন্ধে। আগামি দিনে হয়তো এভাবেই তারা খুঁজে পেয়ে
যাবেন দুই জগতে যাতায়াত করার চাবি । একজন তো পেরেও ছিলেন। ওই যে আপনি যার গল্প অনুবাদ
করছেন। স্বপ্ন জগতে বিচরণকারী এক লেখক এইচ পি লাভক্রফট । তিনি তো লিখেই গেছেন সে
বইয়ের কথা। ”
নেক্রোনমিকন?
“হুম! যাকগে আজ অনেক কথা হলো। আপনার লেখা জমা দিতে তো
এখনো দিন পনেরো সময় আছে, তাই না? আমি খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবো আরো কিছু তথ্য আমাদের
জগত নিয়ে বলার জন্য। আসি তাহলে।”
যন্ত্রের মতো মাথা নাড়লাম । সাথে সাথেই শুনতে পেলাম আর
একবার সেই কণ্ঠস্বর, “আপনি একটা কাজ করতে পারেন। ফেসবুকে আজকে যা যা বললাম সেটা
পোস্ট করে দেখুন। মানুষ কি বলে। তারপর নাহয় বুঝে শুনে সাজিয়ে নেবেন লেখাটাকে। ”
অপেক্ষায় আছি অশরীরীর পুনঃ আগমনের । ইত্যবসরে আপনারা
জানান আপনাদের মতামত।
সমাপ্ত
পুনঃ তেঁনার কাছ থেকে আর কিছু জানতে পারলেই আপনাদের
জানাবো। কথা দিলাম।
No comments:
Post a Comment